বিপুল দাসের গল্প : ঝড়েশ্বর

বৈশাখু বর্মনের জন্ম পঁচিশে বৈশাখ, ইং ঊনিশ’শ চল্লিশ। এত নিখুঁত ভাবে তার জন্মদিন কারও মনে রাখার কথা নয়। কিন্তু সে রাতে রংপুর জেলার সৈয়দপুরে রাখালকুড়া গ্রামে এক ভয়ংকর দুর্যোগ এসেছিল। দুরন্ত ঘুর্ণি বাতাসে গ্রামের সমস্ত ঘরবাড়ি শূন্যে উড়ে গিয়েছিল। প্রাচীন বট, অশ্বত্থ – কিছুই রেহাই পায়নি সেই তান্ডব থেকে। যাদের ঘরে টিনের চাল ছিল, সে সব টিন সাঁই সাঁই শব্দে সুদর্শন চক্রের মত অনেক কিছু ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল। আমাদের পুরনো দালান আর রাসেশ্বর বর্মনের পাকা বাড়ির কিছু অংশ রক্ষা পেয়েছিল। পরবর্তী কালে শোনা যায় পাশের গ্রাম তালহাটির গ্যানা অধিকারীর গোরু নাকি শূন্যে উড়ে ফকিরের বিলে গিয়ে পড়েছিল। পরে অনেকে সে গোরু দেখতে গিয়েছিল। গোরু তখন পুরো পাগল। লোকজন দেখলে শিং-এর কথা ভুলে হা করে কামড়াতে আসে।

এসব কথা কিছু আমার মায়ের মুখে শোনা, কিছু আমার অস্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন গ্রামের স্কুলে পড়ি। সেদিনই আমাদের বাংলার মাস্টারমশাই আবেদিন স্যার রবীন্দ্রনাথের ‘অন্য মা’ নামের একটা কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। আমি অবশ্য আগেই জানতাম পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন।
ঝড়ে আমাদের ঘরদোরের তেমন ক্ষতি না হলেও আমবাগানের খুব ক্ষতি হয়েছিল। সব বউল তো ঝরে গিয়েছিলই, অনেক পুরনো গাছও শিকড়সুদ্ধ উপড়ে এসেছিল। পশ্চিমের বাগানে কলাগাছের একটা গোটা ঝাড় মনে হয় কোনও দৈত্য এসে যেন দুমড়ে মুচড়ে মাটি থেকে তুলে প্রচন্ড আক্রোশে যেখানে খুশি ছুঁড়ে ফেলেছে। অস্পষ্ট মনে পড়ে অনেক মানুষ আমাদের বাড়িতে এসেছে। অনেকে কান্নাকাটি করছে। পাড়ই গো, হামাক বাঁচান – সবার মুখে এক কথা। কয়েকজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে বাবা শলাপরামর্শ করছেন। ক্ষয়ক্ষতির সমস্ত বিবরণ দিয়ে একটা দরখাস্ত লেখার কথা আলোচনা হচ্ছিল। যদি কিছু সাহায্যটাহায্য পাওয়া যায়।
বৈশাখুর নাম আমার মা রেখেছিলেন ঝড়েশ্বর।তার মায়ের সঙ্গে নাড়ির বাঁধন ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি বাতাস ধেয়ে এসেছিল রাখালকুড়ায়। দুদিন বাদে চারদিক থেকে খবর আসতে শুরু করে। ওদিকে নীলফামারি, এদিকে গাইবান্ধা – সব তছনছ হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়েশ্বর নাম বৈশাখুর বাবা আকালু বর্মনের পছন্দ হল না। বৈশাখ মাসে জাত সন্তানের নাম রীতি অনুযায়ী বৈশাখু হয়।
