নাহার মনিকা
গভীর
জঙ্গলে ইঁদুরের সরু তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দটা ঢেউ তুলে তুলে কানে আসছে। একটা অন্ধকার
তলদেশ থেকে নিজেকে উদ্ধার ক'রে সুমন যখন চোখ খোলে, তখন মাথার ভার তার কাঁধের দখলদারীত্ব নিয়ে ফেলেছে। অনেকদিন পরে এত গাঢ়
ঘুম ঘুমিয়েছে সুমন। বিছানার
পাশের টেবিলে লম্বাটে ওয়াইনের গ্লাসে তলানির দাগ আর খালি বোতল সাক্ষ্য দেয় কেন এই সম্বিত হারানো ঘুম। সে লীনার শোবার ঘরে। একটু উঁচু বিছানা।
ঘরের পরিসরের চেয়ে বিশালাকার ড্রেসিং টেবিল। স্কার্টের ধার সরে গিয়ে পর্দাটানা অন্ধকারে লীনার ফর্সা উরু আবছা দেখা যায়। সে কেন রাত পোষাক না পরে স্কার্ট পরে শুয়ে গিয়েছিল- এ প্রসঙ্গে অন্তত গতরাতের কথা সুমন জানে, মনে আছে। এ বাড়িতে আজকে তার তৃতীয় রাত্রি যাপন, আর গতকালই প্রথম লীনার বেডরুমে প্রমোশন। গত দু রাত ড্রইং রুমের সোফাবেডে বন্দোবস্ত ছিল। আইনি জটিলতা এড়াতে এটা একটা মধ্যপন্থা। দুজনে, মানে, সে আর লীনা গত রোববার দোকানে কফি খেতে খতে এ সিদ্ধান্তে এসেছিল। তখন সুমন মোটামুটি নিশ্চিন্ত। লীনার পরিমিত প্রসাধন আর পারফিউম তার ভেতরে শুরু থেকেই একরকম সমীহ জন্মাতে সাহায্য করেছিল। সেখানে কোন প্রেম-ভাবের সূত্রপাত হওয়া অস্বাভাবিক ছিল কিনা- সে সম্পর্কে এই হ্যাংওভারের সকালে সুমন নিশ্চিত হতে পারে না।
ঘরের পরিসরের চেয়ে বিশালাকার ড্রেসিং টেবিল। স্কার্টের ধার সরে গিয়ে পর্দাটানা অন্ধকারে লীনার ফর্সা উরু আবছা দেখা যায়। সে কেন রাত পোষাক না পরে স্কার্ট পরে শুয়ে গিয়েছিল- এ প্রসঙ্গে অন্তত গতরাতের কথা সুমন জানে, মনে আছে। এ বাড়িতে আজকে তার তৃতীয় রাত্রি যাপন, আর গতকালই প্রথম লীনার বেডরুমে প্রমোশন। গত দু রাত ড্রইং রুমের সোফাবেডে বন্দোবস্ত ছিল। আইনি জটিলতা এড়াতে এটা একটা মধ্যপন্থা। দুজনে, মানে, সে আর লীনা গত রোববার দোকানে কফি খেতে খতে এ সিদ্ধান্তে এসেছিল। তখন সুমন মোটামুটি নিশ্চিন্ত। লীনার পরিমিত প্রসাধন আর পারফিউম তার ভেতরে শুরু থেকেই একরকম সমীহ জন্মাতে সাহায্য করেছিল। সেখানে কোন প্রেম-ভাবের সূত্রপাত হওয়া অস্বাভাবিক ছিল কিনা- সে সম্পর্কে এই হ্যাংওভারের সকালে সুমন নিশ্চিত হতে পারে না।
আগে তো বটেই, এ বাসায় আসার প্রথম দিনে লীনা তাকে অনেক রকম বিধি নিষেধ বই খুলে পড়ে পড়ে শোনাবার মত বলেছে। এ আর এমন কি?- মনে মনে কাঁধ শ্রাগ করেছে সুমন। কোন রকমে আঠারো থেকে বাইশ মাস পার হওয়া দিয়ে কথা।
ইঁদুরের
তীক্ষ্ণ ডাক আরো স্পষ্ট
হয়। বেডসাইড টুলের ওপরে রাখা
সেল ফোন। রিং বাজছে না। কেউ মেসেজ পাঠিয়েছে, তার দীর্ঘ টুউট টুউট। এত ভোরে! লীনার ঘুমন্ত শরীর বিছানার কোনে
চলে গেছে। গাঢ় ঘুম মানুষ একাকীই ঘুমায়। তার মুখে এতদিন দেখা কড়া হিসেবী মেজাজটা লাজুক ভঙ্গীতে লেপ্টে
আছে। তারপরও সাবধানে ফোনের দিকে হাত
বাড়ায় সুমন। ঘরের
ভেতরে অন্ধকার। বাইরে শাদা বরফের ছটা অন্ধকারকে জব্দ করতে চাইছে।
সুমন উঠে বসে মাথার কাছে পর্দা এক হাতে
সরিয়ে অন্যহাতে সময় দেখে, পাঁচটা দশ। এই ভোরে কে মেসেজ দিল? লীনা আর তার ছেলে সাড়ে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যাবে, তখন দেখলেই হবে।
