শমীক ঘোষের গল্প জুডাস

Our Father, Who art in heaven, hallowed be Thy name; Thy kingdom come; Thy will be done on earth as it is in heaven. Give us this day our daily bread; and forgive us our trespasses as we forgive those who trespass against us; and lead us not into temptation, but deliver us from evil.

রাস্তাতো না, এক-ফালি পাকা কুমড়ো কেটে ফেলে রেখেছে কেউ। চকচক করছে সকালের রোদে। দূরের হাইওয়ে থেকে ওরকমই মেটে লাল, এঁকেবেঁকে গিয়েছে গির্জার পাশ দিয়ে, আরো দূরে পাহাড়ের দিকে। গির্জার ডানদিকে কয়েকটা টালির চালা, সামান্য ফুলের গাছ আর তারপর কুয়োর পাশ ঘেঁষে পাকা কাঠামো। ঐখানে দেড়পাদ্রী থাকেন।


বাড়ির দরজায় ইংরিজি হরফে লেখা ডেরেক ওয়ালশ – প্যাস্টর। তবে সে নাম যেন বহুকাল আগের, অন্য জন্মের। অনেক দূরে খুব ঠান্ডা ছিল আমেরিকার সেই গ্রাম। সে সব ভুলে গিয়েছেন তিনি। এখন এইখানে এই আদিবাসী গ্রামের মাঝে তিনি দেড়পাদ্রী হয়ে গিয়েছেন।

সকালের রোদ ঠিকরাচ্ছে বুকের উপরে ঝোলা রুপোর ক্রুশটায়। রোদের ঝাঁঝে ইষৎ তেতে তাঁর বাদামী ত্বক। চোখ কুঁচকে তিনি তদারকি করছেন সব কিছুর। এখানে রোদের বড় তেজ। গা ঝলসে দেয়, যেমন ঝলসে দিয়েছে চার পাশের মাটি। লাল পাথুরে মাটিতে ফসল ফলে না প্রায়। বড় গরিব এই চারপাশের আদিবাসী মানুষগুলো। আজ খুব ব্যস্ত তিনি। আজ রবিবার মাস্‌ হবে। আজ আশেপাশের গ্রামের বেশ কিছু লোক খাবে দুপুর বেলায়। সামান্য খাওয়া, খিচুড়ি আর মেটে আলুর তরকারী। তাও অনেক। যারা আসবে তাদের কেউ খৃষ্টান, কেউ নয়। পাদ্রী লক্ষ্য রাখেন। মাঝে মাঝে বলেন, ‘প্রভু তোমাদের মুক্ত করুন।’

ইস্কুলের বারান্দায় ছেলেরা গান ধরেছে। বাইবেলের গান – “আকাশেতে নবতারা/ আবির্ভাবের ইশারা/ দলে দলে ছুটে চলে/ মেষপালকেরা...। খানিক দূরে ওষুধ বিলোচ্ছে যদু। জ্বর, পেট-খারাপ, সাধারণ সব রোগের ওষুধ। ওর জন্যও ভিড় হয় কিছুটা। মাইল দু’য়েক দূরের স্টোনচিপ ক্যোয়ারির শ্রমিকেরাও আসে। যক্ষার চিকিৎসা হয়না, জ্বরের ওষুধ নিয়ে চলে যায়। আসতে আসতে আর আসেনা এক-একটা মানুষ। হয় চলে যায় অন্য খাদানে, নয় মরে যায়। যদু এই সব লক্ষ্য করে, কিন্তু বিশেষ মাথা ঘামায়না। কি করবে? সে ম্যাথিউ যদুনাথ হেমব্রেম। সেই কবে থেকে এইখানে। পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়স হল। ছোটবেলার কথা মনেও পড়ে না। মাঝে মাঝে ভাবে এইসব ছেড়ে সে চলে যাবে দূরের কোন শহরে। একটা ব্যবসা করবে ওষুধের দোকানের। ভাল চলবে। খাদান অঞ্চল হলে আরো ভাল। কয়েক ক্লাস অবধি পড়েছে স্কুলে। চাই কি এক আধটা চাকরিও জুটতে পারে। কিন্তু টাকা লাগবে। কত টাকা তার আন্দাজ নেই। কত হবে? হাজার তিরিশ?

