মৈনাক
প্রতিদিন বেয়ারা এসে প্রোফেসরের গেষ্টহাউসের ঘরে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায় । ভোর থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে সে। প্রোফেসরের ঘুম ভাঙেনি দেখে লোক জড়ো করেছে । তারপর ধাক্কাধাক্কিতে দরজা খুলে দ্যাখে মানুষটি অঘোরে ঘুমিয়ে আছেন । বেয়ারা ভাবল হয়ত অতিরিক্ত মদ্যাপানের হ্যাঙওভার কাটেনি স্যারের । কিন্তু এতবছরে একবারো তো তাঁকে এমন বেসামাল দেখেনি সে ।
কানের কাছে মুখ নিয়ে "স্যার, স্যার" বলে ডাকল সে । নিঃশ্বাস পড়ছে কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
বাথরুম থেকে জল এনে তাঁর চোখে মুখে ছিটোতেই স্যার জড়ানো আওয়াজে বলে উঠলেন "মহুয়া, মধুকা ইন্ডিকা" ।
আবার প্রোফেসর ঘুমের দেশে । একটু গোঙানিও ছিল তখনো... "মৌয়া, মৌয়া, মৌজা, মৌজা" করে..
রাতে বুঝি পার্টি ছিল তাঁর । এমন তো হয়েই থাকে বড়সায়েবদের.. গোবেচারা বেয়ারাটি ব্ল্যাক কফির পট নিয়ে দ্রুত চলে গেল সেখান থেকে । ভাবল কিছু পরে একটু লেবুর শরবত নিয়ে আসবে স্যারের কাছে । বেলা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে তাঁর ।
স্যার মানে প্রোফেসর পুততুন্ড অনেকদিন আছেন অধ্যাপনার জগতে । রিসার্চ ল্যাব আর গবেষণা গত প্রাণ তাঁর । সারাটা বিশ্ব ঘুরে আপাততঃ থিতু হয়েছেন শহর থেকে বেশ দূরে নামকরা এক ইউনিভার্সিটিতে । বিশুদ্ধ রসায়ন নিয়ে পড়াশুনো করে সেই কলেজেই উঁচু পদে নিযুক্ত হয়েছেন সম্প্রতি । প্রোফেসর পুততুন্ডর ঝাঁ-চকচকে একাডেমিক রেকর্ড । ন্যাচারাল প্রোডাক্টস নিয়ে কাজ করেন তিনি । প্রচুর আন্তর্জাতিক জার্নালে পাবলিকেশানও আছে তাঁর । দু-তিনটে পেটেন্টও রয়েছে । কোটি কোটি টাকার সরকারী অনুদানকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটারি তৈরী হচ্ছে তাঁর পরামর্শে । সকলেই মরিয়া ওনার ল্যাবে রিসার্চ করার জন্য ।
অত্যন্ত ভদ্র স্বভাবের এই গুণি মানুষটি আপাত শান্ত প্রকৃতির । প্রতিদিন নিয়ম করে প্রাতঃভ্রমণে বেড়াতে বেরোন । প্রকৃতির সম্পদ নিয়ে তার সর্বক্ষণের ওঠাবসা । কাজেই নতুন কোনো ফল বা ফুল চোখে পড়লেই তার ছাত্রছাত্রীদের ওপর ভার পড়ে সেই নতুন বস্তুটির রাসায়নিক যৌগ গবেষণা করে বের করা ও প্রথমে ইঁদুর, পরে গিনিপিগ ও সবশেষে নিজে পরখ করা । আবার পেপার লেখে ফেলা । সেটিকে বিদেশে পাঠানো । ছেলেপুলেরা বিস্মিত হয় স্যারের কাজের গোছ দেখে । অনেক ভাগ্য করলে এমন রিসার্চ গাইড মেলে, তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে ।
ওনার কথা মত কাজ করতে পারলেই ছোটখাটো ল্যাব-পার্টি হয়ে যায় একটা । তিনিও খুশ আর রিসার্চ স্কলাররাও বুক বেঁধে বসে থাকে একটা পাবলিকেশনে স্যারের নামের পাশে "et-al" ও তার পাশে তাদের নিজেদের নামটা দেখতে পাবে বলে ।
স্টুডেন্ট-কুলের সাথে তার rapport দুর্দান্ত । অন্য সকলের কাছে রিসার্চ করতে গেলে ছয়, সাত এমন কি দশ বছর পর্যন্ত লেগে যায় কিন্তু পুততুন্ড খাটিয়ে নেন ছাত্রদের । ঠিক বছর পাঁচেকের মধ্যে তাঁর স্কলাররা রিসার্চ শেষ করে ফেলে।
প্রোফেসরের পুরো নাম মৈনাক পুততুন্ড । নিতান্তই সাদামাটা দেখতে । পুরুষালি চেহারাই সার । মেয়েরা যেমনটি পছন্দ করে তার ধার কাছ দিয়েও যায়না সেই মুখাবয়ব ।
তাই বুঝি তাঁর ল্যাবে ছেলে স্কলারের সংখ্যাই বেশি । এ পর্যন্ত তাঁর হাতে দুটি মেয়ে ডক্টরেট করেছে । সম্প্রতি তাঁর তৃতীয় মেয়ে স্কলার থিসিস সাবমিট করে বিদেশ যাওয়ার তোড়জোড় করছে । সে মেয়ে আরো পড়বে । পোষ্ট ডক্টরাল রিসার্চ করলে ফিরে এসে নাকি ভালো চাকরী পাওয়া যায় । ন্যাচারাল সায়েন্সে এমনটি হয় । এই ছাত্রীটির নাম মধুজা। এই সামারে মৈনাক যাচ্ছেন নরওয়ে, কোন্ এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে লেকচার দিতে । কথা আছে, মধুজাও যাবে তাঁর সাথে । সুইডেন থেকে মধুজা ভালো অফার পেয়েছে পোস্টডক্টরেট করার ।
কাজ পাগল মৈনাক পুততুন্ডের বিবাহ হয়েছিল এক উঠতি বড়লোকের একমাত্র মেয়ের সাথে । সেই মেয়ের সাথে তাঁর মনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কোনো মিল হয়নি । ফলস্বরূপ বিবাহবিচ্ছেদ । পাঁচবছর ঘর করতে না করতেই ছোট্ট শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে সেই মহিলা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় । মৈনাককে আপাতদৃষ্টিতে কঠিন হৃদয় বলে মনে হলেও বৌকে নিয়ে সুখ চেয়েছিলেন তাঁর জীবন রসায়নে ।
কিন্তু সংসার রসায়নের জটিল সমীকরণ সমাধান করতে অপারগ মৈনাক । আসল রসায়নের ক্রিয়া বিক্রিয়া সব ওলটপালট করে দিত ।
মধুজা
মধুজাকে সুন্দরী বলা চলে । "নাক মাটামাটা, চোখ ভাসা, সে মেয়ে খাসা" বলে তার দিদিমা । সব সময় পরণে আজকালকার শর্ট কুর্তি আর জিনস । কালেভদ্রে শাড়িতে মুখ পাল্টায় আর কি । মৈনাকের ডাকে সাড়া দিয়ে এক একদিন ক্যাম্পাসে মর্নিং ওয়াকেও যায় সে । তখন অবিশ্যি পরণে তার টাইট গেঞ্জি আর ঢোলা থ্রিকোয়ার্টারস । গেঞ্জির মধ্যে থেকে যেন ফেটে বেরিয়ে আসে তন্বীর স্তনযুগল...যেন অমন করে বুকজোড়া দেখানোর জন্যেই ঐ গেঞ্জি পরা । দিদিমা, মা অনেক বলে তাকে । অমন পোশাক পরিসনা । একা থাকিস ক্যাম্পাসে । আর আজকাল যা দিনকাল পড়েছে ! সেদিন টিভিতে ধর্ষণের ওপর এক আলোচনাচক্রে সেই নিয়েই তো কথা হচ্ছিল । মধুজা তখন বাড়িতে । ঘেঁটি ধরে মা তাকে নিয়ে এসেছিল টিভির সামনে । দ্যাখ, কেন বলি অমন পোষাক না পরতে! আজকাল মেয়েরাই নিজেদের দুর্ভাগ্য নিজেরা ডেকে আনে, ইত্যাদি, ইত্যাদি ।
কিন্তু ক্যাম্পাসে ফিরে এলেই মন উশখুশ করে দৃপ্ত ব্যাক্তিত্ত্বে, বুক ফুলিয়ে ঐ রঙচঙে সব টাইট টিশার্ট গুলো পরতে । তখন কোথায় মা আর দিদিমা! আর কাজের যা চাপ সেখানে! মায়েরা তো আর রিসার্চ করেনি কখনো বুঝবেই বা কি করে মধুজার ক্যাম্পাস শেডিউল ।
