বিয়োবার জন্য কিছুদিন থেকেই একটা চাপা প্রস্তুতি ছিল। গত মাসে ঠিকাঝিগিরির কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল এ জন্যেই। গত সপ্তাহ থেকে ঘরের রান্নাবান্নাও বন্ধ। ভারী জিনিসপত্র টানাটানির কাজ থেকে শুরু করে দুবেলার চারটি ভাত ফোটাবার দায়িত্বটুকু কেউ না কেউ এসে করে দেয়। বাসেত চেষ্টা করেছিল রান্নার কাজটা নিজেই করবে, কিন্তু বউটা কোনো কথাই শোনে না, কোনো শর্তেই রাজি হয় নাই; পীরের মতো মানে ওকে বাসেত। ভসভস করে ঘুমালেও ঐটাই বউটার একমাত্র গুণ।
৯ মাস পুরা হলে বাসেত বউকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে একলা পারবি তো? বউটা আরেক ঘরের ভাত খাইয়া আসলেও এখনো লাজশরমের মাথা খায় নাই। বাসেতের জিজ্ঞাসার আন্তরিকতায় প্রায় গলে যায়— মেঝেতে বসে ল্যাছড়াতে ল্যাছড়াতে ঝাট দিতে দিতে কোনোদিকে তাকাতে পারে না... মিহি গলায় বলে, পারুম না কেন; নিজের কুনোদিন হয় নাই তো কী হইছে, মারে তো হওয়াইতে দেখছি একগাদা। এমুন কী আর কঠিন!
আলাপ আলোচনায় খুব নিশ্চিত বোধ কইরা বাসেত হিরনচি পার্টিহাউজের দিকে রওনা হৈলো।
ভালো নাম আনোয়ারা, ডাক নাম আনি। গত বর্ষায় যখন খুব কইরা বৃষ্টি— কাজ কামের কোনো ঠিক নাই, গায়েগতরে তাকদের কমতি নাই, শরীরে নাই কোনো বিষের চাহিদাও— হাতের জমা ভাইঙ্গা পরম আনন্দে দিন চলতাছিল। একদিন সুখের ভুতে কিলাইলো। প্রাণের দোস্ত লায়েক আলি অতি লায়েকি চাল মারতে গিয়া গোপনে যে প্রাণভোমরা বন্ধক রেখেছে পপি কষের কাছে, বাসেত যেদিন টের পেল, সেদিন ওর অবস্থাও সুবিধার না: শতিনেক টাকার কেসে ধরা খেয়ে জনা দশেক খোদাই ষাঁড় পালা করে ওকে গণমেরামত করার পর দেহ থেকে যখন হাজার তিনেক টাকার শক্তি ও তিরিশ হাজারের সাহস বেরিয়ে গেল লায়েক আলির মৃদু পরামর্শ তখন ফেলতে পারেনি।
সব পেশারই নানা রকম টোটকা থাকে। টোটকা চিকিৎসা, টোটকা পথ্য, টোটকা দাওয়াই। লায়েক আলি জব্বর একখানা ব্যবস্থা দিয়েছিল। জীবনের সকল ক্রুরতা ঢেকে ফেলার জন্য— সব অমানুষিক নিচুতা মুছে ফেলার জন্য— সব নিষ্ঠুর অপমান হাওয়ায় উড়িয়ে দেবার জন্য এই বাদামী নায়িকা চূর্ণের শক্তি, বিস্ময়কর।
সেদিন সব গ্লানি হাওয়ায় উড়ে গেল, উপরন্তু রাতের বিছানায় আনি যখন ওকে মালিশ লাগাচ্ছে আর অল্প অল্প ঘেমে উঠছে তেতে গিয়ে আর বাসেত ওর গরম হওয়াটা উপভোগ করতে শুরু করছে একটু একটু করে, তখনো বোঝা যায়নি। চোখ জুইড়া আসা ঘুম কচলাইতে কচলাইতে আনিরে পাকাইতে পাকাইতে কানের কাছে মুখ নিয়া গুনগুনাইতো : আনিরে আনি আনা আনা... গাদলার কামড়ে সব কিছু ভিজা ভিজা, আর দৈত্যের শক্তি ভর করছে ওকে। আর আনি তপ্ত হতে হতে গলে গলে নিস্ব হয়ে মরে যাচ্ছে তখনও ও উন্মত্ত হয়ে ঠাডা ছুড়ে যাচ্ছে। আনি ও সেসব দিন থেকে প্রবল লোভী হয়ে গেল। এই ক্লান্তিহীন দেহরত্নের সেবায় জীবন উৎসর্গ করবে বলে মনস্থ করে। বেলা দশটার বৃষ্টিচাপা অন্ধকারে বাসেত আর চোখই খুলবার চায় না। সত্যিকারের ক্লান্তি ওকে মুর্ছার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ও তালগোল পাকিয়ে আনির কাদার ভিতর পাঁকাল হয়ে মাথা গুঁজে পড়ে থাকলো... বাইরে মাঠ পানিতে ছয়লাব। বস্তির আঠালো কালো পানি, এমন বৃষ্টি— ঘরের পৈঠা সলিলে ডুবুডুবু।
ঘর নাতো খোপখোপ খোপ। দরজায় পা দিতেই আরেক পা আগানোর নাগালের মধ্যে একটা মন মাতানো চৌকি। এক সাইডের বেড়ায় চৌকি বরাবর একহাত একহাত মাপের ফোকর জানালা+ঝাপ লাগানো। ওটা তুলে দিলে মাঝে মাঝে সরু সরু বাতাসের ছিটাফোটা পাওয়া যায়। শোনা যায় কাছের ফাঁকা জায়গায় ময়লা ফেলার শব্দ।
