
শমীক ঘোষ
ঠিক যেন গাছ। শিকড় গেড়েছে সমুদ্রের ভিতর। শাখা প্রশাখা মেলেছে। ইছামতি, রায়মঙ্গল, মাতলা, বিদ্যাধরী কত না নাম। যেন জলের বুকের ভিতর গেড়ে বসেছে জলের শিকড়। আর যদি কাণ্ড খুঁজতে যাও তবে উঠে যেতে হবে খাড়া। মোটা কাণ্ড হয়ে নেমে এসেছে সেই সুদুর উত্তর থেকে। নদী, গঙ্গা, মা, ভগবান, ভাগিরথী যে যা বলবে।
এই নদীতে ভেসে আসত মাছমারারা। হাসনাবাদ, সন্দেশখালির তলা দিয়ে আসত। পুঁড়া, আতুড়ে, ইটিণ্ডে, দণ্ডিরহাট, শাকচূড়া, টাকি - তাবৎ পূব উত্তর আর পূব দক্ষিণ থেকে আসত যাবৎ মৎসজীবিরা। জেলে, চুনুরি, নিকিরি, কৈবর্ত, মালো আসত সবাই। আর আসত ধলতিতার বিলাস। তেঁতুলতলার বিলাস। সমরেশ যার নাম রেখেছিলেন তেঁতুলে বিলাস। সে সব অনেক অনেকদিন আগের কথা। যখন জল ছিল গঙ্গায়।
যখন কলকাতা শহরের ডকে ফিরত আস্ত জাহাজ। তারপর অনেকদিন চলে গেছে। ঘোলা জল আরো ঘোলা হতে হতে, কোমর ভেঙে আছাড় খেয়েছে চরায়। ভরা যৌবনের ডাগর নদী বুড়ি হয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে। আর বিলাস, সাইদার বিলাস, দক্ষিণে সমুদ্রের নুন শরীরে লাগিয়ে কখন যেন বুড়ো থুত্থুড়ে হয়ে সেই গঙ্গার ধারে ছাই হয়ে গেছে।
“টানাছাদি টেনে চলি, পাথালি লৌকার বুক-হেওই আওড়ের ঘূর্ণি-জলে দেখব তোমার মুখ ।।বড় উথালি পাতালি আমার বুক।।”
শেষ দিকে আর গাইতে পারত না বিলাস। হাঁপ ধরত। ছানি না কাটা চোখে সন্ধ্যার অন্ধকারে বিলাসের হাত কাঁপত। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সে যেন দেখতে চাইত টানাছাদি জাল বেয়ে পাথালি, অর্থাৎ নদীর আড়াআড়ি ভেসে যাচ্ছে সে। মুখের ডগা দিয়ে কষ বেয়ে নামত বিলাসের। কষ চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামত খোলা বুকে। বিলাস তখন যেন বাদার আদি সেই মালো। বিলাসের বাপ নিবারণের চোদ্দ পুরুষের চোদ্দ পুরুষ আগের সেই মালো, যিনি হেঁটে এসেছিলেন সমুদ্রের উপর দিয়ে। ওয়াঁর কল্যাণেই সমুদ্দুর পারে মালো বংশ বড় হয়েছেলে, ছইড়ে পড়েছেলে। মালোরা রাজা হয়েছিল দেশের। সমুদ্দুরের উপর দে, পা ফেলে ফেলে দিব্যি হেঁটে এসেছিলেন কালো কুচকুচে দিগম্বর সেই পুরুষ। ক্যাঁচা হাতে নে, হেঁটে এয়েছেলে। দক্ষিণ রায়ের সাগরেদদের যুদ্ধে হারায়ে জিতে নেয়েছেলে আস্ত একটা বাঘছাল। বিলাস যেন তাঁর মত হয়ে উঠত। মাছের চাক যেন পাক খেয়ে খেয়ে ভেসে যেত উঠোনের অন্ধকারে, হলুদ বাল্বের আলোর নিচে। বিলাস মাছ মারতে জানত। খ্যাপ মেরে মেরে সে যেন মাছের চাক তাড়িয়ে ফিরত। উঠোনের আধো অন্ধকারে হাত দুটো কাঁপত বিলাসের। পা নাড়তে চাইত। নড়ত না। আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত ঠাকুর্দাকে নড়তে দেখে হাঁক দিত সুবল, “দাদু হোই দাদু, কষ্ট হয়?”
