কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
সেজদার ভঙ্গিতে নুয়ে-পড়া-বাড়িটির ওপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঝোপঝাড়ই চোখে পড়ে সবার আগে। নানা পদের লতা-পাতা, বাঁশঝাড় আর বেতের ঝোপই কেবল এলোমেলোভাবে বাড়ছে না, সজনে-ডাটাও পশ্চিমভিটার ঘরটার উপর হেলে আছে। চিকনচাকন হলদে-সবুজ পাতা টিনের চালে বিস্তৃত হচ্ছে কেবল। যেন জড়িয়ে-পেঁচিয়ে রাখে ঘরের চালাটাকে। আরেক বিস্ময় বাড়িটাকে সোহনপুরের জীবনপ্রবাহ থেকে একেবারে আলাদা করে; আর তা হচ্ছে, বাড়িটাকে ঘিরে থাকা গোঙানি আর এসবের মাঝে থাকা ঘ্রাণ। বহমান এ ঘ্রাণকে রোদ, বৃষ্টি, জোছনা কিংবা মেঘলা-নীরবতাও জব্দ করতে পারে না। এ-সবের মাঝেই ছমেদ মেম্বারের বৈঠকখানায় বাড়িটা ঘিরে বাড়িবিষয়ক গবেষণাতেই মজলিসটি ঝিমাতে থাকে।
বাড়িটি সোহনপুরের একেবারে শেষ মাথায়, তারও পরে আছে জলখেলি নামের শুকনা খটখটে নদী। এখন তাতে শীতের কুয়াশা-পেঁচানো জলধারা। বাড়িটা এভাবে দেবে যাওয়ায় এর অনেকটা অংশই আর দেখা যায় না। ক’দিন ধরে এই অবস্থা? কলিমুদ্দী এমন একটা হিসাব-কিতাবের ঝুঁকি নিতে গিয়ে রীতিমতো পেরেশানিতে পড়ে; নিজের স্মৃতির চারপাশেই ঘুরপাক খেতে থাকে। রইছুদ্দীর দুধরং-চামড়ার সোহাগী নামের সেই মেয়েটাও তার ভাবনায় ঘুরঘুর করতে থাকে। নিলাজ মাগীটার জাদুটোনা ধরনের ভাব থেকে বের হয়ে আসতে বেশ সময় খর্চা হয় তার। হুক্কার বেবাক ধোঁয়া হাড্ডি-দিয়ে-গড়া বুকটার পাঁজর শুষে নিবে যেন। হুক্কাটা ছমেদ মেম্বারকে বুঝিয়ে দেয়ার পর যখন ষোলআনা মজলিসটি তার চোখের আওতায় আসে, তখনও সে আগের প্রশ্নটির জুৎসই উত্তর বের করতে পারে না। ইসকান্দর মিয়া একরকম ঘুমের ভিতরই এককোনায় পড়ে আছে। হরিপদ’র মেজকাকা মনিন্দ্র সাহা যখন তামাম জায়গা-জমি বন্ধক রেখে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের পয়ষট্টির যুদ্ধের বছর আগরতলা চলে গেল, তার বছর দুয়েক পর থেকেই তো বাড়িটার এমন নুয়ে-পড়া-দশা। নাকি? তা প্রায় ৪০/৪২ বছরতো হবেই। এ বিষয়টা অত্র অঞ্চলে কে না-জানে? এ-সব কাণ্ড-কারখানা তো ঘটতে থাকল সোহাগী নামের মেয়ে আর তার বাবার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বালের মামলা সংক্রান্ত দিগদারিতেই । পুলিশ এবং তৎসংক্রান্ত ঝামেলা মজলিসের সবার মনে গেঁথে আছে এখনও। রঞ্জু এমপি’র বাবা সৈয়দ হায়দর আলীর একটা ইশারায় তামাম সোহনপুর তখন তছনছ করে ফেলল শালার পুলিশের গোষ্ঠী। এই যে হরিপদ, যে এই ভরা মজলিসে ছমেদ মেম্বারের একেবারে কোলের কাছেই বসা, সে ঠাকুরের কৃপায় এই বাড়িটার জলজ্যান্ত একটা হিস্টরি এক নিঃশ্বাসের ওপর ভর করেই বলে দিতে পারত। কিন্তু সোহনপুরের অতগুলো মানিলোকের সামনে সে অত কথা বলার মতো দমই পায় না।
মৌলবি কুতুবুদ্দীন নিজেকে কেন অত ঝিমুনির ভিতর লুকিয়ে রাখলেন! তিনি তো সোহনপুরের বড়ো পদের মুরুব্বি। জ্ঞানবুদ্ধি কিংবা বয়স, যে কোনো সাইড থেকেই ভাবা হোক, তিনিই তো এখন সোহনপুরের মাথা। জাফর চৌধুরীর বাপটা তো মরে গেছে ১০ বছর হলো। তাঁকে মাটিও দেয়া হলো ঢাকা শহরের মীরপুরে। তাহলে এখন তো সোহনপুরের তিনিই আসল গার্জেন। সেই তিনি কেন এমন রোগে-ধরা-মুর্গীর মতন ঝিমান? ছমেদ মেম্বার তো যোগ্য দাবিটাই করে বসে --কিয়ো মৌলবি বেডা, কী মেওডা* (রহস্য) কইন দেহি; অত উঙ্গাইন* (ঘুম-ঘুম ভাব) কেরেতে? সোহনপুরের একটা হক আচে না আফ্নের উফ্রে? বিষয়ডা কী? নাহি, চাচী রাইতে ঘুমাইতো দেয় না হিঃহিঃ? সমবেত হাসির কবলে পড়ে তার ঝিমুনিটা নড়ে ওঠে।
সেই ঝিমুনি ভাবটা কাটিয়ে উঠার পরই মৌলবি কুতুবুদ্দীনের নজরে আসে রইছুদ্দীকে। বারান্দার আন্ধার-খামচে দাঁড়িয়ে আছে সে। এবং মজলিসের অনেকেই সোহনপুরের গোঙানি টের পায়। এমনকি কলিমুদ্দী তার তামাকের নেশাসহ আঁতকে ওঠে। মজলিসটির ভাবনা এভাবেই আরও বিস্তৃত হয় এবং এ ঝিমুনিটা ক্ষণে ক্ষণে ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়ার বিষয়টাই যথার্থ বোধ হয়। তখনই একজন মুরব্বি কিসিমের লোক রইছুদ্দীকে একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে বাইরের দিকে নিতে নিতে চৌধুরীদের সেই বাড়িটার দিকে ঠেলে-ঠুলে পাঠিয়ে দেয়। এখন মজলিসটির স্মরণে রইছুদ্দীর বাড়িটার অবস্থান তাদের অস্তিত্বে জাগ্রত হয়। ওর বাড়িটা তো চৌধুরী বাড়ির দুইটা বাড়ি দক্ষিণেই। রইছুদ্দী তার চলে যাওয়ার ভিতর তার মেয়েটার স্মৃতিও যেন পুনরায় বিতরণ করে গেল! বাড়িটার কপালে তাহলে আরও বড়ো কোনো হিস্টরি অবশিষ্ট আছে। দুই-চার জন এই চান্সে তাদের ভিতর এ সংক্রান্ত বিচরণশীল খোয়াব ঝালাই-বাছাই করতে নেমে যায় -- আজাইরে চিল্লাইলে কী ফায়দাডা অইবো; আমরার সব কতা মন্অ থাহার কী দামডা আছে? একপয়সাদে দাম দে কুনু চেডের বালে! বাড়িডারে নিয়া রইছুদ্দী চাচার মাইয়া সুহাগীর নেশাডা মনে করেন অহন্অ আছে ষোল্লআনা। এমুন ক্যাপচার করুইন্যে মাইয়া আর কই আছে? নিজেগো ডরটার কতা চিন্তা করেন, পুলিশনি ফিরেকবার মাডি খুইদ্দে* (গর্ত খুড়ে) আসামি বাইর করে! অন্যজন পাশ থেকেই বলে ওঠে -- তাইলে বুদ্ধি কি? -- এইরহম গুইট্টেচালি* (নীরবে শলা-পরামর্শ করা) না-কইরে পুলিশের মুখ ঘুস-মুসদে লেইপ্যে দেওন দরহার। খতিবালী জানায় - রইছুদ্দির বুহে যে দাগাটা পড়ছে হেইডাও কেয়াল কইরো। এক আতে* (হাতে) কইলাম তালি বাজে না।
বাড়িটার জামিনদার ইসকান্দর মিয়া তবু মরা মানুষের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকে।
একসময় ছমেদের গলায় মজলিসটি কন্ট্রোল করার ঝাঁজ পুরোমাত্রায় প্রকাশ পেলে, তার সিদ্ধান্তের যাবতীয় ধরনকে পূর্ণমাত্রায় আনতে পারে। সে জানাতে থাকে, এখানে জমায়েত হওয়ার কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করতে পারে নুয়ে-পড়া-বাড়িটায় লেপ্টে থাকা অচিন ঘ্রাণকেই। এর তো একটা কূলকিনারা করা দরকার। তার কথাবার্তাকে একটা সিদ্ধান্তে আনার আগেই উত্তরপাড়ার জয়নাল ভিন্নমাত্রার কথা শুরু করে -- অততা ভাইব্যা লাভ নাই, লও যায় বসন্পুরের কানাই উহিলের বাড়িত। জাগা-জমির যে প্যাঁচ জানে হালার মালাউন, জজেও তাইনেরে ১০ বার বাপ ডাহে হাঃ হাঃ হাঃ। জয়নালের এমন বেতাল কথায় ছমেদের ভাবনা ফের থেঁৎলে যায় -- বাড়িটা তবে --ভেজাইল্যে-অই।
অনেকেই অধীর অপেক্ষায় থাকে মৌলবি কুতুবুদ্দীর পাক-মুখের দু/চারখান কথা শোনার জন্য। বাড়িটা কেমন ঝামেলার ভিতর আছে তা কি জানার দরকার নাই? নাকি মফিজ ফকিরকে দিয়ে রাত-গভীরে জিনের বাদশাহকেই নামাবে। ছমেদ মেম্বার একটা ইশারা দিলেই তো ফকির এক সেকেন্ডের ভিতর চলে আসত এখানে। মৌমাছির খেদমতগার তবে শেখ নইমুদ্দীন নিশ্চয় এর একটা কিনারা করতে পারবে। নিশিতে যার অত চলাচলতি, মৌমাছি নিয়ে যার অত কাজ-জারবার সেকি পারবে না ফালতু একটা গন্ধকে খালি-পড়ে-থাকা চৌধুরী বাড়ি থেকে দূর করতে? মৌমাছির একটা ঝামেলার বিষয়ওতো বাড়িটাতে আছে, তাহলে শালার মুখে কথা নাই কেন্? একটা ইশারায় দিক না!
সোহনপুরের এও এক নড়াচড়া মনে হয় যে; বলা নেই কওয়া নেই ৮/১০টা মৌচাকের শ শ মৌমাছির ভনভন করা শুরু করল বাড়িটা ঘিরে। এ কোন্কিসিমের আলামত? তাহলে শেখ নইমুদ্দীনের এখনও চুপচাপ থাকা শোভা পায়? মৌমাছি সংক্রান্ত সমুদয় ঝামেলার হেতু কী, তা এই শেখ নইমুদ্দীন ছাড়া আর কে জানে? এও তো এক কঠিন সাধনাই। হাসি-মশকরার বিষয় তো আর নয়।
মৌমাছির ওই বিষয়টি অতি শর্টটাইমে আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাত্র বছরখানেক আগে মৌমাছিবিষয়ক যে একটা আলামত দেখা যায় তাও তো শেখ নইমুদ্দীনেরই। তার দাড়িতে যে মৌমাছির চাষ শুরু হয় তা কি গায়েবি আলামতের ইশারা নয়? মৌলবি কুতুবুদ্দীনের কলেজ-পড়–য়া নাতিটা বাজিতপুর থেকে পত্রিকায় ছাপানো ছবি নিয়ে এসে তামাম গ্রামবাসীকে দেখায়ও -
দাড়ির স্থলে মৌ -চাষ
(নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত)
কিশোরগঞ্জ জেলার বহরমপুর থানাধীন সোহনপুর গ্রামের শেখ নইমুদ্দীন দীর্ঘ দেড় বছর ছয় মাস যাবত দাড়ির স্থলে মৌচাক চাষাবাদ করছেন। তিনি উক্ত পেশাকে জীবনযাপনের অঙ্গ করে নিয়েছেন। এ ঘটনায় অত্র এলাকায় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন শ’ শ’ মানুষ; আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা তার গ্রামের-বাড়িতে ভিড় করছে। এর ভিতরে কোনো মাহাত্ম্য আছে বলে স্থানীয় জ্ঞানী-গুণি ব্যক্তিবর্গ ধারণা করছেন। স্থানীয় ৬ নং হিলচিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তাকে একটা রূপার মেডেল উপহার দিয়েছেন।
লোকটাকে নিয়ে সোহনপুরে তখন বেজায় ফুর্তি। তারপর থেকে উক্ত শেখ নইমুদ্দীন ব্যাপক দাপট নিয়ে সোহনপুরের গপসপে* (গল্পসল্পে) হাজিরা দেয়। তার খাতির-প্রণয়ও বেড়ে যায় ম্যালাগুণ। মানুষটার দেহ-পিঞ্জিরায় কোন্কিসিমের রূহানি শক্তি ভর করেছে কে জানে। মফিজ ফকিরও যখন লোকটার পিছ্ ছাড়ে না তখনই এ সিদ্ধান্ত আরও জোরদার হতে থাকে যে, তার কলবে একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে। এমন আলামতের আওতায় পড়ে অনেকে এক্কেবারে বেকুব বনে যায়।
এদিকে শেখ নইমুদ্দীন পড়ে যায় আরেক মুশকিলে। কারণ সে তার দাড়িতে মৌ-চাষ করার বাসনাকে দীর্ঘজীবী করার আর সম্ভাবনাকেই জিইয়ে রাখতে পারে না। সদ্য-বিয়ে করা তার তিননম্বর বৌটা ডাইরেক্ট ওয়ার্নিং দিয়ে ফেলেছে এসব দাড়ি-মাড়ির ঝায়-ঝামেলা সাতদিনের মধ্যে শেষ না করলে সে এ সংসারের বুকে লাত্থি দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে। এরপরই শেখ নইমুদ্দীনের অন্য ঢঙের পলিসি শুরু হয়। পরিমল ছুতারকে দিয়ে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো বাক্সে ঢুকাতে থাকে মৌমাছিদের। এ কাজটিই বা সে কেমন করে করতে পারল? গৈ-গেরামে ঘুরতে আসা বেসরকারি কোন্ কম্পানির কাছে নাকি তার ট্রেনিং নেয়াও শেষ। কিন্তু অত তাড়াতাড়ি মৌমাছির মতো অবুঝ প্রাণীর সাথে তার খাতির-প্রণয় কী করে হয়! মৌমাছির সঙ্গে নিশ্চয় কোনো-না-কোনো রকমের জ্ঞাতিগোষ্ঠির সম্পর্ক থাকতেও পারে তার। কারণ এত খায়-খেদমত তো কেবল জ্ঞাতিগোষ্ঠির সম্পর্কের ভিতরই সম্ভব।
তারও পরে চৌধুরী বাড়িটাতে মৌমাছির এমন ভেজাইল্যে ঘটনার সূত্রপাত হলে আবারও জাফর আর সোহাগীবিষয়ক ঘটনা স্মৃতিতে ভাসতে থাকে অনেকের। সোহনপুরের এমন একটা জলজ্যান্ত ঘটনার তালে পড়ে অনেকের ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটে। বড়ো একটা কাণ্ডকীর্তি হয়ত-বা আবার শুরু হবে। যার জন্য ছমেদ মেম্বারের বাড়িটার সেই মজলিসেই এই শেখ নইমুদ্দীনকেই দায়িত্বটা দেয় শালার মৌমাছিবিষয়ক বেশতি* (বাড়তি) ঝামেলা থেকে তাদেরকে মুক্তি দেয়ার জন্য। মৌমাছিবিষয়ক ঝামেলাটার সাথে ঘ্রাণ কিংবা গোঙানির একটা স্পষ্ট সম্পর্ক অনেকে আন্দাজ করে। গোঙানি তো মৌমাছিদের যৌথ-কান্নাও হতে পারে। প্রাণীকূলের এ কৌশলটা নিয়ে তো শেখ নইমুদ্দীন ছাড়া আর কারও বাপেরও সাধ্য নেয় কিছু করার। অনেকে আবার এমন সন্দেহও করেছে এসব আসলে নইমুদ্দীনেরই কেরামতি নয় তো -- হালায় অহন মৌমাছি চালান দেওনের টেক্টিসও শিইখা ফালাইছে!