এখন অবশ্য এই সব ভাবারও সময় নেই। ভিড় বাড়ছে। দেড়পাদ্রীর বাতিল বুশ সার্ট, প্যান্ট বড় হয় তার। তবে গ্রামের লোক মান্য করে। আপদে বিপদে দেড়-পাদ্রীর শেখানো ওষুধে যদুই ভরসা।

লোকটা খক খক করে কেশেই যাচ্ছে। কাশির সঙ্গে শ্বাস টানার আওয়াজ। একটানা কাশির দমকে চোখদুটো লাল। মুখে কস বেয়ে শুকনো লালা। ত্বকের রঙ ফিকে নীল। ঐ রঙেই যা বোঝার বুঝল যদু। বাঁচবে না, সিলিকোসিস। ফুসফুসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে বসে গেছে পাথরের ধুলো। এ রোগের চিকিৎসা সে জানে না। দেড়পাদ্রীও না। ছেলেটা ছোট। লোকটারই ছেলে হবে, চকচকে চোখে দেখছে বাবার কাশি। বাপ মরলে ওকেও এই রোগ ধরবে।

মাঝে মাঝে যদু রেগে যায়। দেড়পাদ্রীকে বলে, একটো ডাক্তার আনিয়ে লিন কেনে। চার্চটোকে চিঠি লিখে দিন। ইভাবে হয়! শুদ্দু ক্যালপল, ডাইজিন, রেন্ট্যাক লিয়ে চিকিৎসালয় খুলেছেন বটে।

পাদ্রি হাসেন, বলেন, যাঁর রাখার তিনি রাখার হলে রাখবেন। টেনে নেওয়ার টেনে নেবেন। আমি তুমি কেউ নই। তাছাড়া এই জায়গায় আসবে কোন ডাক্তার! চার্চ যদি ওষুধ পাঠায় দেবে কে? তুমি না আমি ? আমরা কেউতো ডাক্তার নই।

তবে খুলেছেন কেনে?

আমরা না থাকলে এটুকুও হত না। বাচ্চাগুলো স্কুলে আসে। সেটাও কি হত?

যদু রেগে যায়। মাঝে মাঝে ভাবে একবার বলে বসে – আপনি কি বুঝবেন! আপনার দেশ নয়। মানুষগুলো আপনার নয়। আবার ভাবে, লোকটা পড়ে আছে এখানে। দেশ ছেড়ে, নিজের মানুষদের ছেড়ে। চুপ করে যায়।

আবার ভুলেও যায়। ভাবে বেশ টাকা পেলেই সে পালাবে। পড়ে থাক লোকগুলো, যেমন আছে। সে নিজে একটু ভালভাবে বাঁচবে। একটা দোকান খুলবে, বিয়ে করবে, একটা ট্রাঞ্জিস্টার রেডিও কিনবে।



২.

এবড়ো খেবড়ো পাথুরে রাস্তায় বার বার নড়ে যায় সাইকেলের হ্যান্ডেল। শক্ত করে ধরে রাখতে হয়। সকাল বেলা। রোদ এখনও থাবা বসাতে পারেনি, ওত পেতে সবে বসছে শিকারী বাঘের মত। হঠাৎ লাল রঙের মোটর বাইকটা দেখতে পেল। সুনীল মাহাতো।

সুনীলকে দেখে যদু না চেনার ভান করেই এগোচ্ছিল। সুনীল ভাল লোক নয়। আজকাল এখানে থাকেও না। মাঝে মাঝে আসে। মুখে দাড়ি রেখেছে, গলায় সরু সোনার চেন । সুনীল নাকি এখন রাজনীতি করে।

রাস্তা আটকিয়ে দাঁড়াল সুনীল। কেরেস্তানটো আইচে! খুব লায়েক হইছিস বটে। আর কতদিন পাদ্রীর পা চাটবি?

