দেশে দেশে সাড়া না পড়লেও গাঁয়ে পড়েছে। বছর পঁয়তিরিশের এক মুসকো জোয়ানের নুনুকাটা উৎসব। বাচ্চা নয়, কিশোর নয়, রীতিমতো জোয়ান। তার ওপরে একজন হিন্দুর মুসলমানে পরিণত হওয়া। গাঁ তো বটেই, পুরো ইউপির বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ একটা ধর্মীয় জোশ এনে দিয়েছে ব্যাপারটা। এমনিতে গাঁয়ে যা একটু ধর্মভাব জাগে, তা ঈদ-বকরি ঈদ-শবেবরাতে। গাঁয়ের মসজিদ বছরে তিনদিন ছাড়া ফাঁকা। জুম্মাবারেও গাঁয়ের বউ-ঝিরাই বরং মাঝেমধ্যে আসে গাঁয়ের মসজিদে। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ-পানিপড়া নিতে। এই নিয়ে ইমাম সাহেবের মনে ভারি দুঃখ। গাঁ ভরতি বেনামাজি। নামাজের জন্য ডাকলে লোকজন ছ্যাবলা হাসে। চাষবাসের জন্যি সারাদিন মাঠেত পড়ি থাকতি হয়, মসজিদে কেমতে আসি। কিংবা, আমার একখান খালি লুঙ্গি, চাদ্দিক ফাটা, কী পড়ি মসজিতে আসপো কন!
সাচ্চা কথা। ফাটা লুঙ্গি পরে থাই-পাছা বের করে গাঁয়ের লোকের সামনে বের হওয়া যায়, কারণ প্রায় সবারই এক অবস্থা, কিন্তু আল্লার ঘরে এসে তার সামনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগার কথাই। কারণ আল্লা তো রোজকার চেনা মানুষ না! ইমাম সাহেব তখন নবীজির দোস্তো বক্কর খলিফার তালিমারা ফাটা কাপড়ের গল্প বলেন, কিংবা এক অক্ত নামাজ না পড়লে পাঁচ শ বছর দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে বলে ভয় দেখান; লোকগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ভয় পায়ও, কিন্তু মসজিদে আসে না। ইমাম সাহেবের তাই বিশ্বাস, এ গাঁয়ের লোকজন প্রায় আধা জানোয়ার। কিন্তু কয়েকদিন হলো গাঁ জুড়ে বলকানো দুধের মতো উথলে উঠছে ধর্মভাব। এর আগে এই গাঁয়ে হিন্দু থেকে কেউ মুসলমান হয়নি, আজ হচ্ছে। একি সোজা কথা!
ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে হবে নুনুকাটা। এত বড় একটা ব্যাপার। তাই চেয়ারম্যান নিজে তদারক করছে ব্যাপারটা। বিল্লাল হাজাম তার-ক্ষুর-কাঁচি-চিমটা-পোড়ামাটি নিয়ে রেডি। গোল হয়ে থাকা লোকজনের মধ্যে পাটির ওপর ভ্যাবলার মতো বসে আছে বটকা। বটকা মানে বটকৃষ্ণ দাস। আজকে অবশ্য বটকার নাম পরিবর্তন হবে। আবদুল বারেক। ইমাম সাহেব রেখেছেন। আল্লার নিরানব্বুই নামের এক নাম।
লোকজন ভিড় করে দেখছে। একটু দূরে মেয়েদের জটলা। কাছে আসতে লজ্জা। নিষেধও আছে। পরপুরুষের যৌনাঙ্গ দেখা মেয়েদের মানা। তবুও ঘরে আটকে থাকতে পারেনি তারা। এমন ব্যাপার ছেড়ে ঘরে থাকা যায়! নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে রসিকতা করছে তারা। মুখে আঁচল চেপে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে এ-ওর গায়ে।
হাজাম রেডি। পিঁড়িতে বসে আছে বটকা। নতুন লুঙ্গি দেওয়া হয়েছে তাকে। সেটা এখন কোমরে গোটানো। মর্তমান সাইজের পুরুষাঙ্গ বের করে বসে আরে সে। কিন্তু লজ্জা পাচ্ছে বলে মনে হয় না। তার চেহারায় কিছুটা ভীতি আছে হতচকিত ভাব। বিশালদেহী লোকটা ঢোক গিলে বলল, নুনু না কাটলি হয় না! আমার ভয় করতিছে!
হা হা করে উঠল লোকজন। শতকণ্ঠে অভয়বাণী-- আরে কুনো ভয় নাই। এট্টুখানি চামড়া কাটতি হবি। বেদনা এট্টুও লাগবি না।
তবুও ভয় যায় না বটকার। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে সে বসে থাকে পিঁড়িতে।
চেয়ারম্যান নিজে পান দিয়ে চোখ ঢাকে বটকার।
বিল্লাল হাজাম রেডি, বলে-- ক বটকা, লা এলাহা
লা এলাহা
ইল্লাল্লাহু
ইল লাল লাহু, ভয় লাগছে
মোহাম্মাদুর
মো-মোহাম-মাদুর, ভয়...
রাছুলুল্লাহ
রাছুলুল্লাহ! ওরে বাপরে ই ই ই!
ব্যাস! বটকা এখন আব্দুল বারেক।
ঘটনা শুরু ভোট নিয়ে। গাঁয়ে বটকাকে সবাই চেনে। রায়বাড়ির মুনিষ। সেখানেই থাকা খাওয়া। রায়বাড়ি মানে গাঁয়ের একমাত্র আর্যবংশ। এ গাঁয়ের লোকজন রায়বাড়িতে ঢুকেছে, তবে তা মুনিষ খাটতে কিংবা পুজোর দান নিতে। বেণী রায়কে দেখলে এখনও পথ ছেড়ে দাঁড়ায় গাঁয়ের চেয়ারম্যান। প্রত্যেক ভোটের সময় খুব নম্রভাবে ভোট চাইতে যায় সেখানে। কেননা বেণী রায় মাথা নাড়লেই সমর্থন জানায় লোকজন। কিন্তু চেয়ারম্যানের চেলারা খেয়াল করেছে বটকা ভোট দিতে যায় না। তার নামও ভোটার লিস্টে নেই। বটকাকে জিজ্ঞেস করলে বলে-- বাবু জানে।
আরে বাবু জানে মানে! তোর নাম আমরা লিস্টে তুলি দি!
বাবুরে বলতি হবি।
বাবুরে বলতি হবি ক্যান? যেকুনো মানুষের নামই ভোটার লিস্টিতে উঠপি।
না। আমি বাবুর বান্দা মুনিষ। বাবুর হুকুম লাগবি।
ক্যান, বাবুরে বলতি হবি ক্যান? বাবুর মুনিষ তো আরও আছে। তারে নাম ভোটার লিস্টিতে আছে। তোর নাম তুলি দিলি তো ক্ষতি নাই।
লিস্টিতে নাম আমার দরকার নাই। আমার খুব কষ্ট হতিছে। আমারে এট্টা মাগি দে।
মাগি!
হ্যাঁরে দাদা। খুব কুটকুটায়। ঘুম আসে না। আমারে এট্টা বউ দে।
ধুস শালা, বউ কি দেওয়া যায়? তুই নিজে বিয়ে করিস না ক্যান?
বাবু দেয় না যে।
বাবুর দেওয়া লাগবিনানে। তুই মুনিষ খাটিস। টেকা কী করিস?
টেকা তো দেয় না বাবু। কয়, শোদ হতিছে।
ও, তুই বাবুর কাছে ধারিস! টেকা নিছিলি?
আমি না। আমার ঠাকুদ্দার বাপ।
তোর ঠাকুদ্দার বাপ!
