আই সি ইউ তে নেবার
সময়ই ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন বিশেষ কিছু করার নেই, তবু আজ অনেকক্ষণ কোন ডাক না
আসায় সবাই অল্প আশ্বস্তও ছিল যে রাতটা হয়তো ভালয় ভালয় কেটে যাবে। নিজেদের মধ্যে
টুকটাক গল্পগাছাও চলছিল। এমন সময় আই সি ইউ সেভেনের ডাক। হিরণ্ময়কান্তি মুখার্জীর
বাড়ির লোক রিসেপশনে দেখা করুন।
তিথি উঠে দাঁড়াল, আমাদের ডাকছে দাদা।
সোনামামা।
হিরণ্ময়কান্তি
মুখোপাধ্যায়! অনীকও উঠে দাঁড়িয়েছে। ফিকেভাবে হাসলও সামান্য, সোনামামার ভাল নামটা
ভুলেই গেছলাম রে!
তার মনে
পড়ল সে প্রায়ই বলত, হিরণ্ময়ই তো যথেষ্ট বড়ো, আবার কান্তি কেন সোনামামা?
সোনামামা
লাজুক মুখে সঙ্গে সঙ্গে সায় দিত, তাই না বটে! আবার একটা কান্তি!
ফুলমামা
পাংশুমুখে লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। লিফট বন্ধ, কি গোলমাল হয়েছে। লিফটম্যান বলল,
সেকেন্ড ফ্লোর তো, সিঁড়ি দিয়ে চলে যান না!
ফুলমামা
অনীকের দিকে তাকাল, সম্ভবত একা যেতে চাইছে না। তিথি বলল, আমি যাব ফুলমামা?
ফুলমামা
চমকে বলল, না না, আমিই যাই। মনে হয় কিছু আনতে বলবে, বুঝলি!
নার্সিংহোমে
ভর্তির পর কটাদিন রাত সোনামামাকে নিয়ে খুবই আতঙ্কে কেটেছে। আই সি ইউ সেভেন শুনলেই
কেঁপে উঠছিল সবাই। এখন সে ভাব কিছু কম।
সোনামাইমা
কোণে বসে ঢুলছিল। হিরণ্ময়কান্তি না আই সি ইউ সেভেন কোনটা কানে গেছে কে জানে, জেগে
উঠে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে সবাইকে।
সোনামাইমার
এখানে আসাটা চায়নি কেউ। একে নিজেই বেশ একটু নড়বড়ে, তার ওপর এসে করবেটাই বা কি!
রাতবিরেতে একটা ওষুধ আনতে বললে যেতে পারবে, ঝাঁঝের সঙ্গে বলেছিল ফুলমামা।
সোনামাইমা
নির্বিকার তাকিয়েছিল, কিছুই শুনতে পায়নি। ইদানীং কানটা একেবারে গেছে। অবশ্য শুনতে
পেলেও একইরকম বিকারশূন্য থাকত। এ বাড়ির কেউই সোনামামার ওপর যেমন, মাইমার ওপরও
তেমনি, সামান্যতম নির্ভরও করে না। ফলে মাইমাও সারাজীবন খুব আলগোছে থাকল।
স্বামীর
সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে এবং মানুষটি পুরোপুরি সংজ্ঞাহীন, কোমায় চলে গেছেন, বলে
দিয়েছেন ডাক্তাররা। এ অবস্থাতেও মাইমা যে বিশেষ কিছু গুরুত্ব বুঝতে পারছে আর সে
কারণে মুষড়ে পড়েছে, তার কোন লক্ষণই নেই। বরং বাড়িতে আসা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে
সবিস্তারে ক্লান্তিহীন গল্প করেই চলেছে কিভাবে কি হল তাই নিয়ে! শুধু আজ দুপুরে
অনীকরা এসে পড়ার পর থেকেই বারবারই জেদ করে যাচ্ছিল একবার দেখতে যাবার জন্য।
তিথি
সকালেই এসে পৌঁছেছে ওর মা কণাকে নিয়ে। শেষ দুপুরে অনীক রুমাও এসে গেল। অমনি
সোনামাইমার কি হল কে জানে, ভাগনাকেই ধরে বসল সঙ্গে যাবে সেও।
শুনে
ফুলমাইমা মুখটা এমনভাবে বাঁকাল যেন এরকম অন্যায় আবদার জন্মে শোনেনি। কণাকে বলল,
দেখলে তো দিদি, অনিকে দেখে এমন করছে যেন চিন্তায় মরে যাচ্ছে একবারে! ওনারও আজই
যাওয়া চাই। বাড়িতে এতগুলি লোকজন...! এদিকে গিনির বিয়ের আর কটাদিনই বা বাকি, কি করে
কি হবে ভেবে দুশ্চিন্তায় যে কাঁটা হয়ে আছি আমরা... একবারও বলছে সে কথা!
