শ্রাবণী দাশগুপ্ত'র গল্প : আবছায়া, আলো ও নীহারিকা

পনিটেল ও কাউবয় টুপি –

ইমিগ্রেশনের কাউন্টারের ঝামেলামুক্ত হয়ে আতান্তরে নীহারিকা, সহযাত্রীরা তথৈবচ। আগে কার সঙ্গে কে আলাপ... হ্যাঁ-না-ইত্যাদি? ট্যাঁকের পয়সায় দামী ভ্রমণ - সদ্য পা-রেখে, বুকের ভেতরে ফুট্‌ফাট্‌ গরম পপকর্ন। কখন? আরও কতক্ষণ? এতঘন্টা বিমানের পেটে, যথেষ্ট আরামযাত্রা সত্বেও জেটল্যাগ শব্দটি সত্য। নীহারিকার প্রথম বিদেশসফর, অফিসে বেধড়ক ছুটি নিয়ে। ঝোপের মধ্যে উসুখুসু কাঠবেড়াল, কর্মিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী অহঙ্কার স্যাঁতান মুড়ি। ঢাউস স্যুটকেস-গাড়ির শোভিত টিকি হাতে, ট্র্যাভেল এজেন্টের উপহার ব্যাগেজ কাঁধে, উজবুকের মতো দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যালে।


ভুঁইফোঁড় নাকি?

--হাই এভরিবডি! মাইসেলফ্‌ বেঞ্জামিন গোমস্‌ – আপলোগোঁকে ট্যুর-গাইড হুঁ। কম্ফর্টেবল ইন ইংলিশ? দয়া করে পরিচয় পেশ করুন, লিস্ট মেলাতে হবে। সবাই ক-লকাতা, ওয়েস্টবেঙ্গল - মানে বঙ্গালি?


খসকুটে বাদামি কাউবয় হ্যাটটা রীতি-অনুসারে হাতে। ব্লণ্ড-চুলে ঝুঁটিবাঁধা এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান, মোটা চশমা, লম্বা প্রায় ছয়। ইংলিশ ঝাড়ছে, ব্যাপক! এতক্ষণ ছিল কোন্‌ চুলোয়? নীহারিকার সঙ্গে চোখাচুখি হল, রোলকল? ওয়াও!


--নাইনটিন মিস্‌ নীহরিকা গ্যাঙ্গুলি... ফ্রম সল্টলেক, ইউ?

--ইয়াপ্‌ মাইসেলফ... নীহা-রিকা।

--সিংগল, আই মীন এলোন?

--ইয়াপ্‌... কোনও অসুবিধে?

--একেবারে না।


সে মাদারির বাঁদর না, কিন্তু কয়েকজোড়া চোখ তাকিয়েছে ওই অর্থে। নীহারিকার দাঁতের ক্লিপে ঠোঁট। ভরদুপুরের আঁচ আয়নায় দাঁড়ালে টের পায়, যদিও চল্লিশ ছাড়িয়ে উর্ধ্বমুখী। চশমা মাইনাস – ক্লাস সেভেন থেকে। পোলকা-ফুটকি ফম্যার্ল-শার্ট, লাল ট্রাউজার, কন্‌ভার্স স্পোর্ট্‌স্‌। উদ্দাম আধুনিক - খামোকা ঝালিয়ে নিচ্ছে। চুলে রুমালফুল। ঘীরঙ ডিসটেম্পার চামড়া রাতভর বেঘুমে ঝিমন্ত চিলতে বিকেলের রোদ্দুর। মন খেয়ালি বাঁকে, হঠাৎ লাইন এগোয়, তড়িঘড়ি সেও। জটলার মাঝখানে গোমসের ঘাড়ে মোরগপুচ্ছ, নাচছে। হাসি পেল। চৌকো মুখ। বয়স পঞ্চান্ন? ষাট? ঠুকে ঠুকে ভারী পা ফেলছে... শেওলা-কোটে প্যাডিং-বসান চওড়া কাঁধ। নীহারিকা ঠোঁট খণ্ড-ত, বোকাবোকা... ধুৎ কীযে...। এয়ারপোর্টের ঠিক বাইরে অপেক্ষারত অতিকায় ট্যুরবাস।


দুধধবল নিশি -

ধুন্ধুমার ব্রেকফাস্ট হোটেলে পৌঁছে, সামান্য পরিপাটি হয়ে ‘মাদাম ত্যুসো’। ভালই, পরদিন সময় মুঠোভর্তি। ম্যুজিয়াম সেরে বেরিয়ে সামনে স্ট্রীটফুড – হ্যামবার্গার, স্বর্গীয় - ও আমার বিদেশমাটি! লাঞ্চ-ডিনারে ভারতীয় থোড়বড়ি... নাকি জনগণের চাহিদা। দুগ্ধফেননিভ ঘর, তিনজনের ভাগাভাগি শোওয়া। দুই বৃদ্ধা (নাকি প্রৌঢ়া)... ‘এলোন এলোন’ ভাব, বিস্তর ‘আহা-উহু’ – ধ্যাৎতেরিকা। বিজলী মৈত্র বোনের আঁচল ধরে - বিধবা, ছেলে দীর্ঘপ্রবাস। অবসৃত দিদিমনি উৎপলা বধর্ন ডিভোর্সি, দীর্ঘদিন ভাইয়ের পরিবারে। নীহারিকা মুখ না খুলে চটপট ঢুকে পড়ছে হাল্কা লেপের নিচে। ভাগ্যে খাটবিছানা আলাদা, নাহলে দুঃখ আছে কপালে। একজনের নাককন্সার্ট, অপর ব্যথাময়ী... বহুক্ষণ কঁকাচ্ছিলেন। সারাঘর ভলিনির গন্ধমদির। নীহারিকার গলায় বাটারমিল্ক ক্রিম, বগলে, কানের লতিতে পারফ্যুম।


