পচন-প্রক্রিয়া বা বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে দেয়ার পরের গল্প--

শাহনেওয়াজ বিপ্লব

শীতের সন্ধ্যা মানুষজনকে তাড়াতাড়ি ঘরে ডেকে এনেছে। তারপরে রাত বাড়তে বাড়তে ক্রমশ গভীর হয়ে একসময় চাঁদও ওঠে। তবে,এত রাতে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের উঠা তো কুয়াশার জালে জড়িয়ে ওঠা। জ্যোৎস্না থাকলে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে পুকুর পর্যন্ত খাঁ খাঁ করত। আলো আঁধারির জন্য সেরকম শূন্য ঠেকছে না,কিন্তু আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত বিপুল জায়গা জুড়ে, ঘোরতর অনিশ্চয়তা যেন। জাহানারা পাতলা ঘুমের তন্দ্রার আগুনের শিখাতে স্বপ্ন দেখে-- আব্বাজান ডান ও বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ‘ইনশাল্লা’ বলে।


‘কী নাম কইলা? অমল বন্দ্যোপাধ্যায়। সে কি তোমায় হিন্দু হইবার প্রস্তাব রাখে? নিজে কি মোছলমান হইতে চায়? তাও না, তাজ্জব ব্যাপার! লাকুম দীনকুম ওয়ালিয়া–দ্বীন –যার যার ধর্ম তার তার;তোমার জন্য তোমার ধর্ম,আমার জন্য আমার ধর্ম।‘

-আমার ধর্ম? ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর গভীর সন্দেহের আবর্তে ধরা পড়ে গেল জাহানারা। তখনই শুনতে পেল-বুক থেকে হাত নামিয়ে শোও,বোবায় ধরেছে। অমল মুখে বলছে এ কথা কিন্তু উঠে গিয়ে জাগিয়ে দিচ্ছে না।

আঃ কতদিন পর আব্বাজান স্বপ্নে এলেন কিন্তু সেদিনের মতন আজও কিছু বললেন না। বললেন না, তার কী করা উচিত? একসময় জাহানারা আবার ঘুমের মধ্যে চলে যায়। সেখানে শুধু শৈশব থেকে অদেখা মানুষের চলন ঢেউ-এর মতন দুলতে দুলতে নিস্তরঙ্গ নদী হয়ে যায়। জোয়ারভাটা নেই,চুপচাপ। স্বপ্নে বোঝাও যায় না দিনরাত্রি। তবে নদীর সমস্ত চরাচর জুড়ে মানুষজন নেই-শূন্য খেয়াঘাট। একমসয় অন্ধকারের গাঢ়তাকে পর্যুদস্থ করে দুলে উঠে নৌকা। তখনই ভীষণ ভয়ে ঘুম ভেঙে যায় পুরোপুরি। জেগে শুয়ে থেকে অনেকক্ষণ পর বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে,জাহানারা বোঝে দু-পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে ওঠাটাই এখন সবচেয়ে কঠিন। নদীর স্রোতে ভেসে থাকা নৌকার মতন কেবলই দুলছে সে-তবুও দাঁড়াবার চেষ্টা করে। ‘চাদরটা জড়িয়ে নাও’-শুনে ঘরের দৃশ্যটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আলনার সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল,তিন্নি ঘুমের ভেতর পাশ ফিরে শুয়ে তার শুন্যস্থান পূরণ করে নিল। তবে কী সে, অন্ধকারের মধ্যেই দেখবার দৃষ্টি পেয়ে যাচ্ছে। না কী সেই বোধ কিছুতেই শূন্য থাকে না। সিংহাসন শূন্য থাকে না, গণতন্ত্র শুন্য থাকে না, মানুষের কিছুই শূন্য থাকে না- শূন্যতা ধ্বনিময় এই মুহুর্তেও বা। চাদরটা আলনা থেকে নিয়ে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ।

জাহানারা বারান্দায় এসে দাঁড়ালে পরে দেখে-রাস্তার আলোর প্রতিবিম্ব পুকুরের জলে চির চির করে ভাঙছে উত্তরের হাওয়ায়। হঠাৎ হঠাৎ মাছেদের বুজগুড়ি কাটবার আওয়াজ সব মিলিয়ে এমনই এক অপ্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যার ফলে তিন্নির জন্য আশঙ্কাই বাড়ে। তিন্নি জম্মাবার পর হাসপাতালের বেডে যখন তার কোলে দেওয়া হয় তখন তার মনে হয়েছিল মাতৃগর্ভই শিশুর বুঝি নিরাপদ স্থান ছিল। হাসপাতালেরই এক ডাক্তার তাদের পরিচয় পেয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছিলেন,তিন্নি বড় হলে কি হবে,মুসলিম না হিন্দু? জাহানারা বলেছিল, জানিনা । কিন্তু জানিনা বললে কী হবে। অমলকে বিয়ে করার পর থেকেই এই প্রশ্ন ধেয়ে এসেছে কেবল। তাই বাথরুমের অন্তরালে এসব মনোকষ্টে মাঝে মাঝে কাঁদে জাহানারা । তবে আজ ঠিক কান্না নয়,এক ধরনের গোঙানি বা বহুদিন ধরে ভিতরে ভিতরে যে কান্নার প্রকরণ চলছিল তারই বহিঃপ্রকাশ হয়ে সশব্দে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে যেন তার সব দুঃখমালা । আর বুঝি গোপন থাকছে না এই চাপাকান্না-এ আশঙ্কায় পানির কল খুলে দেয়, জাহানারা। শব্দের পিছু পিছু পানি এসে নির্ঝরে বয়ে চলেছে। জাহানারার কান্নায় ডুবে যাচ্ছে এই মধ্যরাত্তিরে ভূগর্ভস্থিত জলকে ওপরে নিয়ে এসে আবার ভূগর্ভে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে।.......হায় আল্লাহ এবার কী হবে? বিসমিল্লাহ বলে অজুর নিয়ত করে,প্রথমে ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত পরে বাম হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধুয়ে ডান হাতের তালুতে পানি নিয়ে নাক দিয়ে টানবার জন্য নিজের অজান্তে চেষ্টা করে একসময়। আর তখনই সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে বাথরুমের দেওয়াল ভয়ঙ্কর সাদা। এত সাদা যে তার ভয় হয়।

যা ভেবেছিল তাই হল, অমল বিছানা থেকে উঠে এসেছে দেরি দেখে। এই অনুসরণ যেন রোদ হাওয়া পরস্পর পরস্পরকে অনুসরণ করে গর্ভবতী মেঘের আকৃতি নেওয়া,আর তাতে আছে বৃষ্টির প্রস্তাবনা। এ কী প্রেম না দাম্পত্য? তথাপি এই অনুসরণের মধ্যে প্রশ্ন হয়তোবা আছে-কাজটা ঠিক হয়েছে কিনা? এই প্রশ্ন কি আগেও উঠেনি? উঠেছে। কিন্তু পর্বতশীর্ষ থেকে নীচে নামবার পদ্ধতি জানা না থাকার ফলে প্রশ্ন;প্রশ্নই রয়ে গেছে। অমল দরজায় টোকা দিতেই ‘জী’ বলে জাহানারা বাইরে এলে বাথরুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে দরজার স্বাভাবিকত্বে। কিন্তু তীব্র ফিনাইলের গন্ধ বুকে নিয়ে সব ভীতি একাকার হয়ে যাচ্ছে অমলের কণ্ঠস্বর। অমল কোনও মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠে- জাহানারা এত হতাশার কী আছে।

-জী,বলে সভয়ে পিছিয়ে আসে জাহানারা। কিন্তু আলো-আঁধারির মধ্যে দুই ছায়া মানুষ মুখোমুখি নির্বিকার আবার। কুয়াশা জমাট বেঁধে উঠোনের কাঁঠাল গাছের পাতা থেকে শিশিরের টুপটাপ শব্দ বড় ব্যঞ্জনাময় এখন। খুব সন্তর্পণে বিছানায় লেপের ভেতর ঢুকতে গেলে বোঝে তিন্নি তার শরীরের শৈত্যপ্রভাব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।


... দুই...


রাতের এ সময়টা অমল কিছু পড়াশোনা করে। জাহানারা কাটায় নিজের মতন টিভি দেখে,তিন্নির সাথে লুডো খেলে আর কখনও-সখনও হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বসে। টিভি খোলাই ছিল। ‘মা, তোমার পাকা ঘুঁটি খাওয়া পড়ল’। জাহানারা স্থির। ভাববার চেষ্টা করেই যাচ্ছে ঠিকঠাক শুনেছে তো? ঠিক-ঠাক দেখেছে কি? না অনেকসময় যা হয়,মনের মধ্যে যে ভয়টা থাকে তারই ছায়াতল সৃষ্টি করে দেখবার দৃষ্টিপথ জুড়ে,তা নয় তো? ও ঘরে অমলের কানেও সংবাদের শিরোনাম গিয়েছিল-বাবরি মসজিদ ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। ডিটেইলসে শুনবার জন্য উঠে এসেছে এ-ঘরে। একের পর এক প্রতিবাদের সংবাদ বিবৃত হচ্ছে। কথকথার ভারী গলাতে, শব্দ-প্রেক্ষণের পেশাদারিত্বের রপ্ত কায়দায়,বোঝাতে চাইছে বিষয়ের গুরুত্ব।

-বন্ধ করলে কেন?

-কী হবে এসব শুনে টুনে? এর চেয়ে আমাকে এখন নিরাপদ আশ্রয়ের কথা ভাবতে হবে। যে কোনও সময় হামলা হতে পারে,আমাদের গুতিকতক মানুষের এই হিন্দুপাড়ায় ।

‘এবার খাবার দান ছক্কা’। আবার দান ফেলে তিন্নির ঘুঁটি বর্গক্ষেত্রের মধ্যে বসে পড়ল তখন মা-র দিকে তাকিয়েই বুঝে নিয়েছে মা আর খেলবে না।‘হেরো কোথাকার’? হেরে যাচ্ছে বলে খেলবে না?- একসময়ে কেঁদেই ফেলে প্রায় তিন্নি।

-ওরকম করে না তিন্নি- মা-কে এখন বিরক্ত করো না।

কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে তিন্নি মুখ তুলে তাকাতেই দেখে মা তার দিকে তাকিয়ে স্থির।হিন্দু বিয়ে করেছে এই অপরাধে চাচাতো ভাই ইলিয়াস ছাড়া; জাহানারার মা আর আত্মীয়স্বজনরা সবাই ত্যাগ করেছে তাকে। হিন্দু-পাড়ায় হামলা হলে,এই মুহূর্তে অমলকে নিয়ে কোথায় যাবে,বসে বসে ভাবছে সে । অমল ছাদের দরজায় তালা লাগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বারান্দার দিকে চলে যায়। বারান্দায় গ্রিলের তালা লাগিয়ে বাতি নিভিয়ে ঘরে এসে দেখে জাহানারা সেইভাবেই বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় জাহানারার মুখে যে প্রতœতত্ত্ব তৈরি হয়েছে তার ভাষা এতটাই অসহায় যে, অমল বুঝে উঠতে না পেরে বলে-ইলিয়াসকে ডাকব?

ইলিয়াসের নাম শুনেই তিন্নিকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে,জাহানারা । কান্নার সূত্র ধরে যে বাক্যটি কোনোমতে শেষ করতে পেরেছিল জাহানারা তা, ইলিয়াস বলে গিয়েছিল কদিন আগেই, ‘অমলকে মুসলমান-বিরোধী কোনও ছুতো পেলেই ওরা মেরে ফেলবে- মুসলমানের মেয়ে বিয়ে করার দুঃসাহস দেখানোর অপরাধে’ ।

ইলিয়াসই একমাত্র ব্যক্তি, যে তাদের এই বিদ্রোহী জীবনে একমাত্র সহানুভুতিশীল কিন্তু তারও প্রশ্ন, তিন্নি বড় হয়ে কী হবে, হিন্দু না মুসলমান ? এর উত্তর অবশ্য অমলেরও জানা নেই, কেননা একটু আগেই দেখেছে কয়েকঘন্টার মধ্যে পাঁচশ বছরের একটি মসজিদ গুড়িয়ে দিতে আর পৃথিবীতে যত দাঙ্গা হয়েছে তাতে শিশু ও নারীই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু অমল কী মুসলমান হয়ে যাবে, তার মেয়ে তিন্নির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে? অবশ্য,যদি মনের তাগিদ না থাকে তাহলে শুধুমাত্র তিন্নির জন্যে মুসলমান হবার দরকার নেই, বলে দিয়েছিল জাহানারা। অমল তখন পক্ষে বিপক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষ হয়ে গিয়েছিল। নিরপেক্ষতা যে নিরাপদ দূরত্ব নয় সে এখন বুঝতে পারছে।

আবারো চালু করার পর থেকে টেলিভিশনের সংবাদে একটানা দেখিয়ে চলছে কুন্তি আর শাবল হাতে শিবসেনা সদস্যরা কীভাবে উপড়ে ফেলছে গম্বুজের উপরের চাঁদটি । দৃশ্যটি দেখতে দেখতে,অবচেতনে অমল ফিরে যায়, তার ছোটবেলার চাঁদ দেখার ঘটনায়-

সেবার,কী করতে যেন পুকুর পাড়ে গেছি,দেখি পায়ের কাছে চাঁদ। মুখ তুলতেই দেখি চাঁদটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তখন বাড়ি আর পুকুর একই সীমানার মধ্যে। এরকম ঘনবসতি কোথায়? সামনের কুণ্ডুপাড়া বাদ দিলে সবটাই ফসলের ক্ষেত। যতই সামনে যাই চাঁদ ততই পিছিয়ে যায়। টলটলে চাঁদের অস্পষ্ট প্রতিফলন ধানগাছের মাথা জমা হিমে। অনেকটা সারাদুপুর ধরে দেওয়া গোটা বাড়ি জুড়ে মায়ের আলপনার ধান্যছবি। কতদূর... কতক্ষণ হেঁটেছিলাম জানি না কিন্তু চাঁদ হঠাৎই লুপ্ত হয়ে যায় একটি বড়ো গাছের আড়ালে। তখনই ভয় পেয়ে কেঁদে উঠেছিলাম। গাছ কি কথা কয়? সেদিন মনে হয়েছিল, গাছই কথা বলছে- কোথায় যাবে খোকা!

‘চাঁদ দেখতে দেখতে এতদূর চলে আসা’। উকিলবাবুর বাড়ির ছাওয়ালা না? মা জননী কত কাঁদছেন- চল চল বলে কাঁধে তুলে রওনা হয়েছিলেন ফকির সাব।

চাঁদতো এবার পেছনে পড়ে গেল। কিন্তু তার পায়ের নীচে থই থই জ্যোছনা। যত এগুচ্ছে ততই গড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে পৌঁছে দেখি হুলস্থুল কান্ড। লক্ষীপূজোর ফুল বেলপাতাসহ পট ঘট সবই পুকুরের জলে ভাসছে। পুকুরে জাল ফেলার জন্য জেলেরা চলে এসেছে যদি ডুবে গিয়ে থাকি। আমাকে ধান দুর্বা দিয়ে ঘরে তোলা হয়েছিল। একসময় ফকিরের কাছে নিয়ে গিয়ে বাবা বলেছিল-ওকে একটু দয়া করেন ফকির সাব। আপনার জন্যই তো ফিরে পেলাম।

ফকির বলেছিল দোয়া সে তো কঠিন আরবি শব্দ, মনে থাকে না- চাঁদ তো দেখবারই জিনিস।

চাঁদ তো দেখবারই জিনিস। অমল দেখেছে, জ্যোছনা কাঁঠাল গাছের পাতা ভেদ করে আলোছায়ায় মাখামাখি হয়ে আছে বারান্দায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে জানলা দিয়ে আছড়ে পড়ছে ঘরে। সেখানেই সে বসে আছে এতক্ষণ পরে খেয়াল হল অমলের । সে চমকে উঠে তাকাতেই দেখে,জাহানারা তারই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। এখন তাকে ছাড়া জাহানারা যে কিছুই দেখছে না ভেবে,অমল একটু নড়েচড়ে বসে ।


...তিন...

মায়া বৌদির ডাকাডাকিতে ভোরের ঘুম ভেঙে যায় অমলের। বাইরে এসে শুনে পুকুর পাড়েও হইচই। সমস্ত মাছ পুকুরে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে, কারা যেন। জাহানারার চাচাতো ভাই ইলিয়াসও এসেছে ঘটনাটা শুনে। এসেই গালিগালাজ এর থুবড়ি ফোটাচ্ছে । একবর্ণ কোরান শরীফ জানে না,হারামিরা ধর্ম মারাচ্ছে। যারা একবেলা মসজিদে যায়না, তারাও এখন ধর্মের জন্যে মায়াকান্নায় নেমেছে ইত্যাদি...ইত্যাদি ।

সারাদিন ধরে সরকারি কার্ফু উপেক্ষা করে পুকুরে মাছ ভেসে উঠেছে। এক একটি বড়ো মাছ ভেসেছে আর অমনি ইলিয়াস ভাই চিৎকার করছে-দ্যাখ দ্যাখ,শালাদের দোযখেও স্থান হবে না। একেবারে সন্ধ্যার মুখে ইলিয়াস ভাই সন্দেহ করে নিশ্চয় কেউ বিষ দিয়েছে পুকুরে; যার ফলে প্রথমে মাছেদের কানকো এফেক্ট করে, তারপরে, দমবন্ধ হয়ে মরে গেছে । মাছের মৃত্যু ঘটার প্রক্রিয়ার মধ্যে জিপের মাথায় মাইক বেঁধে সরকারি লোকজন ঘোষণা করে গেছে-সম্প্রীতে বজায় রাখুন।

এ শহরে একসময়ে বেশ কিছু হিন্দু থাকত। মন্দিরের প্রশস্ততা দেখলেই তা বোঝা যায়। শত্রু সম্পত্তি হয়ে হিন্দুদের সব সম্পত্তি নানা দলের নেতাদের কাছে চলে গেছে আইনি কায়দায়। শ্মশানখানাও ছিন্নমূলদের দখলে। হিন্দু বলতে তেমন কোনো স্থায়ী বাসিন্দা নেই, এরকম তথ্যই এবার বেরিয়ে এসেছে সার্ভেতে। এইরকমই শুনেছে অমল।

অমল পুকুর পাড় ঘুরে এসে বলে-একবিন্দু জল দেখা যাচ্ছে না,সব মরা মাছে ঢেকে গেছে। ইলিয়াস ভাইকে বলে এলাম,কেউ যেন এ মাছ না খায় অসুখ-বিসুখ করতে পারে।

-পাহারা বসানো দরকার ?

কারা পাহারা দেবে? হতাশ ভঙ্গিতে অমল মাথা নাড়ে,সে জানে না। যেমন সে বোঝে না,তিন্নি কী তার মা-কে জড়িয়ে জীবনে প্রথম মুসলমানকে চিনছে? তিন্নি ঘুমিয়ে পড়বার পর গভীর রাতে জাহানারা জানতে চায়, সত্যিই কি পানি একটুও দেখা যাচ্ছে না? মুর্দা মাছের লাশে সমস্তই ঢেকে গেছে?

প্রশ্ন শুনে অমল বিছানা থেকে উঠে এলে মনে হয় জাহানারা তাকে ঠিক দেখছে না, তাকে ভেদ করে দৃষ্টি বেরিয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব বিষন্ন চোখের মধ্যে ফুটে উঠেছে উপায়অন্তহীন আমন্ত্রণের ভাষা।

দুপুরে খেতে বসে জাহানারা বলে ওঠে একটা গন্ধ আসছে। তিন্নি নাক কুঁচকে কিছুটা বাতাস নিয়ে বলে, কই? কেউ গন্ধ পাচ্ছে না। কেবল জাহানারাই পাচ্ছে। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনার পর থেকে, অমলকে নিয়ে দুশ্চিন্তার দিনরাত্রি এমন এক বয়স্কতায় পৌঁছিয়ে তাকে ক্রমশ অবসাদগ্রস্ত করে ফেলে। তার কিছু ভালো লাগছে না। দুর্গন্ধ যেন চেপে আসছে। খাওয়া অসম্পূর্ণ রেখে উঠে যায় জাহানারা। তিন্নি ডাকতে যাচ্ছিল,অমল চোখের ইশারায় না করে।

-গন্ধটা এখন না পাওয়া গেলেও পরে পাওয়া যাবেই, মাছগুলো পচতে শুরু করেছে।

কার্ফু উঠে গেছে । ইলিয়াস কয়েকজনকে সাথে নিয়ে থানা সদরের টিএনও’র সঙ্গে দেখা করে জানায় দু-একদিনের মধ্যে মাছগুলো যদি তুলে না ফেলা হয় তবে রোগ ছড়াতে পারে। প্রকৃতপক্ষে আমি তখনই প্রথম শুনলাম, এ শহরে বিষ দিয়ে সব মাছ মেরে ফেলা হয়েছে- এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। যা হোক, ব্যাপারটা ‘দেখব’ বলে ইলিয়াসদের আশ্বস্ত করি।

পরদিন অফিসে এসেই অমলবাবুকে ডেকে পাঠাই। এই মানুষটিকে অফিসের সকলেই চেনে, মুসলিম কন্যা বিয়ে করার জন্য না অধ্যাপনা পেশার জন্য বুঝতে পারিনি।--ব্যবস্থা একটা করা দরকার।

কথা না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। এরপর সমস্ত প্রশাসক যা বলে---আপনি ব্যবস্থা করেছেন না কেন?---কোথায় ফেলব এত মাছ? এসব তর্কাতর্কিতে না গিয়ে আমি অধোমুখে শেষে,একটা প্রশ্ন করেছিলাম----কাউকে সন্দেহ করেন?

--আমি এখন নিজেকেই সন্দেহ করি। শুনেই মুখ তুলে দেখি অমল বাবু বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন।


...চার...


পুরনো একটি কাজের সূত্র ধরে এ শহরে দু-একদিনের জন্য এসেছি। সেবার বদলির জন্য কাজের চাপে ঠিক পরিচিত হতে পারিনি অমলবাবুর সঙ্গে। কৌতুহল ছিলই। পূর্ব পরিচয়ের সামান্য সূত্র ধরে দেখা করতে গেলাম। জাহানারাকে ডেকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কথায় কথায় সেদিনের প্রসঙ্গ উঠে এল। ঘটনাটার জন্যে এখনও নিজেকেই সন্দেহ করেছেন কি না, জানতে চাইলে জাহানারা নাকে আঁচল চাপা দিয়ে উঠে গেল মুহূর্তে। পিছন পিছন অমলও। শুধু যাওয়ার সময় একটু অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলল---আসছি।

বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানাল, জাহানারা আবার সেই পচা মাছের দুর্গন্ধ পাচ্ছে,একটু অসুস্থ বোধ করছে। এরপর আর বসা যায় না। উঠে আসতেই বাড়ির ভেতর থেকে বমি করবার আওয়াজ পেলাম।

তবে কি আমার উপস্থিতির জন্য সেই গন্ধটা আবার ফিরে এসেছে। না কি আমরা কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নই।


লেখক পরিচিতি
শাহনেওয়াজ বিপ্লব
সুইডেনে থাকেন।
গল্পকার।
পেশায় চিকিৎসক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. সুক্ষ্মভাবে আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করানো। ধন্যবাদ প্রিয় গল্পকার।

    উত্তরমুছুন
  2. লেখার গাথুনি ভাল না

    উত্তরমুছুন