খোপের চৌকির ওপর পা ভাঁজ করে বসে আছে আনি। নিশ্চুপ নরোম সরোম। হিরনচি পাতার সন্ধানে পার্টিহাউজের দিকে রওনা হয়। শরীরের নানা জায়গা থেকে বিষসংকেত আসছে, মাথায় ভিতরে বিড়ালটা গড়গড় করছে। আর ঘরে থাকা দায়। এই বউটা খুব বাধুক। কথার মারপ্যাচে নাই। প্যাট ভইরা খিলাইবার পর দুনিয়ার সব জরিবুটি বিশ্বাস করে বসে।
মিটিমিটি পায়ে পার্টিহাউজে গিয়ে দেখে মাল নাই। পুরা তল্লাট খা খা করতাছে। রাত্রে রুবেলের মা অ্যারেস্ট হৈছে। সবাই ব্যস্ত কোটকাচারি লৈয়া। বিড়ালটার থাবার ভিতরে লুকানো নখের কোণা এখন শুড়শুড়াচ্ছে, কিন্তু অচিরেই পাগলা হয়ে উঠবে, খবর পাওয়া যাচ্ছে। নিজের বাচ্চাগুলানরে আগুনে ফেলতি খাকপি, দম খিচে আসবি, নাক ঝরঝর করবি, শীতের ঝাকানি আসবি...। ভয়ে মেজাজ বাঞ্চোৎ, লাফ দিয়া ফুলবাড়িয়ার কোস্টারে ওঠে। পকেটের টাকা খর্চা করা যাবো না। রেলোয়ে বস্তির সিরাজ না হয় পাঞ্জা বাবুলরে ফিট দিতে হইবো।
মানুষের গুঁতা খাইতে খাইতে বিড়ালের বাচ্চাগুলার কাইজ্জা শুরু। বৃষ্টিগুমোট দিনটার আধমরা ঝুলন্ত দেহ ঘামজর্জর পচাপচা; যারা গাড়ির কাচ তুইলা বাদলা দেখতে বেরইছে— সবাই প্রায় ঘুমঘুম। মাঝে মাঝে এমন কতগুলা দিন আইসা হাজির হয়, যেগুলি পথগুলারে টাইনা নিয়া মিলাইয়া দেয় সব কুপথগুলার সাথে। এমনই খাচ্চর ঐ দিনগুলা, মনে হয় দিনটার মা বইনেরা আড়াল থাইকা কোরান উল্টা কইরা পইড়া কুফরি ফু দিয়া দিনটা নিবাইয়া দিছে।
কোস্টারটা চিঁচিঁ করতে করতে হাইকোর্টের সামনে দিয়া দৌড়াইয়া গেল, আবছাভাবে দেখলে খুবই নিরিবিলি ঠাণ্ডা মনে হয় পথটা। চিকনা চাকনা গড়ন, চেক লুঙ্গি পড়নে, গা রঙের ফুলশার্ট হাতাগুটিয়ে পরা। সারা দিন ঘাড় গুঁজে থাকে। দুই গালে কয়েকটা স্থায়ী রেখা। মুখটা হাসি হাসি রাখতে গিয়ে এমন হয়েছে। চাচ বার্নিশের দেহবর্ণে আর কোনো তেজ নাই। সাদা কালো ফিলিম। চোখদুটা অনেক সময় একই সময় দুটা জিনিস দেখে— ফলে চোখের তারা দুটি সূর্য উঠছে আর চাঁদের অস্ত যাবার ক্ষণের মতো দুই দিকে ঘুরে চলে। ঐ চোখের কোনো ভাষাই নাই।
সিরাজের দরজাটা আবছা খোলা। কাশি দিতেই সিরাজ চিনলো। বাসেত, আসো আসো। তোমারে দিয়া আমার বউনি হৈলো। তুমি আমার পয়লা কাস্টোমার।
কী ব্যাপার? না সিরাজ পাতার নতুন ঠ্যাক দিতাছে। মহাজন পাইয়া গেছে, সাপ্লাইও কমপ্লিট, আউজকা হৈলো পয়লা দিন। পয়লা দিনের পয়লা কাস্টোমার, সম্মানই আলেদা। দোস্ত নগদ আছেনি, নগদে একটা পাতা কিনো তো। তারপর দেইখো কী হয়। বাসেত দোনামোনা করছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে কেটে গেল তা। হিরনচি সিরাজ হিরনচি বাসেতকে দিয়ে তার ব্যবসা শুরু করলো।
সিরাজের জীবনে পাতা ব্যাচার আজকাই প্রথমদিন। সব খ্যাত বিখ্যাত হিরনচি নিমন্ত্রণ পেয়েছে। আনন্দবাজারের ঐ মাগি দিছে এক গ্রাম, আমি দিলাম দুই গ্রাম। আউজকা হালায় তোমার লাইগা সব ফ্রি। প্যাট ভইরা খাও দোস। ঘণ্টা কয়েক পর বাসেত যখন গলা পর্যন্ত ভরপুর— একবার চকিত মনে পড়লো আয়শার কথা (আয়শা না আনি? আয়শা তো আগের বউয়ের নাম ছিল!)। সিরাজকে বলে, দোস্ত, এলায় উঠি।
সিরাজ : হপায় তো দুপর। বৈকালের আগে কৈ যাও। আরে বহ বহ। চা খাইবা, পুরি দিয়া খাও! ঐ চা আনতো। তুমি আমার সাইদের কাস্টোমার।
বাসেত : না দোস, অহন যাই। সকালে তোমার ভাবীর ব্যথা উঠছে দেইখা আসছি। এই সময় সামনে থাকা দরকার।
: দুর হালায় কয় কী? তুমি নাড় কাটবা নিকি? সামনেই থাকবার পারবা না।
: যাওন দরকার ছিল।
: হি হি ... তুমি হালায় মাগি নিকি? যাইবানে, বৈকাল হৌক!
