মণিকা চক্রবর্তীর গল্প স্বপ্নে মেঘের নূপুর

বেশ কদিন ধরেই দম আটকানো লোডশেডিং। এ সময়গুলোতে ছকে বাঁধা জীবন থমকে যায়। জ্যৈষ্ঠমাসের গরমে রাতের বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে সিকান্দার গভীর ঘুম ভেঙে হঠাৎ জেগে ওঠে। দীর্ঘমেয়াদি গভীর অন্ধকারে বাথরুমের দরজাটা খুঁজে পেতে খানিকটা সময় নেয় সে। দেয়াল ধরে-ধরে এগিয়ে যেতে যেতে জমাট বাঁধা প্রস্রাবের যন্ত্রণা আর দমবন্ধ গরম নিয়ে গোটা শরীরটাকে অন্ধকার বাথরুমে খাপ খাইয়ে নিয়ে কমোডে বসে পড়ে সে। শরীর চিরে জলের ধারা নিষ্ক্রমনের পর কমোডের ফাশের গর্জন গাঢ় অন্ধকারের নৈঃশব্দ্যকে কিছুটা ম্লান করে দেয়।


নিঃশব্দে গুপ্তচরের মতো সিকান্দার অন্ধকার ঘরের এপাশ-ওপাশ হেঁটে বেড়ায়। মোমবাতি আর দেশলায়ের খোঁজ না পেয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটু হাওয়া নেই। গাটা পুড়ে যাচ্ছে! গায়ের চামড়াটা যদি খুলে ফেলা যেত! সন্ধ্যাবেলায় মোবাইল ফোনটা হাত থেকে পড়ে যেয়ে সুইচ্ড অফ হয়ে আছে। সকালেই সারাতে নিতে হবে, মৃদুস্বরে বিড়বিড় করে সিকান্দার। তবু একবার আলোহীন ঘরে ফোনটাকে টিপে দেখে একটু আলো বের করা যায় কি না! রাত এখন কয়টা হবে! দুইটা বা তিনটা। দূরে কয়েকটি কুকুর ডেকে যাচ্ছে। সিকান্দার ভেবে নেয় রাত তিনটা বাজে। সিকান্দার যুবক মানুষ, তরতাজা শরীর। রাতের অন্ধকারে কুকুরের তীব্র চিৎকার তাকে গোপনে ভয় ধরিয়ে দেয়। গুমোট ঘরে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে সিকান্দার ভয়, অন্ধকার আর শরীরের গরমকে পাশ কাটিয়ে অন্য ভাবনায় ডুবে যেতে চায়। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, এই দুইরুমের বাসায় বড়সড় একটা বারান্দাও নাই। ছোট্ট কিচেনের পাশে এক চিলতে বারান্দা। তাতেই তাদের মা-ছেলের দু’জনের আকাশ দেখার বিলাসিতা। মা কিছুদিন ঢাকায়, কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে। সিকান্দার একার উপার্জনে কুলিয়ে উঠতে পারে না। গ্রামের জমি-জমা পুকুর বর্গা দিয়ে যেটুকু বাড়তি আয় হয় তাতে টানাটানির সময়টায় সামাল দেয়া যায়। তবু কেন জানি গ্রামে আর ফেরা হলো না সিকান্দারের। সেই যে পাঁচ বছর আগে বি-এ পাশ করে আজিমপুরে পুরোনো সরকারি কোয়ার্টারে চাচার বাসায় এসেছিল চাকরির খোঁজে, তারপর এই নাগরিক জীবনের সমস্ত অসঙ্গতি ও অপ্রাপ্তি নিয়েও এইখানে থেকে যাওয়া। কিছু আশা আর স্বপ্ন নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিল এই যান্ত্রিক জীবনে। কখনও ভাবেনি, বাড়ি যাবার পথটা সে এমনি করে ভুলে যাবে। বুকের মধ্যে লুকানো প্রবাহমান নদীর স্রোত নিয়ে সে তখন হেঁটে পার হচ্ছে জেব্রা ক্রসিং, আজিমপুরের কবরস্থান সংলগ্ন সরু অন্ধকার গলি, নীলতে, নিউমার্কেট, মতিঝিল। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে কান্ত হয়ে কখনও উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে কিনেছে দু’টাকার বেলি ফুলের মালা। প্রচণ্ড রৌদ্রে জ্বলতে জ্বলতে দেখেছে সবুজ স্বপ্নগুলো পাতা হয়ে দুলছে বাতাসে। উদ্ভাসে ফুলে উঠেছে ফুসফুস, গ্রামে ছেড়ে আসা সেই কালো মেয়েটির কথা ভেবে। নির্বাসিত শহুরে জীবনে কতবার লটারির টিকেট কিনে নিয়ে দেখেছে আলাদীনের চেরাগ ঘষার স্বপ্ন। জেব্রা ক্রসিং, বেলিফুল, আলাদিনের চেরাগ আর তার প্রেমিকা কোহিনুর মিলে মিশে যেন চমৎকার এক রূপকথা হয়ে যায় কোনো এক জাদুমুহূর্তে।

