‘জানিনা কি করে’- একটা ছেঁড়া কাগজের
ওপরে লেখা অসমাপ্ত একটা লাইন লেখা, হাতেই। কালো হ্রস্য-দীর্ঘ অক্ষর বেঁকে যাওয়া
কাগজের পিঠে চড়ে ঘুরে ফিরে নাচে। একবার উড়ে গিয়ে পড়ে কাঁচা রাস্তায়। আরেকবার কাঁচা
রাস্তা থেকে পাকা সড়কের কালো পীচের ওপর। সেখানে মিউনিসিপ্যালিটির শেষ সীমা
নির্ধারিত। সবাই জানে, পাকা রাস্তা যেখানে শেষ সেখান থেকে গ্রামের শুরু। কাঁচা আর পাকার
ব্যবধান নিয়ে গ্রামের ইউনিয়ন আর পৌরসভার সংযুক্তিতে মেয়েটা প্রথমে বসে প’ড়ে,
তারপর শুয়ে গিয়েছিল। কাগজটা হয়তো মেয়েটার হাতের মুঠোতেই ধরা ছিল, হয়তো কেন, ওর হাত
থেকেই তো উড়লো!
মেয়েটির পানি ভাঙ্গা গর্ভবতী পেটের চামড়া স্খলিত তাবুর মত মুখ থুবড়ে পরে
আছে। প্রসব ব্যথার পারদ তার ইন্দ্রিয় বোধ প্রখর করার বিপরীতে রওনা দিয়েছে। হয়তো সব
অনুভব ঠিক ঠাক কাজ করছে না। কিন্তু সে তার সব ইন্দ্রিয় দিয়ে সন্তান প্রসবের
অনুভুতি বুঝতে চায়, সংজ্ঞালুপ্তি চায় না। বিড়ালটি ছোক ছোক ঘ্রাণ নেয়, মেয়েটির
নাকের কাছে গিয়ে গন্ধ শুকে আসে। জঠরে মেয়াদোত্তীর্ণ শিশুটির হাঁটূ পেটের চামড়া
ঠেলে উর্ধ্বমুখে প্রকাশ হতে চায়। হাত পা বাদ দিলেও মাথা তার গতিপথ চেনে। যে ফড়িংটি এতক্ষণ আখের খস
খসে পাতায় স্থির হয়েছিল, সে তত মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সাক্ষী হতে পারছে না বলে উড়াল
দেয়। যাওয়ার সময় তার লম্বা ঠ্যাংয়ের আঁচড়ে ‘জানিনা কি
করে’ কে নাড়িয়ে
দিয়ে যায়। জীর্ণ শরীরের ভার নিয়ে কাগজের টুকরোটি একটা ঘুড়ির আকার নিতে নিতে আবার
উড়তে উড়তে নীচে নেমে আসে। মাঝারী মাপের আখের পাতা থেকে নিম্নমুখী যাত্রায় তার
সামান্য অবিমৃষ্যকারীতার গল্প মনে আসে। আত্মপরিচয় উন্মোচনের সাধ, ছিঁড়ে যাওয়া
কাগজের কোনায় কোনায় ঝুলে থাকে। অবিমৃষ্যকারীতা- কী এক দৌর্দন্ড শব্দ। এর দাপট এত
নাটকমুখী আর সন্মোহন-সাধ্য যে ধারে আর ভারে দুটোতেই কাটে। ‘জানি না কি
করে’র ইচ্ছে
জাগে কেউ তার গায়ে সত্যি সত্যি ‘অবিমৃষ্যকারী’ শব্দটি লিখে দিক। সে
আরো ভারবাহী হয়ে পড়বে, সত্যি। মেয়েটি তো পারতোই তাকে অর্থপূর্ণ অবয়ব দিতে। শুধু
ছেঁড়া কাগজের টুকরো হলে - একটা ভোকাট্টা উড়াল দিলেই তার দাম আর দম দুইই শেষ। তবে এখনও,
আর যাই হোক তার গায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বয়ান, হোক না তা অসম্পূর্ণ। অন্তত এই মূহূর্তে যখন
একটি প্রসব দৃশ্যের অবতারনা হতে চলেছে।
ঘর বাড়ি থেকে বেশী দূরে না, প্রায় নির্জন এই জনপদ, সঙ্গের আখ-সরষের
মিলিত আর খুব ছোট লুডুর ছকের মত ক্ষেত বাদ গেলে থাকে শুধু একটা অপরিসর খালের ঢাল।
খালটা হয়তো কখনো খরস্রোতা নদী ছিল, কিন্ত এখন আপোসকামী। ‘জানি না কি
করে’ নিজের
সঙ্গে নদীটার একটা মিল খুঁজে পায়। নদীটাও কি জানে কেমন করে তার খরস্রোত দিনে দিনে
মানানসই ঢেউ এ এসে ঠেকেছে! তারপরও ছেঁড়া কাগজের টুকরোটার মনে হয় ওই নদী তার তীর্থ।
যেখানে পৌঁছুতে দরকার টানা একটা অথবা সংক্ষিপ্ত গুটিকয় চেষ্টা। পানির
কাছাকাছি গিয়ে পড়তে পারলে তার পঞ্চভূতে মিলানো সার্থক হবে। যদিও এই মিলিয়ে যাওয়ার