বিলাস উত্তর দিতে পারত না। সে শুধু নদী খুঁজত। নদী ছেড়ে এসেছিল তার ছেলে বলাই। মাছমারা হয়ে কটা টাকাই বা রোজগার হয়? সে তাই উঠে এসেছিল মানচিত্র ধরে, কলকাতা শহরের কোলে। বস্তিতে। সাইদার গুনিন নিবারণ মালোর নাতি লেদ মেশিনের লেব্যার। তার ছোট্ট ঘরে বাল্ব জ্বলে ষাট ওয়াটের। আর ঘরের কোণে চিক চিক করে সাদা কালো টিভি। নদী, সেও আছে একই শহরে, গা ঘষ্টে ঘষ্টে, ফেলে দেওয়া বৃদ্ধা মায়ের মত। বলাই মালোর ঘরের পিছনে ঘর। আরো ঘর। তারপর বাগজোলা খাল। নোনা গাঙে যখন নিদেন কাল, মিঠে জলে যখন সুদিনের বান আসে, দখিনে বাওড় যাকে বলে সমুদ্রের ঝড়, যখন সোজা ঝাপ্টা মারে সুদূর দখিনে, তখনো শান্ত খালের জল। শহরের অনেক প্লাস্টিক তার স্রোত আটকায়। কালো দুর্গন্ধময় জলে চাঁদও ছায়া ফেলতে থমকায়। বাওড় তাড়িয়ে আনে না কোন নৌকা। শুধু দুর্গন্ধ ইটের শরীর গলে, টালির চালের ফাঁক দিয়ে গলে মিহি হয়ে জমাট বাতাসে শুয়ে থাকে। সুবল শুধু দাদুকে দেখত। আর সামান্য আলোয় বই খুলে বসে পড়বার চেষ্টা করত – গঙ্গা ভারতবর্ষের প্রধান নদী। উত্তরপ্রদেশ থেকে বিহার হয়ে পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করে। ষাট ওয়াটের বাল্বে ক্লাস সিক্সের ভূগোল বইয়ের পাতার ট্যারাব্যাঁকা অক্ষরেরা নড়াচড়া করত। মাঝে মাঝে বইয়ের পাতার থেকে বেরিয়ে ঘুরে বেড়াত ঘরময়। নাচত। সুবল দাদুকে দেখত আর ভাবার চেষ্টা করত মোহনা। যেখানে মিঠে জল নোনা জলে মেশে। সবজে জল নীলচে জলকে স্পর্শ করে।
সুবলের দেখা হয়নি সেই জল। ভগবতী যেখানে সাগর হয়ে যান। মেলেন, মেশেন প্রকাণ্ড জলে। বাঁধাছাদি জাল বেঁধেও যেখানে জলকে ধরা যায় না। তুলে ফেলা যায় না সমুদ্রের সব মাছ। সুবল জল দেখেছে খালের, পচা অন্ধকার সেই জল। আর সরু ফিকে জল টাইম কলের। তিরতিরে সেই জলের পাশে অনেক বালতির ভিড়, রাগারাগি, গুঁতোগুতি, মারামারি। শ্যাওলা ধরা কালো ফুটপাথ দিয়ে বয়ে যেতে দেখেছে তিরতিরে লাল জল, রক্তের দাগ লেগে আছে সেই জলের গায়ে। সুবল ভাবত বড় হয়ে সেও ঠাকুর্দার মত হবে, দাঁড় বেয়ে যাবে। নিচে নদী, সে খেয়ালে বয়ে চলে, কখনো জোয়ারে কখনো ভাটায়। আর নদীর স্রোত টোকা দেবে নৌকার খোলে। নাড়াবে, দোলাবে। নদী সেও মা। মাছমারা হবে সুবল, যেমন ছিল তার বাপের বাপ, তারও বাপ। একা দুপুরগুলোয়, বলাই যখন কাজে গিয়েছে, লোকের বাড়ী বাসন মাজতে গিয়েছে সুবলের মা, সুবল তখন মাছমারা হয়ে যেত। বস্তির ঘরের