’এই ডিম, সিদ্ধ ডিম’ হাঁকে ফেরীওয়ালা। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো একজন যাত্রীকে একটা মুরগীর ডিম কিনতে দেখি। বুঝতে পারি তিনি স্বাদ বিলাসী। পরিমানের দিকে আকর্ষন থাকলে তিনি হাঁসের ডিম কিনতেন। পরিমানে না হলেও স্বাদের দিক থেকে হাঁসের ডিমের কাছে মুরগীর ডিমের জিত। অবশ্য এটা আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক তত্ব। ভুল হতে পারে। দেখি ডিমওয়ালা ঝুড়ির গহবরে কাপড়ে মোড়ানো ডিমগুচ্ছ থেকে একটা ডিম বের করছে। স্মৃতি থেকে বলতে পারি ডিমের গায়ে তখনও ক্ষণস্থায়ী ওম লেগে আছে। ডিমওয়ালা নিপুন ভঙ্গীতে ডিমের খোলস ছাড়ায়। খোলস ছাড়ানো হলে একটা সুতার ছুড়ি দিয়ে ডিমটাকে দু’ভাগ করে সে মাঝখানে ছিটিয়ে দেয় লবন। আমি বরাবর ডিম বিক্রেতার পরিবেশন নৈপুন্যে মুগ্ধ। খানিকটা প্রলুব্ধ হলেও ইদানিং জীবনু সচতেনতা আমাকে বেশ ভীতু করে তুলেছে। ফলে ক্ষুধা নিবারনের জন্য আমি ডিমের বদলে কলা কিনি। কলা বরং নিরাপদ। পৃথিবীর সব ফল গোলাকৃতি হলেও কলা কেন লম্বাটে এই ধাঁধা নিয়ে ভাবতে ভাবতে প্ল্যাটফর্মের কোলাহল লক্ষ করি।
এসময় মাইকে শব্দ ভেসে আসে, সন্মানিত যাত্রীবৃন্দ চট্রগামগামী তুর্না নিশীথা চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাবে। ষ্টেশনের মাইক থেকে যে শব্দ প্রবাহিত হয় তার একধরনের আধিভৌতিক চরিত্র আছে। মনে হয় যেন বা কোন গায়েবী আওয়াজ শুনছি। প্ল্যাটফর্মের জনস্রোতে খানিকটা চাঞ্চল্য দেখা দেয়। কেবিনে একাই বসে আছি। বাকী যাত্রীদের তখনও দেখা নাই।
’তুর্না নিশীথা’ ট্রেনটার যাত্রা শুরু যে সামরিক শাসনামলে সেকথা আমার মনে পড়ে। ট্রেনের নামকরনের ব্যাপারে শাসক মহাশয়ের একটা ভুমিকা আছে বলে শোনা যায়। সামরিক শাসক কবি হলে জবরজঙ্গ একটা যানবাহনও হয়ে উঠতে পারে কাব্যিক। মাঝরাতে অন্ধকার প্রান্তরের ভেতর হু হু করে ছুটে চলে যে ট্রেন তার ’তুর্না নিশীথা’র চেয়ে মোক্ষম নাম আর কি হতে পারে? অবশ্য নামটার ভেতর একটা ফেমিনিন ব্যাপার আছে। ট্রেনটাকে ঝড়ের রাতের কোন অভিসারিকাও ভেবে নেয়া যায়; আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার। ল্যাটিন আমেরিকার সামরিক শাসকদের নিয়ে চমৎকার সাহিত্য হয়েছে। আমাদের সামরিক শাসকরাও কৌতুহলোদ্দীপক, তাদের নিয়েও সাহিত্য হতে পারে।
এইসব ভাবনার মুখে কেবিনে দু’জন যাত্রী ঢোকেন। একজন বৃদ্ধ, সঙ্গে আরেকজন অপেক্ষাকৃত তরুন। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটা ধুতি পড়া। এশহরে কোন ধুতি পড়া লোক শেষ কবে দেখেছি মনে করবার চেষ্টা করি। মনে করতে পারি না। আমার দাদা মৌলভী মফিজুদ্দিন তরফদারের একটা ধুতি পড়া ছবি আছে। শুনেছি তিনি বেশ সৌখিন ধরনের ধুতি পড়তেন। ধুতি পড়া বৃদ্ধকে সঙ্গের তরুন হাতে ধরে এনে সীটে বসায়। বৃদ্ধকে ক্লান্ত দেখায়। তরুন ব্যাগ ইত্যাদি গোছগাছ করে নেয়। বলে--বড় জ্যাঠা মশাই, আপনি তো বাঙ্কারে উঠতে পারবেন না, আপনি নীচে থাকেন। আমি উপরে ব্যাবস্থা করছি।’ বৃদ্ধ বলেন- ’হ্যা বাবা, তুমি এই সীটেই চাদর টাদর বিছিয়ে দাও, আর দেখোতো একটু জল যোগাড় করা যায় কিনা ? তরুন কেবিনের জানালায় গলা বাড়িয়ে একটা পানির বোতল কেনে।
এইসময় আমার সহসা মনে হয় এই তরুনকে আমি চিনি। তার কপালের ডানদিকে একটা বড় কাটা দাগ। ঐ কাটা দাগ দেখে আমি আরো নিশ্চিত হই যে এ তরুন পিনাকী। তার মা মাগুর মাছ কুটবার সময় পিনাকী পা পিছলে বটির উপর পড়ে এবং তার কপাল গাঢ়ভাবে কেটে যায়, সামান্যের জন্য তার চোখ রক্ষা পায়। তারপর যে বিবিধ কান্ড ঘটে মনে আছে সে গল্প আমাকে অনেকবার করেছে পিনাকী। পিনাকী রঞ্জন ঠাকুর। পিকানীকে আরো মনে আছে ওর নামটার জন্যও। ত্রিভুবনে আমি শুধু তিনজন ঠাকুরকে চিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাহেরুদ্দিন ঠাকুর আর পিনাকী রঞ্জন ঠাকুর। এক ঠাকুর নোবেল পেয়েছেন, আর এক ঠাকুর শেখ মুজিবের হত্যার সঙ্গে জড়িত, পিনাকী ঠাকুরের ভবিষ্যত কি হবে এবিষয়ে জল্পনা ছিলো আমাদের।
কিন্তু তুর্না নিশিথার কেবিনে পিনাকী আমাকে ঠিক লক্ষ করে না। বৃদ্ধ জ্যাঠা এবং মালপত্র নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। পিনাকী তারপর ভর্তি হয়েছে এক শহরের ম্যাডিকেলে, আমি আরেক শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর বছর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো। পিনাকী দেখতে পাচ্ছি বেশ তরুন আছে এখনও। আমাকে নিশ্চয়ই অতটা তরুন দেখায় না?
