আমি তখন যুদ্ধক্ষেত্রে উঠে
দাঁড়িয়েছিলাম। পায়ের একদিক থেকে রক্ত ঝরে যাচ্ছে তখনো, তবে বেশ কমে এসেছে। বাঁধন দিয়েই
আটকেছিলাম। চারপাশে শুধু মানুষের স্তুপ। তার মধ্যেই আমার মত কয়েকজন ছটফট করছে।
কারোর হাত, কারোর পা, কারোর মাথা
চোট পেয়েছে। আর বাকি যারা পড়ে আছে, উঠছেনা, তারা সব মৃত মানুষ। মাঠটার চারপাশে কিছু গাছ ছিল। গাছগুলোতে এখন পাখির
দল কিচমিচ করছে। মানে সন্ধ্যা হয়ে এল। এছাড়া সন্ধ্যা বোঝার উপায় এখনো নেই। আকাশটা
লালচে হয়ে আছে। কনে দেখা আলো না কী বলে যেন! বেশ কিছু লোক হাতে গড়া মাচা নিয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। তারা বেছে বেছে লোক তুলবে, সেটাই তাদের কাজ।
তারাও সৈনিক সব। কিন্তু দিনের যুদ্ধ শেষে এ কাজ তাদের করতে হয়। দু-পক্ষই নিজেদের
লোক তুলে নিয়ে যায়। মৃতদের কেউ তোলেনা। এক সময়ে সব দেহগুলোকে একপাশে স্তুপ করে
রাখা হবে। তারপরে সস্তার দাহ্য পদার্থ দিয়ে তাদের ভেজানো হবে। পুরোহিত আসবে,
মন্ত্র পড়বে। শেষে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। এমনই চুক্তি
দু-পক্ষে আছে।
বলা হয়নি একটা কথা। আজকের যুদ্ধে আমি
জীবিত শুধু না, আমি বিজয়ী
পক্ষের লোক। আমাকে কেউ হত্যা করতে পারেনি। আমার সৌভাগ্য না তাদের দুর্ভাগ্য কে
জানে? আঘাত শরীরে যা আছে তা নিয়ে আমার খুব একটা ভাবনা
নেই। কিছুদিন যত্ন পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আশাকরি যত্ন পাওয়ার সময় চলে যাবে না।
এর মধ্যে আমি আর কোনো যুদ্ধে যাব না ঠিক করেই নিয়েছি। এই পাহাড়ি অঞ্চলে এসেছিলাম,
অনেকদিনের লোভ ছিল বলে। আসলে এদিকে এমনিতে আসা হয় না। যখন শুনলাম
এখানে যুদ্ধ হবে তখন সমতল থেকে রওনা দিলাম। ঘোড়া আমার ছিল। কিন্তু এখানে ঘোড়া নিয়ে
লাভ নেই। এই যে মাঠটার কথা বলছি এই মাঠতাও কিন্তু সমতল নয় আসলে। একটা সমতলের মতন
জায়গা। চারপাশ থেকে পাহাড় নেমে এসেছে। পাহাড়ি একটা নদী আছে, সেটা বইতে বইতে এখানে এসেছে। এসে হঠাৎ করে একটু জায়গা পেয়ে চওড়া হয়েছে
বটে। কিন্তু তবুও তার পরেও অনেকটা জায়গা পড়ে আছে এখানে। যুদ্ধের জন্যে যথেষ্ট।
বিশেষ করে যদি আমাদের দুটি বাহিনীর যোদ্ধা সংখ্যা দেখা হয় তাহলে তো আর কোনো কথাই
নেই। সব মিলিয়ে চারহাজার হবে কিনা সন্দেহ। কাজেই এই জায়গাটা যথেষ্ট ধরে যাওয়ার
জন্যে। তাছাড়া দুপক্ষ মিলে জায়গা বেছে যুদ্ধ করবে এমনো তো হয়না তাই না?