এছাড়া মা-দিদিমা তো আর ফেসবুকের মুখো হয়নি জানবেই বা কি করে মধুজার এই লাস্যময়ী গেঞ্জিময়তায় ভরা ফেসবুকে সে ছোটখাটো ক্যাটরিনা অথবা চিত্রাঙ্গদা । ফেদারকাট চুলের সাথে এই পোশাকেই সে বেষ্ট.. সকলেই বলেছে তাকে । অতএব নো কম্প্রোমাইজ । আর শাড়ি? নো ওয়ে । একে ঘুম থেকে উঠতে রোজ দেরী । তাতে টাইম মত ল্যাবে না পৌঁছলে মৈনাক অগ্নিশর্মা হয়ে যান । আর শাড়িকে কাচো, রোদে দাও, স্টার্চ করে আয়রন করো । নৈব নৈব চ ।
মধুজার জ্ঞানগম্যি বড়ো একটা নেই । তবে খুব চটুল স্বভাবের । আর তার ফাঁকিবাজির দ্বারা অনেক সময়েই উতরে যায় কঠিন বাস্তব । সব সময় সে স্যারের পেছন পেছন ঘোরে ।
মহুয়া
ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে প্রোফেসার মৈনাক এক একদিন এক এক দিকে যান । মোটামুটি ওনার ধরাছোঁয়ার মধ্যে সব সবুজেরা । চৈত্রের ভোরে শেষ বসন্তের ক্যাম্পাস । হলদে বাঁদরলাটিতে ছেয়ে আছে একপাশ অন্যপাশে কৃষ্ণচূড়া সবেমাত্র ফুটি ফুটি করছে । দোলনচাঁপার শুকনোডালে কোকিল ডেকে চলেছে এক নাগাড়ে।
মৈনাকের জীবনে বসন্ত আর আসেনা তেমনি করে । তবুও ভালো লাগে এই মাতাল প্রকৃতিকে আর যাচাই করতে তার সম্পদকে । কাছেই আদিবাসীদের গ্রাম । গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কি যেন কুড়োচ্ছে । কালো পিচের রাস্তার ওপর নিজের খেয়ালে টুকুস টুকুস করে ঝরে পড়ছে লেমন ইয়ালো রঙের ফল ।
জীবনের অনেকগুলো চৈতালী ভোর পেরিয়েও এমন সর্বনাশের ইশারা পাননি প্রোফেসার । ছাইরঙা কুয়াশার ভোরে হাঁটতে হাঁটতে যে মাদকতা, তা পেয়েছেন আজকের ভোরে ।
কাছে গিয়ে এক কুড়ানিকে প্রশ্ন করতেই সে বলেছে "মৌয়া বটে"
হলুদ ফরাস পাতা মহুয়া সরণী বেয়ে চলেছেন তিনি আর পাশের গাঁয়ের আবালবৃদ্ধবণিতার কোঁচোড় ভরে সেই মহুয়া ফল কুড়িয়ে নেওয়া দেখে মন পৌঁছে গেল সেই লালপাহাড়ির দেশে... বীরভূমে তাঁর মামাবাড়ি । আদতে তিনিও মানুষ। জীবনের অনুভূতিগুলো তাঁর কাজকর্মের ফাঁকে কি আর হারিয়ে যাবে নাকি !
সেবার বোলপুরের ট্রেনে একদল মাদল নাচিয়ের সাথে আলাপ জমেছিল । ওরা শ্যামলা গাঁয়ের শ্যামলা একদল মেয়ে । সাথে কয়েকজনের মরদ। ওদের চিকন কালো চুল, খোঁপায় বাঁধা বকের পালক, হলুদ গাঁদার ফুল, রূপোর শুলগা । লম্বাটে চোঙাকৃতির "মাদল" তালযন্ত্রটিকে আর গোলাকার তবলার মত "লাগড়া" বাদ্যযন্ত্রটিকে নিয়ে ওরা নাচে আর গান তৈরী করে । আর ওদের গান সৃষ্টির মূলে হল চৈত্রমাসের মহুয়া উত্সব । মহুয়ার মৌ জমে ওঠে ওদের ঘরে ঘরে আর ওরা নাচে, গান করে । আজকের মহুয়া কুড়োনোর সেই ছবিটা দেখে বুকে সেই মাদল বাজার শব্দ পেলেন তিনি ।
সেই গানটা গেয়েছিল ওরা । পয়সা দিয়েছিল সকলে । প্রোফেসর মৈনাকও দিয়েছিলেন আনন্দে । সারাক্ষণের কাজের ফাঁকে যেন একটা দমকা বাতাস সেই গান ।
"ও মেয়ে তুই কুথা যাস রাঙামাটির পরে
ধামসা মাদল, মহুয়া ফুল কুথায় আছে ঘরে ? "
আজকের চৈতী ভোর উসকে দিল তাঁর বসন্তকে আরো একবার!
মৈনাক হাতে নিলেন মহুয়া ফলকে । সুখী ফল । কিন্তু অনাদরে ঝরে যায় । টুস টুস করছে রস তাতে । আঠার মত লেগে থাকে যেন আর নাকে লেগে থাকে গন্ধ ।
ফিরে এসে মহুয়ার বৃত্তান্ত নিয়ে ঘাঁটতে শুরু করলেন তিনি । "মধুকা ইন্ডিকা" নিয়ে এবার শুরু হবে তাঁর গবেষণা । আর সঙ্গী হবে তাঁর প্রিয় ছাত্রী মধুজা ।
পরদিন ঠিক করলেন সেই আদিবাসী গ্রামে গিয়ে দেখবেন কি করে তারা মহুয়ার নির্যাস বানায় । মাটির হাঁড়ির মধ্যে জল ফুটছে । তার মাথায় আরেকটা ছোট হাঁড়িতে রাখা মহুয়া ফলগুলো । আর সেই ছোট হাঁড়ির মুখ থেকে একটা বাঁকা নল যার অন্যমুখটি আরেকটি খালি হাঁড়িতে । জল ফুটছে । মহুয়ার সারটুকুনি বাষ্পীভূত হয়ে বাঁকা নল দিয়ে টুপ টুপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় জমা হচ্ছে সেই হাঁড়িতে ।
-এই মহুয়ার রস দিয়ে কি হবে ? জিগেস করলে ওরা শুধিয়েছিল
-নেশার জিনিস বটে
জানলা দিয়ে মুখ বাঁড়িয়ে একটা কুচকুচে কালো লোক বলে উঠেছিল "আমাদের লোকাল মদ"
ছোট্ট একটা মেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল "ছোট বোতল দশ টাকা, বড় বোতল পনেরো "
-ঠান্ডা, গরম দুই রকমই খাওয়া যায় বটে । ঠান্ডা মহুয়ায় ধীরে ধীরে নেশা হয় অর গরম খেলে সাথে সাথে হয়, আরেকজন যুবতী বলে উঠল ।
মহুয়ার বৃত্তান্ত শুনলেন তিনি কচিকাঁচা সকলের মুখে ।
প্রোফেসর বুঝেছিলেন যে ঐ মহুয়া খুব প্রেশাস জিনিস এই আদিবাসী মহলে । আর এদের রুজি রোজগারও বটে ।
তাই এত উত্তেজনা তাদের । হয়ত বা ভেবেছে তিনি কিনতে এসেছেন । এদ্দুর এসে একটা ছোট বোতল নিয়েওছিলেন মৈনাক । দৌড়ে এসে এক বৃদ্ধা মহিলা হাত পেতে দশটা টাকা চেয়েও নিয়েছিল । সেই বৃদ্ধা বুঝি ঐ ব্যাবসার মালকিন । তাই তার এত উতসাহ । আদিবাসী মহলে মেয়েদের এই অন্ত্রেপ্রেণারশিপের তারিফ না করে উপায় নেই !
নিজের ল্যাবরেটারিতে মহুয়া ফল থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে মহুয়ার এক্সট্র্যাক্ট বানাতে গেলে প্রচুর মহুয়া লাগবে । ঐ আদিবাসী গ্রামের মালকিনকে উনি বললেন পরদিন সকালে এক ব্যাগ মহুয়া এনে দিতে । উনি ভোরবেলায় গিয়ে অপেক্ষা করে থাকবেন মহুয়া সরণীর ধারে ।
-পঁচিশ টাকা লাগবেক স্যার, বলল সেই বৃদ্ধা ।
মৈনাক রাজী হলেন । ম্যাজিকের মত ছক কষলেন । এই প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে তো কাজ করা যেতেই পারে । সেদিনের মত ফিরে গিয়ে মধুজাকে নিয়ে ল্যাবে বসে কাজ শুরু হল । মহুয়া ডিসটিলেশানের প্রোটোকল তৈরী হল । কতক্ষণ স্টিমে রিফ্লাক্স করলে মহুয়ার নির্যাস পুরোপুরি বেরুবে সেটা তো হাতে কলমে দেখবার ।
মধুজাও খুব একসাইটেড পুরো ব্যাপারটিতে । পিএইচডির সাথে সাথে আরো একটি পেপার "মধুকা-ইন্ডিকা"র ওপর হলে তো মন্দ হয়না । তাও আবার প্রোফেসর মৈনাক পুততুন্ডর গাইডেন্সে ।
মহুয়া থেকে লিকার তৈরী করে একটা লোকাল ব্র্যান্ড যদি করতে পারেন তাঁরা ! শ্রীলঙ্কায় এক লোকাল লিকার হয় "আরাক" নামে । গোয়ায় গিয়ে কাজুবাদাম থেকে তৈরী "ফেনি" খেয়ে মুগ্ধতায় ভরে গেছিল প্রোফেসরের শরীর-মন । তাহলে বাঙলার এই মহুয়াই বা কম কিসে !
