রওশন জামিল
ব্যাপারটা শেষমেশ এমন
দাঁড়াবে স্বপ্নেও ভাবেনি শেরিফ জেফ টমসন। অনুভূতিহীন একটা স্রোত পা থেকে শিরদাঁড়া
বেয়ে শুঁয়োপোকার মত উঠে গেল মাথায়। মুখ মড়ার মতো, দৃষ্টি অসীমে। আন্ট পলির কোনো কথাই তখন কানে পৌঁছুচ্ছে না। বাইরে অঝোর বৃষ্টি, শব্দ করে পড়ছে ঘরের ছাদে, উঠোনে, যেন অনেকগুলো ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ভেসে আসছে।
ঘটনার শুরু দুসপ্তাহ আগে।
এটাও ছিল সীমান্ত শহরের আর দশটা দিনের মতো একঘেয়ে, নিরুত্তাপ। মাত্র দুপুরের খাওয়া সেরে ঝিমোচ্ছিল টমসন যখন ডেপুটি স্কট ডোলান
ঝড়ের বেগে ঢুকল অফিসে। মুখ ছাইয়ের মতো শাদা, চেহারায় আতঙ্ক। চিজ
আর টর্টিয়া কিনতে এলিয়টদের দোকানে গিয়েছিল সে। ক্যাশে কাউকে না পেয়ে ভেতরে উঁকি
দিতেই দেখে বুড়ো এলিয়ট আর তার স্ত্রী, দুজনেই মেঝেয় পড়ে।
জবাই করা হয়েছে ওদের, রক্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে
ঘর। লিজ, এলিয়ট দম্পতির মেয়ে, তার চিহ্নও নেই কোথাও।
দুদিন পর, মাথার ওপর শকুনের চক্কর দেখে লিজের লাশ আবিষ্কৃত হয়। ডেড ম্যান ওয়াশের পশ্চিম
পাড়ে পড়ে ছিল ওর দেহ। সে এক বীভত্স দৃশ্য। অর্ধনগ্ন, বুকে ছুরির উপর্যুপরি আঘাতে মারা গেছে। নখের নিচে শুকনো রক্ত আর ছেঁড়া চামড়া।
মাত্র এক সপ্তাহ আগেই পনেরোয় পা দিয়েছিল মেয়েটা।
‘শেরিফ,
এদিকে!’ জর্জ হ্যানসন, দুই ডেপুটির অন্যজন, অস্পষ্ট একটা ট্রেইল অনুসরণ করে খানিক দূর গিয়ে ঘাসবনের ভেতর কিছু একটা
পেয়েছে। লম্বা ঘাসের মাথা এক জায়গায় দোমড়ানো, পাশেই রক্ত আর ধুলো
মাখা একটা ছুরি,
বাঁটটা হাড়ের। কাদামাটির ভেতর সজোরে
ঢুকিয়ে দিয়ে কেউ একজন সাফ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তুু তাড়াহুড়োয়
বের করার সময় পায়নি।
‘পরিচিত মনে হয় ছুরিটা?’ জিজ্ঞেস করল স্কট, ক্রিকের ওপাশের ঢালটা জরিপ করে ফিরে এসেছে।
‘হ্যাঁ,’
গম্ভীর গলায় বলল টমসন। ‘স্টিভ জোবস্ বানায় এধরনের জিনিস। এই তল্লাটের সবচেয়ে বড় কামার, কর্ডেসে ওর দোকান।’
বেশ বর্ধিষ্ণু একটা শহর
কর্ডেস। আশেপাশে কয়েকটা র্যাঞ্চ আর মাইন। ক্যালিফোর্নিয়া-অ্যারিযোনা স্টেজ লাইনের
যাত্রীবাহী কোচগুলো নিয়মিত থামে। ফলে জোবসের কামারশালার চুল্লি কখনো নেভে না। ঘোড়া
থেকে নেমে সামনে তাকাল টমসন। ওঠানামা করছে কামারের পেশিবহুল হাত, নিহাইতে হাতুড়ি পিটিয়ে একটা নাল সুগঠিত করছে।
হাতুড়িটা নামিয়ে চোখ তুলল
স্টিভ, দৃষ্টিতে বিরক্তি। ছয়জনের বিশাল সংসার, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
