নভেরা হোসেন
জৌলুসী ঘরের দাওয়ায় বসে চাল বাছে। চালে বিস্তর পোকা। যুদ্ধের পর রিলিফের চাল আসত, সে চালে বিস্তর পোকা থাকত। কিন্তু এখন তো নতুন ধান, নতুন চাল, ঢেকি ছাটা না মেশিনে ভাঙানো সাদা ধবধবে চাল। কিন্তু চালের মধ্যে সেই যে বড় বড় সাদা পোকা এসে ঢুকল এখনও বের হয় নি। জৌলুসী বেওয়া ঘরের সামনের এক চিলতে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে। চালের মধ্যে এত পোকা? একটা পোকা বেছে তুলতে না তুলতে চোখের সামনে হিজিবিজি আরও সব পোকা এসে হাজির হয়। পোকাগুলোকে সাদা চালের মধ্যে নকশার মতো লাগে। জৌলুসী বেওয়ার চুলে পাক ধরেছে, শরীরেও শক্তি কমে এসেছে কিন্তু মনের জোড়টা এখনও কমে নি। মাদারীপুরের সোনাপট্টিতে সেই কোন কালে এসে ঢুকেছিল জৌলুসী! আগে সব ছবির মতো ঝকঝক করত। কিন্তু দিন দিন সব যেন কেমন দূরে সরে যাচ্ছে, হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পলাশপুর, হাউসদী, আমগ্রাম, রাজৈর, চরমুগরিয়া, অড়িয়াল খাঁর হু হু বাতাস, লাল নীল পালতোলা নৌকার বহর, রহমত ভাই, ৭১ সাল, ক্যাম্প, মেজর বিলাল...সব ভাবতে ভাবতে জৌলুসীর মাথাটা এলোমেলো হয়ে যায়। চালের পোকা বাছতে বাছতে চোখের কোণে শিশির কণার মতো এক বিন্দু জল এসে জমে। ইন্ডিয়ান ছাপা শাড়ির খুট দিয়ে জৌলুসী চোখের কোণটা মুছে আবার চাল বাছতে থাকে। ওই লাড়কি ই-ধারমে আও। পাক সেনার আহবানে জৌলুসীর দুই চোখ ভাটার মতো জ্বলতে থাকে। কিন্তু তখন তার শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। পলাশপুরের মহিউদ্দিন বখশ আর তার দলবল কত মেয়েদের ক্যাম্পে চালান করেছে এটা কেউ বলতে পারবে না।
জৌলুসী ঘরের দাওয়ায় বসে চাল বাছে। চালে বিস্তর পোকা। যুদ্ধের পর রিলিফের চাল আসত, সে চালে বিস্তর পোকা থাকত। কিন্তু এখন তো নতুন ধান, নতুন চাল, ঢেকি ছাটা না মেশিনে ভাঙানো সাদা ধবধবে চাল। কিন্তু চালের মধ্যে সেই যে বড় বড় সাদা পোকা এসে ঢুকল এখনও বের হয় নি। জৌলুসী বেওয়া ঘরের সামনের এক চিলতে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে। চালের মধ্যে এত পোকা? একটা পোকা বেছে তুলতে না তুলতে চোখের সামনে হিজিবিজি আরও সব পোকা এসে হাজির হয়। পোকাগুলোকে সাদা চালের মধ্যে নকশার মতো লাগে। জৌলুসী বেওয়ার চুলে পাক ধরেছে, শরীরেও শক্তি কমে এসেছে কিন্তু মনের জোড়টা এখনও কমে নি। মাদারীপুরের সোনাপট্টিতে সেই কোন কালে এসে ঢুকেছিল জৌলুসী! আগে সব ছবির মতো ঝকঝক করত। কিন্তু দিন দিন সব যেন কেমন দূরে সরে যাচ্ছে, হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পলাশপুর, হাউসদী, আমগ্রাম, রাজৈর, চরমুগরিয়া, অড়িয়াল খাঁর হু হু বাতাস, লাল নীল পালতোলা নৌকার বহর, রহমত ভাই, ৭১ সাল, ক্যাম্প, মেজর বিলাল...সব ভাবতে ভাবতে জৌলুসীর মাথাটা এলোমেলো হয়ে যায়। চালের পোকা বাছতে বাছতে চোখের কোণে শিশির কণার মতো এক বিন্দু জল এসে জমে। ইন্ডিয়ান ছাপা শাড়ির খুট দিয়ে জৌলুসী চোখের কোণটা মুছে আবার চাল বাছতে থাকে। ওই লাড়কি ই-ধারমে আও। পাক সেনার আহবানে জৌলুসীর দুই চোখ ভাটার মতো জ্বলতে থাকে। কিন্তু তখন তার শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। পলাশপুরের মহিউদ্দিন বখশ আর তার দলবল কত মেয়েদের ক্যাম্পে চালান করেছে এটা কেউ বলতে পারবে না।