আমি যুদ্ধ করতে এসেছি অন্য দেশ থেকে।
যুদ্ধই আমার পেশা। আগে একসময় চাষ করতাম। বাবার সঙ্গে। সে অনেক ছোট বেলায়। নিজেদের
জমিতেই করতাম। কিন্তু খরায়, বন্যায় ফসল কম হলেই রাজার লোক আসত জোর করে খাজনা নিতে। অতিষ্ট হয়ে
গেছিলাম আমরা। একদিন পালিয়ে গেলাম। সেবার খুব দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। পথে যেতে যেতে
দেখছিলাম অনেক মানুষ মরে পড়ে আছে বা মরতে বসেছে। সপরিবারে আমরা যাচ্ছিলাম। আমার
ছোট বোন, আমি আর আমার বাবা। মা অনেক দিন আগেই মারা
গ্যাছে। বাবার কাঁধে চড়ে আগে বোন যাতায়াত করত। মানে যখন ছোট ছিল। মেলা থেকে
সর্বত্র। আর না হলে আমার হাত ধরে থাকত। এখন সেও কিছুটা বড় হয়ে গ্যাছে বলে আর তাকে
কাঁধে নিতে হয়না। নিজের পায়েই হেঁটে যাচ্ছিল। আমাদের সঙ্গে আরো দুজন ছিল গ্রামের।
তাদের পরিবার আগেই চলে গেছে পাশের দেশে। তারা এবারে যাচ্ছে। একসঙ্গে সকলে গেলে
অনেক সময় খবর হয়ে যায়। আর তাহলেই রাজার লোকেরা রাস্তাতেই ধরে নেবে। তার পরে যা হবে
তা আর কহতব্য নয়। আমাদেরটা ব্যাতিক্রম। আমি আর বোন দুজনেই ছোট বলে কেউই আগে যেতে
পারব না। তাই একসঙ্গে চললাম সবাই। আমাদের রাত হয়ে গেছিল তখন। একটা গাছের নীচে সবাই
বসেছিলাম। আগুন জ্বালিয়ে ছিল বাবা।
বোন: বাবা,এখানে ভূত আছে?
সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। আমি পাশের
থেকে হঠাৎই মজা করব বলে আড়ালে চলে যাই। গাছের আড়াল থেকে গলাটাকে একটু খোনা করে
নিয়ে বলি,
আমি: হাঁউ মাউ খাঁউ,মানুষের গন্ধ পাঁউ!
বোন ভয় পেয়ে চিৎকার করে লাফিয়ে গিয়ে
বাবাকে ধরে। সব্বাই হেসে ওঠে। আমি গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসি। বাবা বলেন,
বাবা: আহ, সুমন্ত! মানুষকে ভয় দেখানো খুব খারাপ
কাজ!
বোন যখন বুঝতে পারে আমি করেছি কাজটা
তখন দৌড়ে এসে আমাকে ঘা-কতক কষায় তার কচি হাতে। আমি চুপ করে যাই। বাকীরাও মুখ
গম্ভীর করে নেয়। রাত হয়ে এসেছিল তখন। বাবা আমাদের শুয়ে পড়তে বলেন। তিনি জেগে
থাকবেন পাহারায়। তারপরে শেষরাতে অন্য দুজন জাগবে। রাতের প্রথম ভাগটা দিব্বি কেটে
যায়। আমি তখন অঘোর ঘুমে। শেষভাগে ঘটে আসল ঘটনা। বাবা যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমাদের
সঙ্গে যে দুজন যাচ্ছিল তারা বাবাকে বেঁধে ফেলে। আমি বাবার ছটফটানিতে উঠে পড়ি। বোন
তখনো ঘুমোচ্ছে। রাত্রে বেশ শীত বলে সে আগুনের ধার ঘেঁসে শুয়েছিল। আমাকে উঠতে দেখে
একজন আমাকেও ঠেসে ধরে তার হাঁটুর নীচে। আমি ছাড়াতে চেষ্টা করি ক্রমাগত। সে আমাকে
হাঁটু দিয়ে ঠেসে ধরেই মুখটা চেপে ধরেছিল। আমি তার হাতে কামড়ে দিই। কিন্তু আরো
তিনজন ততক্ষণে যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। বোন তখনো ঘুমোচ্ছে। তাকে ঘুমন্ত
অবস্থাতেই বেঁধে ফেলল ওরা। আমাকে লোকটা কামড়ে দেওয়াতে জোর একটা চড় মেরেছিল। আমার
মাথাটা ঘুরে যায়। আমি ক্রমশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখি বোন নেই। আমার
গ্রামের ওই লোকগুলো নেই। বাবা ঝুলছে গাছের ডালে। গলায় দড়ি বাঁধা।