রোজগার করতে হয় তাকে। অসময়ে কাজে ব্যাঘাত পছন্দ হয়নি। ওকে ছুরিটা দেখাল শেরিফ।
‘হ্যাঁ,’
কামার বলল, ‘আমিই তৈরি করে দিয়েছিলাম প্যাট বুকাননকে। পাঁড় জুয়াড়ি, প্রেসকটের ব্লাড বাকেটে পাবে।’
প্যাট বুকাননকে পাওয়া গেল
প্যালেস অন হুইস্কি রোয়ে। সকাল দশটা বাজে। সামনে ধূমায়িত কফি নিয়ে নিবিষ্ট মনে
সলিটেয়ার খেলছিল। আস্তে করে ছুরিটা ওর সামনে রেখে শেরিফ জানতে চাইল সে ওটা চেনে কি
না।
‘কে জানতে চাইছে?’ রোমশ ভ্রূযুগলের নিচ থেকে
চোখ তুলল বুকানন।
‘আমি জেফ টমসন, ওল্ড কান্ট্রি কাউন্টির
শেরিফ।’
‘ছুরিটা আমি জুয়ায় হেরেছি। মাস দুই আগে। একটা সোনার ঘড়ি বাজি ধরে ছিল লোকটা।’ শেরিফের দিকে আড়চোখে তাকাল বুকানন। ‘আমার ধারণা ব্যাটা
জালিয়াতি করেছে।’
শব্দ করে হাসল টমসন, ‘লোকটা তারমানে তোমার চেয়েও চালাক! কিন্তুু আমি শুনেছি তুমি চাইলে যখন খুশি
টেক্কা কাটতে পার।’
‘আমার দিকে যখন কেউ পিস্তল তাক করে থাকে, তখন না।’ বুকানন স্মিত হাসল। তাসের জাদুকর হতে পারে লোকটা, কিন্তু কৌতুকবোধ আছে।
‘লোকটার নাম কী?’
‘ও বলেছিল কেনি শেরিডান। একটু বয়স্ক, ছফুটের ওপর লম্বা, কিন্তু কাগজের মতো পাতলা। কেন খুঁজছ?’
‘জান, কোথায় পাব তাকে?’
‘নিজে দেখিনি এ তল্লাটে। তবে শুনেছি ক্রাউন ক্রিকের ওদিকটায় একটা কেবিন আছে ওর।
মালকড়ির দরকার হলে বালু ছাঁকে।’
শটগানহাতে কেবিনের পেছনে
পজিশন নিল ডোলান। একটা ঢিবির আড়ালে জায়গা পেল হ্যানসন, যেখান থেকে সামনের দরজা আর দক্ষিণ দিকটা কাভার করতে পারবে। শেরিফ দাঁড়াল দরজা
থেকে সামান্য তফাতে, পথের ওপর। সেই কাকভোরে
ওখানে অবস্থান নিয়েছে ওরা।
টমসনের ভেতরটা তেতো হয়ে
আছে। রাতে ঘুমায়নি। একটানা পথ চলেছে আইনের থাবায় সন্দেহভাজনকে কবজা করার
উন্মাদনায়। আইন তার জীবনে আসমানি কিতাবের মতো পবিত্র। ওর বাবাও নাকি আইনের লোক
ছিলেন, সে শুনেছে। বাবাকে কখনো দেখেনি টমসন। ওর জন্মের আগেই এক বেজন্মা আউটলয়ের
অ্যামবুশে তিনি নিহত হন। মাকেও মনে নাই। সে যখন কয়েক মাসের শিশু, এক কঠিন অসুখে তিনিও টমসনকে ছেড়ে যান। সেই থেকে সে আন্ট পলির কাছে মানুষ। খালা
নিঃসন্তান;
ওকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন, আগলে রাখেন।
একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল টমসন, হঠাত্ সামনের পথ ধরে একজোড়া পায়ের আওয়াজ এগিয়ে আসার শব্দ পেল। অল্পপরেই
দৃষ্টিসীমায় এল লোকটা, পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে শেরিফকে।
‘হাউডি?’
