সারা শরীরময় থলথলে মাংস ঝুলে আছে । কলার থোড়ের মতো অসংখ্য ভাঁজে ভাঁজে সজ্জিত গাঁয়ের চামড়ার বিন্যাস । রোমগুলো বয়সের পাকা রং ধরে সাদা সাদা । চুল, চোয়ালের উপর এক গাছি জুলফি, জল্লাদি দু-মাথা মোড়ানো গোঁফ ঝরঝরে সাদা রঙের পাঁটের আঁশের মতো লাগে দেখতে । মোটা ভ্রূ থেকে শুরু করে নাসিকা, বগল, বুক যতদূর আয়াত আলিকে একজন পর্যবেক্ষক সামনা সামনি উদোম শরীরে দেখতে পায়, ততটুকুতেই তাকে কেবল শ্বেতচুলা মানব লাগবে । তার লুঙ্গিতে গিট দেয়া থাকে নাভির নিচে একেবারে ঝুলে থাকা পেটখানার ঝুলন্ত ভাঁজ ভেঙ্গে আরও অবনত হয়ে এলে, তাতে নাভি থেকে সরলরৈখিক হয়ে লুঙ্গীর গিটের তলার দিকে নিন্মগামি পথ ধরে যাওয়া আরও কিছু সাদার সন্ধান মিলে যায় । বেশ দীর্ঘ প্রশস্ত দেহ আয়াত আলিকে কিছুটা বাকিয়ে দিয়েছে বাঁশের কঞ্চির মতো করে ।
এই সত্তর ধরা জীবনে আয়াত আলির এক কফ-কাশি ছাড়া অন্য রোগবালাই খুব একটা জোস করে উঠতে পারেনি বলা যায় । তবে চোখে ছানি পড়েছে ইদানীং । বেশ শক্ত-পোক্ত পেটানো শরীরটা এখনো । মাঝরাতে যখন শুরু হয় গলার ভেতর জমে থাকা একগাদা কফের খুসখুসানি তখন অবিরত কাশির লাগাম ধরে টানে আয়াত আলি, গলায় গরগর শব্দ করে নিচে নামাতে অথবা উপরে উঠাতে চায় নালিকার প্রাচীর দখলকারী বর্জ্যগুলো । তার যৌবনবতী বউ মিনু তখন আচমকা সকম্পিত জেগে উঠে । তার অতল ঘুম ভাঙানির জন্য ত্যক্ত হয়ে একটু যেন কেউ কেউ করে উঠতে চায় । তারপর যখন পুরো উদ্দিস ফিরে আসে তার, দেহের ঘুমজড়তা মুক্তি পায়, তখন হুড়মুড় করে জেগে উঠে বসে আয়াত আলির পাশে । তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় । আয়াত আলির চেহারাটার দিকে তাকালে একবার হয়ত মনের ভেতরে কি একটা কথা ভেবে খারাপ লাগাটা উথলে উঠে বদহজমি বমির মতো করে । আয়াত আলির কাশির সাথে কফ চলে এলে এদিক সেদিক আকুপাকু করে কিছু একটা খুঁজতে গেলে মিনু টের পায় তার আবশ্যকতাকে । তখন উঠে গিয়ে পিতলের ঘটিটা এগিয়ে দেয় সে । আয়াত আলি থক করে একদলা কফ ফেলে দেয় ঘটিতে । তারপর কিছুক্ষণ বসে বসে ঝিমায় আয়াত আলি, মিনু তখন কিছু একটা ভাবতে থাকে । ভাবতেই থাকে ।
মিনুর দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী আয়াত আলি । চৌদ্দ কি পনেরোর বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে মিনুর প্রথম বিয়ে হয়েছিল পরগ্রামের আতরজমার সাথে ।
আতরজমা ছিল জাত গাছি । শীতকালীন শিউলি । পৌষ মাঘ মাসে যখন সাদা কুয়াশার কণিকাগুলোকে মনে হত শীতের রোয়া, তখন মিঠাই-রোয়া নির্ভর রুটিরূজির সন্ধানে গ্রামের সম্বলওয়ালাদের কাছ থেকে খেজুর গাছ লগ্নি নিত আতরজমা । প্রতিটি গাছের জন্যে এক খন্দে দুই সের করে মিঠাই দিতে হবে এই শর্ত রেখে তার লগ্নি ।
