মুজিব ইরমের গল্প দড়াটানার মাছ

সেমি-ডিটাছ বাড়িটিতে নির্জনতা যেন লেপ্টে আছে, গায়ের সাথে লোম যেমন লেপ্টে থাকে। উইলো বৃক্ষের নুয়ে-নামা বিস্তৃত ছায়ার পাশে ওক গাছের উদ্ধত ভঙ্গিমা নির্জন বাড়িটিকে পাহারারত দেখায়। পাশেই কোনো এক মৃতবৃক্ষের গুড়ি পড়ে আছে করুণ হয়ে। জুলাই মাসের এই সকাল যেন খুব তাড়াতাড়ি চারপাশে তার কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। আজ দিন শুরু হয়েছে রোদ নিয়ে। ক’দিন থেকে আকাশ মেঘহীন। চারপাশের দৃশ্যে তাই রোদের গন্ধ লেগে আছে। বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে সে বার কয়েক হাই তুলে। দৃশ্যটি তার ভালো লাগে। চির সবুজ গাছের বেড়া ডিঙিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। জমাট-বাঁধা নির্জনতায় নুয়ে-নামা উইলো বৃক্ষের দিকে আরেকবার তার চোখ যায়। আটকে থাকে সে। শহর থেকে দূরে, যেখানে একদা স্থানীয় স্বচ্ছল মানুষের বসবাস ছিলো, এখনও বহিরাগতদের বসবাস নেই বললেই চলে, সেখানে দড়াটানার মাছ ও বেলকই খেতে-চাওয়া একজন মানুষের অস্তিত্ব তার কৌতূহল বাড়ায়। কলিংবেলের শব্দে কেয়ারটেকার মেয়েটি দরজা খুলে দেয়।

সে তাকে অনুসরণ করে।

--আপনে কিতা খাইতা চাইরা, আমারে কউকা চাই? দেলোয়ার হাসানের এই আঞ্চলিক জবান আইজ্যাক আলীর কাছে দূর থেকে ভেসে-আসা কোনো এক অতীতের ধ্বনি বলে ভ্রম হয়। তার চোখের পাতা নড়ে ওঠে। পুনরায় একই প্রশ্নে তার চোখ প্রশ্নকারীর আপাদমস্তক ঘুরে এসে মুখে স্থির হয়। তার ডান হাত বিছানা থেকে উঠে আসে। আইজ্যাক আলীর জীর্ণহাত নিজের হাতে ধরে সে আরো একাত্ম হতে চায়--চাচাজি, আমার কথা কিতা আপনে হুনতা পাররা নি?

আইজ্যাক আলীর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এতোদিন পর নিজের কোনো প্রতিবিম্ব দেখছেন, না-কি পরিচিত জবানে একজন আজ তার হাত স্পর্শ করে শেষ-ইচ্ছার কথা জানতে চাইছে বলে আবেগ কাতর হয়ে পড়ছেন? ভাবনা আর স্থির থাকে না। আইজ্যাক আলী মাথা তুলতে চাইলে সে পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে মাথা একটু উঁচু করে দেয়। এই অন্তরঙ্গতায় তাকে বড়ো সতেজ দেখায়। কথাবার্তা তাই ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। নামধাম জানতে চাইলে নিজের গ্রামের নাম বলামাত্র আইজ্যাক আলীর গলার স্বর পাল্টে যায়।

--তোমার বাপর নাম কিতা, কও চাই রে বা?

--মরতুজ মিয়া...

--কিতা কইলায়! তুমি বড় বাড়ির মরতুজর পুয়া?

--জিওয়!

--হে এখন কেমলান আছে? বাঁচিয়া আছেনি? কোয়াই আছে?

আইজ্যাক আলীকে যেন প্রশ্নে পেয়েছে, একের পর এক প্রশ্নে মরতুজ মিয়া-দেওকলস-আজহার আলী একাকার হয়ে এলে দেলোয়ার হাসানের চোখে এক বিস্ময় এসে খেলা করে--এই সেই দেওকলসের আজহার আলী যাকে সবাই নিখোঁজ জাহাজি-লন্ডনী নামে এখনও স্মরণ করে!

