নীহারুল ইসলাম : নির্দিষ্ট করে বলা খুব মুশকিল। আজ ১৯৯১-এ শুরু করে আজ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা ৩২০ টি। এর মধ্যে বেশকিছু গল্পই সেরা মনে হয়। তবে এই মুহূর্তে যে গল্পটির কথা খুব বেশী করে মনে পড়ছে সেটির নাম, ‘দুলহাবুড়ির ভর’। প্রকাশিত হয়েছিল ১৪১৯ সালের শারদীয় ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকায়। গল্পটি লিখে ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। এবং প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের কাছ থেকে যেরকম সাড়া পেয়েছিলাম, তা আমাকে সাংঘাতিক অনুপ্রাণিত করেছিল। গল্পটি সম্পর্কে আজও সমানভাবে পাঠকদের সাড়া পাই। আজও অনুপ্রাণিত হই।
২. গল্পটির বীজ কিভাবে পেয়েছিলেন?
নীহারুল ইসলাম : আমার ছোটবেলায় দেখা এক কাঠকুড়োনি বুড়ি। যাকে আমরা ‘দুলহাবুড়ি’ নামে জানতাম। সাতকুলে যার কেউ ছিল না। তবে তাঁর বশে অনেক জ্বিন ছিল। ভাল জ্বিন-মন্দ জ্বিন! মানুষের মঙ্গলের জন্য সে নিজের শরীরে জ্বিনের ভর নামাত। মানুষের আপদবিপদে সে ছিল আমাদের অঞ্চলের একমাত্র এবং অন্তিম ভরসা। একবার আমার ছোটবোন দু’বছর বয়সে তড়কা জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবং তার মুখ বেঁকিয়ে যায়। ডাক্তার দেখিয়ে কোনও ফল পাওয়া যায়নি। শেষপর্যন্ত পরিবারের অজান্তে রাতের অন্ধকারে আমার মা ছোটবোনকে নিয়ে ওই দুলহাবুড়ির স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন। সেই সময় আমি মায়ের সঙ্গী হয়েছিলাম। এবং দেখেছিলাম দুলহাবুড়িকে জ্বিনের ভর নামাতে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার জীবনে। ওই অভিজ্ঞতাটুকুই ছিল এই গল্পটির বীজ।
৩. গল্পের বীজটির বিস্তার কভাবে ঘটল? শুরুতে কি থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছেন? না, কাহিনীকাঠামো বা প্লট নিয়ে ভেবেছেন?
নীহারুল ইসলাম : বিষয়বস্তুই ছিল আমার কাছে প্রধান। দুলহাবড়ি চরিত্রটিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম তো! বিভিন্ন রূপে দেখেছিলাম। কখনও কাঠকুড়োনি রূপে। কখনও শাকতোলানি রূপে। কখনও ছাগলচরানি রূপে। কখনও আবার ভর আক্রান্ত উন্মাদিনী রূপে! আমার সেই ছোটবয়স থেকেই সে জারিত হচ্ছিল আমার মননে। সেটা আমার অজান্তেই হয়ত! তাই যখন আমি তাঁকে নিয়ে লিখব ঠিক করলাম, এবং লিখতে শুরু করলাম, একটানেই গল্পটি হয়ে গেল। কোথাও আটকাল না।
না। এই গল্পটির কাহিনীকাঠামো নিয়ে আমাকে কসরত করতে হয়নি। এমনিতে আমি কোনও গল্পের কাহিনীকাঠামো নিয়ে কসরত করি না। আমার গল্পের বিষয়বস্তু নিজেই ঠিক করে নেয় তার কাহিনীকাঠামো। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান।
৪. গল্পটির চরিত্রগুলো কিভাবে এসেছে? শুরুতে কতগুলি চরিত্র এসেছিল? তারা কি শেষ পর্যন্ত থেকেছে? আপনি কি বিশেষ কোনো চরিত্রকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন? তাদের মধ্যে কি আপনার নিজের চেনা জানা কোনো চরিত্র এসেছে? অথবা নিজে কি কোনো চরিত্রের মধ্যে চলে এসেছেন?
নীহারুল ইসলাম : ওই যে বললাম, ওই একটি চরিত্র- দুলহাবুড়ি! তাকে নিয়েই লিখতে শুরু করে দেখলাম এক এক করে আর সব চরিত্ররা ভিড় করে এল। সব চরিত্রই আমার পরিচিত। আমার দেখা। আমি প্রতিটি চরিত্রকেই সাংঘাতিক রকম ভাবে অন্তরে অনুভব করেছি। এই গল্পে আমি সরাসরি চরিত্র হয়ে না এলেও হয়ত প্রত্যেকটি পুরুষ চরিত্রের মধ্যে আমি কোনও না কোনও ভাবে রয়ে গেছি। অমর প্রধান, ঠিকাদার, হাজারি সেখ, ঝাঁটু, সাজা, রেজওয়ান, আসাদ- প্রত্যেকের ভেতরে। যেহেতু আমি নিজে একজন পুরুষ!