সে রাতে মধুজাকে ল্যাবে থাকতে হবে । প্রচুর কাজ । পরেরদিনও থাকতে হবে । মধুজা ভেবেছিল সেই উইকএন্ডে বাড়ি ফিরবে একবার কিন্তু মৈনাক যেতে দিলেন না । অবিশ্যি ল্যাবে থাকাটা মধুজার সয়ে গেছে । ডক্টরেট ডিগ্রীর মূল্যে সে স্যারের কোনো কথা ফেলতে পারেনা ।
শুনশান ক্যাম্পাস । চৈত্রের খড়খড়ে পাতা ঝরে যাওয়া প্রকৃতিতে দখিনের হাওয়ার মত মৈনাকের ভালো লাগে মধুজার সঙ্গ । হোক না বয়সে অনেকটাই ছোট কিন্তু মৈনাকও তো রক্তমাংসের মানুষ । আর মৈনাক বোঝেন যে মধুজাও তাকে চায় । তাই সব স্কলারদের সাথে দিনে দিনে কাজ শুরু করে সন্ধ্যের আগেই ছেড়ে দেন মৈনাক । রাতের রিসার্চ রহস্যময় হয়ে ওঠে মধুজার উপস্থিতিতে । সারা শরীরে রোমাঞ্চ জাগে মৈনাকের । যৌবনের অধরা কামোদ্দীপনা, আবেগ, ভালোলাগা সবকিছু কাজের চাপে ফসিলাইজড হয়ে গিয়েও আবার মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দুমদাম ।
মধুজা খুব সাবধানী । আজকাল সাথে ব্যাবস্থাও রাখে । প্রিমিয়ার ইনস্টিট্যুটের দিকপাল ফ্যাকাল্টির স্কলার বলে কথা । তাতে আবার সবচেয়ে কম সময়ে রিসার্চ করান বলে সুনাম এনার । ইতিমধ্যে সাতটা পেপার পাবলিশ হয়েছে মৈনাকের সাথে বিদেশী জার্নালে । সারাবিশ্বে সকলে বিশুদ্ধ রসায়নের সায়েন্টিস্ট ডাঃ মৈনাক পুততুন্ডকে একডাকে চেনে ।
মধুজা পাততাড়ি গোটানোর তালে আছে। চার বছরেই কাজটা ভালোয় ভালোয় ইতি করে যদি বিদেশে যাওয়া যায় ।
স্যার বলেন "এত তাড়া কোরোনা মধু, ন্যাচারাল সায়েন্সে পাঁচ বছর অন্তত লাগে"
মধুজা বলে "স্যার আমি যদি চব্বিশ ঘন্টাকেই কাজে লাগাই তাহলে কি হবেনা”!
মৈনাকের অন্য স্কলাররা তাদের গাইডকে খুশি রাখার জন্য মাঝেমাঝে খাওয়াতে নিয়ে যায় । ক্যাম্পাসে একটা কফিশপ আছে । কোনো কোনো উইকএন্ডে হৈ হৈ করে বেশ হ্যাঙ আউট হয় । মধুজা সেদিন হয়ত বাড়ি পালায় । আচমকা কোনো পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বললে মায়ের কথা আমান্য করেনা । লক্ষ্মীমেয়ের মত সালোয়ার পরে ট্রেন ধরে সে । আবার কোনো কোনো দিন অন্যদের আড্ডাতে সামিলও হয় সে । কলেজ ফেস্টে মৈনাক ছেলেমেয়েদের আবদারে নিউজিল্যান্ডের আইসক্রিম কিনে খাওয়ান ।
তবু সকলের মাঝে মধুজার সাথে তাঁর সম্পর্কটা যেন একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ ।
মধুজার সাথে মৈনাকের এই সম্পর্কটির কথা অন্য স্কলাররা জানেনা বোধহয় । এতদিনের মধ্যে একটু অসাবধানতাবশত: বেকায়দায় পড়েছিলেন মৈনাক । অনুব্রত সেদিন হস্টেলে ফিরে গিয়ে আবার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এসেছিল স্যারের ঘরে । কন্ট্রোল টি মেরে অন্য একটা ট্যাব খুলে স্ক্রিনের ছবি নিমেষে পালটে ফেলেছিলেন । সে যাত্রায় বেঁচেছিলেন তিনি ।
মৈনাকের কম্পিউটার স্ক্রিনে মধুজার একরাশ ছবি দেখে অনুব্রত অবাক হয়েছিল কিছুটা । তবে আবার অবাক হয়ওনি কারণ অনুব্রতরাও একজোট হয়ে ফেসবুক-বন্ধুদের ছবি নিয়ে তো এমন ঘাঁটাঘাঁটি আকচার করে । ব্যাটাছেলে মাত্রেই এমন । অতএব সে যাত্রায় সাতখুন মাপ ।
অনুব্রতর জায়গায় কোনো মেয়ে স্টুডেন্ট হলে এখুনি ঢাক-ঢেঁড়া পিটিয়ে পাঁচকান করে বসত । একেই বলে ছেলে । পেট বোঝাই কত কথা এদের !
এভাবেই চলতে থাকে মৈনাকের জীবন । একা একা গেষ্ট হাউসের একফালি এসি ঘরে দিনের পর দিন বাস করা তাঁর । সারাদিন তো ল্যাবরেটারিতেই তাঁর সংসার । শুধু গেষ্টহাউসে সময় মত হাজির হয়ে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার খেয়ে আসা । নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের একঘেয়েমি বুঝতে দেয়না বিশুদ্ধ রসায়ন । অফিস কলিগরা একটু ঈর্ষা করে তাঁকে । অত ডিগ্রীধারি, নামী মানুষ হলে যা হয় । স্টুডেন্ট ছাড়া সহজে কেউ কাছে ঘেঁষেনা ।
কাজ কাজ আর কাজ আর মাঝে মধ্যে মধুজার সাথে মৈথুনের মুখবদল । প্রথম মৈথুনের স্বাদ পেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী মালবিকার কাছ থেকে । তারপর থেকে তিনি উপোসী। উপবাস ভাঙে মধুজার নরম স্পর্শে । ম্যানিকিওর্ড চাঁপার কলি যখন ধীরে ধীরে অবলীলায় প্রবেশ করে তাঁর তলপেটের দিকে জীবনটাকে নতুন করে পেতে ইচ্ছে করে মৈনাকের । মনে হয় চুলোয় যাক রিসার্চ । শিকেয় তোলা থাক পেপার পাবলিশিং । এই মেয়েটাকে পেলে তিনি সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে একরাশ সুখ দেবেন । আর ভুল হবেনা তার । মালবিকা যে না পাওয়ার টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়ে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে তেমনটি পুষিয়ে দেবেন এই মেয়েকে কাছে পেলে । ভরিয়ে দেবেন তাকে । সারাবিশ্ব ঘুরবেন এই মেয়েটাকে নিয়ে । গাড়ি থেকে বাড়ি থেকে সবকিছু আছে তার দিল্লীতে । কিন্তু কেউ নেই তা দেখভাল করার ।
মাঝেমধ্যেই মধুজার সাথে রতিসুখ হয় তাঁর । স্বপ্ন দেখেন মধুজার সাথে ঘর বাঁধার । ঘোর সংসারী হয়ে ওঠে মন । মধুজাও বোঝে স্যারের অবস্থা । তাই দেবার ব্যাপারে খামতি নেই তার । মধুজা আরো বোঝে যে তার যা বিদ্যেবুদ্ধি তার জোরে চারবছরে এতগুলো পেপার পাবলিশ করা অন্য কারো আন্ডারে সম্ভব হত না ।
এর মধ্যে মাস-স্পেক্ট্রোস্কোপি ল্যাবে রিডিং নিতে গিয়ে মৈনাক তো জড়িয়ে ধরে আর ছাড়তেই চান না মধুজাকে । রাত আটটার পর ল্যাব এসিটেন্টরাও থাকেনা অফিসে বা ল্যাবে । মধুজাও বুঝতে পেরে উজাড় করে দেয় নিজেকে । নাক ঘষতে থাকে প্রৌঢ়ের কাঁচাপাকা দাড়িতে । তারপর সেখান থেকে শার্টের বোতাম একে একে খুলতে থাকে মেয়েটা । মৈনাকও বুঝতে পারেন মেয়েটার ঠোঁটদুটো চাইছে তাকে ।
হৈ হৈ করে মিশন মহুয়া ডিসটিলেশান সফল হয়েছিল । একশো মিলির ছোট ছোট বোরোসিলের বিকারে মহুয়া ভর্তি করেছিলেন মৈনাক দাঁড়িয়ে থেকে । হালকা গরম মহুয়া পান করেছিলেন দুজনে মিলে । এরপর যে যার মত ফিরে গেছিল বাড়ি । পরদিনের জন্য রাখা ছিল আরো মহুয়া ল্যাবের ফ্রিজে ।