সম্ভাষণ জানাল টমসন।
‘কে তুমি?
কী করছ এখানে?’ একরাশ বিরক্তি ঝরল লোকটার কণ্ঠে। লম্বা, তালপাতার সেপাই, গালের একপাশ থেকে গলা অবধি খামচির দাগ, কিছুটা শুকিয়ে এসেছে
ঘা। চারপাশে ত্রস্ত তাকাল লোকটা, তবে ডোলান কিংবা হ্যানসন, কাউকেই দেখতে পেল না।
‘আমি ক্রিকের ওপাশে একটা জায়গা কিনেছি,’ বলল টমসন। ‘তো এই কেবিনটা দেখে ভাবলাম মালিককে জিজ্ঞেস করি, বেচবে কি না।’
‘আমিই মালিক। ঠিক দাম হলে সবকিছুই সম্ভব।’
হাত বাড়িয়ে দিল শেরিফ, ‘পিটার।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও করমর্দন
করল লোকটা,
‘কেনি শেরিডান।’
টমসন বিনয়ের অবতার, ‘তুমি আগে।’
ঘুরে কেবিনের দিকে রওনা হলো
শেরিডান। চকিতে পিস্তল বের করে ওর ঘাড়ে ঠেকাল টমসন, হ্যামারটা টেনে দিল পেছনে। শক্ত হয়ে জমে গেল লোকটা।
‘আমি শেরিফ জেফ টমসন। তোমাকে গ্রেপ্তার করছি, মি. শেরিডান। তিনজনকে খুন করেছ তুমি। বুড়ো এলিয়ট এবং তার স্ত্রী। এবং ওদের
মেয়ে লিজ। হাত ওপরে তোল।’
‘কখনো শুনিনি নামগুলো।’
ডোলান ওর দুই গোড়ালি আর
কবজিতে শেকল পরান শেষ করে ওয়াগনটা আনতে গেল। হ্যানসেন বেরিয়ে এল কেবিনের দরজায়, ইশারায় ডাকল শেরিফকে। খানাতল্লাশি করে কিছু একটা পেয়েছে সে। শেরিডানের
হাতে-পায়ের শেকলটা একটা পাইন গাছে বেঁধে টমসন পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে।
‘শেরিফ,
দ্যাখো এটা,’ একটা টিনটাইপ লকেটসহ সোনার চেইন চোখের সামনে উঁচু করল ডেপুটি, তাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। ‘হারামিটার বালিশের পাশে
পেয়েছি।’
একদিনে শেষ হল বিচারকাজ।
এলিয়টরা যেদিন নিহত হয় মিসেস সানড্রিন ওদের দোকানে গিয়েছিলেন পনির কিনতে। তিনি
সাক্ষ্য দিলেন কেনি শেরিডানই সেই লোক যে তাকে বাকবোর্ডে পনির ওঠাতে সাহায্য
করেছিল। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস সানড্রিন। খুনিকে বাদ দিলে, তিনিই হলেন শেষ ব্যক্তি যিনি এলিয়টদের জীবিত দেখে ছিলেন।
তবে কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকল
হ্যানসেনের সাক্ষ্য। সে যখন বলল শেরিডানের বাংকের পাশেই লিজ এলিয়টের ছবি পেয়েছে, শেরিডানের ভাগ্য লেখা হয়ে গেল।
‘ঘুরে দাঁড়াও। তারপর হাত দুটো পেছনে করে গরাদের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দাও।’ নেহাত অনিচ্ছাভরে হুকুম তামিল করল শেরিডান। লোহার বালা পরিয়ে মাথা ঝাঁকাল
শেরিফ, ইশারায় ডোলানকে বলল কয়েদখানার দরজাটা খুলতে। এবার হ্যানসেন ঢুকল ভেতরে, কয়েদির পায়ে লোহার বেড়ি আর কোমরে চওড়া একটা বেল্ট পরাল, তারপর বেড়িসমেত হাতদুটো গুঁজে দিল ওটার নিচে।