ছমেদ মেম্বারের বৈঠকখানায় ভরা মজলিসে শেখ নইমুদ্দীনও এমনই প্রতিজ্ঞা করে বসে -- মার্ত সাতটা দিন টাইম চাই; শালার পুতাইন্তেবাপ-বাপ করনের টাইম পাইতো না। মানুষ চিনে না অহন্অ।
ছমেদ মেম্বারের বড়োছেলেটা বলে ফেলে -- আরে কী কইন, মৌমাছি খেদাইতে সাতদিন লাগেনি? শেখ নইমুদ্দীন তখন ঠোঁটের কোনায় ঝিরঝিরে হাসি লেপে দেয়ার ভিতর বলে -- মিয়ার পুত, মনে কইরেন এমুন বিটলা মৌমাছি তামাম ময়ালে নাই, টাইম ত একটু লাগবোই।
এবার বাড়িটা ঘিরে মৌচাকের কাহিনী বাড়েই। রইছুদ্দীর মরে-কাঠ-হয়ে-যাওয়া মেয়েটার কোনো লীলাকীর্তন নয়-তো এ-সব? এমন স্মৃতির ভিতর চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে পড়া রক্তের টাটকা গন্ধ পায় কেউ কেউ। এ গল্প সোহনপুরেরই। কী যে তরতাজা আলামত! শেখ নইমুদ্দীন একলা সাহস না-করতে পারলে মফিজ ফকিরের সঙ্গে যুক্তি-পরামর্শ করে একটা উপায় বের করুক। জিন-পরী বা জাদুর খেলায় সারা সোহনপুর বেঁধে ফেললে কেমন হয়? কিন্তু শেখ নইমুদ্দীন যে কিছুই বলে না; ঠোঁটের কোণের হাসিটাকে প্রলম্বিত করে মাত্র।
বাড়িটি ঘিরে ধীরে ধীরে যা বাড়তে থাকে তাকে বলা যায় ভয়। এর আশপাশ দিয়ে কেউ হাঁটতেই চায় না। এমনকি এসব স্মৃতির ভিতরও যেন কেউ থাকতে চায় না। সোহনপুরের বুক বরাবর যে রাস্তাটা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সঙ্গে মিশেছে তার পুরোটা শুরু হয়েছে এ বাড়িটা থেকেই। এখন কি তবে চৌধুরী মোহাম্মদ সুনতানুল করিমের নামের মাহাত্ম্য নিয়েও কারও কারও ভিতর কথা চালাচালি শুরু হবে! এখন কি অচিন কোনো ভাবনা চলাচল করে? পেরেশানিতে পড়ে মৌলবি কুতুবুদ্দীন কিংবা শেখ নইমুদ্দীন? ছমেদ মেম্বার পর্যন্ত বাড়িটা থেকে ৫০ গজ দূর দিয়ে ঘুরে জলখেলির ব্রিজটাতে ওঠে। ওই ব্রিজে ওঠার রাস্তাটাও এখন শুরু হয়েছে ছমেদ মেম্বারের বাড়ি থেকেই।
শেখ নইমুদ্দীন প্রথমেই সেদিন কড়া লিকার দিয়ে চা খায়। কিমাম, জর্দা আর শুকনা সুপারি দিয়ে পান খাওয়ার পরও তার লাইগ* (নেশা নেশা ভাব) লাগে না। মাথার ঝিমঝিম ভাবটাই তাকে ছাড়ে না। অনেকক্ষণই সে তার নিজের ঘরের বারান্দায় বসে থাকে। শালার জিবে দশ-পর্দার ভাঁজ পড়ল কিনা? তার বউটা কতক্ষণ প্যানর-প্যানর করতে করতে মেয়েটাকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। বাঁশঝাড় থেকে পেশাব করে এলেও ভিতরের ঝিমধরা ভাবটা যায় না। ধীরে ধীরে মৌচাকের বাক্সগুলোর কাছাকাছি যায় সে। ঘুমের প্রলেপ টের পায়। এখন নাক-মুখ-বুকে গুনগুন করতে থাকা মৌমাছির সুর শুনে। গেছো-মৌমাছির পেট-শুড়, হাত-পা -পাখা এমনকী ফুলের রসের গন্ধ টের পেতে থাকে শেখ নইমুদ্দীন। মৌমাছির মধু জোগাড়ের সিজন সে বাতাসের তেজ শুঁকেই বলে দিতে পারে।
এখনও তার চোখে ময়লা-পেঁচানো ঘুমের রেশ লেগে আছে। একসময় সেই রেশও ছিঁড়ে যেতে থাকে। মাঝরাতের বারান্দাটা যেন ঘুমায়। বারান্দাঘেঁষা তিনটি বাক্সও নীরব। অন্ধকারের গন্ধ চেখেই বেরয় সে। বড়ো বেতাল ঘ্রাণ চারদিকে। কোত্থেকে আসে এ-সব। মৌচাক থেকে তো নয়ই -- তবে? নাকি রানিমা’র মিলন-পর্ব চলছে এখন? তীক্ষè গন্ধ ধরেই সে চলে একসময়। নাকি গন্ধটিই তাকে শনাক্ত করে ফেলল? এই গন্ধই তাকে ঠেলতে ঠেলতে সেই বাড়িটার বুক বরাবর এনে দাঁড় করাবে?
মিঞা বাড়ির গোরস্থান ডানে রেখে বাঁশঝাড় আর প্রাচীন বটগাছটা ছাড়িয়ে জলখেলির একটা চিকন শাখা পেরিয়ে উত্তরমুখো হাঁটতে থাকে শেখ নইমুদ্দীন। সারাটা রাস্তায় বিছানো জোছনা-ভেজা ওমে ভিজতে ভিজতে নুয়ে-পড়া-বাড়িটার এক্কেবারে কাছাকাছি চলে আসে। এখন কি বাড়িটার কলবের কিনারায় পৌঁছে গেল? কী যে রূপ-বদলের পালা চারদিকে। এবার তবে গন্ধের ভিতরের আরেক গন্ধ তাকে পথ দেখাবে!
রইছুদ্দীর মেয়েটার কাজ-কাম নয় তো এ-সব? সেই মাগীই কেবল এত রূপ-বদলের কাজ করতে পারে। শেখ নইমুদ্দীন তার কুলুকুলু ঘামের ভিতর এমনই বুঝ-পরামর্শের ভিতর ঘুরপাক খায় ফের। মেয়েটা মরে গেল তো দশ বছরের কম হয়নি। এখন এই অতদিন পর এভাবে বাড়িটাতে জব্দ করে রাখে কোন্মুখে। সোহনপুরের কোন্ কেচ্ছাকাহিনী ধরে যে মেয়েটা চলে। সে-ই গন্ধ বিলায় এমন অন্ধকারে? কোন্ শিথিল-বসনার শাড়ির খসখস আওয়াজ তার গোছানো ভাবকে আউলাঝাউলা করতে থাকে! জেনানা-কাতর অন্ধকার ধরে তবে রইছুদ্দীর মেয়ে সোহাগীই হাঁটছে কিনা! পাঁচব্যাটারির টর্চলাইট দিয়ে দক্ষিণের আমগাছের মৌচাকটি শনাক্ত করতে গিয়েই পড়ে বেতাল ঝামেলায়। শেখ নইমুদ্দী কেন সেই গাছটা থেকে নামে আর কেনই-বা কাঁপতে-কাঁপতে, দৌড়তে-দৌড়তে অতরাতে ডাইরেক্ট নিজের বাড়ি চলে যায় সেই বিষয়টা সোহনপুরের অনেকের কাছেই পৌঁছে পরদিন সকালেই। তার গতরাতের সোঁ-সোঁ শব্দ এমনকি হাঁপানি রোগীর মতো সাই-সাই শব্দটাও সারাটা গ্রামে অতঃপর ছড়িয়ে দেয় কেউ কেউ। বুকের মাঝখানের ধুকপুকানিটা যেন কেউ ছড়াতে থাকে। এমন চমকে-যাওয়া-বিষয় সোহনপুরকে দীর্ঘদিন আন্ধাচক্করের ফেলে দেয়। এই বিষয়টাও কেউ স্মরণ করে, জোছনার ওমে-ভেজা এ কান্নার বয়সও ১০ বছরের কম নয়। শেখ নইমুদ্দীনের বাড়িতে ক্ষণে ক্ষণে জড়ো হতে থাকা জটলাসমূহকে বুঝাতে থাকে বাড়িটার মৌমাছিগুলো সেই কান্নারই অংশ।
এভাবেই সোহনপুরকে বিভোর করে রাখার গল্প ক্রমান্বয়ে বি¯তৃত হয়। এমনকি অবুঝ পেরেশানিরও অংশ হয় এ-সব। কারণ অনেকেই বিষ্টিভেজা রাতে কিংবা ঝমঝমে পূর্ণিমাতেই শুধু খেয়াল করে না, অন্ধকার কিংবা ফকফকা জোছনায়ও বদলে-যাওয়া-বাড়িটার হুহু কান্নার সুর শুনতে থাকে। কান্নার জবজবে ঝাঁকুনিতে বাড়িটিও একসময় ঘামতে থাকে।
. . .
দশফুট উঁচু যে প্রাচীর তাই আসলে পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণের তিনটা ঘরকে পেঁচিয়ে রাখে। বাড়িটার মেইন-গেইট কখন বন্ধ হয় আর কখন খোলে, এ গ্রামটির অনেকের কাছেই তেমন স্পষ্ট নয়। ইস্কান্দার মিয়া এরই ভিতর মাঝে মাঝে ঢুকে এবং বেরও হয়। এমনই আলামতের ভিতর বাড়িটার বয়স বাড়তে থাকে। ছমেদ মেম্বার, হরিপদ, মৌলবি কুতুবুদ্দিন, কলিমুদ্দী এবং শেখ নইমুদ্দীনের চোখের সামনে বাড়িটার দুর্গতি ক্রমশ বর্ধনশীল হয়। ঝোপঝাড় জঙ্গলে রূপ নিতে থাকে। চৌধুরী সাহেবের একমাত্র ছেলের একমাত্র নাতি কি আদৌ আসবে সোহনপুরে? ছমেদ মেম্বারের মন-মনুরায় সেই বিষয়টার একটা ফয়সালা করার বাসনাই ঘুরপাক খেতে থাকে।
শেখ নইমুদ্দীনের প্যারপ্যারানিতে আবারও ছমেদ মেম্বারই মজলিসটা বসায়। আবারও সেই কথাটাই ছমেদ মেম্বার বলে-- বুঝ্যো মিঞারা, মানীর মান আল্লায় রাহে। একটা বিষয় বিবেচনা কইরে দেহো, দুই পয়সার রইছুদ্দী, জোরে একটা পাদ মারলে যার কইলজা কাঁইপ্যে ওঠে, হেই বান্দির পুতে কত লেজালতিডা লাগাইছিন্। তে, কী লাভডা অইলো। চৌধুরীরার বালডি ছিঁড়তে পারল? কিচ্ছু অইল? ৩০২ ধারা, মাডার কেস; ধূলার মতন উইড়া গেল না? কাম একটা করলেই চলে? কই মহারানি আর কই চুৎমারানি হাহাহা। অতই যুদি পাওয়ার তর, তে নিজের মাইয়াডারে খুডা মাইরে রাখলে না কেরে? চৌধুরী বাড়ির বেয়াই অউনের অত শখ কেরে? পরে পুটকিত চেপ্টা কেমুন পড়ল?
ধরতে গেলে সবকিছুই ছমেদের বিবেচনার ভিতরে রাখতে হয়। সোহনপুরের মানুষজন কী বেহুদা মেম্বার বানিয়েছে তাকে? দশজনের দোয়ায় আর আল্লার রহমতে দেখেশুনে চলতে পারে সে। পাঁচটা দিন আগেই সে জাফর চৌধুরীর সঙ্গে ঢাকার অফিসে দেখা করে এল। ইস্কান্দর মিয়া না হয় বাড়িটাই দেখাশুনা করল; জাফর চৌধুরীদের অংশের অত জায়গা-সম্পত্তি কে দেখবে? -- জাফর বাবাজী এইটা খুব বিশ্বাস করে ঘরের চাইয়া পর ভালো। তাইনেরার কি বালের ঠেকা পড়ছে ছাতার এই সব সহায়-সম্পত্তির খুঁজ-খবর নেওনের।’ লেনদেনের একটা ব্যাপার আছে না? তা না হলে কি দায়িত্বটা সে পালন করল? এই বাড়িটার ইজ্জত মানে সোহনপুরের ইজ্জত; তা হলে এর তত্ত্ব-তালাশি তো তাকে করতেই হয়।
তবে এ কথাটা ঠিক, এমনকি আশ্চর্য হওয়ারও বিষয় -- স্বর্ণলতার মতো বাড়িটার নির্জনতা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। সোহনপুরের গুপ্ত-কোলাহল যেন বাড়িটাতে উপছে পড়ে। ছমেদ মেম্বার বারবার কেবলই বুঝ-পরামর্শের ভিতর ডুব দেয়। আশপাশের মানুষজন এতে যোগ দেয় ক্রমশ। ঝোপঝাড়, শ্যাওলাভেজা ছায়া, মৌচাক আর কদিন আগে রাত-দুপুরে শেখ নইমুদ্দীনেরর কাঁপুনিসহ লম্বা-চওড়া দৌড়; সবই রইছুদ্দীর মেয়ে সোহাগীর স্মৃতির সাথে জড়িয়ে যায়। সবার ভিতর এ বিষয়টা পাকাপোক্ত হয়, তাহলে বাড়িটার উজান-ভাটি, সুখ-সুবিধা, ভালো-মন্দ দেখার ভারটা তো একতরফাভাবে ছমেদ মেম্বারের ওপরই পড়ে। জাফর চৌধুরী আর-কী করতে আসবে এখানে? শালার এই গৈ-গেরামে মাত্র ২/৪ দিন মান-ইজ্জত নিয়ে থাকার কোনো জো আছে? ছমেদ মেম্বার তো সেই কথাটাও জাফর চৌধুরীকে বুঝাতে পেরেছে। রইছুদ্দীর বেশরম মেয়েটা সেই মুখ কী আর রেখেছে? নিজে তো শেষ হলোই, চৌধুরীর বাড়ির অংশীদাররা একহিসেবে দোষের ভাগীদার হলো। এর সবকিছুই সেদিন মেম্বার হিসেবে নিজের মুখে বুঝিয়ে এসেছে। আর এত বোঝাবুঝিরই-বা কী আছে, শেখ নইমুদ্দীনের কেসটা কি মিছা? জাফর চৌধুরির চাচাত ভাইটা নাকি কাকে কাকে বলেছে এ-সব ছমেদের কারসাজি? তখন ছমেদের কী করতে ইচ্ছা করে? এমপি’র লোক দিয়ে ওকে একটা ধোলাই দিলে ভালো করত। এ-সব তো এখন এ ভরা মজলিসে দশজনের সামনে আলাপই করা যায় না। আর বাড়িটাকে গন্ধের ভিতর যে দেও-দানবে ঢিল-উল মারে এর মাজেজা কী? একটা পয়েন্টও বাদ দেয়নি সে। তবে একটা বিষয় তার মাথায় ঢুকেনি; এবার তার কথা তেমন আমলেই নেয়নি। বাসার সামনের অংশে সুন্দর সুন্দর গাড়িতে ঠাসা। শাদা চামড়ার লোকগুলোর সাথে কী যে এত কথা বলে আর ভ্যাক-ভ্যাক করে খালি হাসে।
. . .