পলাশপুরের দিকেও কয়েকবার আর্মি এসেছিল তখন সবাই আদিতপুর, তেরভাগদীর দিকে চলে যায়। বাড়ি এসে লুটপাট, ধ্বংসাবশেষ আর পোড়া ভিটে ফিরে পায় অনেকে। অনেকে কিছুই পায় না। মিঠাপুরের বীরেন চৌধুরী, প্রদীপ দাসসহ অনেকের ভিটা পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকসেনারা। তারপর কিছুদিন চুপচাপ। শোনা গেল মাদারীপুর শহরের ক্যাম্পে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ আর মুক্তির নাম শুনলেই ঘরকে ঘর তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ, এমনকি ছয়-সাত বছরের ছোট ছেলে-মেয়েদেরকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছিল পাকসেনারা। তাদের মধ্যে খুব কম জনই ফিরে এসেছিল। হাউসদী, আদিতপুর, মিঠাপুর, পলাশপুরের বহু তরুণ ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসতে শুরু করে। জৌলুসীর মেজো ভাই রহমত ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। বেনাপোল বর্ডারের ঐ পারে রহমতের সাথে আরও অনেক ছেলে মাদরীপুর থেকে ট্রেনিং-এ যায়। অনেকে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ফিরে আসে, অনেকে কোলকাতার দিকে চলে যায়। ট্রেনিং থেকে বাড়ি আসলে জৌলুসী ভাইয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে নি। ভাই যেন হঠাৎ ইয়া লম্বা হয়ে গিয়েছিল। তার সিনা, বুকের পাটা ফুলে গিয়েছিল। জৌলুসৗর মনে হতো এই ভাইকে সে চেনে না! ভরা বর্ষায় যে গ্রামের বিলে রাতের পর রাত ছিপ ফেলে গয়না নৌকায় বসে থাকত, যাত্রাপালা হলে তার দেখা চাই, চাই। চরমুগরিয়াতে যাত্রা হচ্ছে আর রহমত সেখানে নাই এটা হতেই পারে না।
ছোট বোনটাকে রহমতও ভিন্ন চোখে দেখত, তার অনেক আদরের বোন ছিল জৌলুসী। ভাইজান আমারে মেলার থিকা বাতাসা আইনা দিবা? রহমত ছোট বোনকে কপালে চুমু দিতে দিতে বলত কী কস ছুট্টি? তোর জন্য বাতাসা আনমু না? কাগজের টিয়া, মাটির পুতলি, ঘোড়া আরও কত কী আনমু! জানস চরমুগরিয়ার একটা বান্দর পানিতে পইড়া গেছিল, পোলাপান তারে আটকাইয়া খেলা দেখতাছে। কী কও ভাইডি? আহারে অরা নিশ্চিত বানরডারে মাইরা মাইরা ছাতু বানাইতাছে। তুমি অগো থন বানরটারে আইনা দিতে পারবা আমারে? কী কস? অরা যেই ডাকু পোলাপান, খাঁ বাড়ির পোলা। অরা আমারে আরও গুতানি দিয়া দিব। কেন তুমি পারবা না অগো দিতে? আমিতো একারে। কেন আমিও যামু তোমার লগে। সত্যি যাবি ছুট্টি? আগেকার দিনের অনেক কথা মনে পড়ে জৌলুসীর মনে। আহ্ কোনোদিন আর সেই ভাই ফিরা আইব না? আর বিলের পানিতে তিত পুঁটি, রয়না মাছ ধরার দিনও ফিরব না? কিন্তু ওই দুঃস্বপ্ন কেন ফিরা ফিরা আসে?