আমি প্রথম মৃত্যুকে এমন করে দেখি।
বিচ্ছেদকে বুঝি। মা যখন মারা গেছিল তখন আমি থাকতাম আমার দিদার কাছে। কাজেই আমি
দেখিনি তাকে মরে যেতে। অনেক পরে নৌকা করে আমি যখন এসেছিলাম তখন মায়ের সৎকার হয়ে
গেছে। এই প্রথম আমি প্রিয়জনের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করলাম। আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার মতও
কেউ ছিল না। নিজে নিজে বুঝেছিলাম মৃত্যু মানে কী! সেই আমার কৃষক জীবন শেষ।
তারপরে অনেক ঘাট ঘুরে আমি সৈনিক। আর
কিছু না থাক বাবার শারীরিক গড়নটা আমি পেয়েছিলাম। কাজেই লড়াই করতে অসুবিধে ছিলনা।
আর সামনে-পেছনে কেউ না থাকলে যা হয়, আমি আরো বেপরোয়া ছিলাম। আমার সঙ্গে যারা যুদ্ধ করত তাদের অনেকের বাড়ি
ছিল, বাড়ির লোক ছিল। সেই সব বৌ-বাচ্চাওলারা যুদ্ধে এসে
প্রথমে যে ভয়টা পেত সেটা হল মৃত্যুভয়। আর আমার ওটা খুব ছিল না। কারণ আমার জন্যে
কাঁদার কেউ নেই না! একটা জায়গায় যুদ্ধ শেষ হলে হাতের টাকাটা ওড়া অবধি থাকতাম
বিভিন্ন নগরে নগরে। তারপরে আবার চলে যেতাম যুদ্ধে। বেশ লাগত জীবনটা। খাও-দাও-মারো
নয় মর! একই কাজে আমার ক্লান্তিও আসত না। আগের যুদ্ধ করেছি পশ্চিম সীমান্তে। সেখানে
একটা ছোট রাজ্যের সঙ্গে বাইরে থেকে আসা কিছু দস্যুর যুদ্ধ চলছিল। সেই যুদ্ধে
রাজ্যটা হেরে যায়। ওখানে এখন ওই দস্যুরা শাসন করে। আমি হারার মুখে কেটে পড়ি। বন্দী
হয়ে থেকে লাভ কী? আসার পথে কিছু কিছু বাড়িও আমরা কয়েকজন
দল বেঁধে লুটে নিই। তবে কারোকে মারিনি এবং কারোকে আমার বোনের মত বিক্রিও করিনি
অন্যত্র! সেই টাকা দিয়ে আমি উজ্জ্বয়নীতেই ছিলাম। ফুরোনোর মুখে শুনলাম এখানে যুদ্ধ
লাগবে, চলে এলাম।
দুটো পাশাপাশি রাজ্য। এদের মধ্যে
সারাবছর ঝামেলা লেগে থাকে নদীর জল নিয়ে। তাতে বাঁধ দেওয়া নিয়ে। জোয়ার, বাজরা এসব চাষ হয় এখানে। এবারে যে
রাজ্য বাঁধ দিয়ে জল টেনে নেবে অন্য রাজ্য জল পাবেনা। এই নিয়ে লাগে ঝামেলা। দুটো
রাজ্যই চলে গণের শাসনে। গণ মানে পরিষদ। সেখানে থাকে কিছু ধনী লোক, যারা তাদের শাসককে পরামর্শ দেয়। শাসক শুনতে বাধ্য। না হলে এই যে যুদ্ধ
হবে সেই যুদ্ধে সে সৈনিক পাবে কী করে? অন্য সময় তাকে শাসন
চালাতে গেলেও বাহিনী পুষতে হয়। তার খরচ দেবে কে? এখানে
প্রথা বড় নির্মম। সেই প্রথাতেই চলতে হয়। কাজেই রাজাকেও মেনে চলতে হয় এদের কথা,
নইলে গণ সরিয়ে দেবে তাকে। আগের কালে তো আরো বিষয় ছিল। দুই রাজা
থাকত। এক রাজা যুদ্ধ ছাড়া দেশ শাসনের জন্যে, অন্য রাজা
যুদ্ধের জন্য। এখন অবশ্য বেশীরভাগ জায়গাতেই এক রাজা। আমি যাদের জন্যে যুদ্ধ করতে
এসেছি তাদেরও এক রাজা। রাজা নরম-সরম। মানে কথায় কথায় হুঙ্কার ছাড়নেওয়ালা নয়।
কিন্তু তার গণের সদস্যরা একেকটি বস্তু বটে। প্রত্যেকের জমি আছে ক্রোশ খানেক করে।
তারফলে তাদের খাঁইও তেমন। এই পাহাড়ি অঞ্চলের জমির বেশীটাই এদের দখলে। আর রাজ্যের
বাকি অধিবাসীরা জন খাটে। কাজেই জল নিয়ে যে বিবাদ তাতে এদের গণপরিষদের সদস্যদের