কিন্তু এমপি গত পরশুদিন কী এক আজগুবি পয়েন্ট তুলে বসল। তাও তাকে বাড়ি থেকে জরুরি খবর দিয়ে বহরমপুর নিয়ে এমন গোয়াটা মারল? কোন জাতের ইশারাটা দিল -- কিয়ো মেম্বরের ঘরের মেম্বর, বাড়িডার খাতির-প্রণয় চলে ত ঠিক মতন?
ছমেদের সারাটা মাথার ভিতর একটা চক্কর মারে। আর কিছু না-চিনলেও এমপি’র এমন ইশারা সে ঠিকই চিনে। ঝিরঝিরে ঘাম কপাল ফেটে বেরোতে থাকে। শালার এমপি’র চোখ কতদিকে! তার পরও তাকে জিজ্ঞেস করতেই হয় -- কেরে কী অইছে ? কুনু বেয়াদবি পাইছুইননি হেইডা কইন আগে? তার এমন কথার জুতসই স্কোপই নেন এমপি.-- আরে মিঞা খালি আমি, ব্রিটিশ-আমেরিকা এই বাড়ির তত্ত্ব-তালাশি করতাছে। তোমরার সোহনপুর দেখবা মাইয়ামানুষ আর কারেন্টের ঠেলায় খালি নাচব। -- কেন্ কি অইছে কইবাইন
ত? -- আরে ধুর মিয়া, কথা ছোডো করো, বাড়িডারে খায়-খাতির করো আগে, উল্টাসিধা পাইলে পাছার চামড়া থাকত না। আগরম-বাগরম যা আছে; সব কাইট্টে সাফ করবা। দুইদিন টাইম পাইবা; লুঙ্গি খুইল্লা দৌড় লাগাও।
এর মাত্র ১০টা দিন পরেই সারা সোহনপুর চমকে ওঠে। কত-কিসিমের মানুষ যে বাড়িটার চারপাশে গিজগিজ করা শুরু করে। গাড়ি, লোক-লশকর, বাচ্চা-কাচ্চাদের চিল্লাহল্লাতে চারপাশ ভরতে থাকে। মানুষগুলোর কী স্বাস্থ্য। শাদা-চামড়ার মানুষ এ গায়ে আসার মাহাত্ম্য কী? সোহনপুর রীতিমতো চমকে ওঠে। সোহাগী মরে যাওয়ার পর আর অত মানুষ আর দেখেনি সোহনপুর। অত মেয়েছেলের আমদানির কারণ কী? মৌলবি কুতুুবদ্দীনের কাছে ছমেদ এই তথ্যটাই জানতে চায়, কেয়ামতের আর কদিন বাকি। বাঁচার উপায়টা কী? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ছমেদ মেম্বারই এ কিসিমের কথাবার্তাকে আর বেশিদূর বাড়তে দেয় না। শুধু তার নয়, অনেকেরই মাগীদের মোটর সাইকেলের এই ভটভটানিতে ওজু পর্যন্ত হালকা হয়ে যায়।
এই বিষয়টা অনেকের সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক’ঘণ্টা বাংলাদেশে থাকবে, তার বউ সাথে থাকবে কিনা? বেডার নাকি স্বভাব-চরিত্র অত সুবিধার না। তাহলে মনে হয় প্রেসিডেন্টর বউও নিশ্চয় সঙ্গে থাকবেন। এমন একটা বেলাইনের মানুষকে বউ হয়ে কী করে একলা ছেড়ে দিবেন? বউটার কী একলা থাকলে ঘুম হবে ? এমন কাফের-নাসারার দল আল্লার অত কাছে থাকেন কী করে? তাদের ১০/১২ বছরের মেয়েটা নাকি এখনই মায়াবড়ি খায়? তৌবা তৌবা! রইশ্যের মা পর্যন্ত এ নিয়ে কথা চালাচালি থেকে গা ঢলাঢলি পর্যন্ত করে। তামাশা পেয়েছে শালারা। শেখ নইমুদ্দীন এসব নিয়ে ম্যালা পেরেশানিতে পড়ে। মৌলবি কুতুবুদ্দীনকে জানায় সেসব -- চাচা, দিন দিন দ্যাশটার কি অইলো? চৌধুরির পুংডা নাতিডা দ্যাশটাত ফিরে আইবো বুলে? দ্যাশটা তাইলে কাফের-নাসেরাগো কন্ট্রোলে চইলা গেল? রইছুদ্দীরে দে একটা তামাদি কেস করলে কেমুন অয়? আইচ্ছা, ওই শালার জাফইরেরে আল্লা একফোঁটা শরমও দেয়নি ! দেশের মাইনষেরে মুখটা দেকাইবো কেমনে?
. . .
একসময় আড়মোড়া ভাঙে বাড়িটার। ঝোপঝাড় নড়ে ওঠে। নীরবতা কাঁপতে থাকে। অতঃপর শ্যাওলা-পেঁচানো ইট ফরফর করে ঘষামাজা চলে। দেয়াল, ছাদ, মেঝে আর চারদিকের রং পাল্টাতে থাকে। আলোর রোশনাইয়ে কাঁপে সোহনপুর। এমনকি পল্লিবিদ্যুতের বিলিবণ্টনও শুরু হয় এই বাড়িটা থেকেই। শীতাতপের পরশ আসে একসময়। শাদা মিহি আলোর ঝলকানি লাগে বাড়িটাতে। এমপি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কন্ট্রাক্টরের লোকদের একদারসে গালিগালাজ করতে থাকে। ঝোপজঙ্গল সাফ হয় একে একে। বাড়িটার তামাম ঢঙ বদলে যায় ক্রমশ। মৌচাক আচানক ভাবগতিকে নড়েচড়ে ওঠে। আলোর তাপ যেন ওরাই শুষে নিবে। আলো কেবলই বাড়ে - চারপাশে আলোর ঝলকানি লাগে। পি.এম. (প্রজেক্ট ম্যানেজার) ফের ঝানুত্ব প্রমাণের কায়দাকানুনে নিজেকে নিয়োজিত করে এভাবে -- শোনেন পি.সি. (প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর) সাহেব, যা বলছিলাম আর-কী, লেফটিস্টদের সঙ্গে আমাদের ডিফরেন্সটা ধরতে পেরেছেন তো? এখানে তিনি তার স্বভাব-নির্ধারিত কায়দায় থামেন। চুপচাপ থাকেন কিছুক্ষণ। পি.সি. জাফর চৌধুরী তার নির্ধারিত কায়দায় চুপ থাকেন। আবারও পি.এম. সাহেব তার কথা শুরু করেন এভাবে -- মূল বিষয়টা হচ্ছে, ওরা যা বলে তা করে না। আর আমরা যা বলি তা কাগজে-কলমে দেখিয়েই ছাড়ি হাঃ হাঃ হাঃ। গণমানুষের দুয়ারে দুয়ারে যেতে হবে। ওদের কথা থাকার কোনো স্কোপই রাখা যাবে না। জাস্ট নক এ্যাট দি ডোর। জাফর চৌধুরীরও বোঝা হয়ে গেছে মাইক্রোক্রেডিটকে নিয়ে তৃপ্তিষদার মতো বাম নেতারা যতই চিল্লাপাল্লা করুক, মহাজনী ব্যবসা বলুক, আসলে এসব ছাড়া এদের উপায় নেই; হারামজাদা নিুবিত্তের ব্যাকবোন বলে কিছু আছে নাকি।
গেইটটি এত মোলায়েম আর নিঃসঙ্গভঙ্গিতে বন্ধ হয় যে, জাফর নিজেও চমকে ওঠে। তিনজন গেইটম্যান আর তাদের স্ত্রীরাও কী তবে নির্জনতারও অংশ? কর্মকর্তারা একসময় উঠান পেরোয়। তাদের পায়ের হরিণের শু’র ছাপ মিলিয়ে যায়নি তখনও। বাড়ি পয়-পরিষ্কারের পানি তখনও গেইটটার মুখ ছাড়িয়ে যায়নি। কতদিন পরে জাফর চৌধুরী ঢুকলেন বাড়িটাতে? ১০ বছর!!! তার বউ ন্যান্সি আর ছেলে প্রসূন যতই কাঁই-কুঁই করুক তাদেরকে কী করে এখনই আনেন তিনি? পশ্চিমভিটার ঘরটার দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল? ভিতরের জমাট-বাঁধা বাতাস আর দেয়ালের স্যাঁতসেঁতে ঘ্রাণ কোত্থেকে এল? এত ভেজাভেজা কেন ভিতরটা? কুকুরের নাকের মতোই শীতল চলাচলতি তিনি টের পান! মৃত্যুচিহ্ন নয়-তো? তার হাতের পোর্টফোলিওটা এত ভারী কেন? মরার মতো এটি একসময় জাফরের হাত থেকে শুয়ে পড়ে সোফাসেটের সামনের লম্বা টেবিলটাতে। এখন এটিতে হাত রাখতেই বুকের পাঁজর শিরশির করে ওঠে। শীতল-ভরাট গন্ধে চারপাশ ভরে যায়। পি.পি.(প্রজেক্ট প্রোপোজাল)’র চাপেই কি এর ওজন বেড়ে গেল? নন-ফর্মাল এডুকেশন, পাবলিক হেল্থ্, রুরাল স্যানিটেশন, লিগ্যাল এইড, মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রাম, এমনকি রেন্ট-এ কারের পি.পি.টাও তো আছে এর ভিতরেই।
আবারও এ কোন্ ছায়ার গন্ধ?
ডিনারের অ্যারেঞ্জমেন্টটাও এলোমেলো লাগে। ভেজিটেবল স্যুপ আর চাইনিজ চিকেন ফ্রাইটা পর্যন্ত চাখতেই পারল না। পেটে কিছু না-পড়লে কী করে চলে, সামনে সারাটা রাতই তো পড়ে আছে। আবারও এ কোন্ ঘ্রাণ নাকের গভীরে ধাক্কা মারে! বাতাস কী ভেজা-ভেজা। বাড়িটাতে এরই মধ্যে তিন-তিন বার খতম পড়ানো হয়েছে বলে তার নলেজে আনা হয়েছে। এরপরও বদ-আত্মার ইশারা আসে কোন্দিক থেকে? আরে ধুর, কিসের ভয় কিসের কী? কিন্তু কেয়ার টেকার ইস্কান্দর চাচা এ কেমন গুনগুনানি শুনিয়ে গেল। কী সব আলামতের কথা শোনায়! এসব সুপার্র্র্স্টিশনকে পাত্তা দিলে চলে? কিন্তু এমন নীরবতার ভিতর পড়ে এ-সবকে তো অগ্রাহ্যও করতে পারছেন না তিনি। টানা ১০টা বছর তো সে-ই বাড়িটার দেখাশোনা করল। কিছু একটা না-পেলে কেন এ-সব বলতে যাবে -- বাবাজী আমার কথাখান একটু বিবেচনা কইরেন। আফনেরা টেডি-যুগের মানুষ; কিন্তু ময়-মুরুব্বির কথা একটু বিবেচনায় রাখতে অইবো। হেই রুহুখান (এ যে সোহাগীর কথাই বলা হলো তা জাফর বুঝতে পারছে) মনে কয় অহনো সরে নাই। বহুত খতরনাক মেয়েছেলে। আইজও মনে কয় হে-ই বাড়িখান ক্যাপচারে রাখছে। মাইয়াডার আন্দাজ-বরাদ আল্লা-পাক শর্ট কইরাই দিছে। এ কথাগুলো তিনি এত আস্তে-আস্তে বলেন যেন এই খবরটার ভার বহন করতে-করতে তিনি এক্কেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। এই নিুস্বরের ভিতরই তিনি জাফরকে বহরমপুরের ডাক-বাঙলোয় রাতযাপনের পরামর্শ দেয়া শুরু করে। কিন্তু আজ সে সরবে না। হয়ত-বা গন্ধের ভিতর অতিচেনা কোনো গন্ধ তাকে আটকে দিচ্ছে ।
এখনও ঘরটার এ অংশে মাকড়সার জালটা আছে! মাকড়সার বুকটাতে সোনালি দাগটাও আছে!! কী আশ্চর্য!!! এরা কি জন্ম-জন্মান্তর অদল-বদল করতে জানে? কোন্ পদের জীব এ-গুলো? কতদিন বাঁচে? ২/৩ বছর? নাকি ৫/৭ বছর? আরও বেশি? জালটা যে দিনকে-দিন বড়োই হচ্ছে। কিন্তু তার চোখের সামনেই তো হেকিম চাচার বড়ো মেয়েটা তামাম বাড়িখান ঝাঁট দিল -- এরপরও এটা এখানে থাকে কী করে? এর পেটটা কী নরম! কী তাজা! এমন আদুরে চলাচলতি কি তার হাতে উঠে আসবে?
ঘরটা কি আবারও কাঁপে? ব্যাপার কী! দেয়ালটা যেন সোহাগীর জেনানা-কাতর শিৎকারের তাপেই নড়ে! তার গলায়, বুকে, পেটে চোতমাসের নোনতা তাপ লাগে। বুকের সারাটা অংশ যেন তিরতির করে কাঁপে।
. . .