মেজর বিলালের কুড়ালের মতো দাঁতগুলো জৌলুসী বেওয়ার নরম স্তন ফুটো করে আরও আঘাত করতে থাকে। জৌলুসীর উরুসন্ধিতে বিলাল তার দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরত আর বেহুশের মতো জিভ দিয়ে সাড়া শরীর চাটতে চাটতে উন্মাদ হয়ে উঠত। বিলাল জৌলুসীকে আলাদা একটা ঘরে নিয়ে তুলেছিল। খুপরির মতো সে ঘরের পুরোটা জুড়েই ছিল একটা চৌকি। বিলাল জৌলুসীকে চৌকির সাথে বেঁধে রাখত। অনেক সময় তিন-চার দিন পর্যন্ত চৌকির সাথে বাঁধা থাকত সে। তলপেটে প্রস্রাব, পায়খানার চাপ এলে জৌলুসী চিৎকার করতে থাকত। তার বুক ফাটা চিৎকারে কেউ সাড়া দিত না। দু-একজন মেয়ের কান্না আর বিলাপ ধ্বনী ভেসে আসত কানে। জৌলুসী হয়তো মরার মতো পরে পরে ঘুমাচ্ছে, ঠিক সেই সময় বিলাল এসে জৌলুসীর শরীরের কাপড় সরিয়ে ঝাপিয়ে পড়ত তার উপর। জৌলুসী প্রাণপণে চেষ্টা করত দাঁত দিয়ে বিলালকে কামড়াতে, নখ দিয়ে আঁচড় কাটতে, কিন্তু ছয় ফুট লম্বা বিলাল তার দৈত্যের মতো শরীর নিয়ে পিষে ফেলত জৌলুসীকে। জৌলুসী রক্তাক্ত হয়ে কাতরাতে থাকত বাঁধা অবস্থায়।
ক্যাম্পে মেয়েদের খাবার দিত কুলসুম বিবি, কুলসুম ছিল একটা আস্ত ডাইনি। জৌলুসীকে দুই-তিন দিন পর একটু ভাত আর কাঁচা মরিচ দেয়া হতো, তাও সেই ভাত ছিল গন্ধে ভরা। মুখে দিলেই পেট উগড়ে বমি আসত জৌলুসীর। বেশি চিৎকার করলে কুলসুম জৌলুসীর বাঁধন খুলে টাট্টিখানায় নিয়ে যেত। ছালা দিয়ে ঘেরা সেই টাট্টিখানায় গেলে দুর্গন্ধে জৌলুসীর জান-জীবন বের হয়ে যেত আর টাট্টির ছালা গলায় প্যাঁচিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করত। ক্যাম্পে যাওয়ার পরের মাস থেকেই জৌলুসীর মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। দিন দিন তার শরীর শীর্ণ হতে থাকে কিন্তু তলপেটটা একটু স্ফীত হয়ে ওঠে। সারা শরীরে ভয়ঙ্কর ব্যথা আর জ্বলুনি। মেজর বিলাল ঐ অবস্থায় জৌলুসীকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে অন্য মেয়েকে তোলে।
ক্যাম্পে মেয়েদের খাবার দিত কুলসুম বিবি, কুলসুম ছিল একটা আস্ত ডাইনি। জৌলুসীকে দুই-তিন দিন পর একটু ভাত আর কাঁচা মরিচ দেয়া হতো, তাও সেই ভাত ছিল গন্ধে ভরা। মুখে দিলেই পেট উগড়ে বমি আসত জৌলুসীর। বেশি চিৎকার করলে কুলসুম জৌলুসীর বাঁধন খুলে টাট্টিখানায় নিয়ে যেত। ছালা দিয়ে ঘেরা সেই টাট্টিখানায় গেলে দুর্গন্ধে জৌলুসীর জান-জীবন বের হয়ে যেত আর টাট্টির ছালা গলায় প্যাঁচিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করত। ক্যাম্পে যাওয়ার পরের মাস থেকেই জৌলুসীর মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। দিন দিন তার শরীর শীর্ণ হতে থাকে কিন্তু তলপেটটা একটু স্ফীত হয়ে ওঠে। সারা শরীরে ভয়ঙ্কর ব্যথা আর জ্বলুনি। মেজর বিলাল ঐ অবস্থায় জৌলুসীকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে অন্য মেয়েকে তোলে।
