কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
তাঁর জন্ম ১৯৬৩-এ, মামাবাড়িতে। কিশোরগঞ্জস্থ বাজিতপুর থানার সরিষাপুর গ্রামে শৈশব- কৈশোর, যৌবনের প্রাথমিক পর্যায় কাটান তিনি। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা করেছেন গ্রাম ও
গ্রামঘেঁষা শহরে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একাডেমিক পড়াশুনা করেন চট্টগ্রামে। লেখাজোখা তাঁর কাছে অফুরন্ত এক জীবনপ্রবাহের নাম। মানুষের অন্তর্জগতে একধরনের প্রগতিশীল বোধ তৈরিতে তাঁর আকাক্সক্ষা লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন জায়গায়--ছোট বা বড়োকাগজে তিনি লিখে যাচ্ছেন।
কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ কথা’র সম্পাদক। কথা সম্পাদনার জন্য তাকে ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ পুরষ্কার ২০১১’ প্রদান করা হয়।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -- মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম (জাগৃতি প্রকাশনী), স্বপ্নবাজি (ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ), কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প (শুদ্ধস্বর)
উপন্যাস-- পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী ’(মাওলা ব্রাদার্স),
প্রবন্ধগ্রন্থ-- উপন্যাসের বিনির্মাণ, উপন্যাসের জাদু (জোনাকী)।
ওরা একপর্যায়ে ছায়া-ছায়ায় ভরপুর পাহাড়ি গিরিছায়ার সিনা বরাবর পৌঁছে যায়। এবং আমরা জেনে নেবো যে রনি, সৈকত, শিঠু, গৌরাঙ্গ, জাহের মিলে ওরা হয়। মানুষ হিসাবে তাদের ওইটুকু পরিচয় নিয়েই থাকার বান্দা আমরা নই। কারণ আমরা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি কোনোকিছু জানা মানেই অল্পকিছু জানার মধ্যে থাকলে চলছে না— ফ্রি মার্কেট ইকোনমির যুগে এমন চাপা-খাওয়া-ভাবের এক পয়সার ভ্যালু নাই।
এখন সময় এসেছে সবটুকু জানার বোঝার দেখানোর প্রতিযোগিতায় নামার। তা না হলে এই মিছা-দুনিয়ায় নিজেদের সামগ্রিক আয়-উন্নতি হতে পারে না। আমরা তাই তাদের সবটুকু জানার তদ্বিরে নামি। তাহলে তাদের সম্পর্কে আরও খোঁজ-খবর করা যাক। তারা যথাক্রমে এনজিও-মুরুব্বি, পর্যটনকর্তা, বিজনেস ম্যাগনেট, আর্টিস্ট, রাইটার হয়ে আছেন। মানে এইসব কর্মযজ্ঞ তারা পালন করেন। এবং এসব হওয়ার বা থাকার ভিতর নিজেদের সঁপে দিয়ে আছে। তাদের বয়স যথাক্রমে ৩৫, ৩৩, ৪১, ৪০, ৪৭। আবাল্য মাতৃহীন গৌরাঙ্গ ব্যতীত সবারই পিতামাতা বর্তমান। তাদের পরনে যথাক্রমে প্যান্ট-শার্ট-টুপি-টাই, কমপ্লিট-টুপি, প্যান্ট-শার্ট-কুরিয়ানশো, কালচারাল শান্তিনিকেতনি পাজামা-পাঞ্জাবি, টি-শার্ট-প্যান্ট।