কণা চুপ
করেই আছে, বাপের বাড়িতে এলে সমস্যা হয় আজকাল, কাকে সমর্থন করে কথা বলবে ভেবে পায়
না। ছোটজন বলল, তুমিও যেমন মেজদি, বড়দি আবার কবে কার জন্যে চিন্তা করে! নিজের
ছেলেমেয়ে নেই, ওর বয়ে গেছে লোকের মেয়ের জন্য চিন্তা করতে।
সে কণার
দিকে ফিরল, তাই ভাবছি দিদি, বড়দা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান তো সে একরকম, নাহলে যা
শুনছি বেঁচে গেলেও নাকি প্যারালিসিস হয়েই পড়ে থাকতে হবে, কি দুর্গতি হবে জানি না
বাবা। ওই তো বউয়ের ছিরি!
কণা
আড়চোখে দেখল ছেলের বউকে। যদিও ওরা দূরে আছে একটু, কিন্তু শুনে ফেললে মুশকিল, সুযোগ
পেলেই কথা শোনাবে তাকে! আর এরাও সব এমন হয়েছে, এসন আলোচনার কি সময় এটা!
তিথি
মায়ের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল অন্যদিকে। এ বাড়িতে সোনামাইমার অবস্থানটা
এতদিনেও একইরকম নড়বড়ে থেকে গেল, যেমন দেখে আসছে সে ছেলেবেলা থেকে! প্রথম থেকেই
দিদার অপছন্দের পাত্রী ছিল মাইমা, বাবা মা মরা মামাবাড়িতে মানুষ মেয়েটিকে বধূ
হিসেবে দাদু মনোনীত করার পর থেকেই। সে মায়ের কাছে শুনেছে, বিয়ের এক বছর পর
সোনামামা নাকি মাকে বলেছিল, খুব কষ্ট হচ্ছে জানো মা, হোটেলের খাবার মোটে সহ্য
হচ্ছে না। অফিস থেকে ফিরতেও খুব রাত হয়ে যায়, তোমরা কেউ যদি গিয়ে থাকতে –
বুদ্ধিমতী
দিদা ছেলের আবেদনের আড়ালের মূল ইচ্ছেটিকে এককথায় নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছিলেন, দূর,
আমরা যাব কি করে! বাড়িঘর ফেলে দিয়ে...
তখন মায়ের
দাপটে থাকা ত্রস্ত আলাভোলা বড় ছেলেটি সাহস করে আসল কথা বলে ফেলেছিল, তাও বটে! তাহলে
ও যদি গিয়ে থাকে কিছুদিন...!
কথা শেষ
হবার আগেই উঠে পড়েছিলেন দিদ, মাথা খারাপ হল নাকি রে? কদিন বিয়ে হয়েছে তোর যে এখনই
বউ নিয়ে বাসায় যাবি?
কলকাতার
মত জায়গায় ওই হাঁদাকান্ত মেয়ে থাকতে পারবে? নাকি পারলেও আমি ছাড়ব ভেবেছিস? বলে
নিজের দায়িত্বই তুই ভালমত নিতে পারিস না তো আর একজনের! যাবার সময় তো আর পালিয়ে
যাচ্ছে না। তুই যেমন মাসে একবার বাড়ি আসিস...