বাসেত সব কথা খুলেও বলতে পারে না। আনি ঠিক ঠিক কাউরে খপর দিবো না। নিজে নিজেই করবার চাইবো। সিরাজ এতক্ষণ মালআলী মাগির এক গ্রাম চালাচ্ছিল। এবার নিজের স্টক খুললো। খুব চামে আছে। প্রথম দিনেই ভালো জমাইছে। ইকটু আগে থানার সেকেন্ড অফিসার লোক পাঠাইছিল এস্পেশাল বেনা মাল আছে নিকি, থাকলে পাঠাইতে!
: স্যারের নিজের লাইগা, বোঝেন নাই? ইয়ার বন্ধুরা ধরছে আর কী! ইনফর্মার হারুন জানায়।
সিরাজ পারলে হারুনরে কোলে লইয়া খাওয়ায়। এই রকম নোংরা আর খাচ্চর লোক সারা ঢাকা শহরে দুইটা নাই। হালায় যে রাস্তা দিয়া হাঁটে, এক মাস পরেও ঐখানে গুয়ের পোকা পট পট কইরা মানুষের পায়ের তলায় ফাটার শব্দ হয়।
কিন্তু পাতার ব্যবসায় ফর্মাগো খুব দাম। সিরাজ বাসেতকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে সেকথা মনে করায়া দেয়। হারুইন্নারে খুশি করার ভার বাসেতের উপর। সিরাজ ওদের দুজনকে পাশের একটা ছাপড়ায় ছালাটালা পেতে দিয়ে গেল। সেকেন্ড অফিসার ঘোড়েল লোক। এদিককার পাতার স্পটগুলা আগামী ছয় মাস তার হাতেই থাকবে। এখন সে বেছে বেছে লোক বসাচ্ছে। হারুইন্নার রিপোর্টের দাম আছে। মগরেবের ওক্তে ঘরে কুপি নিয়া আইল একটা মেয়া। সিরাজের তালতো বইন। তিন চাইর দিন হয় ঢাকা আইছে। উঠছে সেনপাড়া পর্বতায়। আজকা থাইকা এখানেই থাকপে। বাসেত মাইয়াটার মুখের দিকে তাকাইয়া চমকাইয়া ওঠে। হাসি হাসি মুখ। কিন্তু কয়েকটা গাইল দিতে শুইনা বুঝল লাইনের মাল। হারুন কিন্তু মজছে। নোংরা নাকটা খুটতে খুটতে কয় : ঢাকা শহরে নুতন আইছো, রাস্তাঘাট চিনো? মটর সাইকেলে চড়ছো কুনুদিন? সিরাজ ভাই, চিন্তা কইরো না। আমি অর সব দায়িত্ব নিলাম। স্যার ফিরি অইলেই ওরে ঘুরাইয়া আনবোনে। সাভার জয়দেবপুর কত যায়গায় স্যারের বন্ধুরা থাকে। কথাবার্তা নিতান্তই মাজুল। কিন্তু সিরাজ হারুইন্নার ইশারায় কাফি, রাংতায় ব্রাউন সুগার ঢালতে ঢালতে বাসেতকে বলে : ভালো একটা পান্নি ল, বড় কইরা তিল্লি কাট অনেকক্ষণ যাতে জ্বলে— হারুনের দম তো আবার মাশাল্লা!
বাসেত মাইয়াটারে দ্যাখে আর চমকায়, চমকায় আর দ্যাখে। একবোরে ফাইস্যা গেছে। মাল ছাইড়া উঠতেও মন চায় না, আবার মাইয়াটার উপর চোখ পড়লেই খালি মনে হয়, আনির কী জানি কী অবস্থা? মানুষজন ডাকছে তো সময় মতো? পকেটে তো এখন অ্যাকটা আধলাও নাই। খালি হাতে ফিরে কেমন করে? হারুন না ওঠা পর্যন্ত সিরাজের কাছে কিছু চাওয়ারও তো উপায় নাই।
এর মধ্যে সেকেন্ড অফিসার সিভিল ড্রেসে সিরাজের ঘর ঘুইরা গেল। দারোগা সাহেব সিরাজের ব্যবহারে যারপরনাই মুগ্ধ। ফাঁড়িতে ফিরে যাবার সময় জানিয়ে গেল, সিরাজের তালতো ভইন যেমন খানকি, সিরাজের ভবিষ্যত সাফল্যও সেই রকম উজ্জ্বল, এর মধ্যে কোনো দুই নম্বরি নাই।
রাত দশটার দিকে চলতি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেল হিরনচি। প্রকৃতপক্ষে এখন ওর শরীরের কোনো অংশই আর জাইগা নাই। সব ডাউন হৈয়া গেছে। যা করতাছে সবই ভুইলা যাইতাছে। পেশাব করতে গিয়া দাড়াইয়া থাকলো, মনে হৈল পেশাব না বারইয়া বরং বাতাস ঢুইকা গেল পেশাবের নাল দিয়া। হিরনচি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। শরীরের কোথাও কোনো তাপ লুকায়ে নাই। বাবুপুরা বস্তিতে ফিরলো কাঁপ কাঁপ করে। অনেকক্ষণ লাগলো নিজের অন্ধকার ঘরটাকে সামগ্রিক অন্ধকার থেকে খুঁজে পেতে। আনি কি ঘুমে? সারা দিন কি কিছু খাইছে?