যদু চুপ করে থাকে।

কেনে আমরা মানুষ লই বটেক? গরুছাগল যে অন্য ধর্ম লিব ? উত্তেজিত সুনীলের গলা। শালা! খিচুড়ি গিলিয়ে, উ দাওয়াইগুলান বিলাইয়ে কেরেস্তান বানানো! এসব বেশিদিন চলবেক লাই।

যদুর চোখে চোখ রেখে তাকিয়েই থাকে সুনীল। কি যেন বোঝার চেষ্টা করে। হিস হিসে গলায় বলে, পাদ্রীটোকে ছাড়। আগামী বছর পঞ্চায়েত, তুর একটা বিধিব্যবস্থা হয়ে যাবেক।

ডান হাত দিয়ে অ্যাকসিলেটর নাড়ায় সুনীল। থেমে থাকা মোটরবাইক গোঁ গোঁ করে ওঠে। কোমরটা বাঁকিয়ে এগিয়ে যায় প্রায় যদুর সাইকেল ছুঁয়ে দিয়ে।

যদু দাঁড়িয়ে থাকে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায়, তখনও শোনা যাচ্ছে মোটর বাইকের চাপা গোঙানি।



৩.

ভোররাত থেকে পেটটা ফুলেছে, তলপেটে চাপ-ব্যথা। গলার মধ্যে একটা টকটক ঝাঁঝ। মোক্ষদা শুয়ে আছে। ভোর বেলা মাঠে গিয়েছিল, মাঠেই বমি করেছিল, ওয়াক তুলে।

ধূসর রঙ, গায়ের লোমগুলো যুবতী মেয়ের চুলের থেকে ঘন। ইঁদুরটা কাঁপছিল সামান্য, মুখের ডানপাশে সামান্য রক্তের দাগ। নাতি রঘুনাথ ল্যাজ ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছিল বিকেলবেলায়।

“দ্যাখ গেট্টে। রাঁধ কেনে কষে ঝাল দিয়ে।”

ঘরে চাল ছিল না। চালও এনেছিল রঘুনাথই। চাল, অল্প তেল, শুকনো লঙ্কা। বহুদিন পর মাংস খেয়েছিল বুড়ি। লোভ করে খেয়েছিল, গরম ভাত আর লাল লাল গারডের ঝোল।

তারপর আজ ভোর থেকেই শরীরটা খারাপ। চোখে ভাল দেখেনা বুড়ি মোক্ষদা। রঘুনাথও আজ ঘরে নেই। আজ কিসব পুজো হচ্ছে গ্রামে। এত দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে মাইকের আওয়াজ। বোধহয় খাওয়াদাওয়াও হবে। মন খারাপ হয়। শরীরটা নাড়াতে পারছেনা আজ। রঘুনাথ থাকলে বলত, যদুর থেকে ওষুধ এনে দিতে।

রঘু এল যখন তখন দুপুর পড়ে এসেছে। হাতে শালপাতায় মোড়া ঠোঙা।

পড়ে আছিস কেনে? লে, খাই লে।

রঘু রে, দেড়পাদ্রীর কাছটোতে যা কেনে বাপ। শরীরটো নড়াইতে লারছি, যদুর থিকে উ দাওয়াটো লিয়ে আয়।

নাহ! উয়ার ওষুধ খেলে কেরেস্তান হয়ে যাবি বটে।

কেনে, আগে খাই লাই, তু খাস লাই!

আগে খেতম, ইখন আমরা হিন্দু হইছি বটে। উ সব কেরেস্তানি ওষুধ খেয়ে, খিচুড়ি খেয়ে কি হবেক!

