ইলিশ, কাঁঠাল অথবা জীবনের গল্প


আহমাদ মোস্তফা কামাল

রাত দুপুরে ইলিশ রানড়বার গন্ধ পাড়াময় ছড়িয়ে পড়লে গাঢ়-ঘুমওয়ালারা তা
টের পায় না বটে, কিন্তু পাতলা-ঘুমওয়ালা প্রতিবেশীদের ঘুম ভেঙে যায়,
আর ভাবেÑ এই এত রাইতে ইলশা রান্ধে কিরা? এই পাড়ার বাতাস
বহুকাল ইলিশের গন্ধে মৌ মৌ করে ওঠেনি। ভাতই জোটে না, তার আবার
ইলিশ! কিন্তু ঘুমভাঙা লোকগুলো গন্ধের উৎস বুঝতে না পারলেও, যারা
জেগে ছিলো, তারা ঠিকই বোঝেÑ ফজার বউ তাইলে রানতে বইছে!

ফজা, মানে ফজর, মানে ফজর আলি যে আজকে ইলিশ মাছ নিয়ে
ফিরেছে, তারা তো সেটা নিজ চোখেই দেখেছে। কিছুক্ষণ আগেই তারা
ফজর আলির বাড়ি থেকে ফিরেছে, তার বাচ্চা মেয়েটাকে কবর দিয়ে।
ফিরে, ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। চোখের সামনে নিজের ছেলেমেয়ে
মরে গেলে কেমন লাগতে পারে ভেবে শিউরে-শিউরে উঠেছে, আর মনেমে
ন কাতর প্রার্থনা জানিয়েছেÑ ‘আল্লা, আল্লা, পুলাপানগুলারে তুমি বাঁচায়া
রাখো, গুনাগাতা যা করছি হের জইন্যে আমাগো শাস্তি দ্যাও, কষ্ট দ্যাও,
অসুখবিসুখ দ্যাও, যা ইচ্ছা তাই দ্যাও, ওগো তুমি বাঁচায়া রাখো গো মাবুদ।
ঘুমন্ত সন্তানদের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে যখন হয়তো তাদের মনে
বাৎসল্যরস নতুনভাবে জেগে ওঠে, তখন অকস্মাৎ ইলিশের গন্ধ এসে নাকে
ঝাপটা দিলে বিরক্তিতে অথবা ঈর্ষায় তাদের মাথা গরম হয়ে যায়Ñ ‘হালার
পুতের কাম দ্যাহো। আইজকা তোর মাইয়া মইরা গ্যাছে, আইজকা তুই
ইলশা দিয়া ভাত খাস ক্যামনে!ভাবতে-ভাবতে তারা হয়তো নিজেদেরকে
ফজর আলির জায়গায় স্থাপন করে এবং টের পায়Ñ ইলিশের গন্ধ এবার
তাদের নাক ছেড়ে জিহ্বায় এসে বসেছেÑ জিহ্বায় পানি; ‘হালার জিবলার
লালচ কতো দ্যাহো, কুন ঘরে কী রান্দা অয়, তাতে তর কিরে কুত্তা!কিন্তু
জিহ্বাকে গালাগালি করে কোনো লাভ হয় না, রাগ তাতে পড়ে না, ফলে
আবার সেটি গিয়ে ফজরের ওপরই পতিত হয়।
আজকে, বলতে গেলে সারাদিনই, তারা ফজর আলির বাড়িতে কাটিয়ে
দিয়েছে। মেয়েটা মারা গ্যালো দুপুরের আজানের একটু আগে। ফজর
বাড়িতে ছিলো না, প্রতিবেশী হিসেবে তাদের ওপরই সব দায়িত্ব এসে পড়ে।
বাপের অনুপস্থিতিতে মেয়েকে কবর দিয়ে ফেলাটা কিছুইতেই মন থেকে
অনুমোদন করতে না পেরে ফজরের জন্য এই দীর্ঘ অপেক্ষা বিরক্তিকর হয়ে
উঠলেও বিকল্প কোনো উপায়ও খুঁজে পায়নি তারা। ফজর আলি তো
সকালেও মেয়েটাকে ভালোই রেখে গেছে, ফিরে এসে সেই মেয়ের কবর
দেখলে তার কেমন লাগবে ভেবে নিজেদেরই হাঁসফাঁস লাগে বলে এই
অসহনীয় অপেক্ষাটাও বিবেচনাপ্রসূত বলে মনে হয়েছে তাদের। কিন্তু রাত
এত হয়ে গ্যালো, ফজরের ফেরার নাম নাই কেন? সকালে বড়বাড়ির বউ-
ছেলেকে নিয়ে ঝিটকা যাবে বলে বেরিয়েছেÑ তা, ঝিটকা থেকে ফিরতে এত
সময় লাগে নাকি? এর আগেও তো সে ঝিটকা গেছেÑ একবার নয়, কয়েক
হাজারবার, কই, এত সময় তো লাগেনি কখনো! হালায় আইজকা মরছে
নাকি! কুন দোজখে গিয়া পইড়া রইছে আল্লাই জানেÑ মনে মনে এসব
কথা বললেও মুখে কেউ তা উচ্চারণ করে না। যার মেয়ে হঠাৎ করে মরে
গেছে তাকে তো এভাবে প্রকাশ্যে গালাগালি করা যায় না! কিন্তু দ্যাখো,
মসজিদে রাতের আজান দিয়েছে সেই কখন, এতক্ষণে তাদের খেয়েদেয়ে
ঘুমিয়ে পড়ার কথা, অথচ কতোক্ষণে যে বাড়ি ফেরা যাবে সেটাও নিশ্চিত
করে বলা যাচ্ছে না। কী যে একটা বিপদে পড়া গ্যালো! এভাবে লাশ ফেলে
রেখে চলেও যাওয়া যায় না, আবার সেই দুপুর থেকে লাশ আগলে বসে
থাকতে-থাকতে এখন রাত হয়ে গ্যালো নিঝুম; কতো আর সহ্য করা যায়!