ট্রেন ছাড়ে। আমি জানালা দিয়ে অপসৃয়মান মানুষ দেখি। পিনাকীর ধুতি পড়া বৃদ্ধ জ্যাঠা মশাই নীচের সীটটাতে গা এলিয়ে দেন। পিনাকীকে দেখি বাঙ্কারে উঠবার আয়োজন করছে। আমার দিকে একবার হয়তো চোখ পড়ে তার কিন্তু কেবিনের অল্প আলোয় সে আমাকে দেখতে পায় বলে মনে হয় না। আমি ভেবে দেখি বাঙ্কারে উঠবার আগেই পিনাকীকে পাকড়াও করা দরকার। বলি--পিনাকী চিনতে পারছিস আমাকে ? পিনাকী এবার ভালো করে ফিরে তাকায় আমার দিকে। তারপর হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সে- ’আরে শালা তুই? কত বছর পর বলতো? আমরা মুহুর্তে সংযুক্ত হয়ে যাই। পিনাকী বলে- দরজার কাছে চল, একটা বিড়ি ধরাই। মনে পড়ে সিগারেটকে পিনাকী বরাবরই বিড়ি বলে থাকে। আমরা ট্রেনের দরজার কাছে যাই। খুলে ফেলি দরজা। হু হু বাতাস ঢোকে। আমরা বাতাস আড়াল করে সিগারেট ধরাই।
এত দীর্ঘদিনের অসাক্ষাতের পর কথার সূত্রটা স্থাপন করা খানিকটা দুরুহ হয়ে পড়ে। সিগারেটে টান দিয়ে পিনাকী বলে- তারপর ?
আমিও পাল্টা বলি-তারপর ?
পিনাকী বলে- ভেবেছিলি চলে গেছি ?
মনে মনে তা ভেবেছিলাম বটে। চলে যাওয়া তো অব্যহত আছে বহুকাল। প্রকাশ্যে, গোপনে। আমাদের তো এমনই ধারনা যে এক পা তাদের ওপারেই স্থাপিত। আমাদের বন্ধু বিকাশ শর্মা একদিন উধাও হয়ে গেলো কাউকে না বলেই। জানতাম পিনাকীর বাবা’মাও চলে গিয়েছিলেন, গিয়েছিলো ছোট বোনটাও। ওর বড় ভাই প্রতুল গিয়েছিলো কিনা মনে করতে পারি না। পিনাকীরও একবার চলে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো। মনে আছে ওকে বলেছিলাম-- কোলকাতায় যাবা ? সেইখানে বীভৎস মজা’। আমি আর পিনাকী এক সঙ্গে বসেই ঋত্বিক ঘটকের সুবর্নরেখা দেখেছিলাম। আমরা হরপ্রসাদ রুপী বিজন ভট্টাচার্যকে ঈশ্বর চক্রবর্তীর উদ্দেশ্যে এই সংলাপ বলতে শুনেছিলাম। পিনাকীকে সেই সংলাপ শুনিয়ে আমি হেসেছিলাম প্রচুর, পিনাকী হেসেছিলো কিনা মনে পড়ে না। ফলে পিনাকী চলে যেতে পারে এমনটা আমি ধরেই নিয়েছিলাম।
আমি সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলি--গেলি না তাহলে ?
পিনাকী বলে--না গেলাম না। কি আর যাবো?
এতে কেন সে গেলো না তা স্পষ্ট হয় না। তবে পিনাকী বলে কোলকাতায় তার মা এবং বোন বিশেষ ভালো নাই। সেখানকার বীভৎস মজা তারা টের পেয়েছেন। বাবা মারা গেছেন ওখানে যাবার বছর খানেক পরেই। আমরা পরষ্পরের স্ত্রী সন্তানদের খবরাখবর নিই। শুনি পিনাকীর দুই মেয়ে।
আমি জিজ্ঞাস করি - তোর বড় ভাইটা কোথায়, প্রতুলদা ?
পিনাকী বলে - দাদা তো তো বরাবরই ঢাকাতে।
বলি- তোদের বাড়ি না ময়মনসিংহে। আত্মীয় স্বজন আছে সেখানে ?
