আমি তারেই খুঁজে বেড়াই......
আবার সে
এসেছে। একা। তার সঙ্গে তার ব্যাকপ্যাক, লাঠি, জল। তার বিশ্বাস সন্দেহ, অতীত
বর্তমান, ইতিহাস ভূগোল। সোফিয়া তাকে একা যেতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু নিজেও আসতে
পারেনি, কারণ ঝুঁকি নিতে চায়নি। সোফিয়া চোদ্দ সপ্তাহের গর্ভিনী। ন্যাশান্যাল
হাইওয়ে ধরে শহুরে ব্যস্ততার পাশ কাটাতে কাটাতে বহুদূর চলে এসেছে তার গাড়ি। সে কাল
রাতের মত আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। নামী শৈল শহরের অনামী একটা হোটেলে। সূর্য আড়মোড়া
ভাঙতেই আবার চলার শুরু। তার সঙ্গে চলেছে নদীটা। অনর্গল কথা বলতে বলতে।
দুপাশে জমা
করেছে নুড়ি, বলে ফেলা কথার মতন। এদিকে তার বুকের আরশিতে নিজের ছায়া দেখবে বলে
ঝুঁকে আছে বড় বড় পাহাড়গুলো। তাদের পিছনে আরো পাহাড়, আবছা; যতদূর দৃষ্টি যায়
ডাইনোসরের মতন দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে নরম মেঘেরা আদরে ভিজিয়ে দেয় ওদের। এমনি উপত্যকা
ধরে চলেছে তার গাড়ি সাত আট ঘন্টা ধরে। দিনকয়েক আগে অল্প তুষারপাত হয়েছিল, চারপাশে
তার চিহ্ন। কে তার চোখের পাতায় সুড়সুড়ি দেয়, কেমন লাগছে, বলো! সে যেন হাসে। চোখ
মটকায়, আগে পাই। পথে কয়েকবার ক্লান্তিবশত গাড়ি থামিয়েছে ড্রাইভার। সে-ও নেমেছে পায়ে
খিল ধরে গেলে। বা, বার কয়েক বমি করতে। পথে কিছুই খায়নি। বমিতেও জল ছাড়া বেরোয়নি
কিছু। কষ্ট হচ্ছিল বলে ব্যাগ থেকে বের করে একটা বমন নিরোধক খেয়েছে সে। যদিও এটা
একেবারেই পছন্দ করেনা। কারন, খেলেই তার অনিবার্য ঘুম পায় আর নদীর দেশটা দৃষ্টি
থেকে লুকিয়ে পড়ে। আপাতত সে মনে করার চেষ্টা করে যায় কোথায় নেমেছিল তারা তিনজনে,
শুধু জল ছুঁতে। দশ বছর আগেকার ছবিটা অস্পষ্ট। সে চশমা খোলে। মুখের ভাপ দেয়, মোছে।
তবু ঠাহর হয়না। গাড়ি বাঁক নিয়েছে এবং থেমেছে। সামনে ভেড়ার পাল। সঙ্গে দুজন পালক বা
চালক। পাকদন্ডি বেয়ে গাড়ি উঠতে থাকে। ঘুরে ঘুরে এক পাহাড় ছেড়ে অন্যটায়। তার মাথা
ঘোরে, ধন্দ লাগে। ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা/ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা, সে আউড়ে যায়
বারে বারে। এসব সে মুখস্থ করেছিল একসময়ে। অকারনেই। তার বাঁদিকে পাহাড়ি ঢাল নেমেছে।
ওখানে গতজন্মের মত অনাদি অবিশ্বাস্য গাছেরা ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মাথায় বরফ মেখে। সুযোগ
পেলে সূর্য তাদের সোনার জল ঢেলে স্নান করিয়ে দেয়। সে নিজেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। দূরের
পাহাড়ের মাথা যেখানে বরফ লেপ্টে আছে, দেখে। গাছের গায়ে ফুল দেখে, ফল দেখে। পাতা
থেকে কানের দুলের মত বরফ ঝুলছে দেখে। ভেবে পায়না এর কোনটি অসত্য। তাও কিছুতেই নিঃসংশয়
হতে পারেনা। পরলোক আর পূবজর্ন্ম কি সমার্থক? মন ও আত্মা এক? কোথায় সে এসব পড়েছে
মনে পড়েনা। তখন অনেক নীচে তাকিয়ে ইস্কুলের ড্রইং খাতায় আঁকা নীল রং-এর চলমান নদীটা
নীচে দেখতে থাকে। অবশ্য সে ঠিক দেখেনা, তাকিয়ে থাকে। কিছু খোঁজে। অথবা কিছুই না। উন্মনা
শোনে, ড্রাইভার বলছে আর ঘন্টা দুই এমনি চলতে পারলে আপাতত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। যাবার
আগে সূর্য বলে গেছে, কাল আবার আসবে।
এমন দিনে তারে......