তার বেডসুইচ্‌ টকাটক্‌ জ্বলে নেভে। পাশবালিশ জড়িয়ে ধরার আরামের অন্ধকার, আলোটা মাখন – খাওয়া যায়। কুটকুট করছে আত্মসচেতনতা। জুনিয়র রোহিত জগানিকে ফোন করে অফিস-সংক্রান্ত কিছু নিদের্শ... ডানহাতে বিপুল ডায়াল জ্বলে, সাড়ে-নয় মোটে। মোবাইল তুলতেই মাথায় হেঁচ্‌কি... বিপ্‌-বিপ্‌-বিপ্‌ - ওহো, কোলকাতায় তারিখ বদলে গেছে কখন! মখমলি ভারী ঘুম সদ্য ঢলছে। জরির তাজপরা ধপ্‌ধপে হাতী লণ্ডন শহরের ব্যস্ত রাস্তায় চলে... চলে... চলে, পিঠে রাজকন্যা, হলদে-হওয়া কাস্তে চাঁদ।



টাইম এ্যান্ড টাইড ডু নট ওয়েট –

--গুড মর্ণিং! ডিড য়্যু হ্যাভ আ নাইস ড্রিম?

ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা! নীহারিকা জুসে ছোট চুমু দিয়ে সরিয়ে রাখল। ডাইনিং-হল মহাদেশীয় প্রাতরাশে সুগন্ধিত! অধর্ভোজনের পরে সসেজ, সালামি, ব্রেড, কেক, ক্রোশেঁ, ফল, জ্যাম - নীহারিকার প্লেট স্ফীত। চশমার নীলফ্রেমে অহমিকা - সেও কনভেন্টেড, এমএনসিতে পদস্থ। গজদাঁতের পরিমিত ইশারা,

--মর্ণিং...!

--মে আই শেয়ার য়োর টেবিল?

--প্লিজ ইফ ইউ...।

--ডাইনিঙে তুমি প্রথম, এটা গ্রেট! তোমার সহকক্ষবাসিনীরা?


ঢিলেঢালা কাঁটাচামচে ডিমের টুকরো গেঁথে ঠোঁটের কাছে, যেন অনাগ্রহী... কাঁধ উঁচু করে নঞথর্ক।

--নীহ-রিকা, মনে হয় তুমি একলা ঘর চাইছিলে?

--আই ডিজায়ার... সম্ভব হলে!

--দুঃখিত, ব্যবস্থা আমার নয়।



নীহারিকা পা থেকে আরশোলা ঝাড়ার মতো শব্দ করে,

--ছাড়ো... যাইহোক্‌, সিটিট্যুর ক’টায়?

--পাক্কা আট, বৃটিশ সময়।


ঘড়ি এগিয়েছে চল্লিশ মিনিট... সীটে বসে কেউ নামগান করছেনা, বরং ফোঁড়নের কড়া ঝাঁঝ। কারা এখনও পৌঁছয়নি? দু’দিনেই মাখোমাখো সম্পর্ক হয়নি যে, উত্তাপ ঠাণ্ডাজল হয়ে যাবে। নীহারিকার ধনুকেও টিকোল ভাঁজ, ‘বৃটিশ সময়! ভাষণ! পেলে একহাত উত্তমমধ্যম...।’ জানালার নিচে চালক টমসন্‌ ধোঁয়া সৃজনের আরামে। এতক্ষণ পরে হোটেলের স্বয়ংক্রিয় দরজার গোড়ায় গোমস্‌, হাতে শিশু, পেছনে লজ্জিত দম্পতি, কোলে দ্বিতীয় শিশু। এরাই অর্থাৎ! উটকো ঝামেলা... শুধুমুধু।


--জানো, অনুষ্কা ঘুম থেকেই উটছিলোনা - আর আমি তো গুড গার্ল...।

--তা-ই? সো-ও স্যুইট... তোমার নাম কি?

--মিশ্‌কা সেন, বোনু অনুষ্কা সেন।

মিশ্‌কা! মানে কি? নীহারিকার পাশে বসেছে বছরপাঁচের রেড্‌রাইডিংহুড্‌। অমল ফোয়ারা, অপ্রতিরোধ্য বেবিপাউডারের সুরভি, স্ট্রবেরি-মুস্‌ গাল। হাতে চকোলেট দিতেই মুক্তোর সারি,

--মাম্মা খুব বকবে!

--সিক্রেট, চুপিচুপি, হ্যাঁ?



এই বৃষ্টিতে ভিজে মাটি -

দুখী আকাশ হামেশা, তাই প্রথম আলাপেই – হাওজ্‌ দ্য ডে? লেপে-থাকা মনখারাপের শ্যাওলা। ফিসফিসে ভেজা কালোরাস্তা, লালবাড়ি, চার্চ, দোকান-মল। ক্যামেরায় ক্লিক্‌ - অগুনতি খোলাছাতা, ব্রিজের বাঁপাশে লণ্ডন-টাওয়ার। বাসে বসে শহরের আনাচকানাচ, কোথাও থেমে, নেমেও। নীহারিকা আর দু’য়েকজন বাকিংহাম প্যালেসের শানান সোনালি গেটে, যদিও অধিকাংশ নামেনি। অঝোর ‘কুকুরে-বেড়ালে’... নীহারিকার ছাতায়, হাল্কা কমলালেবু লংকোটে, হাঁটু-বুটে, ইংলিশ ক্যাপে রুপোদানা... কর্ণিয়া ফোকাসবিদ্ধ। বেহিসেবি একটানা সময় চলিয়া যায়, যা পুনর্লভ্য নয়। বাঁ-কাঁধে ছোঁয়া, বেশ ভারী,

--নীহ-রিকা ম্যাডাম, সবাই কিন্তু বাসে, নিজের সীটে। প্লিজ!