হিন্দু কাকে বলে মোক্ষদা জানে। হিন্দুদের বাড়িতে কাজ করত সে, রাঁচির কাছে যখন মাটি কাটতে যেত তার মরদ। উঠোন ঝাঁট দিত, বাগানের আগাছা তুলত। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দিত না তাকে। সেও ঢুকতে চাইত না, সে ছোট জাত। বাড়ির ফেলা খাবার খেত এনামেলের থালায়, খানিক নিয়ে যেত ছেলেগুলোর জন্য।

মোরা হিন্দু বটে? অবাক হয় সে।

হিন্দু লই বটে ? উয়ার লিগ্যে তো আজ কত খেতে দিল, ভাত, তরকারি, মাংস। মিঠাই। তুর লিগ্যেও ইনেছি। খা কেনে। উ সুনীল মাহাতোটো বুলেছে কেরেস্তান না হলে কাজ দিবেক। ট্যাকাও দিল বটে সক্কলকে, পঞ্চাশ ট্যাকা!

পঞ্চাশ ট্যাকা! মোক্ষদা উঠে বসতে যায়, পারে না। তার মাথা ঘুরছে।

রঘু রে, উ দাওয়াটো আনি দে কেনে। রঘু রে।

রঘু থমকায়। বুড়ি ঠাকুমার অবস্থা জরিপ করে।

যেছি, কিন্তুক দাওয়াই আনলম, কাউরে তু বুইলতে লারবি। শহরটোতে কাজের ব্যবস্থা করে দিবে বুলেছে। আরও বইললো, উয়ার ওষুধ খেলে পুরুষ মানুষগুলান বাঁজা হই যাবেক।

মোক্ষদা শুয়ে শুয়ে ভাবে এইসব। হিন্দু তারা কেন হবে? তারা সাঁওতাল, তাদের ধর্ম অন্য। বহুকাল আগে থেকে এই অঞ্চলে তাদের বাস। দিকু হিন্দুরা নাকি আগে ছিল না। তার মাথা ঘুরছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, ভাল ঠাহর করতে পারছে না ঘরটাকেও।

রঘু ফিরে এল বেশ খানিক পরে। জল এগিয়ে দিল থালায়। বলল, খা কেনে, যদু বইললো, রাতে আরেকবার খাই লিতে হবেক।

ওষুধ খেয়ে, মোক্ষদা শালপাতার ঠোঙাটার দিকে তাকিয়ে রইল জুল জুল করে।

সকাল হয়। দরমার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো ঘরের মেঝেতে ঝির ঝিরে হয়ে ঝরে পড়েছে। রঘু উঠল।

মামাগো, মামাগো (দিদা,দিদা)!

সাড়া নেই। রঘু পাশ ফেরে। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মোক্ষদা, হাত দু’টো মাথার উপর রাখা, সামান্য বেঁকানো। ঠোঁটের পাশ বেয়ে সামান্য নেমেছে কষ, একটা মাছি এক পা দু’ পা করে হেঁটে যাচ্ছে তার উপর।



৪.

“উ দাওয়া লয়, বিষ বটেক।”

“ কেরেস্তানি দাওয়াই খাওয়া! এত বারণ শুনলিক নাই”

রঘু কঁকিয়ে উঠেছিল। ভেবে ছিল সত্যিই কেন আনলাম। কেঁদে ফেলেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সুনীলই হাত রেখেছিল পিঠে, পাঁচশো টাকা দিয়েছিল , হাঁড়িয়া খাইয়েছিল গোটা গাঁটাকে।

আর রোগা হাড় বার করা মানুষগুলো একে অন্যকে ফিস ফিস করে বলেছিল, “উ দাওয়া লয়! বিষ বটেক?”

রঘু সেই থেকে খুঁজছে যদুকে। একা পেলে দেখে নেবে।

আজ পেল। সাইকেলে চড়ে ধীর গতিতে আসছে। রঘু সামনে এসে দাঁড়াল।

দিকু হইছিস বটে। কেরেস্তান!

যদু স্থির চোখে দাঁড়ায়। বলে, মাথা ঠাণ্ডা কর রঘু।

মাথা তুয়ার বাপে ঠাণ্ডা করবেক, উ দাওয়াইটো বুইলে বিষ দিলি। কি খারাপ করেছিলাম তোর?

