মানুষের ইতিহাসে যাকে ‘বিকেন্দ্রীভবনেরযুগ’বলাহয়, গ্যালাক্সি জুড়ে মানুষের ছড়িয়ে পড়ার সেই যুগেরসূচনার
প্রায় চার শতাব্দি আগে লিখিতএই বিচিত্রগল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আদি গ্রহ
শীলাবতীর একটি কাগজে ছাপানো সংবাদপত্রে;৩৭ অব্দের চতুর্থ মাসের সপ্তম দিনে, অর্থাৎ
আজ থেকে প্রায় সাত হাজার আটশো বছর আগে। প্রাচীন আলিহান ভাষায় রচিত বিজ্ঞানভিত্তিক
এই রোমান্সে লেখিকার ভিশনারি দৃষ্টি সেই প্রাচীন যুগে বসেও দূর ভবিষ্যতের বহু
আবিষ্কারের কথা সার্থকভাবে অনুমান করতে সক্ষম হয়েছে। যথা মহাকাশভ্রমণ, যন্ত্রগণক, স্বপ্নসফর
ইত্যাদি। উল্টোদিকে, কিছু কিছু বিচিত্র কল্পনারও দেখা মেলে এ গল্পে, বাস্তবে যা
সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
যথা পৃথিবী নামক স্বর্গগ্রহের কল্পনা, ‘পুরুষ’নামে এক শ্রেণীর সন্তান ধারণে অক্ষম মানুষের কথা, কিংবা মহানগর
(আধুনিক গ্যালাকটিক ভাষার মেনাগারবানরক) নামের এক ধরণের যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত ভয়াল মানব
উপনিবেশের কল্পনা। আশ্চর্যের বিষয় হল, নরকসদৃশ এই উপনিবেশের কল্পনা আবার করা হয়েছে
খোদ স্বর্গগ্রহ পৃথিবীর বুকেই! সেই প্রাচীন, ধর্মান্ধ যুগে এমন বৈপ্লবিক ও
ধর্মদ্রোহী কল্পনার ক্ষমতা ও সাহস গ্যালাক্সির যে কোন গ্রহেরআধুনিক পাঠককেই
নিঃসন্দেহে অবাক করবে।গল্পটিকে আন্তর্নক্ষত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে অনুবাদ
করবার অনুমতি দেবার জন্য আমরা শীলাবতীগ্রহের দাহালি প্রত্নশালার কর্তৃপক্ষের কাছে
কৃতজ্ঞ।
উৎসর্গঃ
আমার মায়ের পুণ্য স্মৃতিতে। তিনি ছিলেন আমার লেখিকা
হয়ে ওঠবার প্রেরণা।
--অনসূয়া
রত্নপোত
গ্রাম, শীলাবতী
৩১শে
জুলাই, ২১৬৮
অবশেষে সাফল্য! রত্নপোত পেরেছে। আলোর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ গতিতে
পৌঁছেছি আমি খানিক আগে। গত প্রায় আড়াইশো বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ এই গতির স্বপ্নই
দেখে এসেছে কেবল। কিন্তু আমাদের রকেটচালিত ধাতবমহাকাশযানেরা যা কখনো করে দেখাতে
পারেনি, তাকে কত সহজেই করে দেখালো আমার এই নক্ষত্রপালচালিত, কৃত্রিম হীরের পাতে
তৈরি যান!
বৃহস্পতি পার হল রত্নপোত।
কিছুক্ষণ আগে পার্লামেন্ট হাউজ থেকে শেষ সরাসরি মিটিং-এ অংশগ্রহণ করে ফিরছি।
প্রেসিডেন্ট সহ গোটা মন্ত্রীসভাই হাজির ছিল সেখানে।আমার সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য
সকলের কি হুড়োহুড়ি।মানে, আমার ত্রিমাত্রিক ছবির সঙ্গে! মা-বাবা বেঁচে থাকলে দেখে
আজ খুশি হতেন।
তবে, সরাসরি মিটিং এই শেষ।
পৃথিবীর সঙ্গে রত্নপোতের দূরত্ব মোটামুটি এক আলোকঘন্টায় পৌঁছে গেছে।
সম্প্রচারের সময়ের তফাৎ এরপর ক্রমশই বাড়তে থাকবে। আর তিনশো পার্থিব বছর পরে, আলিহা
যুগ্ম নক্ষত্রের গ্রহমণ্ডলে গিয়ে যখন পৌঁছোবে রত্নপোত তখন এই সময়ের তফাৎ গিয়ে
দাঁড়াবে দেড়শো বছরে। অবশ্য সেই পৌঁছসংবাদ দেবার জন্য আমি সেখানে থাকবো না। সে খবর
দেবে ক্লোনদের চতুর্থ প্রজন্মের বংশধরেরা।
ক্লোনের দল! রত্নপোতের
যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত কোল্ডরুম-এ সাজানো গর্ভপাত্রে ঘুমন্ত নিষিক্ত মানব ডিম্বাণুর সারি!
ঘুমোও মানুষের সন্তানেরা, যতদিন না আমার পরিশোধিত দেহভস্ম রত্নপোতের আবহাওয়ায়
সম্পূর্ণ মিশে যায়!
ডক্টর হান ব্যাপারটা খুব
সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন আমাকে। কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে--“সাংস্কৃতিক দূষণ
এড়াবার এই একটাই মাত্র উপায় শীলা। পুরোন
সভ্যতার সবরকম সংস্পর্শ বাঁচিয়ে--”
“কিন্তুকেনস্যার? দূষণকেনবলছেন?
সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা না থাকলে--”
“ওইটাকেইতোএড়াতেচেয়েছি আমরা
এই প্রজেক্টে। নিজেদের সভ্যতার মডেল ওদের নিজেদেরই গড়ে নিতে হবে।”
“আবারপ্রশ্নকরছিস্যার।কেন?”
মৃদু হেসেছিলেন ডক্টর হান।
সেই হাসিতে ব্যথার ছোঁয়া ছিল। তারপর মাথা নেড়ে বলেছিলেন, “কারণটাসহজ।আমাদের সভ্যতার
মডেলটা ব্যর্থ হয়েছে। ভেবে দেখো শীলা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সভ্যতার সূচনাহবার পর মাত্র ছ’শতাব্দিই কেটেছে তো!
কিন্তু এর মধ্যেই টপসয়েল নষ্ট হয়ে গেছে গোটা গ্রহ জুড়েই। মহানগরগুলোর বাতাস
নিঃশ্বাস নেবার উপযুক্ত নেই আর। আয়নমণ্ডল দ্রুত নেমে আসছে ট্রোপোস্ফিয়ারের দিকে। আর
বড়জোর দু-একটা শতাব্দি। তারপর আর জীবিত
প্রাণীর বাসযোগ্য থাকবেনা পৃথিবী। এই মডেলের তাই কোন ভবিষ্যৎ নেই। ওই না জন্মানো
শিশুদের নতুন জায়গায় গিয়ে অন্য কোন নতুন পথেসভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য
প্রথমেই প্রয়োজন পৃথিবীর সমস্ত রেফারেন্স এড়িয়ে তাদের চেতনাকে গড়ে তোলা।
“অতএব তোমার মৃত্যুর পর
তোমার অস্তিত্ত্বের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়েকম্পিউটার ভ্রূণদের প্রথম ব্যাচটার
প্রসেসিং শুরু করবে। নতুন মানুষেরা জেগে উঠবে আনকোরা নতুন পরিবেশে। সেখানে
বর্তমানের পৃথিবী সম্পর্কে সামান্যতম তথ্য থেকে গেলেও নতুন উপনিবেশে পার্থিব
সংস্কৃতির ছাপ পড়তে পারে। সে ঝুঁকিটা আমরা নিতে পারিনা শীলা। এই আমাদের শেষ বাজি।
“কিন্তুএদের শিক্ষা দীক্ষা?
তার কী হবে? সেখানে তো পৃথিবীর বইপত্র, সাহিত্য, বিজ্ঞানকে বাদ দিতে পারবেন না?
তাহলে?”
