আহমাদ মোস্তফা কামালের গল্প : ছিনতাই

মলিন মুখে সুমনকে বাসায় ফিরতে দেখেই সুমনা যা বোঝার বুঝে ফেললো, শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-- আবার?

হুঁ।

সব নিয়ে গেছে?

না, টাকাপয়সা আন্ডারওয়্যারের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলাম।

শুধু তোমারই এরকম হয় কেন বলো তো! এত মানুষ চলাফেরা করে, তাদের তো এত ছিনতাই হয় না!

শুধু আমারই নিশ্চয়ই হয় না! আরো অনেকেরই হয়, কিন্তু যাদের হয় তারা তো আর তোমাকে বলতে আসে না!


তাই বলে বারবার এরকম হবে? ওরা তোমাকে চিনে রেখেছে নাকি?

জানি না।

তুমি একটু সাবধান থাকতে পারো না?

সাবধানেই তো থাকি। তারপরও...

থাক। যা হওয়ার হয়েছে। টাকাপয়সা না পেয়ে তোমাকে কিছু বলেনি তো?

বলেছে। অনেক কথাই বলেছে। কিছু নেয়ার চেষ্টাই করেনি ওরা, কেবল কথাই বলেছে!

কী বলেছে?

একটু দম নিতে দাও তো! পরেও তো শুনতে পারবে!

আচ্ছা আচ্ছা। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নাও। নইলে স্নান করে নাও। আমি জল গরম করে দিচ্ছি।

গোসল করবো কেন?

নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছ! ভয় পেলে স্নান করে নিতে হয়। নইলে শরীর খারাপ করবে।

এই শীতের রাতে গোসল করবো!

প্লিজ...

আচ্ছা। গরম পানি দাও।

এই শব্দগুলো বলো না তো! তোমাকে অচেনা লাগে।

কোন শব্দগুলো?

এই যে স্নানকে গোসল বলছো, জলকে পানি বলছো!

আমি ঠিকই বলছি। তুমি অভ্যাস পাল্টাও। কতবার বলেছি, বাসায় অভ্যাস না করলে বাইরের মানুষের সামনেও মুখ ফসকে এগুলো বলে ফেলবে!

বললে কী হবে?

কী হবে বোঝো না? আমার অবস্থা দেখেও বোঝো না?

