কাজল শাহনেওয়াজ
একটা ছেলে হলে তাকে আমি চর
মনমোহনায় বাড়ি করে দেব। বানিয়ে
দেবো আশ্বিন মাসে কাটা পাকা
কাশবনে ছাওয়া ঘর, যে, বছর
গেলেই ছাউনি
বদলাতে হয়। দুবছর পর পর বাঁশের
খুঁটি পাল্টাতে হয়। পূর্বের দিকে মুখ
করা বাড়ির উঠানে দাঁড়ালে বহু
দূরে পাহাড়কে দেখা যাবে।
কালো মেঘ
করলে দেখা যাবে দূরদেশের মানুষের
দরবার বসেছে। হাটের দিনের ব্যস্ত তা। ঠিক বুঝা যায় না পাহাড় না
মেঘ, এমনই সমাচ্ছনড়ব সেই চরগুলি।
মেয়ে হলে একটা সবুজ মাটির পাহাড়
দেব তাকে। ধাপে ধাপে উপরে
ওঠার সিঁড়ি, ঠিক টপের কাছাকাছি বাঁকে খানিকটা জায়গা ছেড়ে রাখা Ñ
সেখানে হবে তার বাড়ি। বিকাল হলে
সূর্য নামতেই থাকে যতক্ষণ না ফলবতী
অন্ধকার এসে পড়ে; সে নামার শেষ নেই। সে নামায় গভীর খাদ ভরে ওঠে
ঝিঁঝিঁ পোকায় আর বনবানরের ধুপধাপ
লাফালাফি জেগে ওঠে। ঝর্ণার
জলপ্রপাত অন্তহীন পতনের সঙ্গীতে
একটি ব্যান্ডগ্র“পের জন্ম দিয়ে।
বালুচরে ঘর বানাতে বানাতে আমার
ছেলের হাত যেন থাকে নরম, হে
নদী।
পাহাড়ে চড়তে চড়তে আমার মেয়ের
পায়ের গোছায় যেন থোক না ধরে,
হে বন্ধুরতা!
দেখি সন্ধ্যাগুলি দ্রাবিড় আর
জংলী, বাঁক ঘুরলেই যেখানে পথ ঢুকে পরে
দুটি পাহাড়ের মেয়েলি সখীত্বের
ফাঁকে সেই শহরে বদলি হতে হতে এসে
পড়েছি আমি। খুব সাজানো মানুষ নই
মোটেও, কিন্তু নিজের সম্পর্কে বিলাসী
আমি খুবই, নিজের আসে পাশেই থাকি সর্বদা।
দেখি এই শহরটি আশ্চর্য রকম
আন্তর্জাতিকতায় মোড়ানো। পৃথিবীর সেরা
সেরা জাতিগুলির মহান যোগসূত্র যে
সমুদ্রময় জলপথ, একদিন ক্লান্তিহারা হাঁটা
পথে জীর্ণশীর্ণ এক বুড়োর কাঁধে
হাঙরের শুকনো দেহ দেখে তা মনে পড়ে যায়।
খুবই উৎফুল− হয়ে মনে মনে কোনো একটা পোষা পাহাড়ের মাথায় চড়ে বেশ
খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকি।
বন্দর থাকাতে ব্যস্তচঞ্চল এই শহরটি
একাধারে বহু টাকার ঝনাৎকার
অহোরাত্র ঝমঝম করে বাজছে, আবার
অন্যদিকে ফর্সা আর গৃহবতী
মহিলারা বোরখাবৃত হয়ে নগরীর হৃদয়টিকে করে
তুলেছে অধরা।
একটি ছোট পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্তরে
বাসা হয়েছে। যেকোনো দিকে
তাকালে চোখের দৃষ্টি থাকে অনাহত।
এখন দেখছি পাহাড়ে থাকার চেয়ে
পাহাড়ে থাকবার কল্পনাটুকুই মধুর।
সাগর পাড়ে বাস করিনি। পাহাড়ে
থেকে থেকে পায়ের গোছা যাতে শক্ত
না হয়ে পড়ে সেই চেষ্টা করে যাওয়া
রীতিমতো আয়াস সাধ্য।
এই শহরটা আমার কাছে এই সেদিনও
ছিলো অচেনা। দুচারটি বান্ধব
ছিল, যা
আজকাল হতেই পারে Ñ মানে এখনত এক পেয়ালা চা পানেই
বন্ধুত্ব
উথলে ওঠে। কথ্য ভাষায় স্বস্তি পাই না। সমুদ্রের অপর পাড়ের দেশের
মানুষের ভাষা যদিও বা বুঝা যায়, আপন সমুদ্রের পাড়ে কিন্তু দেখি কথকতা
খুবই আবছা।
চা খানায় গেছি Ñ জমজমাট গমগমে পরিবেশ। ফরমিকা লাগানো