এরপর জৌলুসী ক্যাম্পের বড় ঘরটাতে জায়গা পায়। মাটিতে হোগলা পাতা বিছানো, আর সারা ঘর জুড়ে মেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে আছে। কারও শরীরে শাড়ি আছে কারো পরনে শুধু পেটিকোট। ঘরটার মধ্যে রক্ত পচা গন্ধ। মেয়েদের শীর্ণ দেহ দেখলে দুর্ভিরে চিত্র ভেসে উঠবে মনে। ঐ ঘরে এসে জৌলুসীর যেন নতুন জীবন শুরু হয়। এত দিন মেজর বিলালের একার অত্যাচার সহ্য হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ঐ বড় ঘরে কত যে বিলাল এলো আর গেল তার ইয়ত্তা নাই। চিৎকার, গোঙানি, কান্না, শিৎকার-ধ্বনী সব একত্রে মিলেমিশে যেত। ওখানে সবাই যন্ত্র হয়ে গিয়েছিল। দিন-রাত চলত পাকসেনাদের বলাৎকার। পাশে অসংখ্য মেয়েরা সারি সারি শুয়ে। প্রকাশ্যে এক একজন মেয়ের শরীরে দু-তিনজন করে সৈনিক চড়ে বসত। এ দৃশ্য চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা কঠিন। মেয়েদের শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি সৈনিকরা ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেত। কামড়, আঁচড়ের দাগে ঐ ঘরের মেয়েদের চেহাড়া, শরীর বিভৎস রূপ ধারন করেছিল। জৌলুসী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখত সব। তার নিজের শরীরের কোনো অনুভূতি তখন ছিল না কিন্তু তলপেটটা দিন দিন যেন ভারী হয়ে উঠছিল। ঐ ঘরে সে বাঁধা অবস্থায় ছিল না। আর বাঁধার কোনো প্রয়োজনও ছিল না। তখন জৌলুসীর শরীর, মন এমন হয়ে গিয়েছিল গায়ে গরম পানি ঢেলে দিলেও জায়গার থেকে নড়ার শক্তি নাই। তার পাশে শুয়ে থাকা কেন্দুয়া বাজিতপুরের স্বরস্বতী এত টকটকে ফর্সা ছিল, জৌলুসীর চোখের সামনে সেই সরস্বতী একদিন গলায় শাড়ি প্যাঁচিয়ে মরে গেল। সরস্বতীর গলার কাছটা লাল জবার মতো হয়ে গিয়েছিল। ও ঘরে দু-একবার দু-এক নলা ভাত জুটত, এক ঘটি পানি আবার অচেতন।
ঘুমের মধ্যে জৌলুসী গ্রামের স্বপ্ন দেখত। আঁড়িয়াল খাঁর ধূ ধূ পানি। সাদা পানি ছাড়া আর কিছু নাই । দূরে ছোট ছোট বিন্দুর মতো নৌকার আদল ফুটে উঠে, আবার মিলিয়ে যায়। চোখের সামনে বিলের স্বচ্ছ পানি ভেসে ওঠে। সেই পানিতে ধান ডুবে আছে, শ্যাওলা, নানারকম ঘাস, লতা-পাতা, শাক, ছোট ছোট পোনা মাছ ঝাঁক ধরে ভেসে বেড়ায় পানিতে। দু-একটা বড় মাছ ছলাৎ শব্দ করে লুকিয়ে পড়ে। জৌলুসী পানিতে হাত ডুবিয়ে একটা মাছ হাতে নিতেই তার সারা শরীর দরদর করে ঘামতে থাকে। ক্যাম্পের মেঝেতে তলপেটের ব্যথায় ককাতে থাকে। ব্যথাটা এত তীব্র হতে থাকে জৌলুসী নিঃশ্বাস নিতে পারে না, দম বন্ধ হয়ে আসে। শেষের দিকে জৌলুসীর নিম্নাঙ্গে ঘা হয়ে যায়, সারাদিন চুলকাতে থাকে। একদিন প্রচণ্ড ব্যথা হয় তলপেটে তারপর খালি রক্ত আর রক্ত। এমন রক্ত জৌলুসী কোনোদিন দেখে নাই, নিজের রক্তে সাঁতার কাটতে থাকে জৌলুসী।