মাথাব্যাথাই বেশি। বাকি অধিবাসীরাও খুব বিচিত্র। তাদেরকে শুধু বলে দিলে হয় যে
দেশের শত্রু, ব্যাস! ছায়ার সঙ্গেও যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে
পারে।
এবারে যুদ্ধ বললেই তো হয় না। একেকটা
তরোয়াল চালাতে দম বেরিয়ে যাবে, না জানলে। একেক তরোয়াল একেক রকমের। আগে সব ছিল সোজা তরোয়াল, কিন্তু বেশ বড়। দুহাতে ধরে ঘোরাতে হত। এখন নতুন একধরণের তরোয়াল এসেছে
শকেদের হাত ধরে। আকারে ছোট একটু, কিন্তু ধারে কাটে।
মধ্যিখানে বেশী ধাতু। সংঘাতের জোর যাতে সামলাতে পারে এবং তারপরে কাটতে পারে।
মানুষের মাথা কাটা না গেলে আবার তরোয়াল কী? কাজেই যে সে
এটা চালাতে পারবেনা। আমিও শিখেছি অনেকের কাছে। অনেক কাল নানান যত্ন করে তবে
শিখেছি। জল বওয়া থেকে ঝাঁট দেওয়া কী করিনি? কাজেই এমন নয়
যে যেকোনো চাষাভূষো চাইলেই চালিয়ে দেবে। এবারে এ দেশে চাষাই বেশী। কাজেই যুদ্ধের
সময় লোক লাগে। আমাকে ভাড়া করা হয়েছে তাই। আমার মত আরো বেশ কয়েকজনকেই ভাড়া করা
হয়েছে। তাদের মধ্যে আজ যুদ্ধ শেষে দু-তিনজন অবশিষ্ট। বেশ কঠিন হয়েছে যুদ্ধ এবারে।
একটা বিশেষ কারণে আমি শেষ অবধি আছি। অন্য কোনো সময় হলে যখন দেখতাম জয়-পরাজয় ঠিক
বোঝা যাচ্ছেনা তখন কেটে পড়তাম। লুকিয়ে থাকতাম পাশের কোথাও। তারপরে যদি বুঝতাম জয়ের
দিকে যাচ্ছে তাহলে ফিরে আসতাম পুরষ্কার নিতে, আর পরাজয়ে
স্রেফ কেটে পড়তাম। আমরা যুদ্ধের পরের জন্যে ভাড়া খাটবার টাকা বাকি রাখিনা। কে জানে,
ফিরবো কিনা? কাজেই যা দেবার আগে দাও।
আমি পারি কিনা চাইলে পরীক্ষা নিতেও পারো।
প্রথম প্রথম পরীক্ষা নিত লোকে। এখন আর
নেয়না। আমারো একটা পরিচিতি হয়ে গেছে যোদ্ধা বলে। আর মুখে কাটার দাগটা মুখটাকে আরো
কঠিন করে দেওয়ায় একটা সুবিধে পাই বটে। যুদ্ধের শংসাপত্র আমার মুখের বাঁদিকে রয়েছে।
এখানে কেউ আমাকে প্রশ্ন করেনি পারি কিনা, কিন্তু দাবি করেছে জয় আনতেই হবে। একটা জেদ আমার মধ্যেও কাজ করেছে।
কান্ডটা আশ্চর্য্যই বটে, যা আমার সঙ্গে ঘটেছে।
(২)
এখানে আসার পথে আমার সঙ্গে একজন
শ্রমণের দেখা হয়। এই রাজ্যের শেষ সীমায় যে জঙ্গল শুরু হয় সেটা যায় আরো অনেকটাদূর
অবধি। সেই জঙ্গলে বসে ছিলেন তিনি। একটা পাথরের উপর আনমনে। আমি দেখে তাঁকে প্রণাম
করি। তিনি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকান। জানতে চান আমি তাঁকে প্রণাম করছি কেন? মুশকিল! এ প্রশ্নের কী উত্তর?
সকলে করে তাই! সকলে কেন করে জানতে চাইলেন এবার। আমি আরো বিপাকে
পড়লাম। বললাম ভক্তির জন্যে। তিনি আমাকে বললেন সকলে ভক্তি কেন করে? আমি বললাম ভক্তি করতে হয় বলে ভক্তি করে সকলে। তিনি আমার দিকে কিঞ্চিত
ঝুঁকে পদ্মের মতন চোখদুটকে আরেকটু বড় করে জানতে চাইলেন আমি কী করি! আমি যোদ্ধা
শুনে জানতে চাইলেন, আমি কার সঙ্গে যুদ্ধ করি। যে যখন
আমাকে ভাড়া নেয় আমাকে যুদ্ধ করার জন্য আমি তার হয়ে তার বিরোধীর সঙ্গে যুদ্ধ করি,
এই কথা বললাম তাঁকে। তিনি শুনে বললেন,
- আমি যদি তোমাকে ভাড়া নিই আমার
শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য? তুমি করবে যুদ্ধ?