‘এবার আগে বাড়, কেনি,’ শেরিফ হুকুম করল।
দুপাশ থেকে ওর দুবাহু ধরল
ডোলান আর হ্যানসেন। শেরিফ দরজা খুলে পা রাখল বোর্ডওয়াকে, ইশারায় সরে যেতে বলছে জনতাকে। এলিয়ট পরিবারকে সবাই ভালবাসত। তার ওপর লিজকে
নৃশংসভাবে খুন করায়, শেরিডান এ তল্লাটের সবচেয়ে
ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।
‘সরো সবাই,’
জনতার উদ্দেশে গলা চড়িয়ে বলল টমসন। ‘আইনের পথে ন্যায়বিচার হোক। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই লোক তার পাপের মাশুল গুনবে, কাজেই ঝামেলা বাড়িও না। আজ কেনি শেরিডানের মৃত্যুর দিন, তোমাদের না।’
ক্রুদ্ধ গুঞ্জন উঠল, বিকেল গড়িয়ে সাঁঝ হয়নি, এরই মধ্যে বেশিরভাগ লোক
মাতাল। তবে জনতা পথ ছেড়ে দাঁড়াল। ইশারা করল শেরিফ, কয়েদিকে নিয়ে দুই ডেপুটি ফাঁকায় পা রাখল।
ডোলান আর হ্যানসেন সামনে
এগোল শেরিডানকে নিয়ে, টমসন ওদের পেছনে, জনতার ওপর নজর রাখছে। খিস্তি করে উঠল দু-একজন, তবে বেশিকিছু করার সাহস দেখাল না কেউ। কয়েদিকে নিয়ে কাফেলা নির্বিঘ্নে এগিয়ে
গেল ফাঁসির মঞ্চের দিকে। বিকেলে ঈষত্ হেলে পড়া সূর্যের আলোয় ছায়াগুলো পাশ থেকে
ওদের অনুসরণ করল।
শহর কেন্দ্রের ফাঁকা চত্বরে
কাঠের পিলার আর তক্তা দিয়ে বানান হয়েছে অস্থায়ী ফাঁসির মঞ্চ। সোনাগলা তেরছা রোদ
বিচিত্র আলোছায়ার নকশা এঁকেছে মঞ্চ ঘিরে। সিঁড়িতে পৌঁছুবার ঠিক আগে, হঠাত্ সামান্য বাঁকা হয়ে গেল শেরিডানের হাঁটুজোড়া, তবে ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করেছে মনে হলো না। ওকে মাঝে রেখে শেরিফ এবং তার দুই
ডেপুটি একে একে উঠে গেল ওপরের পাটাতনে। পাদ্রি জেমস আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু জল্লাদকে দেখা গেল না কাছেপিঠে।
ডোলান আরও শক্ত করল
শেরিডানের কনুই আর গোড়ালির বাঁধন। পাদ্রি পবিত্র গ্রন্থ থেকে পড়া শুরু করেছেন, তাড়াতাড়ি কাজ সারতে আগ্রহী। ওবেলায় দাওয়াত আছে। শহরের সবচেয়ে ধনী, জিম ম্যাসনের ছেলে হয়েছে, মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে
নবজাতককে আশীর্বাদ করতে যাবেন। হ্যানসেন গেছে জল্লাদের খোঁজে। ডোলানের কাজ যখন
সারা হলো, শেরিডানকে ট্র্যাপডোরের ওপর নিয়ে দাঁড় করাল শেরিফ, গলায় ফাঁস পরিয়ে বাঁধন শক্ত করল, বাম কানের নিচে রাখল
গিঁটটা। এরপর বেল্টের নিচে গুঁজে রাখা কালো হুডটা বের করে ওর মুখ ঢেকে দিল।
শেরিডানের কানের কাছে মুখ
নিয়ে গেল শেরিফ,
‘সাহস রাখ, কেনি। এই তো আর অল্পক্ষণ, তারপরই তুমি চির শান্তির