মহুয়ার ঘোর কেটে পরের দিন ল্যাবে এসে দুজনেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল একে অপরের দিকে । অদ্ভূত এক আবেশ । অসাধারণ অনুভূতি । সব স্ট্রেশ নিমেষে উধাও ।আর সবচেয়ে বড় কথা মিশন মহুয়া সাকসেসফুল । শুধু ব্র্যান্ডিংয়ের অপেক্ষায় ।
এবার মহুয়ার ওপরে পেপার লেখার শুরু । মধুজা স্যারের ইনস্ট্রাকশান মত পেপার লিখে সাবমিট করবে । এক এক সময় মৈনাক ভাবেন, মধুজার মত রিসার্চ স্কলার না পেলে তাঁর অনেক ইচ্ছেগুলোই অধরা থেকে যেত । মেয়েটা কি প্রচন্ড খাটতে পারে । শুধু স্যারের মুখের কথা খসার অপেক্ষায় । নয় নয় করে সাত-সাতটা পেপার তার । মহুয়ার পেপার একসেপ্টেড হলে আটনম্বর হবে । পিএইচডির কাজ শেষ করে ফেলেছে মধুজা । শুধু ভাইবা বাকী আছে । অবিশ্যি মৈনাককে একটু আধটু ছুঁয়ে থাকলে, তাকে কাছে টেনে নিলে মধুজার কাজ অনেকটাই এগিয়ে রাখেন তিনি ।
মধুজা ল্যাবে সারাক্ষণ থাকে, কাজ করে এই নিয়ে আন্ডার গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টরা ইদানিং অনেক কানাঘুষো শুনছে । মৈনাকের বাকী স্কলাররাও আজকাল ওকে ল্যাবের মক্ষিরাণী বলতে শুরু করেছে । সব প্রোজেক্টে মধুজার নাম থাকে । মৈনাক পুরতুন্ডর সব পাবলিকেশানে মধুজা মিত্রের নাম থাকবেই । মধুজার কিন্তু এসবে কোনো হেলদোল নেই । সে জানে কাজ হাসিল হলেই হোলো । ডিপার্টমেন্টের শ'খানেক ছাত্র ছাত্রীর গুজব, রটনা নিয়ে অনেক চাপানাওতোর কিছুদিন ধরেই চলছে । মধুজা মিত্র লাজলজ্জার কেয়ার করেনা । সে মন দিয়ে পেপার লেখায় ব্যস্ত থাকে ।
মৈনাক গেলেন ব্যাঙ্গালোরে, ডিপার্টমেন্টের কাজে । মহুয়ার ব্র্যান্ডিংয়ের ব্যাপারে সে শহর থেকেও কিছু তথ্য সংগ্রহ করা যাবে আশা করলেন । মধুজা চোস্ত ইংরেজী লেখে । শুধু মহুয়ার কেমিক্যাল কম্পোজিশন আর তার সাপোর্টিং ডেটাগুলো ঠিকঠাক থাকলেই হল ।
কিন্তু মেয়েটার রসায়নের জ্ঞানগম্যি খুব কম । তাই ছোটখাটো ভুলত্রুটিগুলো দেখে নিতে হয় । অবিশ্যি অন্য কারোর পেপারে এমন ভুলকে প্রশ্রয় না দিলেও মধুজার ব্যাপারে সাতখুন মাপ ।
সেবারের একটা পেপারতো মৈনাক নিজেই প্রায় পুরোটা লিখেছিলেন । শুধু মহুয়া তাঁর পাশে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা । মাঝে মধ্যে বোরডম ঘোচানোর জন্য সেই বিদ্যুতলতার মত মিষ্টি দেহ বল্লরীই যথেষ্ট । মৈনাকের ল্যাবের একটা কোণে সোফা আছে । সেখানে ঐ মেয়ের সান্নিধ্যে একটু গড়িয়ে নেওয়া কিম্বা বাইরে থেকে রাতের খাবার আনিয়ে খেয়ে দেয়ে একটু দৈহিক ফূর্তি এবং তৃপ্তি দুটোই পেতেন মৈনাক ।
এবারে একটু তাড়া আছে দুজনেরি কারণ সামার এসে যাচ্ছে । মৈনাকের নরওয়ে ট্রিপ আর ওদিকে মধুজার সুইডেন যাওয়া । যাবার আগেই সবটা শেষ করে ফেলতে হবে । অবিশ্যি কারোর টিকিট এখনো কাটা হয়নি । তাই রক্ষে ।
মণিতম
মৈনাক ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরলেন দিন সাতেক বাদে । খুব হেকটিক শেডিউল ছিল ।
রাতের ফ্লাইটে ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে ল্যাবের ফ্রিজ খুলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলেন সেই বাসি মহুয়ার তলানিটুকু । যদিবা সারাদিনের পথ ক্লান্তিটা একটু রিলিফ দেয় ।
মিশন মহুয়া সাকসেসফুল । এবার পাঠাতে হবে বিদেশের জার্নালে । তারপর নরওয়ে ট্রিপ । মধুজাকে রাজী করিয়ে নরওয়েতেও নিয়ে গেলে ভালো হত । সেখানে মৈনাকের সাথে সেমিনার এটেন্ড করে মধুজা না হয় সুইডেন চলে যেত। তারপর তো আর মধুজাকে কাছে পাওয়া যাবেনা তিনি ফিরে যাবেন ইন্ডিয়াতে আর মধুজা সুইডেনে ।
পোষ্ট-ডক্টরাল রিসার্চ করতে কমপক্ষে বছর দুয়েক তো লাগবেই । যোগাযোগ থাকবে মধুজার সাথে ইন্টারনেটের মধ্যে দিয়ে আর ফোনে । আবারো সেই একাকীত্বের বিষণ্ণতা কুয়াশার মত ঘিরে ধরবে মৈনাককে । মনে পড়বে মালবিকার কথা । ছোট্ট মেয়েটাকেও ভালো করে মনে পড়েনা আর ।
মধুজা এসে এই বছর চারেকে সব কিছু আপসাইড ডাউন করে দিয়েছে । যখন যেভাবে তিনি চেয়েছেন মধুজা তাকে নিরস্ত করেনি । ভাবতে ভাবতে নিজের ডেস্কে এসে বসে পড়লেন । টেবিলে গুচ্ছ কাগজ জমে গেছে । সাতদিনের অনুপস্থিতে চিঠির পাহাড় জমেছে । আগামীকাল অফিসে এসে সব একে একে খুলে দেখতে হবে ।
শরীরটা কেমন যেন আনচান করছিল । বাসি মহুয়াটুকুনি না খেলেই বুঝি ভালো ছিল ...ভাবলেন তিনি ।
আদিবাসী গ্রামের ওরা বলেওছিল "যত ঠান্ডা হবেক্, তত দেরী করে নেশা হবেক "
নাঃ আজ আর দেরী করে কাজ নেই, গেষ্টা হাউসে ফিরে গিয়ে শান্তি । রাতে ঘুমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, মনে মনে বিড়বিড় করলেন মৈনাক ।
কি ভাগ্যি ডিপার্টমেন্টের কাছেই গেস্টহাউস । ঐটুকু হেঁটে চলে গিয়েই নরম বিছানা পাতা আছে তাঁর জন্য । বয়স তো হল । নয় নয় করে পঞ্চাশের কাছাকাছি ।
এই সাতটাদিন ইমেলে যোগাযোগ ছিল মধুজার সাথে । পেপার লেখা শেষ করে মেল করে পাঠিয়েও দিয়েছে স্যারকে। আর সেইসাথে স্যারের টেবিলে রেখে দিয়ে গেছে একখানা সোনালী খামে চিঠি ।
ওপরে লালকালিতে মোটা করে লেখা : প্রোফেসর মৈনাক পুততুন্ড ।
শুভবিবাহের খবর আছে তার মধ্যে । "মধুজা ওয়েডস মণিতম" ।
সুইডেনবাসী এক বাঙালী সায়েন্টিষ্ট মণিতম ।
বিয়ের পর মধুজা শুরু করবে তার পোষ্ট ডক্টরাল রিসার্চ । তেমনি কথা আছে ।
প্রতিদিন বেয়ারা এসে প্রোফেসরের গেষ্টহাউসের ঘরে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায় । ভোর থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে সে। প্রোফেসরের ঘুম ভাঙেনি দেখে লোক জড়ো করেছে । তারপর ধাক্কাধাক্কিতে দরজা খুলে দ্যাখে মানুষটি অঘোরে ঘুমিয়ে আছেন । বেয়ারা ভাবল হয়ত অতিরিক্ত মদ্যাপানের হ্যাঙওভার কাটেনি স্যারের । কিন্তু এতবছরে একবারো তো তাঁকে এমন বেসামাল দেখেনি সে ।
কানের কাছে মুখ নিয়ে "স্যার, স্যার" বলে ডাকল সে । নিঃশ্বাস পড়ছে কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
বাথরুম থেকে জল এনে তাঁর চোখে মুখে ছিটোতেই স্যার জড়ানো আওয়াজে বলে উঠলেন "মহুয়া, মধুকা ইন্ডিকা" ।
আবার প্রোফেসর ঘুমের দেশে । একটু গোঙানিও ছিল তখনো... "মৌয়া, মৌয়া, মৌজা, মৌজা" করে..