এভাবেই বেরিয়ে পড়ে এক বিস্ময়। বটকা হচ্ছে বংশপরম্পরায় রায়বাড়ির ক্রীতদাস। বিংশ শতাব্দীতে এসেও এই গাঁয়ে অনেক আদিম প্রথা দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছে। কিন্তু তাই বলে প্রত্যক্ষ ক্রীতদাস! পাকা দলিল বেণী রায়ের কাছে। পড়ে শুনিয়েছে বেণীবাবু বটকাকে। মুড়মুড়ে তুলোট কাগজের সইসাবুদ করা দলিল।
আত্মবিক্রয় পত্র
রূপৈয়া ওজন
দশ মাষ
নিশান সহী।
মহামহিম শ্রীযুক্ত রামেশ্বর রায় মহাশয় বরাবরেষু লিখিত শ্রী সনাতন দাস ওলদ গোপীবল্লভ দাস সাকিন মৌজে বানিয়াজঙ্গ মামুলে পরগণে বোয়ালিয়া সরকার বাজুহার কস্য আত্মবিক্রয় পত্রমিদং কার্য্যাঞ্চ আগে আমি আর আমার স্ত্রী শ্রীমতি বিবানাম্নি দাসী এই দুইজন কহত সালিতে অন্নোপহী ও কর্জ্জোপহতি ক্রমে নগদ পণ ৯ রূপেয়া পাইয়া তোমার স্থানে স্বেচ্ছাপূর্বক আত্মবিক্রয় হইলাম-- ইতি তাং ১১ কার্ত্তিক সন ১১০১ বাংলা মোতাবেক ১৫ সহর রবিনৌয়ন সন ৩৯ জলুষ।
শ্রীমতি বিবানাম্নিদাসী
কস্যাঃ সম্মতিঃ
শ্রীসনাতন দাস
কস্যঃ নিশান সহী
দলিলটা সাপের বশীকরণ তাবিজের মতো বেঁধে রেখেছে বটকাকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়েছে বাবুর সিন্দুক থেকে চুরি করে পুড়িয়ে ফেলে দলিলটা, তারপর পালিয়ে যায় যেদিকে দুচোখ যায়। বেণী রায় যেন অন্তর্যামী। বলে দিয়েছে দলিল আরও একটা আছে। একই দলিল। রাখা আছে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার দপ্তরে। রাণীর হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। একটু আঙুল হেলালেই হাজার হাজার সান্ত্রী-পুলিশ মর্ত্য-পাতাল চষে ফেলবে তার খোঁজে। অতএব, পালানোর জায়গা ভূ-ভারতে নেই।
একবার যখন মুখ খুলেছে বটকা, এসব সমস্ত কথাই একে একে জানা হয়ে যায় গাঁয়ের লোকের। চেয়ারম্যানের মধ্যে চাগিয়ে ওঠে মানবতাবোধ। গম, চাল, চুরি করে, রিলিফ চুরি করে লোক মেরে ফেলা যায়; কিন্তু তাই বলে, একটা মানুষ ক্রীতদাস হয়ে থাকবে! মানুষ কি গরু-বকরি যে বেচাকেনা হবে? বেণী রায় প্রথমে পাত্তাই দিতে চায়নি চেয়ারম্যানকে। কোর্ট-কাচারি-পুলিশের ভয় বেণী রায় করে না। কিন্তু ভড়কে গেল সাংবাদিকের কথায়। এই এক জাত হয়েছে, যাদের ভয় পাওয়া শুরু করেছে লোকজন। পুলিশের চেয়েও নাকি বেশি বিপজ্জনক এই জাত। শেষমেষ মুহুরি ডেকে দলিল করা হলো। বেণী রায় লিখে দিল তার কোনো দাবি-দাওয়া নেই বটকার ওপর। শুধু তা-ই নয়, এতদিনের মাগনা খাটিয়ে নেবার বদলে তিন বিঘা পতিত জমিও দিতে হলো তাকে।
ভেটের হাওয়া এসে দাস বটকা স্বাধীন হলো। বটকার জমি হলো ঘর হলো। কিন্তু বউ যে হয় না! সবচেয়ে নিচু জাতের হিন্দুও মেয়ে দিতে চায় না বটকাকে। তাই চেয়ারম্যানের এবং ইমাম সাহেবের পরামর্শে বটকা মুসলমান হচ্ছে। তাই এই নুনুকাটা অনুষ্ঠান।
বটকা এখন আব্দুল বারেক।
বটকার গল্প শেষ। এখনকার গল্প আব্দুল বারেকের।
২.
ট্রেনজুড়ে গিজগিজ করছে মানুষ। বসার জায়গা দূরের কথা, দাঁড়াতে পারলেও মানতে হবে ভাগ্যটা ভালো। এই অবস্থাতেও আব্দুল বারেক বসেই এসেছে। বেঞ্চিতে নয়। দুই বেঞ্চির ফাঁকে মেঝেতে দ হয়ে বসে থেকেছে পুরো সময়। মাথা আর হাঁটু চলে এসেছিল একই সমতলে। পিঠ-শিরদাঁড়া বেঁকে সাওতালি ধনুক। সঙ্গীরা এই কামরাতেই আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু কে কোথায় তা বলতে পারবে না বারেক। দেখার জন্য বারেক একবারও মাথা তোলেনি। আসলে মাথা তোলার মতো অবস্থা নেইও। ক্ষিধে আর অনিশ্চয়তায় শরীর মন এতটাই ভেঙে পড়েছে যে দুই পা আর কিছুতেই ধড়টিকে বইতে রাজি নয়। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনোরকমে মানুষঠাসা ট্রেনে ওঠা। তারপরে বেঞ্চিতে বসে থাকা লোকগুলোর পায়ের ফাঁকে ঝুপ করে ময়দার বস্তার মতো বসে পড়া। কেউ কেউ সর সর বলে চিলচ্যাঁচান দিয়েছিল। কিন্তু বারেক নড়েনি। টি টি এসে টিকিট আছে? না থাকলে ট্যাকা বের কর শালা বলে পাঁজরে লাথি কষেছিল। তখনও সে মাথা তোলেনি। ট্রেনের বগির মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ, বিড়ির টুকরা, পানের পিক, গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা বগিঠাসা লোকের শরীরের মিশ্রগন্ধ, হেগে-মুতে জল না ঢালা ল্যাট্রিনের দুর্গন্ধ-- সবগুলো মিলে এক বোঁটকা পাঁঠা-শুয়োরে মেলানো গন্ধ থম ধরে ঝুলে আছে বগির মধ্যে। এসবেও সে নির্বিকার। তার যেন একটাই ইচ্ছা, পরাজিত মুখটাকে দুই হাঁটুর জমিনে চিরতরে লুকিয়ে রাখা।
ন্যাকড়ায় প্যাঁচানো কাস্তের সাথে পেতলের থালাবাটি বিক্রি করে চল্লিশটা টাকা নিয়ে গা ছেড়েছিল বারেক। গাঁয়ে তো মঙ্গা। ভাতের স্বাদ ভুলে গেছে ওরা কয়েকদিন ধরে না খেয়ে খেয়ে। শুয়োরের মতো কচুর কন্দ খুঁড়ে তোলে মানুষ। ধুয়ে সেদ্ধ করলে পেটে কিছু দেওয়া যায়। নুরবানু বাটি হাতে রোজ যায় কোঠাবাড়িগুলোতে। রায়বাড়িতেও। ওরা ফ্যান দিলে নুন মিশিয়ে খাওয়ায় নান্নাকে। চার বছরের নান্না। না খেতে পেয়ে শুকিয়ে হাড্ডিগোনা। দেখায় দুই বছরের মতো। কাঠির কাকতাড়ুয়ার মতো শরীরে বড় দুই চোখ। বারেক ঘরে থাকলে নান্না ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। দুই চোখ যেন বলতে চায়-- বাপ, বড় খিদে লাগিছে, আমারে চাড্ডি খাতি দে! ছেলের চোখের দিকে তাকালেই বারেকের বুক মোচড়ায়। পালিয়ে পালিয়ে থাকে কন্দ খোঁজার নামে। একদিন দেখল পাঁতিপাড়ার শামছু মিয়া মরা কুঁচোসাপ লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেঁড়া গামছায়।
বারেক অবাক হয়ে বলেছিল-- তুমি কি মেথর হয়ি গেছো শামছু ভাই? কুঁচো সাপ খাবা?