আই সি ইউ
থেকে নেমে এসেছে ফুলমামা। বলল, কটা ইনজেকশন এনে দিতে হবে বাইরে থেকে, এখানে নেই।
অনীক কাছে
গিয়ে বলল, আমাকে দাও প্রেসক্রিপশনটা, এনে দিচ্ছি। ফুলমামাকে নিশ্চিন্ত দেখাল, মুখে
বলল, তুই যাবি? তোকে তো আবার ভোরেই ফিরে অফিস করতে হবে বলছিস। বাড়ি গিয়ে একটু
বিশ্রাম নিলে পারতিস!
অনীক
সামান্য ভ্রূ কোঁচকাল, গম্ভীরমুখে বলল, ঠিক আছে, তুমি দাও না!
ছোটমামাও
উঠে এসেছে, চল অনি, আমিও যাচ্ছি। পারিজাত মেডিক্যাল সারারাত খোলা থাকে, ওখানে পেয়ে
যাব।
ওদের
সঙ্গে রুমাও বেরোচ্ছে দেখে সোনামাইমা উঠে পড়েছে, বাড়ি যাচ্ছিস নাকি অনিবাবা? তাহলে
চল আমিও যাই। তোর মামা আগের চেয়ে ভাল, না রে?
ফুলমামা
বলল, হ্যাঁ, ফার্স্টক্লাস। এবার বাড়ি যাও, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়। অনেক কাজ করে
ফেলেছ।
অনীক
বিরক্তচোখে তাকাল। ফুলমামা অপ্রতিভ হয়ে বলল, দ্যাখ না, শুনছে আই সি ইউ, বলে কি না
ভালো তো! কি বলব বল!
যথারীতি
কোন কথাই শুনতে পায়নি মাইমা। গুটিগুটি পায়ে বেরোচ্ছে। অনীক হাত তুলে বলল, বসো
মাইমা। আমরা ওষুধ আনতে যাচ্ছি।
আশ্চর্য,
এ কথাটি মাইমা ঠিকই শুনতে পেল। একগাল হেসে বলল, ওহ ওষুধ আনতে? আমি ভেবেছি বাড়ি।
তিথি সভয়ে
সবার মুখের দিকে তাকাল। এমনিতেই সোনামাইমা সম্বন্ধে ওরা মিটমিটে, ভিজে বেড়াল
ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর বিশেষণ যোগ করে কথা বলে, আবার এই ভুলভাল কাজ! কারো কথা
শুনতে পাচ্ছে, কারো পাচ্ছে না। মানে দরকার মত শুনতে পায় সবই।
অনীক
রুমাকে বলল, তুমি আসছ কেন? মাইমার সঙ্গে থাক। আমরা তো ওষুধ কিনেই ফিরব।
রুমা বলল,
না, চলো। আমারও দু একটা ওষুধ নেবার আছে।
অনীক একটু
রাগ রাগ ভাবে তাকাল, কিন্তু আর কিছু বলল না। সম্ভবত জানে, বলে লাভ নেই।
সোনামাইমা
দেখছিল ওদের, চলে যেতে হাতছানি দিয়ে ডাকল তিথিকে। ফিকফিক হাসছে, হ্যাঁ রে, তোর
বউদি সবসময় বরটিকে ওরকম আগলে বেড়ায় কেন রে? কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে নাকি? তোর
মায়ের সঙ্গেও নাকি একলা কথা বলতে দেয় না?
তারপর
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তবেই দ্যাখ, আমার নেই সে একরকম। কিন্তু কণা
বেচারির তো চিরদিন ছেলে অন্তপ্রাণ, তাকেও তো মেনে নিতে হচ্ছে!