বিল্ডিং সেন্ট্রাল হিটিং এর গুমোট ঘরের ছাদে জেদী হয়ে ঝুলে থাকে। কৃত্রিম উত্তাপে নিজের শ্বাস নাকের কাছে জ্বালা করে। সুমন খচ খচ করে গা চুলকায়। ঘরটাতে আসলেই গরমের গুমোট নাকি সুমনের তাপবোধ বেশী? এতদিন একা বিছানায় ঘুমোতে অভ্যস্ত সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। তবে না, একদম একা বাসাতে সে ঘুমোয়নি, সবসময়ই তার শেয়ারের বসবাস, বাথরুম, রান্নাঘর। শুধু বিছানাতে আপত্তি, মোরশেদের সঙ্গে থাকার সময় সে মেঝেতে বিছানা পেতেছে। টানা তিন বছর। তারপর দেশ থেকে ওর বৌ এলো। মোরশেদ বাসা বদলালো। একা বাসায় ভাড়া একটু বেশী হলেও সুমন তার ঘুমের স্বাধীনতা পুরোপুরি উপভোগ করেছে।
সব ভাবনা ঠেলে দিয়ে মনযোগ ফোনের মেসেজটার
দিকে গেলে সুমন উঠে বসে আবারো। লীনার হাঁটু আর বুক সন্ধি করে
কাছাকাছি হয়েছে। লেপ পায়ের কাছে গুটলি পাকানো। সুমন আবার আঙ্গুল দিয়ে মাথার কাছের জানালার পর্দা
সরায়। দোতলা থেকে বাইরের পৃথিবী কোন ঘোরে অজ্ঞান হয়ে আছে কে জানে? রাস্তার ওপারে স্কুলের ছোট প্রাঙ্গণ শাদা
তুষারে ঢাকা। গত রাতে তুষারপাত হয়নি কিন্তু ফ্রিজিং রেইন হয়েছে। পদার্থের তিন অবস্থার
দুটোকে তাৎক্ষনিক
দেখতে পাওয়া, এখানে শুরুর দিনগুলোতে খুব আমোদের মনে হতো। মেঘের তরল ফোটা নামতে
নামতে নামতে শাপগ্রস্থের মত গাছের ডালে, লোহার গ্রীলে শক্ত হয়ে ঝুলে থাকে, যেন
কাঁচের বাগান। রাস্তায় লবণ ছড়ানো গাড়ীদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। ফ্রিজিং রেইনে জমে থাকা আয়না বরফের ওষুধ হলো লবণ। এমন সব
দিনে ঘরে বসে শুধু বাইরে তাঁকিয়ে থাকার একটা অদম্য ইচ্ছা ধূলোঝাড়ার মত ঝেড়ে বাইরে
বেরোতে হয়।
টুট টুট শব্দ ক’রে মেসেজ ইনবক্সে যায় সুমন। আবারো সামান্য অসস্তি নিয়ে দেখে
লীনার ঘুমন্ত শরীর। ক্লিক
আকাংখিত অনেকগুলো মেসেজ জ্বল জ্বল করে। দেশ থেকে।
বড় মামার ইংরেজী অক্ষরে বাংলা উদ্ধার করতে সময় লাগেনা।
সুমন সবশেষেরটা আগে খোলে,’সুমন তাড়াতাড়ি ফোন করো।’ সে পরপর সবগুলোতে ক্লিক করে যায়- একই কথা লেখা,’
তোমাকে ফোন করে পাচ্ছি না, জরুরী দরকার,
অতিসত্বর ফোন করো’।
এখানকার বিকেল পাঁচটা থেকে প্রায় সাতটা পর্যন্ত এস এম এস পাঠিয়েছে মামা। পাঁচটার সময় কোথায় ছিল সে? দেশের বিকেল পাঁচটা বাজলে কি এখানেও একই সময় দেখাবে ফোনের ডিসপ্লেতে? সময়ের এই হিসেব কেন জানি এখনো সরল না সুমনের কাছে। অথচ বছর ছয়েক হলো। সবসময় উল্টোপাল্টা হয় তার।কত মধ্যরাতে মাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে সুমন –‘কয়টা বাজে আম্মা, তোমার ঘুম ভাঙ্গালাম?’
-‘বাবু তুই ফোন করলেই আমার একটু ভালো ঘুম হয়’…, খৈ খৈ হাসে মা, -‘ওইটাই ঘুমের চিকিৎসা, সময় অসময় নিয়ে ভাবিস না’।
ভাবেও নি সে। সময় নিজেও তো এক গহীন শৃংখলে আটকা। সেই শেকল আবার শুধু এক শব্দগুচ্ছের কাছে
বন্দী, নাম তার টিক... টিক... টিক... টিক। এর বাইরে তার বেড়ে ক’মে চলার উপায় নাই। তবু সময়ের জন্য মায়ের কী মমতা!
-‘বাবু,
সময়কে ভালোবাসিস, সময় তোকে কিছু না দিলেও
তুই কিন্ত সময়কে দিবি। ভালোবাসবি। সময়কে ভালোবাসলে সময় তোর সঙ্গে থাকবে’।
মায়ের মাথা খারাপ- দাদা বাড়ির ঢালাও অভিযোগ সময় সময় সুমনের মনে হয়
হয়তো সত্যি। তা নইলে এমন উদ্ভট কথা বার্তা!