একটুক্ষণ থেমে থেকে ফের
মুখ খুলেছিলেন ডক্টর হান, “তোমারগোটাযাত্রাটাইখুববোরিংহতেচলেছেশীলা।রত্নপোতেকোনবই,
গান,মুভি কিংবা পৃথিবীভিত্তিক ইন্টারঅ্যাকটিভ স্বপ্নসফর গেম রাখা হয় নি সে তো তুমি
জানো। কম্পিউটারের তত্ত্বাবধানে বারো বছরব্যাপী শরীর ও মনের কঠোর চর্চার প্রোগ্রাম
রাখা রয়েছে ওদের জন্য। শিখবে শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, মহাকাশবিদ্যা,
যন্ত্রবিদ্যা, মহানগর গড়বার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তুবিদ্যা;আলিহার চতুর্থ গ্রহ
পৃথিবী-২-এর ভূগোল, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের পাঠও দেবে তাদের রত্নপোতের কম্পিউটার।তার
জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা আকাদেমির দশ বছরের চেষ্টায় সমস্ত পার্থিব রেফারেন্সমুক্ত
নতুন একটা ভাষা তৈরি করে দেয়া হয়েছে। সেই আলিহান ভাষাতে পৃথিবীর সমাজ, ভূগোল বা
ইতিহাসের কোন চিহ্ন রাখা হয়নি। ওদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা ধর্মগ্রন্থ ‘বিদাস্’-এর পুঁথিতে তার উল্লেখ
করা হয়েছে শুধু এক গল্পকথার গ্রহ হিসেবে, যা কিনা পুণ্যবানের আত্মার অন্তিম
গন্তব্য। সেখানে বিভিন্ন গাথায় গল্পের চেহারায় ধরে রাখা হয়েছে সভ্যতার প্রাচীন
যুগের জীবনযাপনের পদ্ধতি—জীবন যখন শ্রমসাধ্য অথচ আনন্দময় ছিল সেই সময়কার
ধারাবিবরণী। হয়তো তা কখনো তাদের কোন কাজে এসে যাবে! কে জানে! ‘স্বর্গ’-র আলিহান প্রতিশব্দ
হিসেবে বাছা হয়েছে পৃথিবী শব্দটাকে। আর তুমি—শীলা। তোমার মহান
আত্মত্যাগের কথা মাথায় রেখে তোমার নামটাকেও রাখা হয়েছে ওদের ভাষায়। আলিহান ভাষায়
শীলাবতী বলতে বোঝাবে সেই গ্রহে মানুষের সৃষ্টিকর্তা প্রথমা ঈশ্বরী।
“প্রথম ব্যাচেরশিক্ষা শেষ হবার
পর কম্পিউটারের কাজ শেষ। যান চালানো, পরেরব্যাচের ভ্রূণদের পরিচর্যা, সবকিছুরই
দায়িত্ব নেবে সেই প্রথম ব্যাচের মানুষেরা। তারপর, একদিন তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
গিয়ে পৌঁছবে নতুন পৃথিবীতে। হয়তো তৈরি হবে নতুন মহানগর। অথবা, অন্য কোন নতুন
সমাজব্যবস্থা! নতুন সভ্যতার ধারা ছড়িয়ে যাবে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে----”
নাঃ। অনেক হয়েছে। এইবারে
ক্যাপ্টেনের লগ রেকর্ডিং শেষ করবো আজকের মত। কফি খেতে যাবো এবারে। ঠিকানা ইন্ডিয়ান
কফি হাউস, কলেজ স্ট্রিট। হোক না স্বপ্নসফর! হোক কম্পিউটারের তৈরি অনুভুতিভ্রম, তবু
যতক্ষণ আমি আমার নিজের প্রিয় মহানগরকে পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারি ততক্ষণ
সত্যি হোক মিথ্যে হোক, কে কেয়ার করে!
বেচারা ড: হান। আমার নিজের
শহরের স্পর্শকে সঙ্গে রাখবার জন্য আমি কতদূর যেতে পারি তার কোন ধারণা ছিলো না ওঁর।
এই লগ তো কোনদিন ওঁর কানে যাবে না! তাই নির্দ্বিধায় সব বলতে পারি এখানে। আচ্ছা, এই
যে নিজের গোটা জীবনটাকে উৎসর্গ করে দিয়ে এই মিশনটায় এলাম আমি, তার জন্য নিয়মের
সামান্য একটু ব্যাতিক্রম তো আমি দাবি করতেই পারি! শুধু আমার নিজের শহরের একটা স্বপ্নসফর
প্রোগ্রাম! আমার প্রিয় শহর—কল্লোলিনী কলকাতা! রওনা হবার দুদিন আগে যে হীরের
ব্রুচটা হান নিজেই আমায় উপহার দিয়েছিলেন, তার ভেতরকার কার্বন পরমাণুর সজ্জার
সামান্য একটা পরিবর্তন করে নিয়েছি শুধু। সেই পরিবর্তিত সজ্জার মধ্যেই রেকর্ড করে
রাখা আছে প্রোগ্রামটা। যাত্রার আগে গোটা যানটা আর তার সব জিনিসপত্র স্ক্যান করা
হলেও, নিজের দেয়া ছোট্ট এই উপহারটাকে স্ক্যান করবার কথা ওঁর মাথায় আসেনি।
জিনিসটাকে নিয়ে শুধু একটা
রিসেপশনে স্লটে রাখা—ব্যস—এইবারে--হ্যাঁ, এই যে , কম্পিউটার—স্থান ইন্ডিয়ান কফি
হাউস, কলকাতা। ঋতু-শেষ বসন্ত। সাল—উম্--২১৬০। প্রেসিডেন্সিতে আমার ফাইনাল ইয়ার—আহা, সেই ঘাম ঝরা
বসন্তের বিকেল, ভিড়ে ভরা স্কাইওয়ে, পোড়া জ্বালানির তীব্র গন্ধ, অক্সিজেন বার,এমনকি
অন্যমনস্ক শিকারের খোঁজে জন্য ভিড়ের মধ্যে
মিশে নজর রেখে চলা আঙুল চোরের দল--
১৬ আগস্ট
২৪৬৮
মাতৃগ্রহ!অবশেষে!
রত্নপোতের বাইরের দিকের রক্ষা আবরণ সরে গেছে। একটা উজ্জ্বল আলোকবুদবুদের মতো
পৃথিবী-২ এর আকাশে ভাসছে আমাদের রত্নপোত। গ্রহটার বিষুব
অঞ্চলের
ওপর একটা ভূ-সমলয় কক্ষে এসে স্থির হয়েছি আমরা। ঘন্টা দুয়েক আগে, এই সময়টার জন্য
রেকর্ড করে রাখা স্তোত্রটা স্বর্গগ্রহ পৃথিবী-১এর উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে
ইথারের স্রোতে। পৃথিবী-১। রূপকথার স্বর্গগ্রহ।
কে জানে তার কোন অস্তিত্ত্ব আছে কিনা এই অসীম ছায়াপথের বুকে! কিন্তু,
বিশ্বাস বড় বিচিত্র বস্তু। সব যুক্তিতর্কের ওপরে তার স্থান। ধর্মগ্রন্থ বিদাস্-এর
প্রথম অধ্যায় ‘রিকা’রশেষে‘ঘরেফেরারগান’নামেছোট্ট এই স্তোত্রটা
রয়েছে। প্রতিটি শিশুকে তা সুর সহ মুখস্ত করতে হয়। প্রতিটি প্রজন্মেই সপ্তাহান্তিক
প্রার্থনাসভাতে আমাদের পুরোহিত দ্বিতীয়,
তৃতীয়, চতুর্থ শীলাবতীরা সযত্নে স্মরণ
করিয়ে দিয়ে এসেছেন এই স্তোত্রের প্রতি আমাদের কর্তব্যটিকে-- মাতৃগ্রহে পৌঁছোবার
সঙ্গেসঙ্গেই সমস্ত পরিচিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এর সম্প্রচার করতে হবে স্বর্গগ্রহের
উদ্দেশ্যে। সেই গ্রহে ঘুমন্ত পবিত্র দেবতাত্মা নাকি তার ঠিক দেড়শো বছর পরে সেই স্তোত্র
শুনতে পাবেন। তৃপ্ত হবেন দেবতা। সকলের মঙ্গল হবে।
অবশ্য সামান্য একটা
সংস্কার নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবার প্রয়োজনই বা কি! ধর্মীয় কারণে তুচ্ছ একটু শক্তি
বিচ্ছুরণ। তাতে কার কী এসে যায়! তবে, স্বর্গগ্রহ আর তার দেবতাত্মা যদি সত্যিই
কোথাও থেকে থাকেন, তাহলে তাঁর জন্য দেড়শো বছর পরে একটা ছোট্ট চমক অপেক্ষা করে
থাকবে। বুদ্ধিটা রিঙ্গা-র। বিদাস-এর তৃতীয় অধ্যায়ে দেয়া প্রথমা ঈশ্বরী শীলাবতীর
বর্ণনা মিলিয়ে তাঁর একটা ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করে দিয়েছিল সে। তরুণী বয়সের
শীলাবতি সেন, কাঁধ থেকে হাঁটু অবধি ছড়ানো ছায়াপথের ছবি আঁকা একটা ন্-গাটো পরে
পৃথিবী-২ এর একটা পাথরের ওপর বসে আছেন। হাসি হাসি মুখে চোখ বুঁজে মহান স্তোত্র “ঘরেফেরারগান”গাইছেন।সৃষ্টিকর্ত্রীদেবতাত্মা
তাঁর সহচরীর এমন মূর্তি দেখবার জন্য নিশ্চয় প্রস্তুত থাকবেন না!
কাল সকালে ল্যান্ডিং। তার পর, আর পৃথিবী-২ নয়, আর ২৩৬৮ সাল নয়।
শুরু হবে শীলাবতী গ্রহের ১/১/০০০১ তারিখ। অন্য কোন কাল্পনিক গ্রহের নাম আর সনতারিখ
নিয়ে আমরা আমাদের মাতৃগ্রহের জীবন শুরু করতে চাই না।
তৃষা বলছিল, খানিক আগে নাকি দুরবীণে সে নিচে জিভা নদীর দেখা
পেয়েছে। চারপাশে তার ঘন অরণ্য। তার মধ্যে আকরিকসমৃদ্ধ অজস্র ছোটবড় পাথুরে টিলা।
শ্রমিক রোবটদের দলটাকে তাদের বাক্স থেকে বের করে এনে জুড়ে নেবার কাজ শেষ। কাল থেকে
ওই বনের মধ্যে তাদের কাজ শুরু হবে। যন্ত্রগুলো শক্তিশালী। আর কিছুদিনের মধ্যেই ওই
নদী, অরণ্য কিংবা আকরিকসমৃদ্ধ পাহাড়গুলোর আর কোন চিহ্ন থাকবে না। তার বদলে থাকবে
শুধু জল, কাঠ আর নানাধরণের ধাতুর স্তুপ। আমাদের প্রথম মহানগরের গোড়াপত্তণ করবার
তিন প্রধান উপাদান। মহানগরের নামটাও আমরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি, রত্নপোত। ওই
নামের মধ্যে দিয়েই আগামি দিনের মানুষের কাছে বেঁচে থাকবে তাদের পূর্বপুরুষদের
দীর্ঘ আকাশভ্রমণের স্মৃতি।
কেমন দেখতে হতে পারে একটা মহানগর? আমার এ ব্যাপারে একটা ভালো ধারণা
রয়েছে। আমার শিক্ষাদিক্ষা হয়েছে একজন নগর বাস্তুকার হিসেবে। আলো ও বায়ুনিরোধক
আবরণের নিরাপদ ঘেরাটোপের ভেতর স্তরে স্তরে মাটির গভীর অবধি ছড়িয়ে যাওয়া বসতি,
চুম্বকনিয়ন্ত্রিত বহুস্তর স্কাইওয়ে, মৌচাকের গড়ণের অজস্র হাউজিং-এর ভিড়, মাঝেমাঝে
হাইড্রোপনিক কৃষিকেন্দ্র, প্রোটিন প্ল্যান্ট, শিশু প্রজনন কেন্দ্র, মৃতদেহ ও বর্জ্যের
পুণঃপ্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র, স্কাইকার ল্যান্ডিং স্ট্রিপ, বিজনেস সেন্টার—এই সবই তো আমার জানা আছে। কিন্তু, মহানগরের
বাসিন্দা হবার অনুভূতিটা ঠিক কেমন? বইতে পড়েছি, মহানগর তার নিজের অস্তিত্ত্ব দিয়ে
তার প্রতিটি বাসিন্দার চেতনাকে ঘিরে ধরে তাকে সে অস্তিত্ত্বের অংশ বানিয়ে নেয়। একক
স্বাধীন সত্ত্বার বদলে প্রতিটি মানুষ সেখানে এক বৃহত্তর অস্তিত্ত্বের অংশ হয়ে
বেঁচে থাকে। যেন একটা বিরাট জীবের দেহের এক একটি কোষ। কেমন লাগবে আমাদের সেইভাবে
থাকতে? কে জানে! গভীর মহাকাশের সন্তান আমরা। কোথা থেকে এলাম, কেমন করে এলাম কিছু
জানিনা। ইতিহাস বলতে শুধু কোন এক কাল্পনিক গ্রহের গল্প শুনেছি ধর্মগ্রন্থের পাতায়।
মহাকাশের ম্যাপে তার কোন অস্তিত্ত্ব দেখিনি কখনো।
আর, ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছি, মাতৃগ্রহে পৌঁছোবার পর ওই মহানগরের সৃষ্টি
করে তার অস্তিত্ত্বে নিজের মিশিয়ে দেয়াই আমাদের নিয়তি। ভালোই লাগবে নিশ্চয়!
রূপাবতী
ইতিহাসের ছাত্রী। তার তত্ত্ব হল, পৃথিবী ও তার মহানগরের মিথ-এর মূলে একটা সত্যি
কিছু আছে। গ্যালাক্সির কোথাও না কোথাও নিঃসন্দেহে এই মহানগরের অস্তিত্ত্ব আছে।
নইলে রত্নপোতের জ্ঞানভাণ্ডারে তার সম্বন্ধে এত তথ্য এল কীভাবে। পুরোহিত চতুর্থ
শীলাবতী অবশ্য তাদের এই তত্ত্ব মেনে নিতে তৈরি নন। তাঁর বক্তব্য, মহানগর আমাদের
রত্নপোতেরই পূর্ব প্রজন্মের কোন মহীয়সী বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কৃত তত্ত্বমাত্র। রত্নপোতের
রক্ষাবর্মের মধ্যেকার যন্ত্রনির্ভর জীবনেরই একটি বৃহৎ রূপ হিসেবে তিনি মহানগরের
রূপ কল্পনা করেছেন। নইলে তার কোন স্থির বা চলমান চিত্র অথবা কোন স্বপ্নসফর
প্রোগ্রাম কেন থাকবে না আমাদের তত্থ্যভাণ্ডারে? তাঁর মতে এবারেই প্রথম সে তত্ত্বের
বাস্তব প্রয়োগ হতে চলেছে পায়ের নিচের গ্রহটির বুকে।
কথাটায়
যুক্তি আছে। রূপাবতী তার কোন প্রতিবাদ করেনি তাই। কিন্তু সায়েন্স অফিসার জামিলা আর
তার দুই বোন তাঁর সঙ্গে একমত নয়। তাদের মতে, সত্যের খানিকটা ভিত্তি না থাকলে এত
বিস্তারিত টেকনোলজি শুধুমাত্র কল্পনায় তৈরি করে ফেলা সম্ভব নয়। অতএব তারা তিনজন
মিলে বেশ কিছুকাল ধরে তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে চলেছে যানের তথ্যভাণ্ডার। তার ধারণা, সে
অনুসন্ধান ব্যর্থ হবে না।
মঙ্গলবার,
প্রথম বর্ষ , প্রথম মাস, দ্বিতীয় দিন। শীলাবতী গ্রহ
একটি অসামান্য অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ দিন। আজ আমরা আসল নদীতে স্নান করেছি!
তারপরধরা যাক খাবার কথা। মানবদেহের ওপরে মাটিতে গজানো প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রভাব
সম্পর্কে কোন নিশ্চিত তথ্য আমাদের তথ্যভাণ্ডারে নেই। অতএব খাদ্যবিশেষজ্ঞরা
হাইড্রোপনিকস প্ল্যান্ট গড়ে না ওঠা পর্যন্ত যানে কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষিত নিরাপদ
খাদ্যের ওপরেই নির্ভর করবার উপদেশ দিয়েছিলেন সকলকে। কিন্তু আমার ছোট্ট অনসূয়া আজ
সবকিছু ওলট পালট করে দিল। সমবয়সী বান্ধবীদের সঙ্গে খেলতে খেলতেই সকলের অলক্ষ্যে
গাছের নিচে পড়ে থাকা সোনালিবর্ণের ফল নিয়ে সে খেতে শুরু করে। তার ভীত বন্ধুরা ছুটে
এসে খবর দিলে আমি তাড়াতাড়ি চিকিৎসক সোমাবতীকে সঙ্গে নিয়ে তার কাছে গিয়ে দেখি সে
প্রথম ফলটি খাওয়া শেষ করে দ্বিতীয় একটি ফলের গায়ে কামড় বসিয়েছে। তাকে পরীক্ষা করে
কোন বিষক্রিয়ার সন্ধান না পেয়ে ফলটিরও উপাদান বিশ্লেষণ করে দেখেন সোমাবতী। তারপর
নিজে একটি ফল ছিঁড়ে নিয়ে সেটি খেয়ে আমাকেও একটি খেতে বলেন। ফলটিতে কামড় বসিয়ে
আমারও বিস্ময়ের সীমা রইল না। মানুষের সংশ্লেষিত কোন খাদ্য আমি এত সুস্বাদু হতে
দেখিনি। কোন প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই প্রকৃতিতে নিজে নিজে এমন সুস্বাদু খাদ্যের
সৃষ্টি হয় কী করে। সোমাবতীর নির্দেশে তারপর চিকিৎসকের একটি দল বনের বিভিন্ন
খাদ্যযোগ্য ফল ও কন্দের সন্ধান বের করেছে।
চারটি শ্রমিক রোবটকে গাছ কাটার কাজ থেকে সরিয়ে এনে সেই ফল সংগ্রহের কাজে লাগানো
হয়েছিল। এখন দ্বিপ্রাহরিক কাজের বিরতিতে সেই
ফলের স্তুপ বিতরণ করা হচ্ছে সকলের মধ্যে।
অনসূয়ার মা হিসেবে আজ আমার বড় গর্বের দিন। ওর ধমনীতে
আমার রক্ত বইছে! কেবল আমার! ওকে গর্ভে ধারণ করে আমি গর্বিত। প্রথমা ঈশ্বরী আদি
শীলাবতীকে ধন্যবাদ। ইতিহাস বলে, তিনিই প্রথম রত্নপোতের মহাযাত্রার শুরুর একাকি
চলার দিনগুলিতে সাধারণ দেহকোষকে নিষিক্ত ডিম্বকোষে বদলাবার কৌশল আবিষ্কার করেন;তারপর
গর্ভপাত্রের বদলে নিজের জরায়ুতে তা স্থাপন করে দ্বিতীয় শীলাবতির জন্ম দেন।সেই
আবিষ্কারের কল্যানেই তো আজ আমিও আমার অনসূয়াকে গর্ভে ধরতে পেরেছি!
মৃত্যুর আগে আর একটি বিচিত্র কাজ করে গিয়েছিলেন তিনি।
বিদেস-এর দ্বিতীয় খণ্ড‘সাম্য’-তেতার
উল্লেখ আছে। শয়তান নাকি মানুষে মানুষে বিভেদের বীজ বপনের জন্য আইন করেছিল যে মানুষ
হবে নারী ও পুরুষ নামে দুটি ভিন্ন শ্রেণীর । তাদের দুই দেহের দুটি কোষকে না জুড়লে
নিষিক্ত ডিম্বকোষের উৎপত্তি হবে না। ফলে নতুন মানুষের জন্ম সম্ভব হবে না। নিজের
দেহকোষ থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু সৃষ্টির কৌশল আবিষ্কার করবার পর প্রথমা ঈশ্বরী নাকি রত্নপোতের
গর্ভপাত্রে সঞ্চিত সেই পুরুষ নামের দ্বিতীয় ধরণের মানুষের সমস্ত ভ্রূণকে বিনষ্ট
করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে দেন।
তবে, এটি সম্ভবত কোন অতিশয়োক্তি হবে। দুই ধরণের
মানুষের দুটি দেহকোষের সংযোজনে নতুন মানুষের সৃষ্টির তত্ত্বটাই আজগুবি বলে বিশ্বাস
করেন আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা।
রোদ চড়ছে। আকাশে জোড়া সূর্য আলিহা এক ও দুইয়ের তেজ বেড়ে উঠছে
ক্রমশ। কয়েকটি মিষ্টি কন্দ দিয়ে দুপুরের সুস্বাদু খাওয়া সেরে আমি আমার ডায়েরি
রেকর্ড করছি আমার ছোট তাঁবুটিতে বসে। জিনিয়ার কর্মীদলটি বেশ বুদ্ধিমান। তাঁবুগুলোর
রঙ ও নকশা এমন করেছে যে চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই মিশে যায় সেগুলো।
আমার এ রেকর্ডিং খুব পরিষ্কারভাবে শোনা যাবে না। আমাদের তাঁবু
গ্রামের পাশেই হাইড্রোপনিকসের প্ল্যান্টটা বসানোর কাজ চলেছে। তার যন্ত্রপাতির
শব্দে কান পাতা দায়। তার সঙ্গে জুড়েছে, চারপাশে খেলায় ব্যস্ত শিশুদের
কলকাকলি। খোলা আকাশের নিচে থাকতে তাদের
বড়দের মত অত অস্বস্তি হয় না।
এইবারে
রেকর্ডিং বন্ধ করব। কাজের ঘন্টা শুরু হতে চলেছে ফের।
রবিবার,
প্রথম বর্ষ , প্রথম মাস, একবিংশতি দিন, শীলাবতী গ্রহ
আমাদের
কাজ চলেছে পূর্ণোদ্যমে। জিভাকে বাঁধ বেঁধে আটকানো হয়েছে। তার বিশাল জলধারা একটা
গভীর সুরঙ্গ বেয়ে ধেয়ে চলেছে মাটির নিচে তৈরি করা জলাধারটিকে ভরিয়ে তুলতে। জিভা আর কোনদিন সমুদ্র দেখবে না। লেজারের মৃদু
গুঞ্জন দিনরাত ধরাশায়ী করে চলেছে প্রাচীন মহীরুহগুলিকে। গতকাল আমি প্রথমবার আকাশ
থেকে প্রস্তাবিত মহানগরের সমীক্ষা সারলাম। গভীর সবুজের মধ্যে জায়গাটা
একটা অতিকায় সাদা রঙের ব্যতিক্রমের মত দেখাচ্ছিল। তার এক কোণায় সাদা চামড়ার গায়ে
বিরাট ব্রণের মত গজিয়ে উঠছে ইস্পাতে গড়া হাইড্রোপনিকস প্ল্যান্টটা। তবে দেখতে
যেমনই হোক না কেন, তৈরি হয়ে গেলে ও থেকে গোটা মহানগরের চারবেলার খাবার জুটবে। বনের
ফল খেয়ে তো আর এত মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে না! বিদাস-এর তৃতীয় অধ্যায়ে অবশ্য
মাটিকে কর্ষণ করে বীজ ছড়িয়ে তাই থেকে খাদ্য উৎপাদনের কিছু গাথা রয়েছে, কিন্তু তা
কতদূর বাস্তবসম্মত পদ্ধতি তা কেউ কখনো পরীক্ষা করে দেখেন নি।
শিশুদের কাছে এই গড়ে উঠতে থাকা হাইড্রোপনিক প্ল্যান্টটা একটা বড়ো
আকর্ষণ। সেখানে সবসময়েই তাদের ভিড় লেগে থাকে। আমার অনসূয়া গতকাল রাত্রে তাঁবুতে
শুয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো, “মা, হাইড্রোপনিকপ্ল্যান্টেকিলালফল, সোনালিফল, মিষ্টিসাদাকন্দকিংবালালকন্দফলবে?”
আমি যখন জবাবে
‘না’বললামআরতারপরতাকে হাইড্রোপনিক
প্ল্যান্ট থেকে বের হয়ে আসা পুষ্টিকর, ছত্রাকভিত্তিক ওষধি খাদ্যঘনকের কথা বললাম,
তখন সে উদাস হয়ে বলে, “কিন্তুআমিলাল,
সোনালিফলখেতেভালোবাসিযেমা!”
অনসূয়া এখন আমার পাশে শুয়ে
গভীর ঘুমে। ডায়েরি রেকর্ড করতে করতে মাঝে মাঝে আমি ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দেখছি তার নরম,
পেলব চামড়া, আর ধন্যবাদ দিচ্ছি পুরোহিত তৃতীয় শীলাবতীকে। দ্বিতীয় শীলাবতীর গর্ভজাত
এই সন্ন্যাসিনীর অনুপ্রেরণা ও অনুশাসণেই আমাদের সমগ্র জাতি গর্ভযন্ত্রের যান্ত্রিক
প্রজনন ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করে নিজ গর্ভে সন্তানধারণের রীতিটিকে গ্রহণ করে। তাই
তো আমি আজ আমার রক্তমাংসের অংশ দিয়ে তৈরি করতে পেরেছি আমার অনসূয়াকে!
তবে এইবারে তাড়াতাড়ি করতে
হবে। জামিলা ও তার দুই বোন মিলে আজ আমাদের জন্য একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন
রেখেছে। ব্যাপারটা একটুখানি রেকর্ড করে
রাখা যাক। ওরা অবশেষে একটা মহানগরের স্বপ্নসফর প্রোগ্রাম আবিষ্কার করতে
পেরেছে; বা, বলা যায় ওদের আকূলতায় মুগ্ধ হয়ে প্রথমা ঈশ্বরী ওদের কৃপা করেছেন
অবশেষে। একেবারে খোদ নিজের গ্রহ পৃথিবীর একটি মহানগরের সন্ধান দিয়ে দিয়েছেন।
ব্যাপারটা ঘটেছিল এইভাবে-
প্রথমা ঈশ্বরীর একটি
ক্ষুদ্র প্রতীক চিহ্ন আজও রাখা আছে আমাদের মন্দির কক্ষের পূজাবেদিতে। সেটি হীরার
তৈরি ছোট্ট একটি ব্রুচ। ঈশ্বরে জামিলার গভীর বিশ্বাস। অতএব কোথাও কোন সন্ধান না
পেয়ে সে ঈশ্বরীর প্রতীক ওই ব্রুচটিকেই আঁকড়ে ধরে শেষ অবলম্বন হিসাবে। তার কাছে
পথের নির্দেশ চায়।
আর তারপরেই আসে জামিলার
সেই বিখ্যাত উদ্ভাবনী কল্পনার উল্লম্ফন, যে ক্ষমতার বলে বারংবার বহু আপাত অসম্ভব
বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করে সে অবাক করে দিয়েছে আমাদের। হীরেটিকে নিয়ে হঠাৎই স্ক্যান
করা শুরু করে সে। আর তারপরেই আবিষ্কার হয়, তার আণবিক সজ্জার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে
একটা গোটা মহানগরের ছবি। জামিলার অবশ্য দাবি যে এ হল প্রথমা ঈশ্বরীর দয়া, কিন্তু
আমরা সে জন্য তার নিজস্ব উদ্ভাবনী
ক্ষমতাকেই পুরো কৃতিত্বটা দিচ্ছি।
কাজটা করা হয়েছিল প্রাচীন
প্রযুক্তি দিয়ে। সঞ্চিত তথ্যের দশা ভালো ছিলো না মোটেই। তাকে পুরোপুরি উদ্ধার করতে
যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে জামিলার দলের মেয়েদের।
অবতরণক্ষেত্রের পাশে একটা
অস্থায়ী স্বপ্নসফর থিয়েটার তৈরি করে নেয়া হয়েছে। সেখানে, আমাদের স্বপ্নসফর শুরুর
আগে জামিলা, ২১৬৮ সালের কলকাতা মহানগরের ব্যাপারে আমাদের একটা করে ছাপানো
নির্দেশিকা দিয়েছে। ওর বক্তব্য, কিছু কিছু ব্যাপার আগে থেকে ভালো করে বুঝে নিয়ে না
গেলে এমনকি স্বপ্নসফরেও ওখানে গেলে বিপদ হতে পারে। কয়েক সেকেন্ডের বেশ কয়েকটা
পরীক্ষামূলক সফর থেকে সে আন্দাজ করেছে মহানগর জায়গাটা খুব বিপজ্জনক কিছু হতে পারে।
নির্দেশিকাটা বেশ ভয়
ধরানো। সেখানে প্রতিটি মানুষ নাকি পরিচিত হয় তার বাঁহাতের বুড়ো আঙুলটির ছাপ দিয়ে।
তার মধ্যে ধরা থাকে তার সমস্ত পরিচয়। এই আঙুলটিই নাকি সেখানে একজন মানুষের সবচেয়ে
বড়ো সম্পদ। জামিলা অবশ্য লিখেছে, আমাদের সকলের আঙুলের ছাপ ও পরিচয় সে প্রোগ্রামের
মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে মহানগরে পৌঁছে সেখানকার জীবনে মিশে যেতে কোন সমস্যা
আমাদের হবে না। তবে সেখানে দূষণ ও অপরাধের হার বেশি। ডাকাতেরা সুযোগ পেলেই নিরীহ
মানুষকে মেরেধরে তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়। আর সবচেয়ে ভয় ধরানো যে খবরটা নির্দেশিকায়
দেয়া হয়েছে সেটা হল, পুরুষ ও নারী এই দু
ধরণের মানুষের অস্তিত্ত্ব রয়েছে নাকি সেখানে; এবংএই পুরুষ জাতীয় মানুষেরা স্বভাবত
অপরাধপ্রবণ, কর্কশ ও স্নেহহীন।
নির্দশিকাটা পড়বার পর
ভেতরে ভেতর একটু অস্বস্তি আমাদের অনেকেরই হচ্ছে। বেশ কয়েকজন মেয়েই তাদের নাম সরিয়ে
নিয়েছে যাত্রীর দলের থেকে। আমারও একবার সে কথা মনে এসেছিল। ভার্চুয়াল দুনিয়ার
কল্পজগতে চেতনাটি যা যা অনুভব করে তার ছাপ পড়ে বাস্তব জগতে ঘুমিয়ে থাকা তার
শরীরটার ওপরে। এমনকি, সে জগতে কারো মৃত্যু হলে অনেক সময় বাস্তব দুনিয়ায় ঘুমিয়ে
থাকা তার শরীরটারও মৃত্যু হতে দেখা গেছে।
আমার যদি সেখানে কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার অনসূয়ার কী হবে?
কিন্তু তবু সে ভয়টাকে মনে
বেশিক্ষণ ঠাঁই দিইনি আমি। প্রথমত কালরিপায়ত্তু নামের আত্মরক্ষার শিল্পে আমরা সবাই
শিক্ষিত। নিজেদের বাঁচাবার পদ্ধতি আমরা ভালোই জানি। তাছাড়া বিদাস বলে, ওই কলকাতা
মহানগর-ই ছিল প্রথমা ঈশ্বরী শীলাবতী সেন-এর মাতৃনগর। আমরা , তাঁর সন্তানেরা আজ
রাতে তাঁর সেই মাতৃনগরে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে যাব। থাকুক বিপদ! বিদাস-এ এই ধরণের
যাত্রার নাম দেয়া হয়েছে তীর্থযাত্রা। দেবী চতুর্থ শীলাবতীও আমাদের সঙ্গে চলেছেন
সেই তীর্থযাত্রায়। এতবড় পুণ্যের লোভ কে আর ছাড়তে চায়! হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যায়
তীর্থযাত্রাতেই চলেছি আমরা সকলে-----
মঙ্গলবার,
প্রথম বর্ষ , প্রথম মাস, ত্রয়োবিংশতি দিন, শীলাবতী গ্রহ
“নরক, নরক।এখনওসেইদুর্গন্ধবাতাসেরকথামনেএলেআমারবুকেরব্যথাফিরেআসে!
আর—ওই পুরুষ জীবগুলি! শিশু প্রজননকেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পেলেই তারা মানুষের
গর্ভস্থ ডিম্বাণু নিষিক্ত করবার জন্য পশুর পালের মত তাদের অনুসরণ করে। আমায়—আমায় ওরা
তিনজন মিলে একসঙ্গে—”
উদ্গত কান্নায় কথা আটকে
গেল কিশোরী মেয়েটির। তার চোখে ফের ফিরে এসেছে তীব্র আতংকের ছাপ। নিজের আসন ছেড়ে
উঠে এসে তাকে সযত্নে বুকে জড়িয়ে ধরলেন চতুর্থ শীলাবতী। মৃদু গলায় সান্ত্বনাবাক্য
বলে চলেছেন তাকে—
--ধীরে ধীরে আসন ছেড়ে উঠে
বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। সকাল থেকে একের পর এক এইরকমই ভয়ানক সব অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে
শুনতে ক্লান্ত আমরা। আমাদের তীর্থযাত্রার কাহিনী!
বাইরে, আলিহার জোড়া
সূর্যের উত্তপ্ত রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে বিস্তীর্ণ অরণ্যের গাছে গাছে। এখানে এখন বসন্ত এসেছে।
অরণ্যে বহুবর্ণ ফুলের ভিড়। উষ্ণ বাতাসে তাদের মৃদু সুগন্ধ। খোলা মাঠের ওপর দিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমাঝেই অন্যমনস্কভাবে নিজের বাঁহাতের বুড়ো আঙুলটার ওপরে হাত
বুলিয়ে নিচ্ছিলাম আমি। সেই রাত্রের কথা মনে হলে এখনো শিউরে উঠি আমি—
--সেদিন
মধ্যরাতে, শিশুরা ঘুমিয়ে পড়বার পর আমরা সবাই থিয়েটারে এসে জমায়েত হয়েছিলাম। অন্ধকার রাতে পুবের পাহাড় থেকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা
হাওয়া বইছিলো। আমাদের খোলা শরীরে সেই হাওয়ার স্পর্শে বড় আরাম লাগছিলো। পরিষ্কার
আকাশে অজস্র তারার ভিড় ছিল। সেই দেখতে দেখতে আমরা জামিলার বক্তব্য শুনছিলাম। অবশ্য
যাত্রার উত্তেজনায় তার সব কথা ভালো করে মনোযোগ দিইনি আমরা কেউ। তার কথা চলতে চলতেই
দ্রুত হাতে তার তিন বোন আমাদের শরীরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় যন্ত্রগণকের সংযোগ স্থাপন
করে দিচ্ছিল।
জামিলার বক্তব্য
শেষ হতেই ধীরে ধীরে মাথার ওপরের সেই ঘন কালো তারায় ভরা আকাশ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
যেকোন স্বপ্নসফর শো শুরুর আগেকার মুহূর্তগুলোর মতই একেবারে হারিয়ে গেল বাইরের
পৃথিবীটা। নিষ্ক্রিয় অথচ জাগ্রত চেতনার এই মুহূর্তগুলি সবসময়েই খুব উপভোগ্য হয়ে
থাকে।
********
বুকের মধ্যে
একটা ভারী অনুভুতি আর সারা শরীরে হালকা জ্বলুনি আমাকে সেই স্থানু অবস্থা থেকে বের
করে আনলো। চোখ খুলে দেখি চারপাশের সেই সুন্দর রাতের আকাশ উধাও। আমার চারপাশে ছড়িয়ে
আছে একটা নীলচে ধোঁয়াশা। স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই আমি তাড়াতাড়ি মুখ খুলে সেই
বাতাস কিছুটা টেনে নিতে চাইলাম ফুসফুসে। একটা বিশ্রি দুর্গন্ধ আমার নাসারন্ধ্র
দিয়ে ঢুকে ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে! আমার সারা শরীরের খোলা চামড়ায় তীব্র জ্বালার
অনুভূতি! প্রতিবার শ্বাস নেবার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভারী ভাবটা দ্রুত বদলে যাচ্ছিল
একটা ভোঁতা একঘেঁয়ে ব্যথার অনুভূতিতে। বুকে হাত চেপে ধরে বসে পড়তে পড়তে আমি খেয়াল
করলাম, সামনে, খানিক দূরে একটা ছোট কাচের ঘরের মাথায় একটা লাল আলো দপদপ করছে। ঝাপসা
দৃষ্টিতে কোনমতে দেখলাম, আলোটার নিচে একটা উজ্জ্বল সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, “আপতকালীনঅক্সিজেনসরবরাহকেন্দ্র।”
কোনমতে ঘরটার
মধ্যে গিয়ে ঢুকতেই একটা মিষ্টি গলা বেজে উঠল তার দেয়াল থেকে—“প্রতিমিনিটশ্বাসনেবারজন্যমাত্রদশটি মুদ্রা--”।ঘরেরভেতরঠাণ্ডা,
স্নিগ্ধহাওয়াখেলছে।জিভারবুকথেকেডাঙায়তোলামাছেরহাঁকরেসেইবাতাসশুষেনিচ্ছিলামআমি।মিনিটকয়েকপরেঘরটারদেয়ালেঝাপসাএকটাছবিভেসেউঠলো।কুৎসিতদর্শনএকটিমানুষ!
ঘনকালোচুলেরমুখেরঅর্ধেকটাঢাকাপড়েতাকেরূপকথারকোনদৈত্যেরমত দেখাচ্ছিল। তার লোলুপ
চোখদুটো আমার খোলা শরীরটাকে গিলছিলো, যেন আমি কোন দুর্লভ সুখাদ্য। ভারী, কর্কশ
গলায় সে বলছিল, “কলকাতা মহানগরের শিলিগুড়ি ওয়ার্ডেআপনাকে স্বাগত। বাঁ হাতের
বুড়ো আঙুলটি এই পর্দার গায়ে একবার ছোঁয়ান।” এই তবে সম্ভবত সেই উপকথার
পুরুষমানুষ! ভয়ে ভয়ে আঙুলটা একবার পর্দার গায়ে ঠেকালাম।
কয়েক সেকেন্ড
পরে লোকটা আবার কথা বললো, “ধন্যবাদমিসঅনুরূপা।আপনারপরিচয়যাচাইশেষহয়েছে।পেছনেরদেয়ালেরস্লটেআপনারনতুনগ্যাসমুখোশ
ও আবহাওয়ানিরোধক পোশাকটি পাবেন। এর দাম আপনার ব্যাংক সঞ্চয় থেকে কেটে নেয়া হয়েছে।
শুভ সন্ধ্যা।”
অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্দা
থেকে হাত সরিয়ে পেছন ঘুরে তাকালাম আমি। সেখানে দেয়ালের গায়ে খুলে যাওয়া একটা ছোট
পাল্লার ভেতরে শেলফে রাখা রয়েছে সারিসারি ধূসর রঙের ভারি পোশাক আর গ্যাসমুখোশ। তার
থেকে মাপমতো একটা পোশাক ও মুখোশ বেছে নিতেই দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ করে পাল্লাটা
বন্ধ হয়ে হয়ে গেল ।
বাইরে বের হলাম,আমার হাতে
বাঁধা ক্রোনোমিটারে তখন সময় দেখাচ্ছে বেলা তিনটে। মাথার ওপরে জালের মত ছড়িয়ে থাকা স্কাইওয়েগুলো
গমগম করছিল ভেসে চলা গাড়ির ভিড়ে। চারপাশে চলমান ফুটপাথগুলোর মধ্যে থেকে একটা
ধীরগতির পথ বেছে নিলাম। আমার চারপাশে ধূসর পোশাক পরা নীরব মুখোশধারী মানুষের
মিছিল। যেন শেষকৃত্যের জন্য শবাচ্ছাদনে ঢাকা মৃতদেহরা প্রাণ পেয়ে হেঁটে চলেছে
চারপাশে। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তাদের দেখলে। যেন সশরীরে হেঁটে চলেছি আমি নরকের
পথে। হাঁটতে হাঁটতে একটা চৌরাস্তায় এসে পৌঁছে একটা রোডসাইন দেখে বোঝা গেল আমি
রয়েছি আঠারো নম্বর স্তরে, অর্থাৎ ভূস্তর থেকে তিনটে তল নিচে। চৌরাস্তার ঠিক
মাঝখানে এক তল থেকে অন্য তলে যাবার লিফটগুলোতে মানুষের ভিড়। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল
একবার মহানগরের ভূপৃষ্ঠের তলটাকে দেখবার। সেখান থেকেই তো সবকিছুর শুরু! লিফটে
ওঠবার লাইনে দাঁড়াবো কি দাঁড়াবোনা তাই ভাবছি, এমন সময় মাথার ওপরের স্কাইওয়ে থেকে
একটা ট্যাক্সি ভেসে এসে আমার পাশে থামল। মাটির ইঞ্চিখানেক ওপরে স্থির হয়ে ভাসছিলো
যন্ত্রটা। তার স্বচ্ছ আবরণের ভেতর থেকে একটা চুলদাড়িভরা একটা মুখ বলছিলো, “কোথায়যাবেনমিস?”
গাড়িটার দরজার গায়ে লাগানো
ছোট্ট পরিচয় প্যাডে আমার বাঁহাতের আঙুলটা এক মুহূর্তের জন্য চেপে ধরলাম আমি। তারপর
খুলে যাওয়া দরজা দিয়ে তার ভেতরে ঢুকে বসে মুখোশটা খুলে ফেলে বললাম, “কলেজস্ট্রিট,
ইন্ডিয়ানকফিহাউস-”নামটাআমিজামিলারমুখে শুনেছিলাম। নাকি প্রথম শীলাবতীর প্রিয়
স্থান ছিল ওটি।
গাড়িটা নিঃশব্দে, তীরবেগে
ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল। প্রায় মিনিট দশেক ওঠবার পর হঠাৎ দেখি মাথার ওপর একটা
কালো চৌখুপি খুলে গেছে। তাই দিয়ে ছিটকে বাইরে চলে এলাম আমরা। পায়ের নীচে তাকিয়ে
দেখলাম যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ একটা ধাতব ছাদ ছড়িয়ে আছে গ্রহটার বেশ খানিকটা
অংশকে ঢেকে। মহানগরের রক্ষা আবরণ!
ট্যাক্সিটা ততক্ষণে
তীরবেগে দক্ষিণদিকে রওনা দিয়েছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশ মেঘে ঢাকা। কালচে রঙের
বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গাড়ির কাচে এসে ধাক্কা খেয়ে বিজবিজ করে ফেনা তুলছিল। ছাপ
ফেলে দিচ্ছিল কাচের গায়ে। সেই বৃষ্টির ধোঁয়াশায় ঢাকা আধো অন্ধকার আকাশে ভেসে চলা
অসংখ্য গাড়ি ছাড়া প্রাণের আর কোন স্পর্শ ছিলো না সেখানে।
সামান্য সময় বাদে আমার
চারপাশের শাটারগুলো বন্ধ হয়ে গেল। ড্রাইভারের কেবিনটাও পুরোপুরি আলাদা। সে আগেই
জানিয়ে দিয়েছিলো ঘন্টাখানেক সময় লাগবে পৌঁছোতে। গায়ের বিশ্রি পোশাকটাকে খুলে
রাখলাম আমি। এয়ার কন্ডিশনারের মৃদু গরম হাওয়া আমার খোলা চামড়ায় এসে আদর করছিল। ঠিক
যেন জিভার ধারে একটা শান্ত দুপুর!
*************
হঠাৎ বুকের ওপর একটা কর্কশ
হাতের চাপে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ খুলে দেখি আমার ওপরে ঝুঁকে রয়েছে আমার গাড়ির
চালক। আমি চোখ খুলে তাকাতেই তার লালাসিক্ত মুখটা আমার মুখের ওপর এসে আছড়ে পড়লো।
লোকটাও তার শরীরের পোশাক খুলে ফেলেছে ততক্ষণে। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সে আমায়
মেরে ফেলতে চায়। হায় দেবী শীলাবতী! মানুষ এত কুৎসিত-ও হতে পারে! ঘন কালো চুলে ঢাকা
কঠিন পেশীবহুল দেহটা থেকে এক অজানা দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল।
অনুমান করছিলাম আমি সম্ভবত
জামিলার বলা সেইসব ডাকাতদের একজনের পাল্লায় পড়েছি। আমাকে মেরে ফেলে এ আমার
জিনিসপত্র সব নিয়ে নিতে চায়। ভেতরে ভেতরে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে গেলাম আমি। এই
পুরুষজীবগুলোর স্নায়ুতন্ত্র সম্ভবত আমাদের মানুষদের খুবই কাছাকাছি হবে। দেখা যাক! চারপাশে
তাকিয়ে দেখলাম একবার। জানালার শাটারগুলো খুলে গেছে ফের। গাড়িটা থেমে রয়েছে একটা
কোন একটা বাড়ির ছড়ানো কংক্রিটের ছাদের ওপর। জায়গাটা একেবারে নির্জন। হঠাৎ একেবারে
থেমে গিয়ে লোকটাকে আমি আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে দিলাম। তারপর চার হাত পায়ে তাকে
আঁকড়ে ধরে মেরুদণ্ডের সারভাইকাল ও লাম্বার অঞ্চলের দুপাশের চারটে বিন্দুতে চাপ
দিতেই অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরে উঠে ছিটকে
গেল পুরুষটা। সেই সুযোগে লাফ দিয়ে উঠে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপ দিলাম আমি।
লোকটার গায়ে জোর থাকলে কি
হয়, লড়াইয়ের কায়দাগুলো সে একেবারে জানে না। প্রথম আঘাতে থতমত খেয়ে গিয়ে সব
সাবধানতা ছেড়ে একটা খ্যাপা জন্তুর মত সে মাথা নিচু করে তেড়ে এল আমার দিকে। আমার
দ্বিতীয় আঘাতটা নেমে এল তার অরক্ষিত ঘাড়ের ওপর।
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা একটা কাটা গাছের মত আছাড় খেয়ে পড়ল আমার পায়ের কাছে। একটু
অবাকই হলাম আমি। খুব বেশি জোরে তো মারিনি! কাছে এসে একটু নিচু হয়ে আমি একবার ভালো
করে দেখে নিতে গেলাম তাকে, আর সেইখানেই একবারে প্রাথমিক ভুলটা করলাম।
কালরিপায়ত্তুর প্রথম শিক্ষাই হল, সম্পূর্ণ বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে কখনো
অসাবধান হতে নেই। আর সেই ভুলটাই করে বসলাম আমি। একেবারে তার কাছে গিয়ে বাঁহাতটা
নামিয়ে দিলাম তার নাকের কাছে, নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা দেখবার জন্য।
সঙ্গেসঙ্গে হঠাৎ একটা মৃদু
গুণগুণ শব্দ উঠল লোকটার হাতের ভেতর থেকে। মোটেই জ্ঞান হারায় নি লোকটা। ভান করে
আমায় হাতের নাগালে পেতে চাইছিলো। এক ঝলকের জন্য চোখে পড়লো, লোকটার হাতের মধ্যে
ঝিকিয়ে উঠেছে একটা লেজার ছুরির তীক্ষ্ণ আলো, আর তারপর আমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটার
গোড়া থেকে একটা তীব্র যন্ত্রণার ঝলক ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে। ভালো করে কিছু বোঝবার
আগেই দেখলাম লোকটা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে মুঠোয় আমার কেটে নেয়া বুড়ো
আঙুলটা ধরা। তারপর একটা সজোরে ধাক্কা খেয়ে আমি ছিটকে পড়লাম কংক্রিটের সেই চাতালের
ওপর। আমাকে সেইভাবে ফেলে রেখে লোকটা ছুটে গিয়ে উঠে পড়ল তার গাড়িতে। প্রায় সঙ্গে
সঙ্গেই তীক্ষ্ণ শীসের শব্দ করে গাড়িটা হাউইয়ের মত সোজা ওপরদিকে উঠে গিয়ে আকাশভরা গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে গেল।
এই স্বপ্নসফর গেমটা বেশ
উঁচুমানের। ঘটমান পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যন্ত্রগণক দর্শকের মনের মধ্যে এমন
একটা বিশ্বাসযোগ্য আবহাওয়া গড়ে তোলে যে মনেই হয় না যে একটা স্বপ্নের মধ্যে আছি।
মনে হয় সবকিছুই একেবারে বাস্তব, সবকিছুই সত্যি সত্যি ঘটে চলেছে। ব্যথার প্রথম ঝলকটা কেটে যাবার পর হঠাৎ করে
গোটা পরিস্থিতিটার গুরুত্ব তাই ঝাঁপিয়ে এল আমার মনের মধ্যে। বুঝতে পারছিলাম এর পরে
কী হতে চলেছে আমার। আমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা ছিল এই দুনিয়াতে আমার সব পরিচয়ের
উৎস। চোরটা সেটা কেটে নিয়ে গেছে। আঙুলটা
ছাড়া এই মানুষ ও যন্ত্রের দূষিত অরণ্যে আমার কোন অস্তিত্ত্ব নেই। আমার জন্মপরিচয়,
আমার বাসগৃহের স্থানাংক, আমার সঞ্চিত অর্থ এই সবকিছুরই মালিক এখন ওই চোরটা। আমার
যা কিছু আছে সব উপভোগ করে নিয়ে আঙুলটাকে সে ছুঁড়ে ফেলে দেবে কোন আস্তাকুঁড়ে। তারপর
বের হবে নতুন শিকারের সন্ধানে।
আঙুল চোরের শিকারের কী দশা
হত এই মহানগরে? জামিলাতার ওপর কিছু কিছু তথ্য দিয়েছিল আমাদের তার ব্রিফিং-এ। আঙুলটা
না থাকলে কোন মানুষের পরিচয় নির্ধারণের কোন উপায় থাকতো না আর। যতদিন তারা বাঁচত,
ততদিন আইনরক্ষকদের আশ্রয়ে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারী কোন অনাথালয়ে পরিচয়বিহীন
ভিক্ষুকের জীবন কাটাতে হত তাদের।
দূরে আকাশের গায়ে লাল নীল
বিকনের ঝলক দেখা যাচ্ছিল। পুলিশের গাড়ি! আলোগুলো দ্রুত এগিয়ে আসছে এইদিকে। এদের
যন্ত্রপাতিতে নিশ্চয় ধরা পড়েছে নির্জন জায়গায় কোন মানুষের উপস্থিতি। ওদের হাতে ধরা
পড়লে চলবে না আমার! তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে আমায়।
তাড়াতাড়ি! তীব্র যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে আমি চিৎকার করে আদেশ দিলাম, “যন্ত্রগণক,
খেলা বন্ধ কর। ফিরিয়ে নিয়ে যাও আমায়---”
আমি জেগে উঠলাম আমাদের
শীলাবতী গ্রহের সেই স্বপ্নসফর থিয়েটারে। আমার চারপাশে আধো আলোয় হাজার হাজার মেয়ে, তাদের
যার যার অলীক অস্তিত্ত্বের মহানগরে নিজের নিজের তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে চলেছে
তখনো। সে যন্ত্রণার তীব্রতা কেমন তা আমি জানি। উঠে দাঁড়িয়ে যন্ত্রগণকের পর্দার
সামনে দাঁড়িয়ে আমি ধাপে ধাপে গোটা প্রোগ্রামটা বন্ধ করবার নির্দেশ টাইপ করতে শুরু
করলাম তার কনসোল প্যাড-এ----
********
শুক্রবার,
প্রথম বর্ষ , ষষ্ঠ মাস, ষড়বিংশতি দিন। শীলাবতী গ্রহ
প্রায় ছ’মাস পরে
আজ একটা ছুটির দিন ঘোষিত হয়েছে। এই ছ’মাস ধরে দিনে ষোল ঘন্টা করে পরিশ্রম করেছি
আমরা প্রত্যেকে। আমিও বাদ যাইনি। মহানগরের বাস্তুকার হিসেবে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
আমি এখন রত্নপোত নামের এই উপনিবেশের একজন সাধারণ শ্রমিকমাত্র। প্রাথমিক
কাজগুলো শেষ করতে এই কঠোর পরিশ্রমটার দরকার ছিল। এখন এই গ্রহে ঘন বর্ষা নেমেছে।
সুদূর সমুদ্র থেকে পাহাড়ের চূড়া পেরিয়ে আসা পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের দল ছেয়ে ফেলেছে
আকাশ। আমাদের সদ্য গড়ে ওঠা বসতির একপাশে বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্রে বৃহীর চারাগুলি
বৃষ্টির জলে মাথা নাড়ছে। আমাদের পরিশ্রমের ফসল। গতকাল তাদের রোপণের কাজ সম্পূর্ণ
হয়েছে।
গত বসন্তে, মহানগর সৃষ্টির
পরিকল্পনা পরিত্যাগের পর, বিদাস-এর চতুর্থ অধ্যায়ে খাদ্যসৃজনের গাথা থেকে এই কৃষিপদ্ধতিটি
উদ্ধার করেছিল জামিলার বৈজ্ঞানিকের দল। তারপর উদ্ভিদবিদদের একটি দলের অক্লান্ত
চেষ্টায় শীলাবতী গ্রহের অরণ্য থেকে খুঁজে বের করা হয়েছে খাদ্যযোগ্য শস্যবীজের
সন্ধান। গাথায় বলা শস্যবীজের নামে আমরা তার নাম রেখেছি বৃহী।
দূরে, দিগন্তের কাছে
পরিত্যক্ত অসমাপ্ত হাইড্রোপনিকসের প্ল্যান্টটি পড়ে আছে উপনিবেশের এক কোণে। ভরা বর্ষায় তার গায়ে এখন সবুজ
লতাপাতার ভিড়! তার পাশ দিয়ে গর্জন করে ছুটে চলেছে বর্ষার জল পেয়ে সজীব, দুরন্ত জিভা। আমরা তাকে মুক্তি
দিয়েছি তার ভুগর্ভস্থ কারাগার থেকে। তার দেহ থেকে খাল কেটে বয়ে আনা জলেই উর্বর
হয়েছে আমাদের চাষের জমি।
“মা, মা—দেখবে
এসো! জিভায় বান এসেছে!”
আমার অনসূয়ার গলা! ফুলে
ফেঁপে ওঠা নদীর দেখতে তার ধারে জড়ো হওয়া কিশোরীদের ভিড় থেকে বের হয় সে তার মাকে
ডাকতে এসেছে তার আনন্দের অংশ নিতে। সে বৃষ্টিতে ভিজেছে। মুক্তার মত জলবিন্দুগুলি
তার সদ্য অংকুরিত কিশোর শরীরটিকে মূল্যবান গহনার মত ঢেকে রেখেছে।
আমি উঠে কুটির থেকে বের হয়ে এসে তার হাত ধরলাম।
উপসংহার
শীলাবতী গ্রহ থেকে একশো পঞ্চাশ আলোকবর্ষ দূরে একটি
মৃত গ্রহ তার হলুদ সূর্যকে ঘিরে অন্তহীন আবর্তন করে চলে। বিষাক্ত হাওয়ার এক ধূসর,
অস্বচ্ছ মেঘের আবরণ তাকে আড়াল করে রাখে তার নক্ষত্রের জীবনদায়ী আলোকস্রোত থেকে।
কোন কৌতুহলী অভিযাত্রী কখনো যদি সেই মেঘপুঞ্জের আবরণের ভেতরে উঁকি মারে তাহলে দেখতে
পাবে তার ভূপৃষ্ঠ জুড়ে অজস্র মহানগরের কংকাল। তাদের নির্জন দেহের ফাঁকে ফাঁকে নিরন্তর
বহে যায় বিষাক্ত, শীতল হাওয়ার স্রোত।
দেড়শো আলোকবর্ষ দূরে এক নতুন রঙ্গমঞ্চে আলো জ্বলেছে
এইবারে। জীবনকে নিয়ে একটি ব্যর্থ পরীক্ষার শেষে, তার ভুলগুলো শুধরে নিয়ে ফের নতুন করে
পরীক্ষা নীরিক্ষা শুরু করেছে মানুষের সন্তানেরা। মহানগরের বদলে তারা স্বেচ্ছায়
বেছে নিয়েছে এক শ্রমসাধ্য অথচ আনন্দময় জীবন। তারা সুখি হোক।
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-এর জন্ম ও বড়ো হয়ে ওঠা - উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে। স্ট্যাটিসটিকস-এর ছাত্র। এখন কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি করেন। প্রকাশিত বই - ইলাটিন বিলাটিন (ছড়া), বনপাহাড়ি গল্পকথা, কল্পলোকের গল্পকথা ও দোর্দোবুরুর বাক্স। জয়ঢাক নামে ছোটোদের জন্য একটি পত্রিকা (ত্রৈমাসিক) চালান বন্ধুদের সঙ্গে মিলে। চাকরিসূত্রে ভূপাল, মধ্যপ্রদেশে কয়েক বছর কাটিয়ে এখন কলকাতায়।
2 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনসার্থক কল্পবিজ্ঞান কাহিনি …
উত্তরমুছুন