পরী আর নেউলদের সন্ধানে, জন্মদিনে

পার্থ মুখোপাধ্যায়


ব্রিজ মানে সেতু নয় । সেতুর সমীকরণ যে কিভাবে কষতে হয়, ভাবতে ভাবতে পঞ্চাশ হলো । আগে পঞ্চাশ মানে ছিল অর্ধমৃত, এখন আশি দেখলে নিজে ভাবি "আহা বুড়ো মানুষ " |  বয়সের একটা চোখ আছে, কত কিছু এখন বুঝি সত্যদ্রষ্টা ঋষির মত ; তবে এখনও টিকটিকি দেখলে পিছু পিছু যাই ।।


কুড়িতে ছিলাম হাড় গিলগিলে, মাথায় পাখির বাসা ।  যৌবনের সেই গণতন্ত্রে বাকিদের মত সে মাথায় একটাই চিন্তা । মেয়েদের হাঁ করে দেখতে দেখতে আমাদের সবার চোয়ালের আকার পাল্টে স্ট্যালোনের মত হয়ে গেছিল । সেন্ট জেভিয়ার্স এর ক্লাসে স্যার বলতেন আমাদের "ওভাবে দেখো না ঘাড় ঘুরিয়ে, স্পন্ডলাইটিস্ হবে " ।

গেঁতো গাঁয়ের ছেলে আমি, ঢ্যাঙ্গা, চোখে পুরু কালো ফ্রেমের চশমা । দামী দামী জলপরী দেখে দেখে সেরকম কোনই লাভ হয় নি ওই বয়সে । কল্পনাশক্তি বেড়েছে, আর নম্বর কমেছে ।

রামতলার বাড়ি তথা খন্ডহরে যে বছর আমাদের খাদ্যের পরিমাণ কমতে কমতে বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছিল, সে বছর আমাকে ভাত দিয়ে মাতৃদেবী ফ্যানের বাটি নিয়ে বসতেন, আর "ফ্যান আমি খাব" বলে কান্না জুড়তাম । আর সেই বছরই লাহিড়িদের বিশাল বাড়িতে ফোন এলো । সে কি ম্যাজিক, ফোনে বাবার গলা পেলাম একদিন, আর আমার পেটের বারোমাসী ব্যথাটা উধাও হয়ে গেল ।

সেদিন প্রথম একটা জন্মদিন দেখেছিলাম সে ফোনবাড়ীর অন্য ঘরে, সেই অবাক পৃথিবীর উদযাপন দেখে এক অনুচ্চার্য প্রশ্ন এল মাথায়, পরীরা কোথা থেকে আসে ?

পরীরা যে পরিযায়ী পাখির মত, মাঝের তিরিশ বছর গেল সেটা বুঝতে, যদিও এখন জানি, কিছুই হারায় না । ফ্যাশন পালটেছে আবার, আবার কালো ফ্রেমের চশমা করতে দেব ভাবছি । বাবা কতই যে খুশি হতেন জানতে পারলে । এদিকে জিম করে করে হাড্ডির ওপর বেশ কিছু পদার্থ গজিয়েছে মিনিয়েচার স্ট্যালোনের মত  - বছর কুড়ির মেহিকান মেয়েরা এক দুবার দেখে অন্তত । পুলকিত আমি নব্বই থেকে আরও বাড়িয়ে একশ পাউন্ড ওজন নিয়ে হাঁস ফাঁস করি মাঝ রাতে । ফ্রয়েডের কথা ভাবি, যাঁর মতে আমাদের সমস্ত চর্চার, চর্যার  মূল শক্তি একটাই, তিনি কুন্ডলিনী হয়ে মূলাধারে অধিষ্ঠিতা, আর সেই কুন্ডলিনী ভোর হলেই আমাকে মনে করিয়ে দেন টোড়িতে "আল্লা জানে" রিয়াজ করার কথা ।জনশূন্য রাস্তায় রাতের আলো গায়ে মেখে ফিরি বীরের মত সরগম করতে করতে, টেক্সাসের সে রাস্তায় সেই সময়ে শুধু কাউবয় আর  আমাকেই মানায় ।  পাওয়া না পাওয়ার গল্পগুলো মাথায় কুটকুট করতে থাকে ।  মৃনাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত, রাস্তা আমাকে দিয়ে গাইয়ে নেয় "এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব" ।

