জাকির তালুকদার
নিখাদ আতঙ্কের
মুখোশ পরা প্রত্যুষ এবাড়ির কেউ আগে কোনোদিন দেখেনি। জ্যৈষ্ঠমাসের খাড়া দুপুরের
আকাশ-পোড়ানো মাটি-পোড়ানো গা-পোড়ানো গরমের সাথে নিম্নচাপ হবে-হবে গুমোট যোগ হলে
যেমন সর্বাত্মক শারীরিক অস্বস্তি তৈরি হয়, বাড়িজুড়ে সেই রকমই দমচাপা আবহাওয়া। এমনকি
এই ভোরে নামাজ-ঘরের টিনে তারস্বরে কাক ডেকে উঠলে, বেড়ার পাশে গাড়া কিংবা নেড়িকুত্তার দল
খেউ খেউ করে উঠলেও ‘দূর হ’ বলার মতো ইচ্ছা
অথবা সাহসটুকুও কারও হয় না।
বাড়ির মানুষ
সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। অল্প বয়স যাদের, তারাও তন্দ্রার
মধ্যে চমকে চমকে উঠেছে দরজায় কড়া নাড়ার কাল্পনিক শব্দ শুনে শুনে। কাল রাতে বাড়ি
থেকে যাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সে নিশ্চিত ফিরে আসবেই এমন বিশ্বাসে কারও কারও চিড় ধরে
গেলেও সে কথা কেউ উচ্চারণ করছে না। প্রত্যাশা। দৈবের ওপর। অলৌকিকের ওপর। আমাদের
সময়কালে কেউ কোনোদিন অলৌকিক কিছু ঘটতে দেখিনি নিজেদের জীবনে। কিংবা অন্য কারও
জীবনে। তবু আমরা কোনো কোনো সময় অলৌকিক কিছু ঘটার প্রত্যাশা নিয়েই জীবনের
ধুকপুকানিটাকে বৈধতা দানের চেষ্টা করি। কিন্তু এই ঘটনাতে অলৌকিকের কোনো হস্তক্ষেপ
ঘটবে, এমনটি আশা
করাও একটু বেশি আশা হয়ে যায়। কারণ যারা তাকে তুলে নিয়ে গেছে, তারা এতই
শক্তিশালী যে অলৌকিককেও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে। তা জেনে এবং মেনেও এই বাড়ির মানুষরা অলৌকিকের ওপরেই ভরসা
রাখে।
এতক্ষণ কোনো
বাতাস ছিল না। এ-ও এক অনিয়ম। সারারাত যতই তাপের দাহ সইতে হোক না কেন পৃথিবীকে, ভোরের দিকে
একটু ঝিরিঝিরি আসবেই। কিন্তু আজ সেটাও কেন নেই? এই কথাটা কেউ কেউ বোধহয় ভেবেছিল। সঙ্গে
সঙ্গেই প্রায়, তাকে
চমকে দিয়ে গেটের পাশে কোনো রকমে খাড়া হয়ে থাকা বাঁজা নারকেল গাছটা একবার নিজের
শ্রীহীন পাতাগুলিকে এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে নেয়। যে খেয়াল করেছে পাতা দোলানো, সে মনে মনে
শিউরে ওঠে। এ তো স্পষ্ট ‘না’ চিহ্ন! মাথা
এপাশ-ওপাশ নেড়ে না বাচক ইঙ্গিত করার মতো দুলল কেন নারকোল-পাতা? এ কি তাদের
অলৌকিকের প্রতি আশা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ‘না’? না কি একেবারেই
জানিয়ে দেওয়া যে, যাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সে আর ফিরে আসবে না।
কিন্তু একটা
বাড়িতে কবরের নিস্তব্ধতা থাকলেই যে সাড়া পৃথিবী তার সাথে স্তব্ধতা নিয়ে সংহতি
জ্ঞাপন করবে, এমন
আশা করা অন্যায়। কারণ পৃথিবী বেশিক্ষণ শব্দহীন থাকতে জানে না। তাই ভোরের নামাজ শেষ
হওয়ার আগেই পাশের দুই বাড়ির রেলিং থেকে দুই মহিলার কথোপকথন ভেসে ওঠে। একজন
আরেকজনকে ডেকে বলছে-- ও ভাবি কী করেন?
কী আর করব
ভাবি! যা যা করতে হয় আমাদের রোজ, সেইগুলানই করি। আপনাকেও তো একই রকম কাজ করতে হয়। তাই আপনাকে
আর কী বলব!
এমনিতেই এই
পাড়ার বাড়িগুলি গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় পাশাপাশি দুই বাড়ির মধ্যে কোনো
প্রাইভেসি নামক জিনিস বেঁচে থাকতে পারে না। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির দেশে এই
জিনিসটা মেনে নিয়েছে সবাই। কেউ তেমন অসুবিধা বোধ আর করে না। এ-পাশের বাড়ির কাজের
বুয়া একটু চালাক-চতুর কানতোলা হলে মোটামুটি নির্ভুল বলে দিতে পারে ডানের বাড়ি
বামের বাড়ির দম্পতি গেল মাসে কয় রাত সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে। কোন বাড়িতে কে কে থাকে, কয়দিন অন্তর
অন্তর কেমন চেহারার নারী-পুরুষ কোন বাড়িতে আসে, অন্যদের তা মুখস্থ। তাই রাতে যে এবাড়ির
সবচেয়ে জোয়ান এবং কর্মক্ষম ছেলেটিকে তুলে নিয়ে গেছে কে বা কারা তা জানতে সবার না
হলেও অন্তত কারও কারও বাকি নেই। তারপরেও এমন কিছু-হয়নি ভাব ধরে রাত কাটিয়ে দিনকে
বরণ করছে কীভাবে পাড়ার মানুষ!
সকালটা আর একটু
ফুটে উঠতে খুব মৃদুস্বরে বাড়ির বড় বউ আহ্বান জানায়-- নাস্তা দেওয়া হইছে টেবিলে।
তখন, একমাত্র ফজরের
নামাজপড়া মা ছাড়া অন্য সকলেরই মনে পড়ে যে আজ এখন পর্যন্ত কারও প্রাতঃকৃত্য সারা
হয়নি। বড়ছেলের তো সকালে পানি-চা-সিগারেট না পেলে পেটে মোচড় আসে না। সে তাই উঠে
নিজের ঘরের দিকে যায়। চায়ের কাপ এবং পানির গ্লাস হাতে বউ তার এক্ষুণি এসে দাঁড়াবে
সামনে। অনেকদিনের রুটিন। কিন্তু আজ কোনোকিছুই আগের মতো ঘটে না। সে চা-পানির জন্য অপেক্ষা
না করেই সিগারেট ধরায়। এবং জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে চেপেই বিছানায় একটু গড়িয়ে নেবার
জন্য এলিয়ে পড়ে।
কিন্তু তাকে
বিছানা ছাড়তে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই। বড় খালু এসেছেন। রিটায়ার করার পরে এই শহরে
আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নিয়ে বেড়ানোই তার প্রধান কাজ। তিনি প্রায় ধমকের সুরে
সবাইকে বলছেন-- কাল
রাত নয়টার সময় ঘটনা ঘটেছে, নয়টার সময় তুলে নিয়ে গেছে ছেলেটাকে, অথচ এখনো থানায়
কোনো খবর দেওয়া হয়নি! এটা একটা কথা হলো?
