দুধের সরের মতো জমা হয়ে থাকা কুয়াশার হীম ভেঙ্গে ভোর হতেই এক কমণ্ডলু জলে কয়েকটা তুলশী পাতা দিয়ে কিছু ফুল হাতে নিয়ে শ্মশান ঘাটের দিকে চলে যায় সুরবালা দাস। স্বামীর শ্মশানে ফুল-জল দিয়ে তারপর বহুক্ষণ ওখানে বসেই কী কথা বলে তা কেউ জানে না। শুধু তিনি যখন ভোরের নীরবতা ভেঙ্গে- ‘গুরু দিন যে গেল, সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে’- গাইতে গাইতে স্বামীর শ্মশানের উদ্দেশ্যে চলতে থাকে তখন ঘুমন্ত মানুষেরা বোঝে ভোর হয়ে গেছে।
সুরবালা দাস। বয়সের চেয়ে বেশি বুড়ো হয়ে গেছে। মাথার সব চুল পেকে গেছে। কতকাল তাতে তেল-জলের ছোঁয়া পড়ে না, তাও জানার আগ্রহ নেই কারো। শরীরের চামড়া ওয়ারগান্ডি শাড়ি সোডার জলে সিদ্ধ করলে যেমন কুঁচকে যায় তেমনি কুঁচকে গেছে। চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে খেলা করে অন্ধকার। ঠিক মতো খেতে পায় না। আচার্য বাড়ির মন্দিরের বারান্দায় শুয়ে থাকে। রাতভর ঘুমায় না। অনেকটা অপ্রকৃতিস্থও। তিন ছেলে, কেউ ঠিক মতো খেতে দেয় না। মাঝে মধ্যে সালিসি বসে- কোন ছেলে কবে তার মাকে খাওয়াবে তা ঠিক করে দেয়। কিন্তু ওই সালিসি পর্যন্তই সব কিছু। তারপরে আর খোঁজ থাকে না কারো। কথায় বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না। সুরবালার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। কোনো ছেলে একবার খেতে দিল, তারপরে আর কেউ খোঁজই রাখলো না। খাওয়া না-খাওয়া নিয়ে সুরবালারও তেমন কোনো টানাপোড়েন নেই। এলাকার অনেকেই বলতো- অনিল আছে, গীতা আছে, ওরা ভারতে লোক পৌছে দিয়ে আসে। পাসপোর্ট-ভিসা কিছুই লাগে না। সুরবালাকে তার মেয়েদের কাছে দিয়ে আসো। মেয়েরা সবাই খুব ভাল আছে। মেয়েরাও চিঠি লেখে মাকে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সুরবালা কখানোই স্বামীর শ্মশান ছেড়ে যাবে না।
এদিকে তার ছেলেদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভাল না। তিন ছেলের মধ্যে ছোটজন ভ্যান চালায়। আর বাকী দু’জন বাবার ব্যবসা ধরে রেখেছে। বাবা ছিলেন লোহার কর্মকার। এজন্য জাত কর্মকাররা তাকে সহ্য করতে পারতো না। কারণ তারা আসলে কর্মকার না। নিচুজাতের, রজক দাস। ‘গৌতম বাড়ি’র ধোপা ছিলেন তারা। এ আবার আরেক ইতিহাস। গৌতমরা যে জমিদারি পেয়েছিল সেই রায়তের নাম ‘গৌতমের আবাদ’। রায়ত পাওয়ার পরে ধোপা নাপিত এসব পেশাজীবীরা জমিদারদের নির্ভর করেই বেঁচে থাকতো। সেই হিসেবে গৌতমদের দীঘির পাড়ে রজক দাসদের জায়গা দেয়া হয়েছিল। ওখানেই তারা থাকে। রজক দাসদের মধ্যে যারা ওখানে গৌতম বাড়ির ‘শাসন’ ধরে রেখেছিল তাদের মধ্যে শ্যাম দাস ও ধনঞ্জয় দাস এই দুইভাই-ই প্রধান। বড় ভাই শ্যাম দাস গুড়ের ব্যবসা করতো। গোপালগঞ্জের সাঁচিয়াদা থেকে গুড় এনে সিকির বাজার, ঘাঘর বাজার, চৌধুরীর হাট, পয়সার হাটে বিক্রি করে চলতে এদের সংসার। সাঁচিয়াদা ছিল এদের গুড়ের মোকাম। কিন্তু এ পর্যন্ত যেতে আসতে যারপরনাই কষ্ট হতো। দুই-তিন দল মিলে এরা নিজেরা নৌকা বেয়ে যেত মোকামে। গোপালগঞ্জ পৌঁছানোর পর গেটের ভেতর দিয়ে নৌকা নিয়ে পৌঁছানো ছিল সবচেয়ে কষ্টের কাজ। এইজন্য ছয়জনে নৌকা বাইলে কষ্ট কম হতো। কিন্তু সমস্যা ঘটতো একখানে। মোকামে যাওয়ার আগের দিন ধনঞ্জয় হাওয়া হয়ে যেত। দিন-রাত বৈঠা টেনে মোকামে যেতে ভালো লাগতো না তার। তার ভালো লাগতো রামযাত্রা করতে। রামযাত্রার দলছিল সিকির বাজারের কাছেই। প্রাইমারি স্কুলে চলতো রিহার্সাল। এখানেই ধনঞ্জয়ের পুন্য ক্ষেত্র। এরচেয়ে প্রিয়কাজ তার কোনোটাই ছিল না। ঘুমের ভেতরেও ধনঞ্জয় চিৎকার করে ডায়লগ বলে ওঠতো-‘ কে তুমি হাসছো? সত্য করে দাও পরিচয়। দেবে না পরিচয়? তুমি যেই হও লঙ্কেশ্বরী রাক্ষসী তুমি। তোমাদের স্বর্ণ লঙ্কা আমি ছাড়খাড় করে দিয়ে চলে যাবো। হাঃ হাঃ হাঃ...
