পার্টির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে গত রাতে। মিটিং পূর্ব নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এজেন্ডায় যে সুদীপ্ত’র একান্ত নিজের বিষয়টা চলে আসবে তা সে ভুলেও ভাবে নি।
সভার শুরু হয়েছিল যতারীতি রাত দশটায়। গত সভায় সুদীপ্ত থাকতে পারে নি। সে পার্টির এক অপারেশন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ওই সভায় দুই সদস্য বিশিষ্ট এক কমিটি গঠন করা হয়। তাতে নির্ধারিত হয় গান্ধারকুল মসজিদের ইমাম ইমদাদ আলী বহুদিন ধরে ধর্মের আফিম জনগণের ভেতরে বিলি-বন্টন করে আসছে। এতে লোকজন তার নামে পাগল। ফলে শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি পরোক্ষভাবে হলেও সংকটের সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে বিবেচনা করলে তিনি একজন শ্রেণীশত্রু।
প্রকৃতপক্ষে তিনি শ্রেণীশত্রু কিনা এটা তদন্ত করার দায়িত্ব ছিল পার্টির দুই সদস্যের ওপরে। তারা সভার মধ্যে সায় দিল এই বলে যে, কমরেড, জনগণই আমাদের শ্রেণীসংগ্রামের মূলভিত্তি। জনগণের সুখ-দুঃখই আমাদের সুখ-দুঃখ। তাই তাদের বিভ্রান্ত করবে এমন কাউকে বাঁচিয়ে রাধার কোনো অর্থ হয় না। এবং এই শ্রেণী শত্রুদের যদি আমরা অচিরেই খতম না করি তাহলে চেয়ারম্যান মাও এবং সিএম (চারু মজুমদার) এর নির্দেশিত পথে পথচলা না সংশোধনবাদের পা চাটা হবে। তাই ১৪ এপ্রিল শ্রেণীশত্রু খতমের জন্যে তৈরি হন কমরেড। দুনিয়ার মজদুর, লাল সালাম। মিটিং শেষ হয়।
সুদীপ্ত বাড়ি চলে যায়। গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেও সুদীপ্তকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। পুলিশের ইনফরমার, গোয়েন্দা- কত কিছুর চোখ সামলে তারপর সুদীপ্তকে ফিরতে হয়। বেশ কিছুদিন পর গভীর রাতে বাড়ি ফিরে সুদীপ্ত ঘুমাচ্ছে। কখন বেলা উঁকি দিয়েছে খিড়কির দরজা দিয়ে তা স্পর্শ পেয়ে সুদীপ্ত সচকিত হয়ে উঠে। হুলিয়াপ্রাপ্ত গেরিলা হরিণের মতো সতর্ক চাহনিতে দেখে তার বাবা তার শিয়রে বসে। মাথায় হাত বুলাচ্ছে। এলাকায় তাকে তার আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করা ছেলেকে নিয়ে তার বহু কথা শুনতে হয়। শুনতে শুনতে এখন বীতশ্রদ্ধ। তবু সন্তানকে বহুদিন পর কাছে পেয়ে মাওলানা ইমদাদ আলী তার সন্তানকে পরশ বুলিয়ে বলছে- দে বাবা, ওই পথ ছাইড়া দে। মানুষ মাইরা রাজনীতি কিসের, কার জন্য রাজনীতি! সুদিপ্ত চুপ করে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তার বাবা এবার তাকে বলে তার জীবন সংগ্রামের গল্প। তার মসজিদের ইমাম হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ছিল একজন স্কুল-শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। তার বাবা স্বদেশী ছিল। সে সেই শিক্ষায় দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু কালাপানি থেকে আসার পর তার বাবা মারা যায়। মা তারও আগে। বিভিন্ন বাড়ির ফ্যান-ভাত খেয়ে একটু বড় হয়ে এতিমখানায় ভর্তি হয়। ভালো গান গাইতে পারত সে। সেই সুবাদে তার আজানের মুগ্ধ হয় সবাই। এবং এভাবেই একদিন মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তার ইমাম হয়ে যাওয়া। জীবন সংগ্রামের কথা বলতে বলতে কান্নায় বুক ভেসে যায় ইমদাদ আলীর। বাবার এই কান্না সুদীপ্ত’র অনুভূতিতে সামান্যও দোলা লাগে না। তার মাথায় শুধু শ্রেণী শত্রু খতম ভাবনা। আজ রাত ১২টায়।