চিঠি লেখা নিয়ে সোহাগীর সে-সব দিনের এমন আকুল প্যারপ্যারানি জাফরের আজও ভালো লাগে না। তার তখন অত সময় কোথায় ছিল যে অক্ষরের পর অক্ষর বসিয়ে চিঠি লিখবে। টাইপিস্ট কাম এলডি ক্লার্ককে ডিক্টেশন দিয়ে দিল, ব্যস সে কম্পিউটারে পুচপুচ করে একখান পত্র বেরিয়ে এল। তারই জন্য এখন হাজারটা প্রশ্ন, এমুন দরখাস্ত একটা লেখার কী দরকারটা পড়ল পত্রে আমার ভালোবাসা নিয়ো, এইটা কুন্ ধরনের সেন্টেন্স? বাড়ি লিখতে আবার ঈ-কার কেন? রোদ্দুর কী করে রৌদ্র হয়ে গেল?
মেয়েটার কথার কী ঢঙ -- জাফর ভাই, ধইরা দেহো মাকশ্যার শইলডে কী নরম। কী কারিগরি শরীলটার মদ্যে আটকাইয়া রাহে !
তুই অত বুজোছ কেম্নে? ওই ছেড়ি কেমনে বুজোছ?
এইডা বুঝনের কী অইলো। আল্লারে, কী ত্যাল মাখাইন্যে শরীল- দেকছো?
সোহাগীর শরীরব্যাপী হাসি ছড়াতে থাকে। তার ঠোঁট, নাক, মুখ, বুক, চুল, পেট এমনকি শরীরে জমিয়ে রাখা অঙ্গের সারাটা ঘ্রাণ জাফরকে দখল করতে থাকে। তার গলায় পড়িয়ে দেয়া নেকলেসটা জাফরের স্পর্শ পেয়েই অনবরত দ্যুতি বিলায়। এর দানাসমূহ ধূসর থেকে সোনালি রং ছড়ায়। দুটি মানুষের নুন-কাম গন্ধের তাপে নেকলেসটায় জীবনের আরেক স্পন্দন আসে । শরীরের আকুলতা বাড়ে। সর্বাঙ্গে নোনতা ঘ্রাণ হয়ে ওদের কাঁপায়। একসময় ওদের শরীরে নগ্নতা ছাড়া আর কোনো আব্র“ থাকে না।
তারও পরের কোনো একদিনের কথা এ-সব -- জাফর সেদিন কম অবাক হয়নি। এমন আজগুবি ব্যবহারের কী মানে থাকতে পারে! যতই সোহাগী তার ছোটবোন বিন্দুর ক্লাশমেট হোক, ক্লাশ টেনে পড়ুক, রোল নাম্বার এক হোক, সাইন্সে পড়–ক; বাড়িটা ওদের থেকে মাত্র দু’বাড়ি দক্ষিণে হোক, ফুরুত-ফুরুত করে দিনের ভিতর একশ বার তাদের বাড়িতে আপ-ডাউন করুক, তাই বলে আম্মার চলাচলতি খেয়াল না-করে দিনে-দুপুরে পট্ করে দরজাটা বন্ধ করে দিবে!
বিকেলের রং কফি-কালার থেকে ছাই রং পরিপক্ব হয়। খাটের কিনারাটা ঘেঁষে ঘেঁষে তার দিকে এগোতে থাকে সোহাগী। আর এক্কেবারে কানের কাছাকাছি চোখ রেখে তার শরীরের বৃত্তান্ত বলতে থাকে। জাফরের কপাল ফেটে বিনবিনে ঘাম ঝরতে থাকে। কিন্তু ভাবনাবিষয়ক এ জটিলতায় ঘুরপাক খেতে হয় না তাকে। এটা কি নতুন শতাব্দীর শুরুতে কোনো ভাবনার বিষয় থাকতে পারে? আর এ ধরনের মাসিক-সংক্রান্ত ঝামেলা সোহাগীর এটাই তো প্রথম নয়। আগেও তো একবার ওয়াশ করালো। এখন স্বরসতীর মা’র কাছে চলে গেলেই তো চলে। আর ঢাকা যেতে চাইলে, না হয় নিয়ে যাবে একদিন। কচুরিপানার মতো, শীতের শাক-সব্জির মতো কত ক্লিনিক গজিয়েছে। শুধু এম.আর., ডি. এন্ড সি. করে তার বন্ধু ডা. জিন্না বিল্ডিং পর্যন্ত করছে। সোহাগীর এমন ত্যাদরামো একদমই সাপোর্ট করতে পারছে না সে। এবার নাকি ওয়াশ-টয়াশের ঝামেলায় যাবে না। কী আশ্চর্য! মেয়েটা এখন মশগুল হয়ে আছে শিশুজন্মের সৌন্দর্য নিয়ে।
একসময় সোহাগীর শরীরে আরও এক মানবজন্মের বি¯তৃতি ঘটতে থাকে। সারাটা শরীর বলতে গেলে তলপেটের খালি জমিনে দখলিস্বত্ব বিস্তার ঘটাতে থাকে। ঝিমঝিমে জোছনা কিংবা ঘনকুয়াশার অন্ধকার নিজের শরীরটার ভিতর আরও এক সওদা করে বেড়ায়। ভয় আর লজ্জার ভিতর সোহাগীর সময় পার হয়। জাফর ভাই কি এর একটা মিলমিশ করবে না? নিশ্চয়ই একটা কিনারা করবে। ঢাকা থেকে তো অচিরেই ফেরার কথা তার।
কিন্তু বেহায়ার মতো, পাষাণের মতো তলপেটের দলাটা যে বাড়তেই থাকে। অবশেষে এটাতে নড়াচড়াও শুরু হয়।
. . .
পশ্চিমের ঘরটা এখনও শুধু জাফরকে নিয়েই আছে। টেবিল থেকে পোর্টফোলিওটা নিয়ে বসে। তার ভিতরে যেন জাফর নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস টের পায়। হোমওয়ার্ক তো করতে হবে। সোহাগীর বেশরম ভাবনা নিয়ে পড়ে থাকলে চলে? সিনিয়র কন্সালটেন্ট প্রফেসর ছগির তো প্রজেক্ট ওপেন করেই খালাস, এখনতো তাকেই সব ম্যানেজ করতে হবে। নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করা অতই সোজা । কমসে-কম ২০টা মেয়ে ট্রেনিংয়ের যাবতীয় বিষয়টা তো তাকেই দেখতে হবে। অতগুলো কাজ সামলানো কী যা-তা ব্যাপার।
এই রুমটার পিছনে আছে আরও দু’টি রুম। ও-গুলোতেই এসব কাজ-কাম সারবে? নাকি পূবদিকের ঘরটায় মেরামত করিয়ে নিবে? লিগ্যাল এইডের প্রোগ্রামটার একেবারে ভিতরে ডুব দেন তিনি। এই ফাইলটাই আগে কোয়েরি করতে হবে।
রাত বাড়ে। নীরবতা দানা বাঁধে চারপাশে। রুমটার ভিতরে কেউ হাঁটছে নাকি? থপথপ শব্দ আসে কোত্থেকে? গায়েবি কোনো কোলাহল বাড়িটাতে গজাচ্ছে না তো? বুকের একেবারে কলবে হিমহিমে তাপ টের পান জাফর চৌধুরী।
পিছনের রুমটি ফুস্ করে খোলে গেল কার ইশারায়? এখন তার অস্বস্তিটা শুরু হয় ঘামে-ভেজা হাতের তালু থেকে । এত বড়ো খাটটাতে কে পড়ে আছে? কার লাশ!!! কবে থেকে এটা এখানে আছে? এ নারীর লাশ এমন তরতাজা থাকে কী করে! মুখটা কোথায় ওর? গলায় তার ৫+৫=১০টা দাগ আড়াআড়িভাবে আটকে আছে। আঙুলের দাগ এগুলি? ভয়ের ভিতর পড়তে হয় থাকে। এখন যেন আর দাঁড়িয়ে থাকাই সম্ভব না। দুপ্ করে খাটের কিনারায় বসে পড়লে ঝিরঝিরে শীতলতার ভিতর একটা সুর ভেসে আসতে থাকে। গলায় বসে যাওয়া তাজা দাগসমূহ কোন্দিকে তাকিয়ে আছে! জিবটিই কেবল বেরিয়ে এসেছে। মানুষের জিব অত শাদা হয়? শরীরের সবটুকু নীরবতা কি তবে জিবে জমা হয়ে গেল। খাটে, বিছানায়, বালিশে, শাড়িতে এবং শরীরের বাদ বাকি ভঙ্গিমায় এখনও রক্তের ওম লেগে আছে? কামরাটি যেন ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ -- যেন সাড়ে তিনহাত না-হওয়া পর্যন্ত থামবেই না। সেই চাপেই জাফর ক্রমান্বয়ে ঘামে।
জাফরের কপালে, নাকে, থুতনিতে, বুকের এপাশ-ওপাশে ঘাম বসতে থাকে। এখন শ্বাসে যে-টুকু উষ্ণতা আছে তাতেই অসহায় ভাবটা জমাট বাঁধে। খাটের লাশটাকে একসময় সোহাগী বলেই শনাক্ত করতে হয়। এখন সে কী করবে এটাকে? পুঁতে ফেলবে? গায়েব করে দিবে? আগুনে ভ্যানিশ করে দিবে? অত ভারী কেন ওটা? এক মানুষের গহ্বরে কয়টা মানুষ? কিন্তু একে উঠাবে দূরে থাক নাড়াতেই যে পারে না। সিমেন্টের মতো জমাট বাঁধল নাকি? জাফরের রাগটা আবারও নানান কায়দাকানুনে ঘুরতে থাকে। এই মাগী কোর্ট-কাছারি, উকিল-পেশকার-মুহুরি, থানা-পুলিশ করেও তাকে শান্তি দিবে না? সারা সোহনপুর, এমনকি বহরমপুরেও রেকর্ড করে ফেলল এই মাগী। কী করতে পারল? কেসে তো বেকসুর খালাসই পেল ওরা। সোহাগীর হারামি বাপটা তো চেষ্টা-তদ্বির কম করল না। মীমাংসা করলই না শেষ পর্যন্ত। তো, কী লাভটা হলো? খুনের নিষ্কণ্টক প্রমাণ হাজির করতে পারল জজ সাহেবের এজলাসে? এখন আবার এ কোন্ বালের তেলেসমাতি শুরু করল? এ রুমটাতে মাগী দরবার সাজিয়ে বসেছে কী করতে? এ কোনো সাবোটেজ নয় তো? ছমেদ মেম্বার কিংবা শেখ নইমুদ্দীন আবার কোনো ফালতু কারসাজি শুরু করল নাতো? কুতুব চাচা বা ইসকান্দর মিয়া কী করছে? নিজের ভিতরই ভিজে ঝুপঝুপে হয়ে যাচ্ছেন তিনি! তার শ্বাসের চলাচলতিতেও কি নজর পড়ল সোহাগীর? না হলে খাটে আরাম করে বসেও কেন হাঁপানির মতো লাগছে তাঁর। তিনি ঘামতেই থাকেন। ভাবনায় ফিনকি দিয়ে ভয় আসে। এ কোন্ ধারার লালচ মাগীর? চোখজোড়ার এ কেমন অবস্থা -- যেন টাটকা রক্তক্ষরণে ভেসে যাচ্ছে। হাঁসফাঁস করতে থাকে জাফর। নীরব-কাঁপুনিতে কিংবা সোহাগীর চোখের জারিজুরিতে অথবা গভীর রাতের তেজে এক্কেবারে পশ্চিমের রুমটি ধুম্ করে খুলে যায়। দম-আটকে-থাকা বাতাসের হোঁচটে জাফর আঁতকে ওঠে। জং-ধরা-দরজার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দসমুহ তাকে খামচে ধরে। অতগুলো দিন পর কে খুলল এটি? রুমের ভিতরটা এভাবে সাজ-সজ্জা করে রেখেছে যেন এখনও স্বপ্ন বিলি করছে কেউ।
এখন জাফরের মনে পড়তেও পারে, কত দীর্ঘসময় সোহাগীসহ এখানে কাটিয়েছে ওরা। তার ভিতরটা এখন ফাঁপা-শূন্য। রুমটাতে ঢুকতে গিয়েই কট্ করে কপালে ধাক্কা লাগে। দরজাটা কবে থেকে এত নিচু হয়ে গেল? তাহলে ভিতরে ঢুকবেন কী করে তিনি? নুয়ে যেতে হবে!!!