এভাবে বলো না, আমার ভয় করে।

আচ্ছা এবার যাও, পানি গরম করো।

ঘটনা হলো, আজকেও সুমনকে ধরেছিল। এটা প্রথমবার নয়। সত্যি কথা বলতে কি, এরকম ঘটনা যে কতবার ঘটলো তার কোনো হিসেব আর রাখতে পারেনি সুমন বা সুমনা। ও, আচ্ছা, নাম দুটো দেখে আপনারা ভাবছেন বানানো? ভাবছেন স্বামী-স্ত্রীর নামে এরকম মিল থাকতেই পারে না! না, বানানো নয়। এরকম মিলসহ নামের জুটি আরো অনেক আছে। যেমন সুমনের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর নাম রানা আর তার বউয়ের নাম রানু! তো, রানাও সুমনার মতো একই কথা জিজ্ঞেস করে-- ‘সারা শহরে কোটিখানেক লোক ঘুরে বেড়ায়, তাদের তো এত ছিনতাই হয় না, তোর হয় কেন?’ সুমন এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে? এই শহরে এই সময়ে কার জীবনে কখন কী ঘটে যায় তার কি কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে? বাসা থেকে বেরিয়ে ঠিকঠাক মতো আবার বাসায় ফিরে আসাই তো একটা মিরাকল। রানার জীবনেও কি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেনি? হয়তো সুমনের মতো নিয়মিত ঘটছে না, কিন্তু ঘটেছে তো! রানার গল্প পরে, সুমনের ব্যাপারটাই একটু ভেবে দেখা যাক। ঘটনাটি যখন প্রথম ঘটেছিল, সুমন ভীষণ অবাক হয়েছিল। হ্যাঁ, অবাক। দুঃখ পায়নি, কষ্ট পায়নি, ভয়ও পায়নি, স্রেফ অবাক হয়েছিল। তার ধারণা ছিল, যাদের চেহারায় একটু গ্রাম্যভাব থাকে, বা ক্যাবলাকান্ত-বোকাসোকা ভাব থাকে, বা যাদের চেহারায় ‘মফিজ’ভাব প্রবল, মানে দেখেই মনে হয়-- এইমাত্র ঢাকা শহরে পদার্পন ঘটলো জনাবের, তাদেরকেই টার্গেট করা হয় ছিনতাই করার জন্য। সে এই শহরে নবাগত নয়, বরং উল্টোটাই, প্রায় সারাজীবনই কাটলো এখানে। সেই কৈশোরকালে বাবা-মার সঙ্গে সে চলে এসেছিল এই শহরে, আর ফেরা হয়নি। সত্যি বলতে কি, ফেরার কোনো উপায়ই ছিল না। সেই রংবাজ জেনারেলের আমলে পাশের দেশে বাবরী মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে এদেশের নানা জায়গায় যেসব সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছিল, তখন তাদের গ্রামের বাড়িটিও আক্রান্ত হয়। আর এই ধরনের হামলায় যা যা ঘটার সম্ভাবনা থাকে, সবই ঘটেছিল। বাড়িতে তখন কাকারা থাকতেন। বাড়ির লোকজনকে মারধর, সোমত্ত মেয়েদের শ্লীলতাহানি, লুটপাট আর সবশেষে ঘরে আগুন! এই ঘটনার পর কাকারা অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিলেন-- এই দেশে আর নয়। ঢাকায় এসে তারা সুমনের বাবাকে সব ঘটনা জানালেন, সিদ্ধান্তের কথাও জানালেন, বাবাকেও তাদের সঙ্গে যেতে বললেন। তাঁর পক্ষে এত সহজে এরকম একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না। সরকারি চাকরি করতেন তিনি, সব ছেড়ে এরকম আকস্মিকভাবে চলে গেলে অবসর পরবর্তী সুবিধাদি আদায় করা সম্ভব হবে না। আর তাছাড়া, অন্য দেশে গিয়ে করবেনই-বা কী? এই বয়সে কি নতুন করে জীবন শুরু করা যায়? সবকিছুরই একটা বয়স থাকে। এই বয়সটা কোথাও যাওয়ার নয়, বরং স্থির হয়ে নিজের ঘরে বসার। তারচেয়ে বড়ো কথা, কেন যাবেন ওদেশে? ওটা কি তাঁর দেশ? কাকাদের এইসব কথা বলেছিলেন তিনি, কিন্তু কানে নিলেন না তারা, তাদেরও একটাই কথা-- ‘আমাদের জায়গায় আপনি থাকলে বুঝতেন দাদা! শহরে আছেন বলে বেঁচে গেছেন, সোমা মামনির কোনো বিপদ হয়নি, আমার মেয়েটা যে...’-- বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন কাকা। ভাঙা গলায়ই বলতে লাগলেন-- ‘ওটা আমাদের দেশ নয়, কিন্তু এটা কি আমাদের দেশ? হলে এরকম ঘটনা ঘটলো কীভাবে? দূরের কোনো দেশে যাওয়ার উপায় থাকলে তাই যেতাম, উপায় নাই বলে পাশের দেশে যাচ্ছি, ওখানে গিয়ে অন্তত বাঁচতে তো পারবো!’ বাবার আর বলার কিছু রইলো না। কাকারা নিজেদের সম্পত্তি বিক্রি করে পাড়ি জমালেন, বাবা জমিজমার ভাগ চাইলেন না, তবে বাড়িটা বিক্রি করতে নিষেধ করলেন। বললেন, অন্তত বাবা-ঠাকুরদার স্মৃতিটুকু থাকুক। কিন্তু ওটুকুও ধরে রাখা যায়নি। বাড়িটার দিকে নজর ছিল অনেকেরই, কাকারা চলে গেলে শূন্য বাড়িটা দেখে রাখার মতো আর কেউ রইলো না। বাবা তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাইকে কেয়াটেকার হিসেবে রাখলেন, মাঝে মাঝে নিজেও চলে যেতেন, তারপর বিষণœ হয়ে ফিরে আসতেন, মাকে বলতেন-- ‘বাড়িটা বোধ হয় আর রাখা যাবে না। সুবলকে খুব চাপ দিচ্ছে ওরা।’ ওরা কারা? ততদিনে রংবাজ জেনারেলের যুগ শেষ হয়ে গণতান্ত্রিক যুগ শুরু হয়েছে। একদা জেনারেলের প্রিয় মানুষ ওই এলাকার প্রভাবশালী দুই ভাই যোগ দিয়েছে দুই বড়ো গণতান্ত্রিক দলে, তারাই এখন বাড়িটা দখলের জোর চেষ্টা করে চলেছে। বাবা যাবেন কোথায়, কার কাছে? যতদিন চাকরি ছিল ততদিন তবু চেষ্টা-চরিত্র করে বাড়িটা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। অবসর নেয়ার সাথে সাথেই সেই প্রভাবটুকুও হারিয়ে গেল আর বাড়িটা দখল হয়ে গেল। বাবা সইতে পারলেন না, হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সুমন তখন ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষে। খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল সেটি। কেবল টিউশনির টাকার ওপর ভরসা করে সংসারের ভার নেয়া কঠিন, অর্থ সমাগমের অন্য কোনো উপায়ও নেই, বাবার অবসরকালীন টাকাপয়সা খরচ হতে লাগলো দেদারসে। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পরই পথে বসতে হবে, অথচ এখনো কত কাজ বাকি! সোমার বিয়ে দিতে হবে; মা’র বয়স হয়েছে, প্রায়ই অসুস্থ থাকেন, চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গেছে; বাসা ভাড়া, সংসার খরচ; ওদিকে সুমনা অপেক্ষা করছে অধীরভাবে। সব মিলিয়ে দুর্বিসহ অবস্থা। বাবা নেই, কাকারা সব ওদেশে। সে এতসব দায়িত্ব পালন করে কীভাবে? পড়াশোনা শেষ করার পর সরকারি ব্যাংকে একটা চাকরি হয়ে গেল তার, কয়েক বছর ঢাকার বাইরে পোস্টিং হওয়ার ফলে সে কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল। মফস্বলে বা গ্রামে অন্তত বাসা ভাড়ার জন্য এত টাকা খরচ করতে হয় না! কিন্তু অসুবিধা হচ্ছিল অন্য দিক দিয়ে। যেখানেই পোস্টিং হোক, একা তো আর যাওয়া যায় না, মা আর বোনকেও নিয়ে যেতে হয়। তাতে সোমার পড়াশোনার ক্ষতি হয়, মা’র চিকিৎসাও ঠিকমতো হয় না। অথচ এই দুজনকে যে ঢাকায় রেখে যাবে তারও উপায় নেই। শুধু দ্বিগুণ খরচের ব্যাপার নয়, রেখে যাবে কার কাছে? বিপদ কমানোর জন্য বাধ্য হয়ে সোমার পড়াশোনা শেষ হবার আগেই বাবার জমানো টাকার প্রায় পুরোটা খরচ করে ওর বিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে পেরেছে সে। কয়েক বছর পর আবার ঢাকায় পোস্টিং পেলো সুমন। পুরো সময়টা সুমনা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে, এবার আর তাই সময় না নিয়ে বিয়েটা সেরে ফেললো সে, আর তার পরপরই মা-ও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ততদিনে বোনটা বরের সঙ্গে কানাডায় গিয়ে সেটেলড করেছে। সেই অর্থে শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছাড়া দেশে আর কোনো স্বজনই রইলো না সুমনের। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগতো-- দু-চারটে সুখ-দুঃখের কথা বলার মতো বা কারো কাছে বসে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করার মতো কোনো মানুষ নেই তার। সুমনা যতই আন্তরিক হোক না কেন, যেসব স্মৃতিতে তার অংশদারিত্ব নেই সেগুলো অংশগ্রহণ করাও ওর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তবু আত্মীয়-স্বজনের মতো সে দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেও পারলো না। এই দেশ ছেড়ে সে কোথায় যাবে? সব স্মৃতি যে এখানেই জমা হয়ে আছে!

