সৈকত আরেফিন
তখনও ‘বৃক্ষ
সবাইকে ছায়া দেয়, এমনকি কাঠুরেকেও’-জাতীয় ঔদার্য ফিলোসফি আমরা শিখি নি। এমন দয়াশীল বৃক্ষ বা গাছপালা সম্পর্কে
আমাদের ধারণা তখন গুটিকয়েক পত্রপল্লবে। বনেবাদারে ঘুরেফিরে গাছপালার সঙ্গে আমাদের বন্ধুতা যখন
পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে, আমাদের
কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে
বিনামূল্যে পাওয়া পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান বইয়ে প্রথম গাছের সংজ্ঞা দেখে আমাদের
হাসি পায়। গাছের আবার সংজ্ঞা!
গাছ হলো গাছ, এই যে সবুজ পাতা, ডালপালায় ছায়াময়, ফুল হয়, ফল ধরে! শিখি, বৃক্ষ বা গাছের আরেক নাম উদ্ভিদ। বিজ্ঞান বইয়ে লেখা থাকে উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এবং আরও জানতে পারি, উপযুক্ত পরিবেশে বীজ থেকে অঙ্কুর উদ্গত হয়ে মাটির উপর লম্বভাবে দণ্ডায়মান হলে সেই গাছগুলোকে উদ্ভিদ বলা যায়। প্রকারভেদ সম্পর্কে বলা হয় উদ্ভিদ প্রধানত তিন প্রকারের; তখন পত্র ও কাণ্ড বিষয়ে আমরা প্রথম সচেতন হই এবং সূর্যালোকও যে উদ্ভিদের বেঁচে থাকবার জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় তা জেনে আমাদের খুব আনন্দ হয়। তখন রোদ ও ধুলির সঙ্গে সখ্যতা বেশি থাকে বলে সে আনন্দ একেবারে প্রাণের গভীর থেকে উঠে আসে। গুল্ম ও লতা বিষয়েও কিছু জ্ঞান হলে আমাদের ধারণা হয়, বৃক্ষ মূলত অনেক বড় ব্যাপার, তারচে’ গুল্ম ও লতার সঙ্গেই আমাদের বেশি ঘনিষ্টতা হবে; কেননা গুল্মের শরীরী দুর্বলতা ও লতার জড়িয়ে ধরা বৈশিষ্ট্য আমাদেরই স্বগোত্রীয়। তখন ছায়ার নির্বিশেষ তত্ত্ব আমাদের জানা থাকে না, কিন্তু এটা জেনেছিলাম, বৃক্ষ প্রথমত চলাফেরা করতে পারে না; যেহেতু তার হাত ও পা নেই। ফলে বৃক্ষের ভাগ্যে অচল জীবন অনিবার্যই ছিল এবং ছায়া সম্পর্কে বিজ্ঞানের পদার্থবিষয়ক ব্যাখ্যা জানার আগেই আমরা বুঝেছিলাম পাতা, ফুল, কাণ্ড ও ডালপালার কারণে গাছের ছায়া পড়েই। কারণ একদিন এবং অনেকদিন খররোদের ভেতর আমাদের ছায়াও পড়তে দেখেছিলাম। তাই বৃক্ষ এমনকি কাঠুরেকেও ছায়া দেয়—এই ফিলোজফি আপাত তুচ্ছ করবার মতোই। তবু নিতান্ত আপ্ত বাক্যটি জানার পর আমাদের অন্তর্লীন জগতে কী কী রিএ্যাকশন হতে পারে বলে অনুমান করা যেতে পারতো বা একেবারেই রিএ্যাকশন না হবার কথা ভাবা যেত; কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বরং রিএ্যাকশনের মাত্রাটা অনুমানের চেয়ে বেশি অনুভূত হয়। আমরা একধরনের অস্থিরতা তখন আর আক্ষরিক অর্থেই আর মনের মধ্যে চাঁপা দিয়ে রাখতে পারি না; হয়তো এই অস্থিরতা বুদবুদ হয়ে চোখে ফুটে ওঠে বা মুখের ভূগোলে একটা গুমোট আবহাওয়া তখন সতত বিরাজমান হয়; এই অবস্থায় আমাদের ঘনিষ্ট এক দুজন যেমন — মামা-ভাগ্নে হেয়ার কাটিংয়ের বিষ্ণুপদ শীল বা জননী রাইচ এজেন্সির গোলাম মোস্তফার চোখে ঠিকই আমাদের অন্তর্গত বিলোড়ন ধরা পড়ে; তারা আমাদের অস্থিরতা দেখে উদ্বিগ্ন হয় বা সেটা তাদের উদ্বেগ নয়, বরং তখন তাদের মনে হয়—আমরা ক্ষুধার্ত বা আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব মেয়েদের কথা তারা জানে, তাদের সঙ্গে আমাদের মনোমালিন্যের আভাস পায়— ‘কি হইছে কন তো, মন খারাপ কইরেন না তো’—বলে মামা-ভাগ্নে হেয়ার কাটিংয়ের বিষ্ণুপদ শীল আমাদের নজরুল ইসলামের গান— ‘নীলাম্বরী শাড়ী পড়ে নীল জোছনায়/ কে যায় কে যায়, বা অন্য কোন ভাবের গান, নচিকেতার বা হাবীবের বা ‘উড়ালপঙ্খী রে/ যা যা তুই উড়াল দিয়া যা’—শুনিয়ে দেয়, অথবা গোলাম মোস্তফা জননী রাইস এজেন্সির সামনে চেয়ার পেতে বসতে বলে রানাকে ডাক দেয়— ‘রানা চার কাপ চা, একটা বিষ চা, একটা দুধ আর দুইটা লাল।’ একটু পরে রানা ঠিকই চিনি-পানি ছাড়া একটা বিষ চা, একটা দুধ চা আর দুই কাপ লাল চা এনে হাজির করে। কিন্তু সত্যিই আমাদের মন অস্থির থাকে, চা-ও শরীর, মন চাঙা করতে পারে না। তখন, রোদপিঠে, ধুলো মেখে বা মেঘ ও বৃষ্টির যূথবদ্ধতায় রিকশার হুড ফেলে আমরা পার্ক মোড় থেকে কলেজ রোডে যাই; বিপণিগুলোতে ললনারা কেনাকাটা করতে আসে, আমরাও এ দোকান ও দোকান যাই, সেলসম্যানকে এটাসেটা বের করতে বলে বস্ত্র বা দ্রব্যাদির চেয়ে ললনাদের চোখ, মুখ, শরীর দেখতে আগ্রহী হই, সুন্দর মেয়েরা এ দোকান থেকে ও দোকান ঘুরে বেড়ায়, তাদের সঙ্গে আমরাও ঘুরতে থাকি। এটাসেটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে সেলসম্যানকে বলি—কী সব আনেন আপনারা, সব দুই নম্বর রদ্দি মাল, রাইখা দ্যান; তখন বস্ত্র বা দ্রব্যাদি রেখে দিয়ে সেলসম্যান আমাদের দিকে কড়া বা অবজ্ঞার চোখে তাকায়; এই চোখরাঙানি বা অবজ্ঞা উপেক্ষা করে আমরা ভিড়ে মিশে যাই। ভিড়ের মধ্যে পরিচিত কেউ, ফজলু, মাসুদ বা সালাউদ্দিন ভাই আমাদের নাম ধরে ডাক দেয় বা হঠাৎ-ই এসে কাঁধে হাত রাখে। একপাশে সরে গিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে কিছু গল্পগুজব করি, একটা চা বা সিগারেট খাই, তারা ভদ্রতা করে আমাদের বাসায় বা অফিসে আসতে বলে; বলে যে—আসো না একদিন বাসায় বা অফিসে, চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে। এভাবে, দোকানে, পথে-ঘাটে দুপুর গড়িয়ে যেতে যেতে হয়তো আমাদের অস্থিরতা কিছুটা কমে। কিন্তু, মানুষ এমনকি বৃক্ষের মতও উদার নয়, এই ভাবনা আমাদের ছেড়ে যায় না। কলেজ রোড থেকে এলাহি মার্কেট পর্যন্ত রিকশায় এসে হাসপাতালের পিছন দিয়ে হেঁটে স্কাইলার্ক স্কুলে যাই। স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা টিফিন পিরিয়ডে উল্লাস ও প্রমোদে মাতে; ফুলের মত সেইসব বাচ্চাদের দেখে, ভবিষ্যতে একটা শিশুর অবয়ব আমাদের চোখের পাতায়ও স্বপ্ন এঁকে যায়। স্কুলের অফিসঘরে প্রধান শিক্ষক আলাউল হোসেনের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে আমরা আবারও চা টা খাই, নতুন কোন ম্যাডাম বা শিক্ষক আসে, তাদের সঙ্গে পরিচিত হই। এভাবে ঘুরেফিরে বিকেল নেমে আসে।
গাছ হলো গাছ, এই যে সবুজ পাতা, ডালপালায় ছায়াময়, ফুল হয়, ফল ধরে! শিখি, বৃক্ষ বা গাছের আরেক নাম উদ্ভিদ। বিজ্ঞান বইয়ে লেখা থাকে উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এবং আরও জানতে পারি, উপযুক্ত পরিবেশে বীজ থেকে অঙ্কুর উদ্গত হয়ে মাটির উপর লম্বভাবে দণ্ডায়মান হলে সেই গাছগুলোকে উদ্ভিদ বলা যায়। প্রকারভেদ সম্পর্কে বলা হয় উদ্ভিদ প্রধানত তিন প্রকারের; তখন পত্র ও কাণ্ড বিষয়ে আমরা প্রথম সচেতন হই এবং সূর্যালোকও যে উদ্ভিদের বেঁচে থাকবার জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় তা জেনে আমাদের খুব আনন্দ হয়। তখন রোদ ও ধুলির সঙ্গে সখ্যতা বেশি থাকে