প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই ঘনীভূত কুয়াশার ঘের কেটে কেটে আতরজমা নেমে পড়ত কাজে । গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়ে সংগ্রহ করত কাঁধ ভাঙা পেটমোটা বড় কলসিতে । এরপর রসভর্তি দুটি কলসি একটি শক্ত বাঁশের দুই মাথায় বেঁধে মাঝ বরাবর কাঁথে তুলে বাড়ি বয়ে বেড়াত আতরজমা । এই রস তাওয়ায় ঢেলে আগুনে উত্তপ্ত করলে মিঠাই তৈরি হয় । আবার দুপুরের পর থেকে আতরজমা তার বাঁশে বোনা ঠুলিটির মধ্যে গাছ কাঁটার সরঞ্জামাদি নিয়ে পিঠের সাথে বেঁধে ঠুক ঠুক ঠুক শব্দে কাঠ ঠোকরা পাখির মতো করে খুঁড়ে চলত খেজুর গাছের রসালো শরীর, হাড়ি বসিয়ে আসতো একে একে প্রতিটি গাছে । শীতকালীন পুরোটা সময়ে মিঠাইয়ের খুব চাহিদা বলে ওদের সংসার চলত দিব্যি ।
এই তো গেল শীত কাল । গরমকালে আতরজমার কাজ ভিন্ন । তখন গেরস্তদের নারিকেল গাছ ছোলানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় দরকার পড়ত তার । এই এলাকায় গাছ ছুলুনি বলতে শুধু আতরজমাই । খুব চাহিদা তার । ফলন্ত নারিকেল গাছের ফলন বাড়ানোর জন্য আতরজমাকে দিয়ে গাছের মাথায় শুকনা ও রোগাটে ডগা, ছোবা, গাছের ডগায় জমানো ইঁদুর, পিঁপড়া অথবা অন্য কোন উপদ্রপের বাসা কেটেছেটে সাফসুতরো করানো হত । বিনিময়ে প্রতিটি গাছের জন্য সে তিন টাকা হারে পারিশ্রমিক পেত ।
শেষ পর্যন্ত এই নারিকেল গাছই হল আতরজমার কাল । একদিন গাছ থেকে পড়েই প্রাণবায়ু হারায় আতরজমা । আর মিনু হয়ে যায় বিধবা । আঁটকুড়া জামাই আতরজমার সাথে প্রায় বছর দুই ঘরসংসার করে কোন ছেলেপুলে বিয়োতে হয়নি মিনুকে ।
এদিকে আয়াত আলির অবস্থা ও প্রেক্ষাপট ছিল অন্যরকম । তার প্রাপ্তবয়সী দুই ছেলে বউবেটি নিয়ে শহরে থাকে । কাজকর্ম করে খায় ঐখানে । দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন অবস্থা তাদের । গ্রামকে নিয়ে নাক ছিটকানো বাতিক অঙ্কে অঙ্কে । কারেন্টের বাত্তি ছাড়া মানুষ থাহে ক্যামনে? গাড়িঘোড়া না হইলে মানুষ চলে ক্যামনে? টেলিবিশন না হইলে তো আর অয় না কুনোমতে!---- এইসব আর কি ।
এখন আর বৃদ্ধ আয়াত আলির মরা বাঁচারও কোন খোঁজ খবর রাখার প্রয়োজন মনে করে না তারা। মেয়েটি বছরান্তে একবার এসে আয়াত আলির শরীর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে জেনে যায় তার রেখে যাওয়া বিঘা কয় জমি হাত করতে সম্ভাব্য আর কতদিন লাগতে পারে । বারবার হতাশ হয়ে ফিরেও যায় আবার ।
জটায়ুর মত বেঁচে থাকা আয়াত আলির সম্পর্কে মেয়ের জামাই বলে, হালা বুইড়া ভোম! মরে না ক্যান অ্যাহ্যনো!