দখলদারদের কবল থেকে বাড়িটা উদ্ধার করা যায় কী না, এ নিয়ে অনেকবার ভেবেছে সুমন। করতে পারলে একটা ঠিকানা থাকতে পারতো। পৈত্রিক ভিটেবাড়ি থাকা সত্ত্বেও উদ্বাস্তু হয়ে আছে সে, ভেসে বেড়াচ্ছে যাযাবরের মতো, ভাবতেও খারাপ লাগে। একবার বাড়িটা দেখার জন্য গিয়েছিল সুমন। দখলদাররা তাকে বেশ খাতিরযতœ করেছে, নকল দলিল দেখিয়ে বলেছে-- ‘তোমার বাবাকে কত করে বললাম, বাড়িটা বেচবেন না, ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনিদের একটা ঠিকানা তো লাগে। উনি শুনলেন না! তোমার কাকাদেরও বলেছিলাম, আমরা তো আছি আপনাদের পাশে, অন্য দেশে কেন যাবেন? তারাও শুনলেন না! কেন যে তোমরা ইন্ডিয়ায় যাও, বুঝি না বাবা।’

ডাহা মিথ্যে কথা। বাবা বাড়ি বিক্রি করেননি এবং এরাই কাকাদের ওপর হামলা করেছিল। এমন তো নয় যে, সে ছোট ছিল, ঘটনা-পরম্পরা জানে না, ওরা যা বলবে তাই বিশ্বাস করতে হবে! সে কেবল মৃদু কণ্ঠে বলেছিল-- আমি যতদূর জানি, বাবা এ বাড়ি বিক্রি করেননি।

তার মানে বলতে চাও, এই দলিল জাল?

না মানে...

মানে কী, বলো? -- ক্ষেপে উঠলেন দখলদার সাহেব।

একা একা শত্রুশিবিরে এসে বীরত্ব দেখাবার মানে হয় না। সুমন তাই নীরব হয়ে রইলো।

বললা না, তোমার কথার মানে কি? এই দলিল জাল? এই বাড়ি আমরা দখল করেছি? বলো? -- হুংকার দিয়ে উঠলেন তিনি। সুমন আর কিছু বললো না। তিনি রেগেই রইলেন, বলতে লাগলেন-- ‘বাড়ির পুরনো মালিকের ছেলে তুমি, তোমার বাবা কত ভালোমানুষ ছিলেন, কত স্নেহ করতে আমাকে! তোমাকে দেখে খুশি হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম দু-চারটা সুখদুঃখের কথা বলবো, দু-চারদিন এ বাড়িতে থাকতে বলবো। আর তুমি কী না এসেছ বাড়ি দখলের অভিযোগ নিয়ে! কত বড়ো সাহস তোমার! সাধে কি আর তোমাদের এই দশা? সাধে কি আর নিজের দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়ায় যাও!’

সে আর কিছু না বলে উঠে এসেছিল এবং ঢাকায় ফেরার জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে একদল লোক তাকে ঘিরে ধরেছিল, বলেছিল-- একবার আসছেন, কিছু বলি নাই। দ্বিতীয়বার যদি এই এলাকায় আপনাকে দেখি, ফিরে যেতে পারবেন না!

ঢাকায় ফিরে রানার কাছে ব্যাপারটা খুলে বলেছিল সুমন। রানার নানারকম কানেকশন আছে, প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, তবু সে কোনো উপায় বের করতে পারলো না। দখলদার দুই ভাই বড়ো দুই দলের প্রভাবশালী নেতা। যদি যে-কোনো এক দলের হতো তাহলে অন্যদলকে ব্যবহার করা যেত। এখন আর সে সুযোগ নেই। কেউই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না।