মরার চাইতে মেথর হওয়া ভালো। খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল শামছু-- সাপ না খেয়ি করবোডা কী? কেউ কি খাতি দেবি?
তার বউ রাজি হয়নি রান্না করতে। শামছু নিজেই কেটে সেদ্ধ করেছে। খাবার আগে বউ দোহাই পেড়েছে, ওগো বিষ লাগবেনে!
শামছু শোনেনি। নিজে খেয়ে ছেলেমেয়েদের খাইয়েছে। খা খা, দ্যাখ না বাইন মাছের সোয়াদ! হাগা-বমি কিছু হয়নি। শামছু ভয়ঙ্কর হাসি হেসে বলেছে, দেখলা তো, বিষ হতিছে মানুষের প্যাটের বিষ। সেই বিষের কাছে সব বিষ পানি। ইবার থাকি সব খাবো। সাপ-ব্যাঙ-কুত্তা-শিয়াল সব। মঙ্গা আমারে আর মারতি পারবিনানে।
আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গা। এই সময়ে ফেরিঅলা আসে দল বেঁধে। আজব ফেরিঅলা। ওরা কিছু বিক্রি করতে আসে না। আসে কিনতে। ঘটি-বাটি-গরু-ছাগল-কাস্তে-খুন্তি সব বিক্রি করতে থাকে মঙ্গায় আক্রান্ত গাঁয়ের মানুষগুলো। ঘরে খাবার নেই, কোথাও কোনো কাজ নেই, হাট-বাজারে পসরা নেই। মরদেরা পরণের একটা লুঙ্গি রেখে বিক্রি করে দেয় অন্য কাপড়, মেয়েরা একটা শাড়ি বাদে সবকিছু। বাঁচতে তো হবে! ফেরিঅলারা কিনতে থাকে যা পায়। এত সস্তায় অন্য সময়ে তো এসব কেনা সম্ভব নয়। না-খাওয়া মানুষ কচু-ঘেঁচুর খোঁজে ছোটে ডোবা-নালায়। না খেয়ে থাকতে থাকতে মেয়েরা, যাদের গতরে এখনও চটক অবশিষ্ট আছে, ফেরিঅলাদের হাত ধরে চলে যায় নিজের মরদ ছেড়ে। মঙ্গার বিষ। প্যাটের বিষ। বাঁচতে তো হবে।
মঙ্গার শেষে অঘ্রাণে কাজ জোটে আবার। যাদের শরীরে বেচবার মতো শক্তি থাকে, তারা আবার একরত্তি একরত্তি করে ঘর বানায়। যাদের তা থাকে না তারা হারিয়ে যায়। প্রতিবছর মঙ্গা এভাবেই কেড়ে নেয় কয়েকজনকে। খবরের কাগজে লেখা হয়, সাহায্য আসে, মঙ্গার বিষে জর্জরিতদের কেউ কেউ কিছু পায়। কিন্তু মঙ্গা বন্ধ হয় না। ফি বছর নিজেদের মরদকে ছেড়ে চলে যায় কয়েকজন যৌবনবতী নারী, মৃত্যুর বাড়ি যায় অশক্ত পুরুষ, শিশু কয়েকজন।
বারেক যখন বটকা ছিল, টের পায়নি মঙ্গা। তার মনিবের বাড়িতে ভাতে-কাপড়ে ঠিক থাকত। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ টের পায়।
এই গাঁয়ে কাজ নেই, এই জেলায় ভাত নেই। এবারে মঙ্গা এলে গাঁ ছেড়েছিল বারেক। আরও কয়েকজন। বারেকের হাতে ছিল ন্যাকড়ায় জড়ানো কাস্তে আর চল্লিশটা টাকা। নুরবানু খালপাড়ে দাঁড়িয়েছিল নান্নাকে কোলে নিয়ে। ক্ষেতগুলোতে লকলকে ধানচারা কী সবুজ! অথচ গাঁয়ের পর গাঁ জুড়ে মঙ্গার নীল ছোবল।
বারেক বলেছিল নুরবানুকে, যদি সহ্য করি থাকতি পারিস, ভিনগাঁয়ের ফেরিঅলার হাত ধরি চলি না যাস, শুনি রাখ, আমি ফিরে আসপো। টাউনে কাম পাবো। তোর জন্যি ভাত, গ্যাদার জন্যি দুধ পাবো। ভাত-দুধ নিয়া আমি ফিরি আসপো।
ট্রেনের মধ্যে ধ্বসে পড়া বারেক ভাবে, নুরবানু কি এখনও আছে তার অপেক্ষায়? সে তো গাঁয়ে ফিরছে ঠিকই, কিন্তু প্রতিশ্রুত কিছুই সঙ্গে নেই। শহরেও কাজ জোটেনি। জুটলেও পেট-ভাতায়। বারেক যখনই গরাস মুখে তুলেছে, সঙ্গে সঙ্গে মনে ভেসে উঠেছে নান্নার ড্যাবডেবে দুই চোখ-- বাপরে, আমারে চাড্ডি খাতি দে বাপ!
দুইদিন সাতদিন দশদিন। তারপরে সেই পেটভাতার কাজও যে জোটে না। মঙ্গার বিষে নীল হয়ে দলে দলে লোক আসছে শহরে। কে কাকে কাজ দেবে? এত কাজ তো শহরে বন্দরেও নেই। তাই আবার উপোস। শেষ পর্যন্ত বারেকের মনে হয়, না খেয়েই যদি মরতে হয়, তাহলে দূরে কেন, গাঁয়ে ফিরে একসঙ্গে মরাই তো ভালো। কিন্তু ট্রেনে উঠতি গিয়েও বারবার কুঁকড়ে যায় সে। গাঁয়ে ফিরে কী যে দেখতে হবে তাকে? তার নান্না-নুরবানু কি এখনও বেঁচে আছে! মঙ্গার ছোবলে নীল হয়ে যায়নি তো! যদি এখনও বেঁচে থাকে, যদি ভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকে, তাহলে বারেককে দেখে ভাববে, এসে গেছে জীবনের আশ্বাস-- ভাত আর দুধ। তারপর বারেকের শূন্যহাত দেখে কীভাবে মিইয়ে পড়বে তারা!
ট্রেনের প্রত্যেক ঝাঁকুনির সঙ্গে একটু একটু করে গুটিয়ে যেতে থাকে বারেক। এক সময় গড়িয়ে যেতে চায় পোটলার মতো।
আ মরণ দেখি, ব্যাটায় যানি কোলে উঠতি চায়! সর সর!
ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ খোলে বারেক। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় তাকে ধাক্কা দেওয়া যাত্রীর দিকে। তার মতোই মেঝেতে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে কয়েকজন যুবতী ও মাঝবয়সিনী। প্রত্যেকের কোলে ব্যাগ। চালের, চিনির, জিরার। ইন্ডিয়া থেকে আনা। নিজেদের মধ্যে কলকলিয়ে গল্প করে তারা। ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে একটা খাকি পোশাক, এই মাগিরা আজকার তোলা দিলি না!
