এবার অনেকদিন, বেশ কয়েক বছর, ও এল। এল আমার অফিসেই। পরনে ঢলঢল প্যান্ট আর গায়ে কোঁচকানো শার্ট। জুতোর দিকে চাইলাম না। ও দিকের অবস্থা যে কী, বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। আশ্চর্য, এই কয় বছরে একটুও বদলায় নি। না পোষাকে, না স্বাভাবে। ক’বছর আগে প্রচণ্ডভাবে অপমান করার পরে ওকে যেমনভাবে রাস্তায় ফেলে চলে গিয়েছিলাম, ঠিক তেমনিভাবে অবিকলভাবে সেই পোষাকেই ও দরজা ঠেলে আমার কামরায় এসে ঢুকল।
স্বভাবসিদ্ধ মৃদু গলায় আমাকে বলল, এই যে। এটে তাহলে তোমার ঘর। সত্যি তোমার কত উন্নতি হয়েছে। দেখে ভাল লাগল।
ওকে দেখে আমি হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলাম। একটু বিভ্রান্তও হয়ে পড়লাম। কোনও কথা না বলে মুখ নিচু করে কাজে মন দিলাম। ঝাঁ করে মনে পড়ল, সেবার ওর সঙ্গে খুবই রূঢ় ব্যবহার করেছিলাম, অতটা কড়া না হলেও বোধহয় চলত।
একটু থেমে যেন আপন মনেই বলে উঠল, হেঁটে হেঁটে পা ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। এত হাঁটতে হয় আজকাল। তারপর শরীরটাও ভাল নেই। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছি। একটু হাঁটলেই মাথা ঘো্রে। বুকটাও ধড়ফড় করে। আজকাল তো আর কলকাতায় থাকিনে। থাকি হালিশহরের ওইদিকে। ট্রেন ধরতেও অনেকখানি হাঁটতে হয়। অনেক সকালে বেরিয়ে পড়ি। সব দিন খেয়েও আসতে পারিনে।
আমি নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম। আমার ভিতরে প্রবল একটা বিতৃষ্ণার ভার এরই মধ্যে এসে পড়েছে। আমি সেটাকে দমন করবার চেষ্টা করছিলাম। গতবারের ঘটনা মনে পড়ল। আবারও ও ভিক্ষা চাইতে এসেছে মনে হতেই চমকে গেলাম। এটাকে ভিক্ষা বলছি কেন? ছিঃ!
ও মৃদুস্বরে বলল, তোমার শরীর খারাপ হয়েছিল শুনেছিলাম। এখন তো ভালও আছ, না? তোমার এ ঘরটা তো বেশ বড়ই। টেবিলও বেশ বড়। পাশের টেবিলে কে বসেন? তোমার কোনও কলিগ বুঝি?
ও এত কথা বলছে কেন? কোনও কথা না বলে ও যদি চুপ করে বসে থাকত তাহলে হয়তো ওর উপর এত রাগ হত না। না, আজ আমি কিছুতেই ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না। যা খুশি বলুক।
ও আপন মনেই বলে উঠল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। তুমি কি একটু বসতেও বলবে না!
ঝপাৎ করে কেউ যেন আমাকে চাবুক মারল। বললাম, বোসো। কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে দেব না। কাজ আছে।
খালি চেয়ারে বসে পড়ে তেমনি আস্তে আস্তে ও বলল, কাজ তো আছেই। তোমার কাজে বাধা দেব না। আমি এখনই চলে যাব। একটু চা খাওয়াবে না? গলা শুকিয়ে গিয়েছে।
বেয়ারাকে ডেকে চা আনতে বললাম। ও বলল, শুধু চা-ই খাওয়াবে? তোমাদের এখানে তো অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিছু আনতে বল না।
হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, এটা অফিস। খাবারের দোকান নয়।
ও দুঃখ পেল না। অপমানও ওর গায়ে লাগল না। তেমনি ধীর স্বরে বলল, এটা অফিস তাতো জানি। তুমি এমন ভাব করছ যেন ক্ষিধে পেলে এখানে কিছু খাও না বা অন্য কাউকে কখনও কিছু খাওয়াও না। নাও, কিছু আনতে বল। আজ সারাদিন কিছু খাইনি।
ভাবলাম কিছু আনিয়ে দিই। কিন্তু মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, তোমার খাওয়া হয়নি তো আমি কী করব? এটা সদাব্রত নয়, আমার বাড়িও নয়।
ও অম্লান বদনে বলে বসল, তবে তোমার বাড়িতেই নিয়ে চল না। ভাল করে খাইয়ে দাও না একদিন। কতদিন যে ভাল কিছু খাইনি।
বললাম, চা খাও। খেয়ে চলে যাও। আমার কাজ আছে।
আমার স্বর তিক্ত হয়ে উঠেছে।
ও বলল, সত্যিই কিছু আজ খাইনি। আমাকে তবে কিছু টাকা দাও।
হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। আমার ভিতরে একটা নির্দয় মানুষ তখন জেগে উঠেছে। সে ছোবল মারবার ফাঁক খুঁজছে।
ও কোনও কিছুই গায়ে মাখল না। আপন মনেই বলে চলল, তবে তুমি আমাকে পাঁচটা টাকা দাও। আমি মুশকিলে পড়েছি। জান?