ফজর আলির আক্কেলটা দ্যাখোÑ তোর মাইয়া মইরা পইড়া রইছে আর তুই
গুয়ায় গাব দিয়া ঘুইরা বেড়াস, হালার পুত, এহনও তুই আসস না।অস্বস্তি
তে উসখুস করছে প্রায় সবাই, উঠেও যাওয়া যাচ্ছে না, বসেও থাকা যাচ্ছে
না। ফজর আলিকে ছাড়া মেয়েটাকে কবর দিয়ে দেয়া হবে কী না এই
বিষয়েও তাদের মধ্যে কয়েক পশলা সলাপরামর্শ হয়ে গেছে। কিন্তু
একেকজনের একেক মত; আর প্রসঙ্গটা তুলতেই ফজর আলির তরুণী বউ
হোসনার আহাজারিতে সিদ্ধান্তটা নেয়া যায়নি। সব মিলিয়ে অবস্থা কারোরই
ভালো নয়।
ফজর আলি যখন ফিরলো তখন প্রায় মধ্যরাতÑ এক হাতে ইলিশ মাছ
ঝুলিয়ে, অন্য হাতে কাঁঠাল। ততক্ষণে নানা অজুহাতে দুএকজন করে সটকে
পড়তে শুরু করেছেÑ দায়িত্ববান যারা যেতে পারেনি, তারাও বিরক্তির চূড়ান্ত
মাত্রায় পৌঁছে গেছে। ফজর আলিকে দেখে তাদের বিরক্তিটা তাৎক্ষণিকভাবে
একটু বেড়েই যায়Ñ ‘নওয়াব সাব আইলেন। আতে আবার ইলশা মাছ।
নটির পুলা, ইলশা মাছ তোর বউয়ের ইসের মইদ্যে ঢুকায়া রাখ!ফলে,
পরিস্থিতির কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া বাড়ি ফেরা ফজর আলি আহাজারির
নতুন ঢেউ তুললে প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো শক্তি বা উৎসাহ
খুঁজে পায় না। তবে আহাজারিতে কাজ হয়Ñ তাদের বিরক্তি এখন পানি
হয়ে চোখে জমেছে, মনটা আর্দ্রÑ আহারে মাইয়াডা গেরাম মাতায় রাখতো;
কেমুন যে মায়া লাগতো মাইয়াডারে দ্যাকলে; ফজার তো একডাই মাইয়া,
তাও তুমি কাইড়া নিলা আল্লাএইসব নানাবিধ ভাবনায় ও মন্তব্যে তারা
এখন নতুন পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদেরকে সেঁধিয়ে দ্যায়। নিজেদের মধ্যে
বলাবলি করেÑ ‘ফজা ভালা মাইয়াডা রাইখা গ্যালো। আইসা দেখলো মরা
মুখ। আহারে! আল্লার লীলাখেলা বুঝা ভার।ভালো বলতে তারা যে কী
বোঝাতে চায় তারাই জানে। মেয়েটা তো অসুস্থ অনেকদিন ধরেই। জন্মের
পর থেকে এই ৫/৬ বছর মেয়েটা একনাগাড়ে অনেকদিন সুস্থ থেকে দেখলো
না। এই জ্বর, তো এই পেট খারাপ; এই পেটে কৃমি, তো এই পায়ে পানি
নামলো; দুদিন সুস্থ, তো চারদিন অসুস্থ। সাধ্যমতো চিকিৎসাও করিয়েছে
ফজর আলি। মৌলবি সাহেবের পানি-পড়া থেকে শুরু করে কবিরাজের
দাওয়াই, ফকিরের তাবিজ থেকে সুধীর ডাক্তারের হোমিওপ্যাথ, এমনকি
বাজারের জিতেন ডাক্তারের এলোপ্যাথও বাদ দেয়নি। ওষুধ কিনতে-কিনতে
ফজর আলির বাজারটাও ঠিকমতো করা হয় না, আর ওদিকে দ্যাখো,
মেয়েটা ওষুধ খেতে-খেতে ওষুধের ডিপো হয়ে গ্যালোÑ তাও কিছু হলো
না। ফজর আলি তবু আশা ছাড়েনি কখনো। থানা সদর হাসপতালে বড়
ডাক্তারের কাছে দেখাতে পারলে যে মেয়েটা ভালো হয়ে যাবে, এ বিষয়ে
তার কোনো সন্দেহই ছিলো না! কিন্তু বড় ডাক্তারের কাছে যেমন-তেমনভাবে
গেলে চলবে না। লোকে বলে, ডাক্তার সাহেব হাসপাতালে যেসব রোগী
দ্যাখেন আর হাসপাতালেরই ছাপানো কাগজে ওষুধের নাম লিখে সেখান
থেকেই ওষুধ দিয়ে দেন, তাদের অসুখ সারে না। আর সারবেই বা কেন, সব
রোগের তো ওই একই ওষুধÑ মানে সাদা সাদা ট্যাবলেটÑ পেটে ব্যথা
হলেও যা, জ্বর হলেও তাই, দাউদ-পাচড়া-ঘা-কাটাছেঁড়া-হাতপাভাঙা-খুজলি-
ঘামাচি-বুকে ব্যথা-পায়ে পানি নামা- শরীরে পানি আসা-গ্যস্টিক-আলসার
সব রোগের এক ওষুধ হয় কীভাবে? লোকজন যে এইগুলো বোঝে না তা
নয়, কিন্তু করারই বা কী আছে! তবে তিনি যাদেরকে নিজের নাম লেখা
কাগজে ওষুধের নাম লিখে আন্ধারমানিক বাজারের নিরাময় ফার্মেসিতে
পাঠান, তাদের অসুখ সেরে যায়। এ জন্য ডাক্তার সাহেবকে ভিজিট দিতে