টেকা দিতি পারবোনানে আজ। অন্যকিছু নিলি নিতি পারেন। চোখ ঠারে একজন।
সবার দিকে ঘুরে বেড়ায় খাকি পোশাকের চোখ। এক যুবতীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুই আয়!
যুবতী অসংকোচে উঠে দাঁড়ায়। ভিড় মাড়িয়ে খাকি পোশাকের সাথে ঢুকে যায় অপরিচ্ছন্ন বাথরুমে। বন্ধ হয়ে যায় বাথরুমের দরজা। একজন মাঝবয়সিনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে-- প্যাটের বিষ!
চমকে ওঠে বারেক, প্যাটের বিষ সবখানে!
আলুনি কচুসেদ্ধ খেয়ে বিড়ি ধরাল বারেক। নুরবানু কোনো প্রশ্ন করেনি ভাত-দুধহীন খালি হাতে আরও নিস্ব হয়ে বারেককে ফিরতে দেখে। বুক ঠেলে হতশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলেও মুখে তা আসতে দেয়নি নুরবানু। নিঃশব্দে বারেকের সামনে তুলে দিয়েছে কচুসেদ্ধ। খাওয়া শেষ হবার পর মৃদুস্বরে স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, ইবারে কী বেচবা?
আবার এলো আদম আলী। গেল মঙ্গাতেও এসেছিল। তাকে দেখেই বুকটা ধক করে উঠল বারেকের। আদম আলী বিড়ি এগিয়ে দিল তার দিকে। কিছুক্ষণ ধোঁয়া টেনে বলল, ইবারে কি ভাবতিছ?
দিমু না। দিতি পারব না। বারেক গত বছরের মতো করেই বলে।
নুরবানু খাবারের সন্ধনে বেরিয়েছে।
আদম আলী নড়েচড়ে যুত হয়ে বসে। গেলবার তো টিকে গেছিলা। ইবার পারবানা। বাচতি চাইলে এর চায়ে ভাল রাস্তা আর নেই। ধরি লও, এই মঙ্গাও পার করলা। তারপর সামনে বার? হয়তো না খেয়েই মরি যাবা গুষ্টিসুদ্দো।
খেঁকিয়ে ওঠে বারেক-- মরলি মরব। ঐ কাম করতি পারব না।
ছাওয়ালডার ফ্যান মেগে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতিছে তুমার বউ। তাও রোজ জুটতিছে না। বাপ হয়ি তুমি ছাওয়ালডার জন্যি এট্টু দুধ জোটাতি পারো না। অসুক-বিসুকে এক ফোঁটা অসুদ-পথ্যি দিতি পারো না। ভাবি দেখো, কামডা করলি তুমার ছাওয়ালের সব জুটপি। ভাত-গোস-ফলমূল-কাপড়-- কুনো কিছুর কমতি থাকবি না।
একটু নরম হয়ে আসে বারেকের চোখ। কোনো কথা বলে না।
আবার খেই ধরল আদম আলী-- ধরগে এই মঙ্গাও তুমি পার করতি পারলা। লাভডা কী হবি? জমি তো আগেই বিককিরি করিছ। এখন তুমার জমি নাই যে চষি খাবা। জাল নাই যে খ্যাপ মাইরা খাবা। তার চেয়ে কামডা করলি এক থোক টেকা পাবা। গঞ্জে একটা দুকান খুলতি পারবা। ছাওয়ালডা বাঁচপে, তুমরাও বাঁচপে।
বারেক আর্তস্বরে বলে, কিন্তু নুরবানু! ছাওয়ালের মা!
পথ্থম কয়দিন আহাজারি, তারপরেই সব ঠিক, বুজলা, সব ঠিক।
আদম আলী আশ্বাস দেয়। তারপর চোখ ঠেরে বলে, তুমার জমিন তো থাকল। আবার বীজ বুনবা। বছর না ঘুরতিই কোল ভর্তি।
আদিম মানুষের মতো মোচড়ানো বুক নিয়ে ফোঁস ফোঁস করে বারেক, যেন ভাষা প্রকাশের উপায় জানা নেই। বুঁজে আসা গলায় শুধু বলতে পারে-- আমার ছাওয়াল! আহারে!
আরে তুমার ছাওয়ালের জন্যিই তো সবকিছু। ছাওয়াল ভালো থাকপে। তুমরাও। ভাবি দেখো এক থোক টেকা। এক সাথে কুনোদিন চোখেও দেখোনি। গঞ্জে দুকান দিতি পারবা। বউডারে গতরের কাপড় দিতি পারবা। মঙ্গা এলে না খেয়ে মরার ভয় নাই। কত সুবিদা একবার ভাবো দিনি!
আমি পারব না! পারব না!
বললেও বারেকের গলায় সেই দৃঢ় সংকল্প নেই আর। অভিজ্ঞ আদম আলীর কান এড়ায় না। উঠে দাঁড়ায় সে-- ভেইবে দেখো আরাকবার। করবা কী করবা না। আমি কাল ধলপহরের আগে গাঁও ছাড়ি চলি যাব। কিন্তু আবার বলি, তুমার ছেলে মরুভূমিত পড়ে থাকপে না। আরবের মানুষ সব এক-একজন বাদশা। তানারা যে বাড়ি বানাইছে বেহেস্তও ফেল। তানারা বাড়ির কুত্তারে যা খাওযায়, তা আমরা ঈদের দিনেও খাইতি পারি না। তুমার ছাওয়াল ভালো থাকপে। বছরে কয়ডা দিন খালি উটের পিঠে দৌড়। বড় হলি আবার ফিরত আসপে কাঁড়ি কাঁড়ি মোহর নিয়া। এখন তুমার ইচ্ছা। তয় যাই করো, আজ রাতেই। আমি কিন্তু ধলপহরে গাঁও ছাড়ি চলি যাবো।
না খাওয়া শরীরে ঘুম আসে যেন সমস্ত অস্তিত্বের বাতি নিভিয়ে দিয়ে। নেতিয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে নুরবানু। নান্নাও। এমনিতেই কচি শিশু, তার ওপরে সারাদিনে জুটেছে শুধু আধাবাটি ফ্যান। ক্ষিধেয় কেঁদে কেঁদে ওইটুকু শরীরের সবটুকু শক্তি শেষ।
রাতের শেয়ালগুলো দ্বিতীয়বার ডেকে চলে যাবার পরে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেকে বুকে তুলে নিল বারেক। ঝাঁপ ঠেলে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় একবার তাকাল করুণ ঘুমন্ত নুরবানুর দিকে। তিন পহরের শেয়াল ডাকলেই রোজ ঘুম পাতলা হয়ে আসে নুরবানুর। পাশ ফিরে ছেলের গায়ে হাত দেওয়া তখন তার অভ্যেস। আজকে হাত বাড়ালেই ছেলের বদলে নুবানুর হাতে ঠেকবে কড়কড়ে একটা তাড়া নোট।