কাল জানি সবার আগে মধ্যরাতে ফোন আসবে এক বৃদ্ধার । দুদিন ফোন না করার রাগ কাটিয়ে উঠে বিন্দুমাত্র ইংরিজি না জেনেও তিনি খুব কেতা করে বলবেন "হ্যাপ্পি বার্থডে "...তারপরই বলবেন সুর পাল্টে "একা একা থাকিস, এখানে কত খাবার - লুচি মাংস পোলাও  - তুই ওই ছাইপাঁশ সাবওয়ে স্যান্ডউইচ খেয়ে এত বছর কাটালি - কি কপাল তোর" ।

এর পরেই আমাদের মধ্যে স্যান্ডউইচ বনাম মাছের ঝোলভাতের একটা বিবাদ শুরু হয় । কিন্তু দিনটা আলাদা । তাই আমি বুড়িকে পছন্দের তিনটে গান পরপর শুনিয়ে মুড ভালো করে দেব । তার মধ্যে অবশ্যই থাকবে "এ পরবাসে রবে কে " ।

কেতা করে কাফিতে একটু গলা খেলাতেই বুড়ি আহা আহা করে উঠবেন । আমার চোখে ভাসবে এক বাৎসল্যকাতরা  সর্বংসহা পরীর ছবি, স্নান সেরে এত্ত বড় সিঁদুরের টিপ কপালে, লাল পাড় শাড়ি পরে রান্নাঘরের নিকোনো মেঝেতে বসে লেবু নুন সহ এক কাঁসার  বাটি ভর্তি  ফ্যান নিয়ে বসেছেন । পাশে এক হতাশ বেড়াল । লাইনটা কাটার সময় আমরা দুজনেই জানব এই কাফি যে কোন সময়ে রামনামসৎ হয়ে যেতে পারে৷ একদিক ভাঙ্গা সেতুগুলো বাড়ছে , খুবই বিপজ্জনক, অন্ধকারে ।

ভোরবেলা বেরিয়ে পড়ব গাড়িটা নিয়ে নিউ অরলিন্সের দিকে । ছয় ঘন্টার রাস্তা । আগেরবার সেই রাস্তায় গীটার কাঁধে দেলিয়াকে লিফট দিয়েছিলাম ফ্রেন্চ কোয়ার্টার অবধি । এবারও যদি দেখা হয়ে যায় - যার সম্ভাবনা নেই কিন্তু একটা আশা মনে নিয়ে কফি আর পাম্পকিন ব্রেড , যেটা শুনে  "কুমড়োর কেক কেউ খায় নাকি, এমা " বলবেন মা, খেতে খেতে একলা ড্রাইভ করে যাব । মোজার্টের ফ্লুট কনচার্টো টু থেকে বাঁক ঘুরতেই আঙ্গুরবালা বলবেন "আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা" , তারপর সাঁই যাহুর দরবেশ তিনতারা হাতে ঘুরে ঘুরে গাইবেন  "না মন্দির না মসজিদ মনকে অন্দর হ্যায় এক চিজ", শেষ হতে না হতেই লালনকে বিফল সেতুর আর এক দিক খুঁজতে বেরোতে হবে, আমার মতই কোন ভোরে - কারণ  "সে আর লালন এক ঘরে রয় লক্ষ যোজন দূরে"   ।