ঠিকানাবিহীন-ভাসমান জীবনের বাস্তবতা মেনে নিয়েছে সুমন। কিন্তু কেবল বেতনের টাকা দিয়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া এবং সংসার চালানো কঠিন। সে তাই চাকরির পাশাপাশি টিউশনিও করতে লাগলো। ফলে অফিস শেষ করে টিউশনি সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হতো। আর তেমনই এক রাতে বাসায় ফেরার জন্য বাংলা মোটরে বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিল সে, বাস আসতে দেরি হচ্ছিল আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি দেখে সে তাড়াহুড়া করে টেম্পুতে উঠে বসেছিল। তখনও শহর থেকে ওই বাহনটি নিষিদ্ধ হয়নি। সে জানতো না-- টেম্পুতে যারা বসে আছে তারা কেউ সহযাত্রী নয়, ছিনতাইকারীর দল। প্রথমবারের মতো ছিনতাইয়ের শিকার হলো সে। দুজন দুপাশ থেকে চেপে ধরলো তাকে, সামনের দুজনের একজন বের করলো ছুরি, আরেকজন বের করলো বিকটদর্শন পিস্তল। খেলনা পিস্তল হতে পারে-- এরকম সম্ভাবনা মনে এলেও সুমন ঝামেলা করার চেষ্টা করলো না। সব মিলিয়ে ওরা ছ-জন, পিস্তল বা ছুরি ব্যবহার না করলেও যদি সবাই মারধোর শুরু করে, তার অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে। জনবহুল রাস্তায় টেম্পু চলছে। চলন্ত টেম্পুর ভেতরে কী হচ্ছে বাইরের লোকের তা বোঝার উপায় নেই, উপায় থাকলেও কেউ এগিয়ে আসবে না, এ তো জানা কথাই। সে বিনা বাক্যব্যয়ে সব কিছু তুলে দিলো ওদের হাতে। মানিব্যাগ, বিয়ের সময় পাওয়া অতি সাধের ঘড়ি, আঙটি-- সব। সে অবাক হয়েছিল। এই শহর তার অপরিচিত নয়। যে জায়গাটিতে সে ছিনতাইয়ের শিকার হলো সেখানেও সে প্রচুর আড্ডা দিয়েছে। বলতে গেলে এই শহর তার কাছে হাতের তালুর মতো চেনা। রাত-বিরাতে চলাচল এই প্রথম নয়, সে বরাবরই রাতের পথিক। ছাত্রজীবনে রাতের বেলাতেই বেশি ঘুরতো পথেঘাটে। কোনোদিন কোনো বিপদ হয়নি। সে তাই ভীষণ অবাক হয়েছিল ঘটনাটিতে। তাহলে কি এই শহর তার অচেনা হয়ে গেল?

এরপর আরো বহুবার একইরকম ঘটনা ঘটেছে। একবার বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে আসতেই খামোখা এক লোক গায়ের ওপর এসে পড়লো। সে কিছু বলার আগেই লোকটা স্যরি স্যরি বলতে লাগলো। একজন মানুষ স্যরি বলার পর তো আর কিছু বলা যায় না তাকে, সে মৃদু হেসে ‘না, ঠিক আছে’ বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। কারণ লোকটা ততক্ষণে তার হাত ধরে ফেলেছে।

ভাই ব্যথা পাননি তো!

না পাইনি।

মনে হয় পেয়েছেন।

আরে না, এতটুকুতে ব্যথা পাবো কেন?

আমি সত্যিই খুব স্যরি। ইচ্ছে করে ধাক্কা দেই নাই।

আরে ভাই, বললাম তো ঠিক আছে।

ভাই থাকেন কোথায়?

এই তো এখানেই।

কী করেন?

চাকরি।

বাহ বাহ, ভালো। মিলন ভাইকে চেনেন?

কোন মিলন?

হাতুড়ি মিলন!

হাতুড়ি মিলন আবার মানুষের নাম হয় নাকি?

নাম না, উপাধি। কেউ বাড়াবাড়ি করলে উনি তার মাথা হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে ফাটিয়ে দেন তো, তাই।

না, এই ধরনের লোকজনের সাথে আমার পরিচয় নাই।

না থাকারই কথা। তবে হয়ে যাবে!

মানে? তার সাথে আমার পরিচয়ের দরকার কী?

দরকার আছে। আমি তার লোক। ঝামেলা না করে যা আছে সব বের করে দেন।

সুমন এতক্ষণে বুঝতে পারলো, কোন চক্করে পড়েছে! আশেপাশে আরো কয়েকজনকে দেখতে পেলো সে। নানা আওয়াজ দিতে লাগলো তারা-- ওস্তাদ ঝামেলা করতেছে নাকি? এত গপ্প মারেন ক্যান? দিমু নাকি ভূড়ি ফাসায়া? ইত্যাদি। সে বুঝলো-- এবারও রেহাই নেই। যা ছিল সব গেল।

আরেকবার সে রিকশায় করে যাচ্ছিল সেগুনবাগিচার মৎসভবনের সামনে দিয়ে। পাশের রিকশায় দুটো লোক, একজন ডেকে বললো-- ভাইরে চেনা চেনা লাগে।

সে চেনেনি, তবু মৃদু হাসি দেয়।

ভাই কি শাহবাগ যাইতেছেন?

হ্যাঁ।

পিজির মোড়ে আড্ডা দেন, তাই না? আপনেরে দেখছি মনে হয়।

পিজির মোড়ে সে আড্ডা দেয় বটে মাঝে মাঝে। বন্ধুরা ওদিকে এলে, সময় মিলে গেলে আড্ডা জমেও ওঠে। সেখানে নতুন অনেক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়, সবার কথা পরে মনেও থাকে না, সেরকমই কেউ হবে হয়তো ভেবে সে বললো-- হ্যাঁ, ওখানেই যাচ্ছি।

ভাইয়ের নামটা যেন কী?