টেবলের দুপাশেই চেয়ার পাতা।
হাকডাক সব অন্য শহরের মতোই। কর্কশ
বেল বাজছে ঘনঘন, গলার ভিতরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে ওটার। তাকিয়ে দেখি
সবাই কী খাচ্ছে এই সন্ধ্যা বেলায়? রেস্তোরার অনেকে নিশ্চয়ই আজ বহুবার
পাহাড়ে ওঠানামা করে এসেছে। চোখে
মুখে ক্ষিদার টানটোন। ফুটপাথ থেকে
কেনা শীতের স্যুয়েটার হাতে
শেষবয়েসি বৃদ্ধ তার নাতিটিকে ধরে আমার
সামনের টেবলে বসল। আমাদের এই
ঝকঝকে চাখানার জড়তা পথ থেকে
এসে কাটেনি তার। বয় এলে দাদানাতি
নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে পরামর্শ
করল যেন, বয়কে বলল, চা-পরোটা। গরম পরোটা চায়ে ভিজিয়ে খেতে
খেতে চারদিকে কুতকুত তাকালো নাতি, আরো একটা পরোটা নিল, আর
দাদা সাহেব কোনো দিকে না তাকিয়েই
সাবাড় করল তার বরাদ্দ। চা
পরোটা। হ্যাঁ, ডানে বায়ে, সামনে পেছনে সবাই খাচ্ছে
চা-য়ে-পরোটা।
বাহবাহ, বেশ।
আসলে এখানে চেনা কেউই নেই আমার। রাস্তায়
হাটলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
চলে যায়, কারো সাথে দেখা হয় নাকো। বিরানপুরী এই লোকচঞ্চল ব্যস্তচাল ু
শহরটা। ষাট বর্গমাইল বিস্তৃত এই
শহরের এককোণে রয়েছে অনেকের মধ্যে
বিশেষ এক আউলিয়ার সাধনা ধাম।
সেখানে টিলা পাহাড়ের নিচে সরোবর।
সেই সরোবর ভরা বিশিষ্ট কচ্ছপ
বাহিনী। দূরাগত ভক্তজনেরা যারা
মনষ্কামনা উন্মুক্ত করার মানসে
তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ায় Ñ স্বাধীন কচ্ছপেরা
বহুযুগের শ্যাওলাধরা অলস পদচারণে
ইতস্তত ভ্রমণ করছে সেইসব ভ্রমণঅন্ত
সাংসারিক প্রাণের মাঝে।
এই শহরের ভিখারীরা সব কোথায়? কোথায় সেই সব অন্ধ, আতুর,
বোবা, কালা, গৃহহারা জগতের দায়িত্বহীনতার সন্তানেরা? তাই
তো, চোখে
যে পড়ে না সহসা দলভারী
উঞ্ছবৃত্তিক ময়লা ও ছিনড়ব বেশধারীদের।
এই শহরের প্রাচুর্য কি এতই সুষম? কাজের সন্ধানে ছুটে যাওয়া মানুষের
তো কমতি নেই। টাউন সার্ভিসও চলছে
নিয়মিত। আর বহু রকমের বাজারে
কত শত ধরণের পণ্য নগরের সকল
শ্রেণীর মন জয় করে চলছে প্রত্যহ, কিন্তু
ওরা কোথায়? নবাগত যে কারোর চোখেই এই প্রশড়ব ঝিলিক মারে।
তিনি বোধহয় জানতেন আমি প্রকাশ্যে
প্রশড়ব করতে পছন্দ করি না। নতুন
জায়গায় জিজ্ঞাসা ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু আমাদের এই সীমাবদ্ধ
জীবনে অসংখ্য বস্তু ও বস্তু মিশ্রণের অস্তিত্ব রয়েছে। এগুলি
একটি আরেকটির
তুলনায় সর্বদা আলাদাই শুধু নয়, কোনো কোনোটা একই রকমও বটে। নতুন
শহরে প্রথম কিছুদিন দিক ভুল হতে
থাকে। পাহাড়ি জগৎ থেকে প্রতিদিন
অফিসে যাবার সকাল বেলায় পতন দিয়ে
শুরু করতে হয় দিনটাকে, তৃতীয়
সপ্তাহের প্রথম দিন তা উপলব্ধি
করি। এটা ঠিক চারতলা থেকে নামা নয়,
একটা অন্যরকম ব্যাপার। দিকবলয়
চোখের সামনে রেখে নিকট বস্তুসমূহের