পার্টির কথামতো শ্রেণীশত্রু খতম হয়েছিল। পরদিন স্ট্রোক করে মারা যায় সুদীপ্ত’র মা। এভাবে একটি পরিবারের পতন সবার চোখে ভেসে উঠেছিল। তবু নিরপরাধ দু'টি মানুষের এই অপমৃত্যুতে আকাশ ভেঙে পড়ল না মাটিতে।
সুদীপ্ত অন্য একটি অপারেশনে গিয়ে জনতার রোষের মুখে ট্যাটা বিদ্ধ হয়। তার হাত-পা ভেঙে ফেলেছে জনসাধারণ। কেউ কেউ জবাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু মাওলানা ইমদাদের খ্যাতি তাকে জবাই থেকে মাফ করেছে। এখন জেল হাসপাতালে বসে দিনকাল কাটে তার। এত সংকটের পরও বিশ্বাস তার টলে না। সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় সে বদ্ধ পরিকর। হঠাৎ একদিন পত্রিকায় খবর দেখে চমকে উঠে- তার দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী সরকার দলে যোগ দিয়েছে, মন্ত্রী-মন্ত্রীসভার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ হাতিয়ে নিয়েছে। এরা যোগ দেবার পর পত্রিকায় একটি প্রেস রিলিজ বেরোয়- ১৯৯০ সালে নেয়া তাদের সব সিদ্ধান্তই ভুল ছিল।
আজ ঈদ। জেলখানায় ভালো খাবার দেয়া হবে। আজ তার মা-বাবার কথা মনে পড়ছে। বিগত কথা মোচড় মেরে উঠতে চায়। পারে না। পড়ে যায়। শুধু দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে- বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গবেষণাসহ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার।
dipongker@yahoo.com,
সভার শুরু হয়েছিল যতারীতি রাত দশটায়। গত সভায় সুদীপ্ত থাকতে পারে নি। সে পার্টির এক অপারেশন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ওই সভায় দুই সদস্য বিশিষ্ট এক কমিটি গঠন করা হয়। তাতে নির্ধারিত হয় গান্ধারকুল মসজিদের ইমাম ইমদাদ আলী বহুদিন ধরে ধর্মের আফিম জনগণের ভেতরে বিলি-বন্টন করে আসছে। এতে লোকজন তার নামে পাগল। ফলে শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি পরোক্ষভাবে হলেও সংকটের সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে বিবেচনা করলে তিনি একজন শ্রেণীশত্রু।
প্রকৃতপক্ষে তিনি শ্রেণীশত্রু কিনা এটা তদন্ত করার দায়িত্ব ছিল পার্টির দুই সদস্যের ওপরে। তারা সভার মধ্যে সায় দিল এই বলে যে, কমরেড, জনগণই আমাদের শ্রেণীসংগ্রামের মূলভিত্তি। জনগণের সুখ-দুঃখই আমাদের সুখ-দুঃখ। তাই তাদের বিভ্রান্ত করবে এমন কাউকে বাঁচিয়ে রাধার কোনো অর্থ হয় না। এবং এই শ্রেণী শত্রুদের যদি আমরা অচিরেই খতম না করি তাহলে চেয়ারম্যান মাও এবং সিএম (চারু মজুমদার) এর নির্দেশিত পথে পথচলা না সংশোধনবাদের পা চাটা হবে। তাই ১৪ এপ্রিল শ্রেণীশত্রু খতমের জন্যে তৈরি হন কমরেড। দুনিয়ার মজদুর, লাল সালাম। মিটিং শেষ হয়।