-‘আচ্ছা আচ্ছা আম্মা, সময়কে তুমি ভালোবাসলেই হবে। আমার বিল উঠছে, আমি রাখি’।
কি হতে পারে মায়ের! শারিরীক অসুস্থতার কথাতো এতদিনে কেউ কখনো বলেনি।
-‘আচ্ছা আচ্ছা আম্মা, সময়কে তুমি ভালোবাসলেই হবে। আমার বিল উঠছে, আমি রাখি’।
কি হতে পারে মায়ের! শারিরীক অসুস্থতার কথাতো এতদিনে কেউ কখনো বলেনি।
একটা সিগারেট খাওয়া দরকার।ঘর থেকে বের হলে সরু প্যাসেজ, দেয়ালে লীনা আর তার ছেলের
নানাবিধ ফটো ফ্রেমবন্দী। মেজর সাহেব আছেন একটাতে। বাঁ পাশে বন্ধ দরজা। লীনার ছেলে ঘুমায়। সামনে বাথরুম, ডানপাশে কিচেন। ফ্রিজ, চুলা, চারজনের খাবার
টেবিলের আটোসাঁটো পরিসর ছাড়িয়ে ব্যালকনিতে যাবার দরজা, খুলতে গেলে বাইরে জমে থাকা বরফে
ঠেকে যায়। সুমন
জোর খাটায়। কয়েক সেকেন্ড বুক ভরে ঠান্ডা বাতাস নিতে আরাম হয়, তারপরই শীত হামলে পড়ে
কামড় দিলে নিজের বোকামীতে রাগ হয়। শুধু টি শার্ট আর স্লিপারে কেউ বাইরে
আসে? সিগারেটের প্যাকেট জ্যাকেটের পকেটে, লিভিং রুমের কাবার্ডের ভেতরে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো। লীনার এখানে ঘরে সিগারেট খাওয়ার নিয়ম নেই। দাঁতে দাঁত চেপে পায়ের পাতায় হিংস্র শীতল
ছোবল উপেক্ষা করে সুমন তবু দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দায়। এ রাস্তার সব বাড়িগুলোর
পেছন দিকে বারান্দার কোল ঘেষে লোহার সিঁড়ি, ঘোরানো, নিচে নেমে গেছে।এখন শাদা বরফে ঢাকা। উল্টোদিকেও
তেতলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং,
বরফের স্তর পেছনের সিঁড়ির আর বারান্দার গ্রীস্মকালীন অসামঞ্জস্য ঢেকে
দিয়েছে। শীতবোধ
তীক্ষ্ণ ধারে সুমনের শরীর কেটে ঠক ঠক কাঁপুনি শুরু করতে আরো কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। ভোরের অন্ধকার গাঢ়তা হারালেও পায়ের বুড়ো
আঙ্গুলের চ্যাপ্টা নখের কালচে আভাস দৃশ্যমান হয় না। ডান পা বাড়িয়ে বরফে নখ ডোবায় সুমন। অন্য পায়ের স্লিপার খুলে সে
পায়ের পাতা বরফে রাখে। শক্ত বরফের শৈত্যকণা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ে ফার্ষ্ট
ফরোয়ার্ডে দৌড়ায়। দাঁত চেপে এক দুই ক’রে তেপ্পান্ন পর্যন্ত গোনে সুমন, ধীরে ধীরে
গোনে। এই গোনা তার অভ্যাস। তার মিনিট ষাট সেকেন্ডে না, তেপ্পান্নতে শেষ হয় গত এক
বছর। তার আগে ছিল বায়ান্ন। শীতে পানির কল ছেড়ে গরম পানির অপেক্ষায় সে বায়ান্ন গুণে
তারপর আঙ্গুল ছুঁইয়েছে। গরমে ঠান্ডা পানির ধারা নেমে আসার মধ্যবর্তী সময়েও তাই,
সেকেন্ড কমিয়ে কমিয়ে যদি মায়ের কাছে যাওয়ার দীর্ঘ, অনিশ্চিত সময়টা সংক্ষেপ করা
যায়। সাতচল্লিশ বছরের মাকে দেখে এসেছে সে। গত ছয় বছরে কত বদলে গেছে কে জানে? ফটো
তুলতে অনিচ্ছুক মাথার চুল, ত্বকের মসৃণতা কেমন বদলে গেছে? নাক ফুলটা কি শেষমেষ
খুলতে পেরেছে? সব সময় ভাবে জিজ্ঞেস করবে। ছয় বছর আগে মাকে নিয়ে স্বর্ণকারের দোকানে
যাওয়ার কথা ছিল তার, নাকফুল এঁটে বসে গিয়েছিল, মা খুলে ফেলতে চাইছিল। ছোট্ট একরতি
নাকফুলের বোঁটা ওপরে আর নীচে নিজেকে জুড়ে দিয়ে মায়ের সব অস্বস্তি নাকের ডগায় এনে
নিজের প্রতাপ জাহির করছিল। হয়নি, সুমনের সময় হয়নি খোঁজ নেয়ার যে কোথায় খোলা যায়
জেদে আবদ্ধ নাক ফুল।
অনুচ্চারিত সংখ্যা গুনতে গুনতে শীতের কাঁপুনি সহ্যের সীমা
ছাড়ালে পা সরাতেই হয়। আবার
দরজা ঠেলে রান্না ঘরে। সুইচ
হাতড়ালে এবার লাইট জ্বলে। আলোর আক্রমণে একঝাঁক ব্যাতিব্যাস্ত তেলাপোকা কিচেন কাউন্টার থেকে ছিটকে
দিগ্বিদিকে যায়।
………………………………
বসার ঘরে দুলে দুলে
কোরান পড়ছে আসগর ভাই। ভাবী রান্নাঘরে
খাবার দাবার দেখছে। লীনা সকালে এদের
দুজনকে ফোন ক’রে কাজে চলে গেছে। সেক্রেটারীর চাকরীতে হাজির না থাকার উপায় নেই, আর তাছাড়া, কোন অজুহাতে?
