প্রবীর বিকাশ সরকার
স্বাধীনতার পর কুমিল্লা হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। ছোটরা থেকে সহপাঠী দীপকের সঙ্গে হাত ধরে দুষ্টুমি করতে করতে স্কুলে যাওয়া-আসা করি। ফৌজদারি চৌরাস্তা পেরিয়ে পুরাতন চৌধুরী পাড়ার রাস্তায় প্রবেশ করলেই দত্তদের মন্দিরওলা বাড়ি। এখনো আছে কিন্তু বড়বেশি নিষ্প্রাণ। সামনে এগিয়ে গেলে পড়ে টিএন্ডটি ভবন। আরও এগিয়ে গেলে তিনরাস্তার মোড় সেখানে অর্ধশতাব্দীপ্রাচীন সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকার অফিস। তার সামনে রুবীদির বাড়ি। তিনি এখন নেই শুনেছি মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। খুব মোটা ছিলেন বটে কিন্তু দারুণ মিষ্টি মুখশ্রীর অধিকারী ছিলেন। শিক্ষকতা করতেন ফরিদা বিদ্যায়তনে, তার থেকে অমূল্য শিক্ষা ও স্নেহ দুইই পেয়েছি যখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম ওই স্কুলে।
রুবীদির বাড়ি পেরিয়ে সামনে গেলে পড়ে কুমিল্লার আরেকটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইণ্ডাস্ট্রীয়াল প্রেস। এই প্রেসটির ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে একটি প্রাচীন বাড়ি। নামটি ভুলে গেছি একজন খ্যাতিমান আইনজীবীর। তার সন্তানরা আছেন বলে শুনেছি। এই বাড়িটি আমার জীবনস্মৃতিতে অত্যন্ত উজ্জ্বল। আমি যখন এই স্কুলে থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিই তখনো এই পাড়ায় আসতাম কারণে অকারণে। এই বাড়িটি থেকে একটি অপূর্ব সুন্দরী অষ্টাদশী বেরিয়ে রিকশায় চড়ে কলেজে যেত। যদিও বয়সে ছোট ছিলাম তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভালোবেসেছি। মেয়েটিকে আমার দুর্গাপ্রতিমার মতো মনে হত। গোলগাল ফর্সা মুখ, কপালে কালো টিপ, খোলা দীর্ঘ চুল, সুতির ছাপার শাড়ি-ব্লাউজে হালকাপাতলা গড়নের তাকে কী যে রূপবতী লাগত আমার দৃষ্টিতে কী বলব! অভিভূত হয়ে চেয়ে থাকতাম। তার নামও জানতে পারিনি কোনোদিন। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়তাম তাকে দেখলে সকালবেলা। দুএকবার যে চোখাচোখি হয়নি তা নয়।
একদিন এই বাড়ি থেকে শুনতে পেলাম একটি অসাধারণ গানের সুর: ‘সাত ভাই চম্পা জাগোরে জাগোরে / ঘুম ঘুম কাটে না ঘুমেরই ঘোরে / একটি পারুল বোন আমি তোমার / আমি সকাল সাঁঝে কত কাজের মাঝে / তোমায় ডেকে ডেকে সাড়া...........।’ হারমোনিয়ম বাজিয়ে কোনো মেয়ে গাইছিল। আমার বিশ্বাস ওই অনামিকাই হবে। অনেক দিন শুনেছি গানটি। গানটি প্রথম শোনা। কী ভীষণ ভালো লেগে গেল! তারপর যখনই কোথাও গানটি শুনতাম বিশেষ করে দুর্গা পুজো বা সরস্বতী পুজের সময় সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে মনে পড়ে যেত। এক ধরনের একতরফা বিরহযাতনায় জ্বলেপুড়ে যেতাম। কাউকে বলতে পারতাম না।
তারপর যখন কলেজে উঠলাম। প্রথম বর্ষের ছাত্র। তখন ছড়া, কবিতা লিখি। সাহিত্যচর্চা করি। একদিন একই পাড়ার বন্ধুর সঙ্গে একটি সংকলনের কাজে ইণ্ডাস্ট্রীয়াল প্রেসে গেলাম শেষবিকেলে। ঘড়িতে ছয়টা উৎরে গেছে। সেদিন ছিল বর্ষাকালের অঝর ধারার জলজ উৎসব। সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নতুন আষাঢ়ী জলের ধারা। হঠাৎ করে প্রেসের ভেতর থেকে নজর গেল বাড়িটির দিকে। একটি রিকশা এসে থামল। এবং একটি তরুণী নেমে ফটকের ভেতরে চলে গেল। মুখটা তার দেখা গেল না। ছাপার শাড়িটি জানিয়ে দিল আমায় মেয়েটি সেই অনামিকা। প্রেসে প্রুফ দেখছিলাম বন্ধুর সঙ্গে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। সঙ্গে বেশ বাতাস। আকাশে গুরু গুরু মেঘের ডাকগাড়ি কোথায় চলেছে জানি না। বন্ধুটি যার নাম স্বপন একটি স্টিক জ্বালিয়ে বাইরে এলো এবং আমাকে ইশারা করল। আমিও এসে কয়েকটি টান দিলাম। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। জিভটা শুকনো শুকনো অনুভূত হল। চোখে লাগল ঘোর। বৃষ্টিটাকে বিরহিনীর কান্না বলে সহসা মনে হল। ঘরের ভেতরে যাব এমন সময় ওই বাড়ির ভেতর থেকে কলের গান ভেসে এলো: ‘না যেও না / রজনী এখনো বাকি / আরও কিছু দিতে বাকি / বলে রাত জাগা পাখি.........।’ থমকে গেলাম। চরণ দুটো আটকে গেল দরজার কাছে। স্বপন প্রেসের ভেতরে চলে গেছে।
আমি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মুগ্ধনয়নে বাড়িটির দিকে তাকালাম। গাছগাছালি, ছাদ, ন্যাড়া উঠোন বৃষ্টির জলে অনবরত ভিজছে, মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত, কোথাও কেউ নেই শুধু গানটি বেজে চলেছে। মেয়েটিকে এক নজর দেখার জন্য আমি এক ঘণ্টা প্রতীক্ষা করেছিলাম, ফটক খোলা, বারান্দাও দেখা যাচ্ছে কিন্তু সে বেরিয়ে আসেনি একবারও ভুলেও।
এরপর যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। পার্থ মজুমদার নামে একটি ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হল ক্যাস্পাসে। সে যখন বলল পুরাতন চৌধুরী পাড়ায় থাকে এবং ইণ্ডাস্ট্রীয়াল প্রেসের উল্টো দিকে তখন ভীষণ চমকে উঠলাম! সেই অনামিকার নিরাভরণ মুখ ভেসে উঠল মনের আয়নায়। আমি এবার নিশ্চিত হলাম যে, এবার তার সঙ্গে সরাসরি দেখা হবেই।
পার্থর সঙ্গে একদিন তার বাসায় গেলাম। দালান ও টিনের ঘরের মধ্যবর্তী পথ ধরে তাদের বাসায় গিয়ে উঠলাম। পার্থর বাবা নেই মারা গেছেন মা আছেন। আর আছে বড়দা ও ছোটবোন। সবার সঙ্গে পরিচয় হল। আমার নজর চলে যাচ্ছিল বারংবার পাশের দালানবাড়িটির দিকে। চা পান করতে করতে আমি ফিসফিস করে পার্থকে বললাম, ওই দালানবাড়িটিতে একটি খুব সুন্দর মেয়ে থাকে। চিনিস?
পার্থ বলল, না। দু-একবার দেখা হয়েছিল আমরা যখন এই বাসাটি ভাড়া নিতে আসি। তারপর একদিন দেখি এবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে পডিরবারটি।
ধড়াস করে উঠল বুকের ভেতরটা: চলে যাচ্ছে মানে! চলে গেছে! কোথায়?
এই দালানবাড়িটি এবং টিনের ঘরটি আজও আছে। জরাজীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পালাবদলের প্রতীক্ষায়। হয়ত অচিরেই কোনো আকাশচুম্বী অট্টালিকা দখল করে নেবে এখানটা। এখন সেই দুরন্ত সভ্যতার যুগ। এখনো মাঝে মাঝে ইণ্ডাস্ট্রীয়াল প্রেসের মালিক চিত্রশিল্পী শাহরিয়ার সুলতান ভাইয়ের কাছে গেলে পরে বারংবার দৃষ্টি চলে যায় রাস্তার উল্টোদিকে। নিভৃতে হৃদয়নদীর ঘাটে জলতরঙ্গের সঙ্গে বেজে যায় অবিরাম: না যেও না / রজনী এখনো বাকি................
রুবীদির বাড়ি পেরিয়ে সামনে গেলে পড়ে কুমিল্লার আরেকটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইণ্ডাস্ট্রীয়াল প্রেস। এই প্রেসটির ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে একটি প্রাচীন বাড়ি। নামটি ভুলে গেছি একজন খ্যাতিমান আইনজীবীর। তার সন্তানরা আছেন বলে শুনেছি। এই বাড়িটি আমার জীবনস্মৃতিতে অত্যন্ত উজ্জ্বল। আমি যখন এই স্কুলে থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিই তখনো এই পাড়ায় আসতাম কারণে অকারণে। এই বাড়িটি থেকে একটি অপূর্ব সুন্দরী অষ্টাদশী বেরিয়ে রিকশায় চড়ে কলেজে যেত। যদিও বয়সে ছোট ছিলাম তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভালোবেসেছি। মেয়েটিকে আমার দুর্গাপ্রতিমার মতো মনে হত। গোলগাল ফর্সা মুখ, কপালে কালো টিপ, খোলা দীর্ঘ চুল, সুতির ছাপার শাড়ি-ব্লাউজে হালকাপাতলা গড়নের তাকে কী যে রূপবতী লাগত আমার দৃষ্টিতে কী বলব! অভিভূত হয়ে চেয়ে থাকতাম। তার নামও জানতে পারিনি কোনোদিন। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়তাম তাকে দেখলে সকালবেলা। দুএকবার যে চোখাচোখি হয়নি তা নয়।
একদিন এই বাড়ি থেকে শুনতে পেলাম একটি অসাধারণ গানের সুর: ‘সাত ভাই চম্পা জাগোরে জাগোরে / ঘুম ঘুম কাটে না ঘুমেরই ঘোরে / একটি পারুল বোন আমি তোমার / আমি সকাল সাঁঝে কত কাজের মাঝে / তোমায় ডেকে ডেকে সাড়া...........।’ হারমোনিয়ম বাজিয়ে কোনো মেয়ে গাইছিল। আমার বিশ্বাস ওই অনামিকাই হবে। অনেক দিন শুনেছি গানটি। গানটি প্রথম শোনা। কী ভীষণ ভালো লেগে গেল! তারপর যখনই কোথাও গানটি শুনতাম বিশেষ করে দুর্গা পুজো বা সরস্বতী পুজের সময় সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে মনে পড়ে যেত। এক ধরনের একতরফা বিরহযাতনায় জ্বলেপুড়ে যেতাম। কাউকে বলতে পারতাম না।
তারপর যখন কলেজে উঠলাম। প্রথম বর্ষের ছাত্র। তখন ছড়া, কবিতা লিখি। সাহিত্যচর্চা করি। একদিন একই পাড়ার বন্ধুর সঙ্গে একটি সংকলনের কাজে ইণ্ডাস্ট্রীয়াল প্রেসে গেলাম শেষবিকেলে। ঘড়িতে ছয়টা উৎরে গেছে। সেদিন ছিল বর্ষাকালের অঝর ধারার জলজ উৎসব। সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নতুন আষাঢ়ী জলের ধারা। হঠাৎ করে প্রেসের ভেতর থেকে নজর গেল বাড়িটির দিকে। একটি রিকশা এসে থামল। এবং একটি তরুণী নেমে ফটকের ভেতরে চলে গেল। মুখটা তার দেখা গেল না। ছাপার শাড়িটি জানিয়ে দিল আমায় মেয়েটি সেই অনামিকা। প্রেসে প্রুফ দেখছিলাম বন্ধুর সঙ্গে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। সঙ্গে বেশ বাতাস। আকাশে গুরু গুরু মেঘের ডাকগাড়ি কোথায় চলেছে জানি না। বন্ধুটি যার নাম স্বপন একটি স্টিক জ্বালিয়ে বাইরে এলো এবং আমাকে ইশারা করল। আমিও এসে কয়েকটি টান দিলাম। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। জিভটা শুকনো শুকনো অনুভূত হল। চোখে লাগল ঘোর। বৃষ্টিটাকে বিরহিনীর কান্না বলে সহসা মনে হল। ঘরের ভেতরে যাব এমন সময় ওই বাড়ির ভেতর থেকে কলের গান ভেসে এলো: ‘না যেও না / রজনী এখনো বাকি / আরও কিছু দিতে বাকি / বলে রাত জাগা পাখি.........।’ থমকে গেলাম। চরণ দুটো আটকে গেল দরজার কাছে। স্বপন প্রেসের ভেতরে চলে গেছে।
আমি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মুগ্ধনয়নে বাড়িটির দিকে তাকালাম। গাছগাছালি, ছাদ, ন্যাড়া উঠোন বৃষ্টির জলে অনবরত ভিজছে, মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত, কোথাও কেউ নেই শুধু গানটি বেজে চলেছে। মেয়েটিকে এক নজর দেখার জন্য আমি এক ঘণ্টা প্রতীক্ষা করেছিলাম, ফটক খোলা, বারান্দাও দেখা যাচ্ছে কিন্তু সে বেরিয়ে আসেনি একবারও ভুলেও।
এরপর যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। পার্থ মজুমদার নামে একটি ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হল ক্যাস্পাসে। সে যখন বলল পুরাতন চৌধুরী পাড়ায় থাকে এবং ইণ্ডাস্ট্রীয়াল প্রেসের উল্টো দিকে তখন ভীষণ চমকে উঠলাম! সেই অনামিকার নিরাভরণ মুখ ভেসে উঠল মনের আয়নায়। আমি এবার নিশ্চিত হলাম যে, এবার তার সঙ্গে সরাসরি দেখা হবেই।
পার্থর সঙ্গে একদিন তার বাসায় গেলাম। দালান ও টিনের ঘরের মধ্যবর্তী পথ ধরে তাদের বাসায় গিয়ে উঠলাম। পার্থর বাবা নেই মারা গেছেন মা আছেন। আর আছে বড়দা ও ছোটবোন। সবার সঙ্গে পরিচয় হল। আমার নজর চলে যাচ্ছিল বারংবার পাশের দালানবাড়িটির দিকে। চা পান করতে করতে আমি ফিসফিস করে পার্থকে বললাম, ওই দালানবাড়িটিতে একটি খুব সুন্দর মেয়ে থাকে। চিনিস?
পার্থ বলল, না। দু-একবার দেখা হয়েছিল আমরা যখন এই বাসাটি ভাড়া নিতে আসি। তারপর একদিন দেখি এবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে পডিরবারটি।
ধড়াস করে উঠল বুকের ভেতরটা: চলে যাচ্ছে মানে! চলে গেছে! কোথায়?
এই দালানবাড়িটি এবং টিনের ঘরটি আজও আছে। জরাজীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পালাবদলের প্রতীক্ষায়। হয়ত অচিরেই কোনো আকাশচুম্বী অট্টালিকা দখল করে নেবে এখানটা। এখন সেই দুরন্ত সভ্যতার যুগ। এখনো মাঝে মাঝে ইণ্ডাস্ট্রীয়াল প্রেসের মালিক চিত্রশিল্পী শাহরিয়ার সুলতান ভাইয়ের কাছে গেলে পরে বারংবার দৃষ্টি চলে যায় রাস্তার উল্টোদিকে। নিভৃতে হৃদয়নদীর ঘাটে জলতরঙ্গের সঙ্গে বেজে যায় অবিরাম: না যেও না / রজনী এখনো বাকি................
লেখক পরিচিতি
প্রবীর বিকাশ সরকার
গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, গবেষক
জাপান প্রবাসী
0 মন্তব্যসমূহ