ওষুধ, ওষুধই তো। পেটের ওষুধ।

রঘু শোনে না। তার শোনার সময় নেই। সোজা ধাক্কা মারে সাইকেলে। অভিঘাত সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যদু, লাথি খায়। একটানা লাথির পর লাথি মারতে থাকে রঘু। তার পর কলার ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকে রাস্তা থেকে দূরে। যদু পালানোর চেষ্টা করে। আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করে মাটি। রুক্ষ পাথুরে মাটিতে হাত ছড়ে যায়।

রঘুও হাঁপিয়ে ওঠে। আচমকা হাতে ভর দিয়ে তার পেটে ঢুঁসো মারে যদু। মেরেই দৌড়য় উল্টো দিকে।



৫.

দেড় পাদ্রী মরবে। তুই বাঁচবি বটেক।

পা বেয়ে বেয়ে মেরুদণ্ড স্পর্শ করে শির শিরে ভয়। যদু চুপ করে থাকে। মাটি সরে যাচ্ছে তার। দেড়পাদ্রির যে আগেই গেছে তাও সে বোঝে।

তু দিকু বটিস লাই, তুর কিসের ডর। উয়াকে ছাড়ি দে কেনে, দেড়-পাদ্রীকে।

আমি, আমি...

চুপ যা। উ পাদ্রীটোকে জ্বালাইন দিব বটেক। পঞ্চায়েত তারপর।

কিন্তু পাদ্রী আমাকে রেখেছে, খেতে দিয়েছে, পাপ যে।

পাদ্রী তুয়াকে কেরেস্তান কইরলো, দিকু কইরলো। তু হিন্দু হ বটে। তুকে আমরা রাখব কেনে।

মাহাতো কবে আদিবাসী হল? সাঁওতাল কবে হিন্দু হল? কে হিন্দু কে আদিবাসী, গুলিয়ে যায় যদুর। এই মাটির গভীরে বিষ আছে, সিলিকোসিসের বিষ। তার চেতনা অবসন্ন হয় , নীলচে আভায় যেন ঢেকে যায় চারপাশ।

টাকা চাস, টাকা দিব। তু আদিবাসী বটে।

তিরিশ হাজার দিব। তু জমি কিনবি তো জমিন, বিয়া করবি তো বিয়া।

আর পাদ্রীর?

উয়াকে জ্বালাইন দিব। হিন্দু হবেক আদিবাসীরা, বনবাসী হিন্দু হবেক।

রঘু ঠাহর করার চেষ্টা করে সুনীলের চোখগুলো। মনে হয় যেন অফুরান বর্ষার মাটি চোষা লাল নদী। হড়কা নামাবে।

পাদ্রী ডুববে। পাদ্রীকে কেউ বাঁচাতে পারবে না এই বান থেকে। সে যদু, যদি ভেসে উঠতে পারে! তিরিশ হাজার নিয়ে চলে যাবে রাঁচি শহরে, কাজ নেবে। তিরিশ হাজার নিয়ে দোকান খুলবে টাউনে। তিরিশ হাজার নিয়ে পাদ্রীর চিকিৎসালয় আবার খুলবে... সব ঠাণ্ডা হলে । তিরিশ হাজার...

অফিস ঘরের ঘোলাটে দেওয়ালের হলুদ টিকটিকি বলে ঠিক ঠিক। তারপর জিভ দিয়ে ছোঁ মেরে তুলে নেয় সামনের পোকাটাকে।



৬.