আমাদের দালানের প্রায় লাগোয়া পশ্চিমে ছিল সবচেয়ে ভালো জাতের আমের বাগান। বাগান শেষ হলে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। রাস্তার ওপারেই শুরু আমাদের অফুরাণ ধানিজমি। বাড়ির ভেতরে ছিল একটা বড় পুকুর। আর একটা দিঘি ছিল দালানের উত্তর-পশ্চিম কোণে। বাইরের দিঘির পাড় ঘেঁষে ছিল আকালুর ঘর। সেটা কোনও মতে দাঁড়িয়ে থাকত। এখানে তার আস্তানা হওয়ায় আমাদের জমির ধান, পুকুরের মাছ, বাগানের ফলের ওপর সে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে পারত। উপরন্তু আমাদের গো-সম্পদের তদারকি, মুনিশ মাহিন্দরের সঙ্গে তাল ঠোকা, চাষবাসের যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ – সারাদিন সে প্রায় চরকিবাজির মত ঘুরে বেড়াত।
তার বউ গিরিবালাকে তাদের ওই পুকুরপারের ঘরে আমি একদিনও দেখিনি। গিরিবালামাসি সারাদিন এবং হয়তো কখনও সারারাতও আমাদের বাড়িতেই থাকত। অসম্ভব পরিশ্রম করতে দেখতাম তাকে। সারাদিনে তো বটেই, রাতেও আমি ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত তাকে দেখতাম আমাদের ঘরের টুকটাক কাজ সারতে। আবার যত ভোরেই উঠিনা কেন, দেখি তার আগেই মাসি উঠে কত কাজ সেরে ফেলেছে।
আকালু ছিল সিড়িঙ্গে। সে যেমন ভূতের মত খাটতে পারত, চেহারাও ছিল তেমন। কিন্তু গিরিবালামাসির ছিল অফুরন্ত স্বাস্থ্য। আকালুর বড়ছেলে দিগেন আর আমি একসঙ্গে মাসির কোলে বড় হয়েছি। আমি হওয়ার পর মার কঠিন ব্যারাম হলে আমি আর দিগেন এই মাসির বুকের দুধ ভাগাভাগি করে খেয়েছি। দিগেন পরে ফাঁকা মাঠে মাথায় বাজ পড়ে মারা যায়। আকাশে কালো মেঘ দেখে আমাদেরই গোরু আনতে দৌড়ে মাঠে গিয়েছিল। সেই একবারই আমি বাজপড়া পোড়ামানুষ দেখেছি।

সেই ভয়ংকর ঝড়ের দিনে বাবা বোধহয় আকাশের ভাবগতিক পোড়খাওয়া মাল্লার মত বুঝতে পেরেছিলেন। সংসারও তো এক দরিয়া বটে। বাতাস উঠতে না উঠতে বাবা দৌড়ে গিয়েছিলেন গিরিবালামাসির খবর নিতে। তিনি বোধহয় প্রলয়ের আঁচ পেয়েছিলেন। পিঁপড়ে, আরশোলা, এ রকম আরও কিছু কীটপতঙ্গের মত তিনিও হয়তো উষ্ণতা, বাতাসের গতিবেগ, আর্দ্রতার পরিমাণ বুঝতে পারতেন। মাসিকে সাততাড়াতাড়ি নিয়ে এলেন আমাদের পাকা বাড়িতে। বৈশাখুর কান্না আর ঝড় নাকি একেবারে কাঁতায় কাঁটায় মিলে গিয়েছিল। তাইতে আমার মা ওর নাম রেখেছিলেন ঝড়েশ্বর। সেটা ছিল ঊনিশ’শ চল্লিশের পঁচিশে বৈশাখের রাত্রি।
সন ঊনিশ’শ পঞ্চাশে আমরা চলে আসি জলপাইগুড়িতে। আমার বাবা ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের উগ্র সমর্থক। তিনি কথায় কথায় প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন নেহেরু কোথায় কোথায় ভুল করেছে এবং প্যাটেল কোথায় কোথায় ঠিক করেছে। রাখালকুড়ায় থাকার সময় দেখেছি বাবা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। জলপাইগুড়ি, পার্বতীপুর, দিনহাটা – এ সব জায়গায় বাবার আসাযাওয়া ছিল। দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রীতিমত গুরুগম্ভীর আলোচনা হত আমাদের বাড়িতে। বিচারবিশ্লেষণ, মন্তব্য, সিদ্ধান্ত – বাবার কথাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত। বাবার ওপরে কেউ আর কথা বলত না।