বলে সে আনন্দ একেবারে প্রাণের গভীর থেকে উঠে আসে। গুল্ম ও লতা বিষয়েও কিছু জ্ঞান হলে আমাদের ধারণা হয়, বৃক্ষ মূলত অনেক বড় ব্যাপার, তারচে’ গুল্ম ও লতার সঙ্গেই আমাদের বেশি ঘনিষ্টতা হবে; কেননা গুল্মের শরীরী দুর্বলতা ও লতার জড়িয়ে ধরা বৈশিষ্ট্য আমাদেরই স্বগোত্রীয়। তখন ছায়ার নির্বিশেষ তত্ত্ব আমাদের জানা থাকে না, কিন্তু এটা জেনেছিলাম, বৃক্ষ প্রথমত চলাফেরা করতে পারে না; যেহেতু তার হাত ও পা নেই। ফলে বৃক্ষের ভাগ্যে অচল জীবন অনিবার্যই ছিল এবং ছায়া সম্পর্কে বিজ্ঞানের পদার্থবিষয়ক ব্যাখ্যা জানার আগেই আমরা বুঝেছিলাম পাতা, ফুল, কাণ্ড ও ডালপালার কারণে গাছের ছায়া পড়েই। কারণ একদিন এবং অনেকদিন খররোদের ভেতর আমাদের ছায়াও পড়তে দেখেছিলাম। তাই বৃক্ষ এমনকি কাঠুরেকেও ছায়া দেয়—এই ফিলোজফি আপাত তুচ্ছ করবার মতোই। তবু নিতান্ত আপ্ত বাক্যটি জানার পর আমাদের অন্তর্লীন জগতে কী কী রিএ্যাকশন হতে পারে বলে অনুমান করা যেতে পারতো বা একেবারেই রিএ্যাকশন না হবার কথা ভাবা যেত; কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বরং রিএ্যাকশনের মাত্রাটা অনুমানের চেয়ে বেশি অনুভূত হয়। আমরা একধরনের অস্থিরতা তখন আর আক্ষরিক অর্থেই আর মনের মধ্যে চাঁপা দিয়ে রাখতে পারি না; হয়তো এই অস্থিরতা বুদবুদ হয়ে চোখে ফুটে ওঠে বা মুখের ভূগোলে একটা গুমোট আবহাওয়া তখন সতত বিরাজমান হয়; এই অবস্থায় আমাদের ঘনিষ্ট এক দুজন যেমন — মামা-ভাগ্নে হেয়ার কাটিংয়ের বিষ্ণুপদ শীল বা জননী রাইচ এজেন্সির গোলাম মোস্তফার চোখে ঠিকই আমাদের অন্তর্গত বিলোড়ন ধরা পড়ে; তারা আমাদের অস্থিরতা দেখে উদ্বিগ্ন হয় বা সেটা তাদের উদ্বেগ নয়, বরং তখন তাদের মনে হয়—আমরা ক্ষুধার্ত বা আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব মেয়েদের কথা তারা জানে, তাদের সঙ্গে আমাদের মনোমালিন্যের আভাস পায়— ‘কি হইছে কন তো, মন খারাপ কইরেন না তো’—বলে মামা-ভাগ্নে হেয়ার কাটিংয়ের বিষ্ণুপদ শীল আমাদের নজরুল ইসলামের গান— ‘নীলাম্বরী শাড়ী পড়ে নীল জোছনায়/ কে যায় কে যায়, বা অন্য কোন ভাবের গান, নচিকেতার বা হাবীবের বা ‘উড়ালপঙ্খী রে/ যা যা তুই উড়াল দিয়া যা’—শুনিয়ে দেয়, অথবা গোলাম মোস্তফা জননী রাইস এজেন্সির সামনে চেয়ার পেতে বসতে বলে রানাকে ডাক দেয়— ‘রানা চার কাপ চা, একটা বিষ চা, একটা দুধ আর দুইটা লাল।’ একটু পরে রানা ঠিকই চিনি-পানি ছাড়া একটা বিষ চা, একটা দুধ চা আর দুই কাপ লাল চা এনে হাজির করে। কিন্তু সত্যিই আমাদের মন অস্থির থাকে, চা-ও শরীর, মন চাঙা করতে পারে না। তখন, রোদপিঠে, ধুলো মেখে বা মেঘ ও বৃষ্টির যূথবদ্ধতায় রিকশার হুড ফেলে আমরা পার্ক মোড় থেকে কলেজ রোডে যাই; বিপণিগুলোতে ললনারা কেনাকাটা করতে আসে, আমরাও এ দোকান ও দোকান যাই, সেলসম্যানকে এটাসেটা বের করতে বলে বস্ত্র বা দ্রব্যাদির চেয়ে ললনাদের চোখ, মুখ, শরীর দেখতে আগ্রহী হই, সুন্দর মেয়েরা এ দোকান থেকে ও দোকান ঘুরে বেড়ায়, তাদের সঙ্গে আমরাও ঘুরতে থাকি। এটাসেটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে সেলসম্যানকে বলি—কী সব আনেন আপনারা, সব দুই নম্বর রদ্দি মাল, রাইখা দ্যান; তখন বস্ত্র বা দ্রব্যাদি রেখে দিয়ে সেলসম্যান আমাদের দিকে কড়া বা অবজ্ঞার চোখে তাকায়; এই চোখরাঙানি বা