সুমন বেডরুমে এসে ফোন কানে চাপে। ঘরটা কালকে রাতের তুলনায় বেশী পরিচিত।
সুমন বেডরুমে এসে ফোন কানে চাপে। ঘরটা কালকে রাতের তুলনায় বেশী পরিচিত।
-‘হ্যা মামা বলেন, মামা'
সুমন জানালা খুলে দেয়, ঠান্ডা এক পশলা
হাওয়ার সঙ্গে মামার কন্ঠ অস্পষ্ট হয়ে ঢোকে কানে। অগত্যা জানালার দুই পরত পাল্লা টেনে দিতে হয়।
-‘একদম কাঁদবে না, চিন্তা করবে না। আমরা সব আছি তো’... এমত ভূমিকা সেরে মামা জানায়- ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে এসে ভালোও হয়ে গিয়েছিল প্রায়। তার মায়ের লাশ এখন গোসলের অপেক্ষা করছে। খুব ভাগ্যবতী মায়ের ছেলে সুমন, যাকে গোসল করাতে মসজিদের ইমাম সাহেবের স্ত্রী স্বয়ং আসছেন। কাবা শরীফ থেকে আনা কাফনের কাপড় পাওয়া গেছে।
সুমন বলতে চায়- মামা গোসলের সময় আম্মাকে ব্যথা দিতে মানা করবেন। নাকফুলটা সাবধানে খুলতে বলবেন, যেন কেটে-ছিঁড়ে না যায়।
আসগর ভাই, ভাবী পেছনে কাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে আর বলে না।
-‘একদম কাঁদবে না, চিন্তা করবে না। আমরা সব আছি তো’... এমত ভূমিকা সেরে মামা জানায়- ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে এসে ভালোও হয়ে গিয়েছিল প্রায়। তার মায়ের লাশ এখন গোসলের অপেক্ষা করছে। খুব ভাগ্যবতী মায়ের ছেলে সুমন, যাকে গোসল করাতে মসজিদের ইমাম সাহেবের স্ত্রী স্বয়ং আসছেন। কাবা শরীফ থেকে আনা কাফনের কাপড় পাওয়া গেছে।
সুমন বলতে চায়- মামা গোসলের সময় আম্মাকে ব্যথা দিতে মানা করবেন। নাকফুলটা সাবধানে খুলতে বলবেন, যেন কেটে-ছিঁড়ে না যায়।
আসগর ভাই, ভাবী পেছনে কাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে আর বলে না।
-‘আম্মা
এই দেশে থাকতে আর ভালো লাগে না। চলে আসি
আম্মা? খুব শীত, হাঁটু সমান বরফ পড়ে। এদের কথা বুঝিনা। আম্মা কাজের জায়গায় মাঝে মাঝে দুর্ব্যাবহারও করে। এত দৌড়ের উপরে থাকতে হয়, বুঝাতে
পারবো না। আম্মা তোমার রান্না
খাই না কতদিন!’
-‘এসে কি করবি বাবা?’
এম এ ইন পলিটিক্যাল সায়েন্স বায়োডাটা আসার আগে ছিঁড়ে এসেছিল। আসলেই তো কি করবে সে?
-‘এসে কি করবি বাবা?’
এম এ ইন পলিটিক্যাল সায়েন্স বায়োডাটা আসার আগে ছিঁড়ে এসেছিল। আসলেই তো কি করবে সে?
তারপর আবার কখনো নাড়িছেড়া বেদনা জেগে
উঠলে মা আকুল হয়েছে-‘বাবু, দেশে চলে আসো। খাই না খাই মা ছেলে একসাথে থাকবো। তোর
একটা বিয়ে দেই’।
-‘রেষ্টুরেণ্টে কাজ করলে এক লাখ টাকা
তোমার দেশে কেউ দিবে?’
আম্মার চুপসে ঠোঁট, চোখের নীচে কালি
আরো গাঢ়, সুমন দেখতে পেয়েছে।
আসগর ভাই কাঁধে হাত রাখেন,-‘তোমার
মায়ের হয়ে সবার কাছে মাফ চাও সুমন’।
লীনার ঘরে বিছানা বেশ উঁচু, বসলে
নিজেকে ঝুলন্ত মনে হয়। আসগর ভাই আবারো বলেন-‘সুমন মাফ চাও’।
অভিভূতের মত পূনরাবৃত্তি করে সে-‘মামা আমার মাকে
সবাই মাফ করে দিয়েন, মামা সবাইকে বলেন, মামা’- বলতে বলতে হু হু করে কাঁদে সে। আসগর
ভাই তাকে জড়িয়ে ধরতে ঝুঁকে আসে, কিন্ত সে সোজা হয়ে থাকে, তার শরীর শক্ত। ভাবী আগর
বাতি জ্বালায়। কেমন একটা মৃত্যুগন্ধী বাতাস ঘরের ভেতর বন্দী হয়ে ছটফট করে।
আসগর ভাই
হাত তুলে মোনাজাত করার ভঙ্গিতে বলেন,-‘আমার মা যদি কারো সঙ্গে কোন অন্যায় করে
থাকে, কারো কাছ থেকে ধার নিয়ে পরিশোধ করতে অপারগ হয় আমি তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী’।
এত বড় বাক্য সুমনের বলতে ইচ্ছে করে না। সে শুধু বলে- ‘আম্মার
কি কোথাও ধারকর্জ কিছু ছিল? মামা আমি টাকা পাঠাচ্ছি’।
মামা তখন জানাজা, কুলখানি, চল্লিশার আর্থিক হিসাব কিতাব দেয়, এবং বেশী বাজেট, কম বাজেটের কবর, বাঁধাই ইত্যাদি নিয়ে একটি ফিরিস্তি সুমনকে বিষয়ী ভঙ্গীতে কথোপকথন চালাতে সুযোগ ক’রে দেয়।
মামার চাপাভাঙ্গা গাল আর প্রকট
গোঁফের ভেতর থেকে পরিস্কার কন্ঠস্বর শুনতে পায়, যে, তার মায়ের শেষ গোসলদাত্রী এসে
পৌঁছেছেন। সুক্ষ্ণ ব্যথা থেকে থেকে ক্ষুধার মত চাগাড় দেয় সুমনের মাথায়। ধারভাষ্যের
মত মামা বলে যায়-...‘তোর ছোট চাচাকে ফোন করলাম, তার বৌ ধরলো। বললাম যে নামাজের পর
জানাজা, শুধু ইন্নালিল্লাহে পড়লো আর বললো দেখি পারলে আসবো। বল এটা কোন মানুষের
কাজ? সুমন, বাবা, ওরা সাক্ষাৎ পিশাচের
গুষ্টি। আমার বোনটাকে কোন দিন শান্তি দিল না। পাগল অপবাদ দিয়ে অর্ধেকটা জীবন বাপের
বাড়িতে ফেলে রাখলো, একটা পয়সা দিলো না কোন দিন। বিদেশ টিদেশ হলে এইসব নিয়ে
হুলুস্থুল করা যাইতো, বল যাইতো না? অথচ দ্যাখ, কে না পাগল, তোর বাপের গুষ্টি এমনকি
আমরা সবাইও কি টু সাম এক্সটেন্ট পাগল না?’