--ওহ্‌ সরি।

চমকে দ্রুত ঘাড় ঘোরায়, মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে বাসে ওঠে। জানালার ধারটা - কাঁচ ধরে নীরবে সরে যাচ্ছে সিক্ত সবুজ, শব্দহীন গাড়িরা। হঠাৎ একা হওয়া নীহারিকা, কাঁধের স্পর্শটা কেমন ত্বকভেদী... কী গভীর সুশ্বাস। নীলফ্রেমের চশমা খুলে মুছতে থাকে।


বেঞ্জামিন ধারাভাষ্য দিচ্ছে ইতিহাস বতর্মান ছুঁয়ে। নীহারিকার কান সজাগ, দৃষ্টিও। ফেরা ফেলে-আসা হোটেলে নয়, ফেরি-তে রাতভর। ঝিকমিক সাঁঝবাতি শহর সাজিয়েছে – মোহিনী। বাস পেটভর্তি মালপত্রসমেত জাহাজের গর্ভে এসে হাঁফ ছাড়ে।

ছোট্ট মাইক হাতে গলা ঝাড়ে গোমস্‌,

--হ্যালো এভরিবডি, আশা করি যাত্রা আনন্দময় হয়েছে। এতদূর এসে, না দেখে ফিরে যাওয়া আহাম্মুকি, কিন্তু অকারণে দেরি করাও চলবেনা। খেয়াল রেখো টিমের সদস্যগণ।



দূরদয়শ্চক্রনিভস্যতণ্বী -

একোন্‌ গ্রহে, কোন্‌ ভূতের রাজার বরে? জাহাজের ডেকে ছলছলে জলোচ্ছ্বাস – চেয়ারগুলো ইতস্তত, ভিজেছে। লক্ষ্যহীন স্থির তাকিয়ে নীহারিকা। অপরিচিত ভূমধ্যসাগরপারের বিদেশমাটি, সুদূরে ধনুকাকারে দিক্‌চক্রবাল। পাশের খালি চেয়ারে সামান্য আওয়াজ, তামাকের সৌরভ। অনিয়ন্ত্রিত পেশি কি ঘাড়েও থাকে? সে মাথা ঘোরায়।

--শুভসন্ধ্যা ম্যাডাম, ইয়্যু আর লুকিং এলিগ্যান্ট, গজার্স্‌।


কি উদ্দেশ্য? জানে সে, আয়নায় দেখেছে। চেপেচেপে সমান করে নিচ্ছে নিশিনীল স্কার্টের ভাঁজ, বেগুনি পোলোনেক সোয়েটার। কানঢাকা লালস্কার্ফে স্পধির্ত চন্দ্রমা,

--ওঃ, আই নো ইট্‌, থ্যাঙ্কস্‌।


হাঙরের মুখের অন্ধকার, ক্ষুরধার দাঁত, তুমুল হাওয়ায় বরফ। দু’হাতে নিজেকে জাপটায় নীহারিকা। কেন অযাচিত কেউ নিজর্নতাবিলাসে ভাগীদার? তা’বলে সে অভদ্র নয়,

--কী ঠাণ্ডা... কন্‌কনে – কিন্তু চমৎকার।

--তা ঠিক। কিন্তু ঘুমতে গেলেনা এখনও? রাত আর অত নবীন নয়, সকলে যে যার কেবিনে চলে গেছে। তুমি একা-


উত্তর দেবার দায় না নিয়ে ঘষে চেয়ার ছাড়ে নীহারিকা। বড় ট্যাবলেট শুকনো গলায় আটকানর মত লাগে,

--তুমি কি আমার লোক্যাল গার্জিয়ান? আমি যথেষ্ট – আই মিন...

--একেবারেই না! এই আমার ডিউটি ম্যাডাম... সকলের নিরাপত্তা, আরাম।

--ওহ্‌ দারুন! শোওয়ার অসহ্য বন্দোবস্ত... একঘেয়ে ভারতীয় ডিশ্‌... এমনকি জাহাজেও! তোমার উদ্যোগ কোথায় বলতো?

--এসব পূবর্নিধারিত – এজেন্সির ব্যবস্থা, আমি বদলাতে পারিনা।


ক্যুপে ঢুকে দেখে সহযাত্রিনীরা ঘুমন্ত। ওপরতলার বিছানা খালি তার জন্যে। ডিমের আকারে জানালার বাইরে নিকষ অন্তহীন। দোলদোল দুলুনি... মিলিয়ে যাওয়া তীক্ষ্ণ তির্‍যক তিররেখা, আর কিচ্ছু নেই... রাঙা মাথায়...!

বেঞ্জামিন – বিরক্ত, নাকি কষ্ট পেল? মেজাজটা খিঁচড়ে... এত ভাবার কী! তবু ঘুম আসেনা।



আমি এক যাযাবর –

একগোছ সমান্তরাল সুতো বা উল অজ্ঞাতে জড়িয়ে যাচ্ছে - ক্রমশঃ টুকিটাকি সহানুভূতি, খাবার ভাগাভাগি – নেমেছে অসহিষ্ণুতার পারা। আমস্টারডম শহরে নথর্সীর বফির্ল বাতাসে নীহারিকার কালো উলের স্কার্ফটা মিসেস বধর্নের মাথায়, বেচারির ঠাণ্ডার ধাত। এর শিরাধমনী জল, নেদারল্যাণ্ডস্‌ একদা জলবানিজ্যের দেশ। কবেকার স্থাপত্য, অটুট ব্রিজের নীচ দিয়ে নৌবিহার। তীক্ষ্ণ বারোক-স্টাইল ঘরবাড়ি, মেইন-স্কোয়ারে উড়ন্ত পারাবত, মুখোসধারীর ভিক্ষাপাত্র, হুটোপাটি শ্বেতশিশুরা – সব, সমস্ত বাস্তব। বেঞ্জামিনের উঁচু গলায় স্থানমাহাত্ম্য বণর্না করছে। নীহারিকা মন দিতে পারছেনা। জটলা ভেঙে দীপা গোস্বামী চুপচাপ এসে নীহারিকার কানে,

--ওদিকটাতে যাবে গো? ধ্যাৎ গোমস্‌টা যেকী ভ্যাজর ভ্যাজর করে চলেছে!

