কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
নিত্যানন্দ’র মগজে আবারও মানুষ-পোড়া-গন্ধ জেগে ওঠে এবং তা কুকুরের একটানা হুই্ইয়ো কান্নার ধরনে বিচরণশীল হয়। ঠিক কখন থেকে এ গন্ধ তার মাথার ভিতরে চলাচল শুরু করেছে, এ ভাবনার সঠিক হিসাব মেলাতে গিয়ে সে তার বাবা কিংবা দাদার স্মৃতিবিষয়ক কথাও স্মরণ করে। এমন সিদ্ধান্তেই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যে, এসব মূলত সে বহন করে তার বহুকাল থেকে এবং তারই ক্রমধারায় তা তার বাবার বাবার মগজে খোঁদাই হয়। সেসবও তো ৩০/৩৫ বছর কিংবা তারও আগের কথা।
পুবদুয়ারযুক্ত বাড়িটার দোতলা ঘরের উপর-নিচে চারে চারে মোট আটটা রুম। মানুষ- পোড়া গন্ধ, আগুনের হলকা, অঘ্রানের এই বাতাসে বিচরণশীল। এবং এ গন্ধ ঠিকানাহীন হয়েই থাকে। এরই ভারে যেন রুম থেকে রুমে যাওয়ার দেয়ালসমূহ ভেঙেচুরে, দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাওয়া ঘরটির দোতলায় উঠার একটা সিঁড়ি মাটির, আরেকটি গাছের ডালপালার। মাটির সিঁড়িটায় এঁটে দেয়া আছে কাঠের শক্ত দরজা -- আগুনের তাপ এখানেও আছে। বাড়িটির সামনে লম্বা মাঠ, সামনের এ মাঠটিতে শিশির-শুষ্ক-গন্ধ নিয়ে, আমন ধানের থোড়ের ভরসা নিয়ে, ভরাট হয়ে আছে। এ গ্রামের রাস্তা বেরয় বাড়িটির উঠানের বুক ঘেঁষে ঘেঁষে -- এখন থেকে তা আবারও আগুনের তাপে মৃদু কাঁপুনিতে নড়ে। রোদ বাড়ে রক্তের শুষ্ক ঘ্রাণ চুঁইয়ে চুঁইয়ে। কয়লার ¯তূপের মতো পড়ে থাকা লাশগুলোর উপর কেঁপে কেঁপে আলো ছড়ায়।
ফজরের আজানে হামলে পড়ে মধ্যরাতের রোদনব্যাকুল চিৎকার -- পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়া, দোকানদারপাড়া, বণিকপাড়া, কুমারপাড়া থেকে ’শ ’শ মানুষ হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকে শীলপাড়ার বাড়িটাতে। পশ্চিম সাধনপুর, পালেগ্রাম, কালীপুর, বৈলছড়ি, কোকদণ্ডী, বাণীগ্রাম, জলদি, চাম্বল, গুনাগরি, নাপোড়া, খানখানাবাদ উজাড় করে মানুষের স্রোত বয়। এমনকী তৈলাদ্বারদ্বীপ থেকেও মানুষের জোয়ার আসে; তারা কর্নফুলি পার হয় ফেরিতে। সেই লোকগুলো অত জোরে আর ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছে যেন গলায় আটকা পড়া বারুদের বা গান-পাউডারের ঘ্রাণ তাড়াচ্ছে। এভাবেই যেন নিজেদেরকে সতেজও রাখা যায়। দেয়ালে দেয়ালে মাংস-হাড্ডি-নাড়িভুঁড়ি পোড়ার গন্ধ এখনও লেগে আছে।
নিত্যানন্দ’র গলা-চোখ-মুখ-বুক পেরিয়ে তার সর্বাঙ্গ কান্নায় ভরাট হয়ে যায়; কথার ফাঁকফোকরে গো গো শব্দ জমাট হয়। দুপদাপ করে আসতে থাকা মানুষের পদগুঞ্জনে তার কান্নাকে আরও দীর্ঘজীবী করে। তাদের স্মৃতিতে তখনও আছে ডাকাত ডাকাত চিৎকার, কেয়ামতের হল্লা। আগুনে মানুষ পোড়া গন্ধটি তারাও বহন করে। তামাম অঞ্চল কি আগুনের, বারুদের, গোলাগুলির, যেন কিরিচের ঝিলিক বিলানোর লিজ নিয়ে ফেলল।
বাড়িটিতে মানুষ-পোড়ার লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে তিনদিন হ’ল এবং এর প্রতিবেশি এমনকি গ্রামের লোকগুলোকে ধোঁয়া-বারুদের গন্ধমেশানো বিহ্বলতায় সঁপে দিয়ে ১১টা মানুষ মরে-পুড়ে কাঠ হয়ে গেছে। এমনই কায়দায় এদের পুড়িয়ে দেয়া হ’ল যেন দাহের প্রয়োজন নেই -- এ থেকে সৃষ্ট্রর গন্ধ বিস্তৃত হচ্ছে কেবলই। মানুষগুলোর আলাদা নাম মুছে গেছে। গন্ধের জন্য বাড়িটার দোতলায়ও উঠার প্রয়োজন নেই -- এর উঠান, এমনকি গ্রাম থেকে ছিনতাইয়ে পড়া মানুষের চিৎকারের মতো, নিশি-পাওয়া মানুষের মতো ঝিমুতে ঝিমুতে নাকের একেবারে গভীরে তা যাতায়ত করতে থাকে।
তা টের পাওয়ার আগেই নিত্যানন্দ’র শরীরে অনেক দূর থেকে আসা আগুনের ভাপ লাগে -- যেন তার ভাবনাব্যাকুল মন এরই তাপে গলে গলে পড়ে। উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আগুনের ঝাঁজে কয়লা হওয়া লাউ ডগার দিকে তাকিয়ে এখনও হরিদাসীর বোনঝি কমলা শীল সে-রাতের আগুনের রূপ অনুভব করে -- তা ছিল ঘনমেঘের মতো ধোঁয়াটে; এতে দশহাত দূরের মানুষও ঘনধোঁয়ায় আটকা পড়ে। এরা সে- রাতের ডাকাতি কিংবা হত্যাকাণ্ড অথবা এসবের মিলিত স্মৃতির কবলে পড়ে বারবার। সেই ভারেই যেন বাড়িটার স্থানে স্থানে লালচে খাবলার মতো ক্ষত চোখে পড়ে -- মাটির দেয়াল ক্ষণে ক্ষণে ক্ষয়েই যায়।
দোতলার রুমগুলোতে হঠাৎ-ফেটে-যাওয়া ডিমের কুসুমের মতো আলো আসে। ঘরটিতে মানুষ’রা দুড়মুড় করে হাঁটে। নানাপদের চিৎকার, হাহাকার জমে আছে সবখানে -- উত্তর দিকের রুমটাতে পৌঁছলে গোঙানি আরও জোরে হানা দেয়। এখানকার একটা জানালা দিয়েই সেই রাতে সুনীল পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু তার ডান পাটি একটা গাছে আঘাত লেগে ভেঙে একেবারে থেঁতলে গেছে।
সেই জানালাটি এখনও ঝুলে আছে মাটির লালচে দেয়ালে -- মানুষ- পোড়াগন্ধ নিয়ে। নিত্যানন্দ’র শরীরে বা ধুলাবালিতে বা মটির ঘরের দেয়ালে আবারও আগুনের হলকা লাগে। জানালাটি নিত্যানন্দ’র দাদার বাবার আমলের -- সে-সবই জনস্রোতের সামনে শুষ্ক কান্নার প্রলেপে প্রকাশ পায় । নিত্যানন্দ’র এসব বর্ণনার প্রবাহে এ বাড়িতে আসা লোকগুলো ক্ষণে ক্ষণে মাথা ঝাঁকায়। পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো দোতলার এদিকটাই বেশি দাপাদাপি করেছিল বলে ধারণা হতে পারে।
লাশগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকলেও তাদের দাপাদাপির মিলিত চেষ্টাও এদিকেই ব্যাপৃত হয়। একটা চাপা গোঙানি ছড়িয়ে থাকে -- সেই গোঙানির কবলে পড়ে নিজেকে ষোলআনা সজাগ রাখে নিত্যানন্দ। এমনকি মনুষ্যনির্মিত ছটফটানি, গোঙানি, দাপাদাপি, চিৎকার স্মরণে আসে বারবার। এককসময় নীরবতা নামে এবং তা স্বল্পসময় ভ্রাম্যমাণও থাকে। মাংস, হাড়ি-পাতিল, মাটির দেয়াল কিংবা শুষ্ক কান্নার তাপে অন্য এক গন্ধ নিয়ে তার নাক বেয়ে বেয়ে মাথার ভিতরে গুনগুনিয়ে কান্নার মতো সুর তোলে। এবং আলোর প্রতিধ্বনির কবলে পড়ে জনস্রোতের ব্যাকুলতা বাড়ায় । নিত্যানন্দ সকালটা পরখ করে আবার -- সামনের ধানক্ষেত, পুকুর, স্নানঘাট দিয়ে বণিকপাড়া, কুমারপাড়া হয়ে বড়োরাস্তার সাথে মিলে যাওয়া কাচা রাস্তাটাও বদলে যাচ্ছে। সবখানেই লাশ পোড়া তীক্ষ্ণগন্ধ।
একসময় সশস্ত্র ফর্মান তেড়ে আসে -- ‘তাড়াতাড়ি নামেন, দেখাদেখির তামাশা শেষ করেন, উপরের অর্ডার আছে, বাড়িটি সিল করতে হবে -- ফর আনলিমিটেড পিরিয়ড।’ যেন একবারের হুকুমে
কোনো কাজই হবে না; তাই গলার স্বরটি আবারও শোনা যায়। সকালের আলোয় তার সদ্য ক্লিন সেভ করা মুখে আলোর ঝলকানি এলোমেলো হয়ে ঝরতে থাকে। খালেক বেপারী তার কানে কানে বলে যেতে থাকে -- হালার মালাউন গো কারবার দেকলেন, ডাকাতগো আটকানির লাইগ্যে দুতলায় কেমুন মোটাতাজা দরজা-জানালা ফিট করছে? ৫/৭ জন জোয়ান-মর্দও তা খোলার বুদ্ধি পায়? মৃত মানুষজনের শরীরের কাচাকাচা গন্ধের লোভেই যেন বেপারী জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