গাড়িতে তারা
তিনজন। তিনটি মন । তিনটি আলাদা আলাদা মন। ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক। প্রথম দুজন মন আধা
জীবন পেরিয়ে এসেছে, তৃতীয়টি সদ্য ভোটাধিকার পেয়েছে। মনসুর আলম, মনস্বিতা ঘোষাল আর
মন। তার নামে কোনো লেজূড় রাখা হয়নি। ড্রাইভারের পাশের সীটে মন। তার কানের হেডফোনে
গান চলছিল। বাকি দুজন পিছনের সীটে। তাদেরই একজন অপরজনকে বলল,
--বমির ওষুধ
খেয়ে নেবে একটা?
--না, ঘুম
পায়।
--মন, তুই
খাবি?
মন সামনের সীট
থেকে শুনতেই পায়নি। তাই আবার ডাকে,
--মন খাবি
তুই?
মন হেডফোন
খুলে রেখেছিল।
--আমার বমি
পাচ্ছেনা।
--ও, আচ্ছা।
আবার চুপচাপ।
আস্তে আস্তে আলো কমে আসছিল। অলস ঘুমের চাদরে মুড়ে যাচ্ছিল সব কিছু। পাহাড়, নদী।
অন্তহীন নৈঃশব্দ। তাদের ঘুমঘুম লাগছিল। অথবা ঘোর ঘোর। দুজনের একজন বললো,
--মনে আছে
তোমার! ঊণিশ বছর আগে যখন প্রথম পাহাড়ে এলাম? মন জন্মায়নি।
--সে সময়ে
পাহাড় অনেক শান্ত ছিল। অন্তর্মুখী।
এই অবেলায়
সময়চক্র কেন আবার বিপরীত গতিমুখে। সেই দিনগুলোয় ঝড়ের তুমুল ঝাপটা খেতে খেতে আধমরা
দুজনে পালিয়েছিল। অন্য সব সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদের কাছে। সমস্ত চেনা দরজা
বন্ধ। প্রতিবাদী কবিতার মতন সমমনস্ক দুই যুবক ও যুবতী। নারী ও পুরুষ।
--সেবার বরফ
দেখতে পাইনি। এবারেও পাব না।
--আমরা বরফের
সময়ে আসি নি একবারও। আসবো আবার কখনো।
--আমি কিন্তু
এই প্রথম আর এই শেষ। আর কোনো দিনও না।
--আমরা কিন্তু
তোকে জোর করিনি মন। নিজেই এলি।
অনাবাসী
অতিথিদের জন্য চমতকার অতিথিশালা। পাশাপাশি দুটি ঘর। তৃতীয় মনের বন্দোবস্ত। সমস্ত
ঘরটি জুড়ে ছড়ালো তার পোশাক বই ম্যাগাজিন মিউজিক প্লেয়ার ক্যামেরা। পাশের ঘরে দুটি
আপাতক্লান্ত মন। গভীর, বিরোধহীন দীর্ঘ বন্ধুত্ব। স্যুটকেস খোলা হয়নি। পোশাক বদলানো
হয়নি। আজ রেস্ট। বিদেশি পপ মিউজিকের উদ্দাম আওয়াজ আসছিল পাশের ঘর থেকে।
--মন কেন যে
এই বাজনা শোনে!
--কী বলবো! বড়
হয়েছে। এডাল্ট।
--বোঝেনা যে
পাহাড় রাগ করে?