ঢাকায় আসার দু’দিন আগে কোহিনুরকে নিয়ে সিকান্দার গিয়েছিল নদীর ধারে বেড়াতে। সেদিনের নির্জন সন্ধ্যায় নদীর পারের গাছগুলোর পাতারাও ছিল সুনসান। কোহিনুরের চোখে নিঃশব্দে টলমল করেছিল দু’ফোটা জল। তার মনে কোথাও যেন জমে উঠেছিল গোপন অভিমান। সিকান্দার টের পেয়েছিল, আরও বেশি অসহায় লাগছিল তার সেই মুহূর্তে।

তুমি আব্বারে কিছু কও! সে তো এ ব্যাপারে রাজি না। কোহিনুরের কথাগুলো তীব্র সুচের মতো হুল ফুটিয়ে দিয়েছিল সিকান্দারকে।

এখনও চাকরি-বাকরি পাই নাই। কেমনে কই! তয় আমি ঢাকা গিয়াই আম্মারে কমু তোমার আম্মুর লগে কথা কইতে। আমারে একটা মাস সময় দাও কোহিনুর। একটা মাস যাইতে কয় দিন। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে কোহিনুর কি ভাবছিল সিকান্দার তখনও জানে না।

নিঃশব্দে নদীর ওপারের সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে ছিল কোহিনুর। সূর্যটা তখন ডুবতে গিয়ে দু-টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। সেই আধখানা সূর্যের দিকে তাকিয়ে সিকান্দারের মনে হয়েছিল কোহিনুর যেন নিঃশব্দে ছুরি চালিয়ে স্বপ্নিল লাল সূর্যটাকে দু-ভাগ করে দিয়েছে। আকাশ আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে এল। স্তব্ধতায় পার হয়ে গেল ভাঙা সাঁকো, রাস্তা, নতুন ব্রিজ। না, কোহিনুর তাকে কোনো সময় দেয়নি। ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো অস্থিরভাবে আট-দশদিন যেতে-না -যেতেই কোহিনুরের বিয়ে হয়ে গেল পাশের গ্রামে। সিকান্দার আজও ভেবে পায় না তাদের গভীরতর সম্পর্কের কতটুকু সত্যতা ছিল কোহিনুরের মনে! খণ্ড-বিখণ্ড হতে হতে এইসব ভুল-চুক সম্পর্কের কথা সে ব্যাকুল হয়ে ভেবেছে। নিজের শিকড়-বাকড় উপরে ফেলে উদাসী হয়ে দিনের পর দিন হোঁটে বেড়িয়েছে। মরা প্রাণ আর বিবশ শরীর নিয়ে মাঝে মাঝে নেশার ঘোরে ডুবেছে। তবু সে ভুলতে পারেনি অজস্র শ্রাবণ আর বসন্ত দিনের কথা। শুকনো বাঁশপাতার স্তুপে, জোনাক জ্বলা ঝোপে, ঢোলকলমির আড়ালে লুকিয়ে চুপিচুপি দেখা করার কথা। এই ঘুনধরা শরীর আর মন নিয়ে সিকান্দার আর ফেরেনি বাপের ভিটায়। নিজেকেই