গজেন্দ্র শীলের বেঁচে-যাওয়া কম্পাউন্ডার ছেলে সুনীল তার রক্তের ধারায় যেন ভয়ের থাবা টের পায় এবং তারই ধারাবাহিকতায় সরকারের কাছে আবেদন রেখেছে নগরীতে একটা বাড়ি দানের জন্য।
তার মানে তার নেশা যখন শহরের উপর পড়েছে তা হলে ধরে নিতে হয়, বাপ-দাদার ভিটার প্রতি তাদের মায়া- মহব্বতেরও ভাটা পড়েছে। তাহলে এই মরমী-উদ্যোগে খালেক বেপারী কেন সাহায্য করবে না! দশগ্রামের মুরুব্বি হিসেবে তার একটা দায়িত্ব আছে তো। প্রতিবেশির মান-ইজ্জত দেখার ভারটা তো তাকেই নিতেই হয়। সরকার বাড়ি না-দিক, এই কাজে সেও তো সাহায্য করতে পারে।
বাড়িটা যে সিস্টেমে ডাকাতিটা হ’ল, মানুষদেরকে একাত্তরের যুদ্ধের বছর, শাক-সবজির ভাজির মতো, শ্মশানে পোড়ানোর মতো কয়লা বানিয়ে দিল -- তাহলে সেই বাড়িটাও তো একহিসাবে দূষিতই। ঠিক কিনা? ঘটনা ঘটে গেল তো রাতেই। তা দিনেরও হতে পারত। খালেক বেপারীর সাথে সাথে চলা কেরামতালী জহুর মিঞা ভাবতে থাকে, এ বাড়ির লোকগুলোকে যেভাবে চন্দাই-নন্দাই করতে দেখা যাওয়া শুরু করে তাতে এমনই হওয়ার কথা। টাকায়, বুদ্ধিতে, পড়াশোনায় এমনকি সৌদি রিয়েল রোজগারে তাদের ধারেকাছে এখন কেউ ভিড়তে পারে না, তাহলে এতগুলো যোগ্যতার ভিতর অ্যাটাক আসতে এত দেরি কেন হ’ল, এমন বিস্ময়ও কারও কারও স্মৃতিতে পোষে এবং পুনশ্চ: বিহ্বলতায় পড়ে। সোনাদানা-ধনের গন্ধ ডাকাতের নজরে পড়ে কি? শালার নাপিতের জ্ঞাতিগোষ্ঠী চোখের সামনে কী মাতব্বরিটা দেখায়! বস্তার বস্তা টাকা কামাই করে আর ইন্ডিয়ায় পাস করে, কিছু টাকাকড়ি ডাকাতির খাতে খরচ হবে তাতেই শালাগোর পাছা ফেটে যায়।
একসময় মানুষ পোড়া মিহিগন্ধ ঘিরে ফেলে সারাটা উঠান এবং কান্না ভিড় করতে থাকে প্রবলবেগে। ধূপের ভাপে ঝুরঝুরে কান্নাটা আরও ক্রিয়াশীল হয়। পুড়ে-যাওয়া-ঘরের মাটির দোতলায় তা লটকে থাকা ঘরের মতো জীবন্ত হতে থাকে। পুলিশের খাতায় নাকি আগুনের কারণ হিসাবে পেট্রোল বা গান-পাউডারের চিহ্ন লিখিত হয়ে গেছে। এভাবেই শীলপাড়া কাঠকয়লার মতো পুড়ে যাওয়া বাড়িটা স্মৃতির কবলে পড়তে থাকে। আত্মীয়-পরিজন ও নিত্যানন্দ ঝড়ে ভাঙা গাছের গোড়ার মতো ঝিম ধরে থাকে এবং একসময় উঠানে লুটিয়ে পড়ে।
বাড়িটা ঘিরে গুঞ্জনময় নানাবিধ কোলাহল বাড়ে। একসময় সারাটি শীলপাড়া ডাকাতি আর পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের যৌথভার বহন করতে থাকে। হত্যাযজ্ঞটি ডাকাতি নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড -- এই বিবেচনা চূড়ান্ত করতে গিয়ে গজেন্দ্র শীলের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে থাকা লোকগুলো ক্রমশ বহুধাবিভক্ত হতে থাকে। এমনকি চিন্তা-ভাবনা করার ধরনও প্রথমত দ্বৈত রূপ পায় এবং ক্রমশ তা বর্ধনশীল আর বহুব্রীহি হতে থাকে। অনেকের আরও ভাবনা বাড়ে -- ডাকাতি করতে ব্যর্থ হয়েই কি এমন একটা নৃশংসতার দিকে ডাকাতরা নিজেদেরকে নিয়োজিত করল? এসব খানাখন্দ বেয়ে বহুবিধ সম্ভাবনা চারপাশে গল্প-গুজবে রূপ নিতে থাকে -- সম্ভাবনাসমূহকে নিুরূপে দেখা যায় --
১. এটি স্রেফ ডাকাতি
২. পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
৩. ডাকাতি এবং হত্যাকাণ্ড দুই-ই
৪. ডাকাতির সাথে কোনো হিংসা মিশে গেছে
৫. সংখ্যালঘু নিশ্চিহ্ন করার এক আন্তর্জাতিক কারসাজি।
৬. কিংবা এসবের মিলিত ভাবনার কবলে পড়ে নিরাকার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।
হত্যাকাণ্ড যদি পরিকল্পিতই না হবে তবে গান-পাউডার বা পেট্রোলই-বা কোথায় পাবে। এ কাজটি কেন পরিকল্পিতভাবে করবে তা ভাবতে গিয়ে আরও কিছু ভাবনায় তাদের জড়াতে হয়। গজেন্দ্র শীলরা কি পুরানা আমলের বড়োলোক যে ধনে-মানে অফুরন্ত ভাণ্ডার নিয়ে বসে আছে? অনেকের ভাবনায় মেয়েমানুষজনিত লালসার ইশরাকেও বাদ দিতে পারে না। এভাবে বিবিধ ধরনের গবেষণা চলমান থাকে। আরও তো দু’তিনবার ডাকাতি করতে এল, শালারা তো বাড়িটার দোতলায়ই উঠতেই পারেনি।
একে তো কাঠের সিঁড়িটি উঠিয়ে নিয়েছে আবার মাটির সিঁড়িটি অত শক্ত যে তা ভাঙতেই পারেনি। জনস্রোতের ভাবনা এমনও হয়, তারা যে গান-পাউডার বা পেট্রোল এনেছিল তার প্রমাণ কি? পুলিশের রিপোর্ট নিয়েও আলোচনা চলে দীর্ঘসময়। খালেক বেপারী কি জানে না ওদের মতো
মালাউনদের দু’চারটা ধমক কী লাগানো এমন ব্যাপার? পুলিশ ফাঁড়ির বিষয়টা নিত্যানন্দ’র চিন্তায় বারবার আসা উচিৎ বলে কেউ কেউ বলে। যতই পুলিশ ফাঁড়িটি এই আক্রমণকে অদৃশ্য রাখতে চায় ততই ডাকাতদলের আক্রমণ বিদ্যুতের নিশানার মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। ফাঁড়ির হাবিলদারটি পত্রিকার সাংবাদিকদের জানাতে থাকে, ডাকাতদলটি তাদের ফাঁড়ি থেকে কমপক্ষে একশ গজ দূর দিয়ে মেইন রোডের দক্ষিণ দিকে চলে যায়। এমনকি তারা গ্রাম্য-পাহাড়া থেকেও দূর দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। গোকুইদণ্ডির পুলিশ-ফাঁড়ির এমন আর্জিকে হেসে উড়িয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা-কমান্ডার মুক্তার হোসেন -- হায়রে পুলিশ! ডাকাতের পাদের শব্দে বেটারা যেই একটা দৌড় দিল হাহাহা। তিনজন পাহারাদারকে বেঁধে ফেলল কি ওদের বাপজান? জীবনের এমনই বহুবিধ গুপ্তরূপ নিত্যানন্দ’র বিবেচনায় ক্ষণে ক্ষণে আসে । সমন্বিত ভয়ের স্পর্শ লাগে এতে।
খালেক বেপারী এভাবেই তার চলাচল বজায় রাখছেন, যেন সব জায়গা থেকে বাড়তি ভয়, মাংশ, চামড়া কিংবা চর্বিআশ্রিত কয়লার গন্ধ, আগুনে পোড়ে যাওয়া স্মৃতিকে ধুয়ে-মুছে সাফ করার দিকে মনোযোগী হয় আহাম্মক এলাকাবাসী। যত যতœ করেই মরুক এরা, লাশ তো লাকড়ি দিয়ে পোড়াবেই, তাহলে এই লাশগুলো নিয়ে অত গবেষণার কী আছে? যে নিয়ম-শৃঙ্খলার ভিতর বাড়িটি পুড়ানো হলো, তা দেখেও তো বলা যায় তাদেরকে অন্তত এই শীলপাড়ায় থাকার চিন্তা বাদ দিতে হবে। শুধু কি মানুষ মরল, বাড়ি-ঘর, তুলসিতলা, নৈবেদ্য পুড়েও শেষ হয়ে গেল, তাহলে আর কি নিয়ে থাকবে এরা? দেশত্যাগের চিন্তা তো মাথায় যাতায়ত করতেই পারে । বারুদের জলজ্ব্যান্ত একটা ¯তূপে মরার মতো পড়ে থাকার ফায়দাটা কী! খালেক বেপারীর জ্ঞানবুদ্ধির শুধু এই সাধারণ বিষয়টিই বুঝুক এরা। শবদেহ উঠানে দাহের জন্য প্রস্তুত করার সময় শুধু, পারিবারিক শ্মশানেও খালেক বেপারী তীব্র নিরবতার মতো ফিসফিসিয়ে বলে -- ‘ওয়া নিত্য, তুঁয়ারা ইক্যিনি গরি ভাবি চও। এত প্যাঁচর মইধ্যি থাকনর কুনো দরকার আছে না? ইক্যিনি গরি মাথা ঘামাই চও।’ যেন রাষ্ট্রের বাইরের কারও সঙ্গেই শুধু কথা বলছেন না, একটা বাড়তি উটকো ঝামেলা তাড়াচ্ছেন -- এভাবেই খালেক বেপারী তার কথা শেষ করে নিত্যানন্দের দিকে তাকিয়ে থাকে। কর্ণফুলির তীব্রস্রোতের মতো এই কথাসমূহ নিত্যানন্দ’র সারাটা মগজে যাতায়তকরতে থাকে। ঘটনাটি শুধু বেবুঝের মতো হাঁ-হুতাশ করার বা হাত-পা ছেড়ে বসে থাকার বা শোনার জন্য নয়, বহন করার জন্যও; তা দেখার এবং দীর্ঘস্থায়ীত্বেরও ।