অবশেষে মাথাটা লুকিয়ে-চাপিয়েই ভিতরে ছুঁড়ে ফেলবেন নিজেকে! গলার একেবারে গভীরে থিকথিকে পচাশ্যাওলা-গন্ধ টের পান তিনি। লাথি দিবেন নাকি দরজাটায়? মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কটা সোহনপুর পর্যন্ত না-বাড়ালে আর চলছে না। কন্সট্রাকশন আর টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারকে জুতমতো দু-চারটা ধমক দিতে হবে। অবশেষে মাথা-ঘাড়-গলাটাকে ভিতরে লুকিয়েই তাঁকে রুমে ঢুকতে হয়। রুমের ভিতরটা তখনও ধূলায় ভর্তি। কাদার পচাগন্ধ গলা-বুক ছাড়িয়ে পেটের মাঝখানে যাতায়ত করে। ঝাপসা-আলো যেটুকু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাতে অন্ধকার বেগুনি-নীল রং ধরে। যেন আগুনের হো-স--হো-স... শব্দের ভিতর রুমটি স্থির হয়। অতি আধুনিক কম্পিউটারটি সেট করা আছে টেবিলে। স্যাঁতসেঁতে কল্জে-রঙের দেয়ালের পাঁজর থেকে অতঃপর কতিপয় শব্দ ঝরতে থাকে -- ওহে মানব, তোমার কি কোনো স্বপ্ন নেই? জাফরের ভাবনায় জট প্যাঁচায়, খুলে আবারও। তার গুছিয়ে আনা ভাবনাসমূহ ঝিরঝির করে ঢুকতে থাকে কম্পিউটারে। প্রিন্ট-স্ক্রিন অন্ হয় একসময়। শাদা কাগজের ভিতর যা লেপ্টে আছে, রক্তের ফোঁটার মতোই তা ঝরে একসময়। এত রক্ত কোত্থেকে এল! কাগজই তো এটি? এতে কাফনের গন্ধ মিশে আছে কেন! জং-রং-আলোতে ওটি ধরলেও লেখাগুলো অস্পষ্টই থাকে ।
অতঃপর বাড়িটি নির্জন আর্তনাদের ভারে থরথর করে কাঁপতে থাকে।
০৪-০৪-২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ
সেজদার ভঙ্গিতে নুয়ে-পড়া-বাড়িটির ওপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঝোপঝাড়ই চোখে পড়ে সবার আগে। নানা পদের লতা-পাতা, বাঁশঝাড় আর বেতের ঝোপই কেবল এলোমেলোভাবে বাড়ছে না, সজনে-ডাটাও পশ্চিমভিটার ঘরটার উপর হেলে আছে। চিকনচাকন হলদে-সবুজ পাতা টিনের চালে বিস্তৃত হচ্ছে কেবল। যেন জড়িয়ে-পেঁচিয়ে রাখে ঘরের চালাটাকে। আরেক বিস্ময় বাড়িটাকে সোহনপুরের জীবনপ্রবাহ থেকে একেবারে আলাদা করে; আর তা হচ্ছে, বাড়িটাকে ঘিরে থাকা গোঙানি আর এসবের মাঝে থাকা ঘ্রাণ। বহমান এ ঘ্রাণকে রোদ, বৃষ্টি, জোছনা কিংবা মেঘলা-নীরবতাও জব্দ করতে পারে না। এ-সবের মাঝেই ছমেদ মেম্বারের বৈঠকখানায় বাড়িটা ঘিরে বাড়িবিষয়ক গবেষণাতেই মজলিসটি ঝিমাতে থাকে।
বাড়িটি সোহনপুরের একেবারে শেষ মাথায়, তারও পরে আছে জলখেলি নামের শুকনা খটখটে নদী। এখন তাতে শীতের কুয়াশা-পেঁচানো জলধারা। বাড়িটা এভাবে দেবে যাওয়ায় এর অনেকটা অংশই আর দেখা যায় না। ক’দিন ধরে এই অবস্থা? কলিমুদ্দী এমন একটা হিসাব-কিতাবের ঝুঁকি নিতে গিয়ে রীতিমতো পেরেশানিতে পড়ে; নিজের স্মৃতির চারপাশেই ঘুরপাক খেতে থাকে। রইছুদ্দীর দুধরং-চামড়ার সোহাগী নামের সেই মেয়েটাও তার ভাবনায় ঘুরঘুর করতে থাকে। নিলাজ মাগীটার জাদুটোনা ধরনের ভাব থেকে বের হয়ে আসতে বেশ সময় খর্চা হয় তার। হুক্কার বেবাক ধোঁয়া হাড্ডি-দিয়ে-গড়া বুকটার পাঁজর শুষে নিবে যেন। হুক্কাটা ছমেদ মেম্বারকে বুঝিয়ে দেয়ার পর যখন ষোলআনা মজলিসটি তার চোখের আওতায় আসে, তখনও সে আগের প্রশ্নটির জুৎসই উত্তর বের করতে পারে না। ইসকান্দর মিয়া একরকম ঘুমের ভিতরই এককোনায় পড়ে আছে। হরিপদ’র মেজকাকা মনিন্দ্র সাহা যখন তামাম জায়গা-জমি বন্ধক রেখে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের পয়ষট্টির যুদ্ধের বছর আগরতলা চলে গেল, তার বছর দুয়েক পর থেকেই তো বাড়িটার এমন নুয়ে-পড়া-দশা। নাকি? তা প্রায় ৪০/৪২ বছরতো হবেই। এ বিষয়টা অত্র অঞ্চলে কে না-জানে? এ-সব কাণ্ড-কারখানা তো ঘটতে থাকল সোহাগী নামের মেয়ে আর তার বাবার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বালের মামলা সংক্রান্ত দিগদারিতেই । পুলিশ এবং তৎসংক্রান্ত ঝামেলা মজলিসের সবার মনে গেঁথে আছে এখনও। রঞ্জু এমপি’র বাবা সৈয়দ হায়দর আলীর একটা ইশারায় তামাম সোহনপুর তখন তছনছ করে ফেলল শালার পুলিশের গোষ্ঠী। এই যে হরিপদ, যে এই ভরা মজলিসে ছমেদ মেম্বারের একেবারে কোলের কাছেই বসা, সে ঠাকুরের কৃপায় এই বাড়িটার জলজ্যান্ত একটা হিস্টরি এক নিঃশ্বাসের ওপর ভর করেই বলে দিতে পারত। কিন্তু সোহনপুরের অতগুলো মানিলোকের সামনে সে অত কথা বলার মতো দমই পায় না।
মৌলবি কুতুবুদ্দীন নিজেকে কেন অত ঝিমুনির ভিতর লুকিয়ে রাখলেন! তিনি তো সোহনপুরের বড়ো পদের মুরুব্বি। জ্ঞানবুদ্ধি কিংবা বয়স, যে কোনো সাইড থেকেই ভাবা হোক, তিনিই তো এখন সোহনপুরের মাথা। জাফর চৌধুরীর বাপটা তো মরে গেছে ১০ বছর হলো। তাঁকে মাটিও দেয়া হলো ঢাকা শহরের মীরপুরে। তাহলে এখন তো সোহনপুরের তিনিই আসল গার্জেন। সেই তিনি কেন এমন রোগে-ধরা-মুর্গীর মতন ঝিমান? ছমেদ মেম্বার তো যোগ্য দাবিটাই করে বসে --কিয়ো মৌলবি বেডা, কী মেওডা* (রহস্য) কইন দেহি; অত উঙ্গাইন* (ঘুম-ঘুম ভাব) কেরেতে? সোহনপুরের একটা হক আচে না আফ্নের উফ্রে? বিষয়ডা কী? নাহি, চাচী রাইতে ঘুমাইতো দেয় না হিঃহিঃ? সমবেত হাসির কবলে পড়ে তার ঝিমুনিটা নড়ে ওঠে।
সেই ঝিমুনি ভাবটা কাটিয়ে উঠার পরই মৌলবি কুতুবুদ্দীনের নজরে আসে রইছুদ্দীকে। বারান্দার আন্ধার-খামচে দাঁড়িয়ে আছে সে। এবং মজলিসের অনেকেই সোহনপুরের গোঙানি টের পায়। এমনকি কলিমুদ্দী তার তামাকের নেশাসহ আঁতকে ওঠে। মজলিসটির ভাবনা এভাবেই আরও বিস্তৃত হয় এবং এ ঝিমুনিটা ক্ষণে ক্ষণে ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়ার বিষয়টাই যথার্থ বোধ হয়। তখনই একজন মুরব্বি কিসিমের লোক রইছুদ্দীকে একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে বাইরের দিকে নিতে নিতে চৌধুরীদের সেই বাড়িটার দিকে ঠেলে-ঠুলে পাঠিয়ে দেয়। এখন মজলিসটির স্মরণে রইছুদ্দীর বাড়িটার অবস্থান তাদের অস্তিত্বে জাগ্রত হয়। ওর বাড়িটা তো চৌধুরী বাড়ির দুইটা বাড়ি দক্ষিণেই। রইছুদ্দী তার চলে যাওয়ার ভিতর তার মেয়েটার স্মৃতিও যেন পুনরায় বিতরণ করে গেল! বাড়িটার কপালে তাহলে আরও বড়ো কোনো হিস্টরি অবশিষ্ট আছে। দুই-চার জন এই চান্সে তাদের ভিতর এ সংক্রান্ত বিচরণশীল খোয়াব ঝালাই-বাছাই করতে নেমে যায় -- আজাইরে চিল্লাইলে কী ফায়দাডা অইবো; আমরার সব কতা মন্অ থাহার কী দামডা আছে? একপয়সাদে দাম দে কুনু চেডের বালে! বাড়িডারে নিয়া রইছুদ্দী চাচার মাইয়া সুহাগীর নেশাডা মনে করেন অহন্অ আছে ষোল্লআনা। এমুন ক্যাপচার করুইন্যে মাইয়া আর কই আছে? নিজেগো ডরটার কতা চিন্তা করেন, পুলিশনি ফিরেকবার মাডি খুইদ্দে* (গর্ত খুড়ে) আসামি বাইর করে! অন্যজন পাশ থেকেই বলে ওঠে -- তাইলে বুদ্ধি কি? -- এইরহম গুইট্টেচালি* (নীরবে শলা-পরামর্শ করা) না-কইরে পুলিশের মুখ ঘুস-মুসদে লেইপ্যে দেওন দরহার। খতিবালী জানায় - রইছুদ্দির বুহে যে দাগাটা পড়ছে হেইডাও কেয়াল কইরো। এক আতে* (হাতে) কইলাম তালি বাজে না।
বাড়িটার জামিনদার ইসকান্দর মিয়া তবু মরা মানুষের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকে।
একসময় ছমেদের গলায় মজলিসটি কন্ট্রোল করার ঝাঁজ পুরোমাত্রায় প্রকাশ পেলে, তার সিদ্ধান্তের যাবতীয় ধরনকে পূর্ণমাত্রায় আনতে পারে। সে জানাতে থাকে, এখানে জমায়েত হওয়ার কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করতে পারে নুয়ে-পড়া-বাড়িটায় লেপ্টে থাকা অচিন ঘ্রাণকেই। এর তো একটা কূলকিনারা করা দরকার। তার কথাবার্তাকে একটা সিদ্ধান্তে আনার আগেই উত্তরপাড়ার জয়নাল ভিন্নমাত্রার কথা শুরু করে -- অততা ভাইব্যা লাভ নাই, লও যায় বসন্পুরের কানাই উহিলের বাড়িত। জাগা-জমির যে প্যাঁচ জানে হালার মালাউন, জজেও তাইনেরে ১০ বার বাপ ডাহে হাঃ হাঃ হাঃ। জয়নালের এমন বেতাল কথায় ছমেদের ভাবনা ফের থেঁৎলে যায় -- বাড়িটা তবে --ভেজাইল্যে-অই।
অনেকেই অধীর অপেক্ষায় থাকে মৌলবি কুতুবুদ্দীর পাক-মুখের দু/চারখান কথা শোনার জন্য। বাড়িটা কেমন ঝামেলার ভিতর আছে তা কি জানার দরকার নাই? নাকি মফিজ ফকিরকে দিয়ে রাত-গভীরে জিনের বাদশাহকেই নামাবে। ছমেদ মেম্বার একটা ইশারা দিলেই তো ফকির এক সেকেন্ডের ভিতর চলে আসত এখানে। মৌমাছির খেদমতগার তবে শেখ নইমুদ্দীন নিশ্চয় এর একটা কিনারা করতে পারবে। নিশিতে যার অত চলাচলতি, মৌমাছি নিয়ে যার অত কাজ-জারবার সেকি পারবে না ফালতু একটা গন্ধকে খালি-পড়ে-থাকা চৌধুরী বাড়ি থেকে দূর করতে? মৌমাছির একটা ঝামেলার বিষয়ওতো বাড়িটাতে আছে, তাহলে শালার মুখে কথা নাই কেন্? একটা ইশারায় দিক না!
সোহনপুরের এও এক নড়াচড়া মনে হয় যে; বলা নেই কওয়া নেই ৮/১০টা মৌচাকের শ শ মৌমাছির ভনভন করা শুরু করল বাড়িটা ঘিরে। এ কোন্কিসিমের আলামত? তাহলে শেখ নইমুদ্দীনের এখনও চুপচাপ থাকা শোভা পায়? মৌমাছি সংক্রান্ত সমুদয় ঝামেলার হেতু কী, তা এই শেখ নইমুদ্দীন ছাড়া আর কে জানে? এও তো এক কঠিন সাধনাই। হাসি-মশকরার বিষয় তো আর নয়।
মৌমাছির ওই বিষয়টি অতি শর্টটাইমে আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাত্র বছরখানেক আগে মৌমাছিবিষয়ক যে একটা আলামত দেখা যায় তাও তো শেখ নইমুদ্দীনেরই। তার দাড়িতে যে মৌমাছির চাষ শুরু হয় তা কি গায়েবি আলামতের ইশারা নয়? মৌলবি কুতুবুদ্দীনের কলেজ-পড়–য়া নাতিটা বাজিতপুর থেকে পত্রিকায় ছাপানো ছবি নিয়ে এসে তামাম গ্রামবাসীকে দেখায়ও -
দাড়ির স্থলে মৌ -চাষ
(নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত)
কিশোরগঞ্জ জেলার বহরমপুর থানাধীন সোহনপুর গ্রামের শেখ নইমুদ্দীন দীর্ঘ দেড় বছর ছয় মাস যাবত দাড়ির স্থলে মৌচাক চাষাবাদ করছেন। তিনি উক্ত পেশাকে জীবনযাপনের অঙ্গ করে নিয়েছেন। এ ঘটনায় অত্র এলাকায় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন শ’ শ’ মানুষ; আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা তার গ্রামের-বাড়িতে ভিড় করছে। এর ভিতরে কোনো মাহাত্ম্য আছে বলে স্থানীয় জ্ঞানী-গুণি ব্যক্তিবর্গ ধারণা করছেন। স্থানীয় ৬ নং হিলচিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তাকে একটা রূপার মেডেল উপহার দিয়েছেন।
লোকটাকে নিয়ে সোহনপুরে তখন বেজায় ফুর্তি। তারপর থেকে উক্ত শেখ নইমুদ্দীন ব্যাপক দাপট নিয়ে সোহনপুরের গপসপে* (গল্পসল্পে) হাজিরা দেয়। তার খাতির-প্রণয়ও বেড়ে যায় ম্যালাগুণ। মানুষটার দেহ-পিঞ্জিরায় কোন্কিসিমের রূহানি শক্তি ভর করেছে কে জানে। মফিজ ফকিরও যখন লোকটার পিছ্ ছাড়ে না তখনই এ সিদ্ধান্ত আরও জোরদার হতে থাকে যে, তার কলবে একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে। এমন আলামতের আওতায় পড়ে অনেকে এক্কেবারে বেকুব বনে যায়।
এদিকে শেখ নইমুদ্দীন পড়ে যায় আরেক মুশকিলে। কারণ সে তার দাড়িতে মৌ-চাষ করার বাসনাকে দীর্ঘজীবী করার আর সম্ভাবনাকেই জিইয়ে রাখতে পারে না। সদ্য-বিয়ে করা তার তিননম্বর বৌটা ডাইরেক্ট ওয়ার্নিং দিয়ে ফেলেছে এসব দাড়ি-মাড়ির ঝায়-ঝামেলা সাতদিনের মধ্যে শেষ না করলে সে এ সংসারের বুকে লাত্থি দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে। এরপরই শেখ নইমুদ্দীনের অন্য ঢঙের পলিসি শুরু হয়। পরিমল ছুতারকে দিয়ে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো বাক্সে ঢুকাতে থাকে মৌমাছিদের। এ কাজটিই বা সে কেমন করে করতে পারল? গৈ-গেরামে ঘুরতে আসা বেসরকারি কোন্ কম্পানির কাছে নাকি তার ট্রেনিং নেয়াও শেষ। কিন্তু অত তাড়াতাড়ি মৌমাছির মতো অবুঝ প্রাণীর সাথে তার খাতির-প্রণয় কী করে হয়! মৌমাছির সঙ্গে নিশ্চয় কোনো-না-কোনো রকমের জ্ঞাতিগোষ্ঠির সম্পর্ক থাকতেও পারে তার। কারণ এত খায়-খেদমত তো কেবল জ্ঞাতিগোষ্ঠির সম্পর্কের ভিতরই সম্ভব।
তারও পরে চৌধুরী বাড়িটাতে মৌমাছির এমন ভেজাইল্যে ঘটনার সূত্রপাত হলে আবারও জাফর আর সোহাগীবিষয়ক ঘটনা স্মৃতিতে ভাসতে থাকে অনেকের। সোহনপুরের এমন একটা জলজ্যান্ত ঘটনার তালে পড়ে অনেকের ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটে। বড়ো একটা কাণ্ডকীর্তি হয়ত-বা আবার শুরু হবে। যার জন্য ছমেদ মেম্বারের বাড়িটার সেই মজলিসেই এই শেখ নইমুদ্দীনকেই দায়িত্বটা দেয় শালার মৌমাছিবিষয়ক বেশতি* (বাড়তি) ঝামেলা থেকে তাদেরকে মুক্তি দেয়ার জন্য। মৌমাছিবিষয়ক ঝামেলাটার সাথে ঘ্রাণ কিংবা গোঙানির একটা স্পষ্ট সম্পর্ক অনেকে আন্দাজ করে। গোঙানি তো মৌমাছিদের যৌথ-কান্নাও হতে পারে। প্রাণীকূলের এ কৌশলটা নিয়ে তো শেখ নইমুদ্দীন ছাড়া আর কারও বাপেরও সাধ্য নেয় কিছু করার। অনেকে আবার এমন সন্দেহও করেছে এসব আসলে নইমুদ্দীনেরই কেরামতি নয় তো -- হালায় অহন মৌমাছি চালান দেওনের টেক্টিসও শিইখা ফালাইছে!