পিনাকী- না, না ময়মনসিংহে তো আর কেউ নাই। দাদারাই সব বিক্রি করে চলে গেছেন পঞ্চাশ সালে। বাবারা চলে এসেছিলেন ঢাকায়, তারপর সেখান থেকে কোলকাতা। আমি আর প্রতুলদা, আমরা দু‘জনই তো থেকে গেলাম। ময়মনসিংএর দিকে আমার যাওয়াই পড়ে না। বাবা থাকতে তাও যেতেন মাঝে মাঝে।
জিজ্ঞেস করি - চিটাগাংই আছিস ? বদলীর চেষ্টা করলি না ?
পিনাকী- সেবার ইলেকশনের পর বেশ জোর একটা বদলীর চেষ্টা করেছিলাম।
পিনাকী কোন নির্বাচনের কথা বলছে আমি বুঝতে পারি। নির্বাচন পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতিতে সে বদলীর চেষ্টা করছিলো অনুমান করি। পিনাকী অবশ্য আগেও আমাকে একবার বলেছিলো যেকোন নির্বাচনের পুর্বাপর সময় সে কি বিশেষ মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যায় সেটা আমার বোধ্যগম্য হবে না। সে কলেজ ম্যাগাজিনে একবার একটা নিবন্ধও লিখেছিলো- মুক্তিযুদ্ধের তিন ’ম’ এই শিরোনামে। যাতে সে এই তর্ক তুলেছিলো যে মুক্তিযুদ্ধ মুলত যেন, মিলিটারী, মধ্যবিত্ত আর মুসলমানদের ব্যাপার হিসেবেই পর্যবেশিত হয়েছে। সে অনেকদিন আগের কথা। তখন সেরকম সাহস সে দেখাতে পেরেছিলো। এখন পারবে কিনা সন্দেহ করি। আমি সতর্ক হয়ে তার কথা শুনি।
পিনাকী বলে-সেই ইলেকশনের পর একদিন বাসে দেখি এক লোক বলছে- -এই শালা মালাউনগুলি যায় না ক্যান এই দেশ থাইকা? সন্দেহ নাই এটা অনেকেরই মনের কথা কিন্তু পাবলিকলি এত কনফিডেন্স নিয়ে এর আগে কাউকে বলতে শুনি নাই। তখনই বদলীর চিন্তা করলাম। ভাবলাম ঢাকায় যাওয়ার চেষ্টা করি, দাদার কাছাকাছি থাকি। একটা ইনসিকিউরিটি কাজ করছিলো আর কি।
জিজ্ঞাসা করি-চেষ্টা করেছিলি?
পিনাকী বলে- চেষ্টা মানে সিভিল সার্জন স্যারকে বললাম। একদিন বাসাতেও গেলাম সন্ধ্যায়। কাজের লোক বলে, ’স্যার নামাজ পড়তাসে বসতে বলছে।’ আমি বসে থাকলাম। স্যার নামাজ সেরে আসলেন। বললাম, ’স্যার অনেকদিন তো হলো এখানে এবার একটু ঢাকার কাছাকাছি যেতে চাই, একমাত্র ভাইটা থাকে ওখানে। ঢাকা প্রপারে তো হবে না, মানিকগঞ্জ, ঘিওর কোন একদিকে একটা বদলীর ব্যাবস্থা স্যার করে দেন।’ আমার কথা শুনে সিএস স্যার কি বলে জানিস ?
আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় থাকি।
পিনাকী বলে- আমার কথা শেষ হবার পর সিএস স্যার টুপিটা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন, তারপর বললেন- ’শুন পিনাকী এই দ্যাশে বইসা ডাক্তার হইছো, সেইটাই হাজার শোকর কর, বদলী টদলীর এত আশা কইরো না।’
ট্রেনের দরজা দিয়ে আসা তুমুল বাতাসে আমার সিগারেট নিভে যায়। আমি আবার সিগারেট ধরাই। চেকার এসে আমাদের টিকিট চেক করে। যাবার সময় বলে, দরজাটা লাগান। আমরা বলি, লাগাবো। তারপর লাগাই না।
এসময় আমরা নির্মলেন্দু গুনকে স্মরন করি। আমরা পরস্পরকে বলি যে নির্মলেন্দু গুন ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন। পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। ভাইবাতে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো কোলকাতায় তার কোন আত্মীয় থাকেন কিনা। গুনের বড়ভাই যে কোলকাতায় চলে গিয়েছিলেন সে কথা তিনি ভাইভা বোর্ডকে জানান। আমরা জানি যে এরপর তাকে আর কোন প্রশ্ন করা হয়নি এবং তিনি ভর্তি হতে পারেননি। পিনাকী অবশ্য বলে তাতে বরং ভালোই হয়েছে। আমরা একজন কবিকে পেয়েছি। তা না হলে নির্মলেন্দু গুন হয়তো রোডস এ্যান্ড হাইওয়েজের ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বসে বসে ঘুষ খেতেন। কিন্তু ডাক্তার না হলে পিনাকীর সদরঘাটে কুলিগিরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো বলে তার ধারনা। সুতরাং সে তার সি এস স্যারের কথা শিরধার্য্য করে চিটাগাংএই পড়ে আছে। বদলীর আশা ত্যাগ করেছে আপাতত।