কে তাকে বোঝাবে
যে যারা এ-বাড়ির ছোট ছেলেটাকে তুলে নিয়ে গেছে, তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছিল আইনের লোক
বলেই। সেই কারণেই থানায় যাওয়া হয়নি। কারণ আইনের লোক যখন তাকে নিয়ে গেছে, তখন কোনো খবর
এলে থানা থেকে ঠিকই আসবে।
এমন কথায় কপাল
চাপড়ান বড় খালু-- হায়
হায়, তোমরা সেই
কথা বিশ্বাস করে বসে আছো! পেপার-পত্রিকা-টেলিভিশনে তো রোজ রোজ খবর থাকে যে ভুয়া
পুলিশ, ভুয়া
আইনের লোক সেজে দুষ্কৃতীকারীরা অহরহ লোককে ঠকাচ্ছে। ওদের পরনে কি পুলিশ বা সরকারি
বাহিনীর পোশাক ছিল?
না। সিভিল
ড্রেস।
তাহলেই বোঝো।
কোনো ওয়ারেন্ট দেখিয়েছে ওরা?
না।
নিজেদের পরিচয়
হিসাবে আইডি কার্ড দেখিয়েছে?
না।
তোমরা কেউ
দেখতে চাওনি?
আইডি কার্ড
দেখতে চাওয়ার সাহস তখন কার থাকে? তবে তারা তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছে বারবার। জানতে চেয়েছে
তারা কোন বাহিনীর লোক। অনুনয়ের সঙ্গে জানতে চেয়েছে ছেলেকে কোন অপরাধে নিয়ে যাওয়া
হচ্ছে। আকুল হয়ে জানতে চেয়েছে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ঘটনার পুরো
বিবরণ শুনতে চান খালু।
রাত নয়টার
দিকেই হবে। সাধারণত এত অল্প রাতে বাড়িতে ফেরে না কোনো ছেলেই। যে যার মতো কাজ সেরে
খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ে বাড়ির মানুষ। ছেলেদের ভাত ঢাকা থাকে ডাইনিং টেবিলে। যে যার
মতো খেয়ে নেয়। কিন্তু কাল রাতে ছোট ছেলে ফিরেছে আগে আগে। আটটার পরপরই।
তাকে কি
উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল?
না। অন্য দিনের
মতোই স্বাভাবিক।
তাহলে যে আগে
আগে ফিরল? অস্বাভাবিক
মনে হয়নি?
না। কারণ সে
এসেই টিভির সামনে বসেছিল। তখন মনে হয়েছিল বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট
ম্যাচ দেখার জন্যই তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। এমনটি আগেও হয়েছে। চা-চানাচুর সামনে নিয়ে
জম্পেশ করে বসে খেলা দেখার অভ্যেস ছেলের। সেই খেলা দেখতে দেখতেই মোবাইল ফোন। অন্য
কথা বোঝা যায়নি। তবে ‘আসছি’ শব্দটা কানে
গেছে পাশের ঘরে জায়নামাজে এশার নামাজরত মায়ের। পরনে ঘরে পরার ট্রাউজার আর টি
শার্ট। চটি পরেই বাইরে বেরিয়ে গেছে মোবাইল হাতে। বাইরে মানে দূরে নয়। একেবারে ঘরের
দরজাতেই বলা যায়। মানে গ্রিলের গেটের বাইরেই। সেখান থেকেই মোবাইলে বউকে বলেছে নিচে
আসতে। কণ্ঠস্বরে এমন ভীতি ছিল যে তার বউ সঙ্গে সঙ্গে মাকে জায়নামাজ থেকে প্রায়
টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। একটা মাইক্রো দাঁড়ানো। স্টার্ট দেওয়াই
রয়েছে। মানে ড্রাইভার গাড়িতেই ছিল। চারজন দাঁড়িয়ে ছিল তাদের ছেলেকে ঘিরে। তিনজনের
পরনে জিনস আর টি শার্ট। একজনের পরনের প্যান্টের মধ্যে গোঁজা চেকশার্ট। জোয়ান
সবাই। চুল ছোট করে ছাটা পুলিশের মতো। আলোটা তেমন উজ্জ্বল নয় বলে কারও মুখই স্পষ্ট
দেখা যায়নি। মা গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে কী হয়েছে। তারা বিরক্ত হতে গিয়েও সম্ভবত নামাজ
থেকে উঠে আসা মায়ের অবয়বের মধ্যে এক ধরনের সৌম্যতা দেখে নিজেদের বিরক্তি গোপন করে
স্বাভাবিক কণ্ঠে বলেছে যে ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। শহরে কিছু ঘটনা ঘটেছে। সেসব
নিয়ে কথা বলার জন্য তারা তার ছেলে খালেদুর রহমানকে নিয়ে যাচ্ছে। আধাঘণ্টার মধ্যেই
হয়ে যাবে। তারা ছেড়ে দেবে খালেদকে। শহরে কী ঘটনা ঘটেছে, আর সেসবের সাথে
খালেদের সম্পর্ক কোথায়, এমন প্রশ্নে তারা আর বিরক্তি চেপে না রেখে বলেছে যে সেসব
ব্যাখ্যা করার সময় তাদের হাতে নেই। ওসব পরে শুনে নেবেন ছেলের কাছ থেকে। তারা এখন
রওনা দিতে চায় খালেদকে নিয়ে। সেই অবস্থাতেও মরিয়া হয়ে মা তারা কারা এই প্রশ্ন করায়
শুধু দুইটা শব্দ বলেছে-- আইনের লোক। তখন খালেদ কাপড় পাল্টানোর কথা বলতে ওদের একজন
রসিকতা না শ্লেষ কোনটা মিশিয়ে যে বলল-- শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছেন না সাহেব। এই
ড্রেসেই চলবে। ড্রেস পাল্টানোর নামে দেরি করার কোনো দরকার নেই। খালেদ ভয় পেয়েছে
বোঝা যাচ্ছিল। দেরি করতে চাইছিল। এদিক-ওদিক চঞ্চল চোখে তাকাচ্ছিল বারবার। কিন্তু
তখন একে ক্রিকেট, তার ওপর ইন্ডিয়ান চ্যানেলে তুমুল বউ-ঝি টানা সিরিয়ালের