রাতে বুঝি পার্টি ছিল তাঁর । এমন তো হয়েই থাকে বড়সায়েবদের.. গোবেচারা বেয়ারাটি ব্ল্যাক কফির পট নিয়ে দ্রুত চলে গেল সেখান থেকে । ভাবল কিছু পরে একটু লেবুর শরবত নিয়ে আসবে স্যারের কাছে । বেলা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে তাঁর ।
স্যার মানে প্রোফেসর পুততুন্ড অনেকদিন আছেন অধ্যাপনার জগতে । রিসার্চ ল্যাব আর গবেষণা গত প্রাণ তাঁর । সারাটা বিশ্ব ঘুরে আপাততঃ থিতু হয়েছেন শহর থেকে বেশ দূরে নামকরা এক ইউনিভার্সিটিতে । বিশুদ্ধ রসায়ন নিয়ে পড়াশুনো করে সেই কলেজেই উঁচু পদে নিযুক্ত হয়েছেন সম্প্রতি । প্রোফেসর পুততুন্ডর ঝাঁ-চকচকে একাডেমিক রেকর্ড । ন্যাচারাল প্রোডাক্টস নিয়ে কাজ করেন তিনি । প্রচুর আন্তর্জাতিক জার্নালে পাবলিকেশানও আছে তাঁর । দু-তিনটে পেটেন্টও রয়েছে । কোটি কোটি টাকার সরকারী অনুদানকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটারি তৈরী হচ্ছে তাঁর পরামর্শে । সকলেই মরিয়া ওনার ল্যাবে রিসার্চ করার জন্য ।
অত্যন্ত ভদ্র স্বভাবের এই গুণি মানুষটি আপাত শান্ত প্রকৃতির । প্রতিদিন নিয়ম করে প্রাতঃভ্রমণে বেড়াতে বেরোন । প্রকৃতির সম্পদ নিয়ে তার সর্বক্ষণের ওঠাবসা । কাজেই নতুন কোনো ফল বা ফুল চোখে পড়লেই তার ছাত্রছাত্রীদের ওপর ভার পড়ে সেই নতুন বস্তুটির রাসায়নিক যৌগ গবেষণা করে বের করা ও প্রথমে ইঁদুর, পরে গিনিপিগ ও সবশেষে নিজে পরখ করা । আবার পেপার লেখে ফেলা । সেটিকে বিদেশে পাঠানো । ছেলেপুলেরা বিস্মিত হয় স্যারের কাজের গোছ দেখে । অনেক ভাগ্য করলে এমন রিসার্চ গাইড মেলে, তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে ।
ওনার কথা মত কাজ করতে পারলেই ছোটখাটো ল্যাব-পার্টি হয়ে যায় একটা । তিনিও খুশ আর রিসার্চ স্কলাররাও বুক বেঁধে বসে থাকে একটা পাবলিকেশনে স্যারের নামের পাশে "et-al" ও তার পাশে তাদের নিজেদের নামটা দেখতে পাবে বলে ।
স্টুডেন্ট-কুলের সাথে তার rapport দুর্দান্ত । অন্য সকলের কাছে রিসার্চ করতে গেলে ছয়, সাত এমন কি দশ বছর পর্যন্ত লেগে যায় কিন্তু পুততুন্ড খাটিয়ে নেন ছাত্রদের । ঠিক বছর পাঁচেকের মধ্যে তাঁর স্কলাররা রিসার্চ শেষ করে ফেলে।
প্রোফেসরের পুরো নাম মৈনাক পুততুন্ড । নিতান্তই সাদামাটা দেখতে । পুরুষালি চেহারাই সার । মেয়েরা যেমনটি পছন্দ করে তার ধার কাছ দিয়েও যায়না সেই মুখাবয়ব ।
তাই বুঝি তাঁর ল্যাবে ছেলে স্কলারের সংখ্যাই বেশি । এ পর্যন্ত তাঁর হাতে দুটি মেয়ে ডক্টরেট করেছে । সম্প্রতি তাঁর তৃতীয় মেয়ে স্কলার থিসিস সাবমিট করে বিদেশ যাওয়ার তোড়জোড় করছে । সে মেয়ে আরো পড়বে । পোষ্ট ডক্টরাল রিসার্চ করলে ফিরে এসে নাকি ভালো চাকরী পাওয়া যায় । ন্যাচারাল সায়েন্সে এমনটি হয় । এই ছাত্রীটির নাম মধুজা। এই সামারে মৈনাক যাচ্ছেন নরওয়ে, কোন্ এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে লেকচার দিতে । কথা আছে, মধুজাও যাবে তাঁর সাথে । সুইডেন থেকে মধুজা ভালো অফার পেয়েছে পোস্টডক্টরেট করার ।
কাজ পাগল মৈনাক পুততুন্ডের বিবাহ হয়েছিল এক উঠতি বড়লোকের একমাত্র মেয়ের সাথে । সেই মেয়ের সাথে তাঁর মনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কোনো মিল হয়নি । ফলস্বরূপ বিবাহবিচ্ছেদ । পাঁচবছর ঘর করতে না করতেই ছোট্ট শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে সেই মহিলা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় । মৈনাককে আপাতদৃষ্টিতে কঠিন হৃদয় বলে মনে হলেও বৌকে নিয়ে সুখ চেয়েছিলেন তাঁর জীবন রসায়নে ।
কিন্তু সংসার রসায়নের জটিল সমীকরণ সমাধান করতে অপারগ মৈনাক । আসল রসায়নের ক্রিয়া বিক্রিয়া সব ওলটপালট করে দিত ।
মধুজা
মধুজাকে সুন্দরী বলা চলে । "নাক মাটামাটা, চোখ ভাসা, সে মেয়ে খাসা" বলে তার দিদিমা । সব সময় পরণে আজকালকার শর্ট কুর্তি আর জিনস । কালেভদ্রে শাড়িতে মুখ পাল্টায় আর কি । মৈনাকের ডাকে সাড়া দিয়ে এক একদিন ক্যাম্পাসে মর্নিং ওয়াকেও যায় সে । তখন অবিশ্যি পরণে তার টাইট গেঞ্জি আর ঢোলা থ্রিকোয়ার্টারস । গেঞ্জির মধ্যে থেকে যেন ফেটে বেরিয়ে আসে তন্বীর স্তনযুগল...যেন অমন করে বুকজোড়া দেখানোর জন্যেই ঐ গেঞ্জি পরা । দিদিমা, মা অনেক বলে তাকে । অমন পোশাক পরিসনা । একা থাকিস ক্যাম্পাসে । আর আজকাল যা দিনকাল পড়েছে ! সেদিন টিভিতে ধর্ষণের ওপর এক আলোচনাচক্রে সেই নিয়েই তো কথা হচ্ছিল । মধুজা তখন বাড়িতে । ঘেঁটি ধরে মা তাকে নিয়ে এসেছিল টিভির সামনে । দ্যাখ, কেন বলি অমন পোষাক না পরতে! আজকাল মেয়েরাই নিজেদের দুর্ভাগ্য নিজেরা ডেকে আনে, ইত্যাদি, ইত্যাদি ।
কিন্তু ক্যাম্পাসে ফিরে এলেই মন উশখুশ করে দৃপ্ত ব্যাক্তিত্ত্বে, বুক ফুলিয়ে ঐ রঙচঙে সব টাইট টিশার্ট গুলো পরতে । তখন কোথায় মা আর দিদিমা! আর কাজের যা চাপ সেখানে! মায়েরা তো আর রিসার্চ করেনি কখনো বুঝবেই বা কি করে মধুজার ক্যাম্পাস শেডিউল ।
এছাড়া মা-দিদিমা তো আর ফেসবুকের মুখো হয়নি জানবেই বা কি করে মধুজার এই লাস্যময়ী গেঞ্জিময়তায় ভরা ফেসবুকে সে ছোটখাটো ক্যাটরিনা অথবা চিত্রাঙ্গদা । ফেদারকাট চুলের সাথে এই পোশাকেই সে বেষ্ট.. সকলেই বলেছে তাকে । অতএব নো কম্প্রোমাইজ । আর শাড়ি? নো ওয়ে । একে ঘুম থেকে উঠতে রোজ দেরী । তাতে টাইম মত ল্যাবে না পৌঁছলে মৈনাক অগ্নিশর্মা হয়ে যান । আর শাড়িকে কাচো, রোদে দাও, স্টার্চ করে আয়রন করো । নৈব নৈব চ ।
মধুজার জ্ঞানগম্যি বড়ো একটা নেই । তবে খুব চটুল স্বভাবের । আর তার ফাঁকিবাজির দ্বারা অনেক সময়েই উতরে যায় কঠিন বাস্তব । সব সময় সে স্যারের পেছন পেছন ঘোরে ।
মহুয়া
ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে প্রোফেসার মৈনাক এক একদিন এক এক দিকে যান । মোটামুটি ওনার ধরাছোঁয়ার মধ্যে সব সবুজেরা । চৈত্রের ভোরে শেষ বসন্তের ক্যাম্পাস । হলদে বাঁদরলাটিতে ছেয়ে আছে একপাশ অন্যপাশে কৃষ্ণচূড়া সবেমাত্র ফুটি ফুটি করছে । দোলনচাঁপার শুকনোডালে কোকিল ডেকে চলেছে এক নাগাড়ে।
মৈনাকের জীবনে বসন্ত আর আসেনা তেমনি করে । তবুও ভালো লাগে এই মাতাল প্রকৃতিকে আর যাচাই করতে তার সম্পদকে । কাছেই আদিবাসীদের গ্রাম । গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কি যেন কুড়োচ্ছে । কালো পিচের রাস্তার ওপর নিজের খেয়ালে টুকুস টুকুস করে ঝরে পড়ছে লেমন ইয়ালো রঙের ফল ।
জীবনের অনেকগুলো চৈতালী ভোর পেরিয়েও এমন সর্বনাশের ইশারা পাননি প্রোফেসার । ছাইরঙা কুয়াশার ভোরে হাঁটতে হাঁটতে যে মাদকতা, তা পেয়েছেন আজকের ভোরে ।
কাছে গিয়ে এক কুড়ানিকে প্রশ্ন করতেই সে বলেছে "মৌয়া বটে"
হলুদ ফরাস পাতা মহুয়া সরণী বেয়ে চলেছেন তিনি আর পাশের গাঁয়ের আবালবৃদ্ধবণিতার কোঁচোড় ভরে সেই মহুয়া ফল কুড়িয়ে নেওয়া দেখে মন পৌঁছে গেল সেই লালপাহাড়ির দেশে... বীরভূমে তাঁর মামাবাড়ি । আদতে তিনিও মানুষ। জীবনের অনুভূতিগুলো তাঁর কাজকর্মের ফাঁকে কি আর হারিয়ে যাবে নাকি !