দেশবিভাগের মারাত্মক ফলগুলো তখন এক এক করে ফলতে শুরু করেছে। যুদ্ধ, দাঙ্গা পার হয়ে এবার দুর্ভিক্ষ। প্রবল খাদ্যসমস্য সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত আমেরিকার কাছে হাত পাততে হয়েছে। সুযোগ বুঝে আমেরিকা ঋণের শর্ত নিয়ে টালাবাহানা শুরু করেছে। এদিকে সোভিয়েত দেশ আর চীন থেকে খাদ্যশস্য আমদানি শুরু হলে মার্কিন দেশ তড়িঘড়ি ভারতকে গম কেনার জন্য ঊনিশ কোটি ডলার মঞ্জুর করে দিল। এদিকে তীব্র গণ-আন্দোলন, আভ্যন্তরীণ জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আমেরিকা ও বৃটেনের কূটনৈতিক চাপ – জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা যেন দিশেহারা হয়ে পড়ছিলেন।
তখনকার রাজনীতিতে দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বল্লভভাই-এর নীতি আমার বাবার খুবই পছন্দ হয়। দেশীয় অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত সংস্থার অবাধ প্রবেশ, সমস্ত ভূস্বামী ও জমিদারদার সঙ্গে সমঝোতা, সংগ্রামী আন্দোলন দমন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমি দেশগুলোর প্রভুত্ব স্বীকার – এ সবই বাবার কর্মক্ষমতা ও চিন্তাভাবনাকে দ্বিগুণ তেজে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল। ছোটবড় জোতদার, উঠতি বড়লোক – এরা সবাই আমাদের ঘরে বসত। অনেক রাত পর্যন্ত দেখতাম শলাপরামর্শ চলছে। ধীরে ধীরে সর্দার প্যাটেলের মর্যাদা ও প্রভাব বাড়তে থাকলে আমার বাবার দাপ আরও বৃদ্ধি পায়। পাড়ই থেকে তিনি যেন মহাপাড়ই-এর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। ঊনিশ’শ পঞ্চাশের ফেব্রুয়ারিতে প্যাটেলের উদ্যোগে নিবর্তনমূলক আইন পাশ হয়। এই আইনে পুলিশ রাজনৈতিক কারণে বিনা বিচারে কোনও তদন্ত ছাড়াই যে কোনও ব্যক্তিকে এক বছর আটকে রাখতে পারত। বাবা প্রায় দুহাত তুলে নাচতে আরম্ভ করেন। অ্যালা কোটে যাবো রে বাউ। লৌহমানব, বুঝলু রে কাইচালু।
কিন্তু ডিসেম্বরে প্যাটেলের মৃত্যু হলে কুলাক এবং জমিদারশ্রেণী একটা ধাক্কা খেল। নেহরুর সামন্তবিরোধী কৃষিসংস্কার প্রগতিশীল মোর্চাগুলির, এমন কী বামপন্থীদেরও সমর্থন পায়। দেশে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন জওহরলাল নেহরু। ঊনিশ’শ একান্নতে শেষ পর্যন্ত নেহরু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি মনোনীত হয়ে যান।
আমার বাবা কেমন যেন মিইয়ে গেছিলেন। ডিসেম্বরে সর্দার প্যাটেলের মৃত্যু তার বুকে বড় শেল হেনেছিল। এক ধাক্কায় আমরা সবাই জলপাইগুড়িতে চলে আসি। এক্ষণ আর কথায় কথায় তিনি নেহরুকে অতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন না। এ রকম সময়ে একদিন তিনি আমার কাছে কম্যুনিজম্‌ বিষয়ে জানতে চান। আমি তার অনেক আগে থেকেই বামপন্থী ছাত্র সংগঠনে ভিড়ে গেছি।