- শ্রমণ, আমার এটাই কাজ।
- যদি আমি বলি আমি তোমাকে ভাড়া
নেব তোমারই বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য, তোমার ভেতরে থাকা
যুদ্ধলোলুপ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য, খাটবে আমার
ভাড়া?
এবারে আমার মনে হল থামা দরকার। এরা
এমনই পাগল হয়ে থাকে বলে শুনেছি। হয়ত বাকী জীবন এই ভেবেই কাটিয়ে দেবেন যে আমি আমার
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো না কেন, কিন্তু আমার তাতে চলবে না। আমি তখন তাঁকে বলি এ প্রশ্নের উত্তর আমার
জানা নেই। খুব অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। বললেন যা জানি না তা করি কী করে! অন্য
কেউ একথা বললে আমার মাথাটা মোটেই এত ঠান্ডা থাকত না। কিন্তু শ্রমণের কথা আলাদা।
আমি চুপ করে রইলাম। এরপরে তিনি আমাকে যা বললেন তাতে বুঝলাম এটা আরো কঠিন হতে
যাচ্ছে। আমাকে খুব সাদামাটা স্বরে বললেন তিনিও জানেন না সকলে কেন কোন একটা কাজ করে,
যখন সে কাজের সবটা তার জানা নেই! ফল সম্পর্কেও যে ধারণা থাকে সে
ধারণা সত্যি নাও হতে পারে। তবু পারে কী করে মানুষ এত কাজ করে চলতে এত অজ্ঞানতার
মধ্যে? জানেন না তিনি। জানতে চান। আমি আর কথা বাড়াই না,
নমস্কারও করি না। চুপ করে পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে দিই। কিছুটা
এসে দেখি তিনি একই ভঙ্গিমায় বসে আছেন।
এ রাজ্যে পৌঁছে আমি একটা আশ্চর্য্য
ঘটনা শুনি। অনেক জনপদ, মহাজনপদ
আমার ঘোরা। অনেক জায়গায় গেছি, কিন্তু এমন কান্ড কোথাও
শুনিনি! কপিলাবস্তু নাম রাজ্যটার। রাজা অনেকদিন নি:সন্তান ছিলেন। রাণী মহামায়ার
গর্ভধারণে রাজার উৎকন্ঠার সীমা ছিল না। প্রথা অনুযায়ী রাণী চললেন বাপের বাড়ি
দশমাসের সময়ে। যাওয়ার পথেই লুম্বিনী বাগানে জন্ম দিয়ে ফেললেন। এর পরে রাজ্যে
মহোৎসব হয়েছে। অনেক গুণী-জ্ঞানীরা এসেছেন, শিশুর ভাগ্য
গণনা করে গেছেন। কেউ বলেছেন রাজ-চক্রবর্তী হবে তো কেউ বলেছেন মহাসাধক। এবারে রাজার
চিন্তা বেড়েছে। কারণ জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই মা মায়াদেবী প্রয়াণ করেন। রাণীর বোন
আসেন সিদ্ধার্থকে মানুষ করতে। সেই সিদ্ধার্থ ক্রমে বড় হয়। রাজা তাকে যাবতীয় সুখ
ভোগের উপাদানে ভরিয়ে রাখেন। বস্তু সুখ বেশি বেশি করে তাকে দিতে হবে যাতে সে কোনো
ভাবেই সাধক না হয়ে যায়।
কিন্তু একদিন বিরোধ লাগে সিদ্ধার্থ আর
সম্পর্কিত ভাই দেবদত্তের। দেবদত্ত রাজকুমার হবার উপযুক্ত বটে। তার সিদ্ধার্থের মত
বিভিন্ন মেজাজ নেই। সে যোদ্ধা এবং সে জানত এই রাজ্যের সেই উত্তরাধিকারী হবার
যোগ্য। কাজেই শিকার ইত্যাদি বীরত্বপূর্ণ কাজেই তার মন ছিল। একদিন সে একটি উড়ন্ত
বালিহাঁসকে তীরবিদ্ধ করে। হাঁসটা পড়বি তো পড় সিদ্ধার্থের পায়ের কাছে। সিদ্ধার্থ