সুমন।

হ, সুমন ভাই। চিনছি আপনেরে। কাশেম ভাইরে চেনেন?

বাক্যটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাডুড়ি মিলনের কথা মনে পড়ে গেল তার, মনের ভেতর কুডাক ডাকলো, সে তাই রিকশাওয়ালাকে বললো-- ‘এই টান দাও তো!’ আর তখনই পাশের রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে সুমনের রিকশার গতিরোধ করে দাঁড়ালো লোকটা। ওই রিকশাটা সঙ্গীসমেত চলে গেল সামনের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ থেকে গোটা পাঁচেক ছেলে এসে ঘিরে ধরলো সুমনকে। একজন তার রিকশায় উঠে বসলো। আর লোকটা তার হাত ধরে নিজের কোমরে গুঁজে রাখা অজানা বস্তুটাতে ঠেকিয়ে বললো-- আমি চাইলাম আলাপ করতে, আপনি দেখি যান গা! কাহিনী কী? কাশেম ভাইরে চিনেন না?

কোন ক্যাশেম?

ড্যাগার কাশেম!

না, চিনি না। রিকশা আটকেছেন কেন? ছিনতাই করবেন?

ছি ছি ভাই, ছিনতাই করুম ক্যান?

তাহলে রিকশা আটকালেন কেন?

আলাপ করতে...

আপনার সাথে তো আমার কোনো আলাপ নাই! কী চান?

বুঝেনই তো স্যার! এই এত্তগুলা পোলাপানের খরচ চালাইতে হয়। কিছু ট্যাকা দরকার।

আমার কাছে টাকা নাই।

সত্যি নাই?

না, নাই।

কিছু না কিছু তো আছে! সব তো আর দিয়া যাইতে কইতেছি না! এই যে আপনের মোবাইল, আপনের ঘড়ি এইগুলি তো ছিনায়া নিতে পারি, নিতেছি না। কিছু ট্যাকাপয়সা দিয়া যান।

টাকা নাই তো!

যদি সার্চ করি?

কিছুই পাবেন না।

ঠিক আছে মানিব্যাগটা দেন।

সুমন আর কথা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ বের করে দিলো। ওটাতে বেশি টাকা ছিল না সেদিন। দু-তিনশর মতো হবে। ওরা সব নিলো না। রিকশা ভাড়াসহ মানিব্যাগটা ফেরতও দিলো!

বাহ, ভালোই তো! কত নতুন নতুন কৌশল! কিন্তু বিবিধ কৌশল দেখে মুগ্ধ হবার বদলে তার জীবন অতিষ্ট হয়ে গেল। সারাক্ষণ আতংক লাগে তার, মনে হয় এই বুঝি কেউ ধরলো তাকে!

এইভাবে চললো অনেকদিন। ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সুমনের জন্য নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো-- যেন সব খোয়ানোর জন্যই জন্ম হয়েছে তার! তারপর একসময় দেশের সবকিছুই বদলে যেতে শুরু করলো। রাজাকারদের বিচারের রায় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কিছুর মতো সুমনের ভোগান্তিরও ধরন পাল্টালো। একদিন রাতের বেলা বাসায় ফেরার পথে তাকে নাম ধরে ডাকলো কেউ। সে এগিয়ে যেতেই তারা তার ফেসবুকে লেখার প্রসঙ্গ ধরে জেরা শুরু করলো। সেদিনও খুব অবাক হয়েছিল সুমন। হ্যাঁ, ফেসবুকে সে লেখে বটে, রাজাকার আর তাদের দলের বিরুদ্ধে, তাদের বিচারের দাবিতে স্পষ্ট ভাষাতেই লেখে, কিন্তু সেটা আসল নামে নয়। সরকারি চাকরি করে সে, রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত দেয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে, সে তাই ছদ্মনামে একটা একাউন্ট খুলেছে। অথচ এই লোকগুলো তাকে আসল নামে ডেকে ওই ছদ্মনামে লেখা বিষয়গুলো নিয়েই জেরা করছে! এরা জানলো কীভাবে যে, এই দুজন একই ব্যক্তি? চেনা কেউ পরিচয় ফাঁস করেছে নাকি? সুমন অল্প কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পারলো, এরা কিছু শুনতে চায় না, কেবল তাকে শোনাতে চায়। তবু মরিয়া হয়ে তর্ক করতে লাগলো সে, আর তখনই শুরু হলো মার। ইচ্ছেমতো পেটালো তারা সুমনকে। আচমকা মার খেয়ে কাহিল হয়ে সে মুখ ফসকে বলে ফেললো-- একটু জল খাবো!

অ্যাঁ! জল খাবে! শালা দেখি মালাউন। এই এইটারে খতম কর।

না ওস্তাদ। এখনই দরকার নাই। এরপর থিকা না শুধরাইলে খতম কইরা দিমু।

খতমের হাত থেকে বেঁচে এসে সে ভাবলো-- এরা তাকে ‘মালাউন’ হিসেবে চিহ্নিত করলো কীভাবে? ফেসবুকে তার ছদ্মনাম, বাস্তবেও তার নামের সঙ্গে তো বংশ-উপাধি নেই। সার্টিফিকেটে তার নাম ‘সুমন আবীর’, এই নাম হিন্দু-মুসলমান যে-কারো হতে পারে। বাবা কেন যে তার নামের সঙ্গে বংশ-উপাধি দেননি, সে জানে না। সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে বহুকাল আগেই কি তাঁর মন কুডাক ডেকেছিল? কে জানে! নাম শুনে যেহেতু বোঝার উপায় নেই, তাহলে কি ওই ‘জল’ শব্দটার জন্যই ওরা তাকে মালাউন বলে চিহ্নিত করলো?