উকিল মামার গলায় দার্শনিক ভাব, মনে
হয় ক্রস-আটলান্টিক না, সামনা সামনি বসে কথা বলছে,...‘মরার দুই দিন আগেও আপা ভালো
মানুষ, কোন পাগলামী নাই, আমাকে বললো – রন্টু বথুয়া শাক খাবো, কি ভাগ্য বাজারে পেয়েও গেলাম।
নিজে রান্না করলো, আল্লা মনে হয় আপার হাতে নেয়ামত দিয়ে দিছিলো সেইদিন’।
‘ইউ হ্যাভ ওয়ান মিনিট লেফট’- ফোন কার্ডের সময়সীমা নিয়ে সুকন্ঠী ওয়ার্নিং ভেসে এলে
সুমনকে আবারো পরে ফোন করার কথা বলতে হয়। মেঝে বরাবর তাঁকিয়ে সে তিন জোড়া পা দেখতে
পায়। আসগর ভাই, ভাবী তখনো আছেন, পেছনে আদনান, লীনার ছেলে। সতের বছরের শরীরে তিন
চার বছর বয়সী ব্রেইন গুজে অবাক চাউনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকেই প্রথম সুমনের
দায়িত্ব ছিল আদনানকে রেডি করিয়ে ওর স্পেশাল স্কুলের বাসে তুলে দেয়ার। লীনা এর কোন
সমাধান না খুঁজেই অফিসে বেরিয়ে গেল!
মাতৃহারা পুত্রের ক্ষুধাতৃষ্ণা
প্রাসঙ্গিক কিনা এ বিবেচনার ওপর হাত বুলোতে বুলোতে সুমন জুতোর ফিতে বাঁধে। বিকেলের
কাজে ফোন করতে হবে। একদিন ছুটি পাওয়ার মত যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ঘটেছে। আরো
কতগুলো জরুরী কাজ- ফোন কার্ড কেনা, দেশে টাকা পাঠানো, চুল কাটানো আর আদনানকে
স্কুলে পৌঁছে দেয়া। স্কুল কোথায় তাও তো সে জানে না। লীনাকে ফোন করবে? অফিসের ফোন
নম্বর ফ্রিজের ওপরে লেখা আছে।
ভাগ্য ভালো সকালে তার ম্যানেজার তাকে
ডে-অফ দিয়েছে। বেতন দেওয়ার চান্স নেই। এ নিয়ে দাবী তোলার অবস্থাও সুমনের না, কোন
রকম বেগড়বাই দেখলে যদি লে-অফ দিয়ে দেয়, সে যে এখনো ট্যাক্স পে করে কাজ করতে পারছে
এটাই ভাগ্য মানে এখন। সুযোগ সুবিধার বহর ক্রমেই জন্য ছোট হয়ে আসছে। এখন শেষ ভরসা
আর লটারী হলো- লীনা।
.........…………………
মেঘাচ্ছন্ন সকাল, শীতের তুলনামূলক কম
তীব্রতা আর রৌদ্রোজ্জল দিনে ঠান্ডার প্রকোপ- আবহাওয়ার এই গতিক এখন সুমন বোঝে।
আদনানের মাথায় মাংকি ক্যাপ, জ্যাকেটের হুডও মাথায় দেয়া, যেমন প্রতিদিন দেয়। সুমনের
হাত ধরে ধরে নভোচারীর সতর্কতায় হাঁটছে। লবন ছিটিয়ে যাওয়া পথে বরফ জমে নেই। আদনান
পায়ে বল ছোড়ার মত বরফ দিয়ে খেলার লোভে
ফুটপাতের ধার ঘেষে যায়, আর সুমন টেনে টেনে তাকে মাঝামাঝি আনে। কোথাও গুপ্ত পিচ্ছিল
বরফে পা ফসকালে আর দেখতে হবে না। আসগর ভাইয়ের বউই তো কৃত্রিম এক পা নিয়ে ঘুরে
বেড়ায়। সুমন আদনানকে পা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলা
শেখায়। পদক্ষেপে হাঁটার চেয়ে নিরাপদ, অন্তত ফ্রিজিং রেইনের দিনে।
লীনাকে স্কুলের ঠিকানার জন্য ফোন
করেছে, সে নেই। মেসেজ রেখেছে, কল ব্যাক করেনি এখনো। আদনানের হাত ধ’রে হাঁটতে গিয়ে
নিজের ভেতরে পিতাসুলভ অনুভূতি জাগতে দেখে বিস্ময় জাগে সুমনের। সতের বছরের ছেলে
থাকার সম্ভাবনা তার ছিল না, সে নিজেই সাতাশ। তবে সাতাশ বছর বয়সে বাবা হওয়া বাহুল্য
কিছু না। বাবার বাৎসল্য কি এভাবে
ঘটনাক্রমে হঠাৎ জন্ম নেয়? লীনা
কালকে রাত্রের পর মা হতে পারে আবার? আদনানের দিকে তাঁকিয়ে এ ভাবনা তার আশংকা
বাড়ায়। তার আরো সাবধান হওয়া উচিত ছিল। সিঙ্গেল মা হয়ে খুব ভালো আছে- লীনা তো তাকে এভাবেই বোঝালো- স্বাধীনতা আর দ্বিতীয়বারের মত খোয়াতে চায় না। এ
পর্যন্ত সে সুমনকে নিয়ে সেখানেই গেছে সম্পর্কের বৈধতা, অবৈধতা নিয়ে প্রশ্নসাপেক্ষ
