মৃত্য এসে গিয়েছে। এই ঘন্টা খানেক আগেই আসলো।কিছুক্ষণ আগেও শরীর টা চলমান ছিলো, ভারসাম্যের সাপ-লুডো চলছিল...এখন তা অশরীরী বিভ্রম জোগায় সবার মনে। এখনো খবরটা পৌঁছয়নি। সেকেণ্ডের আগে কি পরে যখন পৌঁছবে, সবাই জানবে এবং কান্নার রোল, অজুহাতের কারণ, আক্ষেপের রোষ সব সিম্ফনি বেজে উঠবে একসাথে। আর একটু পরেই এটা খবর হবে। মারা গেছে। শরীর জোড়া এক দীর্ঘ ঘুম মাখামাখি করে ধূপের গন্ধে । শিরা শিথীল হচ্ছে...
আচ্ছা মৃত্যু দৃশ্য কি সিনেমার লাস্টসিন। মা-এর মেলড্রামা শিক্ত আঁখি পল্লবিত ক্রোড়ে বিদ্রোহী পুত্রের শেষ ঘুম। শহীদের মত।
ধূপ জ্বলছে। মৃত্যুকালের এক নিজস্বমাত্রা আছে । পদ্ধতি আছে। এমনকি কান্নারও। আর কেউ তোমার অতীত নিয়ে চিন্তিত নয়। ভবিষ্যত নিয়ে ভাবিত নয়। কারণ তুমি মৃত বর্তমানে।
একটু বাদেই রানাঘাট থেকে দিদিরা আসবে। শ্যামনগরের রাঙা-দা রা ফোনে জানাবে এই ঢুকল বলে।
বহুদিন যে জমায়েত দেখনি বলে আক্ষেপ ছিল। বারোঘরে জাঁক-জমক ঝেড়ে এক শ্মশানপুরী তে থাকার যে হতাশায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস দিতো, সব মুছে যাওয়ার দিন আজ। ওরা সবাই এসেছে। এবং তুমি দেখতে পাচ্ছ না। চোখ টা বন্ধ তো তাই। ওরাও মৃত......।
সবাই বসেছে তোমাকে ঘিরে। একটুও নড়ছেনা কেউ। শব্দ ও করছেনা।
এতো নীরবতা....বেঁচে থাকলে সহ্য করতে। আওয়াজ করে বাড়ি মাথায় উঠত। এখন সভা হচ্ছে। নীরবে। সবাই চুপ। শোক জানাচ্ছে সবাই।ফিস ফিসিয়ে......ফুঁপিয়ে...ফুঁপিয়ে আলতো স্বরে। সভা চলছে। সবাই চোখ ভরে দেখছে আরতি-সন্ধিপূজার উৎসবের মত। শোকসভা চলছে।
মর্গদাহ
মিশরীয় মৃত্যু দেবতার নাম আনুবিশ। তুমি তাকে চেনো। দেখেছ তাকে। ছেলের কমিকস বই-এর পাতায়, সেদিন রুকু ঘুমাচ্ছিলো। ঘুমন্ত হাতের থাবার মধ্যে ছিল বই টা। ছিল আনুবিশ।সেই সাদা কাপড়ে জড়ানো মমি গুলো কে মনে পড়ে ............।
এখন তুমি মর্গে। ব্যবচ্ছেদ হচ্ছে তোমার শরীর। বেঁচে থাকলে বড় যন্ত্রণা হত। ঢাউস হাতুড়ির বাড়ি,সামান্য কেটে যাওয়া যাকে মূর্চ্ছা দিতো তার...। খুলে দেওয়া হবে গোটা শরীর। ডাক্তারি ছাড়পত্র পাবে মৃতদেহ। তারপর......।
আনুবিশের আশীষ ধন্য শরীর আজ সাদা গজে ঢাকা। মৃতের মৃত্যু পোশাক ।