এসবকে লাশ মনে হয় না; যেন পুড়ে যাওয়া জীবনের ইশারা, নাড়া খেলেই কেঁপে উঠতে পারে। লাশসমূহ যখন উঠান, পুড়ে যাওয়া বাড়ি, পুকুরঘাট, খড়ের ¯তূপ, আমনের আইল পেরোতে থাকে তখনও সংখ্যালঘু নেতাটি সামনে জমা হওয়া সমবেত মানুষজনদের বোঝাতে থাকেন -- ‘এসব অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত। মানুষ পুড়িয়ে মারার কারখানা ফিট করেছে। তারই তেজে দেশ জ্বালানোর ধান্ধা। আমরা ব্যথিত, আমরা নির্যাতিত। এ প্রশ্ন আসে, সম্পদ না-নিয়ে এরা কেন লাশ-পোড়া গন্ধ বিতরণ করল? অসুরের বাচ্চারা এদেশ এ গন্ধে ভরে দিতে চায়।’ শব্দ কিংবা বাক্য নয় যেন ফুসফুসের গভীরে জমটবাঁধা রক্তের স্রোত নিঃসরণ করছেন তিনি। একসময় সমবেত হাততালির ভিতর তিনি বারবার বলতে থাকেন -- ‘কোনোদিন বাংলার মাটিতে এই সব আšতর্জাতিক চক্রান্ত পূরণ করতে দিতে পারি না।’
নিত্যানন্দ এবার ভয়ের কবলে পড়ে, মানুষ-পোড়ার নির্বিচার গন্ধে হুড়মুড় করে অন্যদিকে সরতে চাইলেও গন্ধ তাকে ছাড়ে না। এইসবের ভিতরই নগরীর বড়ো নেতাটি আসেন ব্যাংকের চেক নিয়ে।
লাশের দাম দেয়ার জন্য, গন্ধ চেক করার জন্য ঘন-ঘন শ্বাসের ভাঁজে টাকা শুঁকতে থাকেন তিনি। তিনি বার বার তাকান লাশগুলোর দিকে। এত তীক্ষ চোখে তিনি লাশগুলো পরখ করতে থাকেন যেন সম্ভব হলে দাড়িপাল্লায় ওজন মেপে-মেপে লাশের ঋণ টাকায় শোধ করতেন। নোট আর লাশের লেনদেন মেটাতে দশমিনিটও লাগে না তার। এ যেন মরাপচা থেকে বাঁচার আরেক কৌশল। প্রশাসনের ফাইলপত্র এভাবে গতিশীল হয় যে, যাতে মনে হতে পারে ডাকাতি ছাড়া এটা কিছুই নয়। ডাকাতির উপর যাদের আস্থা নেই, তারা দেশ এবং জাতির শত্রু। এদের উপর আল্লার গজব নাজেল হোক। অতঃপর ঘটনা তদন্তের ভারপ্রাপ্ত এ নেতা বিচারের প্রক্রিয়াটিতে একটা মূর্ত রূপ ফুটিয়ে তোলার দিকে মনোযোগী হন এবং তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন। মুখে, কষের কোনায়, লালার স্তর ভেদ করে, গলার চারপাশের রগ-মাংসপেশি কাঁপিয়েতিনি জানাতে থাকেন -- লাশ নিয়ে রাজনীতির দিন শেষ। ডাকাতদেরকে প্রয়োজনে মাটির তলা থেকে বের করা হবে। রোজ-কেয়ামত পর্যন্ত এ-কাজ চলবে ইনশাল্লাহ।
নগরপিতাও আসেন একসময়। তিনি আসেন সদলবলে। জনস্রোতের অংশ করেন তার এই আগমনকে। তার দলের লোকগুলোকে সঠিক জায়গা দিতে সমবেত জনতা সরে গিয়ে ধীরে ধীরে আশপাশের খালি উঠান, গোপাট, খালি জায়গাসমূহ ভরাট করতে থাকে। কাঁপা কাঁপা গলায়, প্রলম্বিত সুরে, হাহাকারের ভিতর তার স্বনির্মিত হুঙ্কার ছড়াতে থাকে, যেন শ্লোগানের আমেজ বি¯তৃত করতে থাকেন তিনি।
তিনি তার কথাগুলো অত জোর দিয়ে বলেন যাতে নুয়ে-পড়া-মানুষগুলো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং অচিরেই তিনি প্রশাসন বদলের লড়াইয়ে অংশ নিতে পারেন। তাঁর দ্বারা সম্ভব হলে এখনই যেন রাষ্ট্র- ক্ষমতার অদলবদল ঘটিয়ে নিজ হাতে রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিচার করতে পারেন। এবং অল্পসময়ে যেন ফাঁসির দড়িতে লটকাতে চান তিনি।
ঘাম-ঝরা চেষ্টা-তদ্বিরের পরও লাশসমূহকে শনাক্ত করা যায় না। নামহীন মানুষের কতিপয় ¯তূপ পড়ে থাকে চোখের সামনে। এতগুলো লাশের সামনে পড়ে নিত্যানন্দ’র মাথায় নানাবিধ কৌশল গজায়। এবং তা করতে গিয়ে তার জ্ঞানবুদ্ধি পূর্ণমাত্রায় ঘুরপাক খায়। বাবার লাশ মনে করে যার লাশটি বুকের কাছে টেনে নেয় তার মুখটিই অদৃশ্য হয়ে গেছে। অন্য বয়স্ক লাশটি তার মায়ের আদল নিতে গিয়েও পেট- বুকের চওড়া গড়নে তার বড়োভাই সুশান্ত কিংবা বড়োজোর বউদির রূপটিই পায়। সুশান্তদার ছোটমেয়েটিকে কার্তিকের মতো মনে করতে গিয়েও জয়শ্রীর রূপটিই ধারণা করা যায়। মাংস-চর্বি- রক্তের মিলিত স্রোত তার বুকের ভিতরে একপশলা দীর্ঘশ্বাস হয়ে চেপে বসে। একপর্যায়ে তার হুহু কান্নার জোয়ার নামে চোখে। মানুষ পোড়ার ছরছর শব্দ তার মাথায় পিড়পিড় করে চলাচল করে। নুনজলের স্রোত পেরিয়ে অত লাশ আলাদা করে কী করে! অনেক বিবেচনার পর আবারও মা-বাবার বয়স ধরে তাদের শনাক্ত করার ভাবনা আসে। আগুনে পোড়া শরীর হাড্ডি পর্যন্ত না-পৌঁছলেও বুড়া-বুড়ির শরীরে বয়সের তেজ কি আর থাকবে না? যুবক-যুবতীদের শরীরের চিহ্ন, বয়স বা নারীত্বের চিহ্ন কি অবশিষ্ট নেই?
এভাবেই খুঁজতে হয় তাদের। সেই বাচ্চাটা কোথায়, সেই চারদিনের কার্তিক! ও কি আছে এখানে? নাকি মোমের মতো গলে গলে চিরতরে নিভে গেল? একে খুঁজতে গিয়েই সারা শীলপাড়া, এমনকি শোকে- ডুবে-থাকা আত্মীয়-পরিজন নিজেদেরকে শোকের কবলে ফেলতে থাকে। বাবার লাশটা তাঁর সবকটা পড়ে যাওয়া দাঁত আর বাঁ হাতের তালুতে খুর চালানোর শক্ত দাগটা দেখেই শনাক্ত করবে বলে আগে থেকেই ধরে নিয়েছিল নিত্যানন্দ। চোদ্দপুরুষের ব্যবসার একটা চিহ্ন থাকবে না? গোকুইদণ্ডে একটি, হরিশপুরে একটি, কর্ণফুলির ওইপাড়ে একটি চুলকাটার সেলুন দিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের সেলুনটির নাম দিয়েছিল ‘শ্রীযুক্ত গজেন্দ্র হেয়ার কাটিং সেলুন’। বিদেশি স্টাইলে চুলকাটা থেকে চুলের কলপ দেয়া সবই হয় এখানে। শাদা এ্যাপ্রোন পড়া চারটা কর্মচারীকে দেখাশোনা করার জন্য সপ্তাহে অন্ততদুইবার বহদ্দারহাট যাবেই। একসময় তার হাসির তেজে অবশিষ্ট পাঁচটা দাঁতও সমূলে বেরিয়ে পড়ে --
‘ওয়া স্বরস্বতীর মা, কও ত চায়, ভগবানর দুনিয়েত কত লিলে চলের, মানুষুর চুল কাডেয্যে নার্সর কোর্তা পরিয়েরে।’ হাসির কবলে পড়ে কাশির উদ্রেগ হলে কিংবা বুকে কফের জোর বাড়তে থাকলেওসেলুনের দিকে তার নজর থাকত ষোলআনা। ছেলে দুটি বিদেশ থেকে বারবার চিঠি লেখে -- ‘বাবা, তুমি বাপ-দাদার চুল কাটার ঐ ফালতু ব্যবসা ছাড়ো, মেজদা তো স্টক বিজনেস করছেই, তুমি পায়ের উপর পা রেখে পেপার পড়ো আর মাকে নিয়ে চা খাও, আরাম করো।’ কোথায় আরাম কোথায় কী, চুলকাটার আদি ব্যবসা তার আর ছাড়া হয় না। আর এখন তো মরে কাঠের ¯তূপ হয়ে আছে। বাবার কোনো মাঢ়ি বা মুণ্ডুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দলানো-মুচড়ানো একটা কয়লার স্তূপের কাছে গিয়ে একেই তার বাবা বলে শনাক্ত করতে চায়। ৭০ বছর বয়সেও ছানি-পড়া চোখের দুইবার অপারেশন করেও পাই পাই করে জমি-জমার হিসাব নিতে পারত। সেই বাপটাকে এভাবে পুড়িয়ে মারল! স্বাধীনের বছরও তো পাকিস্তানিরা এভাবে মানুষ মারেনি। কীসের বালের স্বাধীন কীসের কী! সাগর-নদী-পাহাড় ঘেরা এই এলাকার পশ্চিম সাইডে কিছু ঘরে খালেক বেপারীর বাবা মালাউন বলে গালিগালাজ করে আগুন দিয়েছিল, মানুষ মেরেছিল -- কিন্তু এভাবে কুত্তা-বিলাইয়ের মতো মানুষ মারার ইতিহাস তো এ এলাকায় নাই। তার বাবাটাকে প্যারালাইসিস রোগীর মতো, অচল মানুষের মতো সারাজীবনের জন্য অকেজো করে রাখতে পারত। মানুষটাকে ওরা এভাবে মেরে ফেলল! কলেজে পড়–য়া মেয়ে দুটিকে খুঁজতে গিয়ে চর্বি আর বয়সের আবরণ চোখে ভাসে সবার আগে।