বাসায় ফিরে সে সুমনাকে বললো ঘটনাটা। তার চোখেমুখে ভয় ও শঙ্কা, মার খাওয়ার কষ্টের চেয়ে বেশি বিস্ময়। কীভাবে ওরা চিনলো তাকে? কে আছে এমন যে তার ছদ্মনাম আর আসল নাম দুটোই জানে? কীভাবেই বা ধর্ম পরিচয়টা বুঝে ফেললো? ওই ‘জল’ শব্দটা? নাহ, এই শব্দগুলো আর সচরাচর বাইরে বলা যাবে না। সে অবশ্য বাইরের জনজীবনের সঙ্গে অনেকখানিই মানিয়ে নিয়েছে বেশ আগে থেকেই। রেস্টুরেন্টে বসে ‘পানি’ই বলে সবসময়, ‘জল’ বলে না, গোসলকে স্নান বলে না, পিতামহর প্রসঙ্গ উঠলে ঠাকুরদা না বলে দাদা-ই বলে। কিন্তু ঘরের ভেতরে শব্দগুলো পাল্টানো যায়নি। সেজন্যই কি মার খেয়ে ওরকম অসহায় মুহূর্তে মায়ের বুলিটা বেরিয়ে পড়লো মুখ ফসকে? নাহ, অভ্যাসটা পাল্টাতে হবে। দিনকাল খুব খারাপ। এই ধরনের শব্দ ব্যবহার না করার জন্য সুমনাকেও বুঝিয়ে বললো সে। সুমনা খানকিক্ষণ তর্ক করলো-- কেন বলা যাবে না, মুখের ভাষাটাও ছেড়ে দেবো নাকি, ইত্যাদি, কিন্তু সুমনের জেদের কাছে হার মানলো। এই মাত্র মার খেয়ে এসেছে সে, তার জ্বালাটাও যে অনেক বেশি! কিন্তু সুমনাকে এত বুঝিয়ে সে নিজে এক ভুল করে বসলো-- ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মার খাওয়ার ঘটনাটা শেয়ার করলো বন্ধুদের সঙ্গে। প্রচুর সহানুভূতি পেলো, নিন্দার ঝড় বয়ে গেল, কিন্তু কারা এই কাজটি করেছে তাদের হদিস পাওয়া গেল না। কেউ সরকারকে দায়ী করলো, কেউ করলো বিরোধী দলকে, কেউ পুলিশকে, কেউ পত্রিকাকে, কেউ টকশোকে; কিন্তু ভুল করেও ওদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়ার দাবি করলো না কেউ। এই ফেসবুক-কান্ডের ফলাফল পাওয়া গেল পরেরদিনই। এবার আর তার নাম ধরে ডাকলো না কেউ, এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এলোপাথারি কিলঘুষি-চড়থাপ্পর-লাথিগুঁতো চললো অনেকক্ষণ ধরে। তারপর, সুমন একদম নেতিয়ে পড়ার পর, হুমকি দিয়ে গেল ওরা-- আরেকটা শব্দ যদি লেখস মালাউনের বাচ্চা, তুই তো মরবিই, তোর বউয়ের পেট বাজামু, তোর পোলার মুন্ডু কাইটা ফুটবল খেলুম, মনে রাখিস!

মার খেতে খেতে মাটিতে বসে পড়েছিল সুমন, বসেই রইলো অনেকক্ষণ। একসময় আশেপাশে চায়ের দোকানদার, সিগারেটওয়ালা, রিকশাওয়ালা, বাদামওয়ালারা এগিয়ে এসে তাকে হাত ধরে ওঠালো! নানা প্রশ্ন আর মন্তব্য শোনা গেল তাদের মুখে--

-- কী হইছিল ভাই?

-- এরম মাইর খাইলেন ক্যান?

-- ছিনতাই করতে আইলে ঠেকানো যায় না, যা আছিল দিয়া দিতেন!

-- ছিনতাই বইলা তো মনে অয় না! পুরান শত্র“তা নাকি?

-- রাজনীতি করেন নাকি ভাই?

এত প্রশ্নের মুখে চুপ করে থাকা যায় না, সে তাই মাত্র একটা বাক্য বললো-- আমি হিন্দু তো, তাই মেরে গেল!

এইবার আরেক প্রস্থ প্রশ্ন আর মন্তব্যের ঝড় বইলো--

-- হিন্দু হইছেন বইলা মারবো ক্যান? মগের মুল্লুক নাকি?

-- এইডা মগের মুল্লুকই। দ্যাখেন না কী ঘটতেছে সারা দ্যাশে?

-- আরে পুলিশগো মাইরা ফাটায়া ফেলতেছে, আর আমরা তো পাবলিক!

-- তাই বইলা এমনে মারবো? ভাই, আপনের লগে কারো শত্র“তা আছে?

-- কি নিয়া লাগছিল? জমিজমা দখল কইরা নিছে নাকি?

-- রাজনীতি নিয়া তর্ক করছিলেন?

আবারও মুখ খুলতে হলো-- নারে ভাই, কিছু করি নাই। খালি রাজাকারগো বিরুদ্ধে কয়েকটা কথা লিখছিলাম!