অকারণ রক্তপাত দেখতে চাইত না। তার সঙ্গে এ নিয়ে বাধে বিরোধ। রাজপ্রাসাদ থেকে বের
না হওয়া সিদ্ধার্থ জানেই না কী জীবন আসলে মানুষের। এই সামান্য ঘটনায় তার কোমল মনে
আঘাত লাগে। আরো সে আঘাত তীব্র হয় যখন দেবদত্ত তাকে বলে যে আসলে সে মূর্খ! জানে না
জীবন কেমন। প্রাসাদের চার দেওয়ালের মধ্যে তাকে এত বেশি আগলে রাখা হয় যে সে আদুরে
হয়ে উঠেছে। বাইরে মানুষ মরছে কীট-পতঙ্গের মত,
আর সে একটা হাঁস নিয়ে এত বিলাপ করে চলেছে। এত ন্যাকামো করে
চলেছে।
সিদ্ধার্থ বাবার কথা না শুনেই বেরিয়ে
পড়ে। শুদ্ধোধন চান নি এই জগৎ এখন সে দেখুক। কিন্তু সিদ্ধার্থ তার সারথী চান্নাকে
নিয়ে রথে, পথে বেরিয়ে পড়ে
সিদ্ধার্থ। মৃত্যু, দারিদ্র, জরা
এসব মানুষের অস্তিত্বের অংশ, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অংশ সে
বোঝে। চান্না তাকে বোঝায়। যখন বোঝে তখন আরেক দিক থেকে জোরালো সমস্যা ঘনিয়ে এসেছিল।
পাশের রাজ্য আবার জলের দখল নিতে চায়। নদীর উপর বাঁধ দিয়ে সে জল টেনে নিচ্ছে তাদের
দিকে। ঐ রাজ্যকে থামাতে হবে। না হলে এবারে চাষের সঙ্কট দেখা দেবে। সিদ্ধার্থ
রাজ্যের রাজকুমার। এত দিন সে এসব বিতর্কে কিছুতেই অংশ নেয়নি। এবারে সে আসে
রাজসভায়। তার বক্তব্য ছিল যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধানে দু-পক্ষেরই ক্ষতি হবে, তার বদলে আলোচনা হোক। গণের বাকি সদস্যরা জোর দিয়ে বলে আলোচনার দরকার
নেই, তারা দেশের কথা ভাবে। তাই তারা মনে করে তাদের
দেশবাসীদের জন্যে পুরো জলটাই লাগবে। একটুও ভাগ দেওয়া যাবেনা অন্যকে। সিদ্ধার্থের
বিরোধকে ফিরিয়ে নিতে রাজা শুদ্ধোদন অনুরোধ জানান। কিন্তু সিদ্ধার্থ অনড়। শেষে
মতদান করতে হয় প্রকাশ্য সভায়। দেখা যায় একা সিদ্ধার্থ একদিকে আর বাকী সকলেই
অন্যদিকে। একা সিদ্ধার্থ! যে রাজকুমারকে এতকাল সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে মানুষ করা
হল সে তার দেশের লোকের লাভ বোঝেনা? তার কাছে বড় কিনা
অন্যদের মানে অন্য রাজ্যের লোকের সুখ-দু:খ? এ তো
দেশদ্রোহী।
এ রাজ্যে কেউ দেশদ্রোহী প্রমাণিত হলে
শূলে যেতে হয় তাকে। সিদ্ধার্থও সামান্য নাগরিক হলে শূলেই যেত। কিন্তু সে রাজপুত্র।
শুদ্ধোধন রাজা, গণকে
অনুরোধ করলেন সিদ্ধার্থকে বোঝানোর সময় দিতে। সে সম্প্রতি যুবক হয়েছে। সদ্য
বিবাহিত। তাছাড়া দেশকাল ভাল জানেনা, বোঝে না এখনো। তাকে
আগলে আগলে রাখা হয়েছে। এ শুদ্ধোধনেরই দোষ। তিনি এবারে তাকে আস্তে আস্তে বোঝাবেন
রাজনীতি কী, কাকে বলে কূটনীতি! শুধু পুঁথি পড়লেই হবে না,
তাকে হাতে কলমে জানতে হবে বৃহস্পতি কি শুক্রাচার্য্যের নীতিসমূহ।
শত্রুমিত্রের উপর তার প্রয়োগ করতে হবে। তবেই সে দেশকে শাসন করতে সক্ষম হবে। গণ