এক পাল্লার বাঁশের ঝাঁপ খুলতে গিয়ে দ্যাখে ওটা ভিতর থেকে আটকানো। বিশেষ একটা কৌশলে ঝাঁপটা খুলে ফেললো, যদিও অনেক সময় লাগলো। মাথাটা আবার কাজ করলো। ঘরে ঢুকে পকেট থেকে ম্যাচ বের করলো, মরা হাতে বারুদে ঘষা দিয়ে কুপি জ্বাললো। আবার খানিক দাঁড়িয়ে থাকলো, ঘরের ভিতর কী দেখবে তাও তো মনে পড়ে না। চোখ গেল বিছানায়, ওখানে কী আনি শোয়া? হ্যাঁ। কিন্তু দেখা গেল অতি বিস্তৃত ভীতিকর একটা কিছু। সমস্ত বিছানা জুড়ে রক্তারক্তির মধ্যে নাড়িটাড়ি জড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে একটা নবজাতক— আনিও চিৎ— নগ্ন নিঃসাড় মাতৃমূর্তি। সমস্ত ঘর নিঃশব্দ।
হিরনচি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েই রইলো। দেখতে পারাও ভুলে গেছে। কিভাবে যেন দ্যাখে? চোখ খুলে? চোখ খুলতেই হয়? ওর শরীর দিয়ে ঘিলু গড়িয়ে পড়ছে। কিসব যেন মিলছে না। ফলে হঠাৎ করে পরিবেশটা একটা ভয়ংকর চেহারা নিলো।
শিশুটার কোনো শব্দ নাই। কোনো নড়াচড়া নাই। চোখও খুলছে না, হাতপাও নাড়ছে না। কখন ও জন্মাইছে? মনে হয় নাড়ী তো কাটে নাই এখনো। কী হবে কী হবে এখন?
অন্ধকার থেকে কার যেন একটা হাত এগিয়ে এলো। হাতে ছুরি ধরা। ও ছুরিটা হাতটা থেকে নেয়। বেশ মাঝারি ছিমছাম ছুরিটা। তবে ওজন মন্দ না। বুড়া আঙ্গুলে ফলার ধার পরীক্ষা করে দেখে, মন্দ না। বেশ নিপুণ মসৃণভাবে ছুরিটায় ধার দেয়া হয়েছে।
চৌকিটা বাদ দিলে, ঘরের ভিতরে জায়গা নাই বললেই চলে। চলাফেরা খুব সাবধানে করতে হয়। ও একটু এগিয়ে শিশুটার আরো কাছে গিয়া চৌকির উপর লেটকি মেরে বসে।
ছুরিটা তুলে আর একবার ধার দেখে, দুই তিন বার ধার দেখে খুব সন্তুষ্ট হয়। তারপর বাহাতি হিরনচি ঘ্যাজঘ্যাচ করে ছুরিটা চালিয়ে দেয় ওর গলায়। মুহূর্তের মধ্যে ফোয়ারা ফুটে উঠলো গলার ডান পাশ থেকে। চটচটে তরলে ভেসে গেল ঘরের যত স্থবিরতা; বিভিন্ন প্রকার নালী, শিরা, উপশিরা দ্বিখণ্ডিত হতে লাগলো আর নিঃশব্দ আতুর ঘর ভরে উঠলো জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা প্রকারের ছন্দছুট ধ্বনিতে। তার হাত পোচানোর আনন্দে যেন আরো বেশি করে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো— আবার অন্যদিকে চেতনার রগগুলি একটা একটা করে কেটে যাওয়াতে, ক্রমশ: ফাঁক হতে থাকা গলার যত ব্যথাবেদনা মগজে পৌঁছানোর পর মস্তিষ্ক যে নির্দেশটা দিতে চাইছিল বাঁ হাতকে : থামো থামো, যাতে ঐ যন্ত্রণা সৃষ্টিকারী কাজ সে বন্ধ করে; কিন্তু সেই নির্দেশ বা আদেশ হাতে পৌঁছানো হলো না, কারণ নির্দেশ বহনকারী রগ ইতোমধ্যেই ছিন্ন হয়ে গেছে। হিরনচির বাম হাত পরম আনন্দে নিজের গলার ফাঁকটাকে বড় করার কাজে লিপ্ত থাকলো আর নিজের মাথাটা ফাঁক হওয়ার তীব্র যন্ত্রণায় অসম্ভব রকম আর্তনাদে হারিয়ে যাওয়া চোখগুলির বিস্ফোরণ দেখতে লাগলো...। হাতের সাফল্যে সেই ছোট অন্ধকারপ্রায় ঘর শব্দে, শক্তিতে, আর্তনাদে ভরে উঠল। হঠাৎ করেই ওর মস্তিষ্ক থেকে উধাও হয়ে গেল বহির্বিশ্ববোধ। হঠাৎই সেটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে তার সংযোগ হারিয়ে ফেলে পরিণত হলো বেশ কয়েক কেজি লোকাল মাংসপিণ্ডে।
লেখক পরিচিতি
কাজল শাহনেওয়াজ
কিশোরগঞ্জ, বাংলাদেশ।
কবি ও গল্পকার।
ঢাকা
৯ মাস পুরা হলে বাসেত বউকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে একলা পারবি তো? বউটা আরেক ঘরের ভাত খাইয়া আসলেও এখনো লাজশরমের মাথা খায় নাই। বাসেতের জিজ্ঞাসার আন্তরিকতায় প্রায় গলে যায়— মেঝেতে বসে ল্যাছড়াতে ল্যাছড়াতে ঝাট দিতে দিতে কোনোদিকে তাকাতে পারে না... মিহি গলায় বলে, পারুম না কেন; নিজের কুনোদিন হয় নাই তো কী হইছে, মারে তো হওয়াইতে দেখছি একগাদা। এমুন কী আর কঠিন!