অবজ্ঞা উপেক্ষা করে আমরা ভিড়ে মিশে যাই। ভিড়ের মধ্যে পরিচিত কেউ, ফজলু, মাসুদ বা সালাউদ্দিন ভাই আমাদের নাম ধরে ডাক দেয় বা হঠাৎ-ই এসে কাঁধে হাত রাখে। একপাশে সরে গিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে কিছু গল্পগুজব করি, একটা চা বা সিগারেট খাই, তারা ভদ্রতা করে আমাদের বাসায় বা অফিসে আসতে বলে; বলে যে—আসো না একদিন বাসায় বা অফিসে, চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে। এভাবে, দোকানে, পথে-ঘাটে দুপুর গড়িয়ে যেতে যেতে হয়তো আমাদের অস্থিরতা কিছুটা কমে। কিন্তু, মানুষ এমনকি বৃক্ষের মতও উদার নয়, এই ভাবনা আমাদের ছেড়ে যায় না। কলেজ রোড থেকে এলাহি মার্কেট পর্যন্ত রিকশায় এসে হাসপাতালের পিছন দিয়ে হেঁটে স্কাইলার্ক স্কুলে যাই। স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা টিফিন পিরিয়ডে উল্লাস ও প্রমোদে মাতে; ফুলের মত সেইসব বাচ্চাদের দেখে, ভবিষ্যতে একটা শিশুর অবয়ব আমাদের চোখের পাতায়ও স্বপ্ন এঁকে যায়। স্কুলের অফিসঘরে প্রধান শিক্ষক আলাউল হোসেনের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে আমরা আবারও চা টা খাই, নতুন কোন ম্যাডাম বা শিক্ষক আসে, তাদের সঙ্গে পরিচিত হই। এভাবে ঘুরেফিরে বিকেল নেমে আসে।
পার্ক মোড়ে রেজাউল করিম ওরফে রিজু নেতার আড্ডাখানায় আমাদের
জন্য চেয়ার ফাঁকা থাকে। আমরা
সেই চেয়ারগুলো কাগজ দিয়ে মুছে বা ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে বা না ঝেড়ে বসে পড়ি; বসে রাজা উজির মারতে মারতে আমাদের আবার
চা বা কফির তেষ্টা পাায়; ও
শুধু তেষ্টাই পায় না, দুপুরে
না খাওয়ার জন্য আমাদের খিদেও লাগে। তখন
রানাকে বা কোনদিন বাবুকে চা বা কফি এবং চা বা কফির সঙ্গে সিঙারা বা মোগলাই পরোটা
বা সিঙারা ও মোগলাই পরোটা দুটোই আনতে বলি। রানা বা কোনদিন বাবু আমাদের চা বা কফি
এবং চা বা কফির সঙ্গে মোগলাই পরোটা বা সিঙারা ও মোগলাই পরোটা দুটোই এনে দেয়। তখন নুয়ে আসা বিকেলের নরোম আলোয়
চৌরাস্তার মোবাইল কোম্পানির বিশাল বিলবোর্ডে জনপ্রিয় মডেলের মুখে ও বুকে এবং চোখের
তারায় আরও সেক্সএ্যাপিল দানা বাঁধে।
রিরংসা একেবারে মুছে যায় না বটে, কিন্তু চেতনার অন্তঃস্তরের পরিবর্তন টের পাই। তখন বৃক্ষের ঔদার্য বিষয়ক দর্শনতত্ত্বও
সদ্য ক্রিয়াশীল। যেপ্রকারে
পরিবর্তন হয় তার প্রকৃতি আমাদেরই অজ্ঞাত থাকে; অথবা পরিবর্তন শুরু হয় এরও অনেক আগে, অন্তরালে; যেহেতু
পরিবর্তন একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া, সহজে
তাকে বোঝা যায় না বা কখনো অবচেতনাতেই তার কিছু পর্যায় সমাপ্ত হয়। তখন, নুয়ে আসা বিকেলের নরোম আলোয় রেজাউল করিম রিজু ভাইয়ের
আড্ডাখানায় বসে ফ্রি চা বা কফি বা কখনো কখনো সিঙারা কিংবা মোগলাই পরোটা খেতে খেতে
পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক অংশ আমরা বুঝতে পারি। দৃশ্যপটে শুকিয়ে যাওয়া নদীআত্রাইয়ের
বুকের উপর ভেঙে পড়া পরিত্যক্ত ব্রিজ; এই
শুকনো নদীআত্রাই ও তার বুকের উপর ভেঙে পড়া ব্রিজের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু
বলতে আমাদের ভাল লাগে না; হয়তো
যে পরিবর্তনের সূচনা কিছু আগে মাত্র আমরা টের পাই, যা এমনকি রিরংসাকে পর্যন্ত ঝাপসা ও দুর্বল করে দেয়, তার পরম্পরায় শুকনো নদী ও ভাঙা ব্রিজের