প্রায় তিনযুগ পর হঠাৎ দেলোয়ার হাসান-দেওকলস-মরতুজ মিয়া আইজ্যাক আলীকে আবার আজহার আলীতে ফিরিয়ে নেয়। দেলোয়ার হাসানের কৌতূহল মেটাতে সন্তানদের কথা উঠলে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে আসে। মুরগির বাচ্চা বড় হলে যেভাবে দলছুট হয়ে যার-যার মতো ছিটকে পড়ে, সেভাবেই তারা ছিটকে পড়েছে--আজহার আলীর গলা বড়ো করুণ শোনায়। সদ্য প্রয়াত শ্বেতাঙ্গ রমণী--জাহাজ-পালাতক আজহার আলীকে যুদ্ধোত্তর পুরুষশূন্য শহরে যে আইজ্যাক আলী করে তুলেছিলো, তার জন্য দীর্ঘশ্বাস বাড়ে। তারপর আবার কথায়-কথায় আজহার আলী ও দেলোয়ার হাসান দেওকলসে ফিরে এলে এ-ঘর হয়ে ওঠে দেওকলসের ঘর। আজহার আলীর চোখ খুঁজে ফিরে তার সেই কৈশোরোত্তর কালের কোনো এক ভরাবর্ষার নইলার হাওর। এ-তো কোনো বর্ষার পানিভর্তি বিল নয়, যেন সদ্যযুতীর বুক উঁচিয়ে-থাকা লাবণ্য তাকে অষ্টপ্রহর ডাকে। নিত্যদিনের সাথী মরতুজ ডিঙ্গি, টানা জাল ও বিশ-হাতি লোহার শিকল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সে কি আর ঘরে থাকতে পারে? নইলার হাওরের বুক উছলে-ওঠা পানিতে আশপাশের ধানি-জমিও ভরা যৈবতি। সেই যৈবতি বিলে বেড়াতে-আসা মাছেদের ভিড়ে তাদের ভারি শিকল ঝপ করে নামে। নৌকাটাকে লগিতে বেঁধে রাখে তারা। বাঁশ দিয়ে টানাজাল আটকে রেখে দূর থেকে ভারি শিকল টেনে পাতা জালের দিকে দ্রুত এগুতে থাকলে নতুন পানিতে বেড়াতে-আসা পাঁচমিশালি মাছের দল স্রোতের তোড়ে জালমুখী হয়। সেই জাল তুলে দেখতে-না-দেখতে ভরে ফেলে তারা নৌকার পাটাতন। দড়াটানার মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরলে মা-চাচিরা ইছা-বৈছা, পুঁটি-টেংরা, চেঙ-বালিগরা, বাইম-বোতুম-চান্দু মাছের মিশেল দিয়ে জলপাইয়ের টক তরকারি রাঁধে। দড়াটানার মাছ ও বেলকইয়ের টেংগা--আহ, আজহার আলীর জিহ্বা ভিজে ওঠে! শুধু কী আর তাই! মা যেন এইমাত্র মাছগুলো কুটে তেল-মশলা মাখিয়ে নিল্লা সালুন রেঁধে খেতে দিয়েছেন, আর নাগামরিচের গন্ধমাখা ঝালে তার নাকে-চোখে পানি এসে যাচ্ছে! নাক-মুখ হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিল্লা-তরকারির সাধ আরো দ্বিগুণ করে তুলছে সে। ছেলের এই উচ্ছ্বাস দেখে মা পরের বেলায় যোগ করছেন শুকনো হাতকড়া, কমলার বাকল, বরই, কাঁচা আম কিংবা ডেফলের আমী। তাতে করে দড়াটানার মাছ আরো বেশি সুস্বাদু হয়ে ওঠে!

দড়াটানার মাছের স্মৃতি ও স্বাদ আইজ্যাক আলীর শুভ্র বিছানার চারপাশে ভিড় করতে থাকলে লেইছ মারার চিকন মার্বেল হয়ে সময় গড়িয়ে যায়। সেই মার্বেল উপেক্ষা করে নইলার হাওরের নয়া পানিতে জলকেলিরত চেলাপাতা মাছেদের সাথে তারা নিরুদ্দেশ হয়।

বর্ষা চলে গেছে, শরতও যায়-যায়; এদিকে হেমন্ত তখন আসি-আসি। নইলার হাওরের জোয়ানকিতে ভাটা ধরেছে। সেই পড়তি-বয়সের একাকীত্বে নিচু ধানিজমিতে বেজার মাছেরা ঘুরে বেড়ায়। রাতের অন্ধকারে মশাল ও কুঁচ নিয়ে আলোয়া শিকারে তারা বেরিয়ে পড়ে। পানির তলায় বেজারমুখে চলাফেরা করা মাছ মশালের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠলে কুঁচ দিয়ে গাঁথা মাছে ভরে ওঠে কাকরাইন। আলোয়া শিকারের মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরলে মধ্যরাতে মা ঘুম থেকে উঠে মাছ, হিদইল ও নানাজাতের তরকারি মিশিয়ে শুটকি-সিরা রান্না করছেন, সারাবাড়ি রান্নার গন্ধে ভেসে যাচ্ছে--আহ! লতা-হিদইল-ইছা-কাঁঠালবিচির শুকনা তরকারি, ইলিশ ও চুকার বাইঙ্গনের টেংগা, পানিকদুর সাথে বোয়াল মাছের সালুন, শীতের সকালে চৈপিঠা দিয়ে কতোদিন খাওয়া হয়নি বলে আজহার আলীর দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারি করে তুলে। দেলোয়ার হাসানের গলা বড়ো আদ্র শোনায়--হকলতা আরবার অইবো চাচাজি, আমি আপনারে রাইন্ধা খাওয়াইমু!