হয় একশ টাকা, নিরাময় ফার্মেসির দামি ওষুধ কিনতে আরো তিন/চারশ
টাকাÑ অর্থাৎ প্রায় পাঁচশ টাকার মামলা। বিরাট খরচের ব্যাপার। এত টাকা
ফজর আলি একসঙ্গে পায় কোথায়? মৌলবি সাহেবের পড়া পানি আনতে
পয়সা লাগে নাÑ পেঁপেটা, লাউটা দিলেই তিনি এমন দোয়া করে দ্যান যে,
আল্লার আর উপায়ই থাকে না তার দোয়া কবুল করা ছাড়া। তবে তার দোয়া
যে সব সময় কবুল হয়Ñ তা-ও বলা যায় না। নইলে কি আর কবিরাজ বা
সুধীর ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয়! কবিরাজ অবশ্য বেশি নেয় না, সুধীর
বাবুও ভিজিট আর ওষুধসহ কুড়ি টাকার বেশি নেননি কখনো; এতেও না
হলে জিতেন ডাক্তার যাদের শেষ ভরসা তাদেরও পঞ্চাশ টাকার বেশি লাগে
না।
কিন্তু বড় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য এত টাকা জোগাড় করাটাই
সমস্যা। ফজর আলি ভেবে রেখেছিলÑ এই বর্ষায়ই টাকাগুলো জমিয়ে
ফেলবে সে। কিছু যে জমেনি তাও নয়; কিন্তু পাঁচশ টাকা কিছুইতে জমছে
না। বর্ষাকালে এমনিতেই কাজ থাকে না, সবাই প্রায় বেকার বসে থাকে।
ফজর আলির একমাল্লার নৌকাটা না থাকলে তাকেও বেকারই থাকতে
হতো। সারা বছর নৌকাটা কাজেই লাগেনা, প্রায় শুকিয়ে আসা ইছামতির
অল্প পানিতে অবহেলায় ডোবানো থাকে। অথচ দ্যাখো, বর্ষায় সে-ই খাবার
জোগায়। এখন অবশ্য তার নৌকার সেই রমরমা চাহিদা আর নাই। ভটভটি
এসে তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। লোকজন সব এখন ভটভটিতে চড়ে।
ইঞ্জিনের জোরে চলা বড় নাও, একসাথে অনেক মানুষ যেতে পারে,
তাড়াতাড়িও যাওয়া যায়, আর মানুষ তো এখন খালি তাড়াতাড়ি যেতে চায়।
এত তাড়াতাড়ি গিয়ে কী বালের লাভ হয়, তা অবশ্য ফজর আলির বুঝে
আসে না। কী আর করা, এ্যাকেক জমানার এ্যাকেক ভাও, এ্যাহন ভটভটির
জমানা, হালারা ব্যবসা কইরা নিবোÑ ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেয় সে।
আরামপ্রিয় আর আয়েসী লোকজন অবশ্য ফজর আলির নৌকাই বেশি পছন্দ
করে। বিছানা-বালিশ পেতে শুয়ে-বসে গল্প করতে-করতে তারা গন্তব্যে
পৌছে যায়। এই গ্রাম, মানে উদাসপুর, থেকে মানিকগঞ্জ সদর কি ঢাকায়
যেতে চাইলে হয় যাত্রাপুর নয়তো ঝিটকা গিয়ে বাসে চড়তে হয়। উদাসপুর
থেকে এই দুই জায়গার দুরত্বই প্রায় সমান, ঝিটকা একটু বেশি দূর হতে
পারে, কিন্তু যাত্রাপুর যাওয়ার ঝাক্কিটা বেশি। সরাসরি নৌকা বা ভটভটিতে
যাওয়া যাবে না। বড় সড়ক ধরে হেঁটে যেতে হবে। সড়কটা আবার
উদাসপুর লাগোয়া নয়। বর্ষায় যখন সারা গ্রাম ডুবে থাকে তখন খোলা
নৌকা বা কোষা কি নিদেনপক্ষে কলাগাছের ভেওয়ায় করে সড়কে উঠতে
হয়, তারপর হেঁটে যেতে হয় ৪/৫ মাইল। তারচেয়ে ঝিটকা যাওয়া সহজ।
ইছামতি দিয়েই ভটভটি যাওয়া-আসা করে, নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে
ভটভটিওয়ালারা যাত্রী তুলে নেয়, তারপর সোজা ঝিটকা। কেউ যদি আবার
একটু আয়েশ করে যেতে চায় তাহলে ফজর আলিকে খবর দিলেই হলোÑ
সে নৌকা নিয়ে বাড়ির ঘাটে গিয়ে হাজির। বাড়ি থেকে কাঁথা-চাদর-বালিশ
নিয়ে নৌকায় সুন্দর করে বিছানা করে দেবে আবার ফেরার পথে ওগুলো
যথাস্থানে ফেরতও দিয়ে আসবে সে। কিন্তু এরকম খ্যাপ আর কদিনই বা
জোটে? গ্রামে সচ্ছল লোকের সংখ্যাই বা কতোÑ দুচারজন যা-ও বা আছে;
সবাই তো আবার আরামপিয়াসী নয়! তা-ও যদি হতো, তবু তো আর রোজ-
রোজ ঝিটকা যাওয়ার দরকার পড়তো না তাদের। অতএব এসব লোককে
নিয়ে ভরসা করতে পারে না ফজর আলি। সে বরং অপেক্ষা করে শনিবারের
জন্য। এদিন ঝিটকার হাট বসে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাটÑ
আশপাশের মহাজন-ব্যাপারীরা তাদের মালপত্র নেয়ার জন্য ফজর আলিকেই
ডাকে। ঝিটকার হাট মিলতে শুরু করে সকাল নটার মধ্যেই। উদাসপুর
থেকে যেতে তিন-চার ঘণ্টা তো লাগেই, ফলে ব্যাপারীদের রওনা দিতে হয়
বেলা ওঠার আগে। ফজর আলির তাতে আপত্তি নেই। অন্ধকার থাকতেই সে
গিয়ে হাজির হয়, মালপত্র ওঠানোর জন্য কাজে হাত লাগায়, নামানোর
সময়ও তাই। ব্যাপারীরা তাই তাকে পছন্দই করে। কিন্তু এই একদিন না হয়
তার কাজ বান্ধা, অন্যান্য দিন তো অনিশ্চিতই। সবসময়ই যে বসে থাকতে
হয় তাকে তা নয়, কিন্তু ব্যাপারী বা সচ্ছল লোকজন নৌকায় উঠলে যেমন
৮০/৯০ টাকা নিশ্চিত, খুচরা ভাড়াটিয়াদের কাছে তা পাওয়া যায় না।
৩০/৪০ টাকা দিতেই তাদের মুখ কালো হয়ে যায়। ঝিটকা কি আজিমনগর
কি ধুলশুরা কি সুতালড়ি অথবা ঘুরপথে খাবাশপুর গিয়ে আবার ফিরে আসতে
সকাল-সন্ধ্যা লেগে যায়। নিদেনপক্ষে ৬০/৭০ টাকা না হলে সে খায়ই কি
আর জমাবেই বা কি? মেয়েটাকে বড় ডাক্তারের কাছে নিতেই হবে, টাকা না
জমিয়ে কোনো উপায়ই নাই। ওদিকে বর্ষা-বাদলে ঘরের চাল বেয়ে পানি
পড়েÑ সেটাও সারানো দরকার। সে কোনটা রেখে কোনটা করে? শালার
জিনিসপত্রের দামও আসমানছোঁয়া। এক কেজি চালের দাম ২৭/২৮ টাকা,
তারপর ধর তেল-নুন, আটা, মরিচ এগুলা তো আছেইÑ মাছ-টাছের কথা না
হয় বাদই থাক, ওসব তো আর কপালে নাইÑ সব মিলিয়ে দিনের খরচই
তো ৫০/৬০ টাকা। তারপর ধরো মেয়ের ওষুধ, ছোটখাটো বায়না, নিজের
লুঙ্গি-গেঞ্জি, বউয়ের জন্য না হলেও তো বছরে দুটো শাড়ি লাগে। বউয়ের
আবার ভরা শরীর, ভদ্রলোকের বউদের মতো তার তাই ব্লাউজ পরার শখÑ
ওই জিনিসটা আবার ছেঁড়ে তাড়াতাড়ি। এখন ব্লাউজ ছিড়ঁ লে তো আর পরা
যায় না, পরার মানেও হয় নাÑ যা ঢাকার জন্য পরা, তা যদি বেরিয়েই
থাকলো...। এটা যে ফজর আলির জন্য বাড়তি খরচ, বউ তা বুঝতেই চায়
না। ক্যানরে মাগি, গেরামে আর মাইয়া মানুষ নাই? তারা বেলাউজ ছাড়া
চলতাছে না? এক পোলার মা অইলে মাইয়া মানুষের আর থাহেডা কী? দুধ
পড়ে ঝুইলা, তরও তো পড়ছে। হেই দুধ মাইনষে দেখলে অয়ডা কি?’ কিন্তু
এসব কথা তো আর বলা যায় না! আর এইসব বিবিধ কারণে ফজর আলি
টাকা জমিয়ে উঠতে পারে না। শুকনা মৌসুমে মাটি কেটে, কামলা খেটে যা
জমানোর চেষ্টা করে শুকনা আর বর্ষার মাঝখানের কিছু সময় বসে থাকতে
হয় বলে তা যায় ফুরিয়ে। ঝামেলা কি একটা? বর্ষার আগে-আগে নৌকার
টুকটাক সারাই লাগে। অনেক দিনের পুরনো নৌকা। গাব আর আলকাতরা
না লাগালে, দুএকটা কাঠ-কুঠ না বদলালে বর্ষা পার হবে না। তারপর মনে
করো, এইসব যদি একমাত্র সমস্যা হতো তা-ও না হয় কষ্টসৃষ্ট করে চালিয়ে
নেয়া যেত, কিন্তু মাথার ওপরে আরেক বড় চিন্তা। পদ্মা ভাঙছে অবিরাম।
উদাসপুর ধরলো বলে। আর বড়জোর ২/৩ বছর। তারপরই এ বাড়ি ভেঙে
নিয়ে যাবেÑ কোনো সন্দেহ নাই। এর আগে তাদের বাড়ি ভাঙলো দুইবার।
নইলে কি আর এরকম দুর্দশায় পড়তে হয! তাদেরও তো দু-চার কানি
জমিজমা ছিলো, নিজেদের গরু ছিলো, বাড়ি ছিলো। সেই বাড়ি খুব একটা
বড় না হলেও দু-চারটা আম-কাঁঠালের গাছও ছিলো। এখন মেয়ে একটা
আম খেতে চাইলে হাট থেকে কিনতে হয়। কেউ অবশ্য বলতে পারেÑ
কেন, বড়বাড়ির আম গাছতলা থেকে কি দু-একটা আম কুড়িয়ে পাওয়া যায়
না? ‘আমার বালডা পাওয়া যায়। এই এক গেরামে আইসা দশ গেরামের
পদ্মাভাঙা মানুষ ভর করছে, মাইনষের জ্বালায় বলে গাছের পাতা পর্যন্ত
পাওয়া যায় না, আর আম!তাহলে বড়বাড়ির লোকজন এত ভালোÑ