আমরা কিছুক্ষন নীরব থাকি। ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে তাকাই। বাইরে রাত ঘন হয়ে এসেছে। রাতের শরীর চিরে এগিয়ে যাচ্ছে তুর্না নিশীথা। আমরা চুপচাপ ট্রেনের চাকার অবিরাম শব্দ শুনি। পিনাকী বলে- তোর মনে আছে আমাদের হাকিম স্যার ক্লাসে একটা কবিতা বলতেন-
ধায় গাড়ি ধুম ছাড়ি ধায় শত পায়
ঝড় গতি দ্রুত অতি দুনিয়া কাঁপায়
ভাপরার বাজে ভেঁপু, প্রাণপনে বাজে ভেঁপু
কানে তালা লাগে তবু খুসী উথলায়
ধায় গাড়ি ধুম ছাড়ি ধায় শত পায়
আমার তা মনে পড়ে। আমার আরো মনে পড়ে হাকিম স্যার বলতেন তার বাড়ি রেলষ্টেশনের খুব কাছে হওয়াতে ট্রেন ব্যাপারটা নিয়ে তার একটা অবসেসন আছে। এই কবিতায় যে ইমেজ রয়েছে বলা বাহুল্য সেটা স্টিম ইঞ্জিনের। পিনাকীর কথায় বাগেরহাটে ন্যারোগেজ রেললাইনে স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেনে চড়বার স্মৃতি মনে পড়ে আমার।
আমি জানি টুকরো টুকরো করে এখন আরো বিবিধ স্মৃতি আমাদের মনে পড়বে। আমি তার আগে আমার মনের ভেতর যে খটকাটা লেগে আছে তার নিস্পত্তি করতে উদ্যত হই। পিনাকীকে বলি- আচ্ছা এই ফাঁকে আমাকে একটু তোর ঐ ধুতি পড়া জ্যাঠা মশাইয়ের ব্যাপারটা কি বলতো ? আজকাল তো এভাবে একজন ধুতি পড়া লোককে রাস্তাঘাটে দেখি না।
পিনাকী বলে- এ তো জটিল কেস। দাঁড়া আরেকটা বিড়ি ধরাই।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে পিনাকী আমাকে জানায় এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসেছেন কোলকাতা থেকে। তার বাবার সবচেয়ে বড়ভাই, তাদের বড় জ্যাঠা। বয়স সত্তর পেরিয়েছে। তার দাদার সাথে সেই পঞ্চাশেই চলে গিয়েছিলেন কোলকাতায়। তারপর আর কোনদিন ফেরেননি এদিকে। ধুতি ব্যাপারটা নিয়ে পিনাকীরও একটা অস্বস্থি আছে জানায়। ধুতির চল কোলকাতাতেও যে এখন আর তেমন নাই পিনাকী আমাকে তা স্মরন করিয়ে দেয়। তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে এভাবে ধুতি পড়ে চলাফেরা করা যে খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না সেটা তার জ্যাঠাকে সে বলেছে বলে আমাকে জানায় পিনাকী। কিন্তু জ্যাঠা মশাই বরাবরই ধুতি যুগের মানুষ। প্যান্ট, পায়জামার যুগে তিনি প্রবেশ করেননি, করতে চানও না।
পিনাকী বলে- বেশ কিছুদিন ধরে উনি এক ধোঁয়া তুলে আসছিলেন যে মরবার আগে তিনি তাদের আদি ভিটাটা একবার দেখতে চান।
আমি জিজ্ঞাসা করি - মানে তোদের ঐ ময়মনসিং এর বাড়িটা ?
পিনাকী বলে- হ্যা, ঐ ময়মসিংহেই যাওয়ার ইচ্ছা তার। নষ্টালজিয়া আরকি। কিন্তু তার বয়স হয়েছে, শরীর টরীর ভেঙ্গে গেছে। ভিসার কতরকম ঝামেলা। কোলকাতার সবাই নিষেধ করলো তাকে। তাছাড়া ঐ দেশভাগের সেন্টিমেন্ট নিয়ে কে আর এখন মাথা ঘামায় বল? কার অত সময় আছে? কিন্তু জ্যাঠা নাছোড়বান্দা। শেষে নানা ঝামেলা টামেলা করে ভিসা পাওয়া গেলো।
জানতে পারি পিনাকীর জ্যাঠা মৈত্রী ট্রেনে চেপে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন গত সপ্তাহে এবং উঠেছিলেন পিনাকীর বড় ভাই প্রতুলদার ওখানে। প্রতুলদা পিনাকীকে অনুরোধ করেছে জ্যাঠা মশাইকে ময়মনসিং ঘুরিয়ে আনতে। এসব দেশভাগ জনিত আবেগ নিয়ে পিনাকীর তেমন কোন উৎসাহ নাই। খানিকটা বাধ্য হয়েই সে তার জ্যাঠাকে নিয়ে গেছে ময়মনসিংহে। কোলকাতা ফিরবার আগে জ্যাঠা মশাইকে তার চিটাগাংএর বাড়িতে একবার ঘুড়িয়ে আনবার ইচ্ছাতেই সে আজ চড়ে বসেছে তুর্না নিশীথায়।
জিজ্ঞাসা করি- ময়মনসিংহে পেলি তোর দাদা’র বাড়ি ?