উত্তুঙ্গ সময়। বাইরে লোকজন নেই। পাড়ার মুদি দোকানে বা চায়ের দোকানে যারা থাকে, তারাও
টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসেছে। কাজেই এমন কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না, যাকে পেলে এই
ঘটনাটাকে বিলম্বিত করা সম্ভব। এমন গায়ে-গা-লাগা মানুষের দেশে এমন নিঃশব্দে একটা
মানুষকে মানে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, ঘটনা-শোঁকার আগ্রহে আকুল বাঙালির দেশে
প্রায় নির্জন একটা প্রহর তার সামনে এসে উপস্থিত হবে, এটা বিশ্বাসই হতে চাইছিল না খালেদের। এই
তো সবগুলো বাড়ির জানালা দিয়েই টেলিভিশনের শব্দ ভেসে আসছে। বাংলাদেশের কোনো
ব্যাটসম্যান চার-ছয় মারলে তো কথাই নেই, এক-দুই নিলেও উল্লাসের তোড় বেরিয়ে আসছে
বাড়িগুলোর দুর্বল দেয়াল ফুঁড়ে, সেইসব শব্দে পুরোটা ঢাকা পড়ে আছে দামি মডেলের মাইক্রোগাড়ির
শক্তিশালী ইঞ্জিনের চাপা আওয়াজ। তারপর আর কথা হয়নি কোনো। খালেদকে জোর করে গাড়িতে
ওঠায়নি তারা, কারণ
খালেদ কোনো ধস্তাধস্তি করেনি, বা না যাওয়ার
জন্য জোরাজুরি করেনি। গাড়িটা চলে যাওয়ার সময় এগজস্ট পাইপ থেকে যেটুকু ধোঁয়া বের
হওয়ার কথা, তার
চাইতে অনেক কম ধোঁয়া প্রায় না-বওয়া বাতাসের সাথে মিলিয়ে দিয়ে দিয়ে চলে যায়।
বর্ণনা শুনে
খালু কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকেন। যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন। এই রকম ভঙ্গি সামনের
লোকদের মনে প্রভাব বিস্তার করতে বাধ্য। বিশেষ করে আজকের পরিস্থিতিতে, যখন খড়কুটো
যা-ই পাওয়া যাক, তা
আঁকড়ে ধরতে পারলে বেঁচে থাকার জ্বালানির জোগান পাবে এই বাড়ির মানুষ। তাই অনেকক্ষণ
ধরে চোখ বুজে থাকলেও কেউ-ই খালুর ওপর বিরক্ত হয় না। বরং তার ধ্যান-পর্যায়ের
চিন্তার যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, তাই কথা বলা বন্ধ করে নিজেদের মধ্যে ইশারায় কাজ চালিয়ে নিতে
থাকে সবাই।
বেশ অনেকটা সময়
পরে চোখ খুলে খালু নির্দ্বিধ কণ্ঠে ঘোষণা করেন-- ওরা আইনের লোক ছিল না।
খালুর মুখ থেকে
এমন কথা শুনতে কেউ প্রস্তুত ছিল না। তারা শুনতে চেয়েছিল আশ্বাসের বাণী। খালেদকে
তুলে নিয়ে যাওয়া লোকেরা আইনের লোক না কি আউট-ল তা জেনে লাভটা কী?
বোধহয় তাদের
মনের কথা বুঝতে পেরেই খালু নিজেও একটু বিব্রত হয়ে পড়েন। বলেন-- না, তোমরা চিন্তা
করে দ্যাখো, ওরা
আইনের লোক হতেই পারে না। কারণ আইনের লোক হলে, কেউ দেখতে চাক আর না চাক, চোখের সামনে
ডান্ডি কার্ড একবার ঝুলিয়ে দেখানোর অভ্যেস থাকে। মানে কোনো কোনো মানুষের কাছে
নিজের চাইতে নিজের আইডেন্টিটি কার্ডের দাম বেশি।
বাদল কিছু বলতে
যায়। কিন্তু তার আগেই খালু আবার নিজের ট্র্যাকে ফিরে গেছেন-- তাছাড়া আইনের
লোক আসবে কেন বলো? খালেদ কি বিরোধী দল করে?
নাহ। কোনো
রাজনৈতিক দলই করে না। তার কোনো কোনো বন্ধু বরং সরকারি দলেরই বিভিন্ন গ্রুপের সাথে
জড়িত।
তাহলেই বোঝো।
সে এমনকি সরকারি দলের সাথেও নেই।
না নেই।
সরকারি দলের
সাথে থাকলে তো কোনো ঝামেলাই হতো না। তবে কথাটা তা নয়। কথাটা হচ্ছে সে বিরোধী দলের
লোক নয়। নেতা নয়, পাতি নেতা নয়, কর্মী নয়, এমনকি হাতা-নাতাও নয়।
না।
তাহলে তো মিটেই
গেল।
মানে?
মানে নিশ্চিত
হওয়া গেল যে তাকে পুলিশ, মানে আইনের লোকেরা ধরে নিয়ে যায়নি। আর ক্রসফায়ারের তো কথাই
আসে না।
ক্রসফায়ার!
শব্দটা শোনার
সাথে সাথে এই জ্যৈষ্ঠ মাসের গরম সকালেও প্রত্যেকের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে
যায়। ক্রসফায়ার মানে তো মৃত্যু। এতক্ষণ তারা তাদের বাড়ির ছোট ছেলেকে কে ধরে নিয়ে
গেছে, সে কখন
ফিরবে-- এসব
চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু সে যে মৃত্যুর মুখে চলে যেতে পারে এমনটি ভাবেনি
কেউ। খালুর মুখ থেকে ক্রসফায়ার শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে তাদের দুশ্চিন্তার
মাঝে নতুন যে আতঙ্কের ব্যঞ্জনা যোগ হয়, তার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে কেউই অনেকক্ষণ
ধরে কোনো শব্দই উচ্চারণ করতে পারে না। বাদলের মনে আরও অনেক বেশি তথ্য হাঁচোরপাঁচোর
করে। খালু জানে না, অথবা জানলেও ভুলে গেছেন, ক্রসফায়ারে সরকারি দলের লোককেও মারা হয়।
এই মফস্বল শহরেই মারা হয়েছে।
খালু সশব্দে
চুমুক দিয়ে চা শেষ করে বাবলুর দিকে তাকিয়ে বলেন-- চলো!
কোথায়?