আয়াত আলির মেয়ে জমিলা তখন একটু প্রতিবাদ করে তার সোয়ামীকে ধমকের সুরে বলে, আরে ধুর!! কি যে কউ না তুমি?
পাঁচ-ছয় বছর আগে প্রথম পক্ষের বউ গত হয়ে গেলে দুনিয়াব্যপি আন্ধার হয়ে যায় আয়াত আলির। কি রাত কি দিন । দিনের বেলাও আয়াত আলির ঘরের আন্ধার কাটে না বলে কুপি জ্বালিয়ে রেখে তেল পুড়ত সে । ঘরের আনাচে কানাচে বিভীষিকার পোকামাকড় দেখত । কুপির মোটা সলতে পুড়েও আন্ধার কাটে না তার চোখ থেকে, মন থেকে । এক ফোঁটা ঘুম নেই । আয়াত আলি কি জীবিত না মৃত ঠাওর করে উঠতে কষ্ট হত । ভয় পেত পদে পদে ।
তারপর একদিন তন্দ্রাচ্ছন্নের মাঝে আয়াত আলি ঘরময় এক অপার্থিব আলোর সন্ধান পায় । চলন্ত আলো, জ্বলন্ত আলো । আলোর একখানা মুখ আছে, হাত আছে, পা আছে, ভরাট নিটোল বুক আছে, শরীরজুড়ে জোয়ার আছে । মুখে খই ফোঁটা শব্দ আছে, চোখে অতলান্তিক জল আছে । আলোর মধ্যে জীবন আছে, আজন্মের সাধ আছে । আয়াত আলি এসব দেখে জেগে উঠে নবজন্মলাভ করে আবার । মনের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ গাঙের ঢেউ আছড়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ ।
আয়াত আলি বিধবা মিনুকে বিয়ে করে নিয়ে আসে ঘরে । তার মৃত্যুর পর সকল সম্পত্তি মিনুকে দিয়ে যাবে এই শর্তে কন্যাদায়গ্রস্ত মিনুর মা তার বাবার বয়সী আয়াত আলিকে জামাই করে ঘরে তোলে ।
মিনুকে তার মা বুঝিয়েছিল, কইদিন আর হেই বুইড়া বাইচ্যা থাকবো! হেরপর তো সব কিচ্চু তোরই অইব!
মিনুও তাই ভেবেছিল । কইদিন আর বাইচ্যা থাকবো হে?
কিন্তু যখন সেই কয়দিনের হিসাব মিনুকে তার ছোট সময় পরিসর থেকে খোল পাল্টে অপেক্ষাটা ক্রমেই বাড়তে লাগলো তখন বড় অসহ্য লাগছিল মিনুর যাপিত জীবন । আয়াত আলির এই বৃদ্ধ থলথলে শরীরটাকেই বড় ঘেন্না লাগত তার । আয়াত আলির কথা শুনলে গা জ্বালাপোড়া করত । আক্ষেপের ছুতো বাড়াতে খুঁজে বেড়াত ত্রুটি ।
এই বৃদ্ধ বয়সে মিনুকে পেয়ে আয়াত আলি যেন আর নিজের মধ্যে নেই । ছন্দ পেল গায়ে গতরে, নৌকার পালের মতো হাওয়া বইতে লাগলো সে । সত্তরের আয়াত আলি যেন বয়সের ভার কাঁধ থেকে নামিয়ে হঠাৎই হয়ে উঠলো এক নওজোয়ান পুরুষ । কিন্তু এতদসত্ত্বেও একবিন্দু প্রশ্রয় পেত না মিনুর কাছে।
এই মিনুই কিনা আবার বছরান্তে অন্য এক মিনু হয়ে গেল ।