তাদের কাছে চাইলে কি দুএকটা আম দেবে না? তা না হয় দেবে, কিন্তু
কাঁঠাল? এই যে মেয়ে কয়েকদিন ধরে ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে
চাইছে, কাঁঠাল কাঁঠাল করে মাথা খারাপ করে ফেলছেÑ কাঁঠালের মরশুম
শেষ হয়ে এলো বলে, মেয়েকে সে খাওয়ায় কিভাবে? ইলিশ মাছ আর
কাঁঠাল দিয়ে একদিন একটু উৎসব করতে পারলে তো মন্দ হতো না; কিন্তু
একসঙ্গে একটা ইলিশ, একটা কাঁঠাল, চাল, ডাল, পিয়াজ, মরিচ, নুন, তেল
ইত্যাদি কিনতে কম করে হলেও শ দেড়েক টাকা দরকার। এইটা সে পায়
কোথায়? যদিও বা জমানো-টমানো মিলে একদিন কাজটা করে ফেলা যায়।
তো, তারপর? মেয়েকে বড় ডাক্তারের কাছে নেয়ার কি হবে? ঘরের চাল
দিয়ে পানি পড়াটা না হয় এ বছরের জন্য মেনেই নেয়া গ্যালো, কিন্তু মেয়ের
অসুখ তো আর বছরের-পর-বছর অপেক্ষা করবে না। অতএব এই ধরনের
পাগলামি আসলে করা যায় না; ইলিশ-কাঁঠালের চিন্তা তাকে বাদই দিতে
হয়।
কিন্তু আজকে এই এত রাতে সে ওসব নিয়ে ফিরলো কোত্থেকে? এত
টাকা সে পেলো কোথায়? সে এক বিরাট ইতিহাস। কি ইতিহাস? বড়বাড়ির
ছেলেটা যেদিন নতুন বউ নিয়ে শহর থেকে বাড়ি এলো বেড়াতে আর ফজর
আলি ঝিটকায়ই তাদের ধরে ফেললোÑ সেদিনই এই ইতিহাসের শুরু।
সেদিন তাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যে সে ১০০ টাকা পেয়েছিল, সেটা
কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তারা বড় মানুষ; তাদের ব্যাপারস্যাপারই
আলাদা। সবাই যেখানে ৩০/৩৫ টাকা দিতেই জান খারাপ করে ফেলে
সেখানে তারা ১০০ টাকা দেয় কিছু না ভেবেই। ওদিকে আবার দ্যাখো, বউ
নৌকায় চড়ে খুব মজা পেয়েছে বলে বড়বাড়ির ছেলেটা ফজর আলিকে
বলেছেÑ যতদিন তারা থাকবে, সে যেন সময় পেলে বিকেলে তাদেরকে
নৌকায় করে বেড়াতে নিয়ে যায়। তা ফজর আলির আর কাজ কী? ব্যস্ততাই
বা কিসের? সময় না পাওয়ারই বা কী হলো? আর নতুন রাঙা বউটা যখন
নৌকায় চড়ে অকারণে খুশি হয়ে ওঠেÑ নৌকায় চড়ার এতো শখ যে কারো
থাকতে পারে ফজর আলি নিজের চোখে না দেখলে, কারো কাছে শুনে
বিশ্বাস করতো নাÑ বাচ্চাদের মতো হইচই করে, স্বামীর সঙ্গে খুনসুটি করে
তখন তার কী যে ভালো লাগে! শুধু কি ভালো লাগা? প্রতিদিন বিকেলে
বেড়ানো শেষে সে পায় ৫০ টাকা, এও কি কম? তাছাড়া ফজর আলি
একেবারে নিশ্চিত হয়ে আছেÑ ঢাকায় যাওয়ার সময় এরা তাকে বখশিশ
দিয়ে যাবে। ভাগ্য ভালো হলে সেই বখশিশের পরিমাণ ১০০ টাকাও হতে
পারে। এই বাড়ির শহরবাসী লোকেরা কারণে-অকারণে গ্রামের লোকদের
বখশিশ দেয়। যেন ছুতো খোঁজে, সুযোগ পেলেই বাঁচে। একদম বিনা
কারণে তো আর দেয়া যায় না, সেটা ভিক্ষার মতো দ্যাখায়; ফলে দ্যাখা
যায়, পিচ্চি পোলাপান হয়তো ও বাড়ির শহরবাসী ছেলেটার গোসলের সময়
টিউবওয়েল চেপে দিয়েছিলÑ এরা আবার বর্ষার পানিতে গোসল করতে চায়
নাÑ তো, সে যাওয়ার সময় পিচ্চিটাকে ৫০ টাকা বখশিশ দিয়ে গ্যালো।
খামাখা। একদম খামাখা। তবে এদের মনটাই আসলে অনেক বড়। ফজর
আলি এ বিষয়ে আপত্তি করবে না, আর বড় মানুষের কাজ-কামই আলাদা,
তা তো সে জানেই। নইলে কি আর আজকে এরকম ঘটনা ঘটে? বড়বাড়ির
ছেলেটা আগেই বলে রেখেছিল আজকে ঝিটকায় নামিয়ে দিতেÑ ওখান
থেকেই তারা ঢাকার বাস ধরবে। কিন্তু ঝিটকায় পৌছতেই বউটাÑধুর,
এত তাড়াতাড়ি এসে এলাম! আমার নামতে ইচ্ছে করছে না। এ্যাই, এই
নৌকা নিয়ে ঢাকা যাওয়া যায় না? Ñ বললে ফজর আলি ভারি আমোদ
পায়। নৌকা নিয়ে ঢাকায় যাওয়া! ওদিকে ছেলেটা সত্যি সত্যি বলেÑ
--ফজর আলি, নাও নিয়া বাইনাজুরি যাওন যায় না?