সেবার বোলপুরের ট্রেনে একদল মাদল নাচিয়ের সাথে আলাপ জমেছিল । ওরা শ্যামলা গাঁয়ের শ্যামলা একদল মেয়ে । সাথে কয়েকজনের মরদ। ওদের চিকন কালো চুল, খোঁপায় বাঁধা বকের পালক, হলুদ গাঁদার ফুল, রূপোর শুলগা । লম্বাটে চোঙাকৃতির "মাদল" তালযন্ত্রটিকে আর গোলাকার তবলার মত "লাগড়া" বাদ্যযন্ত্রটিকে নিয়ে ওরা নাচে আর গান তৈরী করে । আর ওদের গান সৃষ্টির মূলে হল চৈত্রমাসের মহুয়া উত্সব । মহুয়ার মৌ জমে ওঠে ওদের ঘরে ঘরে আর ওরা নাচে, গান করে । আজকের মহুয়া কুড়োনোর সেই ছবিটা দেখে বুকে সেই মাদল বাজার শব্দ পেলেন তিনি ।
সেই গানটা গেয়েছিল ওরা । পয়সা দিয়েছিল সকলে । প্রোফেসর মৈনাকও দিয়েছিলেন আনন্দে । সারাক্ষণের কাজের ফাঁকে যেন একটা দমকা বাতাস সেই গান ।
"ও মেয়ে তুই কুথা যাস রাঙামাটির পরে
ধামসা মাদল, মহুয়া ফুল কুথায় আছে ঘরে ? "
আজকের চৈতী ভোর উসকে দিল তাঁর বসন্তকে আরো একবার!
মৈনাক হাতে নিলেন মহুয়া ফলকে । সুখী ফল । কিন্তু অনাদরে ঝরে যায় । টুস টুস করছে রস তাতে । আঠার মত লেগে থাকে যেন আর নাকে লেগে থাকে গন্ধ ।
ফিরে এসে মহুয়ার বৃত্তান্ত নিয়ে ঘাঁটতে শুরু করলেন তিনি । "মধুকা ইন্ডিকা" নিয়ে এবার শুরু হবে তাঁর গবেষণা । আর সঙ্গী হবে তাঁর প্রিয় ছাত্রী মধুজা ।
পরদিন ঠিক করলেন সেই আদিবাসী গ্রামে গিয়ে দেখবেন কি করে তারা মহুয়ার নির্যাস বানায় । মাটির হাঁড়ির মধ্যে জল ফুটছে । তার মাথায় আরেকটা ছোট হাঁড়িতে রাখা মহুয়া ফলগুলো । আর সেই ছোট হাঁড়ির মুখ থেকে একটা বাঁকা নল যার অন্যমুখটি আরেকটি খালি হাঁড়িতে । জল ফুটছে । মহুয়ার সারটুকুনি বাষ্পীভূত হয়ে বাঁকা নল দিয়ে টুপ টুপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় জমা হচ্ছে সেই হাঁড়িতে ।
-এই মহুয়ার রস দিয়ে কি হবে ? জিগেস করলে ওরা শুধিয়েছিল
-নেশার জিনিস বটে
জানলা দিয়ে মুখ বাঁড়িয়ে একটা কুচকুচে কালো লোক বলে উঠেছিল "আমাদের লোকাল মদ"
ছোট্ট একটা মেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল "ছোট বোতল দশ টাকা, বড় বোতল পনেরো "
-ঠান্ডা, গরম দুই রকমই খাওয়া যায় বটে । ঠান্ডা মহুয়ায় ধীরে ধীরে নেশা হয় অর গরম খেলে সাথে সাথে হয়, আরেকজন যুবতী বলে উঠল ।
মহুয়ার বৃত্তান্ত শুনলেন তিনি কচিকাঁচা সকলের মুখে ।
প্রোফেসর বুঝেছিলেন যে ঐ মহুয়া খুব প্রেশাস জিনিস এই আদিবাসী মহলে । আর এদের রুজি রোজগারও বটে ।
তাই এত উত্তেজনা তাদের । হয়ত বা ভেবেছে তিনি কিনতে এসেছেন । এদ্দুর এসে একটা ছোট বোতল নিয়েওছিলেন মৈনাক । দৌড়ে এসে এক বৃদ্ধা মহিলা হাত পেতে দশটা টাকা চেয়েও নিয়েছিল । সেই বৃদ্ধা বুঝি ঐ ব্যাবসার মালকিন । তাই তার এত উতসাহ । আদিবাসী মহলে মেয়েদের এই অন্ত্রেপ্রেণারশিপের তারিফ না করে উপায় নেই !
নিজের ল্যাবরেটারিতে মহুয়া ফল থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে মহুয়ার এক্সট্র্যাক্ট বানাতে গেলে প্রচুর মহুয়া লাগবে । ঐ আদিবাসী গ্রামের মালকিনকে উনি বললেন পরদিন সকালে এক ব্যাগ মহুয়া এনে দিতে । উনি ভোরবেলায় গিয়ে অপেক্ষা করে থাকবেন মহুয়া সরণীর ধারে ।
-পঁচিশ টাকা লাগবেক স্যার, বলল সেই বৃদ্ধা ।
মৈনাক রাজী হলেন । ম্যাজিকের মত ছক কষলেন । এই প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে তো কাজ করা যেতেই পারে । সেদিনের মত ফিরে গিয়ে মধুজাকে নিয়ে ল্যাবে বসে কাজ শুরু হল । মহুয়া ডিসটিলেশানের প্রোটোকল তৈরী হল । কতক্ষণ স্টিমে রিফ্লাক্স করলে মহুয়ার নির্যাস পুরোপুরি বেরুবে সেটা তো হাতে কলমে দেখবার ।
মধুজাও খুব একসাইটেড পুরো ব্যাপারটিতে । পিএইচডির সাথে সাথে আরো একটি পেপার "মধুকা-ইন্ডিকা"র ওপর হলে তো মন্দ হয়না । তাও আবার প্রোফেসর মৈনাক পুততুন্ডর গাইডেন্সে ।
মহুয়া থেকে লিকার তৈরী করে একটা লোকাল ব্র্যান্ড যদি করতে পারেন তাঁরা ! শ্রীলঙ্কায় এক লোকাল লিকার হয় "আরাক" নামে । গোয়ায় গিয়ে কাজুবাদাম থেকে তৈরী "ফেনি" খেয়ে মুগ্ধতায় ভরে গেছিল প্রোফেসরের শরীর-মন । তাহলে বাঙলার এই মহুয়াই বা কম কিসে !