দেশে চলে যাচ্ছ।’
টমসন পেছনে সরল, পাদ্রি জেমসের পড়া শেষ করার জন্য অপেক্ষা করছে। সিঁড়ি ভেঙে হাঁপাতে হাঁপাতে
উঠে এল হ্যানসেন, হতভম্ব চেহারা। শেরিফের
কানে কানে বলল,
‘জল্লাদের বুকে ব্যথা। ডাক্তারের টেবিলে
শুয়ে আছে। বলছে কাজটা করতে পারবে না। তোমাকে বলল করতে।’
ঘাড় ফিরিয়ে চারপাশের জনতার
দিকে তাকাল শেরিফ টমসন। চোখেমুখে বুনো উল্লাস নিয়ে অপেক্ষা করছে লোকগুলো। এটাই
পশ্চিমের বৈশিষ্ট্য: বৈরী প্রকৃতি আর পরিবেশের সঙ্গে লড়তে লড়তে নিজেদের অজান্তেই
হিংস্র হয়ে উঠেছে ওরা। এমনিতে শান্ত, উন্মুক্ত প্রেইরির
মতোই উদার,
কিন্তু স্বার্থে ঘা লাগলে চোখ উল্টাতে
দ্বিধা করবে না। হয়ত কদিন আগেও ওদের কেউ কেউ সাজা পাওয়া এই লোকটার সঙ্গে পানশালায়
আড্ডা দিয়েছে,
একত্রে ড্রিংক করেছে, খাবার ভাগ করেছে; কিন্তু এখন, অবস্থার ফেরে, সেই লোকগুলোই ওর মৃত্যুর
ক্ষণ গুনছে। অতি সহজ-সরল বলেই কিনা কে জানে, মাঝে মাঝে ভাবে সে, সীমান্তের লোকগুলোর ঘৃণার প্রকাশও চরম।
অবশ্য নিজেকে সে ওদের একজন
মনে করে না। বাইরে অমায়িক একটা চেহারা বজায় রাখলেও, নিজের ভেতরটাকে সে একধরনের অনমনীয় ভালমন্দ বিশ্বাসের ঘেরাটোপে ঘিরেছে। সবকিছু
সে দেখে শাদা-কালোয়, সুনীতির দাঁড়িপাল্লায় মেপে।
আবার নিজের চারপাশটা দেখল
টমসন। সে আইনের লোক, জল্লাদ না। কিন্তু কাউকে এই
নরকযাতনা দুবার দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, এমনকি কেনি
শেরিডানকেও না। পাদ্রি জেমস শেষ করে আনছেন, দ্রুত পড়তে গিয়ে থুতু
ছিটছে। সাবধানে গা বাঁচিয়ে, ট্র্যাপ লিভারের সামনে গিয়ে
দাঁড়াল শেরিফ টমসন। জনতা লক্ষ্য করছিল সবকিছু, বুঝতে পারছে কোথাও
একটা গড়বড় হয়েছে। শেরিফকে জল্লাদের জায়গায় দেখে বস্ফািরিত হলো তাদের চোখ, শব্দ করে নিশ্বাস ফেলল। এখানে আলো ঝলমলে হলেও, দিগন্তে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। টমসনের মনে হলো একপাল ইঁদুর এগিয়ে আসছে
গুটিপায়ে, শাদা মেঘগুলোকে হটিয়ে আস্তে আস্তে গ্রাস করছে আকাশটাকে। নিচে ফাঁসির মঞ্চের
ছায়াগুলোকে মনে হচ্ছে টুমস্টোন।
পড়া শেষ করলেন পাদ্রি জেমস, ‘আমেন’ বলে সরে গেলেন। খুক্ করে করে কাশল টমসন, শুরু করল, ‘কেনি শেরিডান, আইনমাফিক জুরি তোমার বিচার
করেছেন। জুরি দলের সবাই ছিলেন তোমার সমাজেরই মানুষ। তারা তোমাকে খুনের অপরাধে দোষী
সাব্যস্ত করেছেন এবং ফাঁসিতে তোমার মৃত্যুদ্ল দিয়েছেন। খোদা তোমার আত্মাকে শান্তি
দিন।’
কথা শেষ করেই লিভারটা
হ্যাঁচকা টেনে ধরল শেরিফ। পাটাতন সরে যেতে ভয়ার্ত একটা চিত্কার বেরোল কালো হুডের