রক্তপাতের সময়ে কুলসুম আর একজন সৈনিক জৌলুসীকে নদীর পারে ফেলে যায। ঐখান থেকে পূর্বপাড়ার জলিল আর বাহাদুর শেখ জৌলুসীকে বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু জৌলুসীর মা মেয়ের ঐ দশা দেখে মেয়েকে ঘরে নিতে সাহস করে না। মেয়েকে নিয়ে ভানু দাইয়ের ঘরে আশ্রয় নেয়। ভানুমতি অনেক বড়ি, গাছ-গাছরার শিকড় খাইয়ে জৌলুসীকে সুস্থ করে তোলে। জৌলুসী তখন কথা বলা ভুলে গিয়েছিল, কিছুই মনে পড়ত না তার। মাসের পর মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠে ঘা হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের পর পর জৌলুসীকে নিয়ে গ্রামে নানা কথা ওঠে। গ্রামের মুরুব্বিরা তাকে বাড়িতে তোলা নিয়ে আপত্তি তোলে। জৌলুসীর ভাই রহমত যুদ্ধের পর ফিরে আসে নি, জৌলুসীর মা সমিরন গ্রামের লোকের তোপের মুখে জৌলুসীকে নিয়ে মাদারীপুর শহরে চলে যায়। মেস-বাড়িতে রান্নার কাজ নেয়। জৌলুসীও মার সাথে সাথে কাজে নামে। তেয়াত্তরের শেষের দিকে জৌলুসীর মার কঠিন অসুখ হলে সে বাড়ি চলে যায়। জৌলুসী কলেজের স্যারদের রান্নার কাজ নেয়। এর তার আশ্রয়ে দিন কাটায়। স্যারদের মেসেই জয়তুন খালার সাথে পরিচয় হয়। জয়তুন খালার বুদ্ধিতে জৌলুসী সোনাপট্টিতে পানি টানার কাজ নেয়। ওখানে শুরু হয় তার আরেক জীবন।
জৌলুসী বসে বসে ভাবে আর চালের পোকা বাছে। ওখানে ভাত-পানি পেয়ে জৌলুসীর চেহারা ধীরে ধীরে ফিরতে থাকে, জয়তুন খালা যত্ন করে জৌলুসীকে তৈরি করে। তার আশ্রয়ে জৌলুসী অনেক কাস্টমারের দেখা পায়, টাকা পয়সা আসতে থাকে। অনেক কাস্টমার জৌলুসীকে যাতাকলের মতো পিষে মারে, অনেকে টাকা-পয়সা, উপহার দিয়ে খুশি করতে চেষ্টা করে। সোনাপট্টিতে দিন শেষ হলেই শুরু হয় রাতের ব্যবসা। মাছ ব্যবসায়ী, দোকান মালিক, স্বর্নকার, ডাক্তার, উকিল, পিয়ন কত রকমের কাস্টমার যে আসে! চলতে থাকে ুধার্ত মানুষের আকাঙ্খা পূরণের কসরৎ। জৌলুসীও সাজ পোশাক করে অপো করে তাদের জন্য। এ যেন জীবনের এক অমোঘ নিয়তি। সেই নিয়তিতে বাঁধা জৌলুসী, তার আর কোনো আশ্রয় নাই কোথাও। একটা নীড়হারা পাখির মতো সোনাপট্টির আঁশটে গন্ধমাখা ঘরে দিন গুজরান। মহাকাব্যের চরিত্রের মতো কঠিন গাঁথুনিতে আটকে থাকা বারাঙ্গনা নারী। এই বারাঙ্গনার জীবনে যা ঘটে তার ভেতরেই সে সাঁতার কাটতে থাকে। সোনাপট্টির ছোট ঘরে তার জীবনটা আটকে গেছে কিন্তু জীবনের সব প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে যায় নি। জৌলুসীর মৃৎ শরীরও কখনো কখনো জেগে ওঠে। মাছের আরতদার বদরুল মজুমদার জৌলুসীর স্তনে চুমু খেতে থাকলে জৌলুসীর শরীরে এক ঝিলিক শিহরণ বয়ে যায়, শ্বেত তরল গড়িয়ে পড়তে থাকে উরুসন্ধি থেকে। জৌলুসী বদরুল মজুমদারেরর সারা শরীর চুমুতে ভরিয়ে ভরিয়ে দেয়, একটা ছটফটে পাখির মতো বদরুল মজুমদারেরর বিশাল বুকে আশ্রয় খোঁজে কিন্তু মুহুর্তে তার শরীর শিথিল হয়ে আসে। ঘুমে ঢলে পড়ে জৌলুসী, জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে।