লেখক পরিচিতি
জাকির তালুকদার
জাকির তালুকদার এসময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার। তিনি লেখেন অভিজ্ঞতা থেকে। এবং এই অভিজ্ঞতার জন্য তাকে গ্রামে যেতে হয়নি। তিনি গ্রামেরই মানুষ। এর সঙ্গে মেল বন্ধন ঘটেছে তাঁর বহুমূখী পড়াশুনার। তিনি শুরু থেকে সিরিয়াস গল্পকার। কোনো অর্থেই সখ করে লেখেন না। ফলে তাঁর পাঠকও তাঁর সঙ্গে হয়ে ওঠেন সিরিয়াস। সম্ভবত জাকির তালুকদারই সাহিত্যের সেই প্রাচীন বংশের নিঃশ্ব সন্তান যিনি সত্যি সত্যি লেখালেখির জন্য সব ছেড়েছেন। নিজেকে বাজী ধরেছেন। এবং তাকে পড়া ছাড়া পাঠের পূণ্যি অসম্ভব।
গল্পের পাশাপাশি লিখছেন উপন্যাস ও প্রবন্ধ। প্রথম উপন্যাস কুরসিনামা। মুসলমানমঙ্গল উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকমহলে পরিচিতি পান। তার সর্বশেষ উপন্যাস পিতৃগণ সম্প্রতি জেমকন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে হবে নুনুকাটা। এত বড় একটা ব্যাপার। তাই চেয়ারম্যান নিজে তদারক করছে ব্যাপারটা। বিল্লাল হাজাম তার-ক্ষুর-কাঁচি-চিমটা-পোড়ামাটি নিয়ে রেডি। গোল হয়ে থাকা লোকজনের মধ্যে পাটির ওপর ভ্যাবলার মতো বসে আছে বটকা। বটকা মানে বটকৃষ্ণ দাস। আজকে অবশ্য বটকার নাম পরিবর্তন হবে। আবদুল বারেক। ইমাম সাহেব রেখেছেন। আল্লার নিরানব্বুই নামের এক নাম।
লোকজন ভিড় করে দেখছে। একটু দূরে মেয়েদের জটলা। কাছে আসতে লজ্জা। নিষেধও আছে। পরপুরুষের যৌনাঙ্গ দেখা মেয়েদের মানা। তবুও ঘরে আটকে থাকতে পারেনি তারা। এমন ব্যাপার ছেড়ে ঘরে থাকা যায়! নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে রসিকতা করছে তারা। মুখে আঁচল চেপে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে এ-ওর গায়ে।
হাজাম রেডি। পিঁড়িতে বসে আছে বটকা। নতুন লুঙ্গি দেওয়া হয়েছে তাকে। সেটা এখন কোমরে গোটানো। মর্তমান সাইজের পুরুষাঙ্গ বের করে বসে আরে সে। কিন্তু লজ্জা পাচ্ছে বলে মনে হয় না। তার চেহারায় কিছুটা ভীতি আছে হতচকিত ভাব। বিশালদেহী লোকটা ঢোক গিলে বলল, নুনু না কাটলি হয় না! আমার ভয় করতিছে!
হা হা করে উঠল লোকজন। শতকণ্ঠে অভয়বাণী-- আরে কুনো ভয় নাই। এট্টুখানি চামড়া কাটতি হবি। বেদনা এট্টুও লাগবি না।
তবুও ভয় যায় না বটকার। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে সে বসে থাকে পিঁড়িতে।
চেয়ারম্যান নিজে পান দিয়ে চোখ ঢাকে বটকার।
বিল্লাল হাজাম রেডি, বলে-- ক বটকা, লা এলাহা
লা এলাহা
ইল্লাল্লাহু
ইল লাল লাহু, ভয় লাগছে
মোহাম্মাদুর
মো-মোহাম-মাদুর, ভয়...
রাছুলুল্লাহ
রাছুলুল্লাহ! ওরে বাপরে ই ই ই!
ব্যাস! বটকা এখন আব্দুল বারেক।
ঘটনা শুরু ভোট নিয়ে। গাঁয়ে বটকাকে সবাই চেনে। রায়বাড়ির মুনিষ। সেখানেই থাকা খাওয়া। রায়বাড়ি মানে গাঁয়ের একমাত্র আর্যবংশ। এ গাঁয়ের লোকজন রায়বাড়িতে ঢুকেছে, তবে তা মুনিষ খাটতে কিংবা পুজোর দান নিতে। বেণী রায়কে দেখলে এখনও পথ ছেড়ে দাঁড়ায় গাঁয়ের চেয়ারম্যান। প্রত্যেক ভোটের সময় খুব নম্রভাবে ভোট চাইতে যায় সেখানে। কেননা বেণী রায় মাথা নাড়লেই সমর্থন জানায় লোকজন। কিন্তু চেয়ারম্যানের চেলারা খেয়াল করেছে বটকা ভোট দিতে যায় না। তার নামও ভোটার লিস্টে নেই। বটকাকে জিজ্ঞেস করলে বলে-- বাবু জানে।
আরে বাবু জানে মানে! তোর নাম আমরা লিস্টে তুলি দি!
বাবুরে বলতি হবি।
বাবুরে বলতি হবি ক্যান? যেকুনো মানুষের নামই ভোটার লিস্টিতে উঠপি।
না। আমি বাবুর বান্দা মুনিষ। বাবুর হুকুম লাগবি।
ক্যান, বাবুরে বলতি হবি ক্যান? বাবুর মুনিষ তো আরও আছে। তারে নাম ভোটার লিস্টিতে আছে। তোর নাম তুলি দিলি তো ক্ষতি নাই।
লিস্টিতে নাম আমার দরকার নাই। আমার খুব কষ্ট হতিছে। আমারে এট্টা মাগি দে।
মাগি!
হ্যাঁরে দাদা। খুব কুটকুটায়। ঘুম আসে না। আমারে এট্টা বউ দে।
ধুস শালা, বউ কি দেওয়া যায়? তুই নিজে বিয়ে করিস না ক্যান?
বাবু দেয় না যে।
বাবুর দেওয়া লাগবিনানে। তুই মুনিষ খাটিস। টেকা কী করিস?
টেকা তো দেয় না বাবু। কয়, শোদ হতিছে।
ও, তুই বাবুর কাছে ধারিস! টেকা নিছিলি?
আমি না। আমার ঠাকুদ্দার বাপ।
তোর ঠাকুদ্দার বাপ!