মেয়ে দুটির এই সৌন্দর্যের সাথে যোগ হয় -- রাস্তায় বকাটে ছেলেদের উৎপাতের স্মৃতি।
একরকম ঘরের ভিতর থেকেই প্রতিদিন পাহারা বসিয়ে, শরীর দেখে, জননৃত্য করতে করতে মোহরমপুরের মাজেদ চেয়ারম্যানের ছোটছেলে আরশ আলী ক্লাশ টেনের বেঞ্চিতে বসিয়ে দিয়ে আসে এবং সে আসার সময় ক্লাশ-টিচারকে এভাবে বুঝিয়ে আসে যে যাতে মনে হবে হ্যাপি শুধু স্কুল টাইমে নয়, অষ্টপ্রহরই আরশ আলীর যৌন-তাপের কন্ট্রোলেই আছে। তার তিন বন্ধুসহ হ্যাপিকে এভাবেই মনুষ্যনির্মিত দেয়াল নির্মাণ করে; বুকে, পাছায়, এমনকি যৌনাঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে স্পর্শ দিতে দিতে এগিয়ে যায়। শীলবাড়ির মেয়েছেলেকে নিয়ে এমন কায়দাকানুন দেখে গোকুইদণ্ডের পুলিশ ফাঁড়ির মাইদুল হকও হাসে। মানুষের চলাচলতি আর আনন্দ-কোলাহলকে পাহারা দেয়া যে তাদের দায়িত্ব তাতে বাগড়া দেয় আরশ আলী -- পুলিশ চাচা, হাসর য্যা কিয়ুর লাই? বেশি হাসিলি ত দাত খুলি পরি যাইবু।
এ্যাক পেকেট সিগেরেট দও চায়। হাঁ-করে থাকে পুলিশের লোকটি। একসময় তিনজনের এ দলটির ঠাঠা হাসিটি ভরাট হতে থাকে পুলিশেরই দেয়া সিগ্রেটের ধোঁয়ায়। পুলিশ হাঁটে মালখানার দিকে।
এসব ইয়ং ব্লাড নিয়ে থাকলে জগৎ-সংসার চলবে? আর একটাকে যদি জোরে একটা ধমক মাওে সে,তবে দেখা যাবে কত রঙের ঠাপানি। আজিজুল স্যার আর মালখানার কইরত আলী তো পারলে এদেরকে কোলে করে নাচে। খয়ের-জর্দার ডাবল-পানটি চিবিয়ে তছনছ করতে-করতে জোরে-জোরে পা ফেলে ফাঁড়ির দিকে।
এ দলটিকেই শায়েস্তা করতে এককিস্তি টাকা পাঠায় কুয়েত নাকি মাস্কাটে চাকুরি করা তার মেঝো দাদা মহেন্দ্র শীল । মণিন্দ্র কাকা কদিন আগেও বলেছিল -- ‘ ওরে বা-জি, এরেইম্যে গরিয়া তোঁ-রা পুলিশের মুক বন্ধ গরিত্ পারিবানা--? এরইম্যে গইত্যো যাইয়ারে তুঁয়ারা ত ফতুর অই যাইবা গই।’
কার্তিকের স্মৃতি উঠানের জটলাটির ভিতর বারবার বিচরণ করতে থাকে। এর বয়স মাত্র চারদিন। গুনগুন করে এই আলাপই অনেকে করতে থাকে -- বাচ্চাটা কী দোষ করেছিল, অসুরের বুনিয়াদ একেও পুড়িয়ে, গন্ধ ছড়িয়ে মারল! শীত আসি-আসি করা কার্তিক মাস-পেরুনো এ’রাতে, দেবতা কার্তিকের মতোই সৌম্যকান্তি চেহারার এ ছেলের নাম জন্মের পরপরই তার দাদীমা কার্তিক রাখে এবং দুটি দাঁত অবশিষ্ট থাকা চুপসে-যাওয়া-ঠোঁট দিয়ে বেদম চুমু খায় -- ওরে আমার দাদুরে তুঁয়ার নাম রাকিদ্যে কাত্তিক। চাঁন-মুইক্যে নাতিগোরে আই কাত্তিক রাইতাম চাইদ্দে।
লাশ সনাক্তকরণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং এর সর্বপর্যায়ে সমবেত কান্না ক্রমশ বাড়ে। তা গন্ধযুক্ত ছোঁয়াচে রোগের মতো সারাটি উঠান, এমনকি সারা শীলপাড়া ছাড়িয়ে বণিকপাড়া, কৈবর্তপাড়া, কুমারপাড়া ছাড়িয়ে চৌদিকে তার হাহাকার বর্ধনশীল হয়। একসময় যেন ভয়ের রায়ট লাগে সবখানে।
বাচ্চাটির লাশ কোথাও নেই। মাত্র চারদিনের বাচ্চাটা মোমের মতো, ধূপের ধোঁয়ার মতো নিভে যায়। লাশগুলোকে উঠানে রাখা হয় তিন ভাগে -- প্রথম ভাগে ৭০ বছরের বৃদ্ধ গজেন্দ্র শীল ও তার স্ত্রী ৬০ বছরের মনোলতা। দ্বিতীয়ভাগে বড়োছেলে বৃন্দাবন, তার বউ সেবাদাসী, ১২, ৭ বছর ও চার দিনের গলে যাওয়া শিশুকে আন্দাজ করে একটা পোঁটলার মতো করে চাটাইয়ে রাখা হয়। একটা লাশ কমই বলতে হয়।
চারদিনের ছেলেটির লাশ কি আসলে পাওয়া গেল? ছ’দিনের দিন কোষ্ঠিপত্র দেখে নাম ঠিক করবে বলে ওরা (দুইজন) এল আর পোড়া-কয়লা হয়ে ইহধাম ত্যাগ করতে হ’ল। কার্তিকও মোম হয়ে গলে গলে কোথায় যে মিশে আছে। তৃতীয় ভাগে থাকে দুই যুবতী -- বর্ণা আর হ্যাপি। আর বেড়াতে আসা দুজনকে তার আত্মীয়-কুটুমরা তাদের বাড়িতে নিয়ে এরই মধ্যে দাহ করে ফেলেছে। লাশের এ ভাগসমূহ করতে হয় শেষকৃত্যের জন্যই। হরিদাসীর মা, কমলের বউ, মণিন্দ্রের স্ত্রী, ঝর্ণার বিধবা জা’টাও তাদের আত্মীয়- কুটুমদের সাজানো ডেডবডি কল্পনা করে গহীন রাতের একলা-শকুনের মতো চুঁইচুঁই করে কাঁদে।
নিত্যানন্দের চোখে একফোঁটা জল নেই -- নিভে যাওয়া কয়লার তাপ চোখের জলও শুষ্ক করে দিয়েছে। পুরোহিত তিনটি ঘটে জল, আম্রপত্র, কাঠি রাখেন। কলাগাছের খোসার ছোট টুকরায় চালেরগুঁড়া দিয়ে লাড়–র মতো পিণ্ড বানায়। কয়েকটি ছেলে দাহের অংশ হিসেবে পুকুর পাড়ে বসে সরু সরু কাঠি বানাতে থাকে। মুখাগ্নি করতে করতেই মনুষ্যবাহিত স্মৃতি ও মানুষ-পোড়া গন্ধ হুহু কান্নায় ভেঙে পড়ে গজেন্দ্র শীলের ছেলে দুটি। নাভিদ কামাল নামের প্রতিবেশিকে জড়িয়ে ধরে নিত্যানন্দ কান্নায় ভেঙে-লুটিয়ে পড়ে -- ‘আঁরা কি লই বাঁইচ্যুম গও ত চায়। মরিই-রে ব্যাকে ত শ্যাষ হই যারগুর।
আঁরার বুককান পুরি ছাই হই যার।’ গন্ধের রায়টের ভিতর ব্রাক্ষণ মন্ত্র পড়েন। নিত্যানন্দ, সুনীল ও হ্যাপী- বর্ণার বাবা সাত বার ঘুরে লাশের চৌদিকে। ফিনকি দিয়ে কান্না আসে সুনীলের, ডানপায়ের ভেঙে যাওয়া হাড়টা সেই কান্নার ধমকে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মরদেহের মাথাপিছু সাতটা করে আম্রকাষ্ঠেরকাঠি ছুঁড়ে মারে জ্বলন্ত চিতায়। বোল হরি বোল বলে সমবেত আওয়াজ দেয়, বাকিরা জোরে জোরে বোল হরি বল বলে। দূরে গাছের ছায়ায় দুই ভাই বসে একসময়। রক্তের ফোঁটার মতো স্নানের জল তাদের গা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে, ভিজে ওঠে বসার জায়গাটা। শোকগীতি তাদের নির্জন কান্নাকে ছুঁয়ে যায়। ঘণ্টাতিনেক তো লাগবে আধপোড়া লাশগুলো দাহ করতে।
শেষকৃত্যও শেষ হতে থাকে ধীরে ধীরে । শোঁ-শোঁ করে আগুনের হলকা নিভে যেতে থাকে।
কয়লাগুলোকে লাঠি দিয়ে দক্ষিণদিকের গর্তে জমা করে। নিত্যানন্দ শ্মশান থেকে ফেরার পথে ঘট থেকে কয়েক আঁচলা মন্ত্রপুত জল ছিটিয়ে দেয় শ্মশানের সেই কয়লার ¯তূপের ওপর। হোস্হোস্ শব্দ
তুলে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি উপরে ওঠে -- কিন্তু এর নাড়িভুঁড়ি থেকে গন্ধটা আসেই। ছাই রং ধোঁয়া
মিশে যায় একসময়। ৯টা লাশ পোড়ার তাপ তখনও বাতাসে ওড়ে বেড়ায়; এরই তাপে নিত্যানন্দ’র শরীরে কাঁপুনি তৈরি হয়। পিণ্ড রেখে দেয় শ্মশানে। দাহের এক খাবলা কয়লা গামছার ভাঁজে লুকিয়ে নেয়, জমা করে রেখে দেয় -- সত্যিই যদি বাপ-দাদার ভিটা ছাড়তে হয়! স্যাঁতসেঁতে ভয়মিশ্রিত কান্না ওর বুকের চারপাশে জমাট বাঁধতে থাকে। মাথাহীন, মুখহীন, ত্বকহীন, রক্তহীন, ছায়াহীন কতগুলো টুকরা টুকরা মানুষ এগিয়ে যায় বাড়িটার দিকে। কে যেন সারা অঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে পোড়া-কয়লার গন্ধ, আগুনের তাপ; এরই ঝাঁজে পড়ে মিশে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কায়দা নিয়ে বাড়িটার দিকে পা বাড়ায় সে। আগুনের তাপে, ধোঁয়ায়, রক্তের কাদায় পা পিছলে যায়। তামাম শরীরে পোড়া-কয়লার গন্ধ ভর করে! আগুনের ভাপ উঠে আসছে ওদের শরীরে, তা থেকে হয়ত বাঁচার জন্যই ওরা দ্রুত পা ফেলে শতছিন্ন
বাড়িটার দিকে ...