তুলনায় দূর বস্তুগুলোর
প্রতিসাম্যের দারুণ একটা ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। ঘর
থেকে বেরিয়ে অবরোহন, প্রথমধাপে পা দিতে দিতে মনে হয় আমি একটা
অতি বিশাল লিভারের প্রান্ত স্পর্শ
করেছি, যার অন্য প্রান্ত দৃশ্যাতীত এক কর্ম
পঙক্রিয়ার সাথে লাগানো। সকাল
বেলা পরিষ্কার মনে যতই নামতে থাকি
পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে, অর্থাৎ আমার লিভারের নিকটবাহুতে, তখন
নিশ্চয়ই দূরপ্রান্ত ভারী কোন
কিছুকে তুলতে থাকে উপরের দিকে। এসব
ভাবতেই কেমন করে ওঠে মন। একটা
আবিষ্কারের উপলব্ধি হয়। চোখমুখ
ছটফট করে ওঠে।
--কী দেখাল পাহাড়গুলি শুনি!
আমি বেশ খুশি হলাম চার সপ্তাহ
পর। সন্ধ্যা তখন। রেস্টহাউজের
পূর্বকোণের আমার ঘর থেকে কেবল
বের হতে চাইছি, খাবার টেবলটার পাশ
দিয়ে যাব; বৈঠকখানা থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
--বুক বুক, একদম এ-কুইশ বছরের কউচ্যা বুক
দেখলাম কাল।
--সাব্বাশ, চালিয়ে যা।
--চলি।
--কোন দিকে।
--যেখানে পাহাড় হাটে বলে দুহাতের দশ আঙুল
দিয়ে দুটি কচি
পাহাড়ের টপভিউ বানিয়ে উল্টা করে
দেখালাম।
--নিউমার্কেট যাচ্ছ, আর এদিকে আমার চুট্টা শেষ
--তো।
--মন পছন্দ্ কোনো ফিরনি যদি চোখে পড়েই তাহলে তার নাম করে...
--...চুট্টার দোকান বরাবর গিয়ে জিজ্ঞেস করো কোন চুট্টা তোমার প্রিয়,
বল তো? তার গলার স্বর নকল করে
বলি।
দীর্ঘ সাত বছর ধূমপান নিষিদ্ধ
রাখার পর গত সপ্তাহে আবার শুরু
করেছেন। বিনয় মজুমদারের একটা
কবিতায় আছে অনেকটা এইরকম :
একবার বসা হলে সাতদিন তার আমেজ
থাকে ... ইত্যাদি। আর সাত বছর
পর শুরু হলে দিনে ঊনপঞ্চাশেও
নিকোটিনের চাহিদা মেটে না রক্তে। দুদিন
ধরে তাই চুট্টাসিগার ধরেছেন তার
আপন সাইজের।
এই শহরটা সশস্ত বিপ্লবীদের খুব প্রিয়। দুই শতাব্দীতে দুটি বিখ্যাত যুদ্ধ
ঘোষণার ঘটনা এর পাহাড়গুলির শক্ত
শরীরে আটকে রয়েছে। একটা জাতির
সব সময় একই রকম যায় না কিছুতেই। ক্ষয়গুলো
খুব ধীরে ধীরে আগায়।
এতই ধীরে যে চূড়ান্ত পতনের পরই
কেবল বুঝা যায়।
বিপণি বিতানের ঝকঝকে আলোর নিচে
গিয়ে আমি অস্থির হয়ে পড়ি।
আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়ি এই ভেবে
যে, কিছুদিন আগে পথ চলতি এক
লোক খুব সপ্রতিভ হয়ে আমাকে
বলেছিল Ñ তখন বউ ছিল সাথে, ওকে
বলেছিলাম বাড়ি করতে হলে যমুনার
চরে করব, চাষাবাদ করেই, হ্যাঁ, বছর
বছর পলি পড়া জমি, মাঝে মাঝে নদী ভাঙ্গন, এক চর থেকে আরেক চরে
অভিবাসন Ñ ও তখন খুব খিলখিল করে হাসে, হাসি থেমে গেলে আবারও হাসে, তখন কোত্থেকে হাজির হল লোকটা, বলল-হাতটা দেখ। আমি
বিরক্ত হলাম না। এরকম উটকো লোকের
সানিড়বধ্য মন্দ না। শুধু ওর উদ্দেশ্যটা
পরিষ্কার বুঝতে হয়।
--হাত দেখাই না রে। বল কী বলবি, চেহারা দেখে বলতে পারবি না?