থানায়।
তৈরি হওয়ার
জন্য বাদল নিজের ঘরের দিকে এগোয়।
মা বলে ওঠে-- আমিও যাব।
ফটক পেরিয়ে
থানার কম্পাউন্ডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বাদলের মনে পড়ে যে সে এই শহরের সব জায়গাতে
গেলেও এর আগে কোনোদিন থানাতে আসেনি। সে তাই ছোট ছেলের মতো নতুন জায়গায় যাওয়ার
কৌতূহল নিয়ে থানা কম্পাউন্ডের সবকিছু দেখার চেষ্টা করতে থাকে চোখ এবং মাথা ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে। খালু গেটেই সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছেন ওসি সাহেব কোন ঘরে বসেন।
তারা ওসির ঘরের
সামনে গিয়ে দেখে দরজার পাল্লা খোলা। ভেতরে বেশ পরিচ্ছন্ন সাজানো চেয়ার-টেবিল।
মাথার ওপরে একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে। কিন্তু কোনো মানুষ নেই। কিছুক্ষণ সেই ঘরের
দরজায় দাঁড়িয়ে তারা অপেক্ষা করে। কিন্তু কাউকে ঘরে ঢুকতে দেখা যায় না। এমনকি কেউ
তাদের কোনো প্রশ্নও করে না। তখন কী করা যায় ভঙ্গিতে তিনজন প্রায় গোল একটা সার্কেল
তৈরি করে দাঁড়ায় বারান্দায়।
বলুন আমি
আপনাদের জন্য কী করতে পারি!
বিশাল ধাক্কা
খায় তিনজনই। বিশেষ করে বাদল।
থানার
বারান্দায় এমন পরিশীলিত এবং মার্জিত উচ্চারণ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে সবাই। কোনো
মোবাইল ফোনের সেলস সেন্টারের মেয়েরাও তো এমন সুন্দর এবং আন্তরিক উচ্চারণে কথা বলে
না!
বাদলের পেছন
দিক থেকে এসেছে কথাটা। সে ফিরে তাকায়।
চমৎকার নিভাঁজ
পুলিশ-ড্রেস পরা একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে স্মিত হাসি। বড়খালু তড়বড় করে
বলেন-- আমরা ওসি
সাহেবের কাছে এসেছি।
আলতো মাথা
নাড়িয়ে যুবক বলে-- আসুন।
ওসি সাহেবের
ঘরে নিয়ে বসানো হয় তাদের। কিন্তু যুবক বসে না। বাদলের দিকে তাকিয়ে বলে-- ওসি সাহেব
জরুরি কাজে বাইরে গেছেন। আপনারা কি ততক্ষণ অপেক্ষা করবেন?
মৃদুকণ্ঠে
জিজ্ঞেস করে বাদল-- কতক্ষণ লাগবে উনার ফিরতে?
তা তো বলা যায়
না। পুলিশের কাজতো বোঝেনই। যে কাজে তিনি বেরিয়েছেন, সেটা শেষ হলো তো দেখা যাবে তাকে দৌড়াতে
হচ্ছে আরেক দিকে। তবে ভাগ্য ভালো থাকলে হয়তো আপনাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে
না। ভালো কথা, আপনারা
কি চা খাবেন?
তারা মাথা
নাড়ে। না, চা খাব
না।
তাহলে বলুন আমি
আপনাদের কী খেদমত করতে পারি। না কি ওসি সাহেব আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন?
তারা তিনজন
পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। কী বলবে বুঝতে পারে না। পুলিশ অফিসার নিজেই আবার বলে-- কী কাজে এসেছেন
তা কি আমাকে বলা যাবে?
হ্যাঁ হ্যাঁ
অবশ্যই। খালু এবার নিজের কথা খুঁজে পেয়েছেন। বলেন-- আমরা এসেছি একটা ডায়েরি করার জন্য।
কী বিষয়ে?
মা এতক্ষণে কথা
বলে-- আমার ছেলে
নিখোঁজ।
মানে?
মানে আমার
ছোটভাই। এবার বাদল বলে-- কাল রাত নয়টার দিকে কয়েকজন লোক তুলে নিয়ে গেছে তাকে।
তাহলে তো
নিখোঁজ নয়। অপহরণ। মাই গড! এই এলাকাতেও অপহরণ শুরু হয়ে গেছে! কারা করেছে কাজটা
বলতে পারেন? মানে
কোনো ধারণা আছে অপহরণকারীদের সম্পর্কে?
এবার একটু অস্বস্তির
সঙ্গে বলে বাদল-- আমরা
তাদের চিনি না। তবে...
বলুন!
অস্বস্তি
আরেকটু বেড়েছে বাদলের। বলে-- ওরা আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় বলেছে তারা না কি
আইনের লোক।
কাকে বলেছে?
আমার মা আর ছোট
ভাইয়ের স্ত্রী ছিল তখন উপস্থিত। তাদেরকে বলেছে।
পুলিশ অফিসার
সটান দাঁড়িয়ে গেছে একথা শুনে। মুখে চিন্তার রেখা।
কী নাম আপনার
ভাইয়ের?
খালেদ।
কী করেন তিনি?
ব্যবসা করে।
ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স পাস করে বিভিন্ন সংস্থায় চাকুরি করেছে কয়েক বছর। এখন
বছর চারেক হলো ব্যবসা করছে।
রাজনৈতিক কোনো
ইনভলভমেন্ট আছে?
আমাদের জানা
মতে নেই।
পুলিশ অফিসার
বলে-- আপনারা
একটু বসুন। আমি আসছি।
তারা তিনজন বসে
থাকে চুপচাপ। দেয়ালের রং দেখে, দেয়াল ঘড়ির পাশে একটা টিকটিকির ছুটাছুটি দেখে, ফ্যানের বাতাসে
ক্যালেন্ডারের পাতার একবার ফুলে ওঠা আরেকবার চুপসে যাওয়া দেখে, আর বারবার
দরজার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কখন আসবে সেই পুলিশ অফিসার।
অবশেষে ফিরে
আসে সে। এবার যখন কথা বলে, তাকে আগের মতো মার্জিত মনে হয় না। বলে-- আপনারা যদি
জিডি করাতে চান তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। ওসি সাহেব ফিরলে তার অনুমতি নিয়ে জিডি
করাতে পারবেন। ততক্ষণ আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে পাশের ঘরে। আর আমিও থাকতে পারছি না
আপনাদের সঙ্গে। আমাকে বেরুতে হবে।
ঐ খোঁজটা কি
পাওয়া গেল?
কীসের খোঁজ?
খালেদকে আইনের
লোক, মানে
পুলিশ ধরে এনেছে কি না?
একটু চিন্তা
করে পুলিশ অফিসার। এখন সে কথা বলছে মেপে মেপে। বলে-- পুলিশ আনেনি তাকে। এই নামে কোনো লোকের
রেকর্ড নেই আমাদের খাতায়। তাছাড়া কালরাতে আমাদের কোনো অপারেশন টিম ঐ এলাকায় যায়নি।
তাহলে!