গলার স্বর চড়িয়ে ওকে বললাম, তোমাকে কিছুই দেব না। তুমি চলে যাও।
ও তেমনি মৃদুস্বরে বলল, পাঁচটা টাকা দিতে তোমার এমন কী? পাঁচটা টাকা তুমি অনায়াসেই দিতে পার।
আমি যেন কথা দিয়ে ওকে খুন করব। বললাম, তুমি আমার কথা শুনতে পারছ না। তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছি।
ও উঠল না। বসে রইল। বলল, তবে আমাকে দুটো টাকা দাও।
আমি কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলাম, তুমি যদি এখনই না ওঠো, তবে আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
ও বলল, তুমি কি বুঝতে পারছ না, তুমি কিছু না দিলে আমাকে আবার হাঁটতে হবে। এই খালি পেটে...শরীর দুর্বল..একটা মানুষ কত আর হাঁটতে পারে...তুমি মাঝে মাঝে কেন যে এত অবুঝ হয়ে ওঠো..এমন কি ভাল দুটো কথাও বল না।...
আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম। ও চলে গেল।
আবার হয়তো কয়েক বছর আসবেই না। হয়তো কালই আসবে। পঁচিশ বছর এই রকম চলছে। আশ্চর্য, ওর কোনও পরিবর্তন নেই। পঁচিশ বছর আগেও যে-রকম ছিল, আজও সেই রকম। পঁচিশ বছর আগে আমি আরও ও একই রকম ছিলাম। তবে ওকে, কেন আজ সহ্য করতে পারি নে।
স্বভাবসিদ্ধ মৃদু গলায় আমাকে বলল, এই যে। এটে তাহলে তোমার ঘর। সত্যি তোমার কত উন্নতি হয়েছে। দেখে ভাল লাগল।
ওকে দেখে আমি হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলাম। একটু বিভ্রান্তও হয়ে পড়লাম। কোনও কথা না বলে মুখ নিচু করে কাজে মন দিলাম। ঝাঁ করে মনে পড়ল, সেবার ওর সঙ্গে খুবই রূঢ় ব্যবহার করেছিলাম, অতটা কড়া না হলেও বোধহয় চলত।
একটু থেমে যেন আপন মনেই বলে উঠল, হেঁটে হেঁটে পা ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। এত হাঁটতে হয় আজকাল। তারপর শরীরটাও ভাল নেই। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছি। একটু হাঁটলেই মাথা ঘো্রে। বুকটাও ধড়ফড় করে। আজকাল তো আর কলকাতায় থাকিনে। থাকি হালিশহরের ওইদিকে। ট্রেন ধরতেও অনেকখানি হাঁটতে হয়। অনেক সকালে বেরিয়ে পড়ি। সব দিন খেয়েও আসতে পারিনে।
আমি নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম। আমার ভিতরে প্রবল একটা বিতৃষ্ণার ভার এরই মধ্যে এসে পড়েছে। আমি সেটাকে দমন করবার চেষ্টা করছিলাম। গতবারের ঘটনা মনে পড়ল। আবারও ও ভিক্ষা চাইতে এসেছে মনে হতেই চমকে গেলাম। এটাকে ভিক্ষা বলছি কেন? ছিঃ!
ও মৃদুস্বরে বলল, তোমার শরীর খারাপ হয়েছিল শুনেছিলাম। এখন তো ভালও আছ, না? তোমার এ ঘরটা তো বেশ বড়ই। টেবিলও বেশ বড়। পাশের টেবিলে কে বসেন? তোমার কোনও কলিগ বুঝি?
ও এত কথা বলছে কেন? কোনও কথা না বলে ও যদি চুপ করে বসে থাকত তাহলে হয়তো ওর উপর এত রাগ হত না। না, আজ আমি কিছুতেই ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না। যা খুশি বলুক।
ও আপন মনেই বলে উঠল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। তুমি কি একটু বসতেও বলবে না!