ছমেদ মেম্বারের বৈঠকখানায় ভরা মজলিসে শেখ নইমুদ্দীনও এমনই প্রতিজ্ঞা করে বসে -- মার্ত সাতটা দিন টাইম চাই; শালার পুতাইন্তেবাপ-বাপ করনের টাইম পাইতো না। মানুষ চিনে না অহন্অ।
ছমেদ মেম্বারের বড়োছেলেটা বলে ফেলে -- আরে কী কইন, মৌমাছি খেদাইতে সাতদিন লাগেনি? শেখ নইমুদ্দীন তখন ঠোঁটের কোনায় ঝিরঝিরে হাসি লেপে দেয়ার ভিতর বলে -- মিয়ার পুত, মনে কইরেন এমুন বিটলা মৌমাছি তামাম ময়ালে নাই, টাইম ত একটু লাগবোই।
এবার বাড়িটা ঘিরে মৌচাকের কাহিনী বাড়েই। রইছুদ্দীর মরে-কাঠ-হয়ে-যাওয়া মেয়েটার কোনো লীলাকীর্তন নয়-তো এ-সব? এমন স্মৃতির ভিতর চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে পড়া রক্তের টাটকা গন্ধ পায় কেউ কেউ। এ গল্প সোহনপুরেরই। কী যে তরতাজা আলামত! শেখ নইমুদ্দীন একলা সাহস না-করতে পারলে মফিজ ফকিরের সঙ্গে যুক্তি-পরামর্শ করে একটা উপায় বের করুক। জিন-পরী বা জাদুর খেলায় সারা সোহনপুর বেঁধে ফেললে কেমন হয়? কিন্তু শেখ নইমুদ্দীন যে কিছুই বলে না; ঠোঁটের কোণের হাসিটাকে প্রলম্বিত করে মাত্র।
বাড়িটি ঘিরে ধীরে ধীরে যা বাড়তে থাকে তাকে বলা যায় ভয়। এর আশপাশ দিয়ে কেউ হাঁটতেই চায় না। এমনকি এসব স্মৃতির ভিতরও যেন কেউ থাকতে চায় না। সোহনপুরের বুক বরাবর যে রাস্তাটা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সঙ্গে মিশেছে তার পুরোটা শুরু হয়েছে এ বাড়িটা থেকেই। এখন কি তবে চৌধুরী মোহাম্মদ সুনতানুল করিমের নামের মাহাত্ম্য নিয়েও কারও কারও ভিতর কথা চালাচালি শুরু হবে! এখন কি অচিন কোনো ভাবনা চলাচল করে? পেরেশানিতে পড়ে মৌলবি কুতুবুদ্দীন কিংবা শেখ নইমুদ্দীন? ছমেদ মেম্বার পর্যন্ত বাড়িটা থেকে ৫০ গজ দূর দিয়ে ঘুরে জলখেলির ব্রিজটাতে ওঠে। ওই ব্রিজে ওঠার রাস্তাটাও এখন শুরু হয়েছে ছমেদ মেম্বারের বাড়ি থেকেই।
শেখ নইমুদ্দীন প্রথমেই সেদিন কড়া লিকার দিয়ে চা খায়। কিমাম, জর্দা আর শুকনা সুপারি দিয়ে পান খাওয়ার পরও তার লাইগ* (নেশা নেশা ভাব) লাগে না। মাথার ঝিমঝিম ভাবটাই তাকে ছাড়ে না। অনেকক্ষণই সে তার নিজের ঘরের বারান্দায় বসে থাকে। শালার জিবে দশ-পর্দার ভাঁজ পড়ল কিনা? তার বউটা কতক্ষণ প্যানর-প্যানর করতে করতে মেয়েটাকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। বাঁশঝাড় থেকে পেশাব করে এলেও ভিতরের ঝিমধরা ভাবটা যায় না। ধীরে ধীরে মৌচাকের বাক্সগুলোর কাছাকাছি যায় সে। ঘুমের প্রলেপ টের পায়। এখন নাক-মুখ-বুকে গুনগুন করতে থাকা মৌমাছির সুর শুনে। গেছো-মৌমাছির পেট-শুড়, হাত-পা -পাখা এমনকী ফুলের রসের গন্ধ টের পেতে থাকে শেখ নইমুদ্দীন। মৌমাছির মধু জোগাড়ের সিজন সে বাতাসের তেজ শুঁকেই বলে দিতে পারে।
এখনও তার চোখে ময়লা-পেঁচানো ঘুমের রেশ লেগে আছে। একসময় সেই রেশও ছিঁড়ে যেতে থাকে। মাঝরাতের বারান্দাটা যেন ঘুমায়। বারান্দাঘেঁষা তিনটি বাক্সও নীরব। অন্ধকারের গন্ধ চেখেই বেরয় সে। বড়ো বেতাল ঘ্রাণ চারদিকে। কোত্থেকে আসে এ-সব। মৌচাক থেকে তো নয়ই -- তবে? নাকি রানিমা’র মিলন-পর্ব চলছে এখন? তীক্ষè গন্ধ ধরেই সে চলে একসময়। নাকি গন্ধটিই তাকে শনাক্ত করে ফেলল? এই গন্ধই তাকে ঠেলতে ঠেলতে সেই বাড়িটার বুক বরাবর এনে দাঁড় করাবে?
মিঞা বাড়ির গোরস্থান ডানে রেখে বাঁশঝাড় আর প্রাচীন বটগাছটা ছাড়িয়ে জলখেলির একটা চিকন শাখা পেরিয়ে উত্তরমুখো হাঁটতে থাকে শেখ নইমুদ্দীন। সারাটা রাস্তায় বিছানো জোছনা-ভেজা ওমে ভিজতে ভিজতে নুয়ে-পড়া-বাড়িটার এক্কেবারে কাছাকাছি চলে আসে। এখন কি বাড়িটার কলবের কিনারায় পৌঁছে গেল? কী যে রূপ-বদলের পালা চারদিকে। এবার তবে গন্ধের ভিতরের আরেক গন্ধ তাকে পথ দেখাবে!
রইছুদ্দীর মেয়েটার কাজ-কাম নয় তো এ-সব? সেই মাগীই কেবল এত রূপ-বদলের কাজ করতে পারে। শেখ নইমুদ্দীন তার কুলুকুলু ঘামের ভিতর এমনই বুঝ-পরামর্শের ভিতর ঘুরপাক খায় ফের। মেয়েটা মরে গেল তো দশ বছরের কম হয়নি। এখন এই অতদিন পর এভাবে বাড়িটাতে জব্দ করে রাখে কোন্মুখে। সোহনপুরের কোন্ কেচ্ছাকাহিনী ধরে যে মেয়েটা চলে। সে-ই গন্ধ বিলায় এমন অন্ধকারে? কোন্ শিথিল-বসনার শাড়ির খসখস আওয়াজ তার গোছানো ভাবকে আউলাঝাউলা করতে থাকে! জেনানা-কাতর অন্ধকার ধরে তবে রইছুদ্দীর মেয়ে সোহাগীই হাঁটছে কিনা! পাঁচব্যাটারির টর্চলাইট দিয়ে দক্ষিণের আমগাছের মৌচাকটি শনাক্ত করতে গিয়েই পড়ে বেতাল ঝামেলায়। শেখ নইমুদ্দী কেন সেই গাছটা থেকে নামে আর কেনই-বা কাঁপতে-কাঁপতে, দৌড়তে-দৌড়তে অতরাতে ডাইরেক্ট নিজের বাড়ি চলে যায় সেই বিষয়টা সোহনপুরের অনেকের কাছেই পৌঁছে পরদিন সকালেই। তার গতরাতের সোঁ-সোঁ শব্দ এমনকি হাঁপানি রোগীর মতো সাই-সাই শব্দটাও সারাটা গ্রামে অতঃপর ছড়িয়ে দেয় কেউ কেউ। বুকের মাঝখানের ধুকপুকানিটা যেন কেউ ছড়াতে থাকে। এমন চমকে-যাওয়া-বিষয় সোহনপুরকে দীর্ঘদিন আন্ধাচক্করের ফেলে দেয়। এই বিষয়টাও কেউ স্মরণ করে, জোছনার ওমে-ভেজা এ কান্নার বয়সও ১০ বছরের কম নয়। শেখ নইমুদ্দীনের বাড়িতে ক্ষণে ক্ষণে জড়ো হতে থাকা জটলাসমূহকে বুঝাতে থাকে বাড়িটার মৌমাছিগুলো সেই কান্নারই অংশ।
এভাবেই সোহনপুরকে বিভোর করে রাখার গল্প ক্রমান্বয়ে বি¯তৃত হয়। এমনকি অবুঝ পেরেশানিরও অংশ হয় এ-সব। কারণ অনেকেই বিষ্টিভেজা রাতে কিংবা ঝমঝমে পূর্ণিমাতেই শুধু খেয়াল করে না, অন্ধকার কিংবা ফকফকা জোছনায়ও বদলে-যাওয়া-বাড়িটার হুহু কান্নার সুর শুনতে থাকে। কান্নার জবজবে ঝাঁকুনিতে বাড়িটিও একসময় ঘামতে থাকে।
. . .
দশফুট উঁচু যে প্রাচীর তাই আসলে পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণের তিনটা ঘরকে পেঁচিয়ে রাখে। বাড়িটার মেইন-গেইট কখন বন্ধ হয় আর কখন খোলে, এ গ্রামটির অনেকের কাছেই তেমন স্পষ্ট নয়। ইস্কান্দার মিয়া এরই ভিতর মাঝে মাঝে ঢুকে এবং বেরও হয়। এমনই আলামতের ভিতর বাড়িটার বয়স বাড়তে থাকে। ছমেদ মেম্বার, হরিপদ, মৌলবি কুতুবুদ্দিন, কলিমুদ্দী এবং শেখ নইমুদ্দীনের চোখের সামনে বাড়িটার দুর্গতি ক্রমশ বর্ধনশীল হয়। ঝোপঝাড় জঙ্গলে রূপ নিতে থাকে। চৌধুরী সাহেবের একমাত্র ছেলের একমাত্র নাতি কি আদৌ আসবে সোহনপুরে? ছমেদ মেম্বারের মন-মনুরায় সেই বিষয়টার একটা ফয়সালা করার বাসনাই ঘুরপাক খেতে থাকে।
শেখ নইমুদ্দীনের প্যারপ্যারানিতে আবারও ছমেদ মেম্বারই মজলিসটা বসায়। আবারও সেই কথাটাই ছমেদ মেম্বার বলে-- বুঝ্যো মিঞারা, মানীর মান আল্লায় রাহে। একটা বিষয় বিবেচনা কইরে দেহো, দুই পয়সার রইছুদ্দী, জোরে একটা পাদ মারলে যার কইলজা কাঁইপ্যে ওঠে, হেই বান্দির পুতে কত লেজালতিডা লাগাইছিন্। তে, কী লাভডা অইলো। চৌধুরীরার বালডি ছিঁড়তে পারল? কিচ্ছু অইল? ৩০২ ধারা, মাডার কেস; ধূলার মতন উইড়া গেল না? কাম একটা করলেই চলে? কই মহারানি আর কই চুৎমারানি হাহাহা। অতই যুদি পাওয়ার তর, তে নিজের মাইয়াডারে খুডা মাইরে রাখলে না কেরে? চৌধুরী বাড়ির বেয়াই অউনের অত শখ কেরে? পরে পুটকিত চেপ্টা কেমুন পড়ল?
ধরতে গেলে সবকিছুই ছমেদের বিবেচনার ভিতরে রাখতে হয়। সোহনপুরের মানুষজন কী বেহুদা মেম্বার বানিয়েছে তাকে? দশজনের দোয়ায় আর আল্লার রহমতে দেখেশুনে চলতে পারে সে। পাঁচটা দিন আগেই সে জাফর চৌধুরীর সঙ্গে ঢাকার অফিসে দেখা করে এল। ইস্কান্দর মিয়া না হয় বাড়িটাই দেখাশুনা করল; জাফর চৌধুরীদের অংশের অত জায়গা-সম্পত্তি কে দেখবে? -- জাফর বাবাজী এইটা খুব বিশ্বাস করে ঘরের চাইয়া পর ভালো। তাইনেরার কি বালের ঠেকা পড়ছে ছাতার এই সব সহায়-সম্পত্তির খুঁজ-খবর নেওনের।’ লেনদেনের একটা ব্যাপার আছে না? তা না হলে কি দায়িত্বটা সে পালন করল? এই বাড়িটার ইজ্জত মানে সোহনপুরের ইজ্জত; তা হলে এর তত্ত্ব-তালাশি তো তাকে করতেই হয়।
তবে এ কথাটা ঠিক, এমনকি আশ্চর্য হওয়ারও বিষয় -- স্বর্ণলতার মতো বাড়িটার নির্জনতা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। সোহনপুরের গুপ্ত-কোলাহল যেন বাড়িটাতে উপছে পড়ে। ছমেদ মেম্বার বারবার কেবলই বুঝ-পরামর্শের ভিতর ডুব দেয়। আশপাশের মানুষজন এতে যোগ দেয় ক্রমশ। ঝোপঝাড়, শ্যাওলাভেজা ছায়া, মৌচাক আর কদিন আগে রাত-দুপুরে শেখ নইমুদ্দীনেরর কাঁপুনিসহ লম্বা-চওড়া দৌড়; সবই রইছুদ্দীর মেয়ে সোহাগীর স্মৃতির সাথে জড়িয়ে যায়। সবার ভিতর এ বিষয়টা পাকাপোক্ত হয়, তাহলে বাড়িটার উজান-ভাটি, সুখ-সুবিধা, ভালো-মন্দ দেখার ভারটা তো একতরফাভাবে ছমেদ মেম্বারের ওপরই পড়ে। জাফর চৌধুরী আর-কী করতে আসবে এখানে? শালার এই গৈ-গেরামে মাত্র ২/৪ দিন মান-ইজ্জত নিয়ে থাকার কোনো জো আছে? ছমেদ মেম্বার তো সেই কথাটাও জাফর চৌধুরীকে বুঝাতে পেরেছে। রইছুদ্দীর বেশরম মেয়েটা সেই মুখ কী আর রেখেছে? নিজে তো শেষ হলোই, চৌধুরীর বাড়ির অংশীদাররা একহিসেবে দোষের ভাগীদার হলো। এর সবকিছুই সেদিন মেম্বার হিসেবে নিজের মুখে বুঝিয়ে এসেছে। আর এত বোঝাবুঝিরই-বা কী আছে, শেখ নইমুদ্দীনের কেসটা কি মিছা? জাফর চৌধুরির চাচাত ভাইটা নাকি কাকে কাকে বলেছে এ-সব ছমেদের কারসাজি? তখন ছমেদের কী করতে ইচ্ছা করে? এমপি’র লোক দিয়ে ওকে একটা ধোলাই দিলে ভালো করত। এ-সব তো এখন এ ভরা মজলিসে দশজনের সামনে আলাপই করা যায় না। আর বাড়িটাকে গন্ধের ভিতর যে দেও-দানবে ঢিল-উল মারে এর মাজেজা কী? একটা পয়েন্টও বাদ দেয়নি সে। তবে একটা বিষয় তার মাথায় ঢুকেনি; এবার তার কথা তেমন আমলেই নেয়নি। বাসার সামনের অংশে সুন্দর সুন্দর গাড়িতে ঠাসা। শাদা চামড়ার লোকগুলোর সাথে কী যে এত কথা বলে আর ভ্যাক-ভ্যাক করে খালি হাসে।
. . .