তিথি
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে আড়চোখে তাকাল সামান্য দূরে দাঁড়ানো ফুলমামাদের দিকে। মাইমা
বুঝতে পেরে মুচকি হাসল একটু। মুখটা দেখে ভাবলেশহীন মনে হলেও মানুষটা যথেষ্ট বুদ্ধি
ধরে, অনেকবারের মত এবারও মনে হল তিথির।
কত বয়স
তখন তাদের দু ভাইবোনের, অনীক বছর দশ, সে চার বছর পেছনে। মামাবাড়িতে বেড়াতে এসেছে
তারা। রাত্রে খেতে বসে দিদা নাম না করে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে, পাকা ঝানু মেয়ে,
স্বামীর কানে মন্ত্র দিচ্ছে, বাসায় গিয়ে থাকবে! মা বাবা মরা মেয়ে আনলুম দয়া করে,
পেটে পেটে এত প্যাঁচ! দূর করে দিলে তো দাঁড়াবার জায়গা নেই! কটাকা রোজগার করে তোর
বর!
কণা দু
একবার কিছু বলার চেষ্টা করেও পারেনি। মাইমা চুপ করে খেয়ে যাচ্ছে। একবারও খাওয়া
থামায় নি, একটা প্রতিবাদ করেনি, চোখেও জল নেই। কিন্তু ওই বয়সেও তার মনে হত, এই
লাঞ্ছনার মধ্যেও মাথা নিচু করে খেয়ে যাওয়া যেন কান্নার চেয়েও বেশি কিছু। একজন
ব্যাক্তিত্বহীন, তত প্রতিষ্ঠিত হতে না পারা মানুষের স্ত্রীর এর চেয়ে বেশি আর কি
করার আছে! রাগে গরগর করতে করতেই একসময় চুপ করত দিদা, হাওয়ার সঙ্গে তো আর ঝগড়া করা
যায় না!
সোনামাইমা
হঠাৎ তার হাত ধরল, ওরা আমাকে কিছু বলে না তিথি, আমার কিছু বলাই চলে না। সত্যি করে
বল না মা, তোর মামা কেমন আছে?
তিথি মাথা
নিচু করল। অনেক ছবি হুড়মুড়িয়ে ভেসে আসছে চোখের সামনে।
হিরণ্ময়কান্তির
দু হাতে দুটো ব্যাগ, আশ্বিনের শেষ বিকেলেও দরদর করে ঘামছে।
উফ, বাসে
কি ভিড় রে আজ! পঞ্চমীর দিন বলে কথা, বুঝলি তিথি, সবাই বাড়ি ফিরছে। শেষে ঝুলে ঝুলে
কোনরকমে আসা! তবু যাই বলিস, দিনটা বাপু ফ্যানটাসটিক, চারদিকে কেমন পুজো পুজো ছুটি
ছুটি ভাব!
তিথির আর
তর সইছে না, দেখাও না সোনামামা, আমার জামাটা কেমন কিনেছ! নীল রং নিয়েছ তো?
সোনামামা
হেসেই যাচ্ছে আর বলছে, না রে নীল পাইনি, গোলাপী নিলাম।
কথা শেষ
হবার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে তিথি, দুমদাম হাত পা ছুঁড়ছে। এ্যাঁ? গোলাপী? নেব না আমি,
কিছুতেই না।
কণা চোখ
পাকিয়ে বকছে মেয়েকে, ছি ছি এ কি অসভ্যতা! মামাকে আগে বসতে দাও। যা এনেছে তাই আনন্দ
করে নেবে। কই, দাদা তো তোমার মত করে না কোনদিন!
ততক্ষণে
প্যাকেট খুলে ফেলেছে মামা, কি করব বল! কত খুঁজলাম, তোর নীল আর পেলাম না!
তিথি আর
একবার নাকি কান্না কাঁদার উপক্রম করে দেখছে প্যাকেটের খোলা মুখ দিয়ে উঁকি মারছে
ঝকঝকে নীল, ঠিক যেন পুজোর আকাশ। সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছুটে গিয়ে হাঁটু জড়িয়ে
ধরছে মামার।
হিরণ্ময়
তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। বোনকে বলছে, এই জামাটা কিনতে কত ঘুরতে হল জানিস! রং পছন্দ
হয় তো সাইজ পাই না, নয়তো ডিজাইন ভালো নয়। জামাকাপড় কেনা, বুঝলি কণা, সবচেয়ে কঠিন
কাজ।
কণা লেবু
নুন চিনির সরবত বাড়িয়ে দিয়ে ধমকাচ্ছে, তুইও যেমন সোনাদা, ও বলল নীলই চাই আর তুইও
বোকার মত ঘুরে মরলি! যতসব অন্যায় আবদার!