আকুল-ব্যাকুল রোদ্দুর ছিলো তখন। চিরদিন কিছুই থাকে না, পরিবর্তন হয় এবং সেইহেতু ডিসেম্বরের এই ছায়া-ছায়া রোদ্দুর সরতে সরতে, শীত-শীত ভাব মলিন হতে হতে এ রোদ্দুর এখন তেজময় হয়ে আছে— অথচ ঘণ্টাদুয়েক আগে, যখন তারা সমুদ্রের কিনারা ধরে বেড়ে ওঠা নগর থেকে কোম্পানির পিকআপ ভ্যানে যাত্রা করে তখন এতো তীব্র-তীক্ষ্ণ রোদ্দুর ছিলো না। সকালের ছায়া-ছায়া ভেজাভেজা রোদের ভিতরই তারা রওয়ানা দেয়। তারা যেভাবে চিল্লাহল্লা করছে তাতে যে কারো মনে হতে পারে, তাদের চিল্লানি নিত্যদিনের ব্যাপার। কার্যত যে তা নয়, তা বোঝার জন্য নীরবে ড্রাইভাবের পাশঘেঁষে বসে থাকা কবিস্বভাবের রাইটার ওরফে জাহের নামধারী মানুষটির শর্টনোট দেখলেই আন্দাজ করা যাবে। সে যা লেখে তার ভাষা কারও জানার কথা নয়। তার আর্টিস্ট-বন্ধু-গৌরাঙ্গ তাকে এ নিয়ে প্রায়ই খোঁচায়, এসব নাকি তার পরপারের ভাষা, যে ভাষা সৃষ্টিকর্তা (নাকি মরণকর্তা!) কেবল তাকেই শিখিয়েছে। রাইটারও হাস্যরসের ভিতর অনেকবার জানিয়েছে, তার এ সাঙ্কেতিক মুদ্রা এই জগতের কেউ বুঝবে না। তাহলে তো আর একটাই জগৎ থাকে, তা হচ্ছে, মরণলীলার জগৎ। শিঠুই মনে হয় এ বাণীটি ছাড়ে (আমরা জেনে রাখবো, শিঠু যা বলে তা আর সাধারণ কথা’র মর্যাদা নয়, বরং তা বাণীর মর্যাদা পায়!)। এ কথাতে রুনিও হঠাৎই হোহো করে হাসে। তার হাসিটি এমনই প্রলম্বিত আর মনসঞ্চারি যে তার সাথে সাথে পর্যটন কর্পোরেশনের অফিসারটিও তার অফিসিয়াল নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে খিকখিক করে হাসে, আর তার হাসির কারণকে ঢাকায় অবস্থান করা নিজের পরিবারকে জানায়। তার কথার তরফে রাইটারের চিন্তা বাড়ে। যা কিছু পাওয়ার থাকে, তা নতুন করে নির্জনতায় পাওয়ার বাসনা তার মনে ওঁৎ পেতে থাকে— এ সত্য তার একার, সে নিজের ঈশ্বরত্ব নিজেই আবিষ্কার করাতে দ্বিধাহীন। তাই সে আবারও নীরবতায় ডুব দেয়। ডাকাতের ছোরার মতো, তীব্র-আন্ধারের মতো নির্জনতা লালন করে। সে ভাবে, জগতের ম্যালাকিছু নীরবতার ভিতর দিয়েই তৈরি হয়েছে। এমনকি সে চাইলে নতুন নিয়মের একটা রাস্তাও তা দিয়ে নির্মাণ করে ফেলতে পারে। কিন্তু এনজিও’র লোকটি নীরবতা-বিরোধি-পক্ষ। এই যুগ সরবার যুগ, মানুষের ভিতরে ঢুকে ভিতরটা তছনছ করে ফেলার যুগ। সরবতা দিয়ে জালের মতো সবকিছু চাপা-দিয়ে-ধরার যুগ। তবু আর্টিস্টকে নীরবতা পালনের ইশারা দিয়ে রাইটার নিজেও নীরব-হয়ে-থাকা সাধনা করে। সময় অনেকটাই পার হয়। আর্টিস্ট এইসবের ভিতর থাকতে পারে না, গিরিছায়ার কোন এক প্রলেপের ভিতর দিয়ে পাহাড়ি রমণী সংক্রান্ত সৃজনের নেশায় পড়ে। এখন তারা অনেক দূর চলে এসেছে। তাদের সামনে গিরিছায়ার খাসমহল আছে। ওই স্থলে কোনো একসময় হাস্যসৃজনকরত ওদের প্রবেশ হয়। এই যে তাদের প্রবেশ, এ প্রবেশ কিন্তু আরও দুইটি রাস্তা দিয়ে হতে পারতো। একটি পাহাড়ের ডান দিক দিয়ে যেখানে কবরস্থানটার পিছন দিয়ে রাস্তাটি ঘুরতে ঘুরতে কাঁঠালছায়ার ভিতর দিয়ে আনসার ক্যাম্পের কোলঘেঁষে একেবারে পাহাড়ি নীরবতার ভিতর এখানে ঢোকা যেত। কিন্তু তাতে নাকি রাস্তার যে মজা, পিচ ঢালা পথের যে চাঞ্চল্য তা দেখা দেখা যেত না। এমনকি পর্যটনের কর্তাব্যক্তি যে রাস্তাটির সন্ধান দেয়, তা