হয়ত আবার দেলিয়া এসে উঠবে । বড়ুর "কনয়লতা অবলম্বনে উয়ল হরিণহীন হিমধামা"  আগের মতই সঙ্কোচবিহীন এক গাল হাসি নিয়ে পেরুভিয়ান উচ্চারণে  বলবে "অ্যাম আই প্রেটি "? আমার ফোন খুঁজে খুঁজে লেড জেপেলিন এর স্টেয়ারওয়ে টু হেভেন চালিয়ে দেবে । রাস্তা চলতেই থাকবে, আর আমরা তারস্বরে গলা মেলাবো । বাবা আলাউদ্দিনের ছবি দেখে বলবে "হি লুকস সো অ্যাংরি " ।

আমি একটু হেসে বিখ্যাত জিলা কাফিটা খুঁজে বার করব । সেই বেহালার জাদু, সেই কান্না, সেই উল্লাস ঝড়ের মত উঠতে উঠতে মাচু পিচু তোলপাড় করে ফেলবে ।মায়াসভ্যতা থেকে নেমে আসা এক শিখরদশনা পঞ্চবিংশতিদশী গাড়ি থেকে নামার সময় ন যযৌ অবস্থায় আমাকে বলবে "রাতে গাইছি, তোমার ড্রামটা বাজাবে?"

আমি তবলা নামিয়ে তার  পিছু হেঁটে যাব । ফ্রেন্চ কোয়ার্টারের এক গাঁট্টাগোট্টা কুকুর, তার নাম দিয়েছিলাম হনুমান, আমাদের পিছু পিছু হোটেল অবধি আসবে । তার পিছনে অনেক মহামানব, সন্ত সুরদাস থেকে আমীর খান, রুমি থেকে জন মরিসন দেখবেন তাঁদের সেতু তৈরির উপকরণ কি অলৌকিক ।

আগেরবার কদিনপর ফিরে আসি অস্টিনের একলার আস্তানায় । যে জমি পেলে  মানুষ হামলে পড়ে চাষ আবাদি করতে লাগে, আমি সে সব অবহেলায় ছেড়ে দিতে পারি । তবে এবারটা আলাদা, এবার চলে যেতেও পারি পেরু । পিরামিড এর ওপর বসে পালাকীর্তন গাইবার খুব ইচ্ছে জেগেছে । দেলিয়ার গীটার থাকবে । অনেক দূরে নদীর ধারে এক রিকেটি বাচ্চা গরুদের পিছনে ধাওয়া করে যাবে । কলকাতায় বসে এক অশীতিপর বৃদ্ধা চোখের জল মুছে বলবেন নার্সকে "আমার ছেলের ফোন । জন্ম ইস্তক ভুগত, বাঁচবে ভাবিনি জানো? " ।  রামতলা  স্টেশনে দাঁড়িয়ে বাবা লিকলিকে ছেলেটাকে বলবেন "তোর গায়ে এত্ত জোর ! মা কে পাহারা দিবি তুই ।"

আমি গাড়িটা থামাবো কালভার্টের ওপর । অভ্যেসমত উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার চালাব কিন্তু দেখা যাবে না কিচ্ছু ।

"হোয়াট হ্যাপেণ্ড, হ্যান্ডসাম? "  দেলিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকবে । হারিকেন ক্যাটরিনার পর পর যে জলা জমিতে মৃতদেহ ভাসতে দেখেছি , সেখানে এখন সবুজ লম্বা ঘাস মাথা তুলে আছে  । তার ওপর দিয়ে হাইওয়ে উঠে গেছে, শেষটায় শুধু মেয়েটার চোখের মত নীল আকাশ । দূরে কলাবন আর লাহিড়ীবাড়ি পেরিয়েই মিসিসিপি । কে জানত, রামতলার বাইরেও এত পরী থাকে?


-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি

পার্থ মুখোপাধ্যায়

জন্ম রামরাজাতলা,হাওড়ায়১৯৬৩ সালে।
পেশায় যন্ত্রগণক নিয়ে তাঁর কাজকারবার ।
দীর্ঘ দিন ধরে সঙ্গীত এবং সাহিত্য চর্চা করে আসছেন পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে বর্তমানে আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যের অধিবাসী |

যোগাযোগ +1 512 2892147 /
parthacalcutta@gmail.com 



------------------------------------------------------------------------------------------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