নীহারিকা দেওয়াল ভেঙে গর্ত করে, ইতিহাসে পা ফেলছে... মধ্যযুগে অবগাহন, নাক ভরে শ্বাস, ক্যামেরায় থেমে-যাওয়া সময়ের কুচি। তৃপ্তি-অতৃপ্তি মেশান, খুব ইচ্ছে করছে পুরোন শহরটায় শুধু হেঁটে বেড়াতে।


রাতে বাস এসে বেলজিয়ামে... ব্রাসেলস্‌-এ ভোর। ঘুম ভেঙেছে সামান্য দেরিতে, এখানেও মেঘছায়ায় মোড়ক। শহরভ্রমণে বাসে নীহারিকার পাশে দীপা, রসাল কিছু – এমন স্বর,

--শুনেছ কালকের কাণ্ড?


সামান্য হেসে, অনুত্তেজিত চোখ ফেলে ভাবে– কী ব্যাপার! বেশ মজার মহিলা, চোখ গোল করে গুছিয়ে পরচর্চা।

--ওই মিস্টার ঘোষ কাল রাত্তিরে ড্রিঙ্ক করে বেরিয়ে, ফেরার সময় রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলনা। অন্ধকার রাত... তারপর... গোমস্‌, সঙ্গে আমার কর্তা - খুঁজেপেতে.. এই বিদেশ বিভুঁই! আমাদের পাশের রুম – ভাব, মাঝরাত অবধি এইসব! তার বউও তেমনি – এত...

--গোসোয়ামিদিদি, প্লিজ... এই আলোচনা নয়, ভদ্রলোক এমনিতে যথেষ্ট সুস্থ নন।


কঠিন নিদের্শ। কখন এসে দাঁড়িয়েছে? গরম তারাবাজিতে হঠাৎ ঠাণ্ডাজল, চমকে তাকায় দুজনে। দীপা গোস্বামী জিভ কাটছে,

--এমা, সরি সরি! আসলে নীহারিকা জানতনা বলে... আমি তাই!

--নো! নো! দরকার নেই। হাই, গুড মর্নিং নীহ-রিকা –

--মর্নিং।


জোর করে কাস্তে-ঠোঁট বানিয়েছে নীহারিকা। জনসংখ্যা গুণে বেঞ্জামিন ফিরে গেছে ডেমনস্ট্রেটারের সীটে, বোঝাচ্ছে, বণর্না করছে চমৎকার। পেছনের সীট থেকে গান-কবিতা-কৌতুকী... হলে বসে নাটক দেখার মতো ভাল লাগছে, সাময়িক জড়িয়ে পড়ছে। ইওরোপীয়ন ইউনিয়ন বিল্ডিং-এর কাছে বাস থেমেছে, এখানে নামা। দীপা কানেকানে বলে,

--বেশি এঁচোড়ে-পাকা লোকটা, সব ব্যাপারে... তবে খুব দায়িত্ববোধ আছে, না? তুমি এখানকার চকলেট কিনলেনা?


অনেকবাক্স চকোলেট কিনেছেন, ফিরে উপহার দিতে হবে।


আই নো হাউ টু সামন্‌ আপ হ্যাপিয়েস্ট মোমেন্টস -

প্যারিস! শেষবিকেলের রোম্যান্টিকতায় লুটোপুটি – স্বপ্ন হাতের তালু জুড়ে। নীহারিকা হ্যাংলাচোখ সরেনা জানালার বাইরে থেকে। ডি-গল এয়ারপোর্টের কাছে হোটেল, অবিরাম প্লেনের শব্দ। মুখ বুজে ডিনার খুঁটেছে, অদূরে এক ভারতীয় রেস্টুরেন্ট। ডিনারের পর লিডো-শো। খুব অনুরোধ করেছিল দীপা, সে কাটিয়ে দিয়েছে, যায়নি আরও দুয়েকজনও। বিজলী মৈত্র ঘরে শুয়ে, শরীর খারাপ। লাউঞ্জে নীহারিকা বসেছিল, ভাবছিল। ‘একা’ শব্দটা নেহাৎ ক্লিশে, আসলে অভ্যাস। একা ও নিঃসঙ্গ – সমার্থক কি? বিদেশি ঘাসের নিয়মিত ছাঁটা সবুজ লন টাল খায়না, দোলে সামান্য। আহ্‌, আবার সেই অনাহুত?

--হ্যালো ইয়াংলেডি, হোয়াই ডিন্ট ইয়্যু গো? প্রায় সকলেই গেছে।

--হাই!

কড়া তামাক খায় বেঞ্জামিন, হাসে। নীহারিকার এক্সিক্যুটিভসুলভ মুচকি,

--হুঁ, মনে হচ্ছে গেলে ভাল হত। বুঝতে পারিনি।

--ম্যাডাম, ওরকম হয়, অনেক কিছুই বুঝতে দেরি হয়ে যায়। সময় চলে গেলে, ভুলটা শুধরানো চলেনা। অহো, তুমি আবার বিরক্ত হচ্ছ নাকি? আমি পালাই। কাল সারাদিন শহর দেখাব। একটা প্রস্তাব ছিল– যদি পছন্দ হয়!