রক্তপাতের সময়ে কুলসুম আর একজন সৈনিক জৌলুসীকে নদীর পারে ফেলে যায। ঐখান থেকে পূর্বপাড়ার জলিল আর বাহাদুর শেখ জৌলুসীকে বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু জৌলুসীর মা মেয়ের ঐ দশা দেখে মেয়েকে ঘরে নিতে সাহস করে না। মেয়েকে নিয়ে ভানু দাইয়ের ঘরে আশ্রয় নেয়। ভানুমতি অনেক বড়ি, গাছ-গাছরার শিকড় খাইয়ে জৌলুসীকে সুস্থ করে তোলে। জৌলুসী তখন কথা বলা ভুলে গিয়েছিল, কিছুই মনে পড়ত না তার। মাসের পর মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠে ঘা হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের পর পর জৌলুসীকে নিয়ে গ্রামে নানা কথা ওঠে। গ্রামের মুরুব্বিরা তাকে বাড়িতে তোলা নিয়ে আপত্তি তোলে। জৌলুসীর ভাই রহমত যুদ্ধের পর ফিরে আসে নি, জৌলুসীর মা সমিরন গ্রামের লোকের তোপের মুখে জৌলুসীকে নিয়ে মাদারীপুর শহরে চলে যায়। মেস-বাড়িতে রান্নার কাজ নেয়। জৌলুসীও মার সাথে সাথে কাজে নামে। তেয়াত্তরের শেষের দিকে জৌলুসীর মার কঠিন অসুখ হলে সে বাড়ি চলে যায়। জৌলুসী কলেজের স্যারদের রান্নার কাজ নেয়। এর তার আশ্রয়ে দিন কাটায়। স্যারদের মেসেই জয়তুন খালার সাথে পরিচয় হয়। জয়তুন খালার বুদ্ধিতে জৌলুসী সোনাপট্টিতে পানি টানার কাজ নেয়। ওখানে শুরু হয় তার আরেক জীবন।
জৌলুসী বসে বসে ভাবে আর চালের পোকা বাছে। ওখানে ভাত-পানি পেয়ে জৌলুসীর চেহারা ধীরে ধীরে ফিরতে থাকে, জয়তুন খালা যত্ন করে জৌলুসীকে তৈরি করে। তার আশ্রয়ে জৌলুসী অনেক কাস্টমারের দেখা পায়, টাকা পয়সা আসতে থাকে। অনেক কাস্টমার জৌলুসীকে যাতাকলের মতো পিষে মারে, অনেকে টাকা-পয়সা, উপহার দিয়ে খুশি করতে চেষ্টা করে। সোনাপট্টিতে দিন শেষ হলেই শুরু হয় রাতের ব্যবসা। মাছ ব্যবসায়ী, দোকান মালিক, স্বর্নকার, ডাক্তার, উকিল, পিয়ন কত রকমের কাস্টমার যে আসে! চলতে থাকে ুধার্ত মানুষের আকাঙ্খা পূরণের কসরৎ। জৌলুসীও সাজ পোশাক করে অপো করে তাদের জন্য। এ যেন জীবনের এক অমোঘ নিয়তি। সেই নিয়তিতে বাঁধা জৌলুসী, তার আর কোনো আশ্রয় নাই কোথাও। একটা নীড়হারা পাখির মতো সোনাপট্টির আঁশটে গন্ধমাখা ঘরে দিন গুজরান। মহাকাব্যের চরিত্রের মতো কঠিন গাঁথুনিতে আটকে থাকা বারাঙ্গনা নারী। এই বারাঙ্গনার জীবনে যা ঘটে তার ভেতরেই সে সাঁতার কাটতে থাকে। সোনাপট্টির ছোট ঘরে তার জীবনটা আটকে গেছে কিন্তু জীবনের সব প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে যায় নি। জৌলুসীর মৃৎ শরীরও কখনো কখনো জেগে ওঠে। মাছের আরতদার বদরুল মজুমদার জৌলুসীর স্তনে চুমু খেতে থাকলে জৌলুসীর শরীরে এক ঝিলিক শিহরণ বয়ে যায়, শ্বেত তরল গড়িয়ে পড়তে থাকে উরুসন্ধি থেকে। জৌলুসী বদরুল মজুমদারেরর সারা শরীর চুমুতে ভরিয়ে ভরিয়ে দেয়, একটা ছটফটে পাখির মতো বদরুল মজুমদারেরর বিশাল বুকে আশ্রয় খোঁজে কিন্তু মুহুর্তে তার শরীর শিথিল হয়ে আসে। ঘুমে ঢলে পড়ে জৌলুসী, জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে।