আজহার আলীর চোখ চিকচিক করে। তার মন এখন শুধু খেতেই চায় না, চায় তার সামনে আবার দড়াটানার মাছ ও বেলকইয়ের টেংগা রান্না করা হোক; আর সেই রান্নার সুগন্ধে এককালের ফেলে-আসা দেওকলসের দিনগুলি ফিরিয়ে আনুক। হঠাৎ আজহার আলীর কন্ঠ বড়ো উচ্ছ্বলতা ছড়ায়--আমরার ঘরর খান্দাত যে কালা জামগাছ আছিল, তা কিতা এখনো আছেনি রে বা?

দেলোয়ার হাসান এ-মুহুর্তে কালো জামগাছ, যেটাতে জাম পাড়তে গিয়ে কিশোর আজহার একদিন বাম হাত ভেঙে ফেলেছিলো--ঠিক মনে করতে পারে না, তবে গাছটির এখনো ফলবতী হওয়ার মিথ্যা-সংবাদ আজহার আলীকে একাধারে পুলকিত ও বিমর্ষ করে। একে-একে গাছগাছালি থেকে শুরু করে বাড়ির পাশের খালটির কুশল পর্যন্ত আজহার আলী জানতে চাইলে আবার দেওকলস আসে, মরতুজ মিয়া-স্মৃতি-শৈশব-দড়াটানার মাছ আসে। একসময় তাকে উঠতে হয়। আজহার আলীর হাত তার হাতে বড়ো কাতরতা ছড়ায়--তোমার লাখান আমার একটা পুয়া থাকলে মরবার আগে বড়ো শান্তি পাইয়া মরতাম রে পুত!

রাতে তার ঘুম হয় না। পাশেই বউ-বাচ্চা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মফস্বল শহর, বাম ছাত্ররাজনীতি, লামাবাজারস্থ মেস, মস্কো, লেলিন, মার্কস, দেওকলস, গেন্ডাফুল, মায়ের মুখ, এই শীতের শহর, কাজ, বউবাচ্চা, বাড়িগাড়ি--দেলোয়ার হাসানের ঘুমহীন মাথায় আজহার আলীর ছায়া হয়ে নামে। দড়াটানার মাছ দিয়ে বেলকইয়ের টেঙ্গা খাওয়ার শেষ ইচ্ছা তাকে তাড়া করে। আজহার আলীর শেষ ইচ্ছার মর্র্মার্থ ডাক্তার-নার্সরা উদ্ধার করতে পারেনি বলে কাজের অংশ হিসাবে তাকে ডাকা হয়েছিলো। সে কি তখন ভেবেছিলো এই কাজ তাকে এতো ঘুমশূন্য করে দেবে? আজহার আলীর বাড়ি থেকে ফিরে বউয়ের বানানো প্রিয় কফিতে চুমুক দিয়েও লামাবাজারস্থ মেসের পাশের টং দোকানের এক সিঙ্গেল চা তাকে অনেকদিন পর বড়ো বিমর্ষ করে; কিচেনের ঝুড়িতে এতো-এতো ফলমূল দেখেও হঠাৎ করে ঘরের পাশের লালি আম তাকে বড়ো পিছু টানে। এরকম তো আগে কখনো ঘটেনি, তাহলে!

পাড়ার গ্রোসারি সপ থেকে ফ্রোজেন দড়াটানার মাছ ও জলপাই কিনে সকাল-সকাল আজহার আলীর বাড়ির দিকে সে রওয়ানা দেয়। আজ সে নিজহাতে দড়াটানার মাছ দিয়ে টক সালুন রেঁধে আজহার আলীর বিগত ফিরিয়ে দেবে। এ তো শুধু তরকারি নয়--এ হচ্ছে আজহার আলীর স্মৃতি, শৈশব, জন্ম ও বেড়ে-ওঠা! দড়াটানার মাছে রান্না-হওয়া টেঙ্গার স্বাদে আজহার আলীর চোখেমুখে যে মায়ার ছায়া ঝিলিক দিয়ে উঠবে, তা যেন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু পথ এতো দীর্ঘ হচ্ছে কেনো! একটা এম্বুলেন্স সাঁই করে তার পাশ কেটে নিমেষে নাই হয়ে গেলে সে তার সদ্য কেনা গাড়িটাকে বাতাসে ভাসিয়ে দেয়।



লেখক পরিচিতি
মুজিব ইরম

জন্ম মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে, ১৯৬৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাসাহিত্যে স্নাতক সম্মান সহ এমএ। 
কাব্যগ্রন্থ : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় ন জানি ২০১২। 
শিশুসাহিত্য : এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ১৯৯৯। 
উপন্যাস/আউটবই : বারকি ২০০৩, মায়াপির ২০০৪, বাগিচাবাজার ২০০৫। 
কবিতাসংগ্রহ : ইরমসংহিতা ২০১৩, এবং বাংলা একাডেমী থেকে নির্বাচিত কবিতার বই : ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০০৩ ।

পুরস্কার : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