হঠাৎ খুব নিচুতে উড়ে যাচ্ছে এরোপ্লেনটা, কান ফাটিয়ে। নীহারিকা ওপরদিকে চেয়ে থাকে।

--যদি চাও, সেইন-নদী আর আইফেল-টাওয়ার দেখে আসতে পার, অভিজ্ঞতা সারাজীবনের। নাইট ইজ স্টিল ইয়াং, তোমার মতো। এখানে নিরাপদ। ইণ্ডিয়ান খাবার একটুও ভালবাসনা দেখেছি, অনেক স্ট্রিটফুড পাবে পছন্দমতো। বেরোলেই ট্রেন ও বাসস্টেশন... চাওতো আমি -


আহ, সাবধানে চাক ভাঙতেই মধু! নীহারিকা উজ্জ্বল ভেপার ল্যাম্প, এমন একটা কিছু চাইছিল।

--ওহ্‌ নো, মেনি থ্যাংক্স। আমি একাই... একটা কথা বলব, যদি মনে না কর!

--নিশ্চয়ই?

--এত স্মোক্‌ করা ভাল?



আলটপকা প্রশ্ন মনে পড়ে নীহারিকা হাসে। আয়নায় ঝকঝকে প্রতিবিম্ব, পাশে অস্পষ্ট টুকরোটাকরা। কালো ভ্রমরীর ধাঁধাঁন রেশম-খোলসে বেরনোর মুহূর্তে চোখে পড়ল – লাউঞ্জে সুখেন্দু ঘোষের সঙ্গে বেঞ্জামিন। মিসেস ঘোষ সম্ভবত গেছে লিডো-শোতেই।

--মিস্টার ঘোষ, আমিও ড্রিঙ্ক পছন্দ করি। তবে খেয়াল রাখি। আমার দেখভাল করতে কিন্তু ফ্যামিলি সঙ্গে থাকেনা... মাস্টবী কেয়ারফুল। জান, আমার বয়স সেভেনটি টু, বুঝতে পার?


সেভেনটি-টু? মসৃণ মেঝেয় পেন্সিলহীল-পা ফস্‌কাচ্ছিল।


দাঁড়িয়ে অনিমেষ নীহারিকা। সেইন-এর পাশে আলোপাখি আইফেল – ছায়াগবির্নী নদী, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ঘোষণা। সুন্দর, উজ্জ্বল, গবির্ত নীহারিকার মূর্তিতে কারও ছায়া নেই, অনুভব নেই। গলা পর্‍যন্ত টৈটম্বুর বেমিশাল ভাললাগা – দুমূর্ল্য সুতোর ফোঁড়ে অভিজাত রাতপোশাক। ইতিউতি অপ্সরী ফ্রেঞ্চকন্যেরা, সটান পদক্ষেপ – নাইট ইজ স্টিল ইয়াং।



সকালে থৈথৈ ভীড় ল্যুভরেতে। সম্মোহিত নীহারিকা দিশা হারিয়ে, অতিরিক্ত সময় নিয়েছিল। ততক্ষণে গোমসের পাশে জটলা, কয়েকজন এদিকওদিক। স্বর ও সুর চড়েছিল,

--তুমি খুব লেট্‌ – শেষতম! ভুলে গেছ যে, আমাদের সময় মাপা।

--সো হোয়াট? ল্যুভরে দৌড়ে এসে দেওয়াল ছুঁয়ে বলব, দেখা হল?

--প্রোগ্রাম যেভাবে বানানো প্রত্যেকের মানতে হবে। সেটা জেনেই এসেছ - যেই হওনা!

--আরে যাও! তুমি বলার কে? অভিযোগ করব... ভাষাসংযম শেখ!


সে একক, উগ্র, উদ্ধত, উদ্যত ঝাপট, দু’একজন মিনমিন তারও সমর্থনে – সত্যিই, সত্যিতো! দীপা হতভম্ব,

--ছাড়না নীহারিকা, বাদ দাও... বলেছিলামনা?


রক্তচাপ গিলে ফেলা যায়না, কানমুখ তেতে ওঠে। এখানে বারোমাসই কি আষাঢ়-শ্রাবণ? খোলাচুল বষার্তি দিয়ে ঢাকে। ভরদুপুরে বৃষ্টি ঠেলে একঘন্টার পথ উজিয়ে, ঘ্যানানো মশালাদার রাজমা-চাওল। দেশভক্তের দল! ন্যাপকিনে মুখ মুছে নীরবে বাইরে... সরু ফুটপাথ, দোকানপাটে দরদাম, উপহার কেনাকাটা। ওসব নেই তার। সেবেলা সময় অঢেল! অদূরেই নোৎরদাম গির্জা – আঙুল দিয়ে দেখ – ওইযে, ওই!

--ইয়াংলেডি, ঠিকমতো খাওনি! লক্ষ্য করেছি। ভেরি সরি!

--কিচ্ছু দরকার নেই, দয়া করে যাও।


নিজর্ন গাঢ়স্বর, কেন বারবার এরকম?

আইফেল টাওয়ার পৌঁছতে বিকেল গড়িয়েছে, অনুষঙ্গে অঝোর বৃষ্টি। বিকল মন, ফিরতি বাসে পাশের সীট খালি, কানবন্ধ হেডফোনে গান। দ্রুত মসৃণ সরে-যাওয়া সবুজের পরে সবুজ, উঁকি মারে অবিকল পুরোন ম্যানর – শ্যাটো, খেলনার মতো - অগম্য। রাস্তার পাড় ঘেঁষে বস্তিমতো – অপরিচ্ছন্ন, জিপসি, উদ্বাস্তরা। নেমে পড়তে পারলে দৌড় দৌড় – ‘ও... আ হাইল্যাণ্ড ল্যাস্‌’! মাথায় জড়ান লালস্কার্ফের ফাঁকে আগুণমুখ বারদুই দেখে গেছে গোমস্‌, নীহারিকা তাকায়নি। আবার কি? ক্ষ্যাপা নাকি?

--মে আই...?


হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি –

পাশ্চাত্যের আকাশ প্রায়শঃ কাকের গলার রঙ, নখ অবধি কনকনে। ভারতবর্ষ সূর্‍যের এক নাম – পেছনের সীটে গলা খুলে গাইছে কেউ।



লোকটি জানে অনেক, লোকটি খবর রাখে, গড়গড়িয়ে বলে যায়। একেকটা দিন – নোতুন, বিচিত্র, বিরতিহীন দীর্ঘ। প্রযুক্তি-প্রকৃতির সাথর্ক দাম্পত্য - স্বপ্নরাজ্য সুইজারল্যাণ্ড! উপত্যকায় তাদের হোটেল থেকে আধোঘুমে অনৈসর্গিক কাউবেল, তুষারভ্রমণ। নীহারিকার ওভারকোটে রোঁয়া শাসনে, সানগ্লাসে তীক্ষ্ণতা। আল্পসের চূড়ায় আকাশের উজ্জ্বলতা তাকেই ফেরত পাঠাচ্ছে জমাট বরফের চাঁই। আবার উল্টোটাও – চেষ্টাটা অনুভব করতে পারে নীহারিকা। নেমন্তন্ন বুঝি?

--ইয়াংলেডি, আজকের স্পেশাল ডিনার হয়ত ভাল লাগতে পারে।


ফোঁটাফোঁটা গলছে বরফ, সম্ভবত নিরাপত্তার উষ্ণবলয়ের ছোঁয়াতে। নীহারিকা নির্ভরশীল পড়ছে? অসম্ভব! ফুটপাথে চেয়ার-পাতা অসংখ্য পাব্‌, কফিশপ, বাতাস মধুময়। এখানে কিছু চকোলেট কেনার পরিকল্পনা তার।


দুপুরের জনবিরল অসহ্য সুন্দর জুরিখ ছাড়িয়ে, মেপলগাছে শোভন দাম্ভিক জার্মানি – মিউনিখে রাজপ্রাসাদ, হিটলারের একনায়কত্বের স্মৃতি – রঙিন সিনেমার মতো, যেটা হয়তো একবারই দেখা হল! মাত্র কয়েক কিলোমিটারে অসউইচ্‌ ক্যাম্প – মজ্জা হিম-হওয়া সত্য ইতিহাস। ইচ্ছেপ্রকাশ অথর্হীন, বলেছিল সবিনয়ে – তবু হলনা। কত অদেখা, কাছাকাছি পৌঁছেও... চাঁদে পা-ফেলে আ-ল-তো ভেসে চলা।

অস্ট্রিয়া সুইজারল্যাণ্ডের দুয়োভাই? অসামান্য শান্ত ঝিমঝিমে আল্পসের বুকে ঝকঝকে অস্ট্রিয়া, এক-আধটু বরফ পড়া শুরু। যুদ্ধ, মোজার্ট, সরভস্কির চকমেলান কৃস্টাল, সব মিলিয়ে। ফুটপাথে পসরা, সে টুপি কিনল নিজের জন্যে। আনকাট্‌ কৃস্টালচোখ রহস্যে চিকচিক, তার কেয়ারি-করা বাগান কাঁপছে মৃদুবষর্ণের হাওয়াই শব্দে।


অসুস্থ হয়ে পড়েছে অলক্তা, মিষ্টি কিশোরী - বাস থামিয়ে বারেবারে ওয়াশরুম। অথচ একদিনও অপেক্ষার উপায় নেই। অনেকের ভ্রূতে ভাঁজ – মাপা সময়ে টান! অধিকাংশ নিবির্কার, কী বিভ্রাট! মুখে কেউ বলেনা কিছু। ডালপালা-ছড়ান পুরোন গাছ – বাহাত্তুরে ঝুঁটিদার টানটান! বিব্রত মায়ের হাত ছুঁয়ে ভরসা দিচ্ছে, পাশে বাবা কৃতজ্ঞতায় ভেজা। নীহারিকা দেখে, ঈর্ষার টোকোগন্ধ জোর করে অস্বীকার করে। অকারণ বাস থেকে নেমে অদূরে দাঁড়ায়, জালের মতো চোখ ছুঁড়ে ডুবিয়ে দেয়। আজ বৃষ্টি নেই, নীল-সবুজ ঘেঁষাঘেঁষি দিগন্তরেখা।


--আর য়্যু স্টিল এ্যাংরি উইদ মী?


ঠিক পাশটিতে, কাছ ঘেঁষে - যেন মাফ-চাওয়া, যেন অনুতাপ। আচমকা গলগল ঘনধোঁয়া, চোখে পাতলা পরত। প্রকাণ্ড প্রাচীন সজীব গাছটার পাশে, নিজেকে দেখায় রঙচঙে প্লাস্টিকের পাতাবাহার। মুখ তুলে বলে,

--সরি, কিছু মনে করনা। আমারও মাথাগরম... তুমি সত্যি সফল টীমলিডার।

--ইয়াংলেডি, এটা আমার চাকরি, অর্থের বিনিময়ে... অবসর নেওয়ার পর থেকে কতবছর ধরে।


টুনিবালব গোমসের চশমার ভেতরে, নীহারিকার মুখের ওপরেও ঝলক। নীহারিকা সত্যিকারের হাসে,

--তাই-ই? কিন্তু তুমি চাকরিটা বড্ড ভালবাস, তাইনা?

--ইয়া, আই লভ ট্রাভেলিং। চুল পাকল এভাবে।

--আর এইযে কতলোকের সঙ্গে মেলামেশা?

--হ্যাঁ সেটাও ঠিক, তবে যতটুকু প্রয়োজন...।

সত্যি বলছে? না কথার পিঠে কথা দিয়ে ঢাকছে?

--জান, আমি তোমার কাজকে হিংসে করব ভাবছি! এমন প্রফেশন... আর আমারও পিছুটান নেই।

--সীরিয়াসলি? ভেবেছ? ভেবে বলছ? এতরকম দায়িত্ব, ঝামেলা সত্বেও... এইতো তুমিই কত রাগ...