বল? সীতা কোথায় বল? কোথায় অশোক বন? মা সীতা, তুমি কেঁদ না মা। আমাকে যদি বিশ্বাস না হয় এই দেখ আমার হাতে প্রভু রামের পদচিহ্ন। বল মা, কিভাবে উদ্ধারিব তোমায়?’
ধনঞ্জয়ের মন পরে থাকতো এই যাত্রা গানে। শ্যাম দাস ধনঞ্জয়কে একটু সংসার মুখি করার জন্য তাকে ঘটাকরে বিয়ে দেয়। মা মারা যাওয়ার সময় শ্যাম দাসকে বলে গেছেন, পাগল ভাইড্যারে ফ্যালাইস ন্যা শ্যাম। শ্যাম দাস এতোদিন মায়ের কথা শুনে আসলেও ধনঞ্জয়ের বিয়ের পরে তার ছন্নছাড়া জীবনে জন্য কথা শুনতে হতো তার বউকে। প্রতিনিয়ত এই কথা একসময় ঝগড়ায় রূপ নেয়। শ্যাম দাস ও ধনঞ্জয়ের বউয়ের ঝগড়া প্রাত্যহিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর শ্যাম দাসকে একদিন ছোট ভাইকে আলাদা করে দিতে হয়। আলাদা হওয়ার পর শ্যাম দাস তার দুই ছেলেকে নিয়ে গুড়ের ব্যবসা শুরু করে। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। শ্যাম দাসের পেটের ব্যথা দিনদিন বাড়তে থাকে। তার পেটের ডানপাশ থেকে ব্যথাটা ওঠতো। ওঠলে আর হিতাহিত জ্ঞান থাকতো না। এসময় কৌটায় রাখা ‘খাই-সোডা’ কৌটার দুই মুখটি খেলেই ব্যথা পড়ে যেত।
একবার মোকামে যাওয়ার পথে ব্যথা ওঠলে যত সোডা খায় ব্যাথা আর কমে না। পরে তাকে দুই ছেলে গোপালগঞ্জ শহরের সেরা ডাক্তার বিজিতেন বাবুর কাছে নিতে নিতে পথিমধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। শ্যাম দাস মারা যাওয়ায় ধনঞ্জয় বিপদে পড়ে যায়। কারণ রামযাত্রা গাইতে গলেও তাতে শ্যাম দাস যতই রাগ হতো আলাদা হওয়া সত্তে¡ও খাওয়ার সময় ছোট ভাইকে ছাড়া ভাত তার গলা নামতো না। তাছাড়াও বাজার-ঘাট যা কিছু তিনি আনতেন তার অর্ধেকটা ধনঞ্জয়ের বউ সুরবালা ডেকে দিয়ে দিত। কোথাও রামযাত্রা গাইতে গলেও দাদার কথা ভেবে ধনঞ্জয় কোনো চিন্তা করতো না। কিন্তু এখন?
ধনঞ্জয় কর্মকার পাড়ার সুচিত কর্মকারের সঙ্গে ‘সামনের কাজ’ নেয়। সামনের কাজ মানে দোয়াত(বড় হাতুড়ি) দিয়ে লোহা পেটানো। কয়লার আগুনে পোড়া দগদগে ঘায়ের মতো লোহার রঙ হয়ে গেলে তাকে পেটানো হয়। ধনঞ্জয় এই লোহার রঙের মধ্যে দাদার মৃত্যুর পর নিজের হৃদয়টাকে দেখে নিতো। একমায়ের গর্ভে জন্ম নেয়ার যে কত জ্বালা তা আর কেউ না বুঝলেও লোকশিল্পী ধনঞ্জয় বুঝতো। এভাবে কয়লায় লোহা পোড়াতে আর হাঁপরের শিকল টানতে টানতে ধনঞ্জয় কাজ শিখে ফেলে এবং নিজের বাড়ির ওপর একখানা দোকান দেয়।
তাদের বাড়িটা দেখতে খুব সুন্দর। পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রাম একটি রাস্তা। রাস্তার পরেই একটা ছোট খাল। খালে প্রচুর মাছ, কিলবিল করে। ধনঞ্জয়ের কাজ হলো কিছু সময় কর্মকারের কাজ করা, তারপর পথ দিয়ে যারা যায় তাদের ডেকে হুঁক্কা খাওয়ানো ও রামযাত্রার গল্প করা। লোকজন বেশি হলে নিজে সুগ্রীবের ভূমিকায় কিভাবে অভিনয় করেছেন দেখিয়ে দিতেন। কখনো কখনো লক্ষ্মণ শক্তিশেলে আহত হওয়ার পর রামের বিলাপ গেয়ে শোনাতেন-
‘প্রাণের ভাই লক্ষ্মণ রে
ওরে তুই মরলে আমি
ভাই বলিব কারে রে
আমার ভাই বুকে আয় রে’
স্ত্রী রাগ হতো। ছেলেরা বড় হচ্ছে। ঘরে চাল বেশি লাগে, আর সে কাজ ফেলে রাম যাত্রা গায়। একদিন বউয়ের ওপর ভীষণ চটে যায়। হাতের একটা লাঠি পেয়ে সে তেড়ে গেল বউয়ের দিকে। পেটাতে পেটাতে বলতে শুরু করলো-‘চুতমারানি মাগী, রামযাত্রা তোর চোদ্দ পুরুষ শোনছে? শিক্ষা-দীক্ষাহীন মূর্খ কোথাকার, আইজই