অন্তর্বেদনা আমাদের ব্যথিত করে। এবং
মনে পড়ে, নদীআত্রাইয়ের যৌবন না
হোক অন্তত ভাটা যৌবন আমরাই দেখে দেখে বড় হই। যে ব্রিজ ভেঙে পড়ে থাকে তার পাশে হাটবারে শ শ নৌকা এসে ভিড়ত। তারপর একে একে নৌকাবন্দর থেকে নৌকার
হারিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আর সিন্দুরি
পল্লির গল্প শুনে শুনে কেটে যায় আমাদের শৈশব, কৈশোর। নদীআত্রাইয়ের
পাশে গড়ে উঠেছিল সিন্দুরি পল্লি। জমিদারি
আমলে জমিদার রামজীবন চৌধুরি তার ও তার নায়েব, গোমস্তা, বরকন্দাজদের
বিলাস ব্যসন চরিতার্থের জন্য জমিদারি অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে দরিদ্র
অভাবগ্রস্ত সুন্দর মেয়েদের ধরে এনে বসিয়ে দিত সিন্দুরিতে। বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে আমরা শুনি, এভাবে ক্রমে সিন্দুরি হয়ে উঠেছিল প্রমোদ
ও চিত্তবিনোদনের নগরী। তারা
বলে— ‘নয়নসুহির ঘাট দ্যাহো
নাই, নয়নসুহির ঘাটে
সিন্দুরির বেশ্যা মাগিরা গায়ের কাপড়, শাড়ি
বেলাউজ খুইলে ডুবগোছল করত, আর
তাই নদীর ঘাটে বজরা ভিড়ায়া বজলার জানলা দিয়া দেখতো জমিদার রামজীবন চোধরি, নয়নের সুখ করত, আরে বোজ না হেই কারণেই তো এই ঘাটের নাম
হইছে নয়নসুহির ঘাট।’ তারা
বলে—সুন্দর নারীদের
বিবস্ত্র স্নানদৃশ্য দেখে রামজীবন চৌধুরি ঠিক করতেন সে রাতে বা কাউকে বেশি পছন্দ
হয়ে গেলে হয়তো অনেকদিন ধরে কাকে তিনি নিজের কাছে রাখবেন। বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে শুনে আমাদের মনে হয়,
মেয়েরাও কোন উপায় না পেয়ে এই কাজকেই
শ্রেয়তর ভাবে বা নাচতে নেমে ঘোমটা দেবার চিন্তা বাদ দেয়; তারা হয়তো ভাবে যে, জমিদারের
সঙ্গে থাকতে পারলে জীবনের তবুও একটা সার্থকতা হয়। তখন তারা নদীআত্রাইয়ের ঘাটে জমিদারের
বজরার প্রতীক্ষা করে; যেদিন
আকাক্সিক্ষত বজরা ঘাটে এসে ভিড়ে, সিন্দুরির
মেয়েদের মধ্যে হয়তো বিবস্ত্র স্নানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বহু বছর পরে, রেজাউল করিম ওরফে রিজু নেতার আড্ডাখানায় শুকনো নদীআত্রাই ও তার
বুকের উপর ভেঙে পড়া ব্রিজ যখন আসন্ন সন্ধ্যার ক্রমে ঘন হয়ে আসা অন্ধকারে মিলিয়ে
যেতে থাকে তখন জমিদার রামজীবন চৌধুরির সময়কার সিন্দুরির মেয়েদের জীবনযাপনার কথা
ভেবে আমরা দুঃখভারাক্রান্ত হই; দুঃখভারে
বিনত হতে হতে আমাদের মনে পড়ে ইসমত আরা খাতুন বা সুমিত্রা সরকার বা জুলেখা খাতুনের
অসহায় আত্মসমর্পণের কথা; আমাদের
জানা থাকে ইসমত আরা খাতুন ততদিনে ছেলের মা হয়ে স্বামীর সঙ্গে ক্যাপিটালে ঘরকন্নায়
ব্যস্ত বা সুমিত্রা সরকার ক্যানাডায় ইমিগ্রেটেড হয়; জুলেখা খাতুন সম্পর্কে সর্বশেষ যে তথ্য আমাদের জানা থাকে,
সে তখন স্কুলমাস্টারির সঙ্গে ঠাকুরগাঁও
বেতার কেন্দ্রে মেয়েদের একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে। হয়তো তারা সেখানে, ক্যাপিটালে, ক্যানাডায়, বা
ঠাকুরগাঁওয়ে খুব সুখি জীবনযাপন করে। কিন্তু
আমাদের মনে পড়ে, তারা একদিন, অনেকদিনের জমা করা স্বপ্ন, নারীজীবন ও সামাজিক বাস্তবতার কথা বলে
একমুহূর্তে ভেঙে দিয়ে অর্থ ও বিত্তের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল। তখন ইসমত আরা খাতুন বা সুমিত্রা সরকার
বা জুলেখা খাতুনকে মনে হয়, তারা