পিনাকী বলে- সেটা তো এক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
আমি কৌতুহলী হই জানতে।
পিনাকী বলে- একটু কেবিন থেকে দেখে আসি জ্যাঠার কিছু লাগবে টাগবে কিনা।
পিনাকী ঘুরে এসে বলে- বেচারা ঘুমিয়ে পড়েছেন।
আমরা ট্রেনের দরজাটা লাগিয়ে দিই। দীর্ঘক্ষনের দমকা হাওয়ায় একটু ঠান্ড ঠান্ডা লাগে। দরজা বন্ধ করে দেয়াতে শব্দ খানিকটা কমে। পিনাকীর কথা শুনতে সুবিধা হয়। পিনাকী আরেকটা সিগারেট ধরায়।
এরপর পিনাকী আমাকে তার জ্যাঠা মশাইকে নিয়ে ময়মনসিংহ অভিযানের গল্প শোনায়। ময়মনসিংহের রাস্তাঘাট বিশেষ কিছু চেনে না বলে বেশ অনিশ্চয়তা নিয়েই ট্রেনে রওনা দেয় পিনাকী। কিন্তু পিনাকী লক্ষ্য করে জ্যাঠা মশাই ট্রেন ষ্টেশনগুলোর নাম মনে করতে পারছেন। এমনকি জামালপুর পর্যন্ত সবকটা ষ্টেশনের নাম তিনি বলে যান পিনাকীকে- বাইগুনবাড়ি, বিদ্যাগঞ্জ, পিয়ারপুর, নুরুন্দী, নান্দিনা। পিনাকী এসব জায়গার নামও কখনো শোনেনি। জ্যাঠা মশাই তাকে বলেন, ময়মনসিংহে নেমে তাকে নিয়ে যেতে হবে ময়মনসিং জিলা স্কুলের কাছাকাছি। তিনি নিশ্চিত সেখানে গিয়ে তার বাবা ক্ষেত্ররঞ্জন ঠাকুরের বাড়ির কথা বললেই লোকে তা চিনতে পারবে কারন ঐ এলাকায় তাদের বাড়িটাই ছিলো সবচেয়ে বড়।
ময়মনসিংহে নেমে জ্যাঠাকে নিয়ে রিকসায় চড়ে পিনাকী যথারীতি যায় জিলা স্কুলের কাছে। সেদিন শুক্রবার ফলে স্কুল চত্বর ফাঁকা। কাছের এক পান দোকানদারকে পিনাকী প্রথম জিজ্ঞাসা করে ক্ষেত্ররঞ্জন ঠাকুরের বাড়ির কথা। কিন্তু জ্যাঠাকে অবাক করে দিয়ে পান দোকানদার ক্ষেত্ররঞ্জনকে চিনতে পারে না। সে বরং পাশের কনফেকশনারীর কারিগর এ এলাকার পুরনো বাশিন্দা হালিম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়। হালিম মিয়াকে পাওয়া যায়। তাকে ক্ষেত্ররঞ্জনের কথা জিজ্ঞসা করলে সে বলে- ঠাকুর মাকুর কাউরে চিনি না ভাই।এই এলাকার হিন্দুরা তো সব গেছে গা বহুতদিন আগে।’ জ্যাঠা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। আশেপাশের আরো বেশ কয়টা দোকানে জিজ্ঞাসা করা হলেও কেউ ক্ষেত্ররঞ্জনকে চেনে না। জ্যাঠা রিকসা থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে বিষ্মিত চোখে চারিদিকে দেখতে দেখতে বলেন --কি ভীষণ বদলে গেছে সব পিনাকী, আমি কিচ্ছু চিনতে পারছি না। স্কুলের চারপাশটায় ছিলো শুধু প্রান্তর ভরা ধান ক্ষেত। কিন্তু আমি বড় অবাক হচ্ছি যে কেউই বাবাকে চিনতে পাচ্ছে না।’
একজন ধুতি পড়া লোক বিহবল হয়ে এদিক ওদিক এভাবে ঘুরছে দেখে লোকজন কৌতুহলী হয়ে তার দিকে তাকায়। পিনাকীর অস্বস্থি বেড়ে যায়। জ্যাঠা এসময় শানকি পাড়া বলে একটা জায়গার নাম স্মরন করতে পারেন। লোকজন তখন তাকে শানকি পাড়ার রাস্তা দেখিয়ে দেয়। কিন্তু জ্যাঠামশায় এও নিশ্চিত করেন যে শানকি পাড়া তিনি খুঁজছেন না। তার সময় ওটা ছিলো মুসলমান পাড়া। ওনাদের বাড়িতে যেতে হতো শানকি পাড়ার উল্টোদিকের রাস্তায়। তখন সেদিকটায় তেমন কোন পাড়া গড়ে ওঠেনি ফলে তার কোন নামও ছিলো না। কিন্তু জ্যাঠামশায় যে দিকটা দেখাচ্ছেন সেদিকে গিজগিজ করছে দোকানপাট, মার্কেট, বেশকিছু দোতালা বাড়ি, কয়েকটা বহুতল ফ্ল্যাট। তার ভেতর দিয়ে হিজিবিজি গলি। জ্যাঠা মশায় এসময় কয়েকটা ল্যান্ড মার্কের কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, তাদের বাড়ির দিকে যেতে ছিলো গুরু ট্রেনিং সেন্টার, সেখানে গুরু যশোদামাল ব্যায়াম শেখাতেন। নামজাদা ব্যায়ামবীর তিনি। এও বলেন তাদের বাড়ির কাছাকাছি ছিলো ভুষন ময়রার দোকান। আর ছিলো রাম বাবুর লন্ড্রি। ধোপাবাড়ি তখন বিস্তর থাকলেও লন্ড্রী নাম দিয়ে তিনিই ঐ এলাকায় প্রথম তেমন একটা দোকান খুলেছিলেন। পিনাকী এইসব ল্যান্ডমার্কের সুত্র ধরে বাড়িটা চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঐ যশোদামাল, ভুষন কিম্বা রাম বাবু সবই বিস্মৃত নাম এ লোকালয়ে। কেউ তাদের হদিস দিতে পারে না।