আড়াল থেকে,
ঝপাত্ করে নিচে পড়তে শুরু করল ও, তারপর অকস্মাত্ দড়ির শেষপ্রান্তে আটকে গেল দেহটা, মট্ করে ঘাড়টা ভেঙে গেল। দূর-আকাশে বিজলি চমকাল।
ট্র্যাপডোরের কাছে হেঁটে
গিয়ে নিচে উঁকি দিল টমসন, দড়িটা টানটান হয়েছে কিনা
পরখ করার জন্য নিজের অজান্তে হাত বাড়াল। এবং সেখানেই ভুলটা করল। শেরিডানের দেহে
তখন খিঁচ ধরেছে,
মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর দড়ি বেয়ে
সেই ছটফটানিটা চিরকালের জন্য শেরিফ টমসনের মস্তিষ্কে গেঁথে গেল। যেন সাপ ছুঁয়েছে, দড়িটা ছেড়ে দিল সে, মনে হচ্ছে এখুনি ওর সব
নাড়িভুড়ি উলটে বেরিয়ে আসবে।
জনতা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে পড়তে শুরু করেছে। লাশ সরানোর জন্য ডেপুটিদের সঙ্গে করে নিচে নেমে গেল
শেরিফ। হঠাত্ সেখানে হাজির হলেন আন্ট পলি, অদ্ভুত একটা অনুরোধ
করলেন, ‘জেফ, লোকটার মুখ দেখব আমি। একদম কাছ থেকে। দরকার আছে। ওকে মনে হয় আমি চিনি।’
‘আন্ডারটেকারের কাছে থাকবে ও, কাল গোসলের পর দেখ। এখন
দেখার অবস্থায় নাই।’
‘না, এখুনি দেখতে হবে। কাল পাউডার ছিটানোর পর আর চেনা যাবে না। দরকার আছে, জেফ। তুমি জান, কারণ না থাকলে আমি বলতাম
না।’ খালা ভীষণ জেদি, টমসন জানে। একবার যখন বের
করেছেন মুখ দিয়ে, কিছুতেই আর শুনবেন না। কাঁধ
উঁচুনিচু করল সে, হুডটা সরিয়ে নিল।
মুখটা এঁকেবেঁকে গেছে, গলার চামড়া কেটে বসে গেছে দড়ি, তারপরও শেরিডানকে
দেখতে খুব বীভত্স লাগছিল না। বেশ কিছুক্ষণ ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন
আন্ট পলি, ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন।
সোজা হলেন বৃদ্ধা, ‘আমি যা চেয়েছিলাম দেখেছি। তোমরা এবার ওকে নিয়ে যেতে পার।’
সেরাতে নীরবে ডিনার সারল
ওরা। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে টমসন জানে কিছু একটা আসছে। সে অপেক্ষায় রইল।
অবশেষে টমসনের সামনে এক
পেয়ালা ধূমায়িত কফি রেখে মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলেন আন্ট পলি, হাতে কফি।
‘এলিয়টদের মার্ডারে আমি নিজেকে জড়াইনি, জেফ, কারণ আমার কিছুই করার ছিল না। তুমি যখন কেনি শেরিডানকে অ্যারেস্ট করলে, নামটা আমার চেনা মনে হয়নি। আমি বিচার দেখতে যাইনি, কিন্তু রায়ে খুশিই হয়েছিলাম। ফাঁসি দেখতে গিয়েছিলাম কারণ আমি মনে করি এটা দেখা
নাগরিক দায়িত্ব যত বীভত্সই হোক না কেন, এর ভেতর দিয়ে আমাদের
পড়শীরা ন্যায়বিচার পেয়েছে।’
কফিতে চুমুক দিলেন বৃদ্ধা।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছে। খোলা জানালাপথে একটুআধটু ছাঁট