মানে তার অজানা, কেউ তার গায়ে লিখে রাখেনি। হয়তো কালো পানির গায়ে ততোধিক কালো
হস্তাক্ষরে ‘জানিনা কি করে’ জল ছাপ রেখে যাবে। এখন
তার শুধু এক পশলা উত্তুঙ্গ হাওয়া দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে এই মেয়েটার
থেকে, রাগী বেড়ালটার থেকে দূরে নিতেও ইচ্ছে করছে না।
মেয়েটির কোঁকানি এতক্ষণ বেড়ার আড়াল পার হতে চাইছিল না। সে নিজেই হয়তো ব্যথার
শব্দকে গলাটিপে মারার হুমকি দিয়ে স্থির রেখেছে। এখন আর পারছে না। বেড়ার গোড়ায় গায়ে
লেগে থাকা ময়লা আর উচ্ছিষ্ট মেশা গন্ধ তার সন্তান ভূমিষ্ঠ করার অনুভূমিক
প্রক্রিয়ায় বাড়তি বেদনা যোগ করছে। এতক্ষণ গন্ধের তীব্রতা নাকে লাগেনি। এখন লাগছে,
তার মানে বাতাস বইছে। বাতাসে ঘাপটি মারা গন্ধের তোড় তার অভিমুখ খুঁজে নিলে মেয়েটা
চারপাশে চোখ তুলে তাঁকায়। সময়োচিত কাউকে খোঁজে। এই লোকালয় তার অপরিচিত। তবুও কারুর
কথা স্মরণে আসতে দোষ নেই।
এতক্ষণ বেড়ালটা নিরব দর্শক হয়ে গলা আর বুক মাটিতে ঠেকিয়ে বসেছিল। মেয়েটার
ঘাড় উঁচু করা দেখে সেও গা ঝাড়া দেয়। তারপর দু পায়ের নখর দিয়ে সামনের মাটি আঁচড়ায়,
যেন বড় সড় কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি। তার খুড়ে ফেলা মাটির গুড়ো মেয়েটির চোখে মুখে
ছিটে ছিটে আসে। সে চোখ আর কপালে ভাঁজ ফেলে। নিজের এই কপাল কুচকানো ভঙ্গী তাকে অনেক
কিছু মনে করতে সাহায্য করায়। সেসব আজকের এই অবিমৃষ্যকারী দৃশ্যায়নের অংশও না। তবু মনে পড়ে
কোন আত্মীয়ের আইবুড়ো ভাত। মেয়েরা গোল হয়ে বসে গীত গায়। তার আগের রং খেলা, যে খেলার
অবশ্যম্ভাবী উল্লাসের অংশ হিসেবে কিছুক্ষণের মধ্যে কাদা খেলা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। ঘন পিচ্ছিল
কাদায় সবার মুখাবয়ব মাটির মূর্তির মত মনে হয়। কেউ কাউকে কিছুক্ষণের জন্য চিনতে
পারেনা। তারপরও হুল্লোড় থেমে যায় না। আপাত অচেনাকে ঘিরে জারী থাকে উত্তাল নাচ। এই
প্রসঙ্গে তার মনে হয়- আজকে তার অতীতের একটি কাজকে কেন অবিমৃষ্যকারী মনে হচ্ছে? সে
খোলা আকাশের নীচে, প্রায় নর্দমার ধারে এসে পৌঁছেছে আর দূর্দৈব কারণে তার অনাগত
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়টা মিলে গেছে। এই ঘটনা পরম্পরাকে কেন একটা দুধারী লোহার
মত শব্দ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে? ঢেকে দেবার পরও যে কচাৎ করে সব ভার
কেটে আবারো প্রকাশিত হয়ে, আবারো ভারী হয়ে উঠবে। এ কথা তাকে কতবার, কতভাবে, কত
বিচিত্র মানুষের কাছ থেকে গত নয় মাসে শুনতে হয়েছে।
হ্যা, সেটা একটা গ্রাম। বাসিন্দারা বড় হুল্লোড় প্রিয় ছিল। যে কোন ছুতোয় একটা
ঢিল ছোড়া মৌচাকের মাছির মত এক কাট্টা হয়ে হয় ছুট লাগায় নয়তো ঝিম ধরে বসে
থাকে কবে আবার ছুট লাগানোর মওকা পাবে সে অপেক্ষায়। তাদের অপেক্ষার পালা কখনো কখনো
অস্বাভাবিক দীর্ঘ হয়। তখন কেউ কেউ অসহিষ্ণু হলে তাকে গ্রামের মাতব্বর গোছের দু চার
জন সাময়িক একঘরে করে আবার দল ভুক্তি করে। তবে অসহিষ্ণুতা কখনোই তেমন মাত্রা ছাড়ায় না।