সিন্দুরির মেয়েদের চেয়ে দুর্বল আর লোভী। হয়তো স্বপ্ন ও
সুন্দরের চেয়ে মেদ ও মোহে তারা বাঁচতে চায়, সিন্দুরির মেয়েরা যেমন জমিদার রামজীবন চৌধুরির বজরার
প্রতীক্ষায় থেকে তার শয়নকক্ষ কামনা করত।
সিন্দুরির মেয়েদের জন্য, ইসমত আরা খাতুন বা সুমিত্রা সরকার বা জুলেখা খাতুনের জন্য
আমাদের সহমর্মিতা তবু কমে না। নদীআত্রাই
শুকিয়ে গেলেও তখনও আমাদের বুকের মধ্যে যে নদীটি প্রবহমান থাকে, সেখানে একটা ঢেউ ছলাৎ করে ওঠে। হয়তো
তখনই বুকপকেটে বা প্যান্টসের হিপে মুঠোফোনে রিংটোন শব্দ করে বাজে। আমরা হ্যান্ডসেট বের করে দেখি কে কল করে;
হয়তো সমাপ্তি মজুমদার বা পান্না বাড়ই বা
সাবিনা ইয়াসমিনের আমাদের কথা স্মরণ হয়। নম্বর বানিয়ে ফোন করে এইসব মেয়েদের সাথে আমাদের পরিচয় হয়;
বানানো নম্বরে কল করে কোনটাতে পুরুষ কথা
বলে বা কোনটাতে বয়স্ক মহিলারা ফোন রিসিভ করে চিৎকার
করে। কিন্তু আমরা মুঠোফোনে
প্রথমত সুকণ্ঠী ইয়াংদের খুঁজি, খুঁজে
খুঁজে সমাপ্তি মজুমদার বা প্ন্নাা বাড়ই বা সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে আমাদের কথা হয়,
তাদের সঙ্গে জমবে ভেবে আমরা বলি যে,
ডিজিট ভুল করে কলটা তাদের সেটে ইন করে
বা কখনো বলি বাসের সিটে বা টাকায় এই নম্বরে বন্ধু চাওয়া হয়, বা কারো নাম করে, পুলক বা আরিফ বা সুকান্তর কাছ থেকে এই
নম্বর আমরা পেয়েছি। তারা
বলে— এখানে পুলক বা আরিফ
বা সুকান্ত বলে কেউ থাকে না—যত্তসব! —বলে তারা ফোন রেখে
দেয়। আমরা নির্লজ্জভাবে
আবারও ফোন করি; তারা আবারও ফোন রেখে
দেয়, আমরা ধৈর্য হারাই না। ভুল নাম, ভুল পেশা, ভুল
শহরের অধিবাসীর ছদ্ম পরিচয়ে আমরা ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখাই। এভাবে কয়েকবার ফোন রেখে দেবার পরে
সমাপ্তি মজুমদার বা পান্না বাড়ই বা সাবিনা ইয়াসমিন হয়তো হাল ছেড়ে দেয়, বা তাদের মনে হয় এই নির্লজ্জ বেহায়া ছেলেদের
সাথে দেখিই না কথা বলে। কথা
শুরু হয়, একসময় আমাদের
পারস্পরিক ফোননম্বর ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ফ্যামিলিও করে নিই। সম্বোধন নিম্নগামী হতে হতে, কখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসি তা
আমাদের চেতনা এড়িয়ে যায়। আমাদের
কথা হতেই থাকে; হয়তো ভুলভাবে আমাদের
কিছু প্রেমও হয়। বহুবার
কথা হলেও দিনে প্রেমের কথা একেবারেই বলা
হয় না; যা বলি শিষ্ট ও শুদ্ধ
বাংলা ভাষায়, তাতে কী খাই বা কখন
স্নান করি বা দাড়ি শেভ করি কি না এইসব কথাবার্তা থাকে; তবে রাতে আমাদের ভাষা বদলে যায়। তখন, ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া আবেগঘন পরিবেশে সমাপ্তি মজুমদার বা পান্না
বাড়ই বা সাবিনা ইয়াসমিনকে কী পোশাক তারা পরে থাকে, তাই জিজ্ঞেস করি। তারা
সালোয়ার কামিজ বা থ্রি পিস পরে থাকার কথা বলে; রঙের কোন প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই আমরা তাদের সালোয়ার কামিজের বা
থ্রি পিসের রঙ জিজ্ঞেস করি। আসলে
গন্তব্যে যাওয়ার আগে আমরা কিছু সময় নিতে চাই। তখন সমাপ্তি মজুমদার বা পান্না বাড়ই বা
সাবিনা ইয়াসমিন আমাদের বলে—রঙ
দিয়া কী হবে, আছে একটা রঙের,
তুমি কি এখন আমারে আইসা দেখবা, খালি খালি ঢং কইরা রঙ জিজ্ঞাস কর। আবেগ আপ্লুত স্বরে আমরা তাদের বলি—কী রঙের সালোয়ার পরেছ, বল না! কামিজটা কি একই রঙের জান!