বললামই তো।
বাদল এবার যোগ
করে-- আইনের লোক
বলতে তো পুলিশ ছাড়া আরও বিভিন্ন বাহিনী আছে।
তার দিকে
ত্যারছা চোখে তাকায় অফিসার-- তাদের কথা আমি বলতে পারব না। আপনারা বরং ঐ ঘরে মুন্সির কাছে
গিয়ে বসুন। আমি বেরুব।
আমাদের জিডি
করার ব্যাপারটা?
ওসি সাহেবের
পারমিশন লাগবে। মানে মতামত লাগবে। ব্যাপারটা সেনসিটিভ বুঝতেই পারছেন। আমাদের বা
আমাদের সহযোগী কোনো সংস্থার নাম ভাঙানো হয়েছে। এখন জিডি করার ব্যাপারে আমার পক্ষে
মতামত দেওয়া সম্ভব নয়।
পুলিশ অফিসার
বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করছে দেখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় বড়খালু। অসহায় পানিতে পড়া
গলায় বলে-- আমরা এখন
তাহলে কী করব অফিসার! আমাদের কোনো কিছু জানার উপায় নাই। আপনাদের সাহায্য না পেলে
আমরা যাব কোথায়?
একটু ইতস্তত
করে অফিসার বাদলের দিকে তাকায়-- আপনার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিন। দেখি কী করা যায়। আমি আমার
সোর্সে খোঁজখবরের চেষ্টা করব। কোনো সংবাদ পেলে জানাব আপনাকে।
কিন্তু কোনো
ফোন আসে না।
একদিন কাটে।
দুইদিন কাটে।
এক সপ্তাহ
কাটে।
পত্রিকার পাতায়
খবরও ছাপা হয় খালেদের নিখোঁজ হওয়ার।
তারপরেও এক
সপ্তাহ কেটে যায়।
রাতে বারোটার
পরে মোবাইল বন্ধ করে ঘুমানোর অভ্যেস বাদলের। কিন্তু ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর
থেকে আর অফ করে না সে। যদি কোনো খবর আসে!
কোত্থেকে আসবে
খবর?
হয়তো
অপহরণকারীরা যোগাযোগ করবে। যদি তারা সত্যিই অপহরণকারী হয়। তাহলে তো তাদের একমাত্র
উদ্দেশ্য হবে খালেদকে জিম্মি বানিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা।
কিন্তু যদি ওরা
খালেদকে মেরে ফেলে!
চিন্তাটা
আসামাত্রই নিজের ভেতরটা কেঁপে ওঠে থরথরিয়ে। সেই কাঁপুনি থামাতে সময় লাগে অনেকখানি।
মনে মনে আওড়ায়-- না
না মারবে কেন? মারলে
তো ওদের কোনো লাভ নেই। বাদল নিজেকে এই বলে নিশ্চিত করতে চায় যে ফোন আসবে। খালেদের
মুক্তির বিনিময়ে বা খালেদকে ছেড়ে দেবার বিনিময়ে টাকা চেয়ে ফোন আসবে। হয়তো সেই
টাকার পরিমাণটা হবে বিশাল। হয়তো এতই বিশাল হবে তা যে খালেদের ব্যবসার পুরো পুঁজি, সঞ্চয়, তাদের
পারিবারিক সঞ্চয়, এমনকি বাড়িঘর বিক্রি করলেও সেই পরিমাণ টাকা জোগাড় হবে না।
তবু ফোন তো আসুক! আসুক ফোন! টাকা চেয়ে হলেও ফোন আসুক। খালেদের মুক্তির বিনিময়ে
মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসুক! অন্তত এটুকু জানা যাক যে তার ভাই বেঁচে আছে। ফোন আসুক।
নিজের ভাবনাটা ঠোঁটে চলে আসে বাদলের। বিড়বিড় করে জপমন্ত্রের মতো বলতে থাকে-- ফোন আসুক! ফোন
আসুক!
আর ফোন আসে।
সে সবুজ ইয়েস
বাটনে চাপ দেয়। কানের কাছে নেয় মোবাইলকে। কিন্তু হ্যালো বলতে গিয়ে খেয়াল করে যে
তার স্বর ফুটছে না। তার বদলে চোখ থেকে নেমে এসেছে জলের ধারা। গলা পরিষ্কার করার
জন্য গলা খাঁকারি দেয় সে। তার গলা খাঁকারির শব্দ শুনেই ওপার থেকে কথা বলে ওঠে
বোধহয় কলকারী-- বাদল
সাহেব বলছেন?
হ্যাঁ। হ্যাঁ।
বাদল বলছি।
কাঁপা কাঁপা
গলায় বলে সে।
ওপার থেকে সেই
কণ্ঠ বলে-- আমি
সাব-ইনসপেক্টর শাজাহান বলছি।
কে? বুঝতে না পেরে
প্রশ্ন করে বাদল।
আমি
সাব-ইনসপেক্টর শাজাহান। চিনতে পারছেন না?
কোনো ভনিতা না
করেই উত্তর দেয় বাদল-- না তো!
ঐ যে থানায়
দেখা হলো সেদিন! মনে নেই? ওসি সাহেবের ঘরে। আপনার মা আর একজন মুরুব্বি সঙ্গে ছিলেন।
এতক্ষণে
স্মার্ট পুলিশ অফিসারটির কথা মনে পড়ে বাদলের। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হয় অমন স্মার্ট
একটা যুবকের নাম শাজাহান! তবে ভাবনাটা সরিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি বলে-- এবার মনে
পড়েছে। বলেন।
প্রত্যাশায়
কেঁপে ওঠে তার বুক এবং কণ্ঠও-- খালেদের, মানে আমার ভাইয়ের কোনো খবর পাওয়া গেছে ভাই!
ওপাশ থেকে
উত্তর দেবার আগে একটু যেন চিন্তা করে শাজাহান। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলে-- ঠিক নিশ্চিত
করে বলতে পারছি না। আপনি কি একটু আসতে পারবেন?
কোথায়? থানায়?
না। থানাতে নয়।
আপনাকে আসতে হবে দক্ষিণ বাইপাসের একেবারে শেষ মাথায়। যেটাকে যোগীর জঙ্গল বলে, সেই জায়গাতে।
চিনতে পারছেন তো জায়গাটা?
পরিষ্কার চিনতে
পারছে বাদল। তাদের ছোটবেলায় ঐ অঞ্চল ছিল সত্যিকারেরই জঙ্গল। দিনের বেলাতেও মানুষ
সাহস পেত না একা যেতে। এখন জঙ্গল না থাকলেও মানুষ যেতে চায় না সহজে। কারণ ঐ জায়গা
নাকি ফেনসিডিলের গুদাম। আর ইন্ডিয়ান মালের বড় স্মাগলারদের আখড়া। বছর বছর ডাক হয়
যোগীর জঙ্গলের। বড় বড় গডফাদাররা ইজারা নেয় ঐ জঙ্গল। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ
অলিখিতভাবে নিষেধ। ওখানে কী করছে খালেদ!