এক ঝুম বৃষ্টির দিনে তারা দেখা পেয়েছিল দলছাড়া একজনের। সে এ গ্রামের কেউ
না, এখানে থাকেই না। এই পর্যন্ত ভেবে মেয়েটির মনে হয়– তার গল্পটা
বড় শাদা মাটা। তার আজকের অবস্থার পেছনের কাহিনী হিসেবে এই গল্প প্রতিষ্ঠা পায় না।
এই গল্পের জের হিসেবে সে একঘরে হয়েছে যদি বলে তাহলে বুঝে নিতে হয় সামনের সময়কে ভুল
দেখতে পেত সে। অথবা আদৌ পেত না।
আর সেই নতুন মানুষ? সেকি হুল্লোড় নিয়ে এসেছিল? না, সে একটা খেলা শেখাতে
এসেছিল, যে খেলায় লুকোবার জায়গা লাগে। অথচ এ গ্রামে লুকোবার কোন জায়গা নেই। আর আর
গ্রামে যেমন থাকে, একটা বাঁশঝাড়, পুরোনো মন্দির বা মসজিদ, কোন আকাট নিদান বৃক্ষ,
সে সব কিছু নেই। সূর্য মাথার ওপরে তেড়িয়া হয়ে উঠে গেলে তাদের সব আড়াল ঘুঁচে যায়। নতুন
মানুষটি তখন আত্মগোপন উপযোগী জায়গা বানানোর প্রস্তাব দেয়। কারুর কোন
বিরোধিতা নেই, সবাই রাজি। ব্যাস হয়ে গেল, কয়েক দিনের ব্যবধানে বানিয়ে ফেললো দু
চারটে বাড়তি পথ, সেই সব পথের মোড়ে মোড়ে রহস্যাবৃত গাছ, দালান। ইটের ভাটা,
কৃত্রিম পাহাড় তাতে আরো রংয়ের পোচ লাগানো গুহামুখ, হাতছানিতে ডাকে। নতুন মানুষ
যেন যাদুকর, সারা গ্রাম তার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায়। হুল্লোড়, বেজায় ফূর্তি। রাত
ভোর গান হতে থাকে, বাজনা থাকে অক্লান্ত। তবে একটা সমস্যা দু তিন দিনের মাথায় সবার,
বিশেষ করে তরুণদের মাথায় খেলে যায়। হুল্লোড় হচ্ছে, খেলার জায়গাও তৈরী। কিন্তু কেউ খেলছে
না সেই বিশেষ খেলা। প্রথম কথা হলো- এক সঙ্গে এককাট্টা হয়ে থাকলে খেলা হবে কিনা। আর
দ্বিতীয়ত- খেলাটা তো তাদের গ্রামে কেউ জানে না। তাদের এই খেলা শিখতে হবে। যত সহজই
হোক, খেলা মানেই তো কিছু নিয়ম, নিয়মের ব্যতিক্রম আর আবার নিয়মের পূর্ণপ্রতিষ্ঠা। আর শেখানোর
কথাতো নতুন মানুষটার। সবাই গিয়ে ধরে পড়লো তাকে, এ খেলার প্রতিবেশ যে বানাতে
পেরেছে, প্রশিক্ষনের দায়ও তার ওপরেই বর্তায়। মানুষটির আপত্তির কোন কারণ নেই। সেতো
খেলা শেখাতেই এসেছে। একটি মাত্র শর্তের অধীনে গ্রামের সব মানুষ আবারো এককাট্টা হয়ে
গেলো, মৌচাক ঘিরে গুঞ্জনরত মৌমাছিদের মত। মানুষটা খেলা শেখাবে একজনকে মাত্র। যদিও এ খেলাটি
দলগত ভাবে খেলতে হয়। আর তেমন কোন জটিল মন্ত্রগুপ্তি নেই, বলে সে নিজেও স্বীকার
করেছে। তবু সে শুধু একজনকে এ নিয়ম জানানোর উত্তরাধিকার দিতে চায়। আর তাকে হতে হবে
সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত নারী। গ্রামের সবাই আবারো একদল, এক শ্লোগান। এই শর্ত শোভন
শর্ত নয়! প্রবীণ, তরুণ, আর যৌবনপ্রাপ্ত পুরুষের আকাল নেই তাদের। নিদেনপক্ষে
সংসারঅভিজ্ঞ নারীও তো চাইতে পারতো শিক্ষার্থী হিসেবে। কিশোর, কিশোরী, যাদের
শেখার আগ্রহ আর মস্তিস্ক দুইই অগ্রসর? না, এ শর্ত মেনে নেয়া যায় না। তাদের গ্রামে
সূর্য আবার তেড়িয়া হয়ে আলো আর তাপ দেয়। একদিন। দ্বিতীয় দিনে আরেকটু ম্লানভাবে ছড়ায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে
রহস্যময় লুকোনোর জায়গাগুলো বেশী স্পষ্ট হয়ে থাকে। গ্রামের দু একজন আড়মোড়া