সমাপ্তি মজুমদার বা পান্না বাড়ই বা সাবিনা ইয়াসমিন বিগলিত হয়, বা তারাও ভড়ং করে। বলে, তারা খয়েরি বা সবুজ বা লাল সালোয়ার কামিজ পরে থাকে। তখন, আরও আবিষ্ট হয়ে তাদের আমাদের কাছে আসতে বলি; বলি—একটু কাছে আসো না সোনা, বুকের মধ্যে আসো। তারা
না না করে আমাদেরকেই তাদের কাছে যেতে বলে। মুঠোফোনের পাখনায় ভর করে ভাসতে ভাসতে আমরা তাদের কাছে যাই বা
কখনও তারাই আমাদের কাছে আসে; তাদের
শরীরে তখন সালোয়ার কামিজ বাহুল্য হয়, এমনকি
সালোয়ার কামিজের নিচে তারা যে সেমিজ কিংবা ব্রা পরে থাকে, আমরা সেসব টেনে টেনে খুলি; তারাও আমাদের পরিধেয় একে একে খুলে নেয়। আমরা কল্পিত আদর-সোহাগের মধ্যে ডুবে যাই। বুকপকেটে বা প্যান্টসের হিপে মুঠোফোনে
রিংটোন শব্দ করে বেজে উঠলে তখন প্রথমত আমাদের সমাপ্তি মজুমদার বা পান্না বাড়ই
কিংবা সাবিনা ইয়াসমিনের কথা মনে পড়ে।
সন্ধ্যার অন্ধকার আরো ঘন হয়। সামনে শুকনো নদীআত্রাই ও তার বুকের উপর
ভেঙে পড়া ব্রিজ অন্ধকারে দেখা যায় না, তখন
রেজাউল করিম ওরফে রিজুর আড্ডাখানায় বসে রাজা উজির মারতে মারতে শার্টের বুক পকেটে
বা প্যান্টসের হিপে যখন মুঠোফোনে রিংটোন শব্দ করে বাজে আমরা হ্যান্ডসেট বের করে
দেখি কে আমাদের কল করে। কিছু
আগেই সিন্দুরির মেয়েদের প্রসঙ্গে যেহেতু ইসমত আরা খাতুন বা সুমিত্রা সরকার বা
জুলেখা খাতুন আমাদের নতুন করে দুঃখভারাক্রান্ত করে, তাই সমাপ্তি বা পান্নার কিংবা সাবিনার সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি
হয়; রাতে অনেক কথা হবে
বলে ফোন ছাড়ি। তখন
ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, ফার্মেসিতে,
কসমেটিকস শপে ও চৌরাস্তার ট্রাফিক মোড়ে
পুরসভার শাদাবাতি এবং মোবাইলের বিশাল বিলবোর্ডে ইলেকট্রিক আলো জ্বলে উঠলে আবারও
চায়ের তেষ্টা পায়। রানা
বা কোনদিন বাবু চা দিয়ে গেলে আমরা তা চুকচুক করে খাই; চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে হয় আমাদের কিছু জটিলতা আছে। যদিও তখন পর্যন্ত সিন্দুরির মেয়েদের
জন্য এবং ইসমত আরা খাতুন বা সুমিত্রা সরকার বা জুলেখা খাতুনের জন্যে বুকের মধ্যে
কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে দুঃখিত হতে হতে সমাপ্তি মজুমদার বা পান্না বাড়ই কিংবা
সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে কথা বলতে আমাদের ভালো লাগে না, তবু শুভবোধ ও আবেগের উপর কিছু প্রলেপ বা আস্তরণ জমা হয়;
না হলে বৃক্ষের ছায়াতত্ত্ব বা
নদীআত্রাইয়ের শুকিয়ে যাওয়া বা জমিদার রামজীবন চৌধুরির কাছে পরাজিত সিন্দুরির
মেয়েদের জন্যে অন্তর্লীনে ঈষৎ রিএ্যাকশন অনুভব করতে পারলে, বিপণিগুলোতে মেয়েদের পেছন পেছন ঘুরঘুর,
রাতের ফোনালাপ ও কর্মকাণ্ড আমাদের দিয়ে
কি করে হয়! তখন ইসমত আরা খাতুন বা সুমিত্রা সরকার বা জুলেখা খাতুনকে জীবনের এই
অশুভতার জন্যে দায়ী করে নিজেদের কাছে কিছু সান্ত্বনা পেতে পারি। কিন্তু মৃত্যু সম্পর্কে কোন ভীতি আমাদের
থাকে না; জীবনের উন্নাসিকতায়
তখন মৃত্যু আর তেমন কার্যকরী ভীতি নয়, এমনকি
সামান্য শোক তৈরি করার জন্যও দুর্বল অনুষঙ্গ। আমাদের মনে পড়ে, কোন এক শীতে রাতে জোসনাকে ঘিরে কুয়াশার