-- যায়। যাবে না কেন?
ফজর আলির তো তাড়া নাই। বানিয়াজুড়ি থেকে বাড়ি ফিরতে অবশ্য অনেক
রাত হয়ে যাবে। ঝিটকা থেকে উদাসপুর আর বানিয়াজুড়ির দুরত্ব প্রায়
সমান-সমান, বানিয়াজুড়ি একটু বেশিই দূর হবেÑ তবে দুটো দুদিকে; মানে
মাঝখানে ঝিটকা রেখে দুটো জায়গা দুইদিকে। তা, রাত একটু বেশি হলে
এমন কি আর অসুবিধা? সে কি কোনোদিন রাতে নৌকা চালায়নি? অতএব
ফজর আলি তার নৌকা বানিয়াজুড়ির দিকে ঘোরায়। সেখানে পৌঁছতেই
বিকেল হয়ে যায়। আরিচা রোডের পাশেই বানিয়াজুড়ির ঘাট। তারা এখন
বাসে উঠবে। নৌকা চালাতে-চালাতে ফজর আলি ভাবছিলোÑ বখশিশ-
টখশিশ মিলিয়ে বড় বাড়ির ছেলেটা নিশ্চয়ই অন্ততপক্ষে ১৫০ টাকা দেবে।
এমনকি খুশি হয়ে ২০০ টাকাও দিতে পারে। কিন্তু নৌকা থেকে নেমে
ছেলেটা তার হাতে একশ টাকার পাঁচটা চকচকে নোট ধরিয়ে দিলে সে
হতভম্ব হয়ে যায়। ৫০০ টাকার কথা ফজর আলি স্বপেড়বও ভাবেনি। কী
করবে-না-করবে অনেকক্ষণ সে বুঝেই উঠতে পারেনি। তারপর হঠাৎ প্রায়
হুমড়ি খেয়ে সে বড়বাড়ির ছেলেটার পা ছুঁয়ে ফেললেÑ ‘এই কর কি, কর কি
ফজর আলি’Ñ শুনতে-না-শুনতেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন রাঙা বউটার পা
ছুঁয়ে দিতেও দ্বিধা করে না সে। বউটা আঁতকে উঠে নিজেকে সরিয়ে নিলে,
ফজর আলি বউটির দেবী প্রতিমার মতো মুখটির দিকে তাকায়। তার চোখ
এখন অশ্রসজল। ফলে অতো সুন্দর মুখটা ভালোভাবে দ্যাখারও সুযোগ হয়
না। ওদিকে ছেলেটা তাকেÑ ‘ফজর আলি, ব্যাগবুগগুলা একটু বাসে তুইলা
দ্যাও’Ñ বলে বউকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দেয়। এখান থেকে
আরিচা বেশি দূরে নয়, রিকশায় করে যেতে মিনিট দশেক লাগে। তবে
এখান থেকেও সহজেই বাস পাওয়া যাবে। আরিচা থেকে ঢাকাগামী ডাইরেক্ট
কোস্টারগুলোতে যদি সিট খালি থাকে, তাহলে হাত উঁচু করেই থামানো
যায়। অচিরেই তা ঘটেও। ফজর আলি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ব্যাগপত্রগুলো
তুলে দিয়ে নেমে দাঁড়ালে হঠাৎ করে বউটা তার হাতে কিছু গুঁজে দিয়েÑ
মেয়ের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেও’Ñ বলতে-না-বলতে বাস ছেড়ে দেয়।
ফজর আলি মুঠো খুলে আরেকটি ১০০ টাকার নোট দেখে বিমূঢ় হয়ে যায়।
তার চোখ আবার পানিতে ভরে ওঠে। রাঙা ভাবীকে আবার সালাম করা
দরকার ভেবে সে তাকিয়ে দ্যাখে বাস অনেকদূর চলে গেছেÑ ফলে
বড়বাড়ির শহরবাসী ছেলে আর তার নতুন বউ ফজর আলির ভেজা চোখ
দ্যখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়।
তাড়াতাড়ি ঘাটে এসে সে নৌকা ছাড়ে। বাড়ি ফিরতে যে কতো রাত
হবে! সে যথাসম্ভব দ্রুত বৈঠা চালাতে চায়, কিন্তু হাতটা এমন অবশ-অবশ
লাগছে কেন? অবশ্য তার চোখ-মুখে এখন খুশির আভা। কপাল! কপাল
নিয়ে জন্মেছে সে। প্রায় নিজের অজান্তে সে একবার নিজের কপাল মেপে
নেয়Ñ অনেক বড়, এত বড় কপাল নিয়ে এই উদাসপুরে আর কজনই বা
জন্মেছে! পনেরদিনের কামাই সে একদিনে কামিয়ে ফেললো! আর গত এক
সপ্তাহে সে তো কম কামায়নি! মেয়েটাকে কালকেই বড় ডাক্তারের কাছে
নিতে হবে। হঠাৎ করে মেয়েটার কথা মনে পড়লে ফজর আলির কেমন
অস্থির লাগে। কাল রাতে মেয়ে তার একফোঁটা ঘুমায়নি, কী যে জ্বর! আহা,
না জানি এখন কেমন আছে! সে তার প্রায় অবশ হাতেই প্রাণপণে বৈঠা
মারে। তবু ঝিটকা পৌঁছতে-না-পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গ্যালো। মানিকনগর
বাজারের কাছে যখন সে পৌঁছলো ততক্ষণে সাপ্তাহিক হাট ভাঙতে শুরু
করেছে। বেশি কিছু না ভেবে সে নেমে পড়ে। ইলিশ মাছ আর কাঁঠাল
আজকেই নিতে হবে। হঠাৎ পাওয়া টাকা সঙ্গে-সঙ্গে খরচ না করলে পরে
আর করা যায় না। মানিকনগর বাজারে দাম একটু বেশি পড়বে, ঝিটকার
হাট থেকে কিনলে ভালো হতো। তা, ওই শনিবার পর্যন্ত কে অপেক্ষা করে?