বাবাকে কম্যুনিস্ট বানানোর জন্য আমার কোনও আগ্রহ ছিল না। আমার বাবাকে আমি ভালোই চিনতাম। তার রক্তে ছিল কংগ্রেস। রংপুরে আমাদের ভূ-সম্পত্তির এবং অস্থাবর সম্পত্তির প্রায় সমপরিমাণ সম্পত্তি তিনি নানা কলে কৌশলে বিনিময় করেছিলেন। কিন্তু এখানে এসে জমিজমার প্রতি আকর্ষণ তার বেশ কমে যায়। বরং সিনেমাহল, করাতকল, চা-বাগানের শেয়ার – এসব দিকে তার ঝোঁক দেখা যায়। তা হলেও হলদিবাড়ি আর মেখলিগঞ্জে আমাদের নেহাত কম জমি ছিল না।
আমি তখন সারা ভারত কিষাণসভার হয়ে গ্রামে কাজ করতে শুরু করেছি। নতুন প্রজাস্বত্ত্ব আইন ব্যাখ্যা করা, রায়তচাষিদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার, সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিভিন্ন চেহারা পরিষ্কার বুঝিয়ে দেওয়া – এসব কাজ করে যাচ্ছি। জোতদারের ছেলে হয়েও মাঠে ঘাটে পড়ে থাকি, চিড়েমুড়ি খেয়ে দিন কাটাই, এর ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষিদের মধ্যে এবং পার্টিতেওয়ামার একটা এক্সট্রা পজিশন হয়। একান্নতে সারা ভারত কিষাণসভার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে আমাদের কাজে কর্মে বেশ জোয়ার আসে। জমির জন্য সংগ্রাম, ভূমিস্বত্ত্বের জন্য সুবিধাজনক শর্ত ইত্যাদি কারণে কৃষক আন্দোলন তখন জোরদার হয়েছে। আমার বাবা এবং জোতদার জমিদাররা কৃষি-সংস্কারের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে ভাগচাষিদের বেশি করে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য স্থায়ী-রায়ত উচ্ছেদ শুরু করেছে। কয়েক জায়গায় দাঙ্গা হাঙ্গামাও হয়।
কৃষি-সংস্কার বিল আইনসভায় গ্রহণ এবং অনুমোদন পায় বটে, কিন্তু আসল অবস্থার কোনও হেরফের ঘটে না। আমরা এটা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। জমিদারের নিজস্ব খামার, কৃষিযন্ত্রপাতি, গো-সম্পদ, অন্যান্য সম্পত্তি এবং বসতবাটি এলাকার বিশাল মালিকানার কোনও রদবদল ঘটে না। আমাদেরও তাই হয়। উপরন্তু দিনবাজারে বাবা একটা সাইকেলের দোকান, একটা ওষুধের দোকান খুলে বসলেন।
এ রকম সময়ে একদিন হঠাৎ আমাদের জলপাইগুড়ির বাড়িতে বৈশাখু এসে হাজির। পঁচিশে বৈশাখ সেই ঝড়ের রাতে যার জন্ম হয়েছিল, এক্ষণ সে প্রায় পনেরো ষোলো বছরের কিশোর। কিন্তু সে তার মায়ের মত স্বাস্থ্য পেয়েছে, ফলে যুবা মনে হয়। প্রথমে তাকে আমি চিনতেই পারিনি। আমার বাবার কাছে সে তার বাবার নাম বললে বাবা কিছুক্ষণের জন্য থ মেরে যান। তখন সে তার মায়ের নাম বললে বাবার টনক নড়ে। তখন বাবা গিরিবালার ছোয়াটাক চিনতে পারেন। অনেক কষ্টে সে আমাদের ঠিকানা জোগাড় করে টুনিয়ার হাট দিয়ে এপারে এসেছে।