--খুব পারি!
সরাসরি তুই সম্বোধন করলেও ওর
কোনো পঙতিক্রিয়া নাই। এখনো
নিশ্চিত হতে পারি না। তথাপি
তাকিয়ে দেখি ও আমাকে নিরীক্ষণ না করে
চোখ বুজে রয়েছে, মিনিট খানেক পর চোখ খুলে গড়গড় করে বলতে শুরু
করলো :
--বছরটা কাজের জন্য ভালাই ... ব্লা ব্লা ব্লা ... আপনি হলেন শহরের মন।
শহরেই থাইকেন। শহর ছাইড়া গ্রামে
গিয়া থাইকেন না ... ব্লা ব্লা ব্লা
...
আমি পাথর বেচি না তবে বলি আপনি
একটা রক্তপ্রবাল পইরেন ভালা
হইব...!
ওর দিকে তাকিয়ে ঠিক বুঝি না আসল
পেশা কী? পাথর বেচা না
ঝাপটাবাজি? দুটাই হতে পারে। যেমন চোখ।
--না রে ভাই, পাথর দরকার নাই!
--খুব ভাল, খুব ভাল। পাথর তো রতড়ব, সখেও পরতে পারেন। চশমার
কাচে যদি পাওয়ার থাকতে পারে
তাইলে এইগুলাতে থাকলে থাকতেও
তো পারে, কি বলেন। তবে বিশ্বাসটাই আসল!
--আমার পাথর লাগে না!
--খুব ভাল, খুব ভাল!
পাহাড়টাহাড়ের গা ঘেঁষে ফিরতে
ফিরতে মনে হয় লোকটা ঐদিন গ্রাম
নিয়ে আমার আবেগটাকে কি ব্যঙ্গ
করল? কিন্তু কিভাবে বিষয়টা মাথায়
আনল? পেশাদার, সন্দেহ নাই; বোধ করি মাজারে ঘোরে। কিন্তু
এইকথাটা
দিয়ে কি আমাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা
করেছিল?
রিজনিং করে কোথাও গিয়ে থামতে
পারছিলাম না। যারা হাত দেখায়
তাদের তো উৎকন্ঠা থাকে স্বাস্থ্য, অর্থ, বিবাহ বা মোকদ্দমা নিয়ে। কখনো তো
শুনিনি গ্রাম শহর নিয়ে এরকম
অসাধারণ বোলচাল। ফুটপাতে বিশেষজ্ঞ হস্ত
রেখাবিদদের হাত দেখানো শুরু করব
নাকি? আজকাল মানুষ কী নিয়ে উদ্বিগড়ব
হচ্ছে তা জানা হত। ওরা তো চালু
বিষয়গুলিই বলে।
চুট্টা নিয়ে রেস্টহাউজে ফিরে
দেখি তিনি সোফায় বসে ঘুমাচ্ছেন হিন্দি
ছবির ভিডিও ছেড়ে। তার ঘুমানোর
এটাই নাকি সর্বোত্তম পন্থা। কাপড় পাল্টে
লিভিং রুমে বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা
করি। বাবুর্চি এসে জিজ্ঞেস করে যায় খাবার
গরম করবে কিনা।
এই নতুন শহরে এসে গত পাঁচ সপ্তাহ
ধরে যা কিছু আমি দেখেছি তা নিয়ে
কোথাও আলোচনা করি নাই। কিন্তু
আমার এই জ্যেষ্ঠ সঙ্গী নিজেকে একজন
পাকা বেত বলে দাবি করেন, যে নাকি মত্ত হাতিকে বেঁধে রাখতে পারে।
টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করি :
এই শহরের ভিখারিরা কোথায়? আমি যে প্রতিদিন সকালে ভাবি একটা
লিভারের কাছে যাচ্ছি, কী তুলি তাতে? শহরের পাহাড়গুলি হাউজিং এস্টেট
হয়ে গেলে দুই শতাব্দীর যুদ্ধ
ঘোষণার প্রতিধ্বনি কোথায় শোনা যাবে?