ভয় পেয়েছে সিকান্দার। ভিতরের গোপন হিংসাগুলো আজও আলো-অন্ধকারে ছোবল দেয়, কোহিনুরের সাথে দেখা হলে যদি সে সাপ হয়ে যায়। গোখরো সাপের ফনা হয়ে ছোবল দেয়। তার গোপন থাবা, নখ, তিরস্কার, রিরংসা, পৌরুষ সবকিছু নিয়েই সে কোহিনুরের মুখোমুখি হতে পারতো। হয় নি, হতে পারেনি! নিজেকে দূরে সরিয়ে আলগোছে ফেরারি মানুষের মতো থাকতে চেয়েছে। তার মনের ভিতর আজও ভালবাসা হয়ে বেঁচে আছে কোহিনুর। থাক বেঁচে থাক। ওইটুকুই যে তার সম্বল। মনের গুমোট ঘরে যে আর্তনাদ উপচে পড়েছে তার দরজায় সে তালা লাগিয়ে দিয়েছে শক্তভাবে। তবু মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে উপচে পড়েছে তপ্ত ফেনা। চাকরি খুঁজে খুঁজে কান্ত হয়ে এ পথে আর পথ হাঁটেনি সিকান্দার। নিজেই খুলে বসেছে একটি বুটিকের দোকান। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দোকানে যেয়ে প্লাস্টিকের ডামিগুলোকে নানা রঙিন কাপড়ে সাজিয়ে তুলতে খুব ভালো লাগে তার। কালো ডামিটাকে যখন সাদ-কালো শাড়ি বা লাল-সবুজ সেলোয়ার কামিজ পরাতে থাকে তখন তার শরীরের রক্ত কেমন যেন টগবগ করে ফুটতে থাকে। কালো ডামির দিকে তাকিয়ে মনে হয় কোহিনুর তাকিয়ে আছে। তাকাতে তাকাতে তার বেদনার অনুভবকে সে অনেকগুলো চোখ দিয়ে অনন্তের পথে নিয়ে যায়। তবু সে ভালোবাসে ডামিগুলোর উরু, উদোম নিতম্ব, জঘন, উদোম বাহু আর যুবতী-বুক। সব সাজের পর হাতের আলতো স্পর্শে কখনও বা সোনালি চুলে পরিয়ে দেয় কদম ফুল অথবা শরতে পাঁচ টাকায় কেনা শিউলি ফুলের মালা। সিকান্দরের এই সব কর্মকাণ্ড দেখে দোকানের বুড়ো কর্মচারী মুখ টিপে হাসে। সিকান্দার নিচু হয়ে ঘৃণার অতলান্ত থেকে কুড়িয়ে আনে খণ্ডিত প্রেম, খণ্ডিত স্বপ্ন। বড় নিরীহ হয়ে বেঁচে থাকে সে। আর সেই সব উৎক্ষিপ্ত হাসি বড় বেশি চাবুকের মতো লেগে থাকে তার মনে।

রাত অনেক হলো, সিকান্দার ঘুমুতে পারছে না। সাদা-কালো সময়ের সাথে জড়িয়ে থাকা অপমান, প্রতারণা আর দীর্ঘশ্বাসের মাঝে সে খেই হারিয়ে ফেলতে থাকে বারবার। অতঃপর সে চেষ্টা করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে, নিজেরই বুকের ভিতর।