জ্যাঠা মশাই বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। পিনাকী জ্যাঠাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, এ বাড়ি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। পেরিয়ে গেছে ষাট বছরের বেশী সময়, সেই গহবর থেকে কি করেই বা ক্ষেত্র ঠাকুরের বাড়ি উদ্ধার করা সম্ভব? পিনাকী আশংকা করে সে বাড়ি ভেঙ্গে এতদিনে নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে নতুন কোন ফ্ল্যাট।
জ্যাঠা নীরব থাকেন কিন্তু হাল ছাড়েন না। কিছুক্ষন ভাবেন তিনি। তারপর বলেন, ‘বাবা পিনাকী তুমি আমাকে আবার জিলা স্কুলের গেটের ঠিক সামনে নিয়ে যাও।‘ পিনাকী তাই করে। এবার জ্যাঠা মশাই জেলা স্কুলের গেটের দিকে পিঠ রেখে দাঁড়ান। চোখ তার সামনে। পঞ্চাশ সালে জ্যাঠা যখন চলে গেলেন তখন তিনি এই জেলা স্কুলের চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র। বয়স দশ কিম্বা এগার। জ্যাঠা স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে পিনাকীকে বলেন, ষাট বছর আগে তিনি রোজ এই স্কুল গেট থেকে বেরিয়ে ঠিক যেভাবে, যে পথে বাড়ি ফিরতেন, আজ তিনি সেইভাবে, সেই পথে বাড়ি ফিরবেন। এভাবেই তিনি খুঁজে নেবেন তার হারানো বাড়ি।
এ প্রস্তাবে খানিকটা বিহবল হয়ে পড়ে পিনাকী। জ্যাঠা তার ধুতির কাছাটা শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে ধীর পায়ে সামনে এগোতে থাকেন। পিনাকী নীরবে তাকে অনুসরন করে। জ্যাঠা একটা গলির ভেতর ঢোকেন। পিনাকী দেখে গলির মুখে একটা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার। দু’পাশে বেশ কিছু বাড়ি। কোন কোন বাড়ির নীচে মুদির দোকান, ফটোষ্ট্যাটের দোকান। জ্যাঠা এসব কিছু লক্ষ্য করেন না। তিনি ঘোরগ্রস্তের মত যেন অব্যর্থ এক লক্ষের দিকে এগিয়ে চলেন। আশে পাশে লোক ঘুরে জ্যাঠা এবং পিনাকীকে দেখে। জ্যাঠা বামে ঘুরে আরেকটা গলিতে ঢোকেন। সেখানেও রাস্তার দু’পাশে বাড়ি। সেখানে অনেকগুলো কোচিং সেন্টার। এক বাড়ির দোতালায় ’সুরভী কোচিং সেন্টার’, আরেকটাতে সানরাইজ কোচিং সেন্টার’। বাড়ির ছাদে কাপড় মেলে দিতে দিতে এক মহিলা তাদের দিকে নীচু হয়ে তাকায়। জ্যাঠা মশায় হঠাৎ যেন বেশ প্রাণ ফিরে পেয়েছেন, তাঁর হাঁটার গতি বেড়ে যায়। পিনাকী খানিকটা অসহায়ের মত নীরবে এই সত্তরোর্ধ বৃদ্ধের পেছন পেছন হেঁটে চলে। পিনাকীর মনে হয় সে যেন ধুতি ফতুয়া পড়া, হাতে খাতা পেন্সিল, পায়ে ধুলো মাখা এক স্কুল ফেরতা বালকের পেছন পেছন হাঁটছে।
হাঁটতে হাঁটতে জ্যাঠা শেষে একটা বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ান। একটানা হেঁটে এবার তিনি পিনাকীর দিকে পিছনে ফিরে বলেন-- এইটাই আমাদের বাড়ি।’ পিনাকী দেখে উঁচু গেটটা তালা দিয়ে বন্ধ। গেটের ফাঁক দিয়ে একটা দোতালা বাড়ি দেখা যায়। সামনে একটা ছোট্ট বাগান। বাড়ির উপরে সাইনবোর্ড--নিউইয়র্ক কিন্ডারগার্ডেন’।
পিনাকী বলে- আপনি নিশ্চিত এটা আপনাদের বাড়ি? চিনতে পারছেন বাড়িটা?