শুদ্ধোদনকে বলে এই সব সিদ্ধার্থকে দ্রুত শেখাতে হবে। তা না হলে সিদ্ধার্থকে রাজা
করা যাবে না। আর এবারে সে যে কাজ করেছে তার জন্য প্রকাশ্য সভায় তাকে ক্ষমা চাইতে
হবে সকলের কাছে। বিশেষ করে গণের কাছে। নিজের দেশের স্বার্থের চেয়ে বড় আর কিছু নেই
এই কথা তাকে বলতে হবে প্রকাশ্যে। শুদ্ধোদন মেনে নেন এই শর্ত। সিদ্ধার্থ, তাঁর আদেশ অমান্য করতে পারবে না তিনি জানেন।
ভুল জানতেন তিনি। সিদ্ধার্থ আবারো
শুদ্ধোদনের অনুরোধ অমান্য করেই যুদ্ধের আগে চলে যান স্বেচ্ছানির্বাসনে। দেশদ্রোহের
অভিযোগ মাথায় নিয়েই চলে যান। তাঁর মতে মানুষকে জলের মতন প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য
হত্যা করাকে সমর্থন করার চেয়ে দেশদ্রোহ ভাল। আর কূটশাসন মানুষকে উন্নত করেনা, সভ্যতাকে শৃঙ্খলে বেঁধে তার সর্বনাশই
করে। কারণ কূটনীতি এবং রাষ্ট্রনীতি সত্য না, সে মিথ্যায়
আকীর্ণ এক ক্ষমতাবানের ক্ষমতায় থাকার কৌশল মাত্র। নৈতিক কারণে একে সে মানতে পারে
না। চলে যায় সিদ্ধার্থ। তার স্ত্রী-পুত্র পড়ে থাকে। তার যুবরাজত্ব পরে থাকে। সে
চলে যায়।
দেবদত্তই সভায় মূল দেশদ্রোহের অভিযোগ
এনেছিল। সে এবারে নি:শঙ্ক! এবারে যুদ্ধে জিতলে অনেক অনেক পুরস্কার। কিন্তু যুদ্ধে
জিততে হবে। হবেই। কাজেই আমাকেও এরা যখন যুদ্ধের জন্যে বলে তখন স্পষ্ট বলে দেয় কোনো
অবস্থাতেই না জিতে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া চলবে না। জানতে চায় যদি যুদ্ধে আমার মৃত্যু
হয় তাহলে আমার প্রাপ্য পুরস্কার কার কাছে পাঠানো হবে?
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বলি শ্রমণের কথা।
আমার আর কে আছে? হঠাৎ-ই
মনে হয়েছিল শ্রমনের কথা। সদ্য যুবাটি আমাকে কেন জানি না আকর্ষণ করেছিল। তার সরল
আচরণ, তার ওই অবাক হওয়া সব মিলিয়ে আমার মনের মধ্যে দাগ
পড়েছিল। আমার আলাদা করে কোনো ঈশ্বর ভক্তি-টক্তি কোনোদিনই নেই। ধর্মের লোকদের আমি
খুব আলাদা করে পছন্দও করিনা। এগুলোকে যা দেখেছি তাতে বেশ খচ্চর প্রকৃতিরই হয়
বেশিরভাগ। আর হয় লোভী। একে কেমন যেন আলাদা লেগেছিল। তাই বলে ফেলেছিলাম এর নাম।
আমার কাছে জানতে চাওয়া হল সেই শ্রমণের নাম। আমি "জানি না' বলতে বর্ণনা চাইলেন সেনানায়ক। আমি বললাম, তার
দুটো হাত আজানুলম্বিত। দুটো কান যেন হাতির মত বড়। টানা টানা চোখ, পাতলা ঠোঁট। এতোটা শোনার পরে সেনানায়ক অপলক তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। সে
বলে এর সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছে। আমি যখন বলি তার সঙ্গে দেখা রাজ্যের সীমান্ত
পেরিয়ে তখন সে যেন একটু দু:খিত হয়। আমি কারণ বুঝি না। সেনানায়কের ওই এক লহমার
বিষণ্নতা কিন্তু আমার নজর এড়ায় নি। তিনি বললেন,
- বেশ। তোমার মৃত্যু হলে তোমার
পুরস্কারের অর্থ পাবে ঐ শ্রমণ!