আমার মা দুপুরে তাকে খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। বিকেলবেলা বাবার কাছে গিয়ে বৈশাখু একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল। জিলা রংপুরের সৈয়দপুর রাখালকুড়ায় নাকি তার বাবার নামে সাড়ে চার বিঘা জমি আছে। বৈশাখু সে জমির হালহদিশ জানতে চায়। জমির পূর্বপশ্চিম উত্তরদক্ষিণ চৌহদ্দির হিসেব চায়। তার বাপ সারা জীবন শুধু পেটেভাতে আমাদের গো-সম্পদ রক্ষা করে গেছে, জমির আগাছা পরিষ্কার করেছে, আমাদের বাগানের ফলপাকুড় ও পুকুরে মাছ পাহারা দিয়েছে। এক্ষণ তার ব্যাটা এসে সাড়ে চার বিঘার হিসেব চায়। কেউ বোধহয় উসকে দিয়েছে।ওদিকে নাকি জমি মাপামাপি হচ্ছে। তা ছাড়া সে জমি এখন আমাদেরও নয়। বদলে এখানে আমরা দিব্বি আছি। হঠাৎ বৈশাখু উল্টোপাল্টা কথা বলে কেন।
ছেলেটাও, ওইটুকু দুধের শিশু, কেমন কথা শিখে গেছে। ঘাড় বাঁকিয়ে বলে দিল – হামার জমিন হামাক দিবা হোবে। দেশভাগ হয়ে গেছে, দু’দেশের জমির মাঝে পিলার বসে গেছে – এসব কি ছেলেটা কিছু জানে না। জমি তো তার বাপের নামে থাকতেই পারে। শুধু আকালু বা বৈশাখু নয় – কতশত উপিন, নগেন, চৈতুর নামে বাবা জমি রেখেছিলেন। সে সব কারও মনে আছে নাকি। এখানেও কিছু আছে। আমি জানি। কিন্তু সেখানকার জমি তো এখন আর আমাদের নয়। এ গোঁয়ার ছেলেকে এখন আলাদা রাষ্ট্রের নিয়মকানুন বোঝানোই মুশকিল। তা ছাড়া, জমি ফেরত-ই বা চায় কোন মুখে। আজীবন, মানে ওখানে যতদিন আমরা ছিলাম, ওদের পুরো পরিবারের ভরণপোষণ কি আমরা করিনি। অসুখবিসুখ হলে কে দেখেছে। ওরা যেমন আমাদের গোরুবাছুর দেখাশোনা করেছে, ঘাস খাইয়ে এনেছে, বালতিভর্তি দুধ দুয়েছে, তেমন আমরাও ওদের দেখাশোনা করেছি, আপদেবিপদে রক্ষা করেছি। জমি ওদের হাতে দিলে থোড়াই ওরা রাখতে পারত। গ্রামের লোক ভুজুংভাজুং দিয়ে কবে হাতিয়ে নিত।
সন্ধেবেলা বাবা আমাকে ডাক দিলেন। আরে কমুনিস, কনেক শুনি যা। আকালুর ব্যাটা কী কহছে শুনিবার পাছিস ? আমি চুপ করে রইলাম। আগ বাড়িয়ে কিছু না বলে আগে বাবার বুদ্ধিটা দেখি।
কায় বুদ্ধি দিসে। সাড়ে চাইর বিঘা জমিন, মোর তো ফমেই নাই – অ্যালা ফিরত চাহাছে। পাগল। মুই কহে দিছু, যার জমিন উমাক ক। মুই না জানো।
সে কেন দেবে। তুমি কি তাদের বলে এসেছিলে এই সাড়ে চার বিঘা জমি আকালু বর্মনের। তস্য পুত্র বৈশাখু বর্মনের চিহ্ন দিয়ে এসেছিলে ?
ছোয়াটাক দেখি মনটা হাচোং পাচোং করে। মনটা কহে কুরুয়া হয়্যা আকাশত্‌ পাংখা মেলি ওই দ্যাশত্‌ উড়িয়া যাও।

আমার হঠাৎ মনে হল সর্দার প্যাটেলের অকৃত্রিম ভক্ত, একনিষ্ঠ সেবক নেহরুর লাইনে যাচ্ছে। লাইন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। লৌহমানবের শরীরে গোলাপের সুগন্ধ। লালগোলাপের।
ওর বাবা আকালুর খবর কী ?
জমিনের কাথা শুনিবার পাছত্‌ কান্দা ধইচ্ছে।
বৈশাখুর মা ?