হিরণ্ময়
তৃপ্তমুখে হাসছে, তা বললে হয়! বছরকার দিন, ওদের খুশিই তো আগে দেখতে হবে।
বোকার মত,
ঘুরে মরলি এসব কথা একমাত্র হিরন্ময়কেই বলা যায়। হা হা করে হাসে হিরণ্ময়, সবসময়ই
হাসে। যে কোন গল্প শুরু করেই হাসতে থাকে।
সেদিন
বুঝলি, বাজারে যাচ্ছি, দেখি এক কান্ড! একটা লোক রাস্তাতেই... বলেই হাসতে শুরু করে
মামা।
ভাগনা
ভাগনীরা লাফালাফি করে, কি হয়েছিল সোনামামা? রাস্তায় কি?
আহা, অত
ছটফট করিস কেন! ধৈর্য ধরে শোন না। বাজারে যাব বলে তো বেরোলাম, দেখি রাস্তার ওপরেই
একটা লোক... আবার হাসিতে ফেটে পড়ে সোনামামা।
অনীক বলে,
আগে বাঢ়ো সোনামামা, ওই লাইনটা তুমি অলরেডি বলে ফেলেছ।
বলেছি!
হিরণ্ময় থমকে যায়। স্বভাবগম্ভীর ভাগনেটিকে সে যথেষ্ট মানে।
আসলে
কান্ডটা দেখলে তুইও হাসতে হাসতে একেবারে...
ছেলেমেয়েরা
খুকখুক করে হাসতে থাকে। শীতের সন্ধে। বড়দিনের ছুটিতে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে
কণা, প্রতিবার আসে। হিরণ্ময়ও বাড়িতে, সবাইকে নিয়ে জমিয়ে বসেছে। গল্প বলবে। ওদের
অবশ্য কারোরই সোনামামার গল্প বলা পছন্দ নয়। আজ অবধি গোটা একটা গল্প ওদের শোনাতে
পারেনি মানুষটা। আরম্ভ করে একভাবে, মাঝপথে চলে যায় অন্যকথায়, নিজের গল্পে নিজেই
হেসে অস্থির।
একদম
ছোটবেলায়, যখন সবকটা বাচ্চা ছিল, তখন তবু একরকম। এখন সব বড় হচ্ছে,
বুদ্ধিটুদ্ধিগুলো পাকছে, এখন আর ধৈর্য থাকে না। বলে, দূর দূর, কি ঘোড়ার ডিমের গল্প
তোমার, মাথামুন্ডু নেই! ফুলমামাকে ডাকি বরং।
হিরণ্ময়
সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়, ঠিক বলেছিস। ডাক ডাক। দেবুটা সত্যি খুব ভাল বলতে পারে।
স্কুলে একবার এমন ক্যারিকেচার করেছিল, সবাই হেসে অস্থির। বলে কিনা একটা পাগলা গাছে
উঠেছে, সবাই বলছে এই পাগলা নেমে আয়। তো সে নামবে না কিছুতেই। করেছে কি বল তো...
বলে সোনামামা নিজেই হেসে কুটোপাটি
দূর, তুমি
একটা গল্পও ঠিকমত বলতে পারো না। শুধু পাগলের মত কি বকছ আর নিজেই হাসছ! ও ফুলমামা,
তুমি এসো তো!