এভাবেই বেরিয়ে পড়ে এক বিস্ময়। বটকা হচ্ছে বংশপরম্পরায় রায়বাড়ির ক্রীতদাস। বিংশ শতাব্দীতে এসেও এই গাঁয়ে অনেক আদিম প্রথা দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছে। কিন্তু তাই বলে প্রত্যক্ষ ক্রীতদাস! পাকা দলিল বেণী রায়ের কাছে। পড়ে শুনিয়েছে বেণীবাবু বটকাকে। মুড়মুড়ে তুলোট কাগজের সইসাবুদ করা দলিল।
আত্মবিক্রয় পত্র
রূপৈয়া ওজন
দশ মাষ
নিশান সহী।
মহামহিম শ্রীযুক্ত রামেশ্বর রায় মহাশয় বরাবরেষু লিখিত শ্রী সনাতন দাস ওলদ গোপীবল্লভ দাস সাকিন মৌজে বানিয়াজঙ্গ মামুলে পরগণে বোয়ালিয়া সরকার বাজুহার কস্য আত্মবিক্রয় পত্রমিদং কার্য্যাঞ্চ আগে আমি আর আমার স্ত্রী শ্রীমতি বিবানাম্নি দাসী এই দুইজন কহত সালিতে অন্নোপহী ও কর্জ্জোপহতি ক্রমে নগদ পণ ৯ রূপেয়া পাইয়া তোমার স্থানে স্বেচ্ছাপূর্বক আত্মবিক্রয় হইলাম-- ইতি তাং ১১ কার্ত্তিক সন ১১০১ বাংলা মোতাবেক ১৫ সহর রবিনৌয়ন সন ৩৯ জলুষ।
শ্রীমতি বিবানাম্নিদাসী
কস্যাঃ সম্মতিঃ
শ্রীসনাতন দাস
কস্যঃ নিশান সহী
দলিলটা সাপের বশীকরণ তাবিজের মতো বেঁধে রেখেছে বটকাকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়েছে বাবুর সিন্দুক থেকে চুরি করে পুড়িয়ে ফেলে দলিলটা, তারপর পালিয়ে যায় যেদিকে দুচোখ যায়। বেণী রায় যেন অন্তর্যামী। বলে দিয়েছে দলিল আরও একটা আছে। একই দলিল। রাখা আছে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার দপ্তরে। রাণীর হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। একটু আঙুল হেলালেই হাজার হাজার সান্ত্রী-পুলিশ মর্ত্য-পাতাল চষে ফেলবে তার খোঁজে। অতএব, পালানোর জায়গা ভূ-ভারতে নেই।
একবার যখন মুখ খুলেছে বটকা, এসব সমস্ত কথাই একে একে জানা হয়ে যায় গাঁয়ের লোকের। চেয়ারম্যানের মধ্যে চাগিয়ে ওঠে মানবতাবোধ। গম, চাল, চুরি করে, রিলিফ চুরি করে লোক মেরে ফেলা যায়; কিন্তু তাই বলে, একটা মানুষ ক্রীতদাস হয়ে থাকবে! মানুষ কি গরু-বকরি যে বেচাকেনা হবে? বেণী রায় প্রথমে পাত্তাই দিতে চায়নি চেয়ারম্যানকে। কোর্ট-কাচারি-পুলিশের ভয় বেণী রায় করে না। কিন্তু ভড়কে গেল সাংবাদিকের কথায়। এই এক জাত হয়েছে, যাদের ভয় পাওয়া শুরু করেছে লোকজন। পুলিশের চেয়েও নাকি বেশি বিপজ্জনক এই জাত। শেষমেষ মুহুরি ডেকে দলিল করা হলো। বেণী রায় লিখে দিল তার কোনো দাবি-দাওয়া নেই বটকার ওপর। শুধু তা-ই নয়, এতদিনের মাগনা খাটিয়ে নেবার বদলে তিন বিঘা পতিত জমিও দিতে হলো তাকে।
ভেটের হাওয়া এসে দাস বটকা স্বাধীন হলো। বটকার জমি হলো ঘর হলো। কিন্তু বউ যে হয় না! সবচেয়ে নিচু জাতের হিন্দুও মেয়ে দিতে চায় না বটকাকে। তাই চেয়ারম্যানের এবং ইমাম সাহেবের পরামর্শে বটকা মুসলমান হচ্ছে। তাই এই নুনুকাটা অনুষ্ঠান।
বটকা এখন আব্দুল বারেক।
বটকার গল্প শেষ। এখনকার গল্প আব্দুল বারেকের।
২.
ট্রেনজুড়ে গিজগিজ করছে মানুষ। বসার জায়গা দূরের কথা, দাঁড়াতে পারলেও মানতে হবে ভাগ্যটা ভালো। এই অবস্থাতেও আব্দুল বারেক বসেই এসেছে। বেঞ্চিতে নয়। দুই বেঞ্চির ফাঁকে মেঝেতে দ হয়ে বসে থেকেছে পুরো সময়। মাথা আর হাঁটু চলে এসেছিল একই সমতলে। পিঠ-শিরদাঁড়া বেঁকে সাওতালি ধনুক। সঙ্গীরা এই কামরাতেই আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু কে কোথায় তা বলতে পারবে না বারেক। দেখার জন্য বারেক একবারও মাথা তোলেনি। আসলে মাথা তোলার মতো অবস্থা নেইও। ক্ষিধে আর অনিশ্চয়তায় শরীর মন এতটাই ভেঙে পড়েছে যে দুই পা আর কিছুতেই ধড়টিকে বইতে রাজি নয়। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনোরকমে মানুষঠাসা ট্রেনে ওঠা। তারপরে বেঞ্চিতে বসে থাকা লোকগুলোর পায়ের ফাঁকে ঝুপ করে ময়দার বস্তার মতো বসে পড়া। কেউ কেউ সর সর বলে চিলচ্যাঁচান দিয়েছিল। কিন্তু বারেক নড়েনি। টি টি এসে টিকিট আছে? না থাকলে ট্যাকা বের কর শালা বলে পাঁজরে লাথি কষেছিল। তখনও সে মাথা তোলেনি। ট্রেনের বগির মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ, বিড়ির টুকরা, পানের পিক, গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা বগিঠাসা লোকের শরীরের মিশ্রগন্ধ, হেগে-মুতে জল না ঢালা ল্যাট্রিনের দুর্গন্ধ-- সবগুলো মিলে এক বোঁটকা পাঁঠা-শুয়োরে মেলানো গন্ধ থম ধরে ঝুলে আছে বগির মধ্যে। এসবেও সে নির্বিকার। তার যেন একটাই ইচ্ছা, পরাজিত মুখটাকে দুই হাঁটুর জমিনে চিরতরে লুকিয়ে রাখা।
ন্যাকড়ায় প্যাঁচানো কাস্তের সাথে পেতলের থালাবাটি বিক্রি করে চল্লিশটা টাকা নিয়ে গা ছেড়েছিল বারেক। গাঁয়ে তো মঙ্গা। ভাতের স্বাদ ভুলে গেছে ওরা কয়েকদিন ধরে না খেয়ে খেয়ে। শুয়োরের মতো কচুর কন্দ খুঁড়ে তোলে মানুষ। ধুয়ে সেদ্ধ করলে পেটে কিছু দেওয়া যায়। নুরবানু বাটি হাতে রোজ যায় কোঠাবাড়িগুলোতে। রায়বাড়িতেও। ওরা ফ্যান দিলে নুন মিশিয়ে খাওয়ায় নান্নাকে। চার বছরের নান্না। না খেতে পেয়ে শুকিয়ে হাড্ডিগোনা। দেখায় দুই বছরের মতো। কাঠির কাকতাড়ুয়ার মতো শরীরে বড় দুই চোখ। বারেক ঘরে থাকলে নান্না ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। দুই চোখ যেন বলতে চায়-- বাপ, বড় খিদে লাগিছে, আমারে চাড্ডি খাতি দে! ছেলের চোখের দিকে তাকালেই বারেকের বুক মোচড়ায়। পালিয়ে পালিয়ে থাকে কন্দ খোঁজার নামে। একদিন দেখল পাঁতিপাড়ার শামছু মিয়া মরা কুঁচোসাপ লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেঁড়া গামছায়।
বারেক অবাক হয়ে বলেছিল-- তুমি কি মেথর হয়ি গেছো শামছু ভাই? কুঁচো সাপ খাবা?
মরার চাইতে মেথর হওয়া ভালো। খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল শামছু-- সাপ না খেয়ি করবোডা কী? কেউ কি খাতি দেবি?
তার বউ রাজি হয়নি রান্না করতে। শামছু নিজেই কেটে সেদ্ধ করেছে। খাবার আগে বউ দোহাই পেড়েছে, ওগো বিষ লাগবেনে!