বাবা আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। শেষে চোখ সরিয়ে মুখ অন্যদিকে ঘোরালেন।
কায় জানে। অয় তো কহছে মরি গেইসে।
বৈশাখুর মায়ের কথা আমার অস্পষ্ট মনে পড়ল। আমার ধাইমার কথা। উদয়াস্ত আমাদের বাড়িতে পরিশ্রম করে যাচ্ছে।অসম্ভব ভালো স্বাস্থ্য ছিল মাসির। আমি এই গিরিবালামাসির কোলেপিঠে বড় হয়েছি। গিরিবালাকে আমি মাসি বলে ডাকতাম। আমার মা-ও মাসিকে খুব ভালোবাসত। লুকিয়ে ভালো জিনিস খেতে দিত। বৈশাখু হলে মা বলেছিল ওর নাম ঝড়েশ্বর রাখতে। আমি হওয়ার পর থেকেই মার শরীর ভীষণ ভেঙে যায়। নীলফামারির বড় ডাক্তার দেখিয়েও কোনও লাভ হয়নি। মায়ের সব কাজ মাসিই করে দিত, আবার দেখতাম অনেক রাত পর্যন্ত বাবার ঘরে বাবার হাতপা টিপে দিতে। আমাদের তখন সে ঘরে ঢোকা বারণ ছিল।
সেই ঝড়ের মুখে বাবা দৌড়ে গেছিলেন মাসির খবর নিতে। প্রায় কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের পাকা ছাদের নীচে। সেখানেই বৈশাখুর জন্ম হয়। আমবাগান, ধানের খেত আর পুকুর – আমাদের এই তিন সম্পত্তির তেমাথায় ছিল আকালুর ঘর। পরদিন সকালে আমরা দেখেছিলাম সেই ঘরের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। বাবা যদি ওই সময় গিয়ে মাসিকে না আনত ... নিশ্চয় ডেলিভারির ব্যথা শুরু হয়েছিল। বাবা বোধহয় খবর রাখত। বৈশাখু বড় হলে কৃপণ লৌহমানবকে দেখতাম ঝুমঝুমি আর রঙিন জামা কিনে দিতে। আমার চিরকালের রুগ্ন মা গিরিবালামাসির চুলের জট চিরুনি দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে দিত। উকুন বেছে দিত। সাবান মাখতে বলত।

এখন একটা ভয়ংকর কুটিল সন্দেহ আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। আমি শ্রীপূর্ণচন্দ্র বর্মন এবং পনেরো বছরের কিশোর বৈশাখু বর্মনের মুখের আদলে সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করি। বাবার মুখটা ভালো করে লক্ষ করি। আমার চিন্তাভাবনা ক্রমশ আরও জটিল হিসেবের দিকে যেতে থাকে।
আচ্ছা, জলপাইগুড়ির সম্পত্তি দুভাগ হলে কেমন হয়। রায়কতপাড়ার বাড়িটা বৈশাখুকে দিয়ে দেব। হলদিবাড়ির জমিগুলো আমি রাখব। খুব উর্বর। নতুন সিনেমাহল ও চালাতে পারবে না। ওটা বরং আমার থাক। কাঠের মিলটা বৈশাখু নিক।
কিন্তু বৈশাখু যদি কিছুই নিতে রাজি না হয় ? ও যদি ক্রমাগত সেই সাড়ে চার বিঘার কথা বলে, বলে যেতে থাকে – তাহলে ওকে কী দিয়ে ভোলাব।
প্যাটেলের মস্তিষ্কজাত মৃত্তিকাসংরক্ষণ ও নেহরুর মস্তিষ্কজাত মৃত্তিকাবিভাজনের ফলে উদ্ভূত সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমরা দুজনই প্রস্তুত হই।
এসব অবশ্য অনেক পুরনো কথা।

লেখক পরিচিতি
বিপুল দাস

গল্পকার, উপন্যাসিক
জন্ম : ১৯৫০, থাকেন শিলিগুড়িতে।
গল্পগ্রন্থ: শঙ্খপুরীর রাজকন্যা
উপন্যাস : লালবল। সরমার সন্ততিরা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