সেই সরকারী চাকুরেকে মনে আছে , গল্পের পাতায়। কর্কট রোগ হয়েছিলো। যাদের জন্য জীবন ভর উপার্জন। যাদের মতো করে বাঁচা।স্ত্রী পুত্র কন্যা। লক্ষ্মী লোকসান । কেউ নেই পাশে। অথচ মৃত্যু সে তো আসছে। তাই সে ফিরে গেলো সেই অজানা দ্বীপে, একদিন শামুকের খোলে যাকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছিলো।শৈশব। সেখানে ঘুড়ি ওড়ে , ছেলের দল দামালের মত দাপাদাপি করে রাস্তায়। গোঠুরে পথ এগিয়ে যায় বৈকুন্ঠের দিকে.........মৃত্যু আসে ডাক দেয় । ছেঁড়া সুতোয় বাঁধা ঘুড়ি ওড়ে একা।
এবার তাহলে দাহ হবে। যে এতক্ষণ বেঁচে ছিলো। তার কোনো ধর্ম না থাকতে পারে। তবে মৃত দেহের আছে। উড়ন্ত খই আর পয়সা সাক্ষী থেকে যাবে শুধু অস্থি টুকু।ভাসতে- ভাসতে.........এধার থেকে ওধার......পুর্নজন্ম ,উল্লাস।আক্ষেপ.........যন্ত্রণা.........তারপর আবার মৃত্যু। নদীর জল তবে চিরন্তন। দাহ শরীর পোড়া ছাই।
যাওয়ার আগে
যাওয়ার তবে শুরু।পিছনে পড়ে থাকবে ফল-মিষ্টি-পরমান্ন।কথা বলা।নাক বোঁচকান । বউ এর ঘুম না হওয়া। কোমরের যন্ত্রণা।ছেলের কাঁচা শরীর।শব ভ্রমে বিষণ্ণ হবে ওরা।একদিন সয়ে যাবে সব। অভ্যাস বড় চামড়া হীন। তবু তুমি তো চলেছো। মৃত্যু যাওয়ায়.........।
তখনও মৃত্যু আসেনি। যুদ্ধটা চলছে পুরোদমে। স্নায়ুতন্ত্রে ১৪৪ধারা। হঠাৎ সেই নস্যি ডিব্বাটার কথা মনে পড়ল তোমার। বাবা ব্যবহার করতেন। তুমি এখন কর। ডান তর্জনীর একটা মিঠে বোলে আচমকা অন্য মনা হলে...১৪৪ধারা শিথীল করে পৌঁছে গেলে গন্তব্যে......আগেই।হাওয়া গাড়ী......গাড়ীচালক......পকেট গোঁজা ২০০০ টাকা রইলো পড়ে যেমনটি তেমন।
এই তো সেই নস্যি কৌট, চশমার খাপ, চেনা বালিশ।রাত নটার খবর। এক বাড়ী। রান্নাঘর –গেরস্থলী। রাত্রী খাবার। পঙ্গু দুটো শরীরের অন্ধকার ঘুম। মশারির ভেতর যাপন। পাপক্ষয় হতে থাকা সিলিং ফ্যানের ঘুর্ণনে। বদলায় না কিচ্ছু। অভ্যেস শুধু নিয়ন্ত্রণ করে। চেনা বালিশের কভার পালটে। পর্দার রং বদলে।রুমফ্রেশনারের গন্ধে......দুইয়ের মাঝে থাকা কান্না......হাহুতাশ যাকে শোক বলে।অস্থায়ী সাক্ষ্য বহন করে কেবল, আর এক যাওয়ার।

লেখক পরিচিতি
ঈশান বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্মসাল- ২২। ১২। ১৯৯১
জন্মস্থান- বসিরহাট
বর্তমান আবাসস্থল- দিল্লী
পেশা- পড়ালেখাদেখা
যা লিখি – মুক্ত গদ্য, নাটক, চিত্রনাট্য, গল্প।
লেখা পত্রিকা- ইছামতী-বিদ্যাধরী, আমার পত্রপুট, ক্ষেপচুরিয়ান্স,আত্মজা।
ওয়েব পত্রিকার লিঙ্ক- www.drobidro.in
ইমেল-ঠিকানা- ishanreportage@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