চোখ যেখানে বিদ্ধ করে না।
আর্মি অফিসারের এক্স ওয়াইফ লীনা অনেক
বেশী দেখেছে দেশে থাকতে। গুলি, বন্ধুক, সৈনিক সংস্কৃতি আর কুকুর। তারপরও অনেকদিন
তার অন্ধত্ব আসেনি। মেজর, তার চেহারায় ফটোর ভেতরেও, ঢেলা ঢেলা চোখ আর কালো গায়ের
রংয়ে একনায়কতন্ত্রের ছাপ, ঘরের মধ্য থেকে যার প্র্যাক্টিসের শুরু। আরেকটি সুস্থ্য
সন্তানের আশায়, লীনা বলে, শরীরের কোমর থেকে নীচের অংশের দখল এমনভাবে নিতে শুরু
করেছিল যে আতংকজড়িত লীনা অন্ধ হয়ে যায়। সৈনিকদের কোন জৌলুশই আর তার চোখে পড়ে না।
প্রথমে ভেবেছিল বোবা ছেলের জন্য যাচ্ছে, কিন্তু পরে দেখেছে সে আসলে নিজের কথা ভেবে
দেশ ছেড়েছে। কানাডা এসে ভুল হয়নি তার- বলছিল, কালকে রাত্রেই তো, তিন চার গ্লাস
রেডওয়াইনের পর। এখন তার স্বপ্ন একটাই, ছেলেকে দুনিয়ার এমন কোন কামেল মানুষের কাছে
নেয়া যার ছোয়ায় রাজপুত্রের মত চেহারা নিয়ে জন্মানো আদনানের মুখে বুলি ফুটবে, মা
ডাকবে। শুনে সুমন বলেনি যে দুনিয়ার কোথাও যেতে কোন বাঁধা না থাকলেই এই রকমের
আকাশচুম্বী ভাবনা ভাবা যায়। নিজের কথা ভেবেই বলেনি। লীনার স্বপ্নটা তার নিজের
স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার সরু গলি, ঝামেলা পাঁকালে ডেড-এন্ড হয়ে যেতে কতক্ষণ!
কাগজে সই করে লীনা তার অফিসিয়াল
স্পাউস। গত তিন মাস বারোশ ডলার ক’রে দিতে হয়েছে তাকে। এই মাসে তাদের দুজনের ইমিগ্রেশন
ইন্টারভিউ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পুরো এক বছর বেতনের তিন ভাগ লীনাকে দিয়ে একটা
ছাড়পত্র হাতে পাবে সে। লীনার থেকেও মুক্তি। তারপর কি করবে?
-‘দেশে আয় না বাবু। কত দিন তোকে
দেখিনা’।
-‘আসবো আম্মা, কাগজপত্র একটু ঠিক হোক’।
-‘সবার কাগজ ঠিক হয়, খালি তোরটা হয়
না।’
-‘আমার ভাগ্য খারাপ আম্মা’।
-‘না... কে বলে ভাগ্য খারাপ? দ্যাখ,
গুষ্টির মধ্যে তুইই একলা একলা বিদেশ গেলি’।
মা জানতে চাইলে সুমন হয়তো বলতে
পারতো, কেমন ক’রে সে ইউ এস এ থেকে ক্যানাডা পৌঁছালো। মা জানতে চায় না, তাই সে শুধু মসৃণ
কালো পীচের রাস্তা ধ’রে উঁচু জীপ গাড়িটার কথা বলে। রাস্তার দুপাশে কালো, রূপালী পাথরে আচ্ছাদিত
টিলা, আর থেকে থেকে ঢালু উপত্যকা, ধুসর সবুজ ঝোপঝাড় দেখতে দেখতে আধো জাগরণে সে
পৌঁছে গেছে এক নিরাপদ ভূমিতে, এ কথা বলে। সাজেদুল ভাইয়ের কথা বলতেই হয়, অন্তত
এটুকু আশ্বস্ত করতে যে ছেলের কাছাকাছি অভয় দেয়ার মত কেউ একজন আছে। যে তাকে বর্ডার
থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে নামিয়ে দিয়েছিলো। তার নিজের সমস্যা আপাতত না থাকলেও
এফ বি আই আর ইমিগ্রেশান পুলিশের কাছ থেকে দূরত্ব রাখার মত বিচক্ষণতা তার আছে। সুমন
বাসে করেও চলে আসতে পারতো। কিন্তু ঐ যে ভরসার জায়গা, ভরসা করার মজ্জাগত অভ্যাস।
তাই সে হাঁটে, হাঁটতে হাঁটতে পা চলে না। জনমনিষ্যিহীন তেপান্তরের পাড়ে সন্ধ্যা হয়
হয় সময়ে দুই বিপরীতমুখী হাইওয়ে ধ’রে তীব্র গতির গাড়ি অবহেলা ক’রে সে আকাশে তাঁকায়। তারা ফুটি ফুটি
মহাশূণ্যে নিজের ক্ষুদ্রত্বের অনুভব বুঝি তখনই ভালো করে হয়েছিলো। সে মূহুর্তে
নিজেকে ছাড়া আর কারুর ওপর ভরসা করবে না এমন প্রতিজ্ঞা ক’রে ফেললেও থাকলো কই? ভরসা শেষমেষ
করতেই হচ্ছে।
..............................