জানুয়ারি ২০০৪
লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
তাঁর জন্ম ১৯৬৩-এ, মামাবাড়িতে। কিশোরগঞ্জস্থ বাজিতপুর থানার সরিষাপুর গ্রামে শৈশব- কৈশোর, যৌবনের প্রাথমিক পর্যায় কাটান তিনি। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা করেছেন গ্রাম ও
গ্রামঘেঁষা শহরে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একাডেমিক পড়াশুনা করেন চট্টগ্রামে। লেখাজোখা তাঁর কাছে অফুরন্ত এক জীবনপ্রবাহের নাম। মানুষের অন্তর্জগতে একধরনের প্রগতিশীল বোধ তৈরিতে তাঁর আকাক্সক্ষা লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন জায়গায়--ছোট বা বড়োকাগজে তিনি লিখে যাচ্ছেন।
কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ কথা’র সম্পাদক। কথা সম্পাদনার জন্য তাকে ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ পুরষ্কার ২০১১’ প্রদান করা হয়।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -- মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম (জাগৃতি প্রকাশনী), স্বপ্নবাজি (ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ), কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প (শুদ্ধস্বর)
উপন্যাস-- পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী ’(মাওলা ব্রাদার্স),
প্রবন্ধগ্রন্থ-- উপন্যাসের বিনির্মাণ, উপন্যাসের জাদু (জোনাকী)।
নিত্যানন্দ’র মগজে আবারও মানুষ-পোড়া-গন্ধ জেগে ওঠে এবং তা কুকুরের একটানা হুই্ইয়ো কান্নার ধরনে বিচরণশীল হয়। ঠিক কখন থেকে এ গন্ধ তার মাথার ভিতরে চলাচল শুরু করেছে, এ ভাবনার সঠিক হিসাব মেলাতে গিয়ে সে তার বাবা কিংবা দাদার স্মৃতিবিষয়ক কথাও স্মরণ করে। এমন সিদ্ধান্তেই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যে, এসব মূলত সে বহন করে তার বহুকাল থেকে এবং তারই ক্রমধারায় তা তার বাবার বাবার মগজে খোঁদাই হয়। সেসবও তো ৩০/৩৫ বছর কিংবা তারও আগের কথা।
পুবদুয়ারযুক্ত বাড়িটার দোতলা ঘরের উপর-নিচে চারে চারে মোট আটটা রুম। মানুষ- পোড়া গন্ধ, আগুনের হলকা, অঘ্রানের এই বাতাসে বিচরণশীল। এবং এ গন্ধ ঠিকানাহীন হয়েই থাকে। এরই ভারে যেন রুম থেকে রুমে যাওয়ার দেয়ালসমূহ ভেঙেচুরে, দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাওয়া ঘরটির দোতলায় উঠার একটা সিঁড়ি মাটির, আরেকটি গাছের ডালপালার। মাটির সিঁড়িটায় এঁটে দেয়া আছে কাঠের শক্ত দরজা -- আগুনের তাপ এখানেও আছে। বাড়িটির সামনে লম্বা মাঠ, সামনের এ মাঠটিতে শিশির-শুষ্ক-গন্ধ নিয়ে, আমন ধানের থোড়ের ভরসা নিয়ে, ভরাট হয়ে আছে। এ গ্রামের রাস্তা বেরয় বাড়িটির উঠানের বুক ঘেঁষে ঘেঁষে -- এখন থেকে তা আবারও আগুনের তাপে মৃদু কাঁপুনিতে নড়ে। রোদ বাড়ে রক্তের শুষ্ক ঘ্রাণ চুঁইয়ে চুঁইয়ে। কয়লার ¯তূপের মতো পড়ে থাকা লাশগুলোর উপর কেঁপে কেঁপে আলো ছড়ায়।
ফজরের আজানে হামলে পড়ে মধ্যরাতের রোদনব্যাকুল চিৎকার -- পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়া, দোকানদারপাড়া, বণিকপাড়া, কুমারপাড়া থেকে ’শ ’শ মানুষ হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকে শীলপাড়ার বাড়িটাতে। পশ্চিম সাধনপুর, পালেগ্রাম, কালীপুর, বৈলছড়ি, কোকদণ্ডী, বাণীগ্রাম, জলদি, চাম্বল, গুনাগরি, নাপোড়া, খানখানাবাদ উজাড় করে মানুষের স্রোত বয়। এমনকী তৈলাদ্বারদ্বীপ থেকেও মানুষের জোয়ার আসে; তারা কর্নফুলি পার হয় ফেরিতে। সেই লোকগুলো অত জোরে আর ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছে যেন গলায় আটকা পড়া বারুদের বা গান-পাউডারের ঘ্রাণ তাড়াচ্ছে। এভাবেই যেন নিজেদেরকে সতেজও রাখা যায়। দেয়ালে দেয়ালে মাংস-হাড্ডি-নাড়িভুঁড়ি পোড়ার গন্ধ এখনও লেগে আছে।
নিত্যানন্দ’র গলা-চোখ-মুখ-বুক পেরিয়ে তার সর্বাঙ্গ কান্নায় ভরাট হয়ে যায়; কথার ফাঁকফোকরে গো গো শব্দ জমাট হয়। দুপদাপ করে আসতে থাকা মানুষের পদগুঞ্জনে তার কান্নাকে আরও দীর্ঘজীবী করে। তাদের স্মৃতিতে তখনও আছে ডাকাত ডাকাত চিৎকার, কেয়ামতের হল্লা। আগুনে মানুষ পোড়া গন্ধটি তারাও বহন করে। তামাম অঞ্চল কি আগুনের, বারুদের, গোলাগুলির, যেন কিরিচের ঝিলিক বিলানোর লিজ নিয়ে ফেলল।
বাড়িটিতে মানুষ-পোড়ার লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে তিনদিন হ’ল এবং এর প্রতিবেশি এমনকি গ্রামের লোকগুলোকে ধোঁয়া-বারুদের গন্ধমেশানো বিহ্বলতায় সঁপে দিয়ে ১১টা মানুষ মরে-পুড়ে কাঠ হয়ে গেছে। এমনই কায়দায় এদের পুড়িয়ে দেয়া হ’ল যেন দাহের প্রয়োজন নেই -- এ থেকে সৃষ্ট্রর গন্ধ বিস্তৃত হচ্ছে কেবলই। মানুষগুলোর আলাদা নাম মুছে গেছে। গন্ধের জন্য বাড়িটার দোতলায়ও উঠার প্রয়োজন নেই -- এর উঠান, এমনকি গ্রাম থেকে ছিনতাইয়ে পড়া মানুষের চিৎকারের মতো, নিশি-পাওয়া মানুষের মতো ঝিমুতে ঝিমুতে নাকের একেবারে গভীরে তা যাতায়ত করতে থাকে।
তা টের পাওয়ার আগেই নিত্যানন্দ’র শরীরে অনেক দূর থেকে আসা আগুনের ভাপ লাগে -- যেন তার ভাবনাব্যাকুল মন এরই তাপে গলে গলে পড়ে। উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আগুনের ঝাঁজে কয়লা হওয়া লাউ ডগার দিকে তাকিয়ে এখনও হরিদাসীর বোনঝি কমলা শীল সে-রাতের আগুনের রূপ অনুভব করে -- তা ছিল ঘনমেঘের মতো ধোঁয়াটে; এতে দশহাত দূরের মানুষও ঘনধোঁয়ায় আটকা পড়ে। এরা সে- রাতের ডাকাতি কিংবা হত্যাকাণ্ড অথবা এসবের মিলিত স্মৃতির কবলে পড়ে বারবার। সেই ভারেই যেন বাড়িটার স্থানে স্থানে লালচে খাবলার মতো ক্ষত চোখে পড়ে -- মাটির দেয়াল ক্ষণে ক্ষণে ক্ষয়েই যায়।
দোতলার রুমগুলোতে হঠাৎ-ফেটে-যাওয়া ডিমের কুসুমের মতো আলো আসে। ঘরটিতে মানুষ’রা দুড়মুড় করে হাঁটে। নানাপদের চিৎকার, হাহাকার জমে আছে সবখানে -- উত্তর দিকের রুমটাতে পৌঁছলে গোঙানি আরও জোরে হানা দেয়। এখানকার একটা জানালা দিয়েই সেই রাতে সুনীল পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু তার ডান পাটি একটা গাছে আঘাত লেগে ভেঙে একেবারে থেঁতলে গেছে।
সেই জানালাটি এখনও ঝুলে আছে মাটির লালচে দেয়ালে -- মানুষ- পোড়াগন্ধ নিয়ে। নিত্যানন্দ’র শরীরে বা ধুলাবালিতে বা মটির ঘরের দেয়ালে আবারও আগুনের হলকা লাগে। জানালাটি নিত্যানন্দ’র দাদার বাবার আমলের -- সে-সবই জনস্রোতের সামনে শুষ্ক কান্নার প্রলেপে প্রকাশ পায় । নিত্যানন্দ’র এসব বর্ণনার প্রবাহে এ বাড়িতে আসা লোকগুলো ক্ষণে ক্ষণে মাথা ঝাঁকায়। পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো দোতলার এদিকটাই বেশি দাপাদাপি করেছিল বলে ধারণা হতে পারে।
লাশগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকলেও তাদের দাপাদাপির মিলিত চেষ্টাও এদিকেই ব্যাপৃত হয়। একটা চাপা গোঙানি ছড়িয়ে থাকে -- সেই গোঙানির কবলে পড়ে নিজেকে ষোলআনা সজাগ রাখে নিত্যানন্দ। এমনকি মনুষ্যনির্মিত ছটফটানি, গোঙানি, দাপাদাপি, চিৎকার স্মরণে আসে বারবার। এককসময় নীরবতা নামে এবং তা স্বল্পসময় ভ্রাম্যমাণও থাকে। মাংস, হাড়ি-পাতিল, মাটির দেয়াল কিংবা শুষ্ক কান্নার তাপে অন্য এক গন্ধ নিয়ে তার নাক বেয়ে বেয়ে মাথার ভিতরে গুনগুনিয়ে কান্নার মতো সুর তোলে। এবং আলোর প্রতিধ্বনির কবলে পড়ে জনস্রোতের ব্যাকুলতা বাড়ায় । নিত্যানন্দ সকালটা পরখ করে আবার -- সামনের ধানক্ষেত, পুকুর, স্নানঘাট দিয়ে বণিকপাড়া, কুমারপাড়া হয়ে বড়োরাস্তার সাথে মিলে যাওয়া কাচা রাস্তাটাও বদলে যাচ্ছে। সবখানেই লাশ পোড়া তীক্ষ্ণগন্ধ।