--ওর এখনো
নেশা ধরেনি। বলল না, ভালো লাগেনি? সময় লাগবে।
--এবারে আসার
আগে ভেবেছিলাম খুব বরফ পাবো।
--এই সময়ে বরফ
পড়েনা। তবে দেখো আবার, পাহাড়ের মন বোঝা যায়না।
তারা উষ্ণতার
জন্য পাশাপাশি এলো। সব অন্তবার্স লুটিয়ে নামলো পায়ের নীচে। উন্মুক্ত হলো দুটি অনেক
চেনা শরীর। কিম্বা মন। তখন তারা একে অন্যকে সস্নেহে ছুঁইয়ে দিতে লাগল। চোখ, ঠোঁট,
বুক কোমর।
--তোর
মধ্যপ্রদেশে অনেক মেদ জমেছে মন। জীবনে প্রথমবার তুইই দেখিয়েছিলি পাহাড়! এখন তার
চাপে উপত্যকাই হারিয়ে গেছে। এমনকি, হার্টবিট শোনার ফাঁকটুকুও নেই! কালো জড়ুলটা
পযর্ন্ত খুঁজে পাইনা। হয়েছিস ঠিক একটি হাইস্কুলের মার্কামারা...!
--ভালো, বয়স
হয়নি যেন! আমি যে পাঁচমাসের বড় তোর থেকে সেটা ভুলিস কেন? তুইও তো কুমড়োপটাশ।
মাথাটা আরো ফাঁকা। বুকের লোমগুলো সাদা... চশমার পাওয়ার কত বাড়িয়েছিস।
--শোন শোন
তোদের বেদান্ত বলে, শরীর হলো খোলস আর সেটি মনের আশ্রয়, বুঝেছিস?
--ওহ হো...তোদের
কর্পোরেট দুনিয়ায় এসবও শেখাচ্ছে নাকি আজকাল?
--তবে! একা
তুইই ফিলোজফি পড়াস নাকি?
তারা হাসল। প্রতিজ্ঞা
করল ফিরে গিয়ে নিয়মিত যোগব্যায়াম করবে, প্রাণায়াম। তারপর নরম গল্প করতে করতে পরস্পরকে
অবলম্বন করে তৃপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল কম্বলের নিচে। যেন কত বছরের জমানো ঘুম।
তুই ফেলে এসেছিস কারে......
তাদের গাড়ি
তাদের নামিয়ে দিয়েছিল সেখানে, যেখান পযর্ন্ত গাড়ি যেতে পারে। তারা তিন জন, তিন মন।
তাদের মতন আর অল্প কয়েকজন ট্যুরিস্ট। গবোর্দ্ধত পাহাড়। তাদের অনেক উঁচু মাথা।
একপাশে নিঃসীম খাদ। ফেলে আসা অতীত। ওদিকে তাকিয়ে থাকলে মাথা ঘোরে। দুজনে ওই
দৃশ্যকাব্যকে চোখ ভরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তাদের হা-ক্লান্ত হয়রান শহরটাতে। তৃতীয়জনের
চোখ ততক্ষণে অভিমানী ক্যামেরায়। পাহাড়ের সঙ্গে অতখানি আত্মীয়তা না হলেই বোধ হয়
ভালো হত। সঙ্কীর্ণ পথ, নীচে অনাবৃত রহস্যের সংকেত। কী করে হলো, কেমন করে বোঝা
গেলনা। দুজনের একজন গড়িয়ে গড়িয়ে সেই যে অতলে অজানা গাছেদের দেশে। কিছু করার ছিল
না। করা হলো না। যারা দেখল, তারা বলল ভারী শরীর তাল রাখতে পারেনি। বাকি দুজন তখন
দুটো পাহাড়, যাদের মাথায় জমেছিল বরফ। তারপর এক গা-গোলানো হেমন্তের বিকেলে সে তৃতীয়
মনের কাঁধে ভর রেখে সামলাতে সামলাতে শহরের একপ্রান্তে তাদের সাজানো গোছানো ছোট্ট
বাড়িটার তালা খুলল। একবারই হাহাকারটা জমাট শ্লেষ্মার মতন উগড়ে এলো গলা বেয়ে। তখনো