আদনানের হাত ধরে দুই ব্লক পার হয়ে
পেছনে এসে বড় পার্কের বিশাল প্রান্তর। এক পাশ উঁচু করে থাকা সি-সঅ, কিছু নগ্ন গাছ
আর বরফে আচ্ছাদিত দোলনা বাদ দিলে এমন মাঠ শুধু শূন্যতা বাজায়।
এবার লীনাকে ফোনে পাওয়া যায়। নাহ,
আদনান তার স্কুল চেনেনা। আর সেখানে যেতে হলে সাবওয়ে নিতে হবে। এই বেলা সুমন তার
ছেলেকে একটু দেখে রাখুক, সে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চেষ্টা করবে। আদনানকে অগত্যা
পার্কের ভেতরে ছুটে যেতে দিতে হয়। সে দৌড়ে গিয়ে বরফে আছাড় খেয়ে হি হি করে হাসে,
তারপর দুহাতে বরফ নিয়ে চেপে চেপে বল তৈরী করে, আর সেই সঙ্গে তার খুশীর প্রকাশ
দূর্বোধ্য কোন শব্দ। সে শব্দাবলীর মানে না বুঝে তরুণ বয়েসী এক মানুষের শিশুতোষ
ভঙ্গির সঙ্গে অভ্যস্থ হওয়ার চেষ্টা করে সুমন।
চুল কাটানো হবে না। কিন্তু ফোন কার্ড
কেনা ভীষণ জরুরী। তার ফোনে লং ডিস্ট্যান্স সুবিধা সে ক্যান্সেল ক’রে দিয়েছিল, থাকলে
যখন তখন ফোন করা হয়। বাড়তি খরচ।
এ রকম পার্কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে
শীত আরো বেশী লাগে। আদনান আসতে চায় না। শিশুরা কি দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়,
কিন্তু আদনান তো শিশু না। আবার শিশুও। তাকে হাত ধ’রে টেনে আনতে সুমন গোড়ালি উপচানো বরফ
ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে ভেতরে যায়। এবার সে বাধ্য, হয়তো তাকে কম চেনে বলে।
টাকাও আজকে পাঠানো হবে না। রফিকের
মানি এক্সচেঞ্জ বাস আর সাবওয়ে মিলিয়ে অন্তত আধাঘন্টা। আদনানসহ এতটা পথ যেতে
সাচ্ছন্দ বোধ হয় না। অথচ ছুটি শুধু আজকেই মিলেছে। নইলে আবার সেই সামনের রবিরারের
অপেক্ষা।
মোড়ের কর্নার ষ্টোর থেকে চার পাঁচটা
কলিং কার্ড কিনে বাসায় ফেরে। আদনান নীচের মেইন দরজায় এসে আর ঢুকতে চায় না। সুমন
জোর করতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে সিঁড়িতে বসে পড়লে সে খেলা জেতার হাসি হেসে উঠে যায়
দোতলায়।
সময়ের হিসেবে দেশে এখন বিকেল। আসরের
ওয়াক্ত শেষে জানাজা। দেশের বিকেল কি শীতের কাঁপন দিচ্ছে? ব্যস্তহাতে ফোনের
নম্বরগুলো টেপে সুমন। এক রিং হতেই বড়মামার জবাব পাওয়া যায়। কবরের জায়গা সংক্রান্ত
পছন্দ, অপছন্দ ইত্যাদি প্রসঙ্গে সুমন হু হ্যা করে।
-‘তুই যখন আসবি, কবরটা জিয়ারত করতে
পারবি। কিন্তু আজিমপুরের কবর আবার কবর নাকি? এক কবরে কত শত কবর। হাড্ডিগুড্ডিসহ
ট্রাক্টর দিয়ে মাটি সমান করে সেখানে আরো অন্য কবর, আমার ইচ্ছা না যে আমার বোনের
এমন কবর হোক, তুই কি বলিস বাবা’।
কবর জিয়ারত করলে কি মানুষটাকে ছোঁয়া
যায়? মামার কথায় কেন যেন বিরক্ত লাগে সুমনের। ফৌজদারী মামলা লড়লে মানুষে
অনুভবজ্ঞান কমে আসে- এই উপপাদ্যে পৌঁছার সময় বোধহয় এসেছে। মামাকে মূল প্রসঙ্গে
ফিরে যাওয়ার তাগিদ দিলে জানা যায়, আসলে তারা একটি মাইক্রোবাস ঠিক করে মাকে নিয়ে
গ্রামের বাড়ি রওয়ানা হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ, প্রায় দু ঘন্টা ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে
তারা ঢাকা ছেড়েছে। তবে চিন্তার কিছু নেই, মসজিদ থেকে দু জন হাফেজ ছাত্রকে সঙ্গে
নিয়ে এসেছে, তারা মাইক্রোবাসে কোরান তেলাওয়াত করতে করতে যাচ্ছে। আর মিনিট দশেকে
তার নানার বাড়িতে পৌঁছে যাবে। সুমনের যদি অসুবিধা না হয় তাহলে যেন সে কথা বলতে
থাকে। মামা তাকে সব কিছুর পুংখানুপূঙ্ঘ বিবরণ দিতে পারবে।
রান্না ঘর থেকে ভেসে আসা শব্দ সুমনকে
দৌঁড়ে আনে সেখানে। আদনান ফ্রাইং প্যানে লম্বা চামচ দিয়ে তান্ডব করছে। চোখ লাল,
কেঁপে কেঁপে ওঠা উপচানো গাল বেয়ে পানি আর মুখের লালা গড়িয়ে বুকের কাছে ভিজে গেছে।
টেবিলের ওপর আঙ্গুলে টিপে টিপে মারা কুচো তেলাপোকা।
ভাগ্য ভালো লীনাকে এবার ফোনে পাওয়া
যায়। সত্যিই তো, সকাল থেকে ছেলেটার কিছু খাওয়া হয়নি। এখন তার উথাল-পাথাল ক্ষিধের
একমাত্র সমাধান ম্যাকডোনাল্ড। লীনার কথামতো নামটা উচ্চারণেই ম্যাজিক হয়। তেলাপোকার
সঙ্গে বসত লীনার চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। আদনানের হাত ধ’রে আবার লিফটের বোতাম টেপে সুমন,
ছেলেটা তেলাপোকা ধরতে পারলো কি ভাবে? পৃথিবী ধবংস হলেও যে বস্তু ধবংস হবে না, তার
বিরুদ্ধে লীনা হয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছে, কিন্ত তার ছেলে কি দেয়নি!