শামছু শোনেনি। নিজে খেয়ে ছেলেমেয়েদের খাইয়েছে। খা খা, দ্যাখ না বাইন মাছের সোয়াদ! হাগা-বমি কিছু হয়নি। শামছু ভয়ঙ্কর হাসি হেসে বলেছে, দেখলা তো, বিষ হতিছে মানুষের প্যাটের বিষ। সেই বিষের কাছে সব বিষ পানি। ইবার থাকি সব খাবো। সাপ-ব্যাঙ-কুত্তা-শিয়াল সব। মঙ্গা আমারে আর মারতি পারবিনানে।
আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গা। এই সময়ে ফেরিঅলা আসে দল বেঁধে। আজব ফেরিঅলা। ওরা কিছু বিক্রি করতে আসে না। আসে কিনতে। ঘটি-বাটি-গরু-ছাগল-কাস্তে-খুন্তি সব বিক্রি করতে থাকে মঙ্গায় আক্রান্ত গাঁয়ের মানুষগুলো। ঘরে খাবার নেই, কোথাও কোনো কাজ নেই, হাট-বাজারে পসরা নেই। মরদেরা পরণের একটা লুঙ্গি রেখে বিক্রি করে দেয় অন্য কাপড়, মেয়েরা একটা শাড়ি বাদে সবকিছু। বাঁচতে তো হবে! ফেরিঅলারা কিনতে থাকে যা পায়। এত সস্তায় অন্য সময়ে তো এসব কেনা সম্ভব নয়। না-খাওয়া মানুষ কচু-ঘেঁচুর খোঁজে ছোটে ডোবা-নালায়। না খেয়ে থাকতে থাকতে মেয়েরা, যাদের গতরে এখনও চটক অবশিষ্ট আছে, ফেরিঅলাদের হাত ধরে চলে যায় নিজের মরদ ছেড়ে। মঙ্গার বিষ। প্যাটের বিষ। বাঁচতে তো হবে।
মঙ্গার শেষে অঘ্রাণে কাজ জোটে আবার। যাদের শরীরে বেচবার মতো শক্তি থাকে, তারা আবার একরত্তি একরত্তি করে ঘর বানায়। যাদের তা থাকে না তারা হারিয়ে যায়। প্রতিবছর মঙ্গা এভাবেই কেড়ে নেয় কয়েকজনকে। খবরের কাগজে লেখা হয়, সাহায্য আসে, মঙ্গার বিষে জর্জরিতদের কেউ কেউ কিছু পায়। কিন্তু মঙ্গা বন্ধ হয় না। ফি বছর নিজেদের মরদকে ছেড়ে চলে যায় কয়েকজন যৌবনবতী নারী, মৃত্যুর বাড়ি যায় অশক্ত পুরুষ, শিশু কয়েকজন।
বারেক যখন বটকা ছিল, টের পায়নি মঙ্গা। তার মনিবের বাড়িতে ভাতে-কাপড়ে ঠিক থাকত। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ টের পায়।
এই গাঁয়ে কাজ নেই, এই জেলায় ভাত নেই। এবারে মঙ্গা এলে গাঁ ছেড়েছিল বারেক। আরও কয়েকজন। বারেকের হাতে ছিল ন্যাকড়ায় জড়ানো কাস্তে আর চল্লিশটা টাকা। নুরবানু খালপাড়ে দাঁড়িয়েছিল নান্নাকে কোলে নিয়ে। ক্ষেতগুলোতে লকলকে ধানচারা কী সবুজ! অথচ গাঁয়ের পর গাঁ জুড়ে মঙ্গার নীল ছোবল।
বারেক বলেছিল নুরবানুকে, যদি সহ্য করি থাকতি পারিস, ভিনগাঁয়ের ফেরিঅলার হাত ধরি চলি না যাস, শুনি রাখ, আমি ফিরে আসপো। টাউনে কাম পাবো। তোর জন্যি ভাত, গ্যাদার জন্যি দুধ পাবো। ভাত-দুধ নিয়া আমি ফিরি আসপো।
ট্রেনের মধ্যে ধ্বসে পড়া বারেক ভাবে, নুরবানু কি এখনও আছে তার অপেক্ষায়? সে তো গাঁয়ে ফিরছে ঠিকই, কিন্তু প্রতিশ্রুত কিছুই সঙ্গে নেই। শহরেও কাজ জোটেনি। জুটলেও পেট-ভাতায়। বারেক যখনই গরাস মুখে তুলেছে, সঙ্গে সঙ্গে মনে ভেসে উঠেছে নান্নার ড্যাবডেবে দুই চোখ-- বাপরে, আমারে চাড্ডি খাতি দে বাপ!
দুইদিন সাতদিন দশদিন। তারপরে সেই পেটভাতার কাজও যে জোটে না। মঙ্গার বিষে নীল হয়ে দলে দলে লোক আসছে শহরে। কে কাকে কাজ দেবে? এত কাজ তো শহরে বন্দরেও নেই। তাই আবার উপোস। শেষ পর্যন্ত বারেকের মনে হয়, না খেয়েই যদি মরতে হয়, তাহলে দূরে কেন, গাঁয়ে ফিরে একসঙ্গে মরাই তো ভালো। কিন্তু ট্রেনে উঠতি গিয়েও বারবার কুঁকড়ে যায় সে। গাঁয়ে ফিরে কী যে দেখতে হবে তাকে? তার নান্না-নুরবানু কি এখনও বেঁচে আছে! মঙ্গার ছোবলে নীল হয়ে যায়নি তো! যদি এখনও বেঁচে থাকে, যদি ভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকে, তাহলে বারেককে দেখে ভাববে, এসে গেছে জীবনের আশ্বাস-- ভাত আর দুধ। তারপর বারেকের শূন্যহাত দেখে কীভাবে মিইয়ে পড়বে তারা!
ট্রেনের প্রত্যেক ঝাঁকুনির সঙ্গে একটু একটু করে গুটিয়ে যেতে থাকে বারেক। এক সময় গড়িয়ে যেতে চায় পোটলার মতো।
আ মরণ দেখি, ব্যাটায় যানি কোলে উঠতি চায়! সর সর!
ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ খোলে বারেক। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় তাকে ধাক্কা দেওয়া যাত্রীর দিকে। তার মতোই মেঝেতে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে কয়েকজন যুবতী ও মাঝবয়সিনী। প্রত্যেকের কোলে ব্যাগ। চালের, চিনির, জিরার। ইন্ডিয়া থেকে আনা। নিজেদের মধ্যে কলকলিয়ে গল্প করে তারা। ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে একটা খাকি পোশাক, এই মাগিরা আজকার তোলা দিলি না!
টেকা দিতি পারবোনানে আজ। অন্যকিছু নিলি নিতি পারেন। চোখ ঠারে একজন।
সবার দিকে ঘুরে বেড়ায় খাকি পোশাকের চোখ। এক যুবতীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুই আয়!
যুবতী অসংকোচে উঠে দাঁড়ায়। ভিড় মাড়িয়ে খাকি পোশাকের সাথে ঢুকে যায় অপরিচ্ছন্ন বাথরুমে। বন্ধ হয়ে যায় বাথরুমের দরজা। একজন মাঝবয়সিনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে-- প্যাটের বিষ!
চমকে ওঠে বারেক, প্যাটের বিষ সবখানে!
আলুনি কচুসেদ্ধ খেয়ে বিড়ি ধরাল বারেক। নুরবানু কোনো প্রশ্ন করেনি ভাত-দুধহীন খালি হাতে আরও নিস্ব হয়ে বারেককে ফিরতে দেখে। বুক ঠেলে হতশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলেও মুখে তা আসতে দেয়নি নুরবানু। নিঃশব্দে বারেকের সামনে তুলে দিয়েছে কচুসেদ্ধ। খাওয়া শেষ হবার পর মৃদুস্বরে স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, ইবারে কী বেচবা?
আবার এলো আদম আলী। গেল মঙ্গাতেও এসেছিল। তাকে দেখেই বুকটা ধক করে উঠল বারেকের। আদম আলী বিড়ি এগিয়ে দিল তার দিকে। কিছুক্ষণ ধোঁয়া টেনে বলল, ইবারে কি ভাবতিছ?