তাদের শোওয়ার ঘরের পাখাটা ঘুরছিল। যাবার সময় বন্ধ করতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। এইটুকু সে
তেলতেলে ট্রেসিং কাগজে আঁকা আবছা পুরোনো ম্যাপের মত মনে করতে পারে। তারপর দিনের
পরদিন ধুলোর পরে ধুলো জমল। পরিষ্কার হলনা। সে তাঁর ধোঁয়াটে মন নিয়ে তিন বছরের
কাছাকাছি পড়ে রইল রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে। সেইসব দিন অবশ্য তার আর মনে পড়েনা। এক
সন্ন্যাসী তাদের সুন্দর করে বোঝাতেন ভারতীয় দর্শন। তখন সে নিবার্ক হয়ে শুনতো।
তারপর ভুলে যেত। সেই সন্ন্যাসীর নাম বা চেহারা তার আর মনে নেই। শুধু তাঁর পোশাকের
সাঁঝবেলার রং আর গৌরবর্ণ বিরলকেশ কী অদ্ভুতভাবে দৃশ্যমান হতো মাঝে মাঝে। তখন সে
ডুব দিত। ডুব দিত আর খুঁজত। তারপর অঙ্ক কষে কষে যখন ক্লান্ত লাগতো, তখন সে চুপ করে
চোখ বুঁজে বুঁদ হয়ে থাকত। ভাবতনা। আর, কোন অতলে অস্ফুট একটি অনুভূতি বুড়বুড়ি কাটত।
সেটিকে সে ঠিক চিনতে পারত না। অস্বস্তির কারণ হয়ে জেগে থাকত।
তুমি ছেড়ে ছিলে ভুলে ছিলে বলে......
সন্ধ্যে হয়ে
গেলে এখানে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেল ড্রাইভার। ক’দিন থাকবে, নিজেও সে ভাবেনি। ছোটো
পাহাড়ি গ্রাম। পৃথিবীর অনন্য কোন প্রান্তে অস্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কবে থেকে একা
বেঁচে আছে। নামও আছে কিছু একটা। আর অদেখা কল্পনার কিছু ঘরবাড়ি। মেষপালকদের প্রশান্তিময়
যাযাবর চলন। তাদের লাল আপেল গালওয়ালা বৌ আর পুতুলের মত বাচ্চারা। ইতস্তত ঘুরে
বেড়ায় ইয়াক আর ভেড়া। তাদের গায়ের গন্ধের সমকৌণিক তাদের মালিকের সরলতা। কারণ দুইই
জন্মগত। একটু দূরে এক পাহাড়তলির বৌদ্ধমঠ। তার গায়ে রঙিন আঁকিবুকি। কত শতাব্দীর
বার্দ্ধক্যের চিহ্ণ। গায়ে ওভারকোট, পিঠের ব্যাকপ্যাকে অল্প ব্যবহার্য্য, সে
লাঠিতে ভার সামলে এগিয়ে চলে। যেটা ঠিক হোটেল নয়, বরং সরাইখানা, তার একটা ঘরে নিজের
জিনিসপত্র নামিয়ে রাখে সে। তারপর খাবার ঘরে এসে বসে। আজ সে একলাই এখানে। কাঠের
দেওয়ালে দুটি তিব্বতী আর্ট। এককোণায় ঘর গরম রাখার সরঞ্জাম। বসে থাকতে থাকতে তার
প্রবল খিদে বোধ হয়। সে কিছু কিছু খাবারের অর্ডার দেয়। কী খায় সে জানে না। খিদে
নিবৃত্ত না হওয়া পযর্ন্ত খেতে থাকে। ঘরে তার বিছানার ঠিক পাশের জানালায় রঙিন ভারী
পর্দ্দা। গায়ে দেবার জন্য একজোড়া কম্বল, তাতে গুমসানো গন্ধ। সে কিচ্ছু টের পায় না।
পোশাক বদলানোর কথা মনেও আসে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার কাঁপুনি লাগে। তবু কত যুগ