ফোনে বড় মামার মেসেজ- ‘এসে পৌঁছেছি’।
আদনানের জন্য ‘কিডস-হ্যাপি-মিল’ অর্ডার করে সুমন
দেশে ফোন করলে মামার ভেজা কন্ঠ শোনা যায়-‘বাবা তোমার খালা, মামী সবাই কানতেছে।
আপাকে বিদায় দিতে হবে এখন। আমরা মূর্দা কাফন টাফন পরায়া নিয়ে আসছি। এখানে আরেকটা
জানাজা হবে। উঠানে কাঠের কফিনে তাকে রাখা হইছে সুমন। ভালো করে চাপাতা আর বরফ দিয়ে
দিছিলাম। এই কয়ঘন্টায় কিচ্ছু হয় নাই, সেই রকম তাজা ফর্সা চেহারা। শুধু দুই চোখ আর
খুলতে পারবে না। আমার বোন আর চোখ খুলবে না’...। মামা শব্দ করে কাঁদে, তার কান্না
সংক্রামিত হ’লে আদনান অবাক দৃষ্টিতে সুমনের চোখের পানি গড়ানো দেখে দূর্বোধ্য শব্দ করে।
একহাতে সেল ফোন কানে চেপে সুমন তাকে পেপসির পেপার কাপে স্ট্র ঢুকিয়ে দেয়। বার্গার
আর পোট্যাটো চীপ্সের ওপর ক্যাচাপ ছড়িয়ে দেয়। সুক্ষ্ণ ব্যথাটা আবারো কাঁধে ভর ক’রে মাথার দিকে
যাত্রা করছে। তার পিপাসা পায়। ইচ্ছে ক’রে ফোনের লাইন কেটে দেয়। এসব শুনে কি হবে? মা কি আর
আসবে? পরক্ষণেই তার ইচ্ছে করে জুড়ে থাকতে, সেসব অঞ্চল, যেখানে মা ছিল। তার বাইশ
বছরের হর্ষ-বিমর্ষতা ঘিরে সবসময় ছিল।
তিন চার মাস আগে কি? মা ফোন ধরেই
বললো,-‘গেল সোমবার খুব ঝড় তুফান হয়ে গেলরে বাবু। তোকে একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছা করলো
খুব... বারান্দায় বসে বসে ঝড় দেখলাম আর লেখলাম চিঠি...অনেক বড়, তিন পৃষ্ঠা!...পরের
দিন দোকানে গিয়ে খাম কিনলাম, ঐ যে শাদা নীল বর্ডার দেওয়া, এয়ার মেইল...তারপর যারেই
বলি- পোষ্টাপিসে টিকেট লাগায়া দিতে, সে ই হাসে। বলে, ঠিকানা কই?... দেখ, আমি তোর
ঠিকানাই জানিনা!’
-‘ঠিকানা দিচ্ছি আম্মা তুমি চিঠি পাঠাও’।
-‘কিন্ত চিঠি ভর্তি খামটাই তো আর
পাচ্ছি না, কই যে রাখলাম, এখানে এত আলতু ফালতু কাগজ পত্র!’
আদনান খুশী মনে খায় আর ম্যাক টয় দিয়ে
টেবিলের ওপরে খেলে। সকালের ভীড় কমে গিয়ে ম্যাকডোনাল্ড প্রায় ফাঁকা, দু একজন বুড়ো
বুড়ি খায়, হাল্কা যন্ত্রসঙ্গীত বাজে। সুমন আবারো ফোন ঘোরায়। রিসিভ করতে আজকে মামার
ক্লান্তি নেই। তারা কবরস্থানের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। মানুষের গুঞ্জন-ধ্বনি সাত
সমুদ্র পার হয়ে নিকট সম্ভব মনে হয়। ওরা বাড়ির সামনের সরু পথ, বাঁ দিকের সুপারী
গাছের সারি পেছনে ফেলে বড় রাস্তায় যাচ্ছে। মহিলারা মুখে আঁচল চেপে উদগত কান্নার
শব্দ থামাতে চাইছে। কবরস্থান বেশী দূরে না। মামা জানাতে জানাতে কাফেলার পেছনে
হাঁটে...‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে, প্রায় সাতটা। সঙ্গে হ্যাজাক বাতি আছে, টর্চও
আছে...জানোই তো এখানে কোল্ড চেইন কত কম আর তুমি যদি আসতে পারতা...তাইলে রাখার
চিন্তা ভাবনা করা যাইতো’।
আহ, সে যদি আসতে পারতো! অপারগতার
কাঁটা দলা পাকিয়ে সুমনের গলায় আটকে থাকে। অনেকক্ষণ। সে কথা বলেনা। মামা জানতে চান
সে লাইনে আছে কিনা, কারণ তারা কবরে আপাকে শুইয়ে দিয়েছে। এক এক জন এক মুঠো করে মাটি
ছুঁড়ে দিচ্ছে। সবার দেয়া হয়ে গেলে যে লোকটি কোদাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে তৎপর হবে, একটা বাঁশের মাচা দিয়ে ঢেকে দেবে। মাচার ফোঁকর
গলে ঝ’রে ঝ’রে ধীরে ধীরে মাটিময় হবে শাদা কাফনে ঢাকা মায়ের শরীর। সেখান থেকে সুমন কত
দূরে!
------------------------------------------------------------------------------------------------
জন্ম, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গে। পড়াশুনা ঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ত্রপিক্যাল মেডিসিন।
------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি
নাহার মনিকা
জন্ম, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গে। পড়াশুনা ঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ত্রপিক্যাল মেডিসিন।
বর্তমান নিবাস : কানাডা।
গল্পগ্রন্থ : পৃষ্ঠাগুলি নিজের।
কাব্যগ্রন্থ : চাঁদপুরে আমাদের বরষা ছিল।
------------------------------------------------------------------------------------------------
0 মন্তব্যসমূহ