বিজনেট ম্যাগনেট শিঠু খলখল হাসির ভিতর ভাসিয়ে দেয়, জগতের যতো নিয়ম আছে তা চলবে ব্যবসার তালে, তোমার এই সিভিল এভিয়েশন এর কিছুই করতে জানে না। আর্টিস্ট গৌরাঙ্গ এসব না শোনার মতোই তার ডিজিটাল ক্যামেরায় জুমল্যান্স কার্যকর রেখে সমানে ছবি তুলে যায়। সে পারলে সারা পাহাড়ের এক্সপ্রেশন তার ক্যামেরায় বন্দি করে রাখতো। সবচেয়ে যে কম কথা বলে সেই রাইটার যেন কিসের পেশায় আরও মজে আছে। আল্লার এই বান্দা একটা কথাও বলছে না। সে শুধু ইশারায় জানায়, জগতের যাবতীয় ভাষা এখন নীরবতা কর্তৃক উৎপন্ন হবে। সেই উৎপন্নের নেশা ঠিক মতো পাওয়ার জন্য আবারও এই দলের সাথে সেট করা গাইডকে জানায়, পাহাড়ি খাসা ওয়াইন দোচুয়ানি ব্যতীত আর সে একটা কথাও বলবে না। জগতের যাবতীয় সুখ অন্তত পাহাড়ে অর্জন করতে হলে পাহাড়ি পানীয় প্রয়োজন। আমরা আকুল আগ্রহে ওদেরকে যাবতীয় ক্রিয়াকলাপসহ নির্ণয় করতে চাইবো। এই সময়ে যখন তারা পাহাড়-প্রখর-জনপদের ভিতর ঢোকার মানসে ওই পিকআপ ভ্যান থেকে তথাগত হয়, তখনই সেলফোনে ঢাকার এক সাহিত্য-সম্পাদক পাহাড়ি-ঝর্ণার স্নিগ্ধতায় হিহিহি করতে থাকে এবং জাহেরের সামগ্রিক শরীর পাহাড়ি চান্দের গাড়ির পেটের কাছে আটকে যায়। নিম্নকণ্ঠ তার আরও নিম্নকণ্ঠ না হলে উন্মুক্ত বাতাসকে কাঁপিয়ে-সরিয়ে-নাড়িয়ে পর্যটন বিষয়ে সৈকতের মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্য প্রজেক্ট সম্পর্কে তার আহামরি সিদ্ধান্তসমূহ জানতে পারতো। তখন সৈকত সাহেব বলতে আছিলেন, শুনেন মিস্টার... (আমরা অতি সহজেই নির্ণয় করে ফেলবো, পর্যটনের স্থায়ী হেড এসিসটেন্ট আবদুল কাদেরই এই মিস্টার), যিনি পর্যটনেরই নানাবিধ অফিসিয়াল ব্যর্থতার দায় বিনীত কৌশলে বরণে রত। এইসবের সাথে মাইল তিনেক দূরে হজরত আলীর সুড়ংয়ের একটা বিষয় এখানে সংযুক্ত করাটা অতি প্রয়োজনীয় একটা ঘটনা। সেই স্থলে তিনি তার কদমমোবারক রেখেছিলেন। এটা এই এলাকার পেয়ারা বান্দারা সিয়োরিটি দিয়ে বলতে পারে। এইটা যা-তা কথা নয়। একটা রহমতের বিষয় হেথায় যুক্ত আছে। পাহাড়ের এমন সিনার জোর না হলে কোত্থেকে আসে। এইখানকার আদি অঘা-মঘাদের অত জোর কী করে আসে! ঘটনারও নেশা থাকে, কারণ ঘটনা নিরীহ থাকার বিষয়। ঘটনা ঘটনাকে সমানে টানে। রাবারের মতো এক ঘটনা আরেক টেনে-হিঁচড়ে নিজের দিকে আনে। হযরত আলীর পায়ের চাপ এখানে কী করে এলো? এমন প্রশ্ন এইখানকার মানুষ একআনা পাত্তা দেয় না। তারা যেন জানেই এতো এতো যোগসাজস করার বাসনা তাদের কী করে হয় তা জানা দরকার। কামনার চাষ হয়। তখনই আরব-দেশের জোশ তাদের ভিতর আনাগোনা করে, এইটা বিষয় বটে— কী করে পায়ের এমন চাপ তথায় পতিত হয়। তারা ভাবতে থাকে— কী যে ভাবের লেনদেন হয়! কথা তো বিবেচনা করাই লাগে— অত্র স্থলে হজরত আলী না-এলে পাহাড়-জঙ্গলের ভূতের মতো এলাকায় এমন সুড়ং কী করে জন্ম নেয়! তিনার কদমমোবারকের দাগ কি আর এমনি এমনি হয়? এইখানকার মানুষ কী করে মানুষ হয়!