আসছিল, কিন্তু আন্ট পলি ভ্রূক্ষেপ করলেন না, ‘সকালে যখন লোকটাকে
প্রথমবারের মত দেখি, আমি চমকে উঠেছিলাম। মনে
হয়েছিল ওকে আমি চিনি। তুমি তখন ওর মাথায় হুড পরাচ্ছিলে। তাই আমাকে নিশ্চিত হতে হল।
লোকটার সঙ্গে জীবনের একটা সময়ে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, জেফ। ওর আসল নাম স্কট মালদুন।’
কফি নাড়লেন আন্ট পলি, সোজা তাকালেন শেরিফ টমসনের দিকে, ‘লোকটা একসময়ে আমার
স্বামী ছিল।’
ঘরে বাজ পড়লেও বোধহয় এতটা
অবাক হত না টমসন। তার ধারণাতেই আসেনি খালার কখনও বিয়ে হয়েছিল। ভেবেছিল নিশ্চয়
কপালে বর জোটেনি। খানিক পর মহিলা আবার শুরু করলেন, ‘মাত্র কয়েক মাস আমি বিবাহিত ছিলাম, জেফ। তারপর একদিন… একদিন জানলাম, আমার স্বামী দুশ্চরিত্র। না, ভুল বললাম,
একটা আস্ত শয়তান। আমি আবিষ্কার করলাম সে
আমার ষোল বছরের বোনকে ধর্ষণ করেছে।’
বৃদ্ধা তাকালেন শেরিফ
টমসনের দিকে,
ঘষা কাচের মত চোখজোড়া সহসা ভীষণ উজ্জ্বল
লাগছে, ‘ও তোমার মাকে গর্ভবতী করেছিল, জেফ। তোমার বাবা আউটলদের
সঙ্গে যুদ্ধে মারা যায়নি। এই মিথ্যেটা বলা হয়েছিল তোমাকে লজ্জা থেকে বাঁচাবার
জন্য। স্কট মালদুনই তোমার বাবা।’ *
বিদেশি গল্পের ছায়া
অবলম্বনে
সূত্র: ইত্তেফাক সাময়িকী:
শুক্রবার, ৮ জুন ২০১২,
২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯
লেখক পরিচিত
রওশন জামিল
জন্মসাল: ১৯৫৮
জন্মস্থান: ঢাকা
শিক্ষা: বিএ অনার্স, এমএ (বাংলা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আন্ডারগ্র্যাজুয়েট (জার্নালিজম ও ফোটোগ্রাফি) : সিটি ইউনিভার্সিটি অভ ন্যু ইয়র্ক।
বর্তমান পেশা: লিঙ্গুইস্ট, নিউ ইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অভ এডুকেশন
উল্লেখযোগ্য অনুবাদ গ্রন্থ: দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি এবং দি অ্যাডভেঞ্চার অভ হাকলবেরি ফিন; এছাড়া ওয়েস্টার্ন ধারার ওসমান পরিবার সিরিজ।
জন্মসাল: ১৯৫৮
জন্মস্থান: ঢাকা
শিক্ষা: বিএ অনার্স, এমএ (বাংলা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আন্ডারগ্র্যাজুয়েট (জার্নালিজম ও ফোটোগ্রাফি) : সিটি ইউনিভার্সিটি অভ ন্যু ইয়র্ক।
বর্তমান পেশা: লিঙ্গুইস্ট, নিউ ইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অভ এডুকেশন
উল্লেখযোগ্য অনুবাদ গ্রন্থ: দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি এবং দি অ্যাডভেঞ্চার অভ হাকলবেরি ফিন; এছাড়া ওয়েস্টার্ন ধারার ওসমান পরিবার সিরিজ।
0 মন্তব্যসমূহ