মোবাইলের
ওপ্রান্ত থেকে আবার শোনা যায় শাজাহানের কণ্ঠ-- আপনি কি নিজে আসতে পারবেন? নাকি আমি পুলিশ
পিকআপ পাঠাব?
কিছু না ভেবেই
বাদল বলে-- না পারব।
গাড়ি পাঠাতে হবে না। কোথায় যেতে হবে আমাকে? মানে ঠিক কোথায় আছেন আপনি?
বাইপাশের মাথায়
চলে আসুন। এলেই আমাদের পেয়ে যাবেন।
বউ তো আগেই
জেগে গিয়েছিল মোবাইলের রিং শুনে। বাতি জ্বালিয়ে বাদলকে কাপড় পরতে দেখে উঠে বসে
বিছানায়-- কী হয়েছে? কে ফোন করেছিল? কোথায় যাবে
তুমি এত রাত্তিরে?
কাপড় পরতে
পরতেই উত্তর দেয় বাদল-- পুলিশের একজন অফিসার। থানায় দেখা হয়েছিল। সে ফোন করে আমাকে
যেতে বলেছে যোগীর জঙ্গল এলাকাতে।
খালেদের খোঁজ
পাওয়া গেছে?
ঠিক নিশ্চিত
করে বলেনি। বোধহয় কোনো খবর আছে।
তুমি এত রাতে
ওখানে একা একা যাবে?
যেতে হবে। আর
তো কেউ নেই যাকে সঙ্গে নেওয়া যায়।
চুপ করে
কিছুক্ষণ ভাবে বউ। তারপর বলে-- তোমার বন্ধুদের কাউকে সঙ্গে ডেকে নাও না!
পাগল। এত রাতে
কাউকে ডাকা যায়? সবাই
ঘুমাচ্ছে।
যুগপৎ উষ্মা
এবং খোঁচা প্রকাশ পায় এবার বউয়ের কথায়-- যদি বিপদের সময় ডাকাই না যায়, যদি পাশে না-ই
পাওয়া যায়, তাহলে
আর বন্ধু কীসের!
তার বন্ধুদের
যে বউ খুব একটা পছন্দ করে না বা পাত্তা দেয় না, জানে বাদল। অন্য সময় হলে বউকে এই খোঁচার
উত্তর দিত সে। কিন্তু এখন নিঃশব্দে হজম করে। কাপড় পরা শেষ হলে বলে-- এসো। গেটটা
লাগিয়ে দাও।
ঘর থেকে
প্যাসেজে বেরিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয় তাকে। মা দাঁড়িয়ে আছে। একটু থতমত খেয়ে বাদল
প্রশ্ন করে-- এখনও
ঘুমাননি মা?
মা তার
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাদের শুনতে পাওয়ার মতো বিড়বিড় করে বলে-- এক ছেলেকে একলা
যেতে দিয়ে যে ভুল করেছি, আরেক ছেলেকে একলা যেতে দেব না। আমিও সঙ্গে যাব।
বিরক্ত হওয়ার
কথা। কিন্তু উল্টা যেন একটু আশ্বস্তই হয় বাদল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে-- চলেন।
বাইরে বেরিয়েই
বুঝতে পারে, পুলিশের
গাড়িতে করে যাওয়াই ভালো ছিল। রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই। কোনো লোক পর্যন্ত নেই।
রাতে রিক্সা চালায় যে নাইট প্যাডেলাররা তারা বোধহয় নাইট কোচের যাত্রীদের নামিয়ে
দিয়ে চলে গেছে। হয়তো স্টেশনে গেলে তাদের পাওয়া যাবে। সীমান্ত এক্সপ্রেসের যাত্রী
ধরার জন্য সেখানে থাকে কয়েকটা রিক্সা। আর শহরের বাকি কয়জন নাইট রিক্সা প্যাডেলার
মূলত আনা-নেওয়া করে শহরের পাতিনেতা-ক্যাডারদের বাংলামদ আর রক্ষিতাদের।
এখন কী করা
যায়!
এখান থেকে
হেঁটে বাইপাসের যোগীর জঙ্গলে পৌঁছাতে সময় লাগবে অনেক। তার ওপর সঙ্গে মা থাকায় জোরে
হাঁটাও যাবে না। বন্ধুদের মোবাইলে ডেকে তুলে লাভ নেই। এমদাদ ভাইয়ের একটা মোটর
সাইকেল আছে বটে, তাতে
তো আর মাকে তোলা যাবে না। একবার মনে হয় সাব-ইনসপেক্টর শাজাহানকেই আবার ফোন করে
পিকআপ ভ্যান পাঠানোর জন্য অনুরোধ করবে নাকি?
এদিকে মা তার
জন্য অপেক্ষায় না থেকে হাঁটতে শুরু করেছে। অর্থাৎ বাহনের অসুবিধার কথা বলে বাড়িতে
ফেরত পাঠানোর কোনো অবকাশও তাকে দিচ্ছে না।
বাধ্য হয়ে সে
যখন মনে মনে সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলে যে পুলিশ অফিসারকে ফোন করবে, ঠিক সেই সময়
ঠুন ঠুন শব্দ করতে করতে তাদের সামনে আসতে থাকে একটা ভ্যানরিক্সা। মাল টানে এরা। এত
রাতে হয়তো কোনো সাহা মহাজনের গুদামে মাল তুলে দিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। সে ডাকলেও
ভ্যানঅলা যেতে রাজি হবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। বরং না যেতে চাওয়ার সম্ভাবনাই
বেশি। তবু সে হাত তুলতে যায়। কিন্তু তার আগেই তাদের সামনে এসে ব্রেক কষে দাঁড়ায়
ভ্যানচালক। বলে-- এত
রাতে কই যান মা-বেটা?
সে কীভাবে জানল
তারা মা ও ছেলে?