আলাপ আলোচনায় খুব নিশ্চিত বোধ কইরা বাসেত হিরনচি পার্টিহাউজের দিকে রওনা হৈলো।
ভালো নাম আনোয়ারা, ডাক নাম আনি। গত বর্ষায় যখন খুব কইরা বৃষ্টি— কাজ কামের কোনো ঠিক নাই, গায়েগতরে তাকদের কমতি নাই, শরীরে নাই কোনো বিষের চাহিদাও— হাতের জমা ভাইঙ্গা পরম আনন্দে দিন চলতাছিল। একদিন সুখের ভুতে কিলাইলো। প্রাণের দোস্ত লায়েক আলি অতি লায়েকি চাল মারতে গিয়া গোপনে যে প্রাণভোমরা বন্ধক রেখেছে পপি কষের কাছে, বাসেত যেদিন টের পেল, সেদিন ওর অবস্থাও সুবিধার না: শতিনেক টাকার কেসে ধরা খেয়ে জনা দশেক খোদাই ষাঁড় পালা করে ওকে গণমেরামত করার পর দেহ থেকে যখন হাজার তিনেক টাকার শক্তি ও তিরিশ হাজারের সাহস বেরিয়ে গেল লায়েক আলির মৃদু পরামর্শ তখন ফেলতে পারেনি।
সব পেশারই নানা রকম টোটকা থাকে। টোটকা চিকিৎসা, টোটকা পথ্য, টোটকা দাওয়াই। লায়েক আলি জব্বর একখানা ব্যবস্থা দিয়েছিল। জীবনের সকল ক্রুরতা ঢেকে ফেলার জন্য— সব অমানুষিক নিচুতা মুছে ফেলার জন্য— সব নিষ্ঠুর অপমান হাওয়ায় উড়িয়ে দেবার জন্য এই বাদামী নায়িকা চূর্ণের শক্তি, বিস্ময়কর।
সেদিন সব গ্লানি হাওয়ায় উড়ে গেল, উপরন্তু রাতের বিছানায় আনি যখন ওকে মালিশ লাগাচ্ছে আর অল্প অল্প ঘেমে উঠছে তেতে গিয়ে আর বাসেত ওর গরম হওয়াটা উপভোগ করতে শুরু করছে একটু একটু করে, তখনো বোঝা যায়নি। চোখ জুইড়া আসা ঘুম কচলাইতে কচলাইতে আনিরে পাকাইতে পাকাইতে কানের কাছে মুখ নিয়া গুনগুনাইতো : আনিরে আনি আনা আনা... গাদলার কামড়ে সব কিছু ভিজা ভিজা, আর দৈত্যের শক্তি ভর করছে ওকে। আর আনি তপ্ত হতে হতে গলে গলে নিস্ব হয়ে মরে যাচ্ছে তখনও ও উন্মত্ত হয়ে ঠাডা ছুড়ে যাচ্ছে। আনি ও সেসব দিন থেকে প্রবল লোভী হয়ে গেল। এই ক্লান্তিহীন দেহরত্নের সেবায় জীবন উৎসর্গ করবে বলে মনস্থ করে। বেলা দশটার বৃষ্টিচাপা অন্ধকারে বাসেত আর চোখই খুলবার চায় না। সত্যিকারের ক্লান্তি ওকে মুর্ছার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ও তালগোল পাকিয়ে আনির কাদার ভিতর পাঁকাল হয়ে মাথা গুঁজে পড়ে থাকলো... বাইরে মাঠ পানিতে ছয়লাব। বস্তির আঠালো কালো পানি, এমন বৃষ্টি— ঘরের পৈঠা সলিলে ডুবুডুবু।
ঘর নাতো খোপখোপ খোপ। দরজায় পা দিতেই আরেক পা আগানোর নাগালের মধ্যে একটা মন মাতানো চৌকি। এক সাইডের বেড়ায় চৌকি বরাবর একহাত একহাত মাপের ফোকর জানালা+ঝাপ লাগানো। ওটা তুলে দিলে মাঝে মাঝে সরু সরু বাতাসের ছিটাফোটা পাওয়া যায়। শোনা যায় কাছের ফাঁকা জায়গায় ময়লা ফেলার শব্দ।
খোপের চৌকির ওপর পা ভাঁজ করে বসে আছে আনি। নিশ্চুপ নরোম সরোম। হিরনচি পাতার সন্ধানে পার্টিহাউজের দিকে রওনা হয়। শরীরের নানা জায়গা থেকে বিষসংকেত আসছে, মাথায় ভিতরে বিড়ালটা গড়গড় করছে। আর ঘরে থাকা দায়। এই বউটা খুব বাধুক। কথার মারপ্যাচে নাই। প্যাট ভইরা খিলাইবার পর দুনিয়ার সব জরিবুটি বিশ্বাস করে বসে।