এর পরে রাতে আমাকে ডেকে পাঠালেন আবার
তাঁর শিবিরে। জনশূন্য শিবির। বাইরে প্রহরী ছাড়া কেউ নেই। তখন অনেক রাত। বললেন,
- তুমি চেন শ্রমণকে?
- না।
- তাহলে? কেন দিতে চাইছো তাঁকে?
আমি কী বলবো? বললে কী বুঝতে কী বুঝবেন কে জানে?
আমি চুপ করে থাকি। সেনানায়ক কিছুক্ষণ তাকিয়ে যখন বোঝেন এর উত্তর
আমি দেব না তখন বলেন,
- বেশ, উত্তর
তোমার ইচ্ছাধীন। না দিলেও আপত্তি নেই। কিন্তু শ্রমণ যদি না নেন তাহলে?
- তাহলে আপনার যাকে ইচ্ছে দিয়ে
দেবেন, আমার জগতে কেউ নেই।
সেনানায়ক খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তারপরে বললেন,
- যোদ্ধা, আমার সারাজীবন আমি সৈনিক। কথার দাম আমি জানি। যদি শ্রমণ সে পুরস্কার না
নেন তাহলে তার সব চাইতে যা সদ?গতি করা সম্ভব তাই আমি করব।
আমি কথা দিলাম।
আমি সামান্য হেসে যাবার অনুমতি চাইলে
তিনিও হেসে আমার দিকে তাকালেন। গলা আবার নামিয়ে বললেন,
- এই দুর্ভাগা রাজ্যে একজন অন্তত
সিদ্ধার্থকে কিছু দিতে চেয়েছে জেনে ভাল লাগল।
আমি থমকে গেলাম।
- সিদ্ধার্থ?
আমার বিস্ময় দেখে বললেন,
- ওই শ্রমণ অবশ্যই রাজকুমার
সিদ্ধার্থ! আর একটা কথা বলি তোমায় সৈনিক। অনেক অনেক যুদ্ধের পরে আমি আজ জানি
সিদ্ধার্থ ঠিকই বলেছে। চাষের জলের জন্য যুদ্ধ আরো যুদ্ধ শুধু ডেকে আনবে মাত্র।
চাষের নিশ্চিন্তি দেবে না। শান্তি দেবে না। আর শান্তিহীন রাষ্ট্রের পতন শুধু সময়ের
অপেক্ষা।
আমি বাক্রুদ্ধ হয়ে বেরিয়ে এলাম শিবির
ছেড়ে।
(৩)
মাঠের মধ্যে যেখানে আমি উঠে
দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে আমার থেকে কিছুটা দূরে পড়েছিল সেনানায়কের মৃতদেহ। আমরা
জিতেছি। কিন্তু আমাদের বাহিনীর সেনানায়ক মৃত। আমি জীবিত। আমার জিজ্ঞেস করা হয় নি
ওঁর পুরস্কার কাকে দেওয়া হবে ওঁর অবর্তমানে?
কেউ কি জানে? সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি।
পা-টায় টান লাগছে। হঠাৎ-ই আমার কানের কাছে কে যেন বলে উঠল,
-যা জানে না তা মানুষ করে কী করে?
আমি চমকে উঠলাম। ধারে কাছে কেউ নেই।
আমার বোনের ভূতের ভয় ছিল,আমার
কোনোদিন ছিল না। গা-টা শিউরে উঠল। কে বলল? কে? কোথায়? কেউ নেই। চারপাশে এখন জীবিত কেউ নেই। তাহলে?
আমার ভেতরে প্রশ্নটা কেমন যেন বাসা
বেঁধে গেছে। আমাকে অনেকবার অনেকদিন ধরে খোঁচাচ্ছে। আমি এখনি শুনলাম মন দিয়ে।
আবারো!
-যা জানে না তা মানুষ করে কী করে?
যুদ্ধের মানে আমি কী জানি? শুধু হত্যা-মৃত্যু-রক্ত? নাকি অতীত থেকে ভবিষ্যৎ জুড়ে এর বিস্তার? আমি
কি জানি? কী জানি আমি? জল,
জমি, ধন-সম্পদ এসব যে যুদ্ধের কারণ তা
দিয়ে কি রাখা যায় এদের? রাখা গেলে আবার যুদ্ধ হবে কেন?
সব গুলিয়ে যেতে থাকে মাথার ভিতরে। আমি আর কোনো যুদ্ধ করতে পারব
কি এর উত্তর না জেনে?
আহ---! কী আপদ! শ্রমণের কন্ঠস্বর আমার
মাথার ভিতরে ঝরণার মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে।
0 মন্তব্যসমূহ