একসময় সশস্ত্র ফর্মান তেড়ে আসে -- ‘তাড়াতাড়ি নামেন, দেখাদেখির তামাশা শেষ করেন, উপরের অর্ডার আছে, বাড়িটি সিল করতে হবে -- ফর আনলিমিটেড পিরিয়ড।’ যেন একবারের হুকুমে
কোনো কাজই হবে না; তাই গলার স্বরটি আবারও শোনা যায়। সকালের আলোয় তার সদ্য ক্লিন সেভ করা মুখে আলোর ঝলকানি এলোমেলো হয়ে ঝরতে থাকে। খালেক বেপারী তার কানে কানে বলে যেতে থাকে -- হালার মালাউন গো কারবার দেকলেন, ডাকাতগো আটকানির লাইগ্যে দুতলায় কেমুন মোটাতাজা দরজা-জানালা ফিট করছে? ৫/৭ জন জোয়ান-মর্দও তা খোলার বুদ্ধি পায়? মৃত মানুষজনের শরীরের কাচাকাচা গন্ধের লোভেই যেন বেপারী জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
গজেন্দ্র শীলের বেঁচে-যাওয়া কম্পাউন্ডার ছেলে সুনীল তার রক্তের ধারায় যেন ভয়ের থাবা টের পায় এবং তারই ধারাবাহিকতায় সরকারের কাছে আবেদন রেখেছে নগরীতে একটা বাড়ি দানের জন্য।
তার মানে তার নেশা যখন শহরের উপর পড়েছে তা হলে ধরে নিতে হয়, বাপ-দাদার ভিটার প্রতি তাদের মায়া- মহব্বতেরও ভাটা পড়েছে। তাহলে এই মরমী-উদ্যোগে খালেক বেপারী কেন সাহায্য করবে না! দশগ্রামের মুরুব্বি হিসেবে তার একটা দায়িত্ব আছে তো। প্রতিবেশির মান-ইজ্জত দেখার ভারটা তো তাকেই নিতেই হয়। সরকার বাড়ি না-দিক, এই কাজে সেও তো সাহায্য করতে পারে।
বাড়িটা যে সিস্টেমে ডাকাতিটা হ’ল, মানুষদেরকে একাত্তরের যুদ্ধের বছর, শাক-সবজির ভাজির মতো, শ্মশানে পোড়ানোর মতো কয়লা বানিয়ে দিল -- তাহলে সেই বাড়িটাও তো একহিসাবে দূষিতই। ঠিক কিনা? ঘটনা ঘটে গেল তো রাতেই। তা দিনেরও হতে পারত। খালেক বেপারীর সাথে সাথে চলা কেরামতালী জহুর মিঞা ভাবতে থাকে, এ বাড়ির লোকগুলোকে যেভাবে চন্দাই-নন্দাই করতে দেখা যাওয়া শুরু করে তাতে এমনই হওয়ার কথা। টাকায়, বুদ্ধিতে, পড়াশোনায় এমনকি সৌদি রিয়েল রোজগারে তাদের ধারেকাছে এখন কেউ ভিড়তে পারে না, তাহলে এতগুলো যোগ্যতার ভিতর অ্যাটাক আসতে এত দেরি কেন হ’ল, এমন বিস্ময়ও কারও কারও স্মৃতিতে পোষে এবং পুনশ্চ: বিহ্বলতায় পড়ে। সোনাদানা-ধনের গন্ধ ডাকাতের নজরে পড়ে কি? শালার নাপিতের জ্ঞাতিগোষ্ঠী চোখের সামনে কী মাতব্বরিটা দেখায়! বস্তার বস্তা টাকা কামাই করে আর ইন্ডিয়ায় পাস করে, কিছু টাকাকড়ি ডাকাতির খাতে খরচ হবে তাতেই শালাগোর পাছা ফেটে যায়।
একসময় মানুষ পোড়া মিহিগন্ধ ঘিরে ফেলে সারাটা উঠান এবং কান্না ভিড় করতে থাকে প্রবলবেগে। ধূপের ভাপে ঝুরঝুরে কান্নাটা আরও ক্রিয়াশীল হয়। পুড়ে-যাওয়া-ঘরের মাটির দোতলায় তা লটকে থাকা ঘরের মতো জীবন্ত হতে থাকে। পুলিশের খাতায় নাকি আগুনের কারণ হিসাবে পেট্রোল বা গান-পাউডারের চিহ্ন লিখিত হয়ে গেছে। এভাবেই শীলপাড়া কাঠকয়লার মতো পুড়ে যাওয়া বাড়িটা স্মৃতির কবলে পড়তে থাকে। আত্মীয়-পরিজন ও নিত্যানন্দ ঝড়ে ভাঙা গাছের গোড়ার মতো ঝিম ধরে থাকে এবং একসময় উঠানে লুটিয়ে পড়ে।
বাড়িটা ঘিরে গুঞ্জনময় নানাবিধ কোলাহল বাড়ে। একসময় সারাটি শীলপাড়া ডাকাতি আর পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের যৌথভার বহন করতে থাকে। হত্যাযজ্ঞটি ডাকাতি নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড -- এই বিবেচনা চূড়ান্ত করতে গিয়ে গজেন্দ্র শীলের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে থাকা লোকগুলো ক্রমশ বহুধাবিভক্ত হতে থাকে। এমনকি চিন্তা-ভাবনা করার ধরনও প্রথমত দ্বৈত রূপ পায় এবং ক্রমশ তা বর্ধনশীল আর বহুব্রীহি হতে থাকে। অনেকের আরও ভাবনা বাড়ে -- ডাকাতি করতে ব্যর্থ হয়েই কি এমন একটা নৃশংসতার দিকে ডাকাতরা নিজেদেরকে নিয়োজিত করল? এসব খানাখন্দ বেয়ে বহুবিধ সম্ভাবনা চারপাশে গল্প-গুজবে রূপ নিতে থাকে -- সম্ভাবনাসমূহকে নিুরূপে দেখা যায় --
১. এটি স্রেফ ডাকাতি
২. পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
৩. ডাকাতি এবং হত্যাকাণ্ড দুই-ই
৪. ডাকাতির সাথে কোনো হিংসা মিশে গেছে
৫. সংখ্যালঘু নিশ্চিহ্ন করার এক আন্তর্জাতিক কারসাজি।
৬. কিংবা এসবের মিলিত ভাবনার কবলে পড়ে নিরাকার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।
হত্যাকাণ্ড যদি পরিকল্পিতই না হবে তবে গান-পাউডার বা পেট্রোলই-বা কোথায় পাবে। এ কাজটি কেন পরিকল্পিতভাবে করবে তা ভাবতে গিয়ে আরও কিছু ভাবনায় তাদের জড়াতে হয়। গজেন্দ্র শীলরা কি পুরানা আমলের বড়োলোক যে ধনে-মানে অফুরন্ত ভাণ্ডার নিয়ে বসে আছে? অনেকের ভাবনায় মেয়েমানুষজনিত লালসার ইশরাকেও বাদ দিতে পারে না। এভাবে বিবিধ ধরনের গবেষণা চলমান থাকে। আরও তো দু’তিনবার ডাকাতি করতে এল, শালারা তো বাড়িটার দোতলায়ই উঠতেই পারেনি।
একে তো কাঠের সিঁড়িটি উঠিয়ে নিয়েছে আবার মাটির সিঁড়িটি অত শক্ত যে তা ভাঙতেই পারেনি। জনস্রোতের ভাবনা এমনও হয়, তারা যে গান-পাউডার বা পেট্রোল এনেছিল তার প্রমাণ কি? পুলিশের রিপোর্ট নিয়েও আলোচনা চলে দীর্ঘসময়। খালেক বেপারী কি জানে না ওদের মতো
মালাউনদের দু’চারটা ধমক কী লাগানো এমন ব্যাপার? পুলিশ ফাঁড়ির বিষয়টা নিত্যানন্দ’র চিন্তায় বারবার আসা উচিৎ বলে কেউ কেউ বলে। যতই পুলিশ ফাঁড়িটি এই আক্রমণকে অদৃশ্য রাখতে চায় ততই ডাকাতদলের আক্রমণ বিদ্যুতের নিশানার মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। ফাঁড়ির হাবিলদারটি পত্রিকার সাংবাদিকদের জানাতে থাকে, ডাকাতদলটি তাদের ফাঁড়ি থেকে কমপক্ষে একশ গজ দূর দিয়ে মেইন রোডের দক্ষিণ দিকে চলে যায়। এমনকি তারা গ্রাম্য-পাহাড়া থেকেও দূর দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। গোকুইদণ্ডির পুলিশ-ফাঁড়ির এমন আর্জিকে হেসে উড়িয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা-কমান্ডার মুক্তার হোসেন -- হায়রে পুলিশ! ডাকাতের পাদের শব্দে বেটারা যেই একটা দৌড় দিল হাহাহা। তিনজন পাহারাদারকে বেঁধে ফেলল কি ওদের বাপজান? জীবনের এমনই বহুবিধ গুপ্তরূপ নিত্যানন্দ’র বিবেচনায় ক্ষণে ক্ষণে আসে । সমন্বিত ভয়ের স্পর্শ লাগে এতে।
খালেক বেপারী এভাবেই তার চলাচল বজায় রাখছেন, যেন সব জায়গা থেকে বাড়তি ভয়, মাংশ, চামড়া কিংবা চর্বিআশ্রিত কয়লার গন্ধ, আগুনে পোড়ে যাওয়া স্মৃতিকে ধুয়ে-মুছে সাফ করার দিকে মনোযোগী হয় আহাম্মক এলাকাবাসী। যত যতœ করেই মরুক এরা, লাশ তো লাকড়ি দিয়ে পোড়াবেই, তাহলে এই লাশগুলো নিয়ে অত গবেষণার কী আছে? যে নিয়ম-শৃঙ্খলার ভিতর বাড়িটি পুড়ানো হলো, তা দেখেও তো বলা যায় তাদেরকে অন্তত এই শীলপাড়ায় থাকার চিন্তা বাদ দিতে হবে। শুধু কি মানুষ মরল, বাড়ি-ঘর, তুলসিতলা, নৈবেদ্য পুড়েও শেষ হয়ে গেল, তাহলে আর কি নিয়ে থাকবে এরা? দেশত্যাগের চিন্তা তো মাথায় যাতায়ত করতেই পারে । বারুদের জলজ্ব্যান্ত একটা ¯তূপে মরার মতো পড়ে থাকার ফায়দাটা কী! খালেক বেপারীর জ্ঞানবুদ্ধির শুধু এই সাধারণ বিষয়টিই বুঝুক এরা। শবদেহ উঠানে দাহের জন্য প্রস্তুত করার সময় শুধু, পারিবারিক শ্মশানেও খালেক বেপারী তীব্র নিরবতার মতো ফিসফিসিয়ে বলে -- ‘ওয়া নিত্য, তুঁয়ারা ইক্যিনি গরি ভাবি চও। এত প্যাঁচর মইধ্যি থাকনর কুনো দরকার আছে না? ইক্যিনি গরি মাথা ঘামাই চও।’ যেন রাষ্ট্রের বাইরের কারও সঙ্গেই শুধু কথা বলছেন না, একটা বাড়তি উটকো ঝামেলা তাড়াচ্ছেন -- এভাবেই খালেক বেপারী তার কথা শেষ করে নিত্যানন্দের দিকে তাকিয়ে থাকে। কর্ণফুলির তীব্রস্রোতের মতো এই কথাসমূহ নিত্যানন্দ’র সারাটা মগজে যাতায়তকরতে থাকে। ঘটনাটি শুধু বেবুঝের মতো হাঁ-হুতাশ করার বা হাত-পা ছেড়ে বসে থাকার বা শোনার জন্য নয়, বহন করার জন্যও; তা দেখার এবং দীর্ঘস্থায়ীত্বেরও ।