বাইরে এক চিলতে উঠোনে শিশির মোছা রোদ এলে আয়াত আলি ঘর থেকে পিড়ি নিয়ে এসে রোদে বসে প্রতিদিন । তখন সবে এক পা দুই পা হাটতে সক্ষম ছেলেটি মুখে অবিরত বা’য়ের ফুলঝুরি ছড়াতে ছড়াতে ঘরের দেউড়ি ভেঙ্গে একটু একটু করে আয়াত আলির দিকে এগিয়ে আসে । আয়াত আলি হাত বাড়িয়ে দিলে তার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে । তারপর তার সামনের পাটিতে গজানো মোটে চারখানা দাঁত মেলে দিয়ে হেসে কুটিকুটি হয় ছেলেটি । আয়াত আলির বড় আনন্দ লাগে, পরমানন্দ । ছেলেকে আরও গভীরভাবে কোলের মধ্যে নিয়ে তার নরম পেটে নাক ঘষে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসির শব্দ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ । ছেলেটি হাসতে থাকে । হাসি থেমে গেলে আবার বা’ ঝরাতে থাকে পাতলা ঠোক বাঁকা করে । ছেলেটি কাঁপাকাঁপা পায়ে হাঁটতে থাকে উঠোনজুড়ে । এই উঠোন আয়াত আলির উঠোন, মিনুর উঠোন ও ঘরের সামনের ছোট্ট স্বপ্নের উঠোন ।
আয়াত আলি তার ছেলের মুখের প্রতিটি বা’কে পরস্পরের পিঠে সুইসুতোর বুননের মতো করে বুনতে বসে ।
বা! বা! বা! বা! বা!
মিনু তাকিয়ে থাকে সেদিকে....
এই সত্তর ধরা জীবনে আয়াত আলির এক কফ-কাশি ছাড়া অন্য রোগবালাই খুব একটা জোস করে উঠতে পারেনি বলা যায় । তবে চোখে ছানি পড়েছে ইদানীং । বেশ শক্ত-পোক্ত পেটানো শরীরটা এখনো । মাঝরাতে যখন শুরু হয় গলার ভেতর জমে থাকা একগাদা কফের খুসখুসানি তখন অবিরত কাশির লাগাম ধরে টানে আয়াত আলি, গলায় গরগর শব্দ করে নিচে নামাতে অথবা উপরে উঠাতে চায় নালিকার প্রাচীর দখলকারী বর্জ্যগুলো । তার যৌবনবতী বউ মিনু তখন আচমকা সকম্পিত জেগে উঠে । তার অতল ঘুম ভাঙানির জন্য ত্যক্ত হয়ে একটু যেন কেউ কেউ করে উঠতে চায় । তারপর যখন পুরো উদ্দিস ফিরে আসে তার, দেহের ঘুমজড়তা মুক্তি পায়, তখন হুড়মুড় করে জেগে উঠে বসে আয়াত আলির পাশে । তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় । আয়াত আলির চেহারাটার দিকে তাকালে একবার হয়ত মনের ভেতরে কি একটা কথা ভেবে খারাপ লাগাটা উথলে উঠে বদহজমি বমির মতো করে । আয়াত আলির কাশির সাথে কফ চলে এলে এদিক সেদিক আকুপাকু করে কিছু একটা খুঁজতে গেলে মিনু টের পায় তার আবশ্যকতাকে । তখন উঠে গিয়ে পিতলের ঘটিটা এগিয়ে দেয় সে । আয়াত আলি থক করে একদলা কফ ফেলে দেয় ঘটিতে । তারপর কিছুক্ষণ বসে বসে ঝিমায় আয়াত আলি, মিনু তখন কিছু একটা ভাবতে থাকে । ভাবতেই থাকে ।
মিনুর দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী আয়াত আলি । চৌদ্দ কি পনেরোর বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে মিনুর প্রথম বিয়ে হয়েছিল পরগ্রামের আতরজমার সাথে ।
আতরজমা ছিল জাত গাছি । শীতকালীন শিউলি । পৌষ মাঘ মাসে যখন সাদা কুয়াশার কণিকাগুলোকে মনে হত শীতের রোয়া, তখন মিঠাই-রোয়া নির্ভর রুটিরূজির সন্ধানে গ্রামের সম্বলওয়ালাদের কাছ থেকে খেজুর গাছ লগ্নি নিত আতরজমা । প্রতিটি গাছের জন্যে এক খন্দে দুই সের করে মিঠাই দিতে হবে এই শর্ত রেখে তার লগ্নি ।