-- অ! এইবার বুঝছি। এইডা ওই খানকির পোলাগো কাম! জাউরার দল! নিজেরা পাকিস্তানরে নিজের দেশ বইলা ভাবে, আর তাগো বিরুদ্ধে লিখছেন বইলা আইসা পিটায়া যায়! শুয়োরের বাচ্চা!

আর কেউ কিছু বললো না। ওরাই সেবা-শুশ্র“ষা করে দাগ-ময়লা পরিষ্কার করে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। সুমনা দেখেই বুঝেছিল-- কিছু একটা হয়েছে, তবে এত বড় ঘটনা ঘটেছে সেটি বুঝতে পারেনি। ভেবেছে নিত্যনৈমত্তিক ছিনতাই! স্নান করার জন্য চাপাচাপি করে জল গরম করতে গেছে। সেটাই ভালো হয়েছে। মার খাওয়ার কথাটা সুমন গোপন করতে চায়। স্নান করে দাগটাগ ধুয়ে ফেললে ধরতে পারবে না সুমনা।

কিন্তু খাওয়া-দাওয়া শেষে শোবার আগে কিছু একটা সুমনার চোখে পড়ে, আঁতকে উঠে বলে-- তোমার ঘাড়ে এগুলো কিসের দাগ? দেখি, শার্টটা খোলো তো! মাগো! তোমার সারা গায়ে এত দাগ কেন? কী হয়েছিল? বলো আমাকে। অ্যাকসিডেন্ট? নাকি ডাকাতগুলোর সঙ্গে মারামারি করেছ? বলো আমাকে।

এত অস্থির হয়ো না। শুতে চলো, বলছি।

না, তুমি বসো। এরকম দাগ... মাগো! লোশন দিয়ে দিই! তুমি বলো।

গভীর মমতায় ক্ষতস্থানগুলোতে লোশন মেখে দেয় সুমনা, সুমনের চোখ নোনাজলে ভিজে যায়! মানুষ হয়তো এই মায়াটুকুর জন্য বেঁচে থাকে।

যথাসম্ভব রেখেঢেকে ঘটনাগুলো বলতে থাকে সুমন। তারপর ভাঙা গলায় বলে-- বাইরে যাওয়ার সময় সিঁদুর পরো না, সুমনা।

সুমনা কোনো কথা বলে না। সুমনই আবার বলে-- সবই তো গেছে! বাড়ি নেই ঘর নেই, আত্মীয় স্বজন নেই, এখন কেবল কোনোমতে টিকে আছি। জানো, সেদিন এক কবি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন-- ‘সংখ্যালঘুদের কোনো দেশ নাই, আছে দেশের জন্য আর্তনাদ!’ এত মনে লেগেছিল কথাটা! সব গেছে, তবু তো এটাই আমার দেশ। সেজন্যই তো মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চাইছি, তাও পারবো কী না জানি না। সিঁদুরটা পরো না সুমনা। ওরা বুঝে ফেলবে, কোনো একটা ক্ষতি করে ফেলবে। না পরলে কী হয় বলো! জীবনের চেয়ে সিঁদুর বড়ো বলো? সময়টা যে বড়ো খারাপ। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কী নিয়ে বাঁচবো? আমার যে কিছুই নেই!

সুমনের পিঠে মুখ ঠেকিয়ে সুমনা অঝোরে কাঁদে। বলে-- চলো, আমরা কোথাও চলে যাই।

কোথায় যাবো?

অন্য কোনো দেশে যাই।

কিন্তু ওগুলো তো আমাদের দেশ নয়। যত যা-ই ঘটুক না কেন, এটাই আমাদের দেশ। অন্য কোথাও আমাদের কিছু নেই। আর তাছাড়া, ইন্ডিয়া যেতে আমার ভালো লাগে না। সবাই এত খারাপভাবে দ্যাখে ব্যাপারটা! দেশ ছেড়ে সবাই ইন্ডিয়ায় যায় বলেই মানুষ মনে করে-- আমরা এই দেশের চেয়ে ইন্ডিয়াকে বেশি ভালোবাসি।

ইন্ডিয়া যেতে হবে কেন? অন্য কোনো দেশে চলো। কত মানুষ কানাডা-আমেরিকা-ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। আমরাও চলে যাই!

বললেই কি আর ওসব দেশে যাওয়া যায়? এত সহজ হলে তো কেউ ইন্ডিয়া যেত না। এ দেশে যখন আর কোনোভাবেই টিকতে পারে না তখন সহজ বিকল্প হিসাবে ইন্ডিয়ায় যায়। আমি কোথাও যেতে চাই না সুমনা। যা হবার হোক, আমি এই দেশেই থাকবো। তুমি শুধু একটু সাবধানে থেকো। সিঁদুর পরো না, ওই শব্দগুলো বাইরে সচরাচর বলো না...

সিঁদুর পরা যাবে না, নিজের ভাষায় কথা বলা যাবে না, এটাকে বাঁচা বলে? -- সুমনা আবারও কেঁদে ফেলে। সুমন গভীর মমতায় জড়িয়ে রাখে বউকে, ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে! কী নিষ্পাপ একটা মুখ, অথচ না জানি কী বিভীষিকা অপেক্ষা করছে ওর ভবিষ্যতে!