কিন্তু এমপি গত পরশুদিন কী এক আজগুবি পয়েন্ট তুলে বসল। তাও তাকে বাড়ি থেকে জরুরি খবর দিয়ে বহরমপুর নিয়ে এমন গোয়াটা মারল? কোন জাতের ইশারাটা দিল -- কিয়ো মেম্বরের ঘরের মেম্বর, বাড়িডার খাতির-প্রণয় চলে ত ঠিক মতন?
ছমেদের সারাটা মাথার ভিতর একটা চক্কর মারে। আর কিছু না-চিনলেও এমপি’র এমন ইশারা সে ঠিকই চিনে। ঝিরঝিরে ঘাম কপাল ফেটে বেরোতে থাকে। শালার এমপি’র চোখ কতদিকে! তার পরও তাকে জিজ্ঞেস করতেই হয় -- কেরে কী অইছে ? কুনু বেয়াদবি পাইছুইননি হেইডা কইন আগে? তার এমন কথার জুতসই স্কোপই নেন এমপি.-- আরে মিঞা খালি আমি, ব্রিটিশ-আমেরিকা এই বাড়ির তত্ত্ব-তালাশি করতাছে। তোমরার সোহনপুর দেখবা মাইয়ামানুষ আর কারেন্টের ঠেলায় খালি নাচব। -- কেন্ কি অইছে কইবাইন
ত? -- আরে ধুর মিয়া, কথা ছোডো করো, বাড়িডারে খায়-খাতির করো আগে, উল্টাসিধা পাইলে পাছার চামড়া থাকত না। আগরম-বাগরম যা আছে; সব কাইট্টে সাফ করবা। দুইদিন টাইম পাইবা; লুঙ্গি খুইল্লা দৌড় লাগাও।
এর মাত্র ১০টা দিন পরেই সারা সোহনপুর চমকে ওঠে। কত-কিসিমের মানুষ যে বাড়িটার চারপাশে গিজগিজ করা শুরু করে। গাড়ি, লোক-লশকর, বাচ্চা-কাচ্চাদের চিল্লাহল্লাতে চারপাশ ভরতে থাকে। মানুষগুলোর কী স্বাস্থ্য। শাদা-চামড়ার মানুষ এ গায়ে আসার মাহাত্ম্য কী? সোহনপুর রীতিমতো চমকে ওঠে। সোহাগী মরে যাওয়ার পর আর অত মানুষ আর দেখেনি সোহনপুর। অত মেয়েছেলের আমদানির কারণ কী? মৌলবি কুতুুবদ্দীনের কাছে ছমেদ এই তথ্যটাই জানতে চায়, কেয়ামতের আর কদিন বাকি। বাঁচার উপায়টা কী? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ছমেদ মেম্বারই এ কিসিমের কথাবার্তাকে আর বেশিদূর বাড়তে দেয় না। শুধু তার নয়, অনেকেরই মাগীদের মোটর সাইকেলের এই ভটভটানিতে ওজু পর্যন্ত হালকা হয়ে যায়।
এই বিষয়টা অনেকের সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক’ঘণ্টা বাংলাদেশে থাকবে, তার বউ সাথে থাকবে কিনা? বেডার নাকি স্বভাব-চরিত্র অত সুবিধার না। তাহলে মনে হয় প্রেসিডেন্টর বউও নিশ্চয় সঙ্গে থাকবেন। এমন একটা বেলাইনের মানুষকে বউ হয়ে কী করে একলা ছেড়ে দিবেন? বউটার কী একলা থাকলে ঘুম হবে ? এমন কাফের-নাসারার দল আল্লার অত কাছে থাকেন কী করে? তাদের ১০/১২ বছরের মেয়েটা নাকি এখনই মায়াবড়ি খায়? তৌবা তৌবা! রইশ্যের মা পর্যন্ত এ নিয়ে কথা চালাচালি থেকে গা ঢলাঢলি পর্যন্ত করে। তামাশা পেয়েছে শালারা। শেখ নইমুদ্দীন এসব নিয়ে ম্যালা পেরেশানিতে পড়ে। মৌলবি কুতুবুদ্দীনকে জানায় সেসব -- চাচা, দিন দিন দ্যাশটার কি অইলো? চৌধুরির পুংডা নাতিডা দ্যাশটাত ফিরে আইবো বুলে? দ্যাশটা তাইলে কাফের-নাসেরাগো কন্ট্রোলে চইলা গেল? রইছুদ্দীরে দে একটা তামাদি কেস করলে কেমুন অয়? আইচ্ছা, ওই শালার জাফইরেরে আল্লা একফোঁটা শরমও দেয়নি ! দেশের মাইনষেরে মুখটা দেকাইবো কেমনে?
. . .
একসময় আড়মোড়া ভাঙে বাড়িটার। ঝোপঝাড় নড়ে ওঠে। নীরবতা কাঁপতে থাকে। অতঃপর শ্যাওলা-পেঁচানো ইট ফরফর করে ঘষামাজা চলে। দেয়াল, ছাদ, মেঝে আর চারদিকের রং পাল্টাতে থাকে। আলোর রোশনাইয়ে কাঁপে সোহনপুর। এমনকি পল্লিবিদ্যুতের বিলিবণ্টনও শুরু হয় এই বাড়িটা থেকেই। শীতাতপের পরশ আসে একসময়। শাদা মিহি আলোর ঝলকানি লাগে বাড়িটাতে। এমপি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কন্ট্রাক্টরের লোকদের একদারসে গালিগালাজ করতে থাকে। ঝোপজঙ্গল সাফ হয় একে একে। বাড়িটার তামাম ঢঙ বদলে যায় ক্রমশ। মৌচাক আচানক ভাবগতিকে নড়েচড়ে ওঠে। আলোর তাপ যেন ওরাই শুষে নিবে। আলো কেবলই বাড়ে - চারপাশে আলোর ঝলকানি লাগে। পি.এম. (প্রজেক্ট ম্যানেজার) ফের ঝানুত্ব প্রমাণের কায়দাকানুনে নিজেকে নিয়োজিত করে এভাবে -- শোনেন পি.সি. (প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর) সাহেব, যা বলছিলাম আর-কী, লেফটিস্টদের সঙ্গে আমাদের ডিফরেন্সটা ধরতে পেরেছেন তো? এখানে তিনি তার স্বভাব-নির্ধারিত কায়দায় থামেন। চুপচাপ থাকেন কিছুক্ষণ। পি.সি. জাফর চৌধুরী তার নির্ধারিত কায়দায় চুপ থাকেন। আবারও পি.এম. সাহেব তার কথা শুরু করেন এভাবে -- মূল বিষয়টা হচ্ছে, ওরা যা বলে তা করে না। আর আমরা যা বলি তা কাগজে-কলমে দেখিয়েই ছাড়ি হাঃ হাঃ হাঃ। গণমানুষের দুয়ারে দুয়ারে যেতে হবে। ওদের কথা থাকার কোনো স্কোপই রাখা যাবে না। জাস্ট নক এ্যাট দি ডোর। জাফর চৌধুরীরও বোঝা হয়ে গেছে মাইক্রোক্রেডিটকে নিয়ে তৃপ্তিষদার মতো বাম নেতারা যতই চিল্লাপাল্লা করুক, মহাজনী ব্যবসা বলুক, আসলে এসব ছাড়া এদের উপায় নেই; হারামজাদা নিুবিত্তের ব্যাকবোন বলে কিছু আছে নাকি।
গেইটটি এত মোলায়েম আর নিঃসঙ্গভঙ্গিতে বন্ধ হয় যে, জাফর নিজেও চমকে ওঠে। তিনজন গেইটম্যান আর তাদের স্ত্রীরাও কী তবে নির্জনতারও অংশ? কর্মকর্তারা একসময় উঠান পেরোয়। তাদের পায়ের হরিণের শু’র ছাপ মিলিয়ে যায়নি তখনও। বাড়ি পয়-পরিষ্কারের পানি তখনও গেইটটার মুখ ছাড়িয়ে যায়নি। কতদিন পরে জাফর চৌধুরী ঢুকলেন বাড়িটাতে? ১০ বছর!!! তার বউ ন্যান্সি আর ছেলে প্রসূন যতই কাঁই-কুঁই করুক তাদেরকে কী করে এখনই আনেন তিনি? পশ্চিমভিটার ঘরটার দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল? ভিতরের জমাট-বাঁধা বাতাস আর দেয়ালের স্যাঁতসেঁতে ঘ্রাণ কোত্থেকে এল? এত ভেজাভেজা কেন ভিতরটা? কুকুরের নাকের মতোই শীতল চলাচলতি তিনি টের পান! মৃত্যুচিহ্ন নয়-তো? তার হাতের পোর্টফোলিওটা এত ভারী কেন? মরার মতো এটি একসময় জাফরের হাত থেকে শুয়ে পড়ে সোফাসেটের সামনের লম্বা টেবিলটাতে। এখন এটিতে হাত রাখতেই বুকের পাঁজর শিরশির করে ওঠে। শীতল-ভরাট গন্ধে চারপাশ ভরে যায়। পি.পি.(প্রজেক্ট প্রোপোজাল)’র চাপেই কি এর ওজন বেড়ে গেল? নন-ফর্মাল এডুকেশন, পাবলিক হেল্থ্, রুরাল স্যানিটেশন, লিগ্যাল এইড, মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রাম, এমনকি রেন্ট-এ কারের পি.পি.টাও তো আছে এর ভিতরেই।
আবারও এ কোন্ ছায়ার গন্ধ?
ডিনারের অ্যারেঞ্জমেন্টটাও এলোমেলো লাগে। ভেজিটেবল স্যুপ আর চাইনিজ চিকেন ফ্রাইটা পর্যন্ত চাখতেই পারল না। পেটে কিছু না-পড়লে কী করে চলে, সামনে সারাটা রাতই তো পড়ে আছে। আবারও এ কোন্ ঘ্রাণ নাকের গভীরে ধাক্কা মারে! বাতাস কী ভেজা-ভেজা। বাড়িটাতে এরই মধ্যে তিন-তিন বার খতম পড়ানো হয়েছে বলে তার নলেজে আনা হয়েছে। এরপরও বদ-আত্মার ইশারা আসে কোন্দিক থেকে? আরে ধুর, কিসের ভয় কিসের কী? কিন্তু কেয়ার টেকার ইস্কান্দর চাচা এ কেমন গুনগুনানি শুনিয়ে গেল। কী সব আলামতের কথা শোনায়! এসব সুপার্র্র্স্টিশনকে পাত্তা দিলে চলে? কিন্তু এমন নীরবতার ভিতর পড়ে এ-সবকে তো অগ্রাহ্যও করতে পারছেন না তিনি। টানা ১০টা বছর তো সে-ই বাড়িটার দেখাশোনা করল। কিছু একটা না-পেলে কেন এ-সব বলতে যাবে -- বাবাজী আমার কথাখান একটু বিবেচনা কইরেন। আফনেরা টেডি-যুগের মানুষ; কিন্তু ময়-মুরুব্বির কথা একটু বিবেচনায় রাখতে অইবো। হেই রুহুখান (এ যে সোহাগীর কথাই বলা হলো তা জাফর বুঝতে পারছে) মনে কয় অহনো সরে নাই। বহুত খতরনাক মেয়েছেলে। আইজও মনে কয় হে-ই বাড়িখান ক্যাপচারে রাখছে। মাইয়াডার আন্দাজ-বরাদ আল্লা-পাক শর্ট কইরাই দিছে। এ কথাগুলো তিনি এত আস্তে-আস্তে বলেন যেন এই খবরটার ভার বহন করতে-করতে তিনি এক্কেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। এই নিুস্বরের ভিতরই তিনি জাফরকে বহরমপুরের ডাক-বাঙলোয় রাতযাপনের পরামর্শ দেয়া শুরু করে। কিন্তু আজ সে সরবে না। হয়ত-বা গন্ধের ভিতর অতিচেনা কোনো গন্ধ তাকে আটকে দিচ্ছে ।
এখনও ঘরটার এ অংশে মাকড়সার জালটা আছে! মাকড়সার বুকটাতে সোনালি দাগটাও আছে!! কী আশ্চর্য!!! এরা কি জন্ম-জন্মান্তর অদল-বদল করতে জানে? কোন্ পদের জীব এ-গুলো? কতদিন বাঁচে? ২/৩ বছর? নাকি ৫/৭ বছর? আরও বেশি? জালটা যে দিনকে-দিন বড়োই হচ্ছে। কিন্তু তার চোখের সামনেই তো হেকিম চাচার বড়ো মেয়েটা তামাম বাড়িখান ঝাঁট দিল -- এরপরও এটা এখানে থাকে কী করে? এর পেটটা কী নরম! কী তাজা! এমন আদুরে চলাচলতি কি তার হাতে উঠে আসবে?
ঘরটা কি আবারও কাঁপে? ব্যাপার কী! দেয়ালটা যেন সোহাগীর জেনানা-কাতর শিৎকারের তাপেই নড়ে! তার গলায়, বুকে, পেটে চোতমাসের নোনতা তাপ লাগে। বুকের সারাটা অংশ যেন তিরতির করে কাঁপে।
. . .
চিঠি লেখা নিয়ে সোহাগীর সে-সব দিনের এমন আকুল প্যারপ্যারানি জাফরের আজও ভালো লাগে না। তার তখন অত সময় কোথায় ছিল যে অক্ষরের পর অক্ষর বসিয়ে চিঠি লিখবে। টাইপিস্ট কাম এলডি ক্লার্ককে ডিক্টেশন দিয়ে দিল, ব্যস সে কম্পিউটারে পুচপুচ করে একখান পত্র বেরিয়ে এল। তারই জন্য এখন হাজারটা প্রশ্ন, এমুন দরখাস্ত একটা লেখার কী দরকারটা পড়ল পত্রে আমার ভালোবাসা নিয়ো, এইটা কুন্ ধরনের সেন্টেন্স? বাড়ি লিখতে আবার ঈ-কার কেন? রোদ্দুর কী করে রৌদ্র হয়ে গেল?
মেয়েটার কথার কী ঢঙ -- জাফর ভাই, ধইরা দেহো মাকশ্যার শইলডে কী নরম। কী কারিগরি শরীলটার মদ্যে আটকাইয়া রাহে !
তুই অত বুজোছ কেম্নে? ওই ছেড়ি কেমনে বুজোছ?
এইডা বুঝনের কী অইলো। আল্লারে, কী ত্যাল মাখাইন্যে শরীল- দেকছো?