রাত হলেই যেন কোথা থেকে হাজির হয় রাশি রাশি হাওয়া। পাহাড়ের বুক দিয়ে নেমে, গাছের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে দরজা জানলা কাঁপায়। কাঁপায় মানুষের শরীর। শীত করছে।

“যদু আমি খাব না। তুই নে।” রুটি ছিঁড়ে দিয়ে দেন যদুর থালায়।

যদুর অস্বস্তি হয়। বলে, “ফাদার আমায় কেনে।”

“খাসনি যেন আগে! নে খা।”

নিমকহারামি হবে, অবশ্য তা তো হয়েই যেছে। যদুর পায়ের আঙুল কুঁকড়ে চেপে বসে মেঝেয়। মেঝেতে আঁচড় কাটতে চায় যেন। রুটি গাছের পাতার মত বিস্বাদ মনে হয়।

“প্রভু যিশু, তার শিষ্যদের সাথে ভাগ করে নিতেন রুটি। জুডাস ইসকারিয়ট, প্রভুর যে শিষ্য তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তার সাথেও তিনি ভাগ করে নিয়েছিলেন রুটি, মদ।”

তবে কি পাদ্রী জেনে গেলেন সব! কে বলল? সুনীল কি তবে ফাঁসালো তাকে। যদু চোরা চাহনি দিয়ে দেখে দেড়-পাদ্রীর দিকে। তিনি এক মনে রুটির টুকরো তরকারীতে মাখান।

খচ্চর! সুনীল ঠিক বলে। খেতে দিচ্ছে বলে নিজেকে বড় করছে, ধম্ম শুনাচ্ছে। ভারি তো রুটি তরকারী, তাও যদুই করে।

“আসলে কি জানিস। ইশ্বর যখন মানুষকে তৈরী করছিলেন তখন বোধহয় শয়তানের ছায়া তাতে পড়েছিল।”

যদু কেঁপে ওঠে। চকিতে মেপে নেয় দরজার দূরত্ব। গায়ে কাঁটা দেয়।

“ছেলেগুলো স্কুলে আসাও কমিয়ে দিয়েছে। হিন্দু! মানুষের মর্যাদাও দেয়নি কোনোদিন।”

শালা! ওরা হিন্দু হলে তোর কেরেস্তানি হবে কি করে।

“যদু, একটু জল দে।”

যদুর হাত কাঁপছে। জল ঢালতে যায় পাদ্রীর গেলাসে। জগের ধাক্কায় মেঝেতে ছিটকে পড়ে কাঁচের গেলাস। শব্দ করে ভাঙে।



.

চাঁদের বুক চিরে ফালা ফালা করে ছুরির মত ধারাল মেঘ। জ্যোৎস্না রক্তের মত গাঢ় হয়ে চেপে চেপে বসে রাতের শরীরে। টক্‌ টক্‌, টক্‌ টক্‌। জানলার পাল্লায় টোকা দেয় বুনো হাওয়া।

“যদু, যদু”

ফিস ফিসে সাপের ডাকের মত চোরা আওয়াজ আসে জানলার বাইরে। যদু মুখ তুলে দেখে। দেড়-পাদ্রী ঘুমোচ্ছেন। ও ঘুম ভাঙবে না সহজে।

দরজার ছিটকিনি নামায় খুব সন্তর্পনে। পাল্লা খোলে। মুখ ঢাকা কালো অবয়ব যেন শুধু মানুষ নয়। যদু খামচে ধরে কোমরের পুঁটুলিটা। টাকার স্পর্শে সাহস বাড়ে যেন।

“উ দাওয়াটো মিশায়েছিলি খাবারে?”

“হুঁ ! ”

“সাব্বাশ!”

হুড়কো টানে দরজার। অন্য ছায়া মূর্তিরা ভাগ হয়ে ডিজেল ঢালছে বাড়ীর গায়ে। ফস শব্দে দেশলাই জ্বালায়, ছোঁয়াতে চায় মশালে। জ্বলে না, হাওয়ায় নিভে গিয়েছে দেশলাই। আবার জ্বালায়। মশাল দুপ করে জ্বলে উঠে আলো দেয়। ছায়া মূর্তির মুখে মশালের আগুনে লাল আলো।

পিছনে লাফ দিয়ে সরতে থাকে তারা। যদুকেও টেনে নেয়। হাওয়ার দমক যেন ছুঁচ ফোটাচ্ছে যদুর শরীরে। মশাল ছুঁড়ে দেয় দরজার দিকে। ধীরে ধীরে জ্বলতে জ্বলতে লোভী আগুন চুষে গিলে চিবিয়ে খায় বাড়ী – গির্জা সব।

