এক
বাতাসি জানে না আজ ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখ। শীত সামান্য কমে আসার ফলে এখন সে তার ছেঁড়া পোশাকেও খুব ভোরে বেরোতে পারে। সে ঠিক করেছিল আজ নতুন বাড়িগুলোর পেছনের গলিতে যাবে। সে ঠিক জানে এখনও ওদের দলের কেউ ওখানে যায়নি। ওরা লক্ষ করেছে ওই অনেক উঁচু বাড়িগুলোর পাহারাদার মাঝে মাঝে পেছনের গলিতেও টহল দিয়ে যায়। পুব আকাশের অন্ধকার যখন একটু হালকা হতে শুরু করেছে, তখন সে তার পিঠে বস্তা ফেলে সেই গলির দিকে রওনা হল। আজ যদি প্রথম সেখানে পৌঁছতে পারে, তবে আজ তার বস্তা ভরে উঠবে। বাতাসি বোবা। বেরোবার আগে সে তার নিজস্ব সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে মাকে জানিয়ে দিল সে বেরোচ্ছে।
দুই
জি-ওয়ানের অধীর দত্ত সেভেন্টি টুতে এপারে এসেছেন। আত্মীয়স্বজন ছিল। তিনি নিজেও বেশ চালাকচতুর। যোগাযোগের জংশনগুলো ভালো চিনে নিতে পারেন। মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু দেশের বাড়ি, জমিজমা, বাগান, পুকুরের জন্য এখনও তার মন যখনতখন উচাটন হয়ে ওঠে। এখানকার নদীপুকুর, ফলপাকুড়, বাতাস এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত – তার মতে সবকিছুই অতি নিম্নমানের। তিনি বেশ ভালোই রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুলগীতি গাইতে পারেন। কথা বলার সময় বোঝা গেলেও গানের সময় তার উচ্চারণের দুষ্টতা বোঝা যায় না। তাদের হাউজিং কমপ্লেক্সের যে কোনও অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ এবং সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। এবার হাউজিং-এর কমিটি তাকে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনের দায়িত্ব দিয়েছে। প্রভাতফেরি হবে, গান হবে, ভাষণ হবে। খুব ভোরে উঠে পড়েছেন তিনি।
তিন
পাহারাদার নন্দ মাইতি বাতাসিকে ধরে এনেছে। ভোরে উঠে অধীর দত্ত বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। শহরের সমস্ত সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে – এই মর্মে গৃহীত প্রস্তাবে এফ ব্লকের রাম তিওয়ারি এবং এইচ ব্লকের শ্যাম পারেখ সই দেবে কিনা ভাবছিলেন। তখনই তিনি বাতাসিকে দেখতে পান। গার্ডরুমে নন্দকে ইন্টারকমে খবর দিতেই সে বাতাসিকে ধরে ফেলেছে।
বাতাসির বস্তা উপুড় করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটুকরো লোহা, গোটা দশেক বিভিন্ন সাইজের শূন্য মদের বোতল, অনেক প্লাস্টিক, একটা বই। বইটা হাতে নিয়ে অধীর দত্ত লাফিয়ে উঠলেন। এই তো তার সেই হারিয়েযাওয়া বই। মুক্তির গান। মাত্র এক ফর্মার চটি বই, দোমড়ানো মোচড়ানো ছিল। যেন কেউ এটা দিয়ে কিছু মুড়ে পেছনের গলিতে ফেলে দিয়েছিল।
কী নাম তোর ? নন্দ বাতাসিকে ধমক দিল। বাতাসি তবু কথা বলে না। নন্দ এবার একটা চড় মারল বাতাসির গালে। বাতাসির চোখেই শুধু জল ফুটল।
হিন্দিতে জিগা। বাংলা মনে হয় বুঝে না।
এই, চোরি করনে আয়া। নাম বাতা জলদি, নেহি তো ... নন্দ আবার হাত তুলল। স্যার, সময়মত ধরতে না পারলে পাচিল টপকে ঠিক ভেতরে ঢুকে পড়ত। আড়চোখে বাতাসির বুকের দিকে তাকিয়ে নন্দ বলল।
মাটিতে ঢেলেফেলা তার কুড়িয়েপাওয়া জিনিসগুলোর দিকে বাতাসি তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে থরথর করে কেঁপে উঠছে। আস্তে আস্তে সে মুখ তুলে পুব আকাশের দিকে তাকাল। নন্দ এবং অধীর দত্ত দুজনেই ভাবল মেয়েটা ওদিকে কী দেখছে, ওর দলবল আসবে নাকি।
বাতাসি তাকিয়েই আছে পুব আকাশে। বাতাসি জানে না আজ একুশে ফেব্রুয়ারির সূর্য উঠবে আকাশে। কিন্তু সে এমনভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইল, যেন ওই সূর্য ওঠার পথেই কুড়ানি মেয়েদের নাম লেখা থাকে। যেন – এখনই পূর্বদিগন্তে ভাষাহীন বাতাসির নাম লেখা হবে।
গল্পকার, উপন্যাসিক
উপন্যাস : লালবল।