প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই ঘনীভূত কুয়াশার ঘের কেটে কেটে আতরজমা নেমে পড়ত কাজে । গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়ে সংগ্রহ করত কাঁধ ভাঙা পেটমোটা বড় কলসিতে । এরপর রসভর্তি দুটি কলসি একটি শক্ত বাঁশের দুই মাথায় বেঁধে মাঝ বরাবর কাঁথে তুলে বাড়ি বয়ে বেড়াত আতরজমা । এই রস তাওয়ায় ঢেলে আগুনে উত্তপ্ত করলে মিঠাই তৈরি হয় । আবার দুপুরের পর থেকে আতরজমা তার বাঁশে বোনা ঠুলিটির মধ্যে গাছ কাঁটার সরঞ্জামাদি নিয়ে পিঠের সাথে বেঁধে ঠুক ঠুক ঠুক শব্দে কাঠ ঠোকরা পাখির মতো করে খুঁড়ে চলত খেজুর গাছের রসালো শরীর, হাড়ি বসিয়ে আসতো একে একে প্রতিটি গাছে । শীতকালীন পুরোটা সময়ে মিঠাইয়ের খুব চাহিদা বলে ওদের সংসার চলত দিব্যি ।
এই তো গেল শীত কাল । গরমকালে আতরজমার কাজ ভিন্ন । তখন গেরস্তদের নারিকেল গাছ ছোলানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় দরকার পড়ত তার । এই এলাকায় গাছ ছুলুনি বলতে শুধু আতরজমাই । খুব চাহিদা তার । ফলন্ত নারিকেল গাছের ফলন বাড়ানোর জন্য আতরজমাকে দিয়ে গাছের মাথায় শুকনা ও রোগাটে ডগা, ছোবা, গাছের ডগায় জমানো ইঁদুর, পিঁপড়া অথবা অন্য কোন উপদ্রপের বাসা কেটেছেটে সাফসুতরো করানো হত । বিনিময়ে প্রতিটি গাছের জন্য সে তিন টাকা হারে পারিশ্রমিক পেত ।
শেষ পর্যন্ত এই নারিকেল গাছই হল আতরজমার কাল । একদিন গাছ থেকে পড়েই প্রাণবায়ু হারায় আতরজমা । আর মিনু হয়ে যায় বিধবা । আঁটকুড়া জামাই আতরজমার সাথে প্রায় বছর দুই ঘরসংসার করে কোন ছেলেপুলে বিয়োতে হয়নি মিনুকে ।
এদিকে আয়াত আলির অবস্থা ও প্রেক্ষাপট ছিল অন্যরকম । তার প্রাপ্তবয়সী দুই ছেলে বউবেটি নিয়ে শহরে থাকে । কাজকর্ম করে খায় ঐখানে । দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন অবস্থা তাদের । গ্রামকে নিয়ে নাক ছিটকানো বাতিক অঙ্কে অঙ্কে । কারেন্টের বাত্তি ছাড়া মানুষ থাহে ক্যামনে? গাড়িঘোড়া না হইলে মানুষ চলে ক্যামনে? টেলিবিশন না হইলে তো আর অয় না কুনোমতে!---- এইসব আর কি ।
এখন আর বৃদ্ধ আয়াত আলির মরা বাঁচারও কোন খোঁজ খবর রাখার প্রয়োজন মনে করে না তারা। মেয়েটি বছরান্তে একবার এসে আয়াত আলির শরীর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে জেনে যায় তার রেখে যাওয়া বিঘা কয় জমি হাত করতে সম্ভাব্য আর কতদিন লাগতে পারে । বারবার হতাশ হয়ে ফিরেও যায় আবার ।
জটায়ুর মত বেঁচে থাকা আয়াত আলির সম্পর্কে মেয়ের জামাই বলে, হালা বুইড়া ভোম! মরে না ক্যান অ্যাহ্যনো!