চোখ তীক্ষণ করে
ভ্যানঅলার দিকে তাকায় বাদল। নাহ, আদৌ চেনা মনে হচ্ছে না। এমনকি একই ছোট মফস্বল শহরের
বাসিন্দা হলেও তাকে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না বাদলের।
ভ্যান থেকে
নেমে ততক্ষণে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা। নাকটা একটু ফুলে ওঠে বাদলের। লোকটার
গা থেকে রাতের গন্ধ ছিটকে বেরুচ্ছে। রাতের গন্ধ! কথাটা মনে পড়াতে নিজেই একটু অবাক
হয় বাদল। রাতের আলাদা কোনো গন্ধ আছে বলে কোনোদিন তো মনে হয়নি তার। কিন্তু আজ এই
ভ্যানঅলার পাশে দাঁড়িয়ে সে নিশ্চিতভাবেই অনুভব করে যে রাতের একটা আলাদা গন্ধ আছে।
নিয়মিত রাতচরা লোক যারা, কেবল তাদের শরীর থেকই বের হয় গন্ধটা। রাতের রিক্সাঅলা, পাহারাদার, বেশ্যাদের শরীর
শুঁকলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে এই একই গন্ধ। একটা আবিষ্কারের উত্তেজনা, সামান্য হলেও
ভর করে বাদলের মনের ওপর।
ভ্যানঅলা আর
কোনো প্রশ্ন না করেই তাদের উদ্দেশ্য করে বলে-- উঠেন।
এবার লোকটাকে
দেবদূত-প্রেরিত কোনো বাহনের চালক বলে মনে হয় বাদলের। সে মাকে ধরে ওঠায় ভ্যানের
সামনের বামদিকে। তারপর নিজে উঠতে উঠতে বলে-- বাইপাসে যোগীর জঙ্গলের কাছে যাব।
প্যাডেল ঘোরাতে
শুরু করেছে চালক।
মায়ের ঠোঁট
নড়ছে অবিরাম। দোয়া ইউনুস পাঠ চলছে সেই রাত থেকে। এই দোয়া একলক্ষ বার পড়লে নাকি
কবরে বাস করা লাশেরও বিপদ কেটে যায়। মা তো ইতিমধ্যে লক্ষাধিকবার নিশ্চয়ই পড়ে
ফেলেছে দোয়াটি। দুই বউকেও পড়তে তাগাদা দিয়েছে অবিরাম। তারা দুজনে মিলে নিশ্চয়ই আরও
একলক্ষ বার পাঠ করেছে দোয়াটি। হাদিসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুশকিল আসানের
প্রত্যাশা এখন করতেই পারে তারা। সেই কারণেই বোধহয় প্রায় অলৌকিকভাবে এই ভ্যানঅলাকে
পেয়ে যাওয়া, স্বতঃপ্রণোদিত
হয়ে ভ্যানঅলার তাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া। সে ভ্যানঅলার দিকে মনোযোগ দেয়। তার পেশল পিঠ
দেখা যায়, যেহেতু
খালিগায়ে রয়েছে ভ্যানঅলা। প্যাডেল ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে এদিক-ওদিক একটু একটু
আঁকাবাঁকা হচ্ছে ভ্যানঅলার শরীর। আর তার ফলে তার পিঠের পেশিগুলো এমন সুন্দর একটা
পৌরুষ-ছন্দে কিলবিল করে উঠছে যে তা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় বাদল। এবার সামনের দিকে মুখ
তুলে নিজের শহরকে দেখতে থাকে সে। তখন
আবিষ্কার করে, নিজের
শহর যে রাতের বেলা এতটা আলাদা-অচেনা মনে হতে পারে, আগে তার জানা ছিল না। সে ভ্যানের ওপর বসে
থেকে একহাতে কাঠের রেলিংটা চেপে ধরে রাতের শহরকে দেখতে থাকে, আর চেনার
চেষ্টা করতে থাকে। রাস্তার দুইপাশের সাইনবোর্ডগুলো দেখতে দেখতে মনে হয়, এই রাস্তা দিয়ে
প্রত্যেকদিন অনেকবার করে চলাচল করলেও কোনো সাইনবোর্ডই তার ভালো করে পড়া হয়নি। পড়ার
প্রয়োজনই বোধ করেনি সে। কেউই বোধহয় করে না। শুধু যে কয়টা দোকান বা জায়গা চেনার
প্রয়োজন, সেই কয়টার
ল্যান্ডমার্ক মনে গেঁথে রেখে বাদবাকি পুরো জনপদের কাছে অচেনা থেকেই বোধহয় তার মতো
বেশিরভাগ মানুষ জীবন কাটিয়ে দেয়। দিনের বেলায় মানুষের ভিড়ে বোধহয় সবগুলো
ঘর-দোকান-স্থাপনা আরও বেশি গায়ে গা লাগানো মনে হয়। সেই কারণেই সবগুলি ঘর, সবগুলি দোকান, সবগুলি
স্থাপনার যে আলাদা আলাদা চেহারা আছে তা মনেই পড়ে না কারও। রাতের বেলা সবাই আলাদা
আলাদা বিশিষ্টতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলেই বোধহয় তাদেরকে অচেনা মনে হচ্ছে। এমন তো
নয় যে রাত বারোটার পরে, শহর জনশূন্য হয়ে পড়লে বাদল কোনোদিন পথ হাঁটেনি। কিন্তু তখন
এমন মনে হয়নি।
ভ্যান বড় একটা
ঝাঁকি খেলে সে সচকিত হয়। ভ্যানঅলা বলে-- শালার সব ইস্কুলের সামনেত একখান করে
কব্বরের সমান উঁচা ব্যারিকেড খাড়া করিছে। গাড়ি চালায়া সুখ নাই। সাবধানে শরীর চাপায়
বসেন। নাহলে আছাড় খাওয়া লাগবি।
বাদল আলোজ্বলা
সাইনবোর্ড দেখে ঠাহর করতে পারে তারা এখন গার্লস স্কুলের সামনে। স্কুলের গেটের
সামনের রাস্তায় স্পিডব্রেকার। যাকে কব্বর বলছে ভ্যানঅলা। সাইনবোর্ড না পড়লে সে
বোধহয় স্কুলটাকেও ঠিকমতো চিনতে পারত না। অথচ এই স্কুলের সামনের জলনিকাশী
কালভার্টের পাড়ে বসেই কত সন্ধ্যা তাদের আড্ডা দিয়ে কেটেছে। বাদলের মনে পড়ে, বন্ধুদের সাথে
সে প্রথম গাঁজায় দম দিয়েছিল এই কালভার্টের পাড়ে বসেই কোনো এক পড়ন্ত শীতের
সন্ধ্যায়। সেই জ্বলন্ত স্মৃতির জায়গাও তার কাছে অচেনা মনে হচ্ছে! সে কি শুধু রাতের
জন্য? না কি
আজকের বিশেষ রাতে বিশেষ মানসিক অবস্থার জন্য?
নিজেকে যুক্তির
আয়ত্তে নিয়ে আসার চেষ্টা করে বাদল। বুঝতে পারে, ভাইকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় সে স্বাভাবিক দিক-বিদিক ঠিক
রাখতে পারছে না। মনের এই রকম ভগ্নদশা মোটেই কাম্য নয়। তাকে বরং এখন আরও বেশি
মানসিক শক্তি ধারণ করতে হবে। কার্যকারণের সূত্রকে বেশি করে আঁকড়ে ধরতে হবে। না হলে
খালেদের সন্ধানও পাওয়া যাবে না, নিজের মানসিক বৈকল্যও ঘটে যাবে। তাহলে তাদের এত দিনের এত
পরিশ্রমের তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। সে নিজেকে বাস্তবের মাটিতে আর সচেতনার জগতে নামিয়ে আনতে
যায়।
ঠিক সেই সময়েই
ভ্যানঅলা ব্রেক কষে। মুখে বলে-- আইসা পড়িছি ভাইজান। কুন জাগাত নামবেন?