চৌকি হয়ে যেত সরু বাছাড়ি নৌকা, আর দরজার খিল নৌকার দাঁড়। খুব জোরে দাঁড় বাইত সুবল। আর সেই দাঁড়ের আঘাতেই যেন ভেসে যেত ঘরের দেওয়াল, মেঝে সব। বস্তির ঘরের ভিতর বয়ে যেত স্রোতস্বিনী প্রবাহিনী ভগবতী। একুল ওকুল দেখা যায়না তার। গামছা যেন খ্যাপ। খ্যাপ ছুঁড়ে ফেলে সুবল। টেনে তোলে। মায়ের ফেলা শাড়ী টানাছাদি। সারা গায়ে তার অসংখ্য অদৃশ্য মাছ। সুবল তুলে রাখে যত্নে। আরো কত নৌকা বাইতে হবে তাকে। ধরতে হবে আরো কত মাছ। বাইতে হবে। বাচ লড়তে হবে আরো কত অদৃশ্য মাছমারার সাথে।
ভরা গঙ্গায় ভরা কোটাল আসে, মরা কোটাল যায়। আকাশজুড়ে কে যেন বিছিয়ে রাখে বিরাট টানাছাদি জাল। অসংখ্য তারা আটকে থাকে সেই জালের গায়ে। যেন সহস্র মীনচক্ষু। কখনো জ্যোৎস্নায় ঘোলা, কখনো কৃষ্ণপক্ষে কালো নীল। মীনের রাজ্যে চলাফেরার জন্যই জন্ম হয় মাছমারার। তার গহীন স্রোতের অন্ধিসন্ধি জানে সে। মীনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ সম্পর্ক। তার সীমানা পেরিয়ে একদিন সে চলে যাবে দূর সমুদ্রে। আর একদিন ফিরতে হবে তাকে। নির্ঘাত ফিরতে হবে, ধরা দিতে হবে। মীন আর মাছমারার জীবন এক সূত্রে গাঁথা। গাঁথা হয়ে আছে জন্মকাল থেকে। তেমনি বিলাস ধরা দিল একদিন। ভোরবেলায় বলাই, বলাইয়ের বউ, সুবল সবাই ঘুমোচ্ছে। অন্য চৌকিতে পড়ে আছে তেঁতলে বিলাস। ভোররাতে সে যেন শুনতে পেল কার গলা।
-এই শোরের লাতি। এই গুয়োটা। ওঠ।
এই নামে কে যেন ডাকত তাকে, অনেক অনেক কাল আগে। বিলাস যেন উঠে বসতে চায়।
-খুড়ো ? পাঁচু খুড়ো!
-শোরের লাতি। বিলেস। এতদিনে ঘুম ভাঙল তোর। ওঠ উঠে পড়। ঐ দেখ তোর বাপ এয়েছে। এয়েছে মাছমারাদের দেবতা খোকাঠাকুর। এয়েছে তোর বন্ধু সয়ারাম। ওঠ গুয়োটা। যতজনকে মেরেছিলি তারা সব্বাই এয়েছেন তোকে নিতে। শত সহস্র মীন। তাদের ঠান্ডা চক্ষু নিয়ে। একদিন তুমি মেরেছিলে। আজ তোমায় মারেন আরেকজন। একদিন তুমি তাদের ধরেছিলে, আজ তারা এয়েছেন তোমায় নিতে।
বিলাসের মনে হয় যেন ইলিশ ধরার স্যাংলো জাল বিছিয়ে রেখেছে কেউ। বিলাস আটকে গেছে সেই স্যাংলো জালে। কিচ্ছুটি করার জো নেই। পাখনা ছোঁড়ার জো নেই। ল্যাজ ঝাপ্টানোর জো নেই। বিলাস যেন এক প্রকাণ্ড মীন। আটকে আছে। যেমন ছিল এতদিন। জাল তোলো হে মাছমারা। আমাকে তুলে নিয়ে ফেল অন্য কোথাও। জলের বাইরে। জীবনের বাইরে। এতদিন শুধু ঘাই মেরেছি। এইবার যাব জলের বাইরে। নিঃশ্বাস নিতে পারব না। কিন্তু সে কথা শুনছে কে?