যখন তারা গিরিছায়া নামের ঘের দেয়া দশ একর জায়গাটায় পৌঁছে যায়, পাহাড় তখন সেখানে ঘন হতে হতে ব্যাকুলতা ছড়াতে থাকে। একজনম থেকে আরেক জনমে নানাবিধ মনোজৈবিক দাগ স্পষ্ট হতে থাকে। রনি অনেক আগেই হেডম্যানের সাথে তার কথার কথা মনে মনে লেনদেন করে। স্বত্ব তো নেয়াই লাগবে— জমির স্বত্ব। সরকারের আইন তো না মেনে উপায় নাই। সব জায়গায় তো ঘাওরামি চলে না। ওই সোসাইটির থ্রুতে স্বত্ব নেয়ার জমিটা সে দেখে। একা একা একাও সে এটা দেখে গেছে। এর ম্যাপ সঠিক আছে তো। একে আবারও সে চোখস্থ করতে থাকে। সামনে পিছনে ডানে বায়ে আম, কাঁঠাল, তুকমা, পুতি-বেগুনের গাছ রসময় অবয়ব নিয়ে আকুল পরানে দাঁড়িয়ে আছে। তার এ ব্যস্ততা তারই একান্ত বন্ধু শিঠুর নজরেই আসছে না। তাতে রনির মনোযোগে খানিক আতঙ্ক যোগ হলেও পাহাড়ের দাগ-খতিয়ান কিংবা সীমানা চোখের পাওয়ার দিয়ে বাড়াতেই থাকে। যারফলে রনির নজর একান্ত অনুগত শিষ্যের মতোই জাহেরের মুখের এক্সপ্রেশনে মগ্ন হয়— সেকি নীরবতা দিয়ে আবারও কোনো ভেজাল তৈরি করতে চায়? বালের কী অত ভাবে। ভাব দিয়ে দুনিয়া উদ্ধার করতে চায়! প্যাঁচমারা ভাবে তবে যতোই থাকুক, তার সিদ্ধান্ত ব্যতীত গিরিছায়ার এই যে সীমানা, একে বাড়ানো অত সহজ নয়। রনির অনেক বাসনা, অনেক পরিকল্পনা আছে। সে যখন এখানে আসার পরিকল্পনা করে তারও ম্যালা আগে থেকেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরেও এনে রেখেছিলো। তার প্ল্যান হচ্ছে, গিরিছায়ার সীমানা বাড়াতেই হবে। এ জন্য সমতলের যতো নিয়ম-নীতি আছে, লাইন-ঘাট আছে তা প্রয়োগ করবে। খোদ মিনিস্ট্রি থেকে অর্ডার করার কৌশল আর রাস্তা তার জানা আছে। এইখানকার হাবাগোবা বান্দাদের ক্যাপচারে আনা কী এমন ব্যাপার? জানাকে জানার মতো জানতে পারলে এখানে কী আর আটকাবে? সবচেয়ে আশার বিষয় হয় জাহের যদি তার লেখক কাম সাংবাদিক বন্ধুদের দিয়ে একটা সম্ভাব্য জরিপ করে ডেইলি-পেপারে একটা রিপোর্ট করাতে সক্ষম হয়। পর্যটন, সাংবাদিক কিংবা পাহাড়ি-নেতাই হোক—তাদেরকে দোচুয়ানি শুধু নয়, আবদুল কাদের মারফত যার-তার পছন্দের পাহাড়ি রমণী খোঁজ করে-টরে... হঠাৎই গৌরাঙ্গ সৃজনকৃত হোহোহো হাসি পাহাড়ি-দুপুরকে নাড়িয়ে দেয়। এই দেখো, ঈশ্বর কারে কয়? গৌরাঙ্গের ঈশ্বরজনিত বক্তব্যের এমন ঝামেলায় পড়ে রনি শুধু নয় সৈকতও আঁৎকে ওঠে। তখন সে ঈশ্বর নির্মাণের অভিপ্রায়েই সমগ্র প্রকৃতির উপর যেন ঝকঝকে ছুরির মতোই নজর ফেলে— গাছপালা, পাহাড়ের চিপাচাপা আর তথাকার হুলস্থূল রূপ, রোদ, বাতাসের বেআন্দাজ চলাফেরার ভিতরই ঈশ্বর আছেন, (কিসের সিংহাসন-রাজা, কিসের কী) এইসবের ভিতর ঈশ্বরকে মিশাইয়া দাও। তার এমন হাসির অত্যাচারে মজে সৈকতের পর্যটন সংক্রান্ত ফাইলও কেঁপে