হেসে উঠল - একদঙ্গল পায়রা উড়ে যাবার শব্দ। সম্পূর্ণ অপদস্থ, লজ্জা করছে নীহারিকার... ধীরপায়ে বাসে উঠে বসে। বাকি হাতে-গোনা দিন।


ইতালি পৌঁছে চেতাবণী দিয়েছে গোমস, দেশটা তুলনায় এলোমেলো অগোছালো – প্রাচ্যগন্ধী খানিকটা। পিসার স্তম্ভ দেখে ফ্লোরেন্স পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলপ্রায়। ফ্লোরেন্স দেখার এতটুকু সময়? উত্তপ্ত অনেকেই। বাস থেকে নেমে অনেকখানি হাঁটাপথ - হনহনিয়ে চলেছে নীহারিকা। বাঁয়ে প্রাচীন আর্নোনদী আজও। স্তব্ধ বিশাল প্রাচীনত্ব, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের আকর ফ্লোরেন্স। উফিজি! চোখ দিয়ে পান, দেহের লোমকূপ শুষে নিচ্ছে প্রতিটা নিমেষ। কয়েকশ’ বছরের নিবার্ক মূর্তি–মানুষ নিস্পন্দ। নীহারিকা নিজেও কি... নিখুঁত নিরেট ছায়াহীন? সন্ধ্যে পা ফেলেছে, লাইট জ্বলেছে চৌহদ্দিতে। জনারণ্য গমগম, হঠাৎ খেয়াল যখন, দলছুট সে, আশেপাশে সহযাত্রীদের পরিচিত মুখসব অদৃশ্য! চলে গেছে? গা গুলিয়ে বমি আসে এই ভাবনায়, কারও ফোননম্বর রাখা হয়নি। বুঝতে থাকে, প্রবল ভয়ের কবলে... সরব ভীড়ে দাঁড়িয়ে - পাথরের মূর্তিরা জীবন্ত হয়ে ঘিরে ধরছে। মাধ্যাকষর্ণচ্যুত সে অন্তহীন মহাকাশে, একেবারে একা!


কড়া তামাকের চেনা শ্বাস, আধোচোখ খোলে নীহারিকা। পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে মস্ত পাঁচিলে সে আটকেছে, অথবা স্তম্ভে, যা ভেজা এবং স্পন্দিত। দু’হাতে আঁকড়ে জাপটে ধরেই থাকে – অঝোরে ভিজতে থাকে যত্নে-ছাঁটা সবুজ লন! জ্বর-কপালে অডিকোলনের মতো স্বর,

--ডিয়ার ইয়াংলেডি, এত ভয় পেলে কেন? আমি তো ছিলাম গেটের কাছেই, ওয়েট করছিলাম... যতক্ষণ না...


ফর মী? আমার জন্যে, শুধু? দলা হয়ে কিছু নীহারিকার গলায়, চশমাতে বাষ্প – বাক্যহীন ঠোঁট নড়ে কেবল।


--...সকলে ফেরে - আমার কাজ, আমার দায়িত্ব, আয়্যাম পেড ফর ইট ম্যাডাম। চল, বী স্টেডি।


চোখ নামিয়ে ফেলেছে নীহারিকা,

--আই এনভি ইয়োর জব – আবারও বলছি।


হোহো করেই হাসছে মানুষটা। বিদেশীরা শুধু ‘এক্সক্যুজ প্লিজ’টুকু বলে, আর তাকায়না। মাঝরাস্তায় লণ্ডভণ্ড নীহারিকার সমর্পন কি দেখতে পাচ্ছে কেউ?


রোম ওয়াজ্‌ নট্‌ বিল্ট ইন আ ডে -

খেল খত্‌ম্‌, দেশের শিকড়ের জোরাল টান ক্রমশ। ভেনিসের গণ্ডোলায় নীহারিকা, দীপা, মিসেস মৈত্র, মিসেস বধর্ন। দেখে সিঁড়িতে পা-মেলে গোমস্‌, গল্পে মশগুল কার সঙ্গে... হাত তোলে গ্রিন সিগন্যালে। বাড়ির ভিটেয়, ব্রিজে, শেওলা-ধরেছে। নীহারিকার আশৈশব খোলসে চিরচিরে ফাটল- কথা... উপহার... চকোলেট বিনিময়ে!


বাকি রোম! রোমাঞ্চকর – পা রেখে নিবার্ক নীহারিকা, অলিগলিতে ইতিহাস। সিজার, রোম্যুলাস অগাস্টাস, ব্রুটাস্‌... এভাবেও বাঁচিয়ে রাখা যায়? বলিহারি ঐতিহ্যপ্রেম, পথেঘাটে অবিকৃতপ্রায় বিলুপ্ত রোমসভ্যতার নিশানা। যেন সাজিয়েছে, অথবা সিনেমা শুট্‌ করার সেট্‌ - চার্চ, প্রাকার, দরজা, প্রাসাদ... গোলাকার মাথা।


আর, মুষলধার বৃষ্টিতে ভাটিক্যান সিটি। অনেকের ছাতা, তারও... সামনেই ঝুঁটি ভিজছে। আজ হ্যাটটা কোথায়? বিমলেন্দু সরকারের পা মচকেছে, বাস থেকে নামতে চাননি ভদ্রতায়... তবু! স্ত্রী-পুত্র সামনে, ভদ্রলোক খুব ধীরে, গোমসের বাহুতে ভর, যেন উঁচু অনড় থাম। দূর থেকে দেখছে নীহারিকা, সামনে পড়তে চাইছেনা অথচ।


কলোসিয়াম বাকি। অনেক দেরি হয়ে গেছে, ক্লান্ত যাত্রী মতামতে বিভক্ত। ছায়াময় উঁচু দু’ডালে অভয়মুদ্রা, সেই হাসি,

--ইয়েস, আমরা নিশ্চয়ই যাব! যারা ক্লান্ত, বাসে থেক। কে কে আছ সাথে?