৫. এই গল্পটির দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিভাবে নির্মাণ করেছেন?
নীহারুল ইসলাম : এই ব্যাখ্যা দিতে আমি অক্ষম। গল্পটি কীভাবে যেন হয়ে গেছে! এই হয়ে যাওয়ার মধ্যে হয়ত আমার কোনও ভূমিকা নেই। কিংবা থাকলেও তা খুব নগণ্য। কিংবা আমার শৈশবে দেখা ওই চরিত্র বা ওই ঘটনা কৈশর-যৌবন ছাড়িয়ে এই শেষ যৌবনে যখন ঝিলিক মেরে উঠল, আমার কাছে সেটা অনেকটা বজ্রপাতের বিদ্যুৎচ্ছটার মতো। চোখে এসে লাগল। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আমি ভয় পেলাম। আবার আশ্চর্যও হলাম। আমার কাছে এই গল্পের দ্বন্দ-সংঘাত নির্মাণ খানিকটা এরকম ভাবেই এসেছে। ঠিক যেভাবে এসেছে, সেভাবেই লিখে গেছি। বাহাদুরি করিনি। অবশ্য আমার কোনও গল্পের ক্ষেত্রেই সেটা করি না।
৬. গল্পের পরিণতিটা নিয়ে কি আগেই ভেবে রেখেছিলেন?
নীহারুল ইসলাম : না। এই গল্পটির পরিণতি আগে থেকে কিছু ভাবিনি। লিখতে লিখতে পরিণতি এসে গিয়েছিল। আমার বেশীরভাগ গল্পের ক্ষেত্রেই সেটা হয়।
৭. গল্পটি ক’দিন ধরে লিখেছেন? এর ভাষা ভঙ্গিতে কি ধরনের শৈলী ব্যবহার করেছেন?
নীহারুল ইসলাম : একদিনেই। বলতে গেলে এক সন্ধ্যায় লেখা গল্প ‘দুলহাবুড়ির ভর’।
আর ভাষা ভঙ্গিতে কী ধরণের শৈলী ব্যবহার করেছি, গল্পটি পড়লেই পাঠক তা বুঝতে পারবেন। যদিও ভাষাভঙ্গির শৈলীর ব্যাপারে আমি খুব অসচেতন।
৮. গল্পটিতে কি কিছু বলতে চেয়েছিলেন?
নীহারুল ইসলাম : ঠিক জানি না। তবে এই পৃথিবীতে ‘মা’ কী জিনিস! সেটাই দেখানোর চেষ্টা নিয়ে গল্পটি লিখব ভেবেছিলাম। আমার মা একটি শিক্ষিত পরিবারের গৃহবধূ হয়েও নিজের সন্তানের মঙ্গলের জন্য পরিবারের অজান্তে রাতের অন্ধকারে যেভাবে ছুটে গিয়েছিলেন নিরক্ষর কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক বৃদ্ধা নারীর (দুলহাবুড়ি) কাছে, সেটা আমার শৈশবে দেখা ঘটনা। না, গল্পে সেই বিষয়টি কিন্তু এল না। তার বদলে ‘দুলহাবুড়ি’ সম্পূর্ণ নারী জাতির প্রতীক হয়ে চলে এল। প্রথমে লাশ হয়ে এলেও আমরা তাঁকে দেখলাম- সে কখনও দেবী! কখনও কামার্ত রমণী! কখনও প্রেমিকা! কখনও বা দীনদুখিনী মা, ঠাকুমা! সর্বপরি মায়াবী কিংবা মমতাময়ী নারী হিসাবে। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা তাঁকে কে কী ভাবে গ্রহণ করেছি, সেটাই বোধহয় বলতে চেয়েছি। কতটা পেরেছি, জানি না।
৯. গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন? আপনি কি মনে করেন--আপনি যা লিখতে চেয়েছিলেন, তা লিখতে পেরেছেন এই গল্পটিতে?