কেঁপে স্থির হয়। হজরত আলীর কদমমোবারকের একটা গায়েবি আলামত এখানে মনে পড়ে, এইখানকার বন-জঙ্গলের মানুষকে মানুষতা যুক্ত করে কে চাষাবাদ করলো, কে তাদের মানুষ করলো? মানুষ হওয়া কী অত সহজ! এসবের দিকে একরতি পাত্তা না নিয়ে গৌরাঙ্গের যাবতীয় মনোযোগে আছে চান্দের গাড়িতে বেঁধে রাখা পাহাড়ি প্রগাঢ় খাসিটা। জলরঙে ওইটার একটা প্রোফাইল আঁকতে পারলে মুখের আউটলাইন, ডিটেইল, কালার, পাহাড়ের সাথে মিশে থাকা ঘ্রাণটাও ফোঁটাতে পারতো। কেন যে আঁকাআঁকির যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে এলো না! বরাবরই তার পছন্দের মাধ্যম হচ্ছে জলরঙ। আহা, কতো তাড়াতাড়ি কী যে আউটপুট পাওয়া যায়। তার ব্যাচে হায় তার মতো জলরঙে কন্ট্রোল আর কারও ছিলো না। কতো হারামজাদা এখন এক্রিলিক, ওয়েল, প্যাস্টেল, পেন-স্কেচ, এমনকি প্রতিস্থাপনা করে মজা নেয়, তার মতো কেউ জলরঙের কাব্য আঁকুক তো! তারই মনোযোগে সে তাকায় পাঁচ-ছটি পাহাড়ের উপর মেঘের বিছানার উপর, তার উপর যেন রঙের হুলস্থূল আনন্দরশ্মি এসে পড়ছে। ততক্ষণে জাহের কর্তৃক ম্যানেজকৃত দোচুয়ানির নেশায় পড়েছে শিঠু। ঢকঢক করে বিয়ার খাওয়ার মতোই তিন-চার পেগ মিনিট দশেকের সাবাড় করে দেয়। রনি তাকে বারবার আশ্বস্থ করতে চায় পাহাড়ি মোরগ সহযোগে রাতে আরও এমন জিনিস ম্যানেজ করা হবে। গৌরাঙ্গ তখন দোচুয়ানির আবেশে মগ্ন হতে হতে রাখাইন পল্লীর নিচে খালি উপরে ঘরযুক্ত পাহাড়ি-বাড়ির দিকে নজর লাগায়। তার শরীরে তখন নেশার ভিতর আরও নেশা লাগে, তার নজরে জলরঙে ঢেকি সহযোগে শরীর উঠানামা করা রাখাইন তরুণীতে একেবারে গেঁথে রাখে। ওগো সহজিয়া, ওগো মৃদুমন্দ আয়োজনা, সুহাসিনী বননয়না, তোমার সামগ্রিক শরীরে কী যে কী আছে! দখলের নেশাতে সে অতঃপর কাঁপতে-সরতে-নড়তে শুরু করে।
রনিও হাসে— তার হাসির আলাদা এক সৌগন্ধ থাকে। গোলাপের পাপড়ির মতো ভেজাভেজা আবরণের এক অঞ্চল থেকে যেন মধুময় রস ঝরে পরে। তা ধীরে ধীরে মুখের সামগ্রিক অবয়বে আলাদা মাত্রা দেয়। ক্রমে তা চারপাশে ছড়ায়। গিরিছায়ার নির্জনতা ভিন্ন এক ব্যঞ্জনায় কেঁপে কেঁপে আসে। এই হাসিতে সারাটি এলাকা যোগ হওয়ার ব্যবস্থাই থাকতেই আছে। এইটা কী করে সম্ভব তা জানার বিষয়টি আরও ঝামেলার মনে হয়। কারণ এতে যে অদৃশ্যময়তার গন্ধ পাওয়া যায় তা একেবারে পাই টু পাই জানা যাবে না, তাও তো এইক্ষেত্রে হিসাব করে বলা মুশকিল। রনি তা জানানোর বিষয়টা কী করবে? এমন কায়দা সে রাখছে বলে তো মনে হয় না। তারা এটা নিয়ে ভাবে— কিসের এক নেশা লেগেছে যেন। তা কি পাহাড়ের, পাহাড়ের এমন নেশা থাকতে পারে। তবে কি তা নির্জনতার, এমন আকর্ষণের কথা আমরা রাইটার জাহেরের কাছেই প্রত্যাশা করতে পারি। কারণ সে তার জন্মের