সুদীপ্ত বাড়ি চলে যায়। গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেও সুদীপ্তকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। পুলিশের ইনফরমার, গোয়েন্দা- কত কিছুর চোখ সামলে তারপর সুদীপ্তকে ফিরতে হয়। বেশ কিছুদিন পর গভীর রাতে বাড়ি ফিরে সুদীপ্ত ঘুমাচ্ছে। কখন বেলা উঁকি দিয়েছে খিড়কির দরজা দিয়ে তা স্পর্শ পেয়ে সুদীপ্ত সচকিত হয়ে উঠে। হুলিয়াপ্রাপ্ত গেরিলা হরিণের মতো সতর্ক চাহনিতে দেখে তার বাবা তার শিয়রে বসে। মাথায় হাত বুলাচ্ছে। এলাকায় তাকে তার আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করা ছেলেকে নিয়ে তার বহু কথা শুনতে হয়। শুনতে শুনতে এখন বীতশ্রদ্ধ। তবু সন্তানকে বহুদিন পর কাছে পেয়ে মাওলানা ইমদাদ আলী তার সন্তানকে পরশ বুলিয়ে বলছে- দে বাবা, ওই পথ ছাইড়া দে। মানুষ মাইরা রাজনীতি কিসের, কার জন্য রাজনীতি! সুদিপ্ত চুপ করে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তার বাবা এবার তাকে বলে তার জীবন সংগ্রামের গল্প। তার মসজিদের ইমাম হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ছিল একজন স্কুল-শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। তার বাবা স্বদেশী ছিল। সে সেই শিক্ষায় দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু কালাপানি থেকে আসার পর তার বাবা মারা যায়। মা তারও আগে। বিভিন্ন বাড়ির ফ্যান-ভাত খেয়ে একটু বড় হয়ে এতিমখানায় ভর্তি হয়। ভালো গান গাইতে পারত সে। সেই সুবাদে তার আজানের মুগ্ধ হয় সবাই। এবং এভাবেই একদিন মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তার ইমাম হয়ে যাওয়া। জীবন সংগ্রামের কথা বলতে বলতে কান্নায় বুক ভেসে যায় ইমদাদ আলীর। বাবার এই কান্না সুদীপ্ত’র অনুভূতিতে সামান্যও দোলা লাগে না। তার মাথায় শুধু শ্রেণী শত্রু খতম ভাবনা। আজ রাত ১২টায়।
পার্টির কথামতো শ্রেণীশত্রু খতম হয়েছিল। পরদিন স্ট্রোক করে মারা যায় সুদীপ্ত’র মা। এভাবে একটি পরিবারের পতন সবার চোখে ভেসে উঠেছিল। তবু নিরপরাধ দু'টি মানুষের এই অপমৃত্যুতে আকাশ ভেঙে পড়ল না মাটিতে।
সুদীপ্ত অন্য একটি অপারেশনে গিয়ে জনতার রোষের মুখে ট্যাটা বিদ্ধ হয়। তার হাত-পা ভেঙে ফেলেছে জনসাধারণ। কেউ কেউ জবাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু মাওলানা ইমদাদের খ্যাতি তাকে জবাই থেকে মাফ করেছে। এখন জেল হাসপাতালে বসে দিনকাল কাটে তার। এত সংকটের পরও বিশ্বাস তার টলে না। সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় সে বদ্ধ পরিকর। হঠাৎ একদিন পত্রিকায় খবর দেখে চমকে উঠে- তার দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী সরকার দলে যোগ দিয়েছে, মন্ত্রী-মন্ত্রীসভার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ হাতিয়ে নিয়েছে। এরা যোগ দেবার পর পত্রিকায় একটি প্রেস রিলিজ বেরোয়- ১৯৯০ সালে নেয়া তাদের সব সিদ্ধান্তই ভুল ছিল।
আজ ঈদ। জেলখানায় ভালো খাবার দেয়া হবে। আজ তার মা-বাবার কথা মনে পড়ছে। বিগত কথা মোচড় মেরে উঠতে চায়। পারে না। পড়ে যায়। শুধু দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে- বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
লেখক পরিচিতি
দীপংকর গৌতম
কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।
দীপংকর গৌতম
কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গবেষণাসহ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার।
dipongker@yahoo.com,
o1715 816169
0 মন্তব্যসমূহ