কার একটা মুখ মনে পড়ে বিলাসের। লাল শাড়ি। গায়ে জামা নেই। মুখখানা ঢলঢলে। হিমি না। হিমিই তো। মাছমারাদের ফড়েনি হিমি। যে হিমি বিলাসের সাথে সমুদ্রে যেতে চেয়েছিল। হতে চেয়েছিল সমুদ্রের ফড়েনি। কিন্তু শেষ অবধি নেমে গিয়েছিল নৌকা থেকে। টান আসে। আর সময় নেই। এইবার বাইরে যেতে হবে। জাল গোটাচ্ছেন তিনি। বাইরের আকাশ কানকো ছেঁড়া রক্তলাল। বিলেস চলে গেল। ছাই হতে। তুমি মারতে মাছ। তোমায় মারলেন আরেকজন।
জলের উপর তিবড়ি জ্বেলে যেমন রান্না চাপায় মাছমারারা, তেমনি জ্বলে উঠল বিলাস। ছাই হয়ে গেল। সমুদ্রের মত বিরাট হয়ে আকাশে মিশে গেল।
বিলাস যখন পুড়ছে তখন শ্মশানের ধারে প্রথমবার গঙ্গা দেখেছিল সুবল। পোড়া গন্ধ আর ধোঁয়ার মাঝখান দিয়ে দেখেছিল তার বিস্তার। ঘোলা জল। ওই দূরে দক্ষিণে দেখা যায় পারাপার করে খেয়া, লঞ্চ। তারপরে জেটি। পশ্চিমের যাবৎ বাঁধা ঘাটে ভাঙন ধরেছে। শানসুদ্ধ উপড়ে নিয়ে, মুখ থুবড়ে ফেলেছে পারে। তলে তলে খাচ্ছে বহুকাল ধরে সেই বিলাসের বাপ নিবারণ মালোর সময় থেকে। জল নামছে খল খল করে। একে দখিনা বাতাস। তায় ভাটার জলে টান। যেমন ভাটার টান তেমনি ঢেউ। এক-এক জায়গায় পাক খাচ্ছে জল। ওটি ঘূর্ণি-ঘূর্ণি খেলা। মানুষ খাবে না ওতে। লতাপাতা পেলে এক গরাসেই সাবাড় করবে। ছোটখাটো তক্তা ধরে গেলে, ধরে রাখবে খানিকক্ষণ। সুবল গঙ্গায় এসেছ। সামনে তোমার জলেঙ্গা জল। তোমার ঠাকুদ্দা, চোদ্দপুরুষের প্রাণ রসানো। জলেঙ্গা জল তাদের গঙ্গায় আসার প্রস্তাবনা।
পাঁচু মালো থাকলে বলত, একথা জানান দিয়ে গেছে অম্বুবাচী। জানান দিয়েছে, টানের দিনের কচি মেয়েটি, মা হবেন এবার। নারীত্ব দর্শন করেছেন সসাগরা ধরিত্রী। মানুষের পাপ সব। তাই মন বলে, তোমার আমার ঘরনি আর কন্যার মত। সেদিনের ঝিট্কি-চুলো মেয়ে, দেখো ফেঁপে-ফুলে, ছড়িয়ে ভরিয়ে, দিগদিগন্তে ঢলঢলে। কেন? না, মা হলেন এবার সেদিনের মেয়ে। কোল ভরে এবার জন্ম হবে সোনামানিকের।
এইসব কিছুই জানলে না তুমি সুবল মালো। জালে বেঁধা মীনের মতই তুমি শুধু পাকসাট খেয়ে গেলে ঘোলা জলে। বস্তির বাড়িতে। সেও যেন আরেক প্রকাণ্ড জাল। পড়ে আছে মাটির উপর। টালির চালের মাঝে সরু রাস্তা সুতোই যেন। বর্ষার জলে কাদায় মাখামাখি। অসংখ্য অজস্র মানুষের ভিড় সেখানে। মানুষতো নয় মেকো। হেঁটে চলেছে পালে পালে কাকড়ার বাচ্চা মেকো। অসংখ্য জন্মায়। মরেও অসংখ্য। মাছের বাহন মেকো। বস্তির মানুষ বাহন কার? উঁচু মানুষের? উঁচু বাড়ির? কাজ করে তোমার মা যেখানে। বাপে করে যাদের মজদুরি?