--আমরা, আমরা সব্বাই!


উৎসাহের তলানি উষ্কে নিয়ে দিনশেষে কলোসিয়াম – নিস্তব্ধ বৃহদাকার অস্তিত্ব, নামের মতো... আদিম খেল-ময়দান ঘেরাটোপে আলোছায়ায় ভয়াল। আবার নীহারিকা যদি স্বেচ্ছায় হারিয়ে যেত – নির্ভয়ে, প্রশ্রয়ে, ফুরফুরে হয়ে?


ওয়ান্স মোর ইউ ওপেন দ্য ডোর -

রোম ইন্টারন্যাশাল এয়ারে দুবাই পর্‍যন্ত সহযাত্রা। সেখানে চেন্নাই-কোলকাতা – আলাদা পথ। স্যুটকশের কান ধরে গোমস্‌, ঝুঁটি নাচছে, হ্যাট হাতে। দ্রুত সকলের হাত ছোঁয়াছুঁয়ি, ফোননম্বর, ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা ইত্যাদি আর... নীহারিকা চুপ করে সরে, শোনে। সময় ফুরুৎ! মিঠে তামাকের গভীর ঘ্রাণ, পিঠে আলগা ছোঁওয়া,

--বাই ইয়াংলেডি, আশা করি নিরাপদে পৌঁছবে ক-লকাতা!

--বাই, সী ইয়ু -।


‘সী ইয়ু’-টা লব্জ, কেননা জানে...। শুকনো পাতা মাড়ান মচমচ আওয়াজ নীহারিকার গলায়। মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষ... কেন খুব ইচ্ছে করছে...!

ডিম্বাকার জানালায় নীহারিকা। দৃষ্টিতে বিস্তৃত রানওয়ে, ডানা-মেলা জাহাজ। তার গালিচা-ঘাস বেড়েছে, এখন অজস্র রঙের ফুলও। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে মাটি ফেটে গেছে, ফাটছে, চৌচির। অল্পক্ষণে তুমুল ঝড় উঠেছে - ধুলোর ঘূর্ণি। সে আপ্রাণ চোখ টিপে দরজা বন্ধ করে... শোঁশোঁ আওয়াজে ভেঙেচুরে উড়িয়ে নিয়ে – কতদূর।

তার তো কোথাও কোনও নোঙরবাঁধা হয়নি আজও - অরুচি, বিতৃষ্ণা! সদ্য মেয়েবেলায় পৌঁছে বুঝেছিল, তার ও মায়ের চারপাশে পাঁচিলঘেরা নেই। কবে ভেঙে গেছে, মা বলেনি।


কম্পানির দেওয়া ফ্ল্যাটে তালা খুলে ঢুকলেই... পনেরদিনের ধুলোয় ধু-ধু। ব্যালকনির রেলিং-এ জোড়াশালিখ, পাশে পেয়ারা গাছটায় বাসা। পায়রাদুটো বাথরুমের স্কাইলাইট নোংরা করে রেখেছে। নিঃশব্দে ফ্রিজ চলে, আরও টুকিটাকি। আর সে ফোঁটাফোঁটা জল মেপে দেবে কার্পেট-ঘাসে, রোদের শুকিয়ে, ছেঁটে রাখবে। কয়েকটা দিন সময় লাগবে, তারপর সেইরকমি... বি-ন্দা-স। ততদিন থাক খোলা দরজা... অলবেলা বাতাস।





লেখক পরিচিতি
শ্রাবণী দাশগুপ্ত

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
এখন রাঁচিতে থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

10 মন্তব্যসমূহ

  1. এখন বিকেল মরে আসছে সন্ধ্যের আঁচলে।এরকম টা হয় না যে এখন ডালিম ফাটা রোদ উঠবে? কি জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল।

    উত্তরমুছুন
  2. হোক মনখারাপ... তাহলে তো সাড়া পাই... ধূসরবস্তুর বাইরেও আছে কিছু! :)
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন
  3. যাত্রাপথের কাহিনী, স্মার্ট পরিবেশনা...বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ--মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠা।
    বাই দ্য ওয়ে--- পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমিও ঐ ভ্রমণ ক্যাপসুলে ঢুকে পড়েছি !

    উত্তরমুছুন
  4. অনেক ধন্যবাদ জানাই...

    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন
  5. অনিন্দিতা গুপ্ত রায়১২ আগস্ট, ২০১৪ এ ১০:৪০ AM

    দিদি, কি স্বচ্ছন্দ লেখো তুমি!!

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ জানালাম অনিন্দিতা! পড়ার জন্যে...

      শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

      মুছুন
  6. স্মার্ট গদ্যের ঝলসানো শম্পা। ঝিলিক দিচ্ছে এদিক-ওদিক। ক্যানভাস ভিবজিওর ছাড়িয়েও। ভ্রমনের সঙ্গে প্যারালালি চলেছে গল্প- নাগল্প। অসামাণ্য সুন্দর উপস্থাপনা। হ্যাট্‌স অফ শ্রাবণী ।
    নীতা বিশ্বাস।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ জানাই দিদি, কৃতজ্ঞতা... পড়েছ ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছ।


      শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

      মুছুন
  7. অসাধারণ গদ্য শৈলী- কাটা কাটা কিন্তু কনটিনিউয়াস। এমন আপনার অন্য লেখায় পাই নি। জেনে শুণে করেছেন বোঝা যাচ্ছে- এবং খুব সাকসেসফুল হয়েছেন। দাঁতের ক্লিপে ঠোঁট বা পেন্সিল হীন পা নিয়ে পিছলে যাওয়া --- ভাবা যায় না। আমার কথা শুণুন, সব লেখা পত্র এক জায়গায় করুন, বাছুন, তারপরে একতা বই বের করতে হবে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই... মন দিয়ে পড়েছন বলে। আর কি বলি?

      শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

      মুছুন