মিটিমিটি পায়ে পার্টিহাউজে গিয়ে দেখে মাল নাই। পুরা তল্লাট খা খা করতাছে। রাত্রে রুবেলের মা অ্যারেস্ট হৈছে। সবাই ব্যস্ত কোটকাচারি লৈয়া। বিড়ালটার থাবার ভিতরে লুকানো নখের কোণা এখন শুড়শুড়াচ্ছে, কিন্তু অচিরেই পাগলা হয়ে উঠবে, খবর পাওয়া যাচ্ছে। নিজের বাচ্চাগুলানরে আগুনে ফেলতি খাকপি, দম খিচে আসবি, নাক ঝরঝর করবি, শীতের ঝাকানি আসবি...। ভয়ে মেজাজ বাঞ্চোৎ, লাফ দিয়া ফুলবাড়িয়ার কোস্টারে ওঠে। পকেটের টাকা খর্চা করা যাবো না। রেলোয়ে বস্তির সিরাজ না হয় পাঞ্জা বাবুলরে ফিট দিতে হইবো।
মানুষের গুঁতা খাইতে খাইতে বিড়ালের বাচ্চাগুলার কাইজ্জা শুরু। বৃষ্টিগুমোট দিনটার আধমরা ঝুলন্ত দেহ ঘামজর্জর পচাপচা; যারা গাড়ির কাচ তুইলা বাদলা দেখতে বেরইছে— সবাই প্রায় ঘুমঘুম। মাঝে মাঝে এমন কতগুলা দিন আইসা হাজির হয়, যেগুলি পথগুলারে টাইনা নিয়া মিলাইয়া দেয় সব কুপথগুলার সাথে। এমনই খাচ্চর ঐ দিনগুলা, মনে হয় দিনটার মা বইনেরা আড়াল থাইকা কোরান উল্টা কইরা পইড়া কুফরি ফু দিয়া দিনটা নিবাইয়া দিছে।
কোস্টারটা চিঁচিঁ করতে করতে হাইকোর্টের সামনে দিয়া দৌড়াইয়া গেল, আবছাভাবে দেখলে খুবই নিরিবিলি ঠাণ্ডা মনে হয় পথটা। চিকনা চাকনা গড়ন, চেক লুঙ্গি পড়নে, গা রঙের ফুলশার্ট হাতাগুটিয়ে পরা। সারা দিন ঘাড় গুঁজে থাকে। দুই গালে কয়েকটা স্থায়ী রেখা। মুখটা হাসি হাসি রাখতে গিয়ে এমন হয়েছে। চাচ বার্নিশের দেহবর্ণে আর কোনো তেজ নাই। সাদা কালো ফিলিম। চোখদুটা অনেক সময় একই সময় দুটা জিনিস দেখে— ফলে চোখের তারা দুটি সূর্য উঠছে আর চাঁদের অস্ত যাবার ক্ষণের মতো দুই দিকে ঘুরে চলে। ঐ চোখের কোনো ভাষাই নাই।
সিরাজের দরজাটা আবছা খোলা। কাশি দিতেই সিরাজ চিনলো। বাসেত, আসো আসো। তোমারে দিয়া আমার বউনি হৈলো। তুমি আমার পয়লা কাস্টোমার।
কী ব্যাপার? না সিরাজ পাতার নতুন ঠ্যাক দিতাছে। মহাজন পাইয়া গেছে, সাপ্লাইও কমপ্লিট, আউজকা হৈলো পয়লা দিন। পয়লা দিনের পয়লা কাস্টোমার, সম্মানই আলেদা। দোস্ত নগদ আছেনি, নগদে একটা পাতা কিনো তো। তারপর দেইখো কী হয়। বাসেত দোনামোনা করছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে কেটে গেল তা। হিরনচি সিরাজ হিরনচি বাসেতকে দিয়ে তার ব্যবসা শুরু করলো।
সিরাজের জীবনে পাতা ব্যাচার আজকাই প্রথমদিন। সব খ্যাত বিখ্যাত হিরনচি নিমন্ত্রণ পেয়েছে। আনন্দবাজারের ঐ মাগি দিছে এক গ্রাম, আমি দিলাম দুই গ্রাম। আউজকা হালায় তোমার লাইগা সব ফ্রি। প্যাট ভইরা খাও দোস। ঘণ্টা কয়েক পর বাসেত যখন গলা পর্যন্ত ভরপুর— একবার চকিত মনে পড়লো আয়শার কথা (আয়শা না আনি? আয়শা তো আগের বউয়ের নাম ছিল!)। সিরাজকে বলে, দোস্ত, এলায় উঠি।
সিরাজ : হপায় তো দুপর। বৈকালের আগে কৈ যাও। আরে বহ বহ। চা খাইবা, পুরি দিয়া খাও! ঐ চা আনতো। তুমি আমার সাইদের কাস্টোমার।
বাসেত : না দোস, অহন যাই। সকালে তোমার ভাবীর ব্যথা উঠছে দেইখা আসছি। এই সময় সামনে থাকা দরকার।
: দুর হালায় কয় কী? তুমি নাড় কাটবা নিকি? সামনেই থাকবার পারবা না।
: যাওন দরকার ছিল।
: হি হি ... তুমি হালায় মাগি নিকি? যাইবানে, বৈকাল হৌক!