জ্যাঠা এতক্ষন হেঁটে বেশ ক্লান্ত। তিনি একটা বড় শ্বাস নেন এবং গেটের ফাঁক দিয়ে আরেকবার বাড়িটা দেখেন। তিনি বলেন, তাদের বাড়ি দোতালা ছিলো না কিন্তু বাড়ির সামনের ঐ উঠান, ঐ বারান্দা তিনি চিনতে পাচ্ছেন। তিনি নিশ্চিত প্রতিদিন স্কুল থেকে হেঁটে এখানেই তার যাত্রা শেষ হতো এবং চাইলে এখন তিনি চোখ বন্ধ করে আবার এখান থেকে চলে যেতে পারবেন জেলা স্কুলের গেটে।
জ্যাঠা মশাই পিনাকীকে দরজায় ধাক্কা দিতে বলেন। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পিনাকীর মনে একাধারে খানিকটা বিশ্ময়, খানিকটা ভীতি কাজ করে। এ বাড়ি যদি সত্যিই জ্যাঠামশাইয়ের হয় তাহলে ব্যাপারটা কি অদ্ভুত হবে ভেবে অবাক হয় পিনাকী আবার ভাবে এতবছর পর কোলকাতা থেকে এক লোক এসেছে এ বাড়ি দেখতে, সেটা এ বাড়ির এখনকার বাশিন্দারা যে সহজভাবে নেবে তা বলা যায় না। জাটিলতা তৈরী হতে পারে।
এরপর পিনাকীর বয়ান- দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখি একতালার বারান্দায় পাঞ্জাবী পড়া লম্বা সাদা দাঁড়ি, টুপি মাথায় এক বুড়া লোক বসে পেপার পড়ছে। সেটা দেখে তো আমার ভয় বেড়ে গেলো আরো। ভাবি এই হুজুর যদি এখন দেখে এক ধুতি পড়া লোক তার বাড়িতে উঁকি ঝুঁকি মারছে, তাহলে না জানি কোন ঝামেলা বাধায়? আমি সাহস করে লোহার গেটে ধাক্কা দিই। দাঁড়ি, টুপি ভদ্রলোক পেপার হাতে নিয়েই বাগান পার হয়ে লোহার গেট খোলেন। আমাদের দেখে একটু কপাল কুচকান। আমি তাকে লম্বা করে একটা সালাম দেই- ’আসসালামালাইকুম চাচা। উনি কোলকাতা থেকে এসেছেন, একসময় এই বাড়িটা উনার বাবার ছিলো, বাড়িটা জাস্ট একটু দেখতে এসেছেন।’ বলেই আমি বেশ নার্ভাস থাকি। কে জানে ভদ্রলোক এই নিউইয়র্ক কিন্ডারগার্ডেনের দীনিয়াতের টিচার কিনা। ছুটির দিনে হয়তো একটু আরাম করে বসছেন পেপার পড়তে, সেইখানে এক লোক কোলকাতা থেকে এসে যদি বলে এই বাড়ি আমার ছিলো, তাহলে তার ভালো লাগার কথা না। পুরা ব্যাপারটায় একটা গ্যাঞ্জাম লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে।
হুজুর ভদ্রলোকের কপাল কুঁচকেই থাকেন। জ্যাঠাকে জিজ্ঞাসা করেন- কি নাম আপনার বাবার?
জ্যাঠা বলেন- ক্ষেত্র রঞ্জন ঠাকুর।
দাঁড়িওয়ালা লোকটার একটু যেন ভাবান্তর হয়। তার কপালের গিট খোলে, বলে- আপনি ক্ষেত্র বাবুর ছেলে? এরপর লোকটা জ্যাঠার দিকে খুব ভালো করে তাকান, বলেন- তুমি কি নেত্র নাকি?
জ্যাঠা বলেন- হ্যা আমি নেত্র রঞ্জন ঠাকুর।
দাঁড়িওয়ালা লোকটার মুখে এবার হাসি ফোটে- কি আশ্চর্য ব্যাপার, আমার নাম সোহরাব। সোহবার আলী । চিনতে পারতেছ?
পিনাকী বলে -আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। ফাঁড়াটা কাটলো বলে মনে হয়। কিন্তু আমি লক্ষ করি জ্যাঠা ঠিক চিনতে পারছেন না। দাঁড়িওয়ালা লোকটা বলতে থাকেন- আরে আমার বাবা মোহরম আলীই তো তোমার বাবার কাছ থেকে এই বাড়িটা কিনলো। বাড়ির দরদাম, দলিলপত্র যখন হইতেসে, তখন তো বাবার সাথে রোজ আসতাম আমি। তোমরা সবাই তখন এই বাড়িতে। তোমার সাথে রোজ দেখা হইতো আমার, খেলতাম। তুমি তো জিলা স্কুলে আমার দুই ক্লাস নীচে পড়তা, আমি ছিলাম সিক্সে।
হুজুর ভদ্রলোক যখন এই সব বলছেন আমি লক্ষ করি জ্যাঠা মশাইয়ের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। তিনি ক্রমশ তাকে চিনতে পারছেন। জ্যাঠা বলেন- খুব মনে পড়েছে। আপনার এই সাদা দাড়ি দেখে কি করে চিনি বলুন?
দাঁড়ি ভদ্রলোক সাদরে আমাদের ভেতরে ডেকে নেন। বলেন- বাবা মরলে বাড়িটারে দোতালা করছি। নকশা কিছু বদলাই নাই। আমার ছেলেমেয়ে সব থাকে ঢাকা। এতবড় বাড়ি কি করবো, এই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলরে ভাড়া দিছি।
জ্যাঠা বলেন- পেছনের বাগানটা কি আছে এখনও?
সোহরাব আলী বলেন- বাগানটা ঐরকমই রাখছি। পুরান গাছের মধ্যে খালি ঐ চোষা আমের গাছটা আছে।
জ্যাঠা উৎফ্ল্লু হয়ে ওঠেন- আছে গাছটা?
সোহরাব বলেন- আছে তো, দেখবা?