অবলীলায়
ওরা নস্যাৎ করে দেয় সোনামামাকে। ফুল আর ছোট, দুই মামার বেলায় যা ভাবাই যায় না। ওরা রাগী, গম্ভীর। ওরা সমীহ পায় তাই। কিন্তু পাগল ছাগল যাই
বলুক, সোনামামা কিছুই মনে করবে না। তবে মানে না, পাত্তা দেয় না ঠিকই, কিন্তু
ভালবাসে হয়তো সবচেয়ে বেশি। কারণটা ওরা নিজেরাও ঠিক জানত না। কখনও রাগত না
সোনামামা, বকাবকি করত না একদম, সেই কারণে! নাকি মানুষটার মধ্যে নিষ্পাপ শিশুর মত
স্বভাব ছিল বলে! মায়ের কাছে তারা শুনেছে ছোটবেলায় একটা কঠিন অসুখের পর মামা ওইরকম
আলাভোলা। পড়াশোনাতেও ভাল কিছু করতে পারেনি, গ্র্যাজুয়েশনের পর কোনরকমে একটা চাকরি,
বাড়িতে কোনো আদর ছিল না হিরণ্ময়ের।
হয়তো
কাউকে বলতে না পারার, কখনও কঠিন হতে না পারার, জীবনে একটিও প্রতিবাদ রাখতে না
পারার আর হয়তো নির্ভরযোগ্যও না হয়ে উঠতে পারার অসহায়তা ভেতরে ভেতরে কাঁদাত
হিরণ্ময়কে। বয়স যতই বাড়তে লাগল, ততই কেমন চুপচাপ হয়ে যেতে থাকল তাই। আর এই চুপ
থাকাটাই ভাল থাকা ধরে নিয়ে নিজেরাও নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল সবাই। নাকি সোনামামার
অস্তিত্বটাই মুছে গেছল মন থেকে! নইলে যে ভালবাসা আর মনোযোগ তারা পেয়েছিল, তার
কিছুটাও ফিরিয়ে দেবার কথা মনে আসেনি কেন!
পারিজাত
মেডিক্যাল কি কারণে বন্ধ আজ, ফলে অনেক ঘুরতে হয়েছে। রুমা মাঝে বারদুয়েক মৃদু তাড়া
দিয়েছে, অনীক সাড়া দেয়নি। সোনামামার ওষুধ কেনার জন্যে এই প্রায় মাঝরাতে সে ঘুরছে,
এই ভাবনাটা তার নিজের কাছেই কেমন অদ্ভুত লাগছে। তারা রাত জাগছে সোনামামার জন্যে,
সারা শহর ঘুরছে ওষুধ কিনবে বলে, জানতে পারলে হিরণ্ময়কান্তি কি করত!
কি করত
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অনীক। খুব খুব খুশি হত আর সেটা আড়াল করার জন্যে একটু বেশি
হাসত, আরো বেশি উল্টোপাল্টা বকত আর লজ্জা লজ্জা মুখে বলত, আমার জন্যে এত কান্ড!
আমার জন্যে! বাপরে!
কিন্তু
তাই করত কি! এখনও! মাঝের এই বছরগুলোতে কি একটুও পরিবর্তন আসেনি মানুষটার! কত বছর
যেন তার সঙ্গে ভাল করে দেখা হয়নি সোনামামার! অনীক মনে করার চেষ্টা করল। সম্ভবত
অভ্রর বিয়েতে, টুনু মাসির ছেলের। বিয়েতে নয়, গেছল বউভাতে। পরিচিত আত্মীয় ছিল
প্রচুর, দুচারটে করে কথা বলতেই রাত্রি হয়ে গেল। মাঝে একবার দেখা সোনামামার সঙ্গে।
তাকে দেখে একমুখ হাসি, কি রে অনি, কখন এলি?
এইতো!
কেমন আছ?
এমনিই
জিগ্যেস করেছিল, উত্তরও জানাই। হিরণ্ময় বলবে, ভালো আছি রে, খুব ভালো।
কিন্তু
সেদিন সোনামামা বলল, না রে, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ওই জন্যেই সকাল থেকে আসতে
পারিনি। এই একটু আগেই এলাম।
ভালই
করেছ। সে বলেছিল, এত ভিড়ে বিশ্রাম পেতে না। শরীর খারাপ বলছ, একবার ডাক্তার দেখিয়ে
নাও না!