ম্যালা আগে থেকেই যেন নির্জনতার চাষাবাদ করছে। এ ব্যাপারে লেখক-বড়োভাই মেহেরও জানায়। তার নেশা কখনও নির্জনতাকে ছাড়বে না। প্রকৃতি আর জৈবিক আচরণকে নির্জনতার স্বভাবে বিচার করে। নির্জনতার বিশ্বাসই নাকি জগতের অনেককিছুই নিয়ন্ত্রণ করবে। এই কথাই গৌরাঙ্গও হেসে-কেশে উড়িয়ে দেয়। তাহলে এর সাথে দোচুয়ারির কোনো ভাবসাব থাকতে পারে! এর বাইরে আরও কিছু ভাবা যায়— তাহলে অন্যকিছু কী হবে? ভাবনা আর হাস্যকোলাহলের ভিতরই তাদের সময় পার হয়। তবে তাতে আরেক আজগুবি বিষয় জানা যায়, কী সেই বিষয়। গৌরাঙ্গ অন্য ইশারা মারে— তাতে নিজের শেষ পারাপার নিজে রচনা করার একটা ইশারা হয়তো আছে। যতো যাই বলা হোক না কেন, নিজেদের রক্ত আর কবরের ভিতর একটা যোগসূত্র সৃজন করতে না পারলে কিছুই কেয়ামতজীবী হয় না। এ ব্যবস্থায় ঈশ্বরের কোনো অবদান থাকতে পারে বলে গৌরাঙ্গ জানায়। তার এ জানানোর ভিতরই সৈকত হাসে, হাসিতে হাসিতে চারপাশ সয়লাব করতে করতে বলে, এইজন্যই ঈশ্বর আর্টিস্টদের দুই চোক্ষে দেখতে পারেন না। কেন তাদের দেখতে পারে না, জাহেরের এমন প্রশ্নবোধক নির্জন-দৃষ্টিকে সরিয়ে বলে, আর্টিস্টদের মতো বিটলা মানুষ এই দুনিয়ায় নাই, তারা খালি প্যাঁচ লাগায়, সৃজনকর্তার সৃজনে ভাগ বসাইবার চায়... হঠাৎই এক পাহাড়ি যুবক পাহাড়ের একেবারে কলিজায় দাঁড়িয়ে ইশারা দিয়ে জানায়, (পাঁচজনই দারুণ অবাক হয়ে যায়; পাহাড়ের এই মানুষটা তাহলে ছিলো কোথায়, কোত্থেকে সে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করতে পারলো। ও কি নিজেকে পাহাড়ের একেবারে গভীর কোনো অঞ্চলে লুকিয়ে রাখার জাদু জানে? এটা একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। এই ইশারাকে তারা গুরুত্ব দিতো না। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কোনো এক দায়িত্বশীল দপ্তর থেকেই জানানো হয়েছে, পাহাড়ের কোনো কিছুকেই গুরুত্ব না দেয়ার আগে ভাব নির্ণয় করতে হবে। সেই ভাবের নাম কী? সেই ভাবের নামই হলো, অতি অল্প কিছুকেও গুরুত্ব দেয়ার ভাবে রাখতে হবে। পরের বিবেচনা পরে বোঝা যাবে। কারণ তাদের পিছনে দেশি-বিদেশি বহু এজেন্ট আছে। তারা সমতলের মতো পাহাড়ি জীবনকেও তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে। তারা শুধু বোঝায়, কোনো জীবনই হেলাফেলার নয়গো। তাহলে এতো সহজে কি এইটুকুওর দখলে নিবার পারবেন!? এমন এক পাহাড়ি চিক্কুরকে পাত্তা না দিলে চলে? এখানে পাহাড়িদের কর্তৃক নিজেদের জমিন নিজেদের ভালোবাসায় রাখার গল্প আছে, যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব আছে। তারা সকলেই তা দেখে, এখন কি রনির হাসি চলমান আছে? বেকুব কারে কয়? তারা সম্মিলিতভাবে তা তছনছ করতে মনস্থ করে। তাতে কাজও হয়। রনির হাসি যে তারা সহ্য করতে পারছে না তা তারা বুঝাতে সক্ষম হয়। ফলে তার হাসিতে ঈষৎ সরু পাতলা ভাব আসে, এবং আমরা ক্রমশ তা ম্রিয়মাণ হতে দেখবো।