আপনার পাকা বেত এখন একটা চুট্টার
কাছে দুর্বল হল কেন? আর সর্বশেষে
বলুন, রাস্তার
ঐ হস্তরেখাবিদ কিভাবে আমার মনের খবর বলে দিল, এর
প্রতিকারই বা কি? আমি কি প্রবাল লাগাব হাতে?
বাবুর্চির রানড়বা চেটে পুটে খেয়ে
হাত ধুয়ে তাঁর সর্বশেষ আইটেম অর্থাৎ
টুপিক খেতে খেতে লেট নাইট নিউজের
জন্য [তবুও!] টিভিটার সামনে
বসেন। একটা চুট্টা ধরিয়ে ঘনঘন
চারপাঁচটা টান দিয়ে চুট্টার পাছায় ঢোকানো
দেশলাই কাঠি দাঁতে কামড়ে পাকা
বেতের মতো সত্যিই সোজা হয়ে সোফায়
আলতো হেলান দিয়ে বসেন।
--একটু জিনভূত হলে রাতগুলি ভালো হত!
--হ্যাঁ, আপনার জন্য বুথের জিন, আমার জন্য স্কচ!
--জিন এন লাইম।
--জিন এন লাইম উইথ ইনসুলিন! আমি যোগ করি।
--এক ব্যাংকার বলেছিলেন, সত্তর দশকে সারা দেশের যা
ডিপোজিট
ছিল, এই
একটা শহরেই ছিল তার সমান। রাইট। ভিখারীরা সেই টাকার নিচে
চাপা পড়ে গেছে!
--হেঁয়ালি রাখুন। আপনি গত পাঁচ মাস ধরে এখানে আছেন, আপনি
জানেন! ঠিক হল না। আমি সত্তর দশক থেকে তিনবারে মোট ছয় বছর পাঁচ মাস
এই শহরে থেকেছি। সি.শিকদার ছিল আমার সিনিয়র
বন্ধু। বা বলতে পার
আমি অনেক কিছুই জানি বা ছিলাম
অনেক কিছুর সাথে। এই শহর বা এই
পার্বত্যে। দিনের বেলার পানি
বোর্ডের এঞ্জিনিয়ার, রাতের বেলার অচিন
কমরেড। তখন শক্ত পার্টি ছিল, শাসনও ছিল নিষ্ঠুর। অনেক কিছুই আমাকে
করতে হয়েছে। সবই গোপনে। অনেক নামে আমার পরিচয় ছিল। নামের
আড়ালের মানুষটাকে অনেকেই চেনে
নাই। তো তাতে কী হল? ... বার
আউলিয়ার শহর কোনটা জানো তো? সারা দেশে এর খ্যাতি। বার আউলিয়া
এবং সহস্র কোটিপতির শহর।
কোটিপতিরা খোদার ভয়ে পেশাব করে দেয়।
খ্যাতিমান মাজারগুলিতে বেঁচে আছে
ভিখারিরা। কানা, ল্যাংড়া, বিকলাঙ্গ
সাধকদের উঠানে বসে পেটের চিন্তা
করে, ভাব তো একবার!