সে রাতে মধুজাকে ল্যাবে থাকতে হবে । প্রচুর কাজ । পরেরদিনও থাকতে হবে । মধুজা ভেবেছিল সেই উইকএন্ডে বাড়ি ফিরবে একবার কিন্তু মৈনাক যেতে দিলেন না । অবিশ্যি ল্যাবে থাকাটা মধুজার সয়ে গেছে । ডক্টরেট ডিগ্রীর মূল্যে সে স্যারের কোনো কথা ফেলতে পারেনা ।
শুনশান ক্যাম্পাস । চৈত্রের খড়খড়ে পাতা ঝরে যাওয়া প্রকৃতিতে দখিনের হাওয়ার মত মৈনাকের ভালো লাগে মধুজার সঙ্গ । হোক না বয়সে অনেকটাই ছোট কিন্তু মৈনাকও তো রক্তমাংসের মানুষ । আর মৈনাক বোঝেন যে মধুজাও তাকে চায় । তাই সব স্কলারদের সাথে দিনে দিনে কাজ শুরু করে সন্ধ্যের আগেই ছেড়ে দেন মৈনাক । রাতের রিসার্চ রহস্যময় হয়ে ওঠে মধুজার উপস্থিতিতে । সারা শরীরে রোমাঞ্চ জাগে মৈনাকের । যৌবনের অধরা কামোদ্দীপনা, আবেগ, ভালোলাগা সবকিছু কাজের চাপে ফসিলাইজড হয়ে গিয়েও আবার মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দুমদাম ।
মধুজা খুব সাবধানী । আজকাল সাথে ব্যাবস্থাও রাখে । প্রিমিয়ার ইনস্টিট্যুটের দিকপাল ফ্যাকাল্টির স্কলার বলে কথা । তাতে আবার সবচেয়ে কম সময়ে রিসার্চ করান বলে সুনাম এনার । ইতিমধ্যে সাতটা পেপার পাবলিশ হয়েছে মৈনাকের সাথে বিদেশী জার্নালে । সারাবিশ্বে সকলে বিশুদ্ধ রসায়নের সায়েন্টিস্ট ডাঃ মৈনাক পুততুন্ডকে একডাকে চেনে ।
মধুজা পাততাড়ি গোটানোর তালে আছে। চার বছরেই কাজটা ভালোয় ভালোয় ইতি করে যদি বিদেশে যাওয়া যায় ।
স্যার বলেন "এত তাড়া কোরোনা মধু, ন্যাচারাল সায়েন্সে পাঁচ বছর অন্তত লাগে"
মধুজা বলে "স্যার আমি যদি চব্বিশ ঘন্টাকেই কাজে লাগাই তাহলে কি হবেনা”!
মৈনাকের অন্য স্কলাররা তাদের গাইডকে খুশি রাখার জন্য মাঝেমাঝে খাওয়াতে নিয়ে যায় । ক্যাম্পাসে একটা কফিশপ আছে । কোনো কোনো উইকএন্ডে হৈ হৈ করে বেশ হ্যাঙ আউট হয় । মধুজা সেদিন হয়ত বাড়ি পালায় । আচমকা কোনো পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বললে মায়ের কথা আমান্য করেনা । লক্ষ্মীমেয়ের মত সালোয়ার পরে ট্রেন ধরে সে । আবার কোনো কোনো দিন অন্যদের আড্ডাতে সামিলও হয় সে । কলেজ ফেস্টে মৈনাক ছেলেমেয়েদের আবদারে নিউজিল্যান্ডের আইসক্রিম কিনে খাওয়ান ।
তবু সকলের মাঝে মধুজার সাথে তাঁর সম্পর্কটা যেন একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ ।
মধুজার সাথে মৈনাকের এই সম্পর্কটির কথা অন্য স্কলাররা জানেনা বোধহয় । এতদিনের মধ্যে একটু অসাবধানতাবশত: বেকায়দায় পড়েছিলেন মৈনাক । অনুব্রত সেদিন হস্টেলে ফিরে গিয়ে আবার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এসেছিল স্যারের ঘরে । কন্ট্রোল টি মেরে অন্য একটা ট্যাব খুলে স্ক্রিনের ছবি নিমেষে পালটে ফেলেছিলেন । সে যাত্রায় বেঁচেছিলেন তিনি ।
মৈনাকের কম্পিউটার স্ক্রিনে মধুজার একরাশ ছবি দেখে অনুব্রত অবাক হয়েছিল কিছুটা । তবে আবার অবাক হয়ওনি কারণ অনুব্রতরাও একজোট হয়ে ফেসবুক-বন্ধুদের ছবি নিয়ে তো এমন ঘাঁটাঘাঁটি আকচার করে । ব্যাটাছেলে মাত্রেই এমন । অতএব সে যাত্রায় সাতখুন মাপ ।
অনুব্রতর জায়গায় কোনো মেয়ে স্টুডেন্ট হলে এখুনি ঢাক-ঢেঁড়া পিটিয়ে পাঁচকান করে বসত । একেই বলে ছেলে । পেট বোঝাই কত কথা এদের !
এভাবেই চলতে থাকে মৈনাকের জীবন । একা একা গেষ্ট হাউসের একফালি এসি ঘরে দিনের পর দিন বাস করা তাঁর । সারাদিন তো ল্যাবরেটারিতেই তাঁর সংসার । শুধু গেষ্টহাউসে সময় মত হাজির হয়ে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার খেয়ে আসা । নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের একঘেয়েমি বুঝতে দেয়না বিশুদ্ধ রসায়ন । অফিস কলিগরা একটু ঈর্ষা করে তাঁকে । অত ডিগ্রীধারি, নামী মানুষ হলে যা হয় । স্টুডেন্ট ছাড়া সহজে কেউ কাছে ঘেঁষেনা ।
কাজ কাজ আর কাজ আর মাঝে মধ্যে মধুজার সাথে মৈথুনের মুখবদল । প্রথম মৈথুনের স্বাদ পেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী মালবিকার কাছ থেকে । তারপর থেকে তিনি উপোসী। উপবাস ভাঙে মধুজার নরম স্পর্শে । ম্যানিকিওর্ড চাঁপার কলি যখন ধীরে ধীরে অবলীলায় প্রবেশ করে তাঁর তলপেটের দিকে জীবনটাকে নতুন করে পেতে ইচ্ছে করে মৈনাকের । মনে হয় চুলোয় যাক রিসার্চ । শিকেয় তোলা থাক পেপার পাবলিশিং । এই মেয়েটাকে পেলে তিনি সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে একরাশ সুখ দেবেন । আর ভুল হবেনা তার । মালবিকা যে না পাওয়ার টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়ে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে তেমনটি পুষিয়ে দেবেন এই মেয়েকে কাছে পেলে । ভরিয়ে দেবেন তাকে । সারাবিশ্ব ঘুরবেন এই মেয়েটাকে নিয়ে । গাড়ি থেকে বাড়ি থেকে সবকিছু আছে তার দিল্লীতে । কিন্তু কেউ নেই তা দেখভাল করার ।
মাঝেমধ্যেই মধুজার সাথে রতিসুখ হয় তাঁর । স্বপ্ন দেখেন মধুজার সাথে ঘর বাঁধার । ঘোর সংসারী হয়ে ওঠে মন । মধুজাও বোঝে স্যারের অবস্থা । তাই দেবার ব্যাপারে খামতি নেই তার । মধুজা আরো বোঝে যে তার যা বিদ্যেবুদ্ধি তার জোরে চারবছরে এতগুলো পেপার পাবলিশ করা অন্য কারো আন্ডারে সম্ভব হত না ।
এর মধ্যে মাস-স্পেক্ট্রোস্কোপি ল্যাবে রিডিং নিতে গিয়ে মৈনাক তো জড়িয়ে ধরে আর ছাড়তেই চান না মধুজাকে । রাত আটটার পর ল্যাব এসিটেন্টরাও থাকেনা অফিসে বা ল্যাবে । মধুজাও বুঝতে পেরে উজাড় করে দেয় নিজেকে । নাক ঘষতে থাকে প্রৌঢ়ের কাঁচাপাকা দাড়িতে । তারপর সেখান থেকে শার্টের বোতাম একে একে খুলতে থাকে মেয়েটা । মৈনাকও বুঝতে পারেন মেয়েটার ঠোঁটদুটো চাইছে তাকে ।
হৈ হৈ করে মিশন মহুয়া ডিসটিলেশান সফল হয়েছিল । একশো মিলির ছোট ছোট বোরোসিলের বিকারে মহুয়া ভর্তি করেছিলেন মৈনাক দাঁড়িয়ে থেকে । হালকা গরম মহুয়া পান করেছিলেন দুজনে মিলে । এরপর যে যার মত ফিরে গেছিল বাড়ি । পরদিনের জন্য রাখা ছিল আরো মহুয়া ল্যাবের ফ্রিজে ।
মহুয়ার ঘোর কেটে পরের দিন ল্যাবে এসে দুজনেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল একে অপরের দিকে । অদ্ভূত এক আবেশ । অসাধারণ অনুভূতি । সব স্ট্রেশ নিমেষে উধাও ।আর সবচেয়ে বড় কথা মিশন মহুয়া সাকসেসফুল । শুধু ব্র্যান্ডিংয়ের অপেক্ষায় ।