দিমু না। দিতি পারব না। বারেক গত বছরের মতো করেই বলে।
নুরবানু খাবারের সন্ধনে বেরিয়েছে।
আদম আলী নড়েচড়ে যুত হয়ে বসে। গেলবার তো টিকে গেছিলা। ইবার পারবানা। বাচতি চাইলে এর চায়ে ভাল রাস্তা আর নেই। ধরি লও, এই মঙ্গাও পার করলা। তারপর সামনে বার? হয়তো না খেয়েই মরি যাবা গুষ্টিসুদ্দো।
খেঁকিয়ে ওঠে বারেক-- মরলি মরব। ঐ কাম করতি পারব না।
ছাওয়ালডার ফ্যান মেগে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতিছে তুমার বউ। তাও রোজ জুটতিছে না। বাপ হয়ি তুমি ছাওয়ালডার জন্যি এট্টু দুধ জোটাতি পারো না। অসুক-বিসুকে এক ফোঁটা অসুদ-পথ্যি দিতি পারো না। ভাবি দেখো, কামডা করলি তুমার ছাওয়ালের সব জুটপি। ভাত-গোস-ফলমূল-কাপড়-- কুনো কিছুর কমতি থাকবি না।
একটু নরম হয়ে আসে বারেকের চোখ। কোনো কথা বলে না।
আবার খেই ধরল আদম আলী-- ধরগে এই মঙ্গাও তুমি পার করতি পারলা। লাভডা কী হবি? জমি তো আগেই বিককিরি করিছ। এখন তুমার জমি নাই যে চষি খাবা। জাল নাই যে খ্যাপ মাইরা খাবা। তার চেয়ে কামডা করলি এক থোক টেকা পাবা। গঞ্জে একটা দুকান খুলতি পারবা। ছাওয়ালডা বাঁচপে, তুমরাও বাঁচপে।
বারেক আর্তস্বরে বলে, কিন্তু নুরবানু! ছাওয়ালের মা!
পথ্থম কয়দিন আহাজারি, তারপরেই সব ঠিক, বুজলা, সব ঠিক।
আদম আলী আশ্বাস দেয়। তারপর চোখ ঠেরে বলে, তুমার জমিন তো থাকল। আবার বীজ বুনবা। বছর না ঘুরতিই কোল ভর্তি।
আদিম মানুষের মতো মোচড়ানো বুক নিয়ে ফোঁস ফোঁস করে বারেক, যেন ভাষা প্রকাশের উপায় জানা নেই। বুঁজে আসা গলায় শুধু বলতে পারে-- আমার ছাওয়াল! আহারে!
আরে তুমার ছাওয়ালের জন্যিই তো সবকিছু। ছাওয়াল ভালো থাকপে। তুমরাও। ভাবি দেখো এক থোক টেকা। এক সাথে কুনোদিন চোখেও দেখোনি। গঞ্জে দুকান দিতি পারবা। বউডারে গতরের কাপড় দিতি পারবা। মঙ্গা এলে না খেয়ে মরার ভয় নাই। কত সুবিদা একবার ভাবো দিনি!
আমি পারব না! পারব না!
বললেও বারেকের গলায় সেই দৃঢ় সংকল্প নেই আর। অভিজ্ঞ আদম আলীর কান এড়ায় না। উঠে দাঁড়ায় সে-- ভেইবে দেখো আরাকবার। করবা কী করবা না। আমি কাল ধলপহরের আগে গাঁও ছাড়ি চলি যাব। কিন্তু আবার বলি, তুমার ছেলে মরুভূমিত পড়ে থাকপে না। আরবের মানুষ সব এক-একজন বাদশা। তানারা যে বাড়ি বানাইছে বেহেস্তও ফেল। তানারা বাড়ির কুত্তারে যা খাওযায়, তা আমরা ঈদের দিনেও খাইতি পারি না। তুমার ছাওয়াল ভালো থাকপে। বছরে কয়ডা দিন খালি উটের পিঠে দৌড়। বড় হলি আবার ফিরত আসপে কাঁড়ি কাঁড়ি মোহর নিয়া। এখন তুমার ইচ্ছা। তয় যাই করো, আজ রাতেই। আমি কিন্তু ধলপহরে গাঁও ছাড়ি চলি যাবো।
না খাওয়া শরীরে ঘুম আসে যেন সমস্ত অস্তিত্বের বাতি নিভিয়ে দিয়ে। নেতিয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে নুরবানু। নান্নাও। এমনিতেই কচি শিশু, তার ওপরে সারাদিনে জুটেছে শুধু আধাবাটি ফ্যান। ক্ষিধেয় কেঁদে কেঁদে ওইটুকু শরীরের সবটুকু শক্তি শেষ।
রাতের শেয়ালগুলো দ্বিতীয়বার ডেকে চলে যাবার পরে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেকে বুকে তুলে নিল বারেক। ঝাঁপ ঠেলে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় একবার তাকাল করুণ ঘুমন্ত নুরবানুর দিকে। তিন পহরের শেয়াল ডাকলেই রোজ ঘুম পাতলা হয়ে আসে নুরবানুর। পাশ ফিরে ছেলের গায়ে হাত দেওয়া তখন তার অভ্যেস। আজকে হাত বাড়ালেই ছেলের বদলে নুবানুর হাতে ঠেকবে কড়কড়ে একটা তাড়া নোট।
লেখক পরিচিতি
জাকির তালুকদার
জাকির তালুকদার এসময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার। তিনি লেখেন অভিজ্ঞতা থেকে। এবং এই অভিজ্ঞতার জন্য তাকে গ্রামে যেতে হয়নি। তিনি গ্রামেরই মানুষ। এর সঙ্গে মেল বন্ধন ঘটেছে তাঁর বহুমূখী পড়াশুনার। তিনি শুরু থেকে সিরিয়াস গল্পকার। কোনো অর্থেই সখ করে লেখেন না। ফলে তাঁর পাঠকও তাঁর সঙ্গে হয়ে ওঠেন সিরিয়াস। সম্ভবত জাকির তালুকদারই সাহিত্যের সেই প্রাচীন বংশের নিঃশ্ব সন্তান যিনি সত্যি সত্যি লেখালেখির জন্য সব ছেড়েছেন। নিজেকে বাজী ধরেছেন। এবং তাকে পড়া ছাড়া পাঠের পূণ্যি অসম্ভব।
গল্পের পাশাপাশি লিখছেন উপন্যাস ও প্রবন্ধ। প্রথম উপন্যাস কুরসিনামা। মুসলমানমঙ্গল উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকমহলে পরিচিতি পান। তার সর্বশেষ উপন্যাস পিতৃগণ সম্প্রতি জেমকন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
4 মন্তব্যসমূহ
কথাশিল্পী জাকির তালুকদার রচিত গল্প 'দাসপরম্পরা' পড়ে মুগ্ধ। গল্পের উপস্থাপন শৈলী- সংলাপের ব্যবহার,শব্দ চয়ন এবং জীবনঅন্বেষা বেশ তীব্র। তাঁর গল্পের জীবন সত্যের বিশ্বস্ত বয়ান আমাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে।
উত্তরমুছুনগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ভাষার সত্যতায়। এ কোন্ যুগের গল্প? কোন্ সময়ের? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "অশণি সংকেত" মনে পড়ে গেল... কেন জানিনা।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।
haddi khijir, tomij ra jekhane sesh kore chilo barek sekhan thke uthe daralo
উত্তরমুছুনখুব ভালো একটা গল্প।কোথাও অতি-কথন নেই।শ্রদ্ধা।
উত্তরমুছুন