বাসেত সব কথা খুলেও বলতে পারে না। আনি ঠিক ঠিক কাউরে খপর দিবো না। নিজে নিজেই করবার চাইবো। সিরাজ এতক্ষণ মালআলী মাগির এক গ্রাম চালাচ্ছিল। এবার নিজের স্টক খুললো। খুব চামে আছে। প্রথম দিনেই ভালো জমাইছে। ইকটু আগে থানার সেকেন্ড অফিসার লোক পাঠাইছিল এস্পেশাল বেনা মাল আছে নিকি, থাকলে পাঠাইতে!
: স্যারের নিজের লাইগা, বোঝেন নাই? ইয়ার বন্ধুরা ধরছে আর কী! ইনফর্মার হারুন জানায়।
সিরাজ পারলে হারুনরে কোলে লইয়া খাওয়ায়। এই রকম নোংরা আর খাচ্চর লোক সারা ঢাকা শহরে দুইটা নাই। হালায় যে রাস্তা দিয়া হাঁটে, এক মাস পরেও ঐখানে গুয়ের পোকা পট পট কইরা মানুষের পায়ের তলায় ফাটার শব্দ হয়।
কিন্তু পাতার ব্যবসায় ফর্মাগো খুব দাম। সিরাজ বাসেতকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে সেকথা মনে করায়া দেয়। হারুইন্নারে খুশি করার ভার বাসেতের উপর। সিরাজ ওদের দুজনকে পাশের একটা ছাপড়ায় ছালাটালা পেতে দিয়ে গেল। সেকেন্ড অফিসার ঘোড়েল লোক। এদিককার পাতার স্পটগুলা আগামী ছয় মাস তার হাতেই থাকবে। এখন সে বেছে বেছে লোক বসাচ্ছে। হারুইন্নার রিপোর্টের দাম আছে। মগরেবের ওক্তে ঘরে কুপি নিয়া আইল একটা মেয়া। সিরাজের তালতো বইন। তিন চাইর দিন হয় ঢাকা আইছে। উঠছে সেনপাড়া পর্বতায়। আজকা থাইকা এখানেই থাকপে। বাসেত মাইয়াটার মুখের দিকে তাকাইয়া চমকাইয়া ওঠে। হাসি হাসি মুখ। কিন্তু কয়েকটা গাইল দিতে শুইনা বুঝল লাইনের মাল। হারুন কিন্তু মজছে। নোংরা নাকটা খুটতে খুটতে কয় : ঢাকা শহরে নুতন আইছো, রাস্তাঘাট চিনো? মটর সাইকেলে চড়ছো কুনুদিন? সিরাজ ভাই, চিন্তা কইরো না। আমি অর সব দায়িত্ব নিলাম। স্যার ফিরি অইলেই ওরে ঘুরাইয়া আনবোনে। সাভার জয়দেবপুর কত যায়গায় স্যারের বন্ধুরা থাকে। কথাবার্তা নিতান্তই মাজুল। কিন্তু সিরাজ হারুইন্নার ইশারায় কাফি, রাংতায় ব্রাউন সুগার ঢালতে ঢালতে বাসেতকে বলে : ভালো একটা পান্নি ল, বড় কইরা তিল্লি কাট অনেকক্ষণ যাতে জ্বলে— হারুনের দম তো আবার মাশাল্লা!
বাসেত মাইয়াটারে দ্যাখে আর চমকায়, চমকায় আর দ্যাখে। একবোরে ফাইস্যা গেছে। মাল ছাইড়া উঠতেও মন চায় না, আবার মাইয়াটার উপর চোখ পড়লেই খালি মনে হয়, আনির কী জানি কী অবস্থা? মানুষজন ডাকছে তো সময় মতো? পকেটে তো এখন অ্যাকটা আধলাও নাই। খালি হাতে ফিরে কেমন করে? হারুন না ওঠা পর্যন্ত সিরাজের কাছে কিছু চাওয়ারও তো উপায় নাই।
এর মধ্যে সেকেন্ড অফিসার সিভিল ড্রেসে সিরাজের ঘর ঘুইরা গেল। দারোগা সাহেব সিরাজের ব্যবহারে যারপরনাই মুগ্ধ। ফাঁড়িতে ফিরে যাবার সময় জানিয়ে গেল, সিরাজের তালতো ভইন যেমন খানকি, সিরাজের ভবিষ্যত সাফল্যও সেই রকম উজ্জ্বল, এর মধ্যে কোনো দুই নম্বরি নাই।
রাত দশটার দিকে চলতি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেল হিরনচি। প্রকৃতপক্ষে এখন ওর শরীরের কোনো অংশই আর জাইগা নাই। সব ডাউন হৈয়া গেছে। যা করতাছে সবই ভুইলা যাইতাছে। পেশাব করতে গিয়া দাড়াইয়া থাকলো, মনে হৈল পেশাব না বারইয়া বরং বাতাস ঢুইকা গেল পেশাবের নাল দিয়া। হিরনচি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। শরীরের কোথাও কোনো তাপ লুকায়ে নাই। বাবুপুরা বস্তিতে ফিরলো কাঁপ কাঁপ করে। অনেকক্ষণ লাগলো নিজের অন্ধকার ঘরটাকে সামগ্রিক অন্ধকার থেকে খুঁজে পেতে। আনি কি ঘুমে? সারা দিন কি কিছু খাইছে?