পরে যেন আজ ঘুমের ওষুধ না খেয়েও তার ঘুম এসে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙল, তখন ঘড়ির সময়
অনুযায়ী ভোর হচ্ছে। সে কিছু না ভেবেই জানালার পর্দ্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়। কাল
সারারাত তুষারপাত হয়েছে। দূরের পাহাড় থেকে সামনের রাস্তা – নিদাগ নিথর সাদা। টেলিফোনের
কেবল লাইনে সাদা আস্তরণ। এই অসম্ভব স্তব্ধ শুভ্রতা তাকে প্রায় হত্যা করে। তার
শ্বাস আটকে আসে। মাথার ভেতর থেকে কী যেন নিষ্কাশিত হয়ে যায়। অনাবৃত শূণ্যতা। তার
অর্ধচেতনে কেউ ফিসফিস করে বলে, দশ বছর আগে এমনটা দেখবে বলেই কেউ আর ফিরে যায়নি।
তার শিরদাঁড়া বেয়ে বরফস্রোত, আর তলপেটে তীব্র মোচড় দিয়ে ওঠে। সে দিশেহারার মত
টয়লেটে যায়। অনর্গল বেড়িয়ে যায় অপাচ্য তরল। প্রচন্ড শীত লাগে তার। কম্বল গায়ে
জড়িয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়ে। কোথাও কেউ নেই এই অদ্বিতীয় সকালে। চোখের সামনে পড়ে
আছে শ্বেত উপত্যকা – যতদূর দেখা যায়। তার মনে হয় কফনের নোতুন কাপড়।
প্রথম আদি তব শক্তি......
লাঠি ঠুকঠুক
এগোয় সে। অনেক দিন হয়ে গেল লাঠি ছাড়া চলতে অপারগ। তার হাত কাঁপে, পা কাঁপে।
ডাক্তারি মতে এই রোগের বড়গোছের নাম আছে একটা। তার অতসব মনে নেই আর। চশমার কাঁচে
বাষ্পায়ন। বুদ্ধমন্দির থেকে ইয়াকের ঘী-এর প্রদীপ জ্বলার গন্ধ ভেসে আসে। দ্রিম
দ্রিম দ্রিম। একসুরে পাঠের আওয়াজ মিলিয়ে যায়, ওঁ মণিপদ্মে হুং। তার চেতনায় বোধি
শব্দটা ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু আনুষঙ্গিক আর কিছু মনে পড়ে না। হাত থেকে কখন খসে
গেছে লাঠি সে খেয়াল করেনি। তাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তার তলপেট আবার মোচড়ায়। এবারে সে
সামলাতে পারে না। তীরবেগে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায় দুর্গন্ধ তরল। তার ট্রাউজার নষ্ট
হয়ে যায়। খানিক জান্তবভাবে হামাগুড়ি দিয়ে এগোয় সে। বুঝে উঠতে পারে না আনন্দ না
বেদনা, কোনটা এখন তার বেশি কাছাকাছি। রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে দর্শনের ক্লাসে সে
শুনেছিল, মানুষের অস্তিত্বের নানা স্তর। মনে পড়ছিল তিন, অন্নময় কোষ, প্রাণময় কোষ
আনন্দময় কোষ। মানব শরীর অন্নময় কোষ। এমন সব ভারী ভারী কথা সে বিস্মৃত হয়েছে কত দিন
আগে। এমুহূর্তে শুধু আশেপাশে অসংলগ্নভাবে ঘুরে ঘুরে যায় – অন্নময়... প্রাণময়...
আনন্দময়... আর? আর কি? কে তাকে প্রশ্ন করে,
--তুমি কে?
পশু না মানুষ?
--জানি না।
--নারী না
পুরুষ?
--মনে নেই।
--জীবিত না
মৃত?
--বলতে পারি
না।
--তবে তুমি
কি?