এসময়গুলোতে নিত্য দিনের কাস্টমারদের সাথে জৌলুসী দুর্ব্যবহার করতে থাকে, দরজা লাগিয়ে চিৎকার করে গালি দেয়। আয় আয় খানকির পোলারা, তোরা আর কত শুইষা খাবি, এখন আর রস নাই। রস মরছে। খা। খা, বেশি কইরা খা। দেখি তোগো কত তাগত? এই জৌলুসী বেওয়া পাক সেনাগো মারাইয়া আইছে, তার জান তরা লইতে পারবি না। জৌলুসী দরজার কপাট পিটাতে পিটাতে হিস্টিরিয়া রোগীদের মতো দাপাতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে কান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সোনাপট্টিতে জৌলুসী বেওয়াকে প্রথম প্রথম সবাই সমীহের চোখে দেখত, তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ কথা বলতে পারত না, তার তেজ আর সৌন্দর্যের কাছে সবাই মেনি বিড়াল হয়ে থাকত। কিন্তু দিন দিন জৌলুসীর সে তেজ কমে আসে, ব্যবসায় ভাটা নামে, টাকা পয়সা কমে যায়। জৌলুসী চালের পোকা বাছে আর ভাবে কতগুলান বছর কাইটা গেল কই তারে দেখতে তো কোনোদিন কেউ আইলো না, দেশের কেউ চুপি দিয়া তারে দেখল না।
একবার শুধু একবারই জৌলুসী গ্রামে গিয়েছিল, মার মৃত্যুর খবর পেয়ে। কিন্তু গ্রামের লোকজন জৌলুসীর চাল-চলন, কথা-বার্তা দেখে তার সাথে কথা বলে নি। তার আপন বড় ভাই ঘরে এক বেলা ভাত খেতে সাধে নি। মার কবর হওয়ার পর ঔইদিন সন্ধ্যায়ই জৌলুসী সোনাপট্টি ফিরে আসে। তাও তো অনেক দিন হয়ে গেল। মার মৃত্যুর দিন সে বুঝতে পারে পাকসেনারা তার জীবন শেষ করে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তার মায়ের পেটের ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, গ্রামের মানুষ তারা তো জৌলুসীর মরা মুখ দেখলেই খুশি হতো! সবাই জৌলুসীর সাথে কোন্ ব্যবহারটা করেছে? তারা তো তাকে গ্রামে থাকতে দেয় নাই, দেশছাড়া করেছে। নাহ কেউ জৌলুসীর পে দাঁড়ায় নাই। একমাত্র মা তাকে বুকে করে আগলিয়ে রেখেছিল। জৌলুসী শুনেছে যুদ্ধে যেসব মেয়েদের উপর অত্যাচার হয়েছে, নির্যাতন হয়েছে তাদের খোঁজ নেয় সরকার, তাদের ভাত-কাপড়ের বন্দোবস্ত করে। সত্যি না মিথ্যা জৌলুসী জানে না। আর তাতে তার কিছু আসে যায়ও না। ভাতের যোগার সে নিজেই করতে পারে, নিজের শরীরের মাংস বিক্রি করে হলেও ইজ্জত নিয়ে বেঁচে আছে, কারো কাছে কোনোদিন হাত পাতে নাই। কেউ তাকে কোনোদিন বলে নাই জৌলুসী এই রাতটা ঘুমাও, তোমার শরীরটাকে বিশ্রাম দাও। জৌলুসী হু হু করে কাঁদতে থাকে আর চালের পোকা বাছে। যুদ্ধের পর চালে অনেক পোকা আসত, সেই পোকা কি দিন দিন বেড়ে চলেছে? জৌলুসী সাদা ধবধবে চালের মধ্যে খালি কিলবিল করা পোকা দেখতে পায়।
লেখক পরিচিতি
নভেরা হোসেন
কবি। গল্পকার। ব্লগার।
নভেরা হোসেন
কবি। গল্পকার। ব্লগার।
0 মন্তব্যসমূহ