তুমি কতগুলি প্রশড়ব করেছ। হ্যাঁ
আমি দেখেছি, আমি জানি সব উত্তর। ষাট
দশকের এঞ্জিনিয়ার আমি। গত ষাট
বছর ধরে পেকেছি। চাকরি করেছি, ঘুষ
খাইনি। চাকরি জীবনে কতবার
ফেয়ারওয়েলের দিন জোর করে দেয়া টাকা
গ্রামে হেঁটে হেঁটে বিলিয়ে
দিয়েছি। তুমি যে লিভারের কথা ভাবছ Ñ যারা
দূরের ও নিকটের রহস্য জানে শুধু
তারাই এটা ভাবে। জীবনের দীর্ঘ বাহুতে
বসে চেষ্টা করে দেখেছি, সাধারণ চেষ্টাই প্রতিদিন করে গেলে একদিন
অসাধারণ ফল দিতে শুরু করে। কী
তুলবে প্রতিদিন? নিজেকেই তুলবে।
এবার আমার কথা শোনো। পাঁচ বছর
আগে ধরা পড়েছে ভয়ংকর এক
হেপাটাইটিস অনুজীব বাসা বেধেছে
আমার দেহে। প্রতিদিন কুটকুট করে
খাচ্ছে আমার কলিজা। খুবই ছোট সে, কিন্তু ওর কাজের লিভারটা অনেক
বড়। ডাক্তার বলে, এটা একটা টাইম বম্ব। কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে কবে জানার
উপায় নাই, শেষ কখন হবে তাও না। এক ত্রিশঙ্কু অবস্থাএখন আমার। সেটা
এখনও হতে পারে আবার দশ বছরও।
অষুধ এখনো তৈরি হয়নি। ডাক্তার
বলে, অষুধ
ছাড়াও কিউর হতে পারে। তুমি বলবে, এরকম রিস্ক তো এদেশের
সবারই। হ্যাঁ, সবার, তা ঠিক। তবে আমার চিঠিটা পোস্ট করা হয়ে গেছে।
গত পাঁচ মাস অফিসের এই বিশাল
বাসাটায় আমি একাই ছিলাম। কোনো
মানুষ ছিল না। ছিল প্রচথ ব্যথা
দেয় এরকম একটা পরীক্ষামূলক ইনজেকসন।
আসলে এক হিসেবে ঘোরের মধ্যে
ছিলাম। এই পরামর্শকের চাকরিটা
নিয়েছিলাম শুধু ঐ দুর্মূল্য
অষুধটার দাম মেটাতে। সময়ের কোনো হিসেব করি
নি, মাত্রাছাড়া
সময় যাপন শুধু। আরবি পড়িনি কখনো, তবে অনেক বছর ধরে
কুরআন পড়ি, ইংরেজিতে। ওটা বুঝি। ভোরে ক্যাসেটে আরবী আবৃত্তি শুনি।
ধর্মগ্রন্থের সুর শুনি।
এর মধ্যে তুমি এলে। তোমার কাজ
কম্পিউটার নিয়ে। ডিজিটাল ম্যাপিং।
আমার জীবনযাপনে এই মেশিন কি কোনো
প্রভাব ফেলতে পারে আর? জানি
না। কিন্তু আমি আবার কেন ধূমপান
শুরু করলাম? পাকা বেত কি টলে উঠেছে?
গত সাত বছর ধূমপান না করে থেকেছি
কিভাবে তাহলে? তার আগে তো
দিনে সত্তরটা সিগারেট লাগত! হঠাৎ
আমার মনে হল দেহের টাইম বম্বটাকে
কিছুই আটকাতে পারব না। আমার পাকা
বেত ঘুণে খাবে নাকি? তুমি
ডিজিটাল জগতের মানুষ হলেও আমি
জানি তুমি কবি। এই রেস্টহাউজে এখন
আমি একজন কবির সান্নিধ্য পাচ্ছি।
এখন আমার চুট্টা ধরানো ছাড়া কি উপায়
আছে? আর
যাই হোক পাকা বেত তো ঘুণ দিয়ে খাওয়াতে পারি না!
যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলছ? যারা পাহাড় কাটছে, কোটি বছর আগেকার
কীর্তি যারা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে
কাটছে, আমার বিশ্বাস ওদের কবর ফেটে
সেই প্রতিধ্বনি ছড়াতে থাকবে। ওরা
যদি বিশ্বাসী হয় অনন্তকাল সেই তীব্র
বিভীষিকাময়
আলট্রা-আলট্রা-আলট্রাসোনিক ওদের মৃত কোষকলা ভেঙ্গে
ধূলায় মিশিয়ে দেবে। তুমি তো কবি, তুমি কি ওদের ভয়ংকর পরিণতি দেখতে
পাও না?
0 মন্তব্যসমূহ