বাতাসি জানে না আজ ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখ। শীত সামান্য কমে আসার ফলে এখন সে তার ছেঁড়া পোশাকেও খুব ভোরে বেরোতে পারে। সে ঠিক করেছিল আজ নতুন বাড়িগুলোর পেছনের গলিতে যাবে। সে ঠিক জানে এখনও ওদের দলের কেউ ওখানে যায়নি। ওরা লক্ষ করেছে ওই অনেক উঁচু বাড়িগুলোর পাহারাদার মাঝে মাঝে পেছনের গলিতেও টহল দিয়ে যায়। পুব আকাশের অন্ধকার যখন একটু হালকা হতে শুরু করেছে, তখন সে তার পিঠে বস্তা ফেলে সেই গলির দিকে রওনা হল। আজ যদি প্রথম সেখানে পৌঁছতে পারে, তবে আজ তার বস্তা ভরে উঠবে। বাতাসি বোবা। বেরোবার আগে সে তার নিজস্ব সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে মাকে জানিয়ে দিল সে বেরোচ্ছে।
দুই
জি-ওয়ানের অধীর দত্ত সেভেন্টি টুতে এপারে এসেছেন। আত্মীয়স্বজন ছিল। তিনি নিজেও বেশ চালাকচতুর। যোগাযোগের জংশনগুলো ভালো চিনে নিতে পারেন। মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু দেশের বাড়ি, জমিজমা, বাগান, পুকুরের জন্য এখনও তার মন যখনতখন উচাটন হয়ে ওঠে। এখানকার নদীপুকুর, ফলপাকুড়, বাতাস এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত – তার মতে সবকিছুই অতি নিম্নমানের। তিনি বেশ ভালোই রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুলগীতি গাইতে পারেন। কথা বলার সময় বোঝা গেলেও গানের সময় তার উচ্চারণের দুষ্টতা বোঝা যায় না। তাদের হাউজিং কমপ্লেক্সের যে কোনও অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ এবং সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। এবার হাউজিং-এর কমিটি তাকে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনের দায়িত্ব দিয়েছে। প্রভাতফেরি হবে, গান হবে, ভাষণ হবে। খুব ভোরে উঠে পড়েছেন তিনি।
তিন
পাহারাদার নন্দ মাইতি বাতাসিকে ধরে এনেছে। ভোরে উঠে অধীর দত্ত বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। শহরের সমস্ত সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে – এই মর্মে গৃহীত প্রস্তাবে এফ ব্লকের রাম তিওয়ারি এবং এইচ ব্লকের শ্যাম পারেখ সই দেবে কিনা ভাবছিলেন। তখনই তিনি বাতাসিকে দেখতে পান। গার্ডরুমে নন্দকে ইন্টারকমে খবর দিতেই সে বাতাসিকে ধরে ফেলেছে।
বাতাসির বস্তা উপুড় করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটুকরো লোহা, গোটা দশেক বিভিন্ন সাইজের শূন্য মদের বোতল, অনেক প্লাস্টিক, একটা বই। বইটা হাতে নিয়ে অধীর দত্ত লাফিয়ে উঠলেন। এই তো তার সেই হারিয়েযাওয়া বই। মুক্তির গান। মাত্র এক ফর্মার চটি বই, দোমড়ানো মোচড়ানো ছিল। যেন কেউ এটা দিয়ে কিছু মুড়ে পেছনের গলিতে ফেলে দিয়েছিল।
কী নাম তোর ? নন্দ বাতাসিকে ধমক দিল। বাতাসি তবু কথা বলে না। নন্দ এবার একটা চড় মারল বাতাসির গালে। বাতাসির চোখেই শুধু জল ফুটল।
হিন্দিতে জিগা। বাংলা মনে হয় বুঝে না।
এই, চোরি করনে আয়া। নাম বাতা জলদি, নেহি তো ... নন্দ আবার হাত তুলল। স্যার, সময়মত ধরতে না পারলে পাচিল টপকে ঠিক ভেতরে ঢুকে পড়ত। আড়চোখে বাতাসির বুকের দিকে তাকিয়ে নন্দ বলল।
মাটিতে ঢেলেফেলা তার কুড়িয়েপাওয়া জিনিসগুলোর দিকে বাতাসি তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে থরথর করে কেঁপে উঠছে। আস্তে আস্তে সে মুখ তুলে পুব আকাশের দিকে তাকাল। নন্দ এবং অধীর দত্ত দুজনেই ভাবল মেয়েটা ওদিকে কী দেখছে, ওর দলবল আসবে নাকি।
বাতাসি তাকিয়েই আছে পুব আকাশে। বাতাসি জানে না আজ একুশে ফেব্রুয়ারির সূর্য উঠবে আকাশে। কিন্তু সে এমনভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইল, যেন ওই সূর্য ওঠার পথেই কুড়ানি মেয়েদের নাম লেখা থাকে। যেন – এখনই পূর্বদিগন্তে ভাষাহীন বাতাসির নাম লেখা হবে।
গল্পকার, উপন্যাসিক
জন্ম : ১৯৫০, থাকেন শিলিগুড়িতে।
গল্পগ্রন্থ: শঙ্খপুরীর রাজকন্যা
0 মন্তব্যসমূহ