তারা দু’জন তড়িতে উঠে পেছনের বাগানের দিকে রওনা দেন। যেতে যেতে সোহরাব আলী বলেন- নেত্র তোমার মনে আছে, তোমরা যাওনের কয়দিন আগে আমি আর তুমি মিলা ঐ গাছটার নীচে একটা বেজী ধরছিলাম?
পিনাকী এর পরের পর্ব বর্ননা করে- তারপর বুঝলি, দুজনে ছোটে পেছনের বাগানের দিকে। সামনে সোহরাব আলী আর আমার জ্যাঠা তার পেছন পেছন। আমিও তাদের পিছে পিছে যাই। চোষা আমের গাছটা দেখে জ্যাঠা রুদ্ধবাক হয়ে থাকে কিছুক্ষন। কাছে গিয়ে গাছের বাকলে হাত রাখে। এরপর দু’জনে মগ্ন হয়ে পড়ে গল্পে। আমার কথা দুইজনে একরকম ভুলেই যায়। আমি দুর থেকে দেখি, পুরনো এক আম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে এক ধুতি পরা বৃদ্ধ আরেক দাঁড়িটুপিওয়ালা বৃদ্ধের সঙ্গে ষাট বছর আগের এক বেজী ধরার গল্প করছে।
এরপর তারা দু’জন ঘরের ভেতর ঘুরে ঘুরে দেয়ালের, বালিশের, সিন্দুকের, লাটিমের, ঘুড়ির গল্প করে। যশোদামাল ব্যায়ামবীরের গল্প করে, ভুষন ময়রা, রাম বাবুর লন্ড্রির গল্প করে। ইতিমধ্যে চা হয়, বিস্কুট হয়।
একফাঁকে আমি ফিরতি ট্রেনের কথা জ্যাঠাকে স্মরন করিয়ে দেই। সম্বিৎ হয় জ্যাঠার। তারা তারপর পরষ্পরের কাছ থেকে বিদায় নেন।
পিনাকী এরপর বহুদিন আগের কলেজ ম্যাগাজিনের লেখক হয়ে ওঠে। বলে- শেক্সপিয়র বলেছিলো না, সব বিদায়ের ভেতরই খানিকটা মৃত্যুর উপাদান থাকে। ওনাদের ঐ বিদায়টা দেখে আমার সে কথাটা মনে পড়ছিলো। দুজন দীর্ঘক্ষন এককোষী এ্যামিবার মত পরষ্পর যুক্ত হয়ে থাকবার পর এবার বিভাজিত হন। একদিকে টুপি, অন্যদিকে ধুতি।
এরপর ময়মনসিংহ ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে পিনাকী আর তার জ্যাঠা। ষ্টেশনের কোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়ে জ্যাঠা মশাই বলেন-’বুঝলে পিনাকী, এবার আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারি।’ তার চোখ ট্রেন লাইন বরাবর।
আমি আর পিনাকী ট্রেনের ভেড়ানো দরজার পাশে তখনও দাঁড়ানো। পিনাকী ট্রেনের দরজাটা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই ভেতরে হামলে পড়ে বাতাস। বাইরে ঘোর রাত তখন। দেখি ট্রেন কুমিল্লা ষ্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে। রেল লাইনের ধার ঘেষে বাড়িটার সবাই নিশ্চয়ই পাশ ফিরে শোয়? তারা ঘুমের মধ্যেই টের পায় তুর্না নিশীথা যায়। আমি আর পিনাকী আরেক দফা সিগারেট ধরাই।
লেখক পরিচিতি
শাহাদুজ্জামান
জন্ম ঢাকায়। ১৯৬০।
গল্পকার। ঔপন্যাসিক। প্রবন্ধকার। অনুবাদক।
গবেষক।
শিক্ষক, নিউ ক্যাসেল ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।
প্রকাশিত বই
উপন্যাস : ক্রাচের কর্নেল, শাহবাগ , দূরগামী কথার ভেতর,
গল্প : কয়েকটি বিহ্বল গল্প, অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প,
প্রবন্ধ : বায়োস্কোপ চলচ্চিত্র প্রভৃতি, লেখালেখি, চ্যাপলিন আজো চমৎকার, ভাবনা ভাষান্তর।
3 মন্তব্যসমূহ
স্মৃতিপুঞ্জের দেখা মিলেছে অবশেষে অনেক কষ্ট করে । আর কিছু পেতে নয় । চাইবার দাবী করবার আর কি ই বা থাকতে পারে ! টুপি-ধুতি দু'এর বন্ধনটা প্রকাশ পেয়েছে চমৎকার মানবিক দায়বদ্ধতায় । খুব ভালো লেগেছে
উত্তরমুছুনএই গল্পটি নিয়ে 'একই পথে' বলে একটা শর্ট ফিল্ম হয়েছে। রবিউল আলম রবির চিত্রনাট্য ও পরিচালনায়। খুব ভাল লেগেছে আমার। ইউটিউবে আছে শর্ট ফিল্মটি। অসাধারণ এই গল্পটির জন্য শাহাদুজ্জামানকে সাধুবাদ জানাই।
উত্তরমুছুনকতগুলো বাস্তবতার সমন্ময় যোগে গল্পটি আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকার পরে যখন গ্রামে যাই তখন এরকম একটা আবেগ হয় । কখন দেখবো মাটির উপরে কাঠের সেই বাড়িটি ও চেনা যায়গাগুলি।
উত্তরমুছুন