এসবকে লাশ মনে হয় না; যেন পুড়ে যাওয়া জীবনের ইশারা, নাড়া খেলেই কেঁপে উঠতে পারে। লাশসমূহ যখন উঠান, পুড়ে যাওয়া বাড়ি, পুকুরঘাট, খড়ের ¯তূপ, আমনের আইল পেরোতে থাকে তখনও সংখ্যালঘু নেতাটি সামনে জমা হওয়া সমবেত মানুষজনদের বোঝাতে থাকেন -- ‘এসব অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত। মানুষ পুড়িয়ে মারার কারখানা ফিট করেছে। তারই তেজে দেশ জ্বালানোর ধান্ধা। আমরা ব্যথিত, আমরা নির্যাতিত। এ প্রশ্ন আসে, সম্পদ না-নিয়ে এরা কেন লাশ-পোড়া গন্ধ বিতরণ করল? অসুরের বাচ্চারা এদেশ এ গন্ধে ভরে দিতে চায়।’ শব্দ কিংবা বাক্য নয় যেন ফুসফুসের গভীরে জমটবাঁধা রক্তের স্রোত নিঃসরণ করছেন তিনি। একসময় সমবেত হাততালির ভিতর তিনি বারবার বলতে থাকেন -- ‘কোনোদিন বাংলার মাটিতে এই সব আšতর্জাতিক চক্রান্ত পূরণ করতে দিতে পারি না।’
নিত্যানন্দ এবার ভয়ের কবলে পড়ে, মানুষ-পোড়ার নির্বিচার গন্ধে হুড়মুড় করে অন্যদিকে সরতে চাইলেও গন্ধ তাকে ছাড়ে না। এইসবের ভিতরই নগরীর বড়ো নেতাটি আসেন ব্যাংকের চেক নিয়ে।
লাশের দাম দেয়ার জন্য, গন্ধ চেক করার জন্য ঘন-ঘন শ্বাসের ভাঁজে টাকা শুঁকতে থাকেন তিনি। তিনি বার বার তাকান লাশগুলোর দিকে। এত তীক্ষ চোখে তিনি লাশগুলো পরখ করতে থাকেন যেন সম্ভব হলে দাড়িপাল্লায় ওজন মেপে-মেপে লাশের ঋণ টাকায় শোধ করতেন। নোট আর লাশের লেনদেন মেটাতে দশমিনিটও লাগে না তার। এ যেন মরাপচা থেকে বাঁচার আরেক কৌশল। প্রশাসনের ফাইলপত্র এভাবে গতিশীল হয় যে, যাতে মনে হতে পারে ডাকাতি ছাড়া এটা কিছুই নয়। ডাকাতির উপর যাদের আস্থা নেই, তারা দেশ এবং জাতির শত্রু। এদের উপর আল্লার গজব নাজেল হোক। অতঃপর ঘটনা তদন্তের ভারপ্রাপ্ত এ নেতা বিচারের প্রক্রিয়াটিতে একটা মূর্ত রূপ ফুটিয়ে তোলার দিকে মনোযোগী হন এবং তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন। মুখে, কষের কোনায়, লালার স্তর ভেদ করে, গলার চারপাশের রগ-মাংসপেশি কাঁপিয়েতিনি জানাতে থাকেন -- লাশ নিয়ে রাজনীতির দিন শেষ। ডাকাতদেরকে প্রয়োজনে মাটির তলা থেকে বের করা হবে। রোজ-কেয়ামত পর্যন্ত এ-কাজ চলবে ইনশাল্লাহ।
নগরপিতাও আসেন একসময়। তিনি আসেন সদলবলে। জনস্রোতের অংশ করেন তার এই আগমনকে। তার দলের লোকগুলোকে সঠিক জায়গা দিতে সমবেত জনতা সরে গিয়ে ধীরে ধীরে আশপাশের খালি উঠান, গোপাট, খালি জায়গাসমূহ ভরাট করতে থাকে। কাঁপা কাঁপা গলায়, প্রলম্বিত সুরে, হাহাকারের ভিতর তার স্বনির্মিত হুঙ্কার ছড়াতে থাকে, যেন শ্লোগানের আমেজ বি¯তৃত করতে থাকেন তিনি।
তিনি তার কথাগুলো অত জোর দিয়ে বলেন যাতে নুয়ে-পড়া-মানুষগুলো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং অচিরেই তিনি প্রশাসন বদলের লড়াইয়ে অংশ নিতে পারেন। তাঁর দ্বারা সম্ভব হলে এখনই যেন রাষ্ট্র- ক্ষমতার অদলবদল ঘটিয়ে নিজ হাতে রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিচার করতে পারেন। এবং অল্পসময়ে যেন ফাঁসির দড়িতে লটকাতে চান তিনি।
ঘাম-ঝরা চেষ্টা-তদ্বিরের পরও লাশসমূহকে শনাক্ত করা যায় না। নামহীন মানুষের কতিপয় ¯তূপ পড়ে থাকে চোখের সামনে। এতগুলো লাশের সামনে পড়ে নিত্যানন্দ’র মাথায় নানাবিধ কৌশল গজায়। এবং তা করতে গিয়ে তার জ্ঞানবুদ্ধি পূর্ণমাত্রায় ঘুরপাক খায়। বাবার লাশ মনে করে যার লাশটি বুকের কাছে টেনে নেয় তার মুখটিই অদৃশ্য হয়ে গেছে। অন্য বয়স্ক লাশটি তার মায়ের আদল নিতে গিয়েও পেট- বুকের চওড়া গড়নে তার বড়োভাই সুশান্ত কিংবা বড়োজোর বউদির রূপটিই পায়। সুশান্তদার ছোটমেয়েটিকে কার্তিকের মতো মনে করতে গিয়েও জয়শ্রীর রূপটিই ধারণা করা যায়। মাংস-চর্বি- রক্তের মিলিত স্রোত তার বুকের ভিতরে একপশলা দীর্ঘশ্বাস হয়ে চেপে বসে। একপর্যায়ে তার হুহু কান্নার জোয়ার নামে চোখে। মানুষ পোড়ার ছরছর শব্দ তার মাথায় পিড়পিড় করে চলাচল করে। নুনজলের স্রোত পেরিয়ে অত লাশ আলাদা করে কী করে! অনেক বিবেচনার পর আবারও মা-বাবার বয়স ধরে তাদের শনাক্ত করার ভাবনা আসে। আগুনে পোড়া শরীর হাড্ডি পর্যন্ত না-পৌঁছলেও বুড়া-বুড়ির শরীরে বয়সের তেজ কি আর থাকবে না? যুবক-যুবতীদের শরীরের চিহ্ন, বয়স বা নারীত্বের চিহ্ন কি অবশিষ্ট নেই?
এভাবেই খুঁজতে হয় তাদের। সেই বাচ্চাটা কোথায়, সেই চারদিনের কার্তিক! ও কি আছে এখানে? নাকি মোমের মতো গলে গলে চিরতরে নিভে গেল? একে খুঁজতে গিয়েই সারা শীলপাড়া, এমনকি শোকে- ডুবে-থাকা আত্মীয়-পরিজন নিজেদেরকে শোকের কবলে ফেলতে থাকে। বাবার লাশটা তাঁর সবকটা পড়ে যাওয়া দাঁত আর বাঁ হাতের তালুতে খুর চালানোর শক্ত দাগটা দেখেই শনাক্ত করবে বলে আগে থেকেই ধরে নিয়েছিল নিত্যানন্দ। চোদ্দপুরুষের ব্যবসার একটা চিহ্ন থাকবে না? গোকুইদণ্ডে একটি, হরিশপুরে একটি, কর্ণফুলির ওইপাড়ে একটি চুলকাটার সেলুন দিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের সেলুনটির নাম দিয়েছিল ‘শ্রীযুক্ত গজেন্দ্র হেয়ার কাটিং সেলুন’। বিদেশি স্টাইলে চুলকাটা থেকে চুলের কলপ দেয়া সবই হয় এখানে। শাদা এ্যাপ্রোন পড়া চারটা কর্মচারীকে দেখাশোনা করার জন্য সপ্তাহে অন্ততদুইবার বহদ্দারহাট যাবেই। একসময় তার হাসির তেজে অবশিষ্ট পাঁচটা দাঁতও সমূলে বেরিয়ে পড়ে --
‘ওয়া স্বরস্বতীর মা, কও ত চায়, ভগবানর দুনিয়েত কত লিলে চলের, মানুষুর চুল কাডেয্যে নার্সর কোর্তা পরিয়েরে।’ হাসির কবলে পড়ে কাশির উদ্রেগ হলে কিংবা বুকে কফের জোর বাড়তে থাকলেওসেলুনের দিকে তার নজর থাকত ষোলআনা। ছেলে দুটি বিদেশ থেকে বারবার চিঠি লেখে -- ‘বাবা, তুমি বাপ-দাদার চুল কাটার ঐ ফালতু ব্যবসা ছাড়ো, মেজদা তো স্টক বিজনেস করছেই, তুমি পায়ের উপর পা রেখে পেপার পড়ো আর মাকে নিয়ে চা খাও, আরাম করো।’ কোথায় আরাম কোথায় কী, চুলকাটার আদি ব্যবসা তার আর ছাড়া হয় না। আর এখন তো মরে কাঠের ¯তূপ হয়ে আছে। বাবার কোনো মাঢ়ি বা মুণ্ডুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দলানো-মুচড়ানো একটা কয়লার স্তূপের কাছে গিয়ে একেই তার বাবা বলে শনাক্ত করতে চায়। ৭০ বছর বয়সেও ছানি-পড়া চোখের দুইবার অপারেশন করেও পাই পাই করে জমি-জমার হিসাব নিতে পারত। সেই বাপটাকে এভাবে পুড়িয়ে মারল! স্বাধীনের বছরও তো পাকিস্তানিরা এভাবে মানুষ মারেনি। কীসের বালের স্বাধীন কীসের কী! সাগর-নদী-পাহাড় ঘেরা এই এলাকার পশ্চিম সাইডে কিছু ঘরে খালেক বেপারীর বাবা মালাউন বলে গালিগালাজ করে আগুন দিয়েছিল, মানুষ মেরেছিল -- কিন্তু এভাবে কুত্তা-বিলাইয়ের মতো মানুষ মারার ইতিহাস তো এ এলাকায় নাই। তার বাবাটাকে প্যারালাইসিস রোগীর মতো, অচল মানুষের মতো সারাজীবনের জন্য অকেজো করে রাখতে পারত। মানুষটাকে ওরা এভাবে মেরে ফেলল! কলেজে পড়–য়া মেয়ে দুটিকে খুঁজতে গিয়ে চর্বি আর বয়সের আবরণ চোখে ভাসে সবার আগে।
মেয়ে দুটির এই সৌন্দর্যের সাথে যোগ হয় -- রাস্তায় বকাটে ছেলেদের উৎপাতের স্মৃতি।
একরকম ঘরের ভিতর থেকেই প্রতিদিন পাহারা বসিয়ে, শরীর দেখে, জননৃত্য করতে করতে মোহরমপুরের মাজেদ চেয়ারম্যানের ছোটছেলে আরশ আলী ক্লাশ টেনের বেঞ্চিতে বসিয়ে দিয়ে আসে এবং সে আসার সময় ক্লাশ-টিচারকে এভাবে বুঝিয়ে আসে যে যাতে মনে হবে হ্যাপি শুধু স্কুল টাইমে নয়, অষ্টপ্রহরই আরশ আলীর যৌন-তাপের কন্ট্রোলেই আছে। তার তিন বন্ধুসহ হ্যাপিকে এভাবেই মনুষ্যনির্মিত দেয়াল নির্মাণ করে; বুকে, পাছায়, এমনকি যৌনাঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে স্পর্শ দিতে দিতে এগিয়ে যায়। শীলবাড়ির মেয়েছেলেকে নিয়ে এমন কায়দাকানুন দেখে গোকুইদণ্ডের পুলিশ ফাঁড়ির মাইদুল হকও হাসে। মানুষের চলাচলতি আর আনন্দ-কোলাহলকে পাহারা দেয়া যে তাদের দায়িত্ব তাতে বাগড়া দেয় আরশ আলী -- পুলিশ চাচা, হাসর য্যা কিয়ুর লাই? বেশি হাসিলি ত দাত খুলি পরি যাইবু।