এবার মহুয়ার ওপরে পেপার লেখার শুরু । মধুজা স্যারের ইনস্ট্রাকশান মত পেপার লিখে সাবমিট করবে । এক এক সময় মৈনাক ভাবেন, মধুজার মত রিসার্চ স্কলার না পেলে তাঁর অনেক ইচ্ছেগুলোই অধরা থেকে যেত । মেয়েটা কি প্রচন্ড খাটতে পারে । শুধু স্যারের মুখের কথা খসার অপেক্ষায় । নয় নয় করে সাত-সাতটা পেপার তার । মহুয়ার পেপার একসেপ্টেড হলে আটনম্বর হবে । পিএইচডির কাজ শেষ করে ফেলেছে মধুজা । শুধু ভাইবা বাকী আছে । অবিশ্যি মৈনাককে একটু আধটু ছুঁয়ে থাকলে, তাকে কাছে টেনে নিলে মধুজার কাজ অনেকটাই এগিয়ে রাখেন তিনি ।
মধুজা ল্যাবে সারাক্ষণ থাকে, কাজ করে এই নিয়ে আন্ডার গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টরা ইদানিং অনেক কানাঘুষো শুনছে । মৈনাকের বাকী স্কলাররাও আজকাল ওকে ল্যাবের মক্ষিরাণী বলতে শুরু করেছে । সব প্রোজেক্টে মধুজার নাম থাকে । মৈনাক পুরতুন্ডর সব পাবলিকেশানে মধুজা মিত্রের নাম থাকবেই । মধুজার কিন্তু এসবে কোনো হেলদোল নেই । সে জানে কাজ হাসিল হলেই হোলো । ডিপার্টমেন্টের শ'খানেক ছাত্র ছাত্রীর গুজব, রটনা নিয়ে অনেক চাপানাওতোর কিছুদিন ধরেই চলছে । মধুজা মিত্র লাজলজ্জার কেয়ার করেনা । সে মন দিয়ে পেপার লেখায় ব্যস্ত থাকে ।
মৈনাক গেলেন ব্যাঙ্গালোরে, ডিপার্টমেন্টের কাজে । মহুয়ার ব্র্যান্ডিংয়ের ব্যাপারে সে শহর থেকেও কিছু তথ্য সংগ্রহ করা যাবে আশা করলেন । মধুজা চোস্ত ইংরেজী লেখে । শুধু মহুয়ার কেমিক্যাল কম্পোজিশন আর তার সাপোর্টিং ডেটাগুলো ঠিকঠাক থাকলেই হল ।
কিন্তু মেয়েটার রসায়নের জ্ঞানগম্যি খুব কম । তাই ছোটখাটো ভুলত্রুটিগুলো দেখে নিতে হয় । অবিশ্যি অন্য কারোর পেপারে এমন ভুলকে প্রশ্রয় না দিলেও মধুজার ব্যাপারে সাতখুন মাপ ।
সেবারের একটা পেপারতো মৈনাক নিজেই প্রায় পুরোটা লিখেছিলেন । শুধু মহুয়া তাঁর পাশে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা । মাঝে মধ্যে বোরডম ঘোচানোর জন্য সেই বিদ্যুতলতার মত মিষ্টি দেহ বল্লরীই যথেষ্ট । মৈনাকের ল্যাবের একটা কোণে সোফা আছে । সেখানে ঐ মেয়ের সান্নিধ্যে একটু গড়িয়ে নেওয়া কিম্বা বাইরে থেকে রাতের খাবার আনিয়ে খেয়ে দেয়ে একটু দৈহিক ফূর্তি এবং তৃপ্তি দুটোই পেতেন মৈনাক ।
এবারে একটু তাড়া আছে দুজনেরি কারণ সামার এসে যাচ্ছে । মৈনাকের নরওয়ে ট্রিপ আর ওদিকে মধুজার সুইডেন যাওয়া । যাবার আগেই সবটা শেষ করে ফেলতে হবে । অবিশ্যি কারোর টিকিট এখনো কাটা হয়নি । তাই রক্ষে ।
মণিতম
মৈনাক ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরলেন দিন সাতেক বাদে । খুব হেকটিক শেডিউল ছিল ।
রাতের ফ্লাইটে ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে ল্যাবের ফ্রিজ খুলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলেন সেই বাসি মহুয়ার তলানিটুকু । যদিবা সারাদিনের পথ ক্লান্তিটা একটু রিলিফ দেয় ।
মিশন মহুয়া সাকসেসফুল । এবার পাঠাতে হবে বিদেশের জার্নালে । তারপর নরওয়ে ট্রিপ । মধুজাকে রাজী করিয়ে নরওয়েতেও নিয়ে গেলে ভালো হত । সেখানে মৈনাকের সাথে সেমিনার এটেন্ড করে মধুজা না হয় সুইডেন চলে যেত। তারপর তো আর মধুজাকে কাছে পাওয়া যাবেনা তিনি ফিরে যাবেন ইন্ডিয়াতে আর মধুজা সুইডেনে ।
পোষ্ট-ডক্টরাল রিসার্চ করতে কমপক্ষে বছর দুয়েক তো লাগবেই । যোগাযোগ থাকবে মধুজার সাথে ইন্টারনেটের মধ্যে দিয়ে আর ফোনে । আবারো সেই একাকীত্বের বিষণ্ণতা কুয়াশার মত ঘিরে ধরবে মৈনাককে । মনে পড়বে মালবিকার কথা । ছোট্ট মেয়েটাকেও ভালো করে মনে পড়েনা আর ।
মধুজা এসে এই বছর চারেকে সব কিছু আপসাইড ডাউন করে দিয়েছে । যখন যেভাবে তিনি চেয়েছেন মধুজা তাকে নিরস্ত করেনি । ভাবতে ভাবতে নিজের ডেস্কে এসে বসে পড়লেন । টেবিলে গুচ্ছ কাগজ জমে গেছে । সাতদিনের অনুপস্থিতে চিঠির পাহাড় জমেছে । আগামীকাল অফিসে এসে সব একে একে খুলে দেখতে হবে ।
শরীরটা কেমন যেন আনচান করছিল । বাসি মহুয়াটুকুনি না খেলেই বুঝি ভালো ছিল ...ভাবলেন তিনি ।
আদিবাসী গ্রামের ওরা বলেওছিল "যত ঠান্ডা হবেক্, তত দেরী করে নেশা হবেক "
নাঃ আজ আর দেরী করে কাজ নেই, গেষ্টা হাউসে ফিরে গিয়ে শান্তি । রাতে ঘুমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, মনে মনে বিড়বিড় করলেন মৈনাক ।
কি ভাগ্যি ডিপার্টমেন্টের কাছেই গেস্টহাউস । ঐটুকু হেঁটে চলে গিয়েই নরম বিছানা পাতা আছে তাঁর জন্য । বয়স তো হল । নয় নয় করে পঞ্চাশের কাছাকাছি ।
এই সাতটাদিন ইমেলে যোগাযোগ ছিল মধুজার সাথে । পেপার লেখা শেষ করে মেল করে পাঠিয়েও দিয়েছে স্যারকে। আর সেইসাথে স্যারের টেবিলে রেখে দিয়ে গেছে একখানা সোনালী খামে চিঠি ।
ওপরে লালকালিতে মোটা করে লেখা : প্রোফেসর মৈনাক পুততুন্ড ।
শুভবিবাহের খবর আছে তার মধ্যে । "মধুজা ওয়েডস মণিতম" ।
সুইডেনবাসী এক বাঙালী সায়েন্টিষ্ট মণিতম ।
বিয়ের পর মধুজা শুরু করবে তার পোষ্ট ডক্টরাল রিসার্চ । তেমনি কথা আছে ।
লেখক পরিচিতি
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
জন্ম সাল ১৯৬৫।
জন্মস্থান আড়িয়াদহ।
বর্তমান আবাসস্থল : দক্ষিণ কলকাতা।
ছোটগল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী, কবিতা, অণুগল্প লেখেন।
প্রকাশিত কবিতার বই : মোর ভাবনারে"।
রান্নার বই : ( English) 89 Recipes.
ভ্রমণকাহিনী : চরৈবেতি। ।
ছোটগল্প সংকলন : দ্বাদশী ।
প্রাপ্ত পুরস্কার : দ্বাদশ বেহালা বইমেলায়(২০০৯) কবিতার বই শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারে সম্মানিত ।
রোমানিয়ান পত্রিকায় কবিতার অনুবাদের জন্য রোমানিয়ান ব্লগের প্রেসকার্ড ।
সম্পাদিত ই-পত্রিকা: papyrus.sonartoree.com
ইমেইল-ঠিকানা : indira@sonartoree.com
4 মন্তব্যসমূহ
Indira--bhalo laglo golpo pore---aro lekha porar opekshyay roilam....
উত্তরমুছুনগল্পটি খুব সময়োপযোগী কিন্তু মধ্যিখানটা আরেকটু সংক্ষিপ্ত হলেও হতে পারত। এমনিতে বেশ লাগল।
উত্তরমুছুনGood Storyline ! keep it up Indira !
উত্তরমুছুনবেশ ভালো। শ্রাবণী দাশগুপ্ত।
উত্তরমুছুন