আয়াত আলির মেয়ে জমিলা তখন একটু প্রতিবাদ করে তার সোয়ামীকে ধমকের সুরে বলে, আরে ধুর!! কি যে কউ না তুমি?
পাঁচ-ছয় বছর আগে প্রথম পক্ষের বউ গত হয়ে গেলে দুনিয়াব্যপি আন্ধার হয়ে যায় আয়াত আলির। কি রাত কি দিন । দিনের বেলাও আয়াত আলির ঘরের আন্ধার কাটে না বলে কুপি জ্বালিয়ে রেখে তেল পুড়ত সে । ঘরের আনাচে কানাচে বিভীষিকার পোকামাকড় দেখত । কুপির মোটা সলতে পুড়েও আন্ধার কাটে না তার চোখ থেকে, মন থেকে । এক ফোঁটা ঘুম নেই । আয়াত আলি কি জীবিত না মৃত ঠাওর করে উঠতে কষ্ট হত । ভয় পেত পদে পদে ।
তারপর একদিন তন্দ্রাচ্ছন্নের মাঝে আয়াত আলি ঘরময় এক অপার্থিব আলোর সন্ধান পায় । চলন্ত আলো, জ্বলন্ত আলো । আলোর একখানা মুখ আছে, হাত আছে, পা আছে, ভরাট নিটোল বুক আছে, শরীরজুড়ে জোয়ার আছে । মুখে খই ফোঁটা শব্দ আছে, চোখে অতলান্তিক জল আছে । আলোর মধ্যে জীবন আছে, আজন্মের সাধ আছে । আয়াত আলি এসব দেখে জেগে উঠে নবজন্মলাভ করে আবার । মনের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ গাঙের ঢেউ আছড়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ ।
আয়াত আলি বিধবা মিনুকে বিয়ে করে নিয়ে আসে ঘরে । তার মৃত্যুর পর সকল সম্পত্তি মিনুকে দিয়ে যাবে এই শর্তে কন্যাদায়গ্রস্ত মিনুর মা তার বাবার বয়সী আয়াত আলিকে জামাই করে ঘরে তোলে ।
মিনুকে তার মা বুঝিয়েছিল, কইদিন আর হেই বুইড়া বাইচ্যা থাকবো! হেরপর তো সব কিচ্চু তোরই অইব!
মিনুও তাই ভেবেছিল । কইদিন আর বাইচ্যা থাকবো হে?