বর্ষার রাতে, ভিড় করে আসে দমবন্ধ জানলা বন্ধ বাতাস। আর জানলাই বা কি। খুপরির পর খুপরি শুধু। দূরে খালের থেকে ভেসে আসে পূত গন্ধ। যেন মেকোর মড়ক লেগেছে। আঁশটে গন্ধে ভরে গেছে মাছমারার নৌকার চারপাশ।
চাদরটা আরো ভালো করে টেনে নেয় সুবল। স্বপ্নে এলিয়ে দেয় মাথা। ঘোলা জলে ভেসে যাচ্ছে সে। দক্ষিণা বাওড় টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। উপরের টালির গায়ে অজস্র জলের ধারা শব্দ করে। দাঁড়ের আঘাতে ভাঙে জলের গুমোর। আর জল গুমোর ভাঙে মানুষের। মাটিকে পুড়িয়েছ তুমি। শক্ত করেছ। জল আঘাত করে সেখানে। মাটি ধোয়। যদি পায় সামান্য ফুটো টপটপ পড়ে তোমার শরীরে। ওই জলই তো তোমার শরীরে। প্রবাহিত ধমনী শিরায়। চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে ঘাম হয়ে, সামান্য গরমে। সুবল দেখে দাদুকে। হোই সুবল। মালোর ব্যাটা মালো। জল কই তোর? কোন মাটিতে শিকড় গাড়লি তুই ? ওই মাটি জল ছুঁয়েও শস্য দেয় না। দেয় না অন্ন। শুধু শক্ত হয়ে, ইট হয়ে বদ্ধ করে রাখে মানুষকে।
সুবল দেখে ক্যাচা হাতে নে হেঁটে আসতেছেলে দাদু। কালো শরীরে কালো পেশি দোলা খায় ঢেউয়ের মত। পায়ের টোকায় টোকায় ছিটকায় নদীর শরীর। অসংখ্য মাছ দাদুর পায়ে পায়ে। পিছন পিছন মাছের প্রকাণ্ড চাক। মাছমারার সেই ঈশ্বর সেই বাহন। তুমি মারবে তাকে সে তোমায় মারবে। সে থাকলে ভাল। না এলে টোটা, মন্বন্তর।
সুবল একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ঘোলা জল আরো ঘোলা হতে হতে কালো। দক্ষিণে যমের দূয়ার। আর দক্ষিণে সমুদ্র। সমুদ্র নেয় মাছমারাকে। সমুদ্র দেয়ও দু’হাত ভরে। কালো সেই জল প্রকাণ্ড হয়ে ভেসে যেতে যেতে আকাশ ছুঁয়ে দেয়। সে অতলান্ত। সে সীমাহীন। জীবনের মতই। ও সুবল মালো, কোন সীমায় তুমি গিয়ে থামবে? কোন সেই মাটির চরে ধাক্কা খাবে তোমার নৌকা। সুবল ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমিয়ে থাকে বলাই মালো। সুবলের মা। আর প্রকাণ্ড একটা শহর শুষে খায় নদীর রক্ত।
নদী সেও রিক্ত। দিয়ে গিয়েছে সে মানুষকে। আর মানুষ তার শরীরে ঢেলেছে বিষ। আর কত বিষ দেবে তুমি মানুষ। মা যে, ভগবতী যে, ভাগীরথী যে তোমার শুক্কে যাচ্ছেন। রোগা হয়ে কৃষ হয়ে চরায় চরায় ঢেকে ইতিহাস হয়ে যাচ্ছেন। অগ্রহায়ণ পড়ে গেছে। উত্তুরে হাওয়া বয়। পাল নেই তাই উড়িয়ে নিয়ে যায় বাচ্চাদের বেলুন। মেয়েদের চুল। এলোমেলো হয়ে যায় সুবলের চুলও। মা যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ছেলের মাথায়। সামনে দীর্ঘ কালো জল। সমুদ্র। আরব সাগরের পারে সুবল কাজ করে প্লাম্বারের। জলকে বইয়ে নিয়ে চলা সরু পাইপে, জলকে বন্দী করে রাখার কাজ করে সে।
সামনের সমুদ্র অসীমে মেশে। শেষ নেই তার। আকাশের গায়ে কালো ধোঁয়ার চাদর। সমুদ্রের জলে দোলা খায় টুরিস্টের ফেলা প্লাস্টিকে। দোলে আর হাতছানি দেয় সুবলকে। সুবল যেন দেখতে পায় বিলাসকে। ওই দূর আকাশের নিচে ভেসে যাচ্ছে তার দাদু। আরো দূরে সরে যাচ্ছে। পিছন পিছন তাঁর শত সহস্র মীন।
--------------------------
(সমরেশ বসুর গঙ্গা এই লেখার অনুপ্রেরণা। আমারও অনুপ্রেরণা। উদ্ধৃতি ছাড়াই অনেক জায়গায় সমরেশের গঙ্গা থেকে লাইন তুলে দিয়েছি। তাঁর বাক্যের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে আমার শব্দ। প্রথমে ভয় করেছিল। তারপর ভাবলাম ভয় কি। তাঁর লেখা পড়েই তো লিখতে চাওয়া। ভাষা শেখা। সেইদিক দিয়ে তিনিতো পিতা। বাপের কাছে ছেলের ভয় কি?)
লেখক পরিচিতি
শমীক ঘোষ
গল্পকার।
প্রবন্ধকার।
পড়াশুনা ঃ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
বোম্বে থাকেন
0 মন্তব্যসমূহ