এক পাল্লার বাঁশের ঝাঁপ খুলতে গিয়ে দ্যাখে ওটা ভিতর থেকে আটকানো। বিশেষ একটা কৌশলে ঝাঁপটা খুলে ফেললো, যদিও অনেক সময় লাগলো। মাথাটা আবার কাজ করলো। ঘরে ঢুকে পকেট থেকে ম্যাচ বের করলো, মরা হাতে বারুদে ঘষা দিয়ে কুপি জ্বাললো। আবার খানিক দাঁড়িয়ে থাকলো, ঘরের ভিতর কী দেখবে তাও তো মনে পড়ে না। চোখ গেল বিছানায়, ওখানে কী আনি শোয়া? হ্যাঁ। কিন্তু দেখা গেল অতি বিস্তৃত ভীতিকর একটা কিছু। সমস্ত বিছানা জুড়ে রক্তারক্তির মধ্যে নাড়িটাড়ি জড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে একটা নবজাতক— আনিও চিৎ— নগ্ন নিঃসাড় মাতৃমূর্তি। সমস্ত ঘর নিঃশব্দ।
হিরনচি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েই রইলো। দেখতে পারাও ভুলে গেছে। কিভাবে যেন দ্যাখে? চোখ খুলে? চোখ খুলতেই হয়? ওর শরীর দিয়ে ঘিলু গড়িয়ে পড়ছে। কিসব যেন মিলছে না। ফলে হঠাৎ করে পরিবেশটা একটা ভয়ংকর চেহারা নিলো।
শিশুটার কোনো শব্দ নাই। কোনো নড়াচড়া নাই। চোখও খুলছে না, হাতপাও নাড়ছে না। কখন ও জন্মাইছে? মনে হয় নাড়ী তো কাটে নাই এখনো। কী হবে কী হবে এখন?
অন্ধকার থেকে কার যেন একটা হাত এগিয়ে এলো। হাতে ছুরি ধরা। ও ছুরিটা হাতটা থেকে নেয়। বেশ মাঝারি ছিমছাম ছুরিটা। তবে ওজন মন্দ না। বুড়া আঙ্গুলে ফলার ধার পরীক্ষা করে দেখে, মন্দ না। বেশ নিপুণ মসৃণভাবে ছুরিটায় ধার দেয়া হয়েছে।
চৌকিটা বাদ দিলে, ঘরের ভিতরে জায়গা নাই বললেই চলে। চলাফেরা খুব সাবধানে করতে হয়। ও একটু এগিয়ে শিশুটার আরো কাছে গিয়া চৌকির উপর লেটকি মেরে বসে।
ছুরিটা তুলে আর একবার ধার দেখে, দুই তিন বার ধার দেখে খুব সন্তুষ্ট হয়। তারপর বাহাতি হিরনচি ঘ্যাজঘ্যাচ করে ছুরিটা চালিয়ে দেয় ওর গলায়। মুহূর্তের মধ্যে ফোয়ারা ফুটে উঠলো গলার ডান পাশ থেকে। চটচটে তরলে ভেসে গেল ঘরের যত স্থবিরতা; বিভিন্ন প্রকার নালী, শিরা, উপশিরা দ্বিখণ্ডিত হতে লাগলো আর নিঃশব্দ আতুর ঘর ভরে উঠলো জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা প্রকারের ছন্দছুট ধ্বনিতে। তার হাত পোচানোর আনন্দে যেন আরো বেশি করে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো— আবার অন্যদিকে চেতনার রগগুলি একটা একটা করে কেটে যাওয়াতে, ক্রমশ: ফাঁক হতে থাকা গলার যত ব্যথাবেদনা মগজে পৌঁছানোর পর মস্তিষ্ক যে নির্দেশটা দিতে চাইছিল বাঁ হাতকে : থামো থামো, যাতে ঐ যন্ত্রণা সৃষ্টিকারী কাজ সে বন্ধ করে; কিন্তু সেই নির্দেশ বা আদেশ হাতে পৌঁছানো হলো না, কারণ নির্দেশ বহনকারী রগ ইতোমধ্যেই ছিন্ন হয়ে গেছে। হিরনচির বাম হাত পরম আনন্দে নিজের গলার ফাঁকটাকে বড় করার কাজে লিপ্ত থাকলো আর নিজের মাথাটা ফাঁক হওয়ার তীব্র যন্ত্রণায় অসম্ভব রকম আর্তনাদে হারিয়ে যাওয়া চোখগুলির বিস্ফোরণ দেখতে লাগলো...। হাতের সাফল্যে সেই ছোট অন্ধকারপ্রায় ঘর শব্দে, শক্তিতে, আর্তনাদে ভরে উঠল। হঠাৎ করেই ওর মস্তিষ্ক থেকে উধাও হয়ে গেল বহির্বিশ্ববোধ। হঠাৎই সেটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে তার সংযোগ হারিয়ে ফেলে পরিণত হলো বেশ কয়েক কেজি লোকাল মাংসপিণ্ডে।
লেখক পরিচিতি
কাজল শাহনেওয়াজ
কিশোরগঞ্জ, বাংলাদেশ।
কবি ও গল্পকার।
ঢাকা
0 মন্তব্যসমূহ