এইসব নানা ঝামেলায় অনেকদিন রানার কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি। রানু কনসিভ করেছে আবার, খবরটা কয়েকমাস আগেই পেয়েছে, দেখতে যাওয়া হয়নি। রানাও বোধ হয় আসার সময় পাচ্ছে না। ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয় বটে, তাতে আড্ডার আমেজটা আর আসে না। তাই, এক ছুটির দিন সকালে ওকে ফোন করে বাসায় আসতে বললো সুমন। রানার গলায় ক্লান্তি, বললো-- ‘যেতে পারবো নারে দোস্ত। রানুর শরীরটা ভালো নেই। বউ-বাচ্চা নিয়ে তুই চলে আয়।’ হ্যাঁ, সেটাই ভালো। এই শরীরে ছোটাছুটি করা রানুর জন্য ঠিক হবে না। বরং ওদের বাসায় গেলে রানু-সুমনা সারাদিন মন খুলে কথা বলতে পারবে, সুমন-রানাও। দুজনের দুই ছেলেও সারাদিন খেলেটেলে আনন্দে থাকবে। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখা গেল রানু বেশ খারাপ রকমের অসুস্থ, রানার মনও খুব খারাপ।

এত শরীর খারাপ হলো কীভাবে? ডাক্তারের কাছে যাসনি? -- সুমন জিজ্ঞেস করলো।

আরে ডাক্তারের কাছে যেতে গিয়েই তো এই দুর্দশা।

মানে?

এমনিতে তো ওর বাইরে যাওয়া হয় না, কালকে ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। হরতাল ছিল বলে গাড়ি বের করতে পারিনি, রিকশায় যাচ্ছিলাম। কাওরানবাজার মোড়ে দেখলাম কতগুলো লোক লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা ওদের কাছে যেতে না যেতেই এক লোক রানুর মাথায় জোরে বাড়ি বসিয়ে দিয়ে বললো-- মাথায় ঘোমটা দেস না ক্যান মাগী? মুসলমানের দেশে হিন্দুয়ানি চলবো না!

তারপর? তুই কিছু বললি না?

আমি কী বলবো? একা থাকলেও না হয় কথা ছিল। রানুর শরীরের এই অবস্থা, ওদের সাথে ঝগড়া করে বিপদ বাড়াবো নাকি?

তাই বলে কিছুই বলবি না!

আমার জায়গায় তুই থাকলে বুঝতি!

এসব কী হচ্ছে দেশে, বলতো?

আমিও তো বুঝতে পারছি না, কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?

নীরবতা নেমে এলো দুজনের মধ্যে। আড্ডা আর জমলো না। দুপুরে খেতে বসে সুমনার দিকে চোখ পড়লো রানার। অবাক গলায় বললো--

তোমার সিঁদুর কোথায় সুমনা?

সিঁদুর পরা বাদ দিয়েছি সেই কবে!

কেন? বাদ দিয়েছ কেন?

ও নিষেধ করেছে।

সুমনের দিকে রাগি চোখে তাকালো রানা-- নিষেধ করেছিস কেন?

সবই তো জানিস...

তাই বলে ও সিঁদুর পরবে না! এটা কোনো কথা হলো?

আমার জায়গায় তুই থাকলে বুঝতি দোস্ত...

আবার নীরবতা নেমে এলো।

বাসায় ফিরে সুমন সুমনাকে ডেকে বললো-- সিঁদুর পরো বউ, দেখি তোমাকে!

সিুঁদর! কতদিন আগেই তো ছেড়ে দিয়েছি। তুমিই তো পরতে না করেছ!

হ্যাঁ আমি নিষেধ করেছিলাম, আমিই সেটা উইথড্র করে নিলাম।

কেন? হঠাৎ কী হলো?


রানার কথা শুনলে না? মুসলমান হয়েও যদি রানুর মতো একটা গর্ভবর্তী মেয়েকে ঘোমটা না দেয়ার অপরাধে মাথায় বাড়ি খেতে হয়, তাহলে তুমি আর সিঁদুর না পরেই বা কী লাভ হবে? যা হবার হোক। কতটুকুই বা হারানোর আছে আমাদের, বলো? মরতে তো একদিন হবেই, যতদিন বাঁচি নিজের পরিচয় নিয়েই বাঁচি। যাও সিঁদুর পরে এসো, সিঁদুর পরলে তোমাকে ভারি সুন্দর লাগে। কতদিন পরোনি! যাও পরে এসো, চোখভরে মনভরে দেখি তোমাকে...

 

লেখক পরিচিতি
আহমাদ মোস্তফা কামাল
গল্পকার, ঔপন্যাসিক
জন্ম ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৬৯
মানিকগঞ্জ, ঢাকা, বাংলাদেশ।

প্রকাশিত বই
অন্ধ জাদুকর (এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কারপ্রাপ্ত)
ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য (প্রথম আলো বর্ষসেরা বই)
বর্ষামঞ্জরি
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে
অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে
আগন্তুক
একলা থাকার গল্প
হিরন্ময় কতকথা :মাহমুদুল হকের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার
কান্নাপর্ব
পরম্পরা
শিল্পের শক্তি, শিল্পীর দায়
সংশয়ীদের ঈশ্বর বাংলাদেশের ছোট গল্প (দ্বিতীয় খণ্ড)
ছোটগল্পে ছোটরা : কিশোরতোষ রবীন্দ্র-গল্প নিয়ে আলোচনাগ্রন্থ
শ্রেষ্ঠ গল্প : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
ভোর ও সন্ধ্যারা নামছে বেদনায়
আমরা একটি গল্পের জন্য অপেক্ষা করছি
প্রেম ও অপ্রেমের গল্প
অশ্রু ও রক্তপাতের গল্প
দ্বিতীয় মানুষ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