যদু ছোটে, ছুটতেই থাকে। তাকে ঘিরে আরো জোরে ছোটে মাংস পোড়া গন্ধ। আর পিছন পিছন হাওয়ার আর্তনাদ। তারপর কখন এক সময় গির্জার ক্রুশের আগুন আকাশে লেগে গিয়ে আকাশটাকেও করে তোলে গনগনে লাল।




শরীর জুড়ে হেঁটে যাচ্ছে লাল পিঁপড়ের সারি। কামড়াচ্ছে না। হেঁটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, যেন তাড়া নেই কোথাও পৌঁছানোর। পাদ্রীর শরীর অবসন্ন লাগছে। গোটা রাতটা যেন দুঃস্বপ্নের মত।

জলের গেলাসটা পড়ে যাওয়ার পর যদু কেঁদে ফেলেছিল। পা জড়িয়ে ধরেছিল পাদ্রীর।

“ফাদার আপনি মরে যান। তিরিশ হাজার অনেক টাকা। আমি নতুন করে বাঁচব।”

দেড়পাদ্রী ভয় পেয়েছিলেন। তিনি প্যাস্টর, ধর্মই তাঁর কাছে সব। মরতে তাঁর তো ভয় পাওয়ার কথা নয়। তবু বাঁ হাতটা কাঁপছিল তাঁর। শীত করছিল।

যদু গোঙাচ্ছে। গোঙাতে গোঙাতে পা জড়িয়ে ধরে দেড়পাদ্রীর, “আমি কি করলাম!” পাদ্রী কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই যদুকে তিনি ছোট থেকে বড় করেছেন। যদুকে তাঁর ভয় লাগছিল।

বেশ কিছুক্ষণ গোঙানোর পর থামে যদু। বলে, “ফাদার জোব্বাটা খুলুন।”

দেড়পাদ্রী স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন।

“খুলুন ফাদার সময় খুব অল্প। জোব্বাটা খুলে রাখুন। আমি আসছি।”

বস্তাটা টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল যদু। বস্তার গায়ে শুকনো রক্তের দাগ লেগে আছে। বস্তা ভর্তি শুয়োরের মাংস। সেটাকেই জোব্বাটা পরায় যদু। তাঁর গলা থেকে খুলে নেয় ক্রুশটাও।

“ফাদার, আপনি জানলা দিয়ে বেরিয়ে যান। রাতটা বসে থাকবেন জঙ্গলে। ভোর হলেই হাইওয়ে ধরে চলে যাবেন। লরি দাঁড় করিয়ে উঠে যাবেন।”

“তুই যদু? তুই কি...”

“আমি ...আপনি যান বাবা সাহেব”, যদু ধাক্কা মারে , “গামছাটা মাথায় জড়িয়ে নিন।”

পাদ্রী উঠে দাঁড়ান ধীরে ধীরে। এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে দেখেন কালো পোড়া চার্চের দিকে। ঘর ছেড়ে, সব ছেড়ে একদিন এসেছিলেন এখানে, আজ তাও গেল। গলার ক্রুশটা ধরে দেখতে যান। নেই। অস্ফুটে বলে ওঠেন, “যদু...!”


ভোর হচ্ছে। কালো রাতে গায়ে হালকা নরম ফিকে ভাব। পাদ্রী আর দাঁড়ান না। ছুটতে থাকেন হাইওয়ের দিকে। যদি একটা লরি থামানো যায়।



লেখক পরিচিতি
শমীক ঘোষ

গল্পকার। 
প্রবন্ধকার। 
পড়াশুনা ঃ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
বোম্বে থাকেন। চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অসম্ভব ভালো এক গল্প। সময়ের সীমা পার করে দিয়ে ছুঁয়ে যায় ভাবনা...
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন
  2. অসম্ভব ভালো এক গল্প। সময়ের সীমা পার করে দিয়ে ছুঁয়ে যায় ভাবনা...
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন