দীপংকর গৌতমের গল্প : দোলনাটা দুলছে

আকাশের মেঘ দেখে তার স্ত্রী কপিলা কপালের দিব্যি দিয়েছে সমুদ্রে না যাওয়ার। তার শরীরটা ভাল না। বউয়ের এঅবস্থায় অনিলেরও আর যেতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ো বাতাসের গন্ধ পেয়ে সে বাইরে এসে দেখছিল অন্য জেলেরা মাছ ধরতে নেমেছে কিনা। কিন্তু না কেউ নামেনি। অনিল তার নৌকার আরেক জেলে সুশীলকে ডাক দেয় অন্ধকারের মধ্যেই- ও সুশীল, সুশীল আছোস?

কোন উত্তর আসে না। চৈত্রের অমাবস্যার অন্ধকার। উত্তাল সাগর। কোনও আলো কোথাও দেখা যায় না। সোনা দ্বীপে ঝড়ো বাতাসের ভেতরে একা অনির জলদাস তার সারা জীবনের সঙ্গী সুশীলকে না পেয়ে আবার আকাশের দিকে তাকায়। অনিলের ভয় করে। কিসের ভয়? না, ভয় নেই। সে একা একা বলে, কিন্তু তার মুখ শুকিয়ে যায়। সে তার কোমরের রক্ষাকবচ লোহার তাবিজ ছুঁয়ে দাঁড়ায়। বাতাস হু হু করে তার ভেতর কে যেন কাঁদে। অশরীরি এই কান্না ধ্বনি কি কোন প্রেতালোক থেকে আসছে? সে শুনেছে যত ভূত প্রেতই আসুক আগুন জ্বালালে কিছুই থাকতে পারে না। অনিল কোমরে রাখা ম্যাচ দিয়ে বিড়ি ধরাতে চায়। বিড়ি ধরে না। ঝাটকা বাতাসে নিভে যায় সব। অনিল ভয় পেয়ে যায়। তার এবার মনে পড়ে ’৭২ সালের জলোচ্ছ্বাসের কথা। তখন তারা এ দ্বীপে নয়, সাগরপাড়ের জনপদ অলতলীতে থাকত। সেদিনও অনিলের বাবা বুড়ো গৌরাঙ্গ নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিল, মা গিয়েছিল মাঠে গরু আনতে আর অনিল এসেছিল তার বাবার জন্যে বিড়ি কিনতে বাজারে। সেদিনও মেঘ দেখে তার ভয় হচ্ছিল এমনই। কয়েকজনকে ভয়ের কথা বললে তারা বলেছিল- ভয় করলে ঠাকুরকে ডাক। তারপর তার জল আর জল ছাড়া অন্য কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে এই আকাশ তাকে বাবা-মা শূন্য করেছে। তাকে করেছে সর্বহারা। যার জন্যে জীবন দোলায় ভাসতে ভাসতে সে এসেছে সোনা দ্বীপে। সে জেলে। সাগরে মাছ ধরে। চৈত্রের শুরু থেকে আশ্বিনের শেষ তার মৌসুম। এ সময়ের আয়ে তার সারা বছর চলবে। কিন্তু প্রকৃতির যে রুদ্ররোষ তাতে দিনের পর দিন সে নামতে পারে না জলে। প্রকৃতি ভারসাম্য হারিয়েছে বলে এ দশা হয়েছে সমুদ্রের- এ কথা তাকে বোঝাবে কে?

সে রাজনীতি রোঝে না। আবহওয়া বিজ্ঞান বোঝে না, নদীর রাজনীতি বোঝে না- বোঝে মৌসুমে তার রাত শেষে ১০০ থেকে ১৫০ ইলিশ চাই। নতুবা সে খাবে কী?

এই ইলিশেওবা তার আয় পড়ে কত? নৌকায় সে সুশীল ছাড়াও অমর, মানিক, লোহাচান আবার কখনও কখনও গণেশও আসে। সকালে মাছ বিক্রির সময়ে ১০ হাজার টাকা আসলে নৌকার খরচের টাকা ৩/৪ শ’ বাদে বাকি টাকা অর্ধেক ভাগ হবে। এই অর্ধেক টাকা জাল ও নৌকার ভাড়া বাবদ মালিক নেবে। বাকি টাকা ৬ জনের মধ্যে সমান ভাগ। এতে কর্জই বা শোধ করবে কি আর খাবেই বা কি? কিন্তু সংকট হচ্ছে এবারে সাগরে ইলিশ আসছে না। ঘরে ঘরে হাহাকার। জেলেরা শুনেছে ভূমিকম্পের ফলে বাংলাদেশের দিক উঁচু হয়েছে আর বার্মার দিক নীচু হয়েছে। ফলে বার্মার দিকে ইলিশ ধরা পড়ছে বেশি পরিমাণে। এ খবর আসে কিন্তু অনিল কি করবে? তাদের আয় কমলেও ক্ষুধা যেমন শোনে না তেমন শোনে না পুলিশ আর নৌ দস্যুরা। পুলিশদের সপ্তাহে ২৫ টাকা দিতেই হবে। একটু একটু করে হলেও এ টাকা পরিশোধ করতে হবে। খাকি পোশাক পরে পুলিশ সাহেবরা জেলে পাড়ায় আসে অনিলের তা ভাল লাগে না। বড় অফিসার একদিন অনিলের বউয়ের দিকে নৌ-বাহিনীর সিগন্যাল বাতির মতো চোখ করে তাকিয়েছিল, নামও জিজ্ঞেস করেছে। অনিলের সেটা ভাল লাগেনি। এই আসটে গন্ধ শুঁকতে শালারা আসে কেন অনিল বোঝে আবার বোঝে না।

এরপর নৌ দস্যুরা তো আছেই। বন্দুক নিয়ে ট্রলারে রাতভর ঘোরে। জেলেদের বাগে পেলে জাল, টাকা নিয়ে মারধর করে একশেষ করে। পাশে বাড়ির জগামাধবকে তো মেরে সাগরে লেলে দিয়েছিল। জাল ট্রলার সব নিয়ে গেছে। অনিলের দৃষ্টিতে না পড়লে বাঁচা লাগতো না।

কিন্তু এই সিঁদুরে মেঘ ভরা রাত অনিলের ভাল লাগছে না। তার টাকার খুব দরকার। বউয়ের চার মাস চলছে। পোয়াতি বউ। ভাল ভারাব খাওয়াতে হয়। তারপর সন্তান হতে গেলে দাইমাসহ কত খরচ। এত টাকা সে পাবে কোথায়? কিন্তু এ সময় কেন যে বাচ্চা নিতে গেল, ভার ভয় হয়। কোন রকম বিপদ হলে এই দ্বীপে ডাক্তার নেই। পাশের দোকানে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, ওপরে এন্টাসিড। এই হল দ্বীপের চিকিৎসা। সে যাবে কোথায়? আশ্বিন না আসলে এই উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে কে যাবে ডাক্তারের কাছে? কার আছে এ সাধ্য? অনিলের জীবনের একমাত্র অবলম্বন কপিলা। তার বউ। বুদ্ধি পরামর্শ সবই তার বই। ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে। তারপরও কাউকে ছাড়া কেউ বাঁচে না। পাড়া-পড়শীরা তাদের মিল দেখে হাসে।

অনিল মাছ ধরে তাই বিক্রি করে। এই তার পেশা। সন্তান নেবার কথা শুনলেই তার ভয় করে। কারণ এই দ্বীপের যাত মেয়ে মারা যায় সব সন্তান হবার সময়। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না। ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা ছড়া মারা যায় গত্যন্তর শূন্য হয়ে। তাছাড়া এত কম বয়সে জলদাস শ্রেণীর ভেতরে বিয়ে হয় যে বয়সে সন্তান ধারণ খুবই কঠিন। এখানে স্কুল-কলেজ নেই, কোন শিক্ষাও নেই। জন্মবিষয়ক শিক্ষা সম্পর্কেও তাদের ধারণা এতটাই কম যে তারা বিশ্বাস করে সব ভগবানের দান?

কিন্তু কাপিলা বহু জায়গা ঘুরে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শুনে যখন বোঝে যে সে মা হতে যাচ্ছে প্রথমে ভয় হলেও মাতৃত্বের আবীর রঙ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তার পশমের ফাঁকে ফাঁকে বাতাস ছাড়িয়ে পড়ে। সে মা হতে চায়। মা ডাক শোনার ইচ্ছায় বিভোর কপিলা অনিলকে ধরে কেঁদে ফেলে।

- একট সন্তানও যদি না থাহে তাইলে কি লইয়া এই এক ঘর সারা জীবন পাড়ি দিমু।

- নদীরও একটা চর থাহে, সাগরের দ্বীপ থাহে- আমার? কেডা আছে কও? তুমি, তাওতো থাহো সাগরে। আমি কীভাবে বাঁচি?

নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে অনিল।

তারপর কপিলার মুখটা দু’হাতে চেপে ধরে বলে,

- হ, তোর ইচ্ছাই হবে। আমি বাবা অমু তয় ভগমানেরে ডাহিস, আমার যেন এট্টা মাইয়া অয়। মাইয়া না অইলে বাবার শান্তি নাই। বাবা-মা মরলেও দেহিস মাইয়া না থাকলে কেউ শোক করে না।

- বিলীন অইয়া যাইতে চাই। আর ভাল লাগে না। মাইয়াডা বিয়ার পর মইরা গেলে মোরা বিলীন অইয়া গেলাম। কেউ মোগো নামও লবে না।



তারপর নীরবতা নেমে আসে। কপিলা যেন সব সমস্যা অনিলের পর অর্পণ করে স্থির হয়। তারপর অনিলকে ডেকে বলে,

- দেহো সাগরে আর আগের মত সাহস দেহাইতে যাইও না। এহন তুমি আর একা নাই। আমরা তিনজন ঘটনা মনে রাইখো।

চুপ করে থাকে অনিল। সে বাবা হবে। বহু সংশয়-আনন্দ-অনুভূতি সবই তার মধ্যে ঢোকে। পাড়া-পড়শী থেকে নৌকার জেলেরা টিপ্পনী কাটতে শুরু করে। কত রকমের অনুভূতি খেলে তার ভেতরে। এখন সে সমুদ্রে সুর্য ওঠার দৃশ্য দেখে প্রতিদিন। তার ভেতরে বহু প্রশ্ন দেখা দেয়। কি দারুণ লালাভ আভা ছড়িয়ে কাঁচা ডিমের কুসুমের মত পৃথিবীতে সূর্য এসে ছায়াপাত করে। তারপর সমুদ্র থেকে উপকূল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই সূর্য কি তাহলে পৃথিবীর ভ্রুণ। শুধু কি তাই প্রতিদিন সে নৌকা মালিকের কাছে ঠকে কিন্তু এখন সে এক অনাগতর বাবা সে কি তার সন্তানকে ঠকাটাই শিক্ষা দেবে? অনিল যা তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে? না, তা হতে পারে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জটিলতার সব দেয়াল ভাংতে না পারলে এটাতো থেকেই যাবে। অনিল আর ঠকবে না।

পুনরায় অনিল চিরচেনা সমুদ্রের দিকে তাকায়। বাতাস ক্রমশ বাড়ছে। সাগরটা তার পুরো অচেনা। দস্যুরাও আজ ডাকাতি করতে নামেনি। কাকে কে ডাকাতি করবে। একের পর এক বিড়ি শেষ করতে করতে ক্লান্তিতে সে ভেঙ্গে পড়ে। ইদানিং ইলিশ ধরা ছাড়াও সে বেশ কিছু টাকা আয় করেছে বাড়তি পরিশ্রম করে। দিনের বেলায় না ঘুমিয়ে রাতে সাগরে কাজ করা যায় না। তবু বাড়তি আয় না করলে তার কি করে চলবে? সাগরে ইলিশ নেই। আবার তার সন্তান হবে। অনাগত সন্তানের জন্যে অনিল সেদিন সোনা দ্বীপের হাট থেকে বেতের তৈরি একটা দোলনা কিনে এনেছে। কপিলা খুব অখুশী না হলেও এ সময় এত টাকা খরচ তার ভাল লাগেনি। তাছাড়া বাড়তি শ্রম দিতে দিতে অনিলের চোখের নীচে কালি পড়ে এসেছে- শরীরটাও কেমন ভাড়াচোরা হয়ে গেছে।

অনিল সকালে বিকালে দোলনাটাকে দোলায়। ভেতরে কাঁথা ও বালিশ রেখে বহু সময় দোলনাটায় দোল দেয়া তার এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কপিলা প্রায়ই হাসতে হাসতে বলে- তুমি কি পাগল অইয়া গ্যাছো? এমন দ্যাকলে মাইনসে কি কয়?

অনিল জবাব দেয় না। চুপ করে কথাগুলো শোনে আর দোল দিতে থাকে। দোলের সাথে সাথে ক্যার ক্যার করে একটা বেসুরো আওয়াজ হতে থাকে। অনিল এ আওয়াজের ভেতরে কী যেন খোঁজে। এ কি তবে সর্বহারাকরণের কোন প্রাকৃতিক শব্দ? সে শব্দ উদ্ধারের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় অনিল কিন্তু ব্যর্থ হয়।

এসব ভাবনা ভাবতে এই দুর্যোগের ভেতরে সে আজ অন্ধকারে কালো কাপড়ে মোড়া এক সমুদ্র দেখছে। কী অচেনা। বাতাসের গতি বাড়ছে। ঢেউ ক্রমশ দৈত্যাকারে ছড়িয়ে পড়ছে। মেঘরঙ সিঁদুর হয়ে পৃথিবী পিন্ড যেন আবীর বরণ হয়ে যাচ্ছে। তার বুক কাঁপে। পৃথিবীর মনে হয় রক্তস্রাব হচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে সব। ওলট-পালট হচ্ছে পৃথিবী। ঝড়ো বাতাসের সাথে বৃষ্টি। রক্তিম চারদিক। শো শো আওয়াজের মধ্যে সে শিশুর আর্ত চিৎকার শোনে। সে দৌড়ায়- সাগরপাড় থেকে তার ঘর যেখানে সেখানে কুপিটা জ্বলছে। প্রথমে সে- সুশীল, পঞ্চানন বলে অনেক সাথীকেই ডেকেছে। কেউ আসে নি। তারপর কপিলা, কপিলা ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢোকে। কচার বেড়া- কুপি জ্বলছে। কপিলা অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তার কাপড় ভিজে পা বেয়ে রক্ত ধারা ছুটছে সাগরের দিকে। লাল- চারদিক লাল। বাতাস প্রবল। বাতাসে তার স্বপ্নের দোলনাটা সেই শূন্যতার শব্দ তুলে তুলে যাচ্ছে। এবার সে থামাতে চাইছে। কিন্তু দোলনাটা থামে না, তা দুলে যাচ্ছে- অবিরাম। অনিল পার হয়ে সে দৃশ্যটাই দেখতে দেখতে বোবা হয়ে যায়। বাইরে ঝড় তখনও চলছে। ০







লেখক পরিচিতি 
দীপংকর গৌতম

কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক। জন্ম: কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। লিখেন দেশ-বিদেশের কাগজে। কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গবেষণাসহ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। তার মধ্যে কাব্যগ্রন্থ মেঘ-বিচ্ছেদ(২০০৩) এবং মেঘ বলি কাকে (২০০৪) নব্বইয়ের কবিতায় বিশেষ নিরীক্ষার দাবি রাখে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। ই-মেইল : dipongker@yahoo.com, +88 01715 816169

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