নীহারুল ইসলাম : হ্যা, সন্তুষ্ট তো হয়েছি। কিন্তু--
তখন আমি একটি উপন্যাস লিখছিলাম ‘নন্দন’ পত্রিকার শারদ সংখ্যার জন্য। জ্বিন নিয়ে। উপন্যাসটির নাম দিয়েছিলাম ‘পীরনানার জ্বিন’। আমি তখন জ্বিনের ঘোরে ছিলাম। তার মধ্যেই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর শারদ সংখ্যায় গল্প লেখার আমন্ত্রণ। বলতে পারেন এবারে আমায় জ্বিনে পেয়ে বসল। না- পীরনানার জ্বিন নয়, দুলহাবুড়ির জ্বিন। যে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল ছোটবোনকে নিয়ে আমার মায়ের দুলহাবুড়ির কাছে যাওয়ার ঘটনাটা। সঙ্গে সঙ্গে জ্বিন নয়, দুলহাবুড়িই যেন আমার ওপর ভর করে বসল। আর আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল তাঁর নিজের এই গল্পটি। তাহলে আমি আমার চাওয়া গল্পটি লিখতে পারলাম কই?
১০. এই গল্পটি পাঠক কেনো পছন্দ করে বলে আপনার মনে হয়?
উত্তরঃ এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে গল্পটির সাবলীল গতি পাঠকদের গল্পটি পড়তে প্ররোচিত করে থাকতে পারে! কিংবা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের চোখে নারী’র অবস্থানের ব্যাপারটা পাঠক ধরে থাকতে পারেন! কিংবা সাত কুলে কেউ না থাকা এক বুড়ির সবার আত্মীয় হয়ে ওঠার ম্যাজিকটা পাঠকের ভাল লেগে থাকতে পারে! সঠিক ভাবে আমি বলতে পারব না পাঠক গল্পটি কেন পছন্দ করেন...

নীহারুল ইসলাম
আব্বা- রফিকুল ইসলাম। মা- আকরেমা বেগম। জন্ম- ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭, মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘী থানার হরহরি গ্রামে (মাতুলালয়)। শিক্ষা- স্নাতক (কলা বিভাগ), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা- শিক্ষা সম্প্রসারক। সখ- ভ্রমণ। বিনোদন- উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শ্রবণ।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমেই লেখালেখি শুরু। বহরমপুরের ‘রৌরব’ পত্রিকায় প্রথম গল্প ‘ফুলি’ প্রকাশ। তার আগে ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা ‘জন্মান্তর বৃত্তান্ত’ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বৃহত্তর পাঠকসমাজে আত্মপ্রকাশ। এযাবৎ তিন শতাধিক গল্পের রচয়িতা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থঃ ১. পঞ্চব্যাধের শিকার পর্ব (১৯৯৬); ২. জেনা (২০০০); ৩. আগুনদৃষ্টি ও কালোবিড়াল (২০০৪); ৪.ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা (২০০৮); ৫. মজনু হবার রূপকথা (২০১২), দু’টি নভেলার সংকলন; ৬. জনম দৌড় (২০১২), উপন্যাস।
২০০০ থেকে ‘খোঁজ’ নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী’র সম্পাদনা।
লালগোলা ‘সংস্কৃতি সংঘ’ (১৯৯৫)এবং শিলিগুড়ি ‘উত্তরবঙ্গ নাট্য জগৎ’ কর্তৃক ছোটগল্পকার হিসাবে সংবর্ধিত (২০০৩)। সাহিত্য আকাদেমি’র ট্রাভেল গ্রান্ট পেয়ে জুনিয়র লেখক হিসাবে কেরালা ভ্রমণ (২০০৪)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক “ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার” প্রাপ্তি (২০১০)। ‘ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা’ গল্পগ্রন্থটির জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত “সোমেন চন্দ স্মারক পুরস্কার” প্রাপ্তি (২০১০)। ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান “উত্তর বাংলা পদক” প্রাপ্তি (২০১১)। রুদ্রকাল সম্মান (২০১৩) প্রাপ্তি। কলকাতা লিট্ল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ গল্পকার সম্মাননা (২০১৩)।
শৈশব যাপন মাতুলালয়ে। রাখাল বন্ধুদের সংস্পর্শ। মাঠ-ঘাট, বন-বাদাড়ে টো টো ঘুরে বেড়ানো। সঙ্গে মাছ ধরা, পাখি মারা, ঘুড়ি ওড়ানো। কৈশর-যাপন পিতৃভূমি লালগোলা থানার মৃদাদপুর গ্রামে। সেখানেও রাখাল বন্ধুদের সংস্পর্শ। প্রান্তিক মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখা। কৃষিকাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। তারপর, ১৯৮৫ থেকে বর্তমান পর্যন্ত সীমান্ত শহর লালগোলায় বসবাস। বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেলামেশা। তাদের সঙ্গে আড্ডা মারা। বাহাদুরপুর মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে স্কুল-ছুট ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাদান আর গল্প লেখা সবসময়ের কাজ। বিবাহিত। স্ত্রী সাহানাজ বেগম (পলি), মেদিনীপুর শহরের মেয়ে। একমাত্র পুত্র ফারদিন ইসলাম (রোহিত)।
0 মন্তব্যসমূহ