এই আজকে কাঁঠাল আর ইলিশমাছ দেখে মেয়ে যে খুশিটা হবে তাতেই তার
জ্বর সেরে যাবেÑ এতে ফজর আলির কোনো সন্দেহ নাই। তারপর কালকে
বড় ডাক্তারের কাছে নিতে পারলে সারাজীবনের জন্য আর চিন্তা করা লাগবে
নাÑ এ ব্যাপারেও সে মোটামুটি নিশ্চিত।
কিন্তু বাড়িতে ফিরে অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটি দেখে, পরিস্থিতির জন্য
প্রস্তুতিহীন ফজর আলি প্রমত স্তব্ধ হয়ে যায় বটে; কিন্তু একটুক্ষণ পর
বউয়ের সঙ্গে মিলেমিশে আহাজারিতে ফেটে পড়লে উদাসপুরের জেগে থাকা
মানুষগুলো টের পায়Ñ ফজর আলি বাড়ি ফিরেছে। উদাসপুরের ভেজা
হাওয়া এখন আরো আর্দ্র, প্রতিবেশীদের মন কোমল হয়ে উঠেছে। কিন্তু
বেশিক্ষণ আহাজারির সুযোগ তাকে দেয়া যায় না। এমনিতেই অনেক রাত
হয়ে গেছে, সকাল থেকে লাশ নিয়ে বসে থাকতে-থাকতে প্রতিবেশীরা
অনেক আগেই অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ফলে ফজর আলি ফেরার ঘণ্টাখানেকের
মধ্যে মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখা প্রতিবেশীরা প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন সেরে
মেয়েটিকে বড়ই গাছের তলায় কবর দিয়ে এক-এক করে সবাই যে যার
বাড়িতে ফিরে গেলে ফজর আলির বাড়ি নিঝুম, স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে।
উদাসপুর ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ফজর আলি আর তার বউয়ের চোখে ঘুম নেই।
ঘরের ঝাঁপে হেলান দিয়ে বউ হোসনা কবরের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে
কাঁদছে। সারাদিন কেঁদে-কেঁদে তার চোখ এখন শুকনো খটখটে। ফজর
আলি বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। কি করবে সে? কি বলে সে বউকে সান্ত্বনা
দেবে, যেখানে তার নিজেরই মন মানছে না! কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই তাকে
শক্ত হতে হয়, গিয়ে হোসনার হাত ধরে বলেÑ ওঠ হোসন, ঘরে চল।
হোসনা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আবারÑ ওই ঘরে আমি থাকার পারুম না।
আমার মাইয়া নাই, ওই ঘরে আমি যামু না।
ওঠ বউ, ওঠ, ওরম করিস না।
তুমি তো দেখলা না, মাইয়া আমার ছাট পাড়তে-পাড়তে মইরা গ্যালো।
কান্দিস না বউ, কান্দিস না, আল্লার মাল আল্লা নিছে।
আল্লায় আমার চোহে দেহে না? আমি আল্লার মাল না? খালি আমার
পুলা-মাইয়ার ফিলা নজর ক্যান? পুলাডা অইতে না অইতে মরলো, মাইয়াডা
না নিলে তার চলতো না?
এইগুলো কইস না হোসন। আল্লায় বেজার অয়। মুর্দার মনে কষ্ট অয়...
হেই বেডায় আর কি বেজার অইবো? হেরে খুশি কইরাই আমার লাভ কি
অইবো? হে কি আমার মায়েরে ফিরায় দেবো? হারামজাদা বেডায় আমারে
কি পাইছে?...
এভাবে চলতে দেয়া যায় না। ফজর আলি তাই প্রায় জোর করে বউকে
ঘরে নিয়ে শুইয়ে দ্যায়Ñ তুই এটু গুমানোর চ্যাষ্টা কর...
হোসনা কোনো কথা বলে না। ফজর আলিও একসময় বউয়ের পাশে
গিয়ে শুয়ে পড়ে। খিদায় জান বেরিয়ে যাচ্ছে। বউটাও নিশ্চয়ই খায়নি!
পড়শিদের কারো বাড়ি থেকে বোধ হয় কেউ খাবার দিয়ে গেছে। ঘরের এক
কোণায় ঢেকে রাখা। কিন্তু সে এখন খাওয়ার কথা বলে কিভাবে? ওদিকে
মাছটার জন্যও চিন্তা হচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে এক সময় সে তাই
জিজ্ঞেস করেÑ
গুমাইছস বউ?
না।
মাছটা নষ্ট অইয়া যাইবো না তো!
অইলে অউক।
ফজর আলি আর কিছু বলার সাহস পায় না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হোসনা
নিজেই উঠে পড়ে। কুপি ধরিয়ে বঁটি এনে মাছ কুটতে বসে। কুপির মৃদু
আলোয় ফজর আলি বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাছ কুটতে-কুটতে
মাঝে-মাঝে চোখ মুছছে হোসনাÑ এখন আহাজারি নেই, নেই ফুঁপানিও।
তবে চোখে পানি আসছে দ্রুত, ফেরানো যাচ্ছে না। ওদিকে ফজর আলি
নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হচ্ছেÑ বউকে তার এত সুন্দর লাগছে কেন?