অবরোধ হয়, সে রাতে রেডিওর
নিশুতি অধিবেশনে বাংলা নাটক খুব জমে ওঠে, অন্য ঘরে আমাদের দাদি বা দাদা বা মৃত্যু ঘনিয়ে আসা বয়স্ক চাচা
গোঙরাতে গোঙরাতে আর গোঙরায় না; আমাদের
মা, ভাবী বা চাচাত ভাই
বোনেরা তারস্বরে কেঁদে ওঠে, বুঝি,
ও ঘরে কি হয়। তবুও তখনও মনোযোগকে নাটকের কেন্দ্রে
নিয়ে আসতে চাই; নাটকের নায়িকা
তিনতলার ছাদ থেকে নিজেকে শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। হয়তো ঘটনাটাই এমন, সে
এটা করতে বাধ্য হয় বা তার যাপিত যন্ত্রণার এমন অবসান ব্যতিরেক কোন উপায় সে খুঁজে
পায় না। রানু বা রুনু নামের
মেয়েটি শূন্যে ভাসতে থাকলে চারপাশ থেকে মৃত্যু আমাদের গ্রাস করে। রেডিও বন্ধ করে বিছানায় একা ঘরে
একাকীত্ব একমাত্র হলে মৃত্যুভয় দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে—আসে শোক ও বেদনার উপলকল্লোল; অন্য ঘরে দাদি বা দাদা বা বয়স্ক কোন চাচা মরে পড়ে থাকে,
তখন, বৃক্ষের ঔদার্য ও নির্মোহতা বিস্মরণ হয়, লবণজলে স্নান করি এবং নৈঃসঙ্গে ও ভয়ে
আমাদের উন্মাদ হয়ে যাওয়া ছিল খুব স্বাভাবিক। সেই সময়কালে আমরা হুজুর হয়ে যেতে পারতাম বা তাবলিগ জামাতের
চিল্লায় সময় লাগানোও অসম্ভব কিছু ছিল না; তখন আমরা এমন অনুভূতির মধ্যে নিপতিত হই, পরিবেশ ও মনে যে শূন্যতাবোধ বিরাজ করে,
আমাদের ধারণা হয় রবীন্দ্রনাথের গান হয়তো
কখনও এমন শূন্যতায় নিয়ে যেতে পারে। রেজাউল
করিম ওরফে রিজুর আড্ডাখানায় বসে দ্বিতীয়বার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, যখন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, ফার্মেসিতে, কসমেটিকস শপে ও চৌরাস্তার ট্রাফিক মোড়ে পুরসভার শাদাবাতি এবং
মোবাইল কোম্পানির বিশাল বিলবোর্ডে ইলেকট্রিক আলো জ্বলে ওঠে, তখন
আমাদের এইসব কথা মনে হয়। কিন্তু
আমরা বৃক্ষের মত উদার হতে পারি না; নানাকারণে
চাওয়ার সঙ্গে প্রাপ্তির অসাম্য, ইসমাত
আরা খাতুন বা সুমিত্রা সরকার বা জুলেখা খাতুনের লোভ ও মোহের কাছে শোচনীয় পরাজয় বা
নদীআত্রাইয়ের ক্রমে অচল হয়ে যাওয়া আমাদের মধ্যে যে ক্রোধ ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়,
ইচ্ছে করলেই আমরা বৃক্ষের মত উদার হতে
পারি না এবং যেহেতু আমাদের হাত পা ও চলাফেরার ক্ষমতা থাকে, তখন বৃক্ষ কাঠুরেকে ছায়া দিলেও এই
ফিলোজফিকে আমাদের জন্য অপ্রযোজ্য মনে হয়। চা শেষ করে কাপের হাতলে আঙুল দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে আমরা উঠে
দাঁড়াই, একটু পরেই হয়তো
সেদিনের মত আড্ডার সমাপ্তি হবে, তখন
আড়মোড়া ভেঙে একজন বলে—আহাম্মদপুরে,
শেখ শামীম নামে একজন কবি শিশুদের একটা
ষ্কুল দিয়েছে, স্কুলের নাম আত্রাই
মেমোরিয়াল স্কুল। আমাদের
চেতনার অন্তঃস্তরে যে পরিবর্তন আমরা সম্প্রতি টের পাই, স্কুলের নাম শুনে তখন, দুঃখ ও হতাশায় বুক ভরে ওঠে; আমাদের কেবলই মনে হয়, একদা এই জনপদে একটি নদী প্রবাহিত হত, যার নাম ছিল আত্রাই।
2 মন্তব্যসমূহ
সৈকত আরেফিনের গল্পটি এখানে কেন? সৈকত আরেফিনের গল্পটি তার নামের লিংকে নাই।
উত্তরমুছুনদুঃখিত। ওটা ভুল করে লিঙ্ক হয়ে গিয়েছিল আপ্লোড করার সময়ে। ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন