ছোট্ট জেলা শহর। সাড়ে দশটা মানে অনেক রাত। বাড়িগুলো আলোর ঝাপ্টা নামিয়ে যে যার মতো শুয়ে পড়েছে। এতোক্ষণ কারো কারো চোখে ঘুম এসে গেছে। আর যাদের আসেনি, তাদের বেশির ভাগই শয্যাসঙ্গীর সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতূকে ব্যস্ত। আশ্বিনের পাতলা বাতাসে তাদের উৎক্ষিপ্ত (চাপা) শব্দগুলো শিমুল তোলার মতো ফটফট করে ফাটে। তাতে উঠতি বয়সীদের ঘুম ভেঙে গেলে তাড়নার আগুনে পুড়ে মহল্লাকে মহল্লা। আর কেউ কেউ ইনসোমনিয়ায় পোড়া চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে ব্রহ্মপুত্রের দিকে। তাদের চোখের খাণ্ডব দাহনে রাতে রাতে শুকিয়ে যায় নদীটি। আর বাষ্পীভূত জলগুলো জমা হয় তাদের চোখের কোলে। দূরাগত অতীতকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে আফসোসের ঢেউ ভাঙে তারা।
পুরো শহরটাকে আড়ি মেরে জনসন রোডের পুরনো একতলা বাড়িটা চোখ মেলে চেয়ে আছে সার্কিট হাউজের দিকে। বাড়ির সামনে একটা পুলিশ ভ্যান। তাতে চারজন সেপাই উলট-পালট হয়ে শুয়ে আছে। যেন রাতের ট্রেনে ঘুমের ওষুধ খেয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া প্যাসেঞ্জার। পুরো রাস্তা সুনসান। কয়েকটা কুকুর খুব ব্যস্ত ভাব নিয়ে ছুটছে। নিজস্ব ভাষায় তারা তেজীগলায় ভাব বিনিময় করছে। পুলিশ ভ্যানটার সামনে এসে কুকুরগুলো আওয়াজ থামায়। সম্ভ্রমে নিঃশব্দে এড়িয়ে যায় গাড়িটাকে। সকালে আঁস্তাকুড়ের আড়াল থেকে পরম কৌতূহলে এই পুলিশদের ছোটাছুটি দেখেছে কুকুরগুলো। রাত হতেই যেন তাদের অনুকরণে চতুষ্পদীগুলো নেমে পড়েছে নৈশ মহড়ায় । বাড়িটাকে পাস কারতে গিয়ে একবার উঁকি দেয় কুকুরগুলো। শহরের সব গর্দানওলা এসে ভিড়েছে এখানে। পোর্টিকোর পাশে বড়ো রুমটায় গমগমে আওয়াজ হচ্ছে।
পুরনো চাপিলাশের একটা চেয়ারে বসে এক ভদ্রলোক ঘন ঘন ঘামছেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে কুকুরগুলোর একধরণের পরোক্ষ সংযোগ আছে। বলতে পারেন ইনিই তাদের অন্যদাতা পিতা। তার অবহেলা অথবা উদারতায় মাসকে মাস শহরের ডাস্টবিনগুলো ময়লা আবর্জনায় ভরপুর থাকে। সুশীল সারমেয়গণ অহর্নিশ তাতে অনুসন্ধান কর্ম চালিয়ে যায় নির্বিবাদে। ভদ্রলোক জনাব আরফানউল্লাহ হারু নয়নমোহিনী পৌরসভার মেয়র। এটা কোন বিষয় নয়। গত ৯ বছর ধরে হাইকোর্টের মামলার জোরে নির্ঝাঞ্ঝাটে আগলে রেখেছেন পদটা। আরো বছর পাঁচেক তাইরে নাইরে করে চালিয়ে দেয়ার হিম্মত আছে তার। সর্বসাম্প্রতিক সংযোজন- গত মাসের সাধারণ নির্বাচনে তার দল সরকার গঠন করেছে। মেয়রের পদের পাশাপাশি তিনি সরকারি দলের শহর শাখার প্রধান। আসছে মঙ্গলবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আসবেন এই শহরে। নয়নমোহিনীর মানুষ জনের নয়ন জুড়াতে। বাতাসে খবর ভাসছে, এ যাত্রায় তিনি এই জেলা থেকে একজনকে মন্ত্রীর মুকুট পরিয়ে নিয়ে যাবেন ঢাকায়। আর সেটা হারু চেয়ারম্যান (মেয়র হলেও লোকে কেন জানি চেয়ারম্যানই ডাকে তাকে) ছাড়া যে অন্য কেউ নন মোটামুটি তা স্থির। এ আনন্দে গর্দানশীলরা আত্মহারা হয়ে যেন জনসন রোডের এই বাড়িটা ছাড়ছেই না।
কিন্তু হারু চেয়ারম্যান খুব একটা যে আনন্দিত তা মনে হলো না। পর্দার আড়াল থেকে তাকে দেখে মিসেস হারুর আফসোস ঝরে পড়ে। তিন বছর আগের পাইলসের সমস্যাটা আবার গুহ্যদ্বারে উঁকি দিয়েছে। সোজা হয়ে বসাটাই তার জন্য এখন কষ্টকর। তার ওপর পেটের ভেতরে চলছে অবিরাম সিজ ফায়ার। কিছুক্ষণ পর পর গোলা ছাড়তে হয়ে বেদনাক্রান্ত মলদ্বারকে আহত করে করে। সেই যন্ত্রণা আড়াল করতে খেঁকিয়ে উঠেন চেয়ারম্যান সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে হালকা একটা বাতাস বেরিয়ে পড়ে। ফুটুস।
‘অনেক বরদাস্ত করছি, আর না’।
ঘোষণাটি দিয়ে হাতলে দুহাত ভর করে পশ্চাৎ উত্তোলন করেন। পুঞ্জীভূত উষ্ণ বায়ুরা দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। পাশের লোকজন জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
‘আমার ডিস্টিকে চাকরি করতে হইলে আমার কথা মতো চলতে হইব’।
শ্রোতারা আবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় হারু চেয়ারম্যানের দিকে। সাংঘাতিক যুক্তিপূর্ণ কথাটিতে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। গত মাস থেকে হারু চেয়ারম্যান পুরো জেলাটিকে তার পৈত্রিক সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেছেন। পাঁচ ছয়টা মামলার বেড়াজালে পড়ে গত তিন বছর জেলার চৌহদ্দিতে পা রাখতে পারেন নি। মাস চারেক হয় নরম পায়ে বিড়ালের মতো মিটসেলফে উঠার চেষ্টা করছিলেন। শেষ ধাপে উঠে এখন দেখেন তিনি আসলে বিড়াল নন, বিড়াল জাতীয় প্রাণী। রীতিমতো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। অতএব হালুম করা তার স্বভাবের অংশ হওয়া উচিৎ। প্রথম হালুমটা ছেড়েছিলেন এলজিইডির এক্সেনের উপর। এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে কোন রকমের কোর্ডিনেশন করছিল না ব্যাটা। আছে খালি তলে তলে পয়সা বানানোর তালে। এটা হচ্ছে ঘটনার উপরিতল। গর্ভে অন্যবস্তু লুক্কায়িত। ৫ কোটি টাকার কাজ কাউকে কিছু না জিগগেস করে ঢাকার কোন পার্টিকে দিয়ে দিয়েছে এক্সেন। দিয়েছিস ভালো কথা, এলাকার মুরব্বীর ভাগ কই। কয়েকবার ইঙ্গিত করে কাজ হয়নি। তাই পরশু স্ট্যান্ড রিলিজ করিয়ে ছেড়েছে হারু চেয়ারম্যান। হারু এখন ক্ষুধার্ত বাঘ। বিশেষ করে প্রথম থাবায় বড়ো শিকার কাবু করতে পেরে। তার পরবর্তী নজর এখন ডিসি’র দিকে। তার ওপর খ্যাপার বড়ো কোন কারণ নেই। একটু চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে, কিন্তু লোক খারাপ না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে হারমনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গায়। এতো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও দাড় কাকাটা একটা ভুল করে বসেছে। কোরবানি ঈদের সময় হারু চেয়ারম্যানের বাসায় যে কেজি তিনেক গোস্ত পাঠিয়েছিল সে কেবল হাড় আর হাড়। হারু চেয়ারম্যান বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছে, এমপি’র বাসায় পাঠানো মাংসে কোনো হাড় চর্বির নাম গন্ধ ছিল না। তাহলে কি সে ধরে নেবে হাড়গুলো তাকে গছিয়ে দিয়ে মাংস পাঠানো হয়েছে এমপি’র বাসায়! কী অপমান! এই এমপি কী তোর ডিসিগিরি বাঁচাতে পারবে। মনে মনে ফুসছিল হারু চেয়ারম্যান। এর উপর দলের মাঝ সারির নেতা একটা গুরুতর অভিযোগ নিয়ে এসেছে তার কাছে। টিসিবি’র ডিলারের লাইসেন্স পাওয়ার সুপারিশ নিতে সে নাকি ডিসি’র বাংলোয় গিয়েছিল। ডিসি মুখের উপর বলে দিয়েছে, সম্ভব না, আপনার রেকর্ড খারাপ।
‘রেকর্ড বাজানোর জন্য কোন লোকরে আমার ডিস্টিকে আমি রাখব না’। হারু এই বলে উপসংহার টানলেন।
যুব শাখার সভাপতি মীর মঈন কথার কিউতেই ছিলেন রাশ ধরবার আশায়।
‘হারু ভাই এবার আমার ব্যাপারটা একটু সিরিয়াসলি নেন। রেকর্ডপত্রে তো সব ঠিকঠাক কইরা ফালাইছি। খালি বিআইডাব্লুটিএ’রে একটু অফ কইরা দেন’।
হারু মীর মঈনের দিকে ভ্রুকুটিল করে তাকিয়ে থাকেন। মনে করার চেষ্টা করেন পুরো ব্যাপারটা। আস্তে আস্তে স্মৃতিতে ফেনা তোলে মীর মঈন। মঈনুল আলম ইদানীং কবি হয়ে নাম রেখেছে মীর মঈন। দু’দিন পর পর সাহিত্যসভা করে ঢাকার বড়ো বড়ো রাইটারদের এনে ড্রামকে ড্রাম কেরু সাবাড় করে। তবে তার মূল ব্যবসা পানিকে ঘিরে নয়। তার ব্যবসাটা সব্জির। লঞ্চ ঘাটের পাশে একসময় যে বিরাণ জায়গটা ছিল কাশবনে ঢাকা, একদিন চার খুঁটির ওপর একটা টং ঘর তুলে মীর মঈন সেখানে তার ভাগ্যের গাঁথুনি দিতে শুরু করেন। দেখতে দেখতে লঞ্চঘাট থেকে শ্মশান ঘাট পর্যন্ত প্রায় হাফ কিলো এলাকা ছোট বড়ো টংঘরে সুসজ্জিত হয়ে গেছে। প্রতিদিন নৌকা ও লঞ্চে করে ফল ও সব্জি আসে এখানে। এরই মধ্যে মীর মঈন ৮-১০ টা মিনি ট্রাকের মালিক হয়ে গেছে। এসব গাড়িতে করে আশেপাশের কয়েক জেলায় চলে যায় সব্জিগুলো। প্রতিমাসে ভাড়াবাবদ লাখ লাখ টাকা আসে এই আড়তগুলো থেকে। গত সরকারের প্রথম দিকে এই আড়তের দখল নিয়ে বড়ো একটা খুনাখুনি হয়েছিল। মীর মঈন ব্যবসায়ী লোক। সব সময় ভাও বুঝে চলেন। তখন সে সরকারি (তখনকার) দলের ছাত্র শাখার সাধারণ সম্পাদক। কোনদিন পড়ার জন্য কলেজে না গিয়েও সরকারি কলেজের পলিটিক্সটা সেই চালায়। ফলে এমপি সাহেবের শ্যালককে দিয়ে সাময়িক একটা আপোসরফা করেছিল। এবার সরকার চেঞ্জের পর তার মনে হলো এভাবে আর কয় দিন। একটা স্থায়ী বন্দোবস্তের দিকে এগুনো উচিৎ। হবু মন্ত্রী চাইলে এর একটা সুরহা করে দিতে পারেন সহজেই।
‘আরে মঈন ধৈর্য্য ধরো’। জেলা হকার পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ ফকিরউল্লাহ ফ্যাসফ্যাস করে বলে উঠল। ‘এক মোরশেদ ভাই চারটা মিনিস্ট্রির চার্জে আছে। একটা তো ছাড়ন লাগব। নৌপরিবহন তো ধরো দিতে হইলে আমাদের হারু ভাইরে বিকল্প কই’।
‘আমার তো মনে হয় না ইনল্যান্ড ওয়াটার হারু ভাইয়ের ভাগে যাইব। বরং লেবার কি ফিশারিজ একটা যাইব। মোরশেদ ভাইয়ের সেলফ ইন্টারেস্ট আছে ইনল্যান্ডের প্রতি’। প্রেসক্লাবের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম শেখ ফকিরকে বাগড়া দেয়।
হারু চেয়ারম্যানের ভেতরে বয়ে চলা যন্ত্রণার অন্তসলিলা নদীটা ছলাৎ করে উঠে। পাছার নিচে গুঁজে রাখা পা দুটো নাড়িয়ে চাড়িয়ে গুহ্যদ্বারটা একটু প্রসারিত করেন প্রশান্তির আশায়। এদিকে সিজ ফায়ার শেষে পেটটা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। এখন শরীর আর অতীতের সংগ্রামী ঐতিহ্য বয়ে বেড়াতে অপারগ। ঘড়ির কাটা ধরে ধরে পাকস্থলীতে খাই-খাদ্য ঢালতে হয়। নইলে পুরোটা শরীর সিপিএমের মতো বন্ধ ডেকে বসে। ঘড়ির দিকে তাকান হারু। কাটা ১১ টা ছুঁই ছুঁই। এখনও খাবারের খবর নেই। অবশ্য এ দোষ খাবার আনতে যাওয়া ছেলে দুটোর নয়, হারু চেয়ারম্যান সচেতনে তার নিজের ঘাড়েই টেনে নিতে চান। রাত দশটা পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন হাসি হাসি মুখে একে ওকে বুঝ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। তারপর তার বউয়ের হাতে শোল মাছের পাতলা ঝোল দিয়ে নৈশভোজ করবেন। ইদানীং তেল-ঝোল তার পেটে সয় না। কিন্তু বিধিবাম। এদের অভাব অভিযোগ আর আব্দারের শেষ নেই। গরম করে কিছু বলাও যায় না। সামনে পিএম আসবে। কে কোন কথা তার কানে তুলে দেয়। ভালোয় ভালোয় সব হয়ে যাক, তার পর দেখাবেন তিনি তার উত্তাপ। মনে মনে এই সংকল্প করে হারু চেয়ারম্যান ছাত্র শাখার দুই নেতাকে ৫০ প্যাকেট খাবারের জন্য ভোজনবিলাসে পাঠান। এতো রাতে তো খাবার থাকার কথা নয়। হারু দিব্যচোখে দেখতে পারছেন, তার বাপান্ত করতে করতে বাবুর্চি ঘুম জড়ানো চোখে চুলোয় রান্না চড়াচ্ছে।
‘হারু ভাই, আমার শালার ব্যাপারে কি কিছু করলেন’, এলাকার বিশিষ্ট সংস্কৃতি সেবক জানে আলম তার গলায় কথার হারমনিয়াম তুলে নিলেন। হারু মনে মনে ব্যাটাকে একটা কুৎসিত গালি দেন। ‘নিজের ধান্ধা শেষ করে এখন শাল সম্বন্ধির স্বার্থোদ্ধারে নেমেছো বান্দির পুত’।
‘পিএম আসলে তো সবাই আসবে। একটু কমিশনার সাহেবরে ব্যাপারটা বইলেন’। জানে আলমের সিল্কের পাঞ্জাবিটার খুঁট কার থাইয়ের তলায় চলে যাওয়াতে পুরো কথা শেষ না করে পাঞ্জাবি উদ্ধারে নেমে পড়লেন।
‘স্যার..’ বিগলিত একটা কণ্ঠস্বর শুনে হারু চেয়ারম্যানের মনটা ভিজে গেলো। ঘাড় ফিরে তাকাতেই দেখেন সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল মালেক খন্দকার। আগে পথঘাটে দেখা হলে এই লোক দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেত। আর নেহাৎ চোখাচোখি হয়ে গেলে ‘চেয়ারম্যান সাহেব’ বলে দোতলায় দাঁড়িয়ে যেন মাথা ঝুঁকিয়ে তার সঙ্গে কথা বলত। আর এখন নিজে থেকে ‘স্যার স্যার’ বলছে। ইদানীং স্যার শব্দটায় তার দারুণ দুর্বলতা জন্মেছে। পার্টির লোকজনের মধ্যে তো সভ্যতা ভব্যতার বালাই নেই। একজন হবু মন্ত্রীকে তারা নির্লজ্জের মতো সারক্ষণ ভাই ভাই ডাকে। কিন্তু সরকারি লোকজন একেবারেই আলাদা। তাদের সবগুলোকে যেন এক কারখানায় বানিয়েছে কেউ। একই ধরণের চলন বলন। একই ধরণের ভদ্রতা জ্ঞান। প্রিন্সিপালের তৃপ্তিকর সম্ভাষণ শুনে করুণামাখা মুখ নিয়ে হারু ফিরে তাকান।
‘লেডিস হোস্টেল নিয়ে স্যার ভীষণ সমস্যায় আছি। আর দুই দুইটা বাসের তেলের ভাউচার আটকায়া দিছে এজি...’
‘সারা বছর তো বাস দুইটা গ্যারেজেই থাকে, তেলের ভাউচার আসে কেমনে’। বার কাউন্সিলের ট্রেজারার আবুল হাসান উত্তেজিত হয়ে উঠে। প্রিন্সিপাল কিছু একটা পাল্টা বলতে যাবে তখনই হারু চেয়ারম্যান হাতটা তুলেন।
‘আমরা সবাই তো নিজ নিজ ধান্ধা নিয়া অনেক কথা বললাম। এবার পিএমের মিটিংটা কিভাবে সাকসেসফুল করা যায় এইটা একটু বলেন। মিনিমাম এক লাখ লোকের গ্যাদারিং চাই’।
বছর তিনেক আগে, দল তখন অপজিশনে, হারুর হয়ে মিটিং এরেঞ্জ করতে গিয়ে থানা ঘাটে দিনেদুপুরে খুন হয় আলতাফ শেখ। রামদা দিয়ে কুপিয়ে ফালা ফালা করে ফেলা হয়েছিল তাকে। পোস্টমোর্টেমের জন্য ডোমকে বাটালি চালাতে হয়নি আর। সেই আলতাফ শেখের বউ মর্জিনা রুমের এককোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে কুর্চিধরা মুরগীর মতো। সে পৌরসভায় একটা চাকরি পাওয়ার আশায় মাস দুয়েক ধরে ঘুর ঘুর করছে হারু চেয়ারম্যানের বারেন্দায়। হারু চেয়ারম্যান পরম মমতায় তার মাথায় হাত দিয়ে আশ্বাস দেন। কিন্তু এর মধ্যে ৫-৬ জনের চাকরি হলো, তার হলো না। হারুর ব্যাখ্যা, ‘যেমন তেমন চাকরি তো তোমারে দিতে পারি না, একটু অপেক্ষা করো বইন’। হারু যে তার জন্য কি ভবিতব্য রচনা করেছেন তা মোটামুটি মর্জিনা আঁচ করতে পেরেছে। ওইদিন পৌরসভার কনফারেন্স রুমে তাকে একলা পেয়ে খপ করে ধরে ফেলেছিলেন হারু চেয়ারম্যান। হামি খেতে গিয়ে পুরোটা মুখ তার ভরিয়ে দিয়েছিল থুতুতে। ভাগ্যিস, দরজা খোলার আওয়াজে হারু দ্রুত সংযত হয়ে যান। ফলে আর কারো চোখে পড়েনি। মর্জিনা এখন পার্টির মহিলা শাখার নেত্রী। হারু যতই চালাকি করুক, সে তার চাকরিপ্রাপ্তির অধিকার ছাড়তে নারাজ। মোটামুটি সবাইকে কিছু না কিছু বলে বুঝ দিচ্ছেন দেখে মর্জিনার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে শুরু করে। গমগমে ভিড়ের ভেতরে মেয়েলি কণ্ঠের তীক্ষ্ণতা ছুরির ফলার মতো গিয়ে বিঁধে। আলোচনা টুস করে দড়ি ছিঁড়ে সচকিত হয়ে ওঠে কান্নার উৎস সন্ধানে। উৎস আবিস্কার শেষে আবিস্কৃত উৎসের দিকে কৌতূহলমোড়া চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে সবাই।
এদিকে বড়ো গেটের সামনে দাঁড়ানো কুকুরগুলোও বিস্ময়ে ল্যাজ নাড়ানো থামিয়ে ফেলে। এতো পরিচিত লোকটাকে আজ তাদের কেমন যেন অন্য গ্রহের বাসিন্দা মনে হচ্ছে। সর্দার কুকুরটা ভাবে, এতো কিছু ভেবে কাজ নেই। দলে একটা নতুন কুকুরী ভিড়েছে। নির্ভার মাথায় তাকে নিয়ে মাস্তি করাই উত্তম। লেজ নাড়িয়ে পুরো দলকে ইশারা করতে গিয়ে সর্দার থেমে যায়। নিস্তেজ হারিকেনের আলো ছড়িয়ে একটা রিক্সা এগিয়ে আসছে পশ্চিম মাথা থেকে। তার সঙ্গে ভেসে আসছে পোলাও বিরিয়ানির মাতাল করা গন্ধ। পুরোটা দল এটেনশন হয়ে যায়। রাস্তা থেকে সরে গিয়ে লোহার গেটের পাশে পজিশন নেয়। আর ঘন্টা আধেকের ব্যাপার। খাওয়া শেষে প্যাকেটগুলো ছুঁড়ে মারা হবে রাস্তার দিকে। বেশির ভাগ প্যাকেটই থাকবে উচ্ছিষ্টে ভরপুর। অতীতের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে। তেল চর্বিতে মাখো মাখো খাবারগুলো কল্পনায় আসতেই কুকুরগুলোর চোয়াল ব্যথায় টন টন করে ওঠে। লোলুর চোরারাস্তাতে এসে ভিড়ে জিহ্বার অগ্রভাগে।
পাদটীকা: রাশান শরীরতত্ত্ববিদ আইভান প্যাভলভ দেখিয়েছেন, খাবার দেয়ার সময় ঘন্টা ব্যবহার করলে একসময় কুকুরগুলো খাওয়া ছাড়াই ঘন্টার আওয়াজে লোলু ঝরাতে থাকে। এটাকে তিনি ‘চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ’ মতবাদ বলে চালিয়েছেন।
১ জুন ২০১৩
লেখক পরিচিতি
জয়দীপ দে
গল্পকার, ছবি আঁকিয়ে
১৯৮০ ফেব্রুয়ারিতে জন্ম
চট্টগ্রামে পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায়
তারপর সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগে চাকুরিরত ।
একমাত্র গল্প গ্রন্থ: হারকিউলিসের পাখা
5 মন্তব্যসমূহ
অনেক ভালো লাগে গল্পপাঠ।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুনধন্যবাদ সাঈফ ভাই
মুছুনকিছুটা ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনআপনার লেখা এই প্রথম পড়লাম | দারুণ লাগলো |
উত্তরমুছুনSent from http://bit.ly/hrFXfA