কিন্তু যখন সেই কয়দিনের হিসাব মিনুকে তার ছোট সময় পরিসর থেকে খোল পাল্টে অপেক্ষাটা ক্রমেই বাড়তে লাগলো তখন বড় অসহ্য লাগছিল মিনুর যাপিত জীবন । আয়াত আলির এই বৃদ্ধ থলথলে শরীরটাকেই বড় ঘেন্না লাগত তার । আয়াত আলির কথা শুনলে গা জ্বালাপোড়া করত । আক্ষেপের ছুতো বাড়াতে খুঁজে বেড়াত ত্রুটি ।
এই বৃদ্ধ বয়সে মিনুকে পেয়ে আয়াত আলি যেন আর নিজের মধ্যে নেই । ছন্দ পেল গায়ে গতরে, নৌকার পালের মতো হাওয়া বইতে লাগলো সে । সত্তরের আয়াত আলি যেন বয়সের ভার কাঁধ থেকে নামিয়ে হঠাৎই হয়ে উঠলো এক নওজোয়ান পুরুষ । কিন্তু এতদসত্ত্বেও একবিন্দু প্রশ্রয় পেত না মিনুর কাছে।
এই মিনুই কিনা আবার বছরান্তে অন্য এক মিনু হয়ে গেল ।
বাইরে এক চিলতে উঠোনে শিশির মোছা রোদ এলে আয়াত আলি ঘর থেকে পিড়ি নিয়ে এসে রোদে বসে প্রতিদিন । তখন সবে এক পা দুই পা হাটতে সক্ষম ছেলেটি মুখে অবিরত বা’য়ের ফুলঝুরি ছড়াতে ছড়াতে ঘরের দেউড়ি ভেঙ্গে একটু একটু করে আয়াত আলির দিকে এগিয়ে আসে । আয়াত আলি হাত বাড়িয়ে দিলে তার কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে । তারপর তার সামনের পাটিতে গজানো মোটে চারখানা দাঁত মেলে দিয়ে হেসে কুটিকুটি হয় ছেলেটি । আয়াত আলির বড় আনন্দ লাগে, পরমানন্দ । ছেলেকে আরও গভীরভাবে কোলের মধ্যে নিয়ে তার নরম পেটে নাক ঘষে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসির শব্দ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ । ছেলেটি হাসতে থাকে । হাসি থেমে গেলে আবার বা’ ঝরাতে থাকে পাতলা ঠোক বাঁকা করে । ছেলেটি কাঁপাকাঁপা পায়ে হাঁটতে থাকে উঠোনজুড়ে । এই উঠোন আয়াত আলির উঠোন, মিনুর উঠোন ও ঘরের সামনের ছোট্ট স্বপ্নের উঠোন ।
আয়াত আলি তার ছেলের মুখের প্রতিটি বা’কে পরস্পরের পিঠে সুইসুতোর বুননের মতো করে বুনতে বসে ।
বা! বা! বা! বা! বা!
মিনু তাকিয়ে থাকে সেদিকে....
পরিচিতি
সাইফুল্লাহ সাইফ
জন্মঃ ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৯০ ।
জন্মস্থানঃ লালমোহন, ভোলা ।
পড়াশুনাঃ ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং(৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত), পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখালেখিঃ চলতি দশকের শুরু থেকে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা, অনলাইন পোর্টাল, প্রিন্ট ও ওয়েব ম্যাগগুলোতে নিয়মিত লিখছেন ।
সহকারী সম্পাদক ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত আছেন ওয়েব ম্যাগ ‘আদরের নৌকা’র সাথে ।
প্রকাশিত বইঃ ২০১৩ এর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় সাহিত্যকাল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত লেখকের প্রথম গল্পগ্রন্থ “কয়েকটি ডানাকাটা প্রজাপতির উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন” । প্রকাশের অপেক্ষায়, গল্পগ্রন্থ “বাঁধনবেলা” ।
মুঠোফোনঃ 01737155304
ই-মেইলঃ saifullahsaif.ice@gmail.com
সাইফুল্লাহ সাইফ
জন্মঃ ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৯০ ।
জন্মস্থানঃ লালমোহন, ভোলা ।
পড়াশুনাঃ ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং(৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত), পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখালেখিঃ চলতি দশকের শুরু থেকে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা, অনলাইন পোর্টাল, প্রিন্ট ও ওয়েব ম্যাগগুলোতে নিয়মিত লিখছেন ।
সহকারী সম্পাদক ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত আছেন ওয়েব ম্যাগ ‘আদরের নৌকা’র সাথে ।
প্রকাশিত বইঃ ২০১৩ এর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় সাহিত্যকাল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত লেখকের প্রথম গল্পগ্রন্থ “কয়েকটি ডানাকাটা প্রজাপতির উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন” । প্রকাশের অপেক্ষায়, গল্পগ্রন্থ “বাঁধনবেলা” ।
মুঠোফোনঃ 01737155304
ই-মেইলঃ saifullahsaif.ice@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