এই এখন বউকে এত সুন্দর লাগার মানেটা যে কী, সে নিজেই বুঝতে
পারছে না। এক সময় সে উঠে গিয়ে বউয়ের পাশে বসলেÑ তুমি আবার
উঠলা ক্যান? সারাদিন খাটনি করছÑ বলে হোসনা মৃদু ভর্ৎসনা করে।
তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করেÑ
মাছডা কত নিলো?
আশি ট্যাহা।
আইজকা মাইয়াডা থাকলে...
আর কইস না বউ, আর কইস না।
আশি ট্যাহা দিয়া মাছ কিনলা, আবার কাডালও কিনছ। এত ট্যাহা
পাইলা কই?
হেইডা এক বিরাট ইতিহাস।
কি ইতিহাস?
বড়বাড়ির মাইজা ভাইজান আর ভাবীসাব দিলো। কতো দিলো জানস?
কতো?
হুনলে তুই ফিট অইয়া যাবি।
কও না।
ছয়শো ট্যাহা।
ছয়শো? কও কি!
হ। বিরাট মন হ্যাগো।
এইসব টুকটাক কথা চলতে-চলতে হোসনা মাছ কোটা শেষে চুলা
ধরানোর আয়োজন করলে ফজর আলি একটু অবাক হয়। সে ভেবেছিল,
হোসনা মাছে লবণ দিয়ে রেখে দেবেÑ রানড়বা করতে বসবে, ভাবেনি। মৃদু
কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেÑ
এত রাইতে রানতে বইলি নাকি?
ইট্টু জ্বাল দিয়া রাহি, তানাইলে গন্দ অইয়া যাইবো।
ক্যান, নুন দিয়া থুইয়া দে, কাইলকা রান্দিস।
নুন দিয়া থুইলেও গন্ধ অইবো। গরমডা কী দ্যাহো না! ভাদ্র মাইসা
গরম...
অতঃপর চুলা জ্বলে ওঠে, হোসনা তার অভ্যস্ত হাতে ইলিশ মাছে মশলা
মাখায়, এবং আয়োজন দেখেই ফজর বুঝে যায়, কেবল জ্বাল দিয়ে রাখার
জন্যই হোসনা চুলা ধরায় নাই, ঢলঢলে ঝোলের তরকারী নামবে কিছুক্ষণের
মধ্যেই।
তার পেটের ভেতর খিদেটা যেন আরো চনমন করে ওঠে, কোনো কথা না
বলে চুলার আগুনের আঁচে লালচে হয়ে ওঠা হোসনার মুখের দিকে অপলক
তাকিয়ে থাকে সে; আর পাড়াময় ইলিশের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে পাতলা-
ঘুমওয়ালা প্রতিবেশীদের ঘুম ভেঙে যায়, ভাবেÑ ‘এই এত রাইতে ইলশা
রান্ধে কিরা?
মৃতের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার প্রসঙ্গটা ওঠানোও ঝামেলার ব্যাপার।
এইসব দায়িত্ব পাড়া-প্রতিবেশী, আতড়বীয়-স্বজনরাই পালন করে, কিন্তু
এতরাতে তারা আসবে কোত্থেকে? রানড়বা শেষ হলে তাই হোসনাই জিজ্ঞেস
করেÑ চাইরটা খাইবা না? খিদা লাগছে না তুমার?
তুইও তো খাস নাই মনে লয়।
দুজন নিঃশব্দে খেয়ে নেয়! অবশ্য হোসনা যতটা না নিজে খায়, তারচেয়ে
বেশি দ্যাখে স্বামীর খাওয়া। কী হাপুসহুপুস করে খাচ্ছে লোকটা! হারাদিন
প্যাটে দানাপানি কিছু পড়ে নাই মনে লয়। আহারে! এ্যাতো খাটাখাটনি
করে, তার যুগ্যি খাওন তো কপালে জুটেনা, শরীলডা খারাপ অইয়া
যাইতেছে মানুষডারÑ এইসব বিবিধ কথা ভাবতে-ভাবতে সে মৃদুস্বরে
জিজ্ঞেস করেÑ
কাডালডা ভাঙ্গুম?
কাডাল?
হ। ভাঙ্গি?
ভাঙ।
এবার পাকা কাঁঠালের তীব্র গন্ধ ইলিশের গন্ধের চেয়েও দ্রুতগতিতে
পাড়াময় ছড়িয়ে পড়ে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে ফজর আর হোসনা শুয়ে পড়লে প্রায় হঠাৎই
আকাশজুড়ে বৃষ্টি নামে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ভাঙা ঘরের চাল
চুঁইয়ে পানি পড়তে শুরু করে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে ফজর আলি প্রায়
স্বগতোক্তির মতো করে বলেÑ
ঘরের চালডা এইবার ঠিক করন লাগে। আর কয়ডা ট্যাহা অইলেই কামে
আত দিমু।
তারপর আবার চুপচাপ। বাইরে রাত বাড়ে। বৃষ্টি আরো গাঢ় হয়। দূরের
উঁচু গাছ থেকে প্রহরজাগা পাখির নিয়মিত করুণ বিলম্বিত ডাক ভেসে আসে।
ফজর আলির বউ সেই করুণ ডাক শুনেই কী না বোঝা যায় নাÑ আবার
কেঁদে উঠলে, ফজর আলি গাঢ় কণ্ঠেÑ তুই এমুন কইরা কান্দিস না বউ।
আল্লায় একজন নিছে, আরেকজন দিবো। তুই কান্দিস না, আর কান্দিস
নাÑ বলে বউকে জড়িয়ে ধরে।
আর তখন ইলিশের গন্ধ, কাঁঠালের গন্ধ, আর নিঝুম বৃষ্টির শব্দ
মিলেমিশে উদাসপুরের জেগে থাকা মানুষগুলোর চোখে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ঘুম
নামিয়ে আনে।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