ভাঙ্গে। হাই তোলে। বিকেলগুলো পানসে পানসে লাগে। কী এমন হয়, এতো শুধু
একটা খেলা। এক যৌবনপ্রাপ্ত নারী সে খেলাটি শিখে অন্যান্য সবাইকে শেখাবে। এতে এত জটিল কিছু
নেই। পুরো গ্রাম দু দলে ভাগ হয়ে বাহাস করে। দিন গিয়ে তাদের
সন্ধ্যার আলো মিট মিট করে জ্বলতে থাকলে তারা সিদ্ধান্ত নেয়-, হোক, তাহলে যৌবনবতীই
হোক।
মেয়েটি তাদের গ্রামের একমাত্র নয়। আরো ছিল, আছে। তাকে মনোনীত করা হয়নি
বললেও ভুল হবে। লটারীতে অন্তর্ভুক্তির মনোনয়ন তার আছে। আর সে হয়েছে
লটারীতে নাম ওঠা বিজয়ী। তার বিজয়ে গ্রামের সবাই আরেক দফা হুল্লোড় করে। কেবল
মেয়েটির মা, তার শিশুবেলায় দেখা কুমারী পুজার কথা
মনে করে। এই নতুন মানুষটা কেমন অগোচরে, অথবা এতগুলো মানুষের চাক্ষুস উপস্থিতিতে বেশ একটা
দেবতা, নাকি নবী এই রকম ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিয়ে নিচ্ছে। কিন্ত ত্রাণকর্তা কোন
সুবাদে? তাদের তো কোন দূর্যোগ নেই! মা বিড় বিড় করে এসব বলে আর শক্ত বাঁধনে মেয়ের
চুলের গোড়ায় গিঁট দেয়। খেলা শেখার জন্য তৈরী হচ্ছে সে। সমস্ত গ্রামের বিরুদ্ধে
গিয়ে কোন প্রতিবাদ রীতিবিরুদ্ধ আর তাছাড়া শুনবে কে তার কথা?
মেয়েটির প্রসব বেদনা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে থাকবে। সে ব্যথায় বেঁকে যায়। তার
চোখের মনি উলটে শাদা অংশ নীল দেখায়। কালো বেড়াল এবার আরো অধৈর্য্য হয়ে মাটি
আঁচড়ায়-গ্রামের এমন গল্পের পরিবেশে সে কি করে সন্তান সম্ভবা হলো? ‘জানি না কি
করে’ ছোট্ট
বাতাসের একটা দোলায় আখের পাতা বেয়ে এক রত্তি নিচে নেমে আসে। নিচে, মাটিতে, দুহাতে
কোমর চেপে ধরার প্রয়াসে মেয়েটি উপুড় হতে চায়। তার মনে পড়ে – একবার সে
সুযোগ মত মাতা মেরী বা বিবি মরিয়মের কাহিনী পূর্ণ নির্মাণ করে ফেঁদে ফেলতে
চেয়েছিল। তার মা রাজি হয়না। এখন নাকি যুগ পালটে গেছে। মানুষ আর অপ্রাকৃত কাহিনী
মানতে চায় না। তারা আগের চেয়ে বেশী যুক্তি বোঝে। মায়ের সঙ্গে সে তর্কে যায়
না। যদিও তার নিজের মতামত এর বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছে। তা হলেও- নিজের
সত্যিকে মনের সঙ্গে মিলিয়ে মিথ্যে বলা তার পোষায় না। কিন্তু সেইতো সত্যি
বলতে গিয়ে সে ছাড় পেলো না। গ্রামবাসী তাকে ঠিক ঠিকই আটকে দিলো। তার কব্জির হাড়
ভেঙ্গে ফেললো, যেন আজীবন সে এই হাত দিয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরতে না পারে। সে কি মনে করতে পারে কোন চিতানো বুক, চওড়াপিঠ
বেয়ে নামা সাপের মত মসৃণ কোমর, কোন দিন সে দু হাতে জড়িয়ে ধরেছিল? সে বরাবর চেয়েছে-
যখন তার কাউকে এমন জড়িয়ে ধরার সময় আসবে সে তার সব ইন্দ্রিয়ের প্রখর অনুভব চেয়েছে। দেখতে চেয়েছে-
ময়ালের মত ত্বক, ছুঁতে চেয়েছে জিভ, খেয়ে দেখতে চেয়েছে লালা, নাক ডুবিয়ে দিয়ে
বাহুমূলে ত্বকের ঘ্রাণ। তার শতভাগ বোধের মধ্যে অন্য মানুষের বোধ প্রবিষ্ট করাতে
চেয়েছে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে। কিন্তু কি করে তার ইন্দ্রিয় ঝিমিয়ে গেল, সে ঘুমিয়ে
গিয়েছিল?
‘জানি না কি করে’ অনন্ত
গাংচিলের মত নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে আখের সরু ধারালো পাতার ডগা অতিক্রম করে যায়। তার
গায়ে ভাঁজ পরে। পরের মুহূর্তেই আবারো সোজা হয়ে উড়তে শুরু করে।
কব্জির হাড় ভাঙ্গার শব্দটা খালি মাটির পাতিলে বাঁশের ফালি দিয়ে পেটালে যেমন হয়, তেমন
শুনিয়েছিলো। আর কেউ কেউ হয়তো সে শব্দ শুনেছে। তাদের কথা শুনতে সে আর থামেনি।
দৌঁড়িয়েছে। নিজের লোকালয় ছেড়ে ভিন্ন লোকালয়ে। সেখান থেকে আরেক অচেনা গ্রামে।
সবখানে সে একজন নতুন মানুষ দেখতে পেয়েছে। যে একটা নতুন খেলা শেখাতে তৎপর। তার
আয়োজনে সবাই এগিয়ে আসে। মেয়েটি সেই তৎপরতা পার হতে আরো জোরে জোরে হেঁটেছে।
ততদিনে তার শরীরে আরো এক নতুন মানুষ। তার অনিশ্চিত ভাবনা হয়- এও কি আরেক খেলা
শেখানো মানুষ হবে? তারপর একদিন সে নিজেকে না লোকালয়, না পথের মাঝামাঝি জায়গায়
আবিস্কার করে।
মেয়েটি ঘোলাটে চোখে আকাশ দেখে। তার ব্যথার লম্বাটে ধার বাতাস কেটে সেখানে
গিয়ে পৌঁছায় কি? ‘জানি না কি করে’ আরো একটু
নিম্নগামী হয়। তার ইচ্ছে কেউ তার গায়ে আরো কিছু কথা লিখুক। আরো কিছু ভারী শব্দ।
ব্যথার মাত্রা আর সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি এবার চিৎকার করে। তার সন্তান
মাথা বের করে পৃথিবী দেখতে চায়। বেড়ালের রাগী আঁচড় ততক্ষণে মাটিতে একটা অগভীর গর্ত
তৈরী করেছে। মেয়েটি ছেঁচড়ে হেঁচড়ে তার কাছাকাছি আসে। সঙ্গে সঙ্গে তার সন্তান
মাটিতে নামে। মেটে ধূলো মূহূর্তে লাল বর্ণ দিয়ে শিশুটির তুলতুলে ত্বকে আবরণ তৈরী
করে দেয়, আর সে তীক্ষ্ণ চীৎকারে জানিয়ে দেয় তার উপস্থিতি। জ্ঞান হারানোর আগে মেয়েটি
শুনতে পায় অসংখ্য পায়ের শব্দ। শিশুর কান্না শুনে পিল পিল করে মানুষ ছুটে আসছে।

লেখক পরিচিতি
নাহার মনিকা
জন্ম, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গে। পড়াশুনা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন।
বর্তমান নিবাস : কানাডা।
গল্পগ্রন্থ : পৃষ্ঠাগুলি নিজের।
কাব্যগ্রন্থ : চাঁদপুরে আমাদের বরষা ছিল।
0 মন্তব্যসমূহ