একটা সময়ে এই অবস্থার সার্বিক পরিবর্তন ঘটে— কারণ তারা তাদের সৃজিত খসখসে হাসিতেই আলাদা কতক রঙ লাগায়। এমন রঙের হেতু কী? এমন জিজ্ঞাসায় পরস্পর পরস্পরকে চিহ্নিত করতে পারতো। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয় না। কারণ এরই মধ্যে হয়ত ম্যালা সময় পার হয়। কতো সময় তার হিসাব কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ গিরিছায়া নিয়ন্ত্রিত এলাকায়, সারা তল্লাটে বেহায়ার মতো, নির্জনতা খেয়ে ফেলার মতো রঙের ঢেউ লাগে। তাতে পাহাড়ি এলাকা দখলত্ব বজায় থাকার আরাম টের পাওয়া যায়। তাদের হাসিতে, রঙে, তাদের সম্মিলিত আরামে গিরিছায়ার বাউন্ডারি বাড়তে বাড়তে বাড়তে আলাদা কতক ইশারা, এমনকি হিসাব-নিকাশ তৈরি হতে থাকে। আবারও হুলস্থূল হাসির স্রোত নামে সেখানে (তারও অনেক আগে ইতিহাসে হাস্যসৃজনের ইতিহাস থাকে।), হজরত আলীর কদম মোবারকের ছায়া-কায়া দাগ ফেলতে ফেলতে যায়, এবং রনি জানায়, তার কাছে এমন ফর্মান আছে যে ওদের এ হাস্যকোলাহল যতদূর যাবে ততদূরই এর সীমানা বাড়তে থাকবে...
লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
তাঁর জন্ম ১৯৬৩-এ, মামাবাড়িতে। কিশোরগঞ্জস্থ বাজিতপুর থানার সরিষাপুর গ্রামে শৈশব- কৈশোর, যৌবনের প্রাথমিক পর্যায় কাটান তিনি। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা করেছেন গ্রাম ও
গ্রামঘেঁষা শহরে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একাডেমিক পড়াশুনা করেন চট্টগ্রামে। লেখাজোখা তাঁর কাছে অফুরন্ত এক জীবনপ্রবাহের নাম। মানুষের অন্তর্জগতে একধরনের প্রগতিশীল বোধ তৈরিতে তাঁর আকাক্সক্ষা লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন জায়গায়--ছোট বা বড়োকাগজে তিনি লিখে যাচ্ছেন।
কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ কথা’র সম্পাদক। কথা সম্পাদনার জন্য তাকে ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ পুরষ্কার ২০১১’ প্রদান করা হয়।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -- মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম (জাগৃতি প্রকাশনী), স্বপ্নবাজি (ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ), কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প (শুদ্ধস্বর)
উপন্যাস-- পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী ’(মাওলা ব্রাদার্স),
প্রবন্ধগ্রন্থ-- উপন্যাসের বিনির্মাণ, উপন্যাসের জাদু (জোনাকী)।
0 মন্তব্যসমূহ