সোহাগীর শরীরব্যাপী হাসি ছড়াতে থাকে। তার ঠোঁট, নাক, মুখ, বুক, চুল, পেট এমনকি শরীরে জমিয়ে রাখা অঙ্গের সারাটা ঘ্রাণ জাফরকে দখল করতে থাকে। তার গলায় পড়িয়ে দেয়া নেকলেসটা জাফরের স্পর্শ পেয়েই অনবরত দ্যুতি বিলায়। এর দানাসমূহ ধূসর থেকে সোনালি রং ছড়ায়। দুটি মানুষের নুন-কাম গন্ধের তাপে নেকলেসটায় জীবনের আরেক স্পন্দন আসে । শরীরের আকুলতা বাড়ে। সর্বাঙ্গে নোনতা ঘ্রাণ হয়ে ওদের কাঁপায়। একসময় ওদের শরীরে নগ্নতা ছাড়া আর কোনো আব্র“ থাকে না।
তারও পরের কোনো একদিনের কথা এ-সব -- জাফর সেদিন কম অবাক হয়নি। এমন আজগুবি ব্যবহারের কী মানে থাকতে পারে! যতই সোহাগী তার ছোটবোন বিন্দুর ক্লাশমেট হোক, ক্লাশ টেনে পড়ুক, রোল নাম্বার এক হোক, সাইন্সে পড়–ক; বাড়িটা ওদের থেকে মাত্র দু’বাড়ি দক্ষিণে হোক, ফুরুত-ফুরুত করে দিনের ভিতর একশ বার তাদের বাড়িতে আপ-ডাউন করুক, তাই বলে আম্মার চলাচলতি খেয়াল না-করে দিনে-দুপুরে পট্ করে দরজাটা বন্ধ করে দিবে!
বিকেলের রং কফি-কালার থেকে ছাই রং পরিপক্ব হয়। খাটের কিনারাটা ঘেঁষে ঘেঁষে তার দিকে এগোতে থাকে সোহাগী। আর এক্কেবারে কানের কাছাকাছি চোখ রেখে তার শরীরের বৃত্তান্ত বলতে থাকে। জাফরের কপাল ফেটে বিনবিনে ঘাম ঝরতে থাকে। কিন্তু ভাবনাবিষয়ক এ জটিলতায় ঘুরপাক খেতে হয় না তাকে। এটা কি নতুন শতাব্দীর শুরুতে কোনো ভাবনার বিষয় থাকতে পারে? আর এ ধরনের মাসিক-সংক্রান্ত ঝামেলা সোহাগীর এটাই তো প্রথম নয়। আগেও তো একবার ওয়াশ করালো। এখন স্বরসতীর মা’র কাছে চলে গেলেই তো চলে। আর ঢাকা যেতে চাইলে, না হয় নিয়ে যাবে একদিন। কচুরিপানার মতো, শীতের শাক-সব্জির মতো কত ক্লিনিক গজিয়েছে। শুধু এম.আর., ডি. এন্ড সি. করে তার বন্ধু ডা. জিন্না বিল্ডিং পর্যন্ত করছে। সোহাগীর এমন ত্যাদরামো একদমই সাপোর্ট করতে পারছে না সে। এবার নাকি ওয়াশ-টয়াশের ঝামেলায় যাবে না। কী আশ্চর্য! মেয়েটা এখন মশগুল হয়ে আছে শিশুজন্মের সৌন্দর্য নিয়ে।
একসময় সোহাগীর শরীরে আরও এক মানবজন্মের বি¯তৃতি ঘটতে থাকে। সারাটা শরীর বলতে গেলে তলপেটের খালি জমিনে দখলিস্বত্ব বিস্তার ঘটাতে থাকে। ঝিমঝিমে জোছনা কিংবা ঘনকুয়াশার অন্ধকার নিজের শরীরটার ভিতর আরও এক সওদা করে বেড়ায়। ভয় আর লজ্জার ভিতর সোহাগীর সময় পার হয়। জাফর ভাই কি এর একটা মিলমিশ করবে না? নিশ্চয়ই একটা কিনারা করবে। ঢাকা থেকে তো অচিরেই ফেরার কথা তার।
কিন্তু বেহায়ার মতো, পাষাণের মতো তলপেটের দলাটা যে বাড়তেই থাকে। অবশেষে এটাতে নড়াচড়াও শুরু হয়।
. . .
পশ্চিমের ঘরটা এখনও শুধু জাফরকে নিয়েই আছে। টেবিল থেকে পোর্টফোলিওটা নিয়ে বসে। তার ভিতরে যেন জাফর নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস টের পায়। হোমওয়ার্ক তো করতে হবে। সোহাগীর বেশরম ভাবনা নিয়ে পড়ে থাকলে চলে? সিনিয়র কন্সালটেন্ট প্রফেসর ছগির তো প্রজেক্ট ওপেন করেই খালাস, এখনতো তাকেই সব ম্যানেজ করতে হবে। নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করা অতই সোজা । কমসে-কম ২০টা মেয়ে ট্রেনিংয়ের যাবতীয় বিষয়টা তো তাকেই দেখতে হবে। অতগুলো কাজ সামলানো কী যা-তা ব্যাপার।
এই রুমটার পিছনে আছে আরও দু’টি রুম। ও-গুলোতেই এসব কাজ-কাম সারবে? নাকি পূবদিকের ঘরটায় মেরামত করিয়ে নিবে? লিগ্যাল এইডের প্রোগ্রামটার একেবারে ভিতরে ডুব দেন তিনি। এই ফাইলটাই আগে কোয়েরি করতে হবে।
রাত বাড়ে। নীরবতা দানা বাঁধে চারপাশে। রুমটার ভিতরে কেউ হাঁটছে নাকি? থপথপ শব্দ আসে কোত্থেকে? গায়েবি কোনো কোলাহল বাড়িটাতে গজাচ্ছে না তো? বুকের একেবারে কলবে হিমহিমে তাপ টের পান জাফর চৌধুরী।
পিছনের রুমটি ফুস্ করে খোলে গেল কার ইশারায়? এখন তার অস্বস্তিটা শুরু হয় ঘামে-ভেজা হাতের তালু থেকে । এত বড়ো খাটটাতে কে পড়ে আছে? কার লাশ!!! কবে থেকে এটা এখানে আছে? এ নারীর লাশ এমন তরতাজা থাকে কী করে! মুখটা কোথায় ওর? গলায় তার ৫+৫=১০টা দাগ আড়াআড়িভাবে আটকে আছে। আঙুলের দাগ এগুলি? ভয়ের ভিতর পড়তে হয় থাকে। এখন যেন আর দাঁড়িয়ে থাকাই সম্ভব না। দুপ্ করে খাটের কিনারায় বসে পড়লে ঝিরঝিরে শীতলতার ভিতর একটা সুর ভেসে আসতে থাকে। গলায় বসে যাওয়া তাজা দাগসমূহ কোন্দিকে তাকিয়ে আছে! জিবটিই কেবল বেরিয়ে এসেছে। মানুষের জিব অত শাদা হয়? শরীরের সবটুকু নীরবতা কি তবে জিবে জমা হয়ে গেল। খাটে, বিছানায়, বালিশে, শাড়িতে এবং শরীরের বাদ বাকি ভঙ্গিমায় এখনও রক্তের ওম লেগে আছে? কামরাটি যেন ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ -- যেন সাড়ে তিনহাত না-হওয়া পর্যন্ত থামবেই না। সেই চাপেই জাফর ক্রমান্বয়ে ঘামে।
জাফরের কপালে, নাকে, থুতনিতে, বুকের এপাশ-ওপাশে ঘাম বসতে থাকে। এখন শ্বাসে যে-টুকু উষ্ণতা আছে তাতেই অসহায় ভাবটা জমাট বাঁধে। খাটের লাশটাকে একসময় সোহাগী বলেই শনাক্ত করতে হয়। এখন সে কী করবে এটাকে? পুঁতে ফেলবে? গায়েব করে দিবে? আগুনে ভ্যানিশ করে দিবে? অত ভারী কেন ওটা? এক মানুষের গহ্বরে কয়টা মানুষ? কিন্তু একে উঠাবে দূরে থাক নাড়াতেই যে পারে না। সিমেন্টের মতো জমাট বাঁধল নাকি? জাফরের রাগটা আবারও নানান কায়দাকানুনে ঘুরতে থাকে। এই মাগী কোর্ট-কাছারি, উকিল-পেশকার-মুহুরি, থানা-পুলিশ করেও তাকে শান্তি দিবে না? সারা সোহনপুর, এমনকি বহরমপুরেও রেকর্ড করে ফেলল এই মাগী। কী করতে পারল? কেসে তো বেকসুর খালাসই পেল ওরা। সোহাগীর হারামি বাপটা তো চেষ্টা-তদ্বির কম করল না। মীমাংসা করলই না শেষ পর্যন্ত। তো, কী লাভটা হলো? খুনের নিষ্কণ্টক প্রমাণ হাজির করতে পারল জজ সাহেবের এজলাসে? এখন আবার এ কোন্ বালের তেলেসমাতি শুরু করল? এ রুমটাতে মাগী দরবার সাজিয়ে বসেছে কী করতে? এ কোনো সাবোটেজ নয় তো? ছমেদ মেম্বার কিংবা শেখ নইমুদ্দীন আবার কোনো ফালতু কারসাজি শুরু করল নাতো? কুতুব চাচা বা ইসকান্দর মিয়া কী করছে? নিজের ভিতরই ভিজে ঝুপঝুপে হয়ে যাচ্ছেন তিনি! তার শ্বাসের চলাচলতিতেও কি নজর পড়ল সোহাগীর? না হলে খাটে আরাম করে বসেও কেন হাঁপানির মতো লাগছে তাঁর। তিনি ঘামতেই থাকেন। ভাবনায় ফিনকি দিয়ে ভয় আসে। এ কোন্ ধারার লালচ মাগীর? চোখজোড়ার এ কেমন অবস্থা -- যেন টাটকা রক্তক্ষরণে ভেসে যাচ্ছে। হাঁসফাঁস করতে থাকে জাফর। নীরব-কাঁপুনিতে কিংবা সোহাগীর চোখের জারিজুরিতে অথবা গভীর রাতের তেজে এক্কেবারে পশ্চিমের রুমটি ধুম্ করে খুলে যায়। দম-আটকে-থাকা বাতাসের হোঁচটে জাফর আঁতকে ওঠে। জং-ধরা-দরজার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দসমুহ তাকে খামচে ধরে। অতগুলো দিন পর কে খুলল এটি? রুমের ভিতরটা এভাবে সাজ-সজ্জা করে রেখেছে যেন এখনও স্বপ্ন বিলি করছে কেউ।
এখন জাফরের মনে পড়তেও পারে, কত দীর্ঘসময় সোহাগীসহ এখানে কাটিয়েছে ওরা। তার ভিতরটা এখন ফাঁপা-শূন্য। রুমটাতে ঢুকতে গিয়েই কট্ করে কপালে ধাক্কা লাগে। দরজাটা কবে থেকে এত নিচু হয়ে গেল? তাহলে ভিতরে ঢুকবেন কী করে তিনি? নুয়ে যেতে হবে!!!
অবশেষে মাথাটা লুকিয়ে-চাপিয়েই ভিতরে ছুঁড়ে ফেলবেন নিজেকে! গলার একেবারে গভীরে থিকথিকে পচাশ্যাওলা-গন্ধ টের পান তিনি। লাথি দিবেন নাকি দরজাটায়? মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কটা সোহনপুর পর্যন্ত না-বাড়ালে আর চলছে না। কন্সট্রাকশন আর টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারকে জুতমতো দু-চারটা ধমক দিতে হবে। অবশেষে মাথা-ঘাড়-গলাটাকে ভিতরে লুকিয়েই তাঁকে রুমে ঢুকতে হয়। রুমের ভিতরটা তখনও ধূলায় ভর্তি। কাদার পচাগন্ধ গলা-বুক ছাড়িয়ে পেটের মাঝখানে যাতায়ত করে। ঝাপসা-আলো যেটুকু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাতে অন্ধকার বেগুনি-নীল রং ধরে। যেন আগুনের হো-স--হো-স... শব্দের ভিতর রুমটি স্থির হয়। অতি আধুনিক কম্পিউটারটি সেট করা আছে টেবিলে। স্যাঁতসেঁতে কল্জে-রঙের দেয়ালের পাঁজর থেকে অতঃপর কতিপয় শব্দ ঝরতে থাকে -- ওহে মানব, তোমার কি কোনো স্বপ্ন নেই? জাফরের ভাবনায় জট প্যাঁচায়, খুলে আবারও। তার গুছিয়ে আনা ভাবনাসমূহ ঝিরঝির করে ঢুকতে থাকে কম্পিউটারে। প্রিন্ট-স্ক্রিন অন্ হয় একসময়। শাদা কাগজের ভিতর যা লেপ্টে আছে, রক্তের ফোঁটার মতোই তা ঝরে একসময়। এত রক্ত কোত্থেকে এল! কাগজই তো এটি? এতে কাফনের গন্ধ মিশে আছে কেন! জং-রং-আলোতে ওটি ধরলেও লেখাগুলো অস্পষ্টই থাকে ।
অতঃপর বাড়িটি নির্জন আর্তনাদের ভারে থরথর করে কাঁপতে থাকে।
০৪-০৪-২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ
লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
জন্ম ১৯৬৩-এ, মামাবাড়িতে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানারসরিষাপুর গ্রামে শৈশব-কৈশোর, যৌবনের প্রাথমিক পর্যায়ও কাটানতিনি। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা করেছেন গ্রাম ও গ্রামঘেঁষা শহরে।চিকিৎসাবিজ্ঞানে একাডেমিক পড়াশুনা করেন চট্টগ্রামে। লেখাজোখাতাঁর কাছে অফুরন্ত এক জীবনপ্রবাহের নাম। মানুষের অন্তর্জগতেএকধরনের প্রগতিশীল বোধ তৈরিতে তাঁর আকাক্সক্ষা লক্ষ করা যায়।বিভিন্ন জায়গায় Ñ ছোট বা বড়োকাগজে তিনি লিখে যাচ্ছেন।
কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ কথা-র সম্পাদক তিনি। তাঁর প্রকাশিতগল্পগ্রন্থ--মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম। (জাগৃতিপ্রকাশনী), স্বপ্নবাজি (ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ), কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প (শুদ্ধস্বর)। উপন্যাস --পদ্মাপাড়েরদ্রৌপদী(মাওলা ব্রাদার্স), যখন তারা যুদ্ধে (জোনাকী)। উপন্যাসের বিনির্মাণ, উপন্যাসের জাদু(জোনাকী), গল্পের গল্প (জোনাকী), কথাশিল্পের জল-হাওয়া (শুদ্ধস্বর)।
প্রকাশিব্য গ্রন্থ >
১. দেশ-বাড়ি : শাহবাগ (উপন্যাস/ প্রকাশক শুদ্ধস্বর)
২. কথা’র কথা (সাক্ষাৎকারমূলক গ্রন্থ/ প্রকাশক আগামী প্রকাশনী)
৩. ভালোবাসা সনে আলাদা সত্য রচিত হয় (গল্পগ্রন্থ/ জোনাকি প্রকাশনী)
0 মন্তব্যসমূহ