ঝপাৎ করে কেউ যেন আমাকে চাবুক মারল। বললাম, বোসো। কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে দেব না। কাজ আছে।
খালি চেয়ারে বসে পড়ে তেমনি আস্তে আস্তে ও বলল, কাজ তো আছেই। তোমার কাজে বাধা দেব না। আমি এখনই চলে যাব। একটু চা খাওয়াবে না? গলা শুকিয়ে গিয়েছে।
বেয়ারাকে ডেকে চা আনতে বললাম। ও বলল, শুধু চা-ই খাওয়াবে? তোমাদের এখানে তো অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিছু আনতে বল না।
হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, এটা অফিস। খাবারের দোকান নয়।
ও দুঃখ পেল না। অপমানও ওর গায়ে লাগল না। তেমনি ধীর স্বরে বলল, এটা অফিস তাতো জানি। তুমি এমন ভাব করছ যেন ক্ষিধে পেলে এখানে কিছু খাও না বা অন্য কাউকে কখনও কিছু খাওয়াও না। নাও, কিছু আনতে বল। আজ সারাদিন কিছু খাইনি।
ভাবলাম কিছু আনিয়ে দিই। কিন্তু মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, তোমার খাওয়া হয়নি তো আমি কী করব? এটা সদাব্রত নয়, আমার বাড়িও নয়।
ও অম্লান বদনে বলে বসল, তবে তোমার বাড়িতেই নিয়ে চল না। ভাল করে খাইয়ে দাও না একদিন। কতদিন যে ভাল কিছু খাইনি।
বললাম, চা খাও। খেয়ে চলে যাও। আমার কাজ আছে।
আমার স্বর তিক্ত হয়ে উঠেছে।
ও বলল, সত্যিই কিছু আজ খাইনি। আমাকে তবে কিছু টাকা দাও।
হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। আমার ভিতরে একটা নির্দয় মানুষ তখন জেগে উঠেছে। সে ছোবল মারবার ফাঁক খুঁজছে।
ও কোনও কিছুই গায়ে মাখল না। আপন মনেই বলে চলল, তবে তুমি আমাকে পাঁচটা টাকা দাও। আমি মুশকিলে পড়েছি। জান?
গলার স্বর চড়িয়ে ওকে বললাম, তোমাকে কিছুই দেব না। তুমি চলে যাও।
ও তেমনি মৃদুস্বরে বলল, পাঁচটা টাকা দিতে তোমার এমন কী? পাঁচটা টাকা তুমি অনায়াসেই দিতে পার।
আমি যেন কথা দিয়ে ওকে খুন করব। বললাম, তুমি আমার কথা শুনতে পারছ না। তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছি।
ও উঠল না। বসে রইল। বলল, তবে আমাকে দুটো টাকা দাও।
আমি কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলাম, তুমি যদি এখনই না ওঠো, তবে আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
ও বলল, তুমি কি বুঝতে পারছ না, তুমি কিছু না দিলে আমাকে আবার হাঁটতে হবে। এই খালি পেটে...শরীর দুর্বল..একটা মানুষ কত আর হাঁটতে পারে...তুমি মাঝে মাঝে কেন যে এত অবুঝ হয়ে ওঠো..এমন কি ভাল দুটো কথাও বল না।...
আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম। ও চলে গেল।
আবার হয়তো কয়েক বছর আসবেই না। হয়তো কালই আসবে। পঁচিশ বছর এই রকম চলছে। আশ্চর্য, ওর কোনও পরিবর্তন নেই। পঁচিশ বছর আগেও যে-রকম ছিল, আজও সেই রকম। পঁচিশ বছর আগে আমি আরও ও একই রকম ছিলাম। তবে ওকে, কেন আজ সহ্য করতে পারি নে।
3 মন্তব্যসমূহ
মানুষ অদ্ভুত তাতো জানাই । তবু তা তুলে ধরাটা সহজ নয় । এতো অল্প শব্দেও তা' সম্ভব - এমন মোচড় দেয়া সমাপ্তিতে ?
উত্তরমুছুনএকটা অদ্ভূত চরিত্রের মানুষকে অদ্ভূত ভাবে চিত্রিত করেছেন। সেটাই মুন্সিয়ানা।
উত্তরমুছুনএকটা অদ্ভূত চরিত্রের মানুষকে অদ্ভূত ভাবে চিত্রিত করেছেন। সেটাই মুন্সিয়ানা।
উত্তরমুছুন