--অস্তিত্ব...অন্নময়...অন্নময়...আমি
অন্নময়...আমি...আর
এমনি করে বিড়বিড়
করে একই কথা বলতে বলতে সে চলতে থাকে। হঠাত তার ভারী গরমবোধ হয়। খুলে ফেলে সে তার
সমস্ত পোশাক। জুতো, টুপি, মোটা পাওয়ারের চশমা। সে আরও এগোতে থাকে। অস্থির হয়ে ওঠে
আর চারপাশে তাকায়। তার সমগ্র চেতনা জুড়ে প্রবল ঝড় ওঠে। নেই। কী নেই! অথচ কী যেন
থাকার কথা ছিল। এক বিস্ফোরণ ঘটে যাবে হয়তো। অজ্ঞাতেই সমস্ত মন এবং অস্তিত্ব
একবিন্দুতে নিতে পারে সে। এই প্রচন্ড চেষ্টা তার পিপাসা বাড়ায়। সে ঊর্ধ্বমুখে
দাঁড়ায়। দুই হাত ছুঁড়ে দেয় ওপরে। অখন্ড প্রগাঢ় নীল ঔদার্য তার বোধে অনন্য আলোর
বন্যা বইয়ে দেয়। কোথা থেকে দলছুট একটা পাহাড়ি প্রজাপতি এসে তার মাথায় বসে, উলঙ্গ
শরীরে বসে। সেই মুহূর্তেই সামনের সাদা উত্তুঙ্গ পাহাড়ের চূড়ো আর লুটিয়ে পড়া
উপত্যকা তাকে তীব্রভাবে শারীরিক করে তোলে। সে উবু হয়ে বরফের ওপরে মুখ ঘষতে থাকে।
ফিসফিস করে বলে, প্রাণ আনন্দ বিশ্বাস...!
আমার প্রাণের পরে.........
সেই ফেলে
দেওয়া ওভারকোটের পকেটের ওমে চুপ করে থাকে মাস দুই আগেকার একটা ডেথ সার্টিফিকেট আর
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। মিঃ মন (ডেট অব বর্থ...) অব মনস্বিতা ঘোষাল এন্ড মনসুর আলম। পাহাড়
মনকে ডেকেছিল অনেক বছর আগেই। মন বোঝে নি। তার প্রফেশন, জীবিকা ঘুরে ঘুরে।
রিপোর্টার। কোথায় না কোথায় যেতে হত তাকে। শুধু পাহাড়ে যায় নি আর। এবারে যাওয়া দেশের
উত্তর পশ্চিম সীমান্তে। উপদ্রুত অঞ্চলে। মন বলে গিয়েছিল, ফিরে আসবে খুব তাড়াতাড়ি।
সে কিন্তু মনকে একবারও বলেনি, যাসনা। জানতে চায় নি, কবে ফিরবি? বলে নি, আমার ভয়
করে। তার ডান চোখ কাঁপেনি। ঘুমের ওষুধ খেতেও ভোলেনি সে। শুধু গভীর রাতের স্বপ্নে
দেখেছিল নিকষ কালো মসৃণ দীর্ঘ নিটোল নগ্ন পা দুখানা। উন্মুক্ত যোনিতট সাঁতরে এলো
শিশু। আলোর ফুলের মত। তারপর হঠাত মিলিয়ে গেল। সোফিয়া আব্রাহাম, আফ্রো-আমেরিকান।
মনের বান্ধবী। সম্ভবত মন ফিরে এলে বিয়ের কথা ভেবেছিল দুজনে। সেই সোফিয়াকে সে...,অনৈতিকতার
কোনো প্রশ্ন জাগে নি তার মনে। শুধু ঘুমোতে ভয় পেয়েছিল। সারারাত নীল থমথমে ঘুমবাতি
জ্বলেছিল তার ঘরে। তারপর সে বসেছিল অনেকক্ষণ। কোথাও বিস্ফোরণ হচ্ছিল বুঝি, কিম্বা
বজ্রপাত। হয়তো কোথাও পৃথিবীর কোনো কোণ ভেঙে পড়ল। সে তার হাতের মুঠোয় একমুঠো
স্তম্ভিত নীলাকাশ চেপে ধরে আধোঘুমে জেগে রইল।
মন এসেছিল
বন্ধ প্যাকিং বাক্সে, আর উপরে ঢাকা দেওয়া ছিল তীব্র সাদা একটি কাপড়।
বাঃ, মুগ্ধ হলাম। গল্পটা ক্রমে ছড়িয়েছে...চলন খুব সপ্রতিভ।
উত্তর দিনমুছুনপর্বের নামকরণ ভাল লেগেছে এবং সুপ্রযুক্ত হয়েছে। গল্পকারকে শুভেচ্ছা জানাই।
onek onek dhonyobaad...
মুছুনporechhiii
উত্তর দিনমুছুনkemon laglo janao ni ...
মুছুনSrabani Dasgupta