তাই
ভাবছি। বলেছিল হিরণ্ময়। কি হয়েছে, কাকে দেখাবে এসব নিয়ে কথা ওঠেনি। যেন মানুষটি
এসব ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞ। সে তখন ব্যাস্ত হয়ে গেছিল অভ্রর বন্ধুর সঙ্গে অফিসের
আলোচনায়। ফুলমামাও এসে গেছল তখনই, এই যে দাদা, এখনও দাঁড়িয়ে আছ হাঁ করে? যাবার
ইচ্ছে নেই নাকি? তোমার জন্যে সবার দেরী হচ্ছে যে!
সোনামামা
দারুণ অপ্রতিভ হয়ে, এই যে যাই। এই অনিটার সঙ্গে একটু কথা বলছিলাম, দেখা হয় না তো
আজকাল! ইস... আমার জন্যে তোদেরও... বলতে বলতে চলে গেল। তারপর আর দেখা হয়নি।
অনীক এখন
ভাবল, কি আশ্চর্য, হয়নি কেন! নিছক সময়ের অভাব, নাকি ঝামেলার ভয়!
আস্তে
আস্তে মাথা নাড়ল অনীক। কখনও না, এরকম কথা সে ভাবতেই পারে না। আসলে পরিবর্তনশীল
জীবনের নিয়মেই কিছু বদল এসেছে তার জীবনেও। কর্পোরেট জগতে এমনিতেই ভীষণ চাপের মধ্যে
থাকতে হয়। প্রচুর দায়িত্ব, টেনশন, সব মিলিয়ে আলাদা করে তার সময় হয় না, রুমার
মারফতই যেটুকু খবর পায়।
ভেতরে
হঠাৎ একটা প্রবল ঝাঁকুনি টের পেল অনীক। কতটুকু খবর পায় সে! যতটুকু রুমা দেয়। রুমা
যখন যার সম্বন্ধে যেমন বলেছে, সে বিশ্বাস করেছে। যার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চেয়েছে
রুমা, সেও তার সঙ্গে। এইভাবে চলতে চলতে তার নিজের পারিবারিক বাঁধনগুলো কখন আলগা
হয়ে গিয়ে সবাই কত দূরের হয়ে গেছে। তার বিশাল ফ্ল্যাটে রুমার আত্মীয়রাই নিয়মিত
অতিথি, সে কেন তা পারেনি! শুধুই কি নিজের কাজের চাপের পর বাড়িতে একটু শান্তি
চাওয়া, শুধুই কি সময়াভাব! নাকি সে নিজেও দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছে!
ছোটমামা
নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এদিকে দেখ, গিনির বিয়ের নিমন্ত্রণ পর্যন্ত শেষ, কার্ড সব দেওয়া
হয়ে গেছে ডাকে। আর তো বাইশদিন মোটে বাকি! দু বাড়িতেই সব আয়োজন সারা। ছেলেও তো
একমাসের ছুটি নিয়ে এসেছিল বিদেশ থেকে। এর মধ্যে না হলে বিয়েটাই না ভেস্তে যায়! অত
ভাল ছেলে পাওয়া গেছল! ফুলদার মনের অবস্থা ভাব, এই একটাই কাজ তার। সোনাদা কি আর ভাল
হবে অনি? আলাভোলা লোক ছিল, নিজের দিকে তাকায়নি কোনদিন আর বউদিও তো জানিস কোন
কম্মের নয়, ওষুধ টষুধ গুলোও হয়তো খাওয়ায় নি ঠিকমত!

লেখক পরিচিতি
পাপিয়া ভট্টাচার্য
এখন তিনি লিখছেন বড় একটি উপন্যাস।
2 মন্তব্যসমূহ
পাপীয়াদি আমার অন্যতম প্রিয় একজন লেখিকা
উত্তরমুছুনভালো লাগল বেশ ।
উত্তরমুছুন