বাদল তখন কথা
না বলে গলা লম্বা করে পুলিশের পিকআপ খোঁজে। রাস্তার পাশেই তো ওটা দাঁড়িয়ে থাকার
কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। সে তখন মোবাইল বের করে পকেট থেকে। সাব-ইনসপেক্টর
শাজাহানকেই ফোন করে জেনে নেওয়া হোক।
তখন দেখা যায়
এগিয়ে আসছে পুলিশের পোশাক পরা একজন লোক। কাঠামো দেখে দূর থেকেই বাদল বুঝতে পারে এ
লোক শাজাহান নয়। অনেক বেশি পৃথুল আর দোহারা লোকটা। হয়তো কোনো সেপাই হবে। ভ্যান
থেকে নেমে মাকে পাশে নিয়ে পুলিশটার এগিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করে বাদল।
ওজনদার হলেও
লোকটা হেঁটে আসে বেশ জোরে। কাছে এসে তাকায় মা-ছেলের দিকে। সম্ভবত মাকে সঙ্গে দেখে
বিভ্রান্ত হয়েছে। অফিসার শাজাহানকে তো বলা হয়নি সে মাকে সঙ্গে নিয়ে আসছে। পুলিশ
তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর গলা বাড়িয়ে রাস্তার এদিক-ওদিক তাকায়। অন্য কোনো লোক
না দেখে বাদলকে জিজ্ঞেস করে-- আপনারাই তো মীরবাড়ি থেকে আইছেন?
জ্বী। শাজাহান
সাহেব আসতে বলেছেন। উনি কোথায়?
প্রশ্নের উত্তর
না দিয়ে পুলিশটা বলে-- আসেন আমার সাথে।
জায়গা থেকে না
নড়ে আবার প্রশ্ন করে বাদল-- উনি কোথায়?
পুলিশটা একবার
করে তাকায় মা আর তার মুখের দিকে সোজাসুজি। অল্প আলোতেই বোধহয় পাঠ করে নিতে চায়
বাদলদের মুখের ভূগোল। আস্তে আস্তে বলে-- স্যার আমাক পাঠাইছে আপনাদের রাস্তা
চিনায়া আগায়া নিতে। তানি আছে লাশের কাছে। চলেন। ডেডবডির কাছে যাই।
শব্দটা
শোনামাত্র নিজেও টলে উঠেছিল বাদল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে চট করে মায়ের পাশে চলে
যায়। মায়ের প্রতিক্রিয়া কী হবে জানে না। তাই অন্তত সতর্কতার জন্য তাকে মায়ের পাশে
দাঁড়াতে হয়।
এই ম্লান
আলোতেও দেখা যাচ্ছে মায়ের মুখ ব্লটিং পেপারের মতো সাদা শুকনো হয়ে গেছে। বাদল একহাত
দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। থরথর করে কাঁপছে সে নিজেও। তার শরীরের সাথে যোগ হয় মায়ের
কাঁপুনিও। তবে বাদলের আগেই মা সামলে নিতে পারে নিজেকে। তার শরীর থেকে নিজেকে সরিয়ে
নিয়ে একটা হাত চেপে ধরে। একেবারে স্পষ্ট কিন্তু অনুচ্চ স্বরে বলে-- চল!
বাদল আরও একবার
অনুভব করে সমাজ-সংসারের সব বিষ হজম করার ক্ষেত্রে মায়েরাই সবচেয়ে আগে আগে প্রস্তুত
হয়ে যায়। সংসারের সকল ঝড়ে সবার আগে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারে মায়েরাই। মায়ের মোলায়েম
মুঠি বেশ শক্ত করে চেপে ধরে বাদলের হাত। কিঞ্চিৎ চাপ দিয়ে বলে আবার-- চল!
পুলিশের পিঠ
এবং পা দুটোকেই কেবল অনুসরণ করতে থাকে তারা। পরিপার্শ্বের অন্য সবকিছুই অদৃশ্য হয়ে
গেছে বাদলের চোখের সামনে থেকে। তাই তারা বাইপাস রোড থেকে নেমে কোনদিকে যাচ্ছে
কিছুই মনে করতে পারে না। মনে করার প্রয়োজনও বোধ করে না।
হাঁটতে হাঁটতে
একসময় মানুষের সাড়াশব্দের মধ্যে এসে পৌঁছায় তারা।
সাব-ইনসপেক্টর
শাজাহান সামনে এসে দাঁড়ায়। এত রাত, এত ম্লান আলো, এত বিষাদের
মধ্যেও তাকে দেখতে সেই সকালের মতোই স্মার্ট ঝকঝকে। বাদলের সঙ্গে মাকে দেখেও ভাবান্তর
হয় না কোনো। বলে-- আসুন। অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হলো আপনাদের। কিন্তু কী করব
বলুন। সুরতহাল কমপি¬ট না হওয়া পর্যন্ত আমরা ডেড... মানে ভিকটিমকে সরিয়ে নিতে
পারি না। আসুন।
তাদের নিয়ে
একটা গর্তমতো নিচুজমির দিকে এগুতে এগুতে সে বলে-- সরি! আমরা রিয়েলি সরি! কিন্তু কী করব
বলুন! আমরা যতই সক্রিয় থাকি না কেন, কিছু না কিছু ঘটনা ঘটেই যায়। অপরাধকর্মও
বোধহয় প্রকৃতির মতোই অবশ্যম্ভাবী। এই যে এসে পড়েছি। এই গর্তটার মধ্যেই আছে ডেডবডি।
এখানে অনেক
আলো। টর্চের আলো, চার্জার বাতির আলো। সেই আলোর দিকে মুখ ফেরাতে গেলে হঠাৎ
মায়ের তীক্ষণ কণ্ঠস্বরে খান খান হয়ে যায় গুমোট-- তাকাস না বাদল!
খবরদার তাকাবি না লাশের দিকে! দেখতে চাই না আমরা। চল, ফিরে চল!
বাদল একটু নয়, অনেকখানিই
চমকায়। এই সময়ে এসে কী বলছে মা! সে মায়ের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখে মা ফেরার পথ ধরে
হাঁটতে শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাদল নিজেই যেন বুঝে ফেলে মায়ের ইচ্ছাটার কারণ।
সে-ও লাশের দিকে দৃকপাত না করে মায়ের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করে।
লাশ দেখতে চায়
না তারা কেউ। তার চেয়ে অপেক্ষা করবে। মা দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে অপেক্ষা করবে। বাদল
মোবাইল অফ না করে অপেক্ষা করবে।
গুম-খুনের দিনকাল শেষ হলে
একদিন তো খালেদ ফিরে আসলেও আসতে পারে!
0 মন্তব্যসমূহ