এ্যাক পেকেট সিগেরেট দও চায়। হাঁ-করে থাকে পুলিশের লোকটি। একসময় তিনজনের এ দলটির ঠাঠা হাসিটি ভরাট হতে থাকে পুলিশেরই দেয়া সিগ্রেটের ধোঁয়ায়। পুলিশ হাঁটে মালখানার দিকে।
এসব ইয়ং ব্লাড নিয়ে থাকলে জগৎ-সংসার চলবে? আর একটাকে যদি জোরে একটা ধমক মাওে সে,তবে দেখা যাবে কত রঙের ঠাপানি। আজিজুল স্যার আর মালখানার কইরত আলী তো পারলে এদেরকে কোলে করে নাচে। খয়ের-জর্দার ডাবল-পানটি চিবিয়ে তছনছ করতে-করতে জোরে-জোরে পা ফেলে ফাঁড়ির দিকে।
এ দলটিকেই শায়েস্তা করতে এককিস্তি টাকা পাঠায় কুয়েত নাকি মাস্কাটে চাকুরি করা তার মেঝো দাদা মহেন্দ্র শীল । মণিন্দ্র কাকা কদিন আগেও বলেছিল -- ‘ ওরে বা-জি, এরেইম্যে গরিয়া তোঁ-রা পুলিশের মুক বন্ধ গরিত্ পারিবানা--? এরইম্যে গইত্যো যাইয়ারে তুঁয়ারা ত ফতুর অই যাইবা গই।’
কার্তিকের স্মৃতি উঠানের জটলাটির ভিতর বারবার বিচরণ করতে থাকে। এর বয়স মাত্র চারদিন। গুনগুন করে এই আলাপই অনেকে করতে থাকে -- বাচ্চাটা কী দোষ করেছিল, অসুরের বুনিয়াদ একেও পুড়িয়ে, গন্ধ ছড়িয়ে মারল! শীত আসি-আসি করা কার্তিক মাস-পেরুনো এ’রাতে, দেবতা কার্তিকের মতোই সৌম্যকান্তি চেহারার এ ছেলের নাম জন্মের পরপরই তার দাদীমা কার্তিক রাখে এবং দুটি দাঁত অবশিষ্ট থাকা চুপসে-যাওয়া-ঠোঁট দিয়ে বেদম চুমু খায় -- ওরে আমার দাদুরে তুঁয়ার নাম রাকিদ্যে কাত্তিক। চাঁন-মুইক্যে নাতিগোরে আই কাত্তিক রাইতাম চাইদ্দে।
লাশ সনাক্তকরণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং এর সর্বপর্যায়ে সমবেত কান্না ক্রমশ বাড়ে। তা গন্ধযুক্ত ছোঁয়াচে রোগের মতো সারাটি উঠান, এমনকি সারা শীলপাড়া ছাড়িয়ে বণিকপাড়া, কৈবর্তপাড়া, কুমারপাড়া ছাড়িয়ে চৌদিকে তার হাহাকার বর্ধনশীল হয়। একসময় যেন ভয়ের রায়ট লাগে সবখানে।
বাচ্চাটির লাশ কোথাও নেই। মাত্র চারদিনের বাচ্চাটা মোমের মতো, ধূপের ধোঁয়ার মতো নিভে যায়। লাশগুলোকে উঠানে রাখা হয় তিন ভাগে -- প্রথম ভাগে ৭০ বছরের বৃদ্ধ গজেন্দ্র শীল ও তার স্ত্রী ৬০ বছরের মনোলতা। দ্বিতীয়ভাগে বড়োছেলে বৃন্দাবন, তার বউ সেবাদাসী, ১২, ৭ বছর ও চার দিনের গলে যাওয়া শিশুকে আন্দাজ করে একটা পোঁটলার মতো করে চাটাইয়ে রাখা হয়। একটা লাশ কমই বলতে হয়।
চারদিনের ছেলেটির লাশ কি আসলে পাওয়া গেল? ছ’দিনের দিন কোষ্ঠিপত্র দেখে নাম ঠিক করবে বলে ওরা (দুইজন) এল আর পোড়া-কয়লা হয়ে ইহধাম ত্যাগ করতে হ’ল। কার্তিকও মোম হয়ে গলে গলে কোথায় যে মিশে আছে। তৃতীয় ভাগে থাকে দুই যুবতী -- বর্ণা আর হ্যাপি। আর বেড়াতে আসা দুজনকে তার আত্মীয়-কুটুমরা তাদের বাড়িতে নিয়ে এরই মধ্যে দাহ করে ফেলেছে। লাশের এ ভাগসমূহ করতে হয় শেষকৃত্যের জন্যই। হরিদাসীর মা, কমলের বউ, মণিন্দ্রের স্ত্রী, ঝর্ণার বিধবা জা’টাও তাদের আত্মীয়- কুটুমদের সাজানো ডেডবডি কল্পনা করে গহীন রাতের একলা-শকুনের মতো চুঁইচুঁই করে কাঁদে।
নিত্যানন্দের চোখে একফোঁটা জল নেই -- নিভে যাওয়া কয়লার তাপ চোখের জলও শুষ্ক করে দিয়েছে। পুরোহিত তিনটি ঘটে জল, আম্রপত্র, কাঠি রাখেন। কলাগাছের খোসার ছোট টুকরায় চালেরগুঁড়া দিয়ে লাড়–র মতো পিণ্ড বানায়। কয়েকটি ছেলে দাহের অংশ হিসেবে পুকুর পাড়ে বসে সরু সরু কাঠি বানাতে থাকে। মুখাগ্নি করতে করতেই মনুষ্যবাহিত স্মৃতি ও মানুষ-পোড়া গন্ধ হুহু কান্নায় ভেঙে পড়ে গজেন্দ্র শীলের ছেলে দুটি। নাভিদ কামাল নামের প্রতিবেশিকে জড়িয়ে ধরে নিত্যানন্দ কান্নায় ভেঙে-লুটিয়ে পড়ে -- ‘আঁরা কি লই বাঁইচ্যুম গও ত চায়। মরিই-রে ব্যাকে ত শ্যাষ হই যারগুর।
আঁরার বুককান পুরি ছাই হই যার।’ গন্ধের রায়টের ভিতর ব্রাক্ষণ মন্ত্র পড়েন। নিত্যানন্দ, সুনীল ও হ্যাপী- বর্ণার বাবা সাত বার ঘুরে লাশের চৌদিকে। ফিনকি দিয়ে কান্না আসে সুনীলের, ডানপায়ের ভেঙে যাওয়া হাড়টা সেই কান্নার ধমকে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মরদেহের মাথাপিছু সাতটা করে আম্রকাষ্ঠেরকাঠি ছুঁড়ে মারে জ্বলন্ত চিতায়। বোল হরি বোল বলে সমবেত আওয়াজ দেয়, বাকিরা জোরে জোরে বোল হরি বল বলে। দূরে গাছের ছায়ায় দুই ভাই বসে একসময়। রক্তের ফোঁটার মতো স্নানের জল তাদের গা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে, ভিজে ওঠে বসার জায়গাটা। শোকগীতি তাদের নির্জন কান্নাকে ছুঁয়ে যায়। ঘণ্টাতিনেক তো লাগবে আধপোড়া লাশগুলো দাহ করতে।
শেষকৃত্যও শেষ হতে থাকে ধীরে ধীরে । শোঁ-শোঁ করে আগুনের হলকা নিভে যেতে থাকে।
কয়লাগুলোকে লাঠি দিয়ে দক্ষিণদিকের গর্তে জমা করে। নিত্যানন্দ শ্মশান থেকে ফেরার পথে ঘট থেকে কয়েক আঁচলা মন্ত্রপুত জল ছিটিয়ে দেয় শ্মশানের সেই কয়লার ¯তূপের ওপর। হোস্হোস্ শব্দ
তুলে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি উপরে ওঠে -- কিন্তু এর নাড়িভুঁড়ি থেকে গন্ধটা আসেই। ছাই রং ধোঁয়া
মিশে যায় একসময়। ৯টা লাশ পোড়ার তাপ তখনও বাতাসে ওড়ে বেড়ায়; এরই তাপে নিত্যানন্দ’র শরীরে কাঁপুনি তৈরি হয়। পিণ্ড রেখে দেয় শ্মশানে। দাহের এক খাবলা কয়লা গামছার ভাঁজে লুকিয়ে নেয়, জমা করে রেখে দেয় -- সত্যিই যদি বাপ-দাদার ভিটা ছাড়তে হয়! স্যাঁতসেঁতে ভয়মিশ্রিত কান্না ওর বুকের চারপাশে জমাট বাঁধতে থাকে। মাথাহীন, মুখহীন, ত্বকহীন, রক্তহীন, ছায়াহীন কতগুলো টুকরা টুকরা মানুষ এগিয়ে যায় বাড়িটার দিকে। কে যেন সারা অঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে পোড়া-কয়লার গন্ধ, আগুনের তাপ; এরই ঝাঁজে পড়ে মিশে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কায়দা নিয়ে বাড়িটার দিকে পা বাড়ায় সে। আগুনের তাপে, ধোঁয়ায়, রক্তের কাদায় পা পিছলে যায়। তামাম শরীরে পোড়া-কয়লার গন্ধ ভর করে! আগুনের ভাপ উঠে আসছে ওদের শরীরে, তা থেকে হয়ত বাঁচার জন্যই ওরা দ্রুত পা ফেলে শতছিন্ন
বাড়িটার দিকে ...
জানুয়ারি ২০০৪
লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
তাঁর জন্ম ১৯৬৩-এ, মামাবাড়িতে। কিশোরগঞ্জস্থ বাজিতপুর থানার সরিষাপুর গ্রামে শৈশব- কৈশোর, যৌবনের প্রাথমিক পর্যায় কাটান তিনি। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা করেছেন গ্রাম ও
গ্রামঘেঁষা শহরে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একাডেমিক পড়াশুনা করেন চট্টগ্রামে। লেখাজোখা তাঁর কাছে অফুরন্ত এক জীবনপ্রবাহের নাম। মানুষের অন্তর্জগতে একধরনের প্রগতিশীল বোধ তৈরিতে তাঁর আকাক্সক্ষা লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন জায়গায়--ছোট বা বড়োকাগজে তিনি লিখে যাচ্ছেন।
কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ কথা’র সম্পাদক। কথা সম্পাদনার জন্য তাকে ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ পুরষ্কার ২০১১’ প্রদান করা হয়।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -- মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম (জাগৃতি প্রকাশনী), স্বপ্নবাজি (ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ), কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প (শুদ্ধস্বর)
উপন্যাস-- পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী ’(মাওলা ব্রাদার্স),
প্রবন্ধগ্রন্থ-- উপন্যাসের বিনির্মাণ, উপন্যাসের জাদু (জোনাকী)।
0 মন্তব্যসমূহ