০২.
আজও মধ্যরাতে সিকান্দর হৃদয়ের সবটুকু ধুকধুকানি নিয়ে শোবার ঘরের বিছানার কোনায় উঠে বসে। কাপড়ের কিপ দিয়ে আটকে রাখা জানালার পরদাটিকে একটু সরিয়ে দেয় অস্থিরতায় কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে। নিশ্চল আর টানটান হয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের ফ্যাটের জানালার দিকে। সেখানে ছায়াছন্দ ঘরের নীল আলোতে বইয়ের পাতা উল্টানোর মতো পাল্টে যাচ্ছে অসাধারণ সুন্দরী এক নারী শরীর। সিকান্দার উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকে। তার মাথার ভিতর সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছাস টের পায়। ঢেউগুলি ভেঙে পড়ে আর অনেক দূর সরে যায়।

সে মাথা নিচু করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে, অজান্তে শরীরে তার গমক খেলে। তার ভিতরে কামনার নীলসমুদ্র ফুঁসে ওঠে। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল ডিভানটি ছেড়ে। ওর স্কাটটা হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলে ছিল। টিশার্ট মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে বুকটা খানিকটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে হাত দুটি পিছনে নিয়ে সে বেশ যত্নের সাথে টিশার্টটিকে খুলে ডিভানের উপর রেখে দিল। তার উন্মুক্ত স্তন দুটি আবৃত হয়ে ছিল গোলাপি ব্রা দিয়ে। এক মুহূর্ত পরেই লাল ও সোনালি রঙে কাজ করা স্কাটটিও স্থান পেল ডিভানটির উপর। মেয়েটির পরনের গোলাপ প্যান্টি ঢেকে রেখেছে ত্রিকোণ অন্ধকারটুকু। নীল আলোতে কাপড়ের রংগুলো ঠিক স্পষ্ট রোঝা যাচ্ছে না। সিকান্দার প্রতিদিনের মতো আজও মনযোগ দিয়ে বিষয়টি ল করে। প্রতিদিনের মতো আজও সে অনেক দূর থেকে পেয়ে যাচ্ছে মেয়েটির শরীরের ঘ্রাণ। অ্যাটাচ্ট বাথরুমে ঢুকে মেয়েটি এখন জল-সাবানের ফেনা আর সহস্র বুদ্বুদে নিজেকে পরিষ্কার করবে। নাভির আর বগলের নীচের অন্ধকারগুলোর কথা ভেবে সিকান্দার আর একবার রোমাঞ্চিত হয়। মনে হয় সে রয়েছে যমুনাপুলিনে। কিন্তু বাথরুমের দরজা ভেদ করে তার দৃষ্টি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। প্রচণ্ড আেেপ সিকান্দার তার চারপাশের অন্ধকার নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। জানালার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে শূন্য ঘরটিকে। এক পাশে ওয়ার্ডরোব, তার দরজার একপাশের পাল্লায় বড় করে ল্যামিনেটেড করা মেয়েটির নীল শাড়িপরা ছবি। মুখটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। অন্য দিকে ডিভানের উপর ছেড়ে যাওয়া কাপড়ের ¯তূপ। ওয়ার্ডরোবের উপর একটি বড় টিভি অন করা, সাউন্ডটা মিউট বোঝা যাচ্ছে। ঘরের এক কোণে একটি রকিং চেয়ার। বিছানাটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তবে তার সাদা চাদরটির এক কোনার ঝুল ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। ফাইবার গ্লাস দেয়া জানালার পর্দা তোলা। জানালাটি খুলে রাখা হয়েছে নিশ্চিন্তে, বাতাস যেন ঢুকে পড়তে পারে সাঁ সাঁ করে। মেয়েটি কখনও জানে না বাতাস ও চাঁদের আলোর মতো সিকান্দারের চোখ দুটিও এই ঘরে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। সিকান্দারের মগজে বোনা হয়ে যাচ্ছে রাতের এই দৃশ্য নিবিড়ভাবে। প্রায় প্রথম দিকে সিকান্দার এই বিষয়টিকে স্বপ্ন না সত্যি ভেবে বিভ্রম হয়ে থাকত, এখন সে প্রতিরাতেই এই দৃশ্যটির জন্য অপো করে থাকে। সব কাজের শেষে শেষ আশ্রয়ের মতো ওই সুন্দর দেহটির ছায়া কিছুণ তার সাথে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়; তারপর সে ঘুমাতে যায় নিশ্চিন্তে। মুগ্ধতাটুকু নিয়ে ঘুমায়। দিনের বেলা কাজের ফাঁকে ফাঁকে মুগ্ধতার আবেশটুকু থেকে যায়, মাঝে মাঝে বেসুরো গলায় গান গেয়ে ওঠে সিকান্দার। ডামিগুলোর সবকটি জামার রং ভালোবাসায় সবুজ করে দিতে চায়। বুড়ো কর্মচারী অবাক হয়ে দেখে আর ভাবে সিকান্দারের মতিগতি তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

০৩.
সিকান্দার তার নিস্তব্ধ রহস্যগুলো নিয়ে দিন যাপন করে। ঘুরে যায় বার্ষিকগতি। নিজের মধ্যে অন্য এক বিভাজিত সত্তাকে আবিষ্কার করে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। পুরোনো প্রেমের স্মৃতি তার মাথার ভিতর গুঞ্জরিত হয়ে গভীর বেদনার সঞ্চার করে এবং স্বস্তির জন্য লম্পটের মতো নগ্ন মেয়েটির পেছনে সে ধাওয়া করে। মাঝে মাঝে তার নিজেকে নির্লজ্জ আর নষ্ট মানুষ বলে মনে হয়। সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, তার কোন পরিচয়টি সত্য। কোহিনুরকে ভালোবাসা, না এই নগ্ন মেয়েটির পেছনে ধাওয়া করা! জানা-অজানার, ভালো-খারাপের সীমাটুকুর অস্পষ্টতা নিয়ে সে নিজের ভেতরে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে। সে বুঝতে পারে আলো ও অন্ধকারের মতো দুটো জায়গাতেই সে সমান ভাবে বিভাজিত।

পহেলা বৈশাখের সকাল। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় মানুয়ের ভীড়। লাল-সাদা রংয়ে ছেয়ে গেছে বৈশাখের প্রখর দুপুর। মানুয়ের মুখে-চোখে আনন্দ উপচে পড়ছে। গত দু-দিন ধরে সিকান্দারের আর ফুরসৎ নেই, দোকানে কেনা-বেচার বড় চাপ। তবু কেনা-বেচার অবসরে বাইরে তাকিয়ে তীব্র রোদের সাথে সে তার অন্তর্দাহ ছাড়া আর কিছুকে মিলাতে পারে না। পহেলা বৈশাখের সব রং তার কাছে ব্যর্থ হতে হতে, তার অলস চোখের ঘোর কাটিয়ে দিয়ে কার জগৎটাকে চুরমার করে দিয়ে বাইরের সব আলো নিয়ে সেই মেয়েটি হঠাৎ দোকানে ঢুকে পড়ে। মেয়েটির রূপের আলোতে তার চোখ ঝলসে যেতে চায়। মেয়েটি ফোনে কথা বলতে বলতে নানা রঙের কাপড় আর শাড়ি দেখতে থাকে। সিকান্দার থানের পর থান নামায়, ডামির গায়ে পরানো কাপড় এগিয়ে দেয় আর তার চারপাশে একটা মাদকতাময় সুগন্ধ টের পায়। সে ভেবে পায়না তার মস্তিষ্কটা শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক আছে কি না। অনেক কাপড় ঘেটে ঘেটে মেয়েটি তিনটি আনস্টিচ্ড থ্রিপিস পছন্দ করে। সিকান্দার মেয়েটির মোবাইল ফোনের কথাবার্তা থেকে কিছু তথ্য উদ্ধার করে। আজ সন্ধ্যার লঞ্চে সে বরিশাল যাবে। ছোট তিন বোনের জন্য কাপড় কেনা হলো। মেয়েটি কোনো একটি টি ভি চ্যানেলে কাজ করে এবং সে অনেক কষ্ট করে দু’দিনের ছুটি ম্যানেজ করেছে। কাপড় কেনা শেষ হলে মেয়েটি সিকান্দারকে দাম পরিশোধ করার সময় মেয়েটির কড়ে আঙুলের স্পর্শে সিকান্দার জাদুর পর জাদু দেখার মতো বিস্ময় অনুভব করে। সে তার চোখ মাটিতে নামিয়ে রাখে, শেষে আবার কেউ তার চোখের ভাষা পড়ে ফেলতে পারে সেই ভয়ে।

দু-দিন, চারদিন, আটদিন পার হয়ে শেষে পনেরো দিন পর মেয়েটি ফিরে এল। গত কয়েকটা দিন সিকান্দারের বুকটা খুব জ্বলেছে মেয়েটিকে একনজর দেখার জন্য। রাত দশটা বাজলেই সিকান্দারের আর কিছুই ভালো লাগতো না। জানালা খুলে ঝিম মেরে বসেছিল আহত মন নিয়ে। শেষে অশেষ আকাঙ্ক্ষার শেষে সিকান্দার জানালা খুললে মেয়েটিকে দেখতে পায়। কাছ থেকে একবার দেখার ফলে মেয়েটির মুখটি সে তীব্রভাবে খুটিয়ে দেখতে চায়। বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর মেয়েটির কোথাও কোনো সূক্ষ্ম বদল হলো কি না, সে ভাবে। তার স্বপ্ন ও সত্যের মাঝখানের ব্যাপক দূরত্ব সে টের পায় তবু রাত এলে চাঁদ দেখার লোভ সে তাড়াতে পারে না। তাকে কি আসলে চাঁদেই পেয়ে বসল?

ঘরটিতে আজ আলো কম। হাত-পা ছড়িয়ে মেয়েটি অদ্ভুত কায়দায় কিছুণ শুয়ে থাকে। আজ আর সে কাজ থেকে ফিরে পোশাক খুলে ফেলে না। সিকান্দার অনেক দূর থেকেও টের পায় মেয়েটির মুখের যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। কান্ত নীল আলোতে মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। তাকে আজ মনে হয় কুয়াশাবি¯তৃত কোনো দ্বীপ, অস্পষ্ট অথচ অমোঘ। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে কী যেন খোঁজে। রকিং চেয়ারে দু-মিনিট বসে থাকে। তারপর আবার টেবিলের কাছে যেয়ে কাগজ-কলম নিয়ে কাটাকুটি করে। সিকান্দার তখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, মেয়েটি ফ্যানের সাথে লাগানো শাড়িটিকে ফাঁস-এর মতো করে তার মাথাটিকে গলিয়ে দেয়। সিকান্দার মুখ দিয়ে কোনো স্বরই বের করতে পারে না, শুধু অস্ফুট কিছু আর্তরব ছাড়া। সে দেখে, আধো আলো-অন্ধকারে একটি হলুদ প্রজাপতি ক্রমশ অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে তার রং হারাচ্ছে।


লেখক পরিচিতি
মণিকা চক্রবর্তী





জন্ম কুমিল্লায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেস্নাতকোত্তর। লেখালেখি করছেন দীর্ঘকাল ধরে। মূলত গল্প ও উপন্যাস লিখে থাকেন।
প্রথম উপন্যাস অতঃপর নিজের কাছে প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, একুশে বইমেলায়। দ্বিতীয় উপন্যাসটি,
দিগন্ত ঢেউয়ের ওপারে, ২০১১ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। গল্পগ্রন্থ বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে।
লেখালেখির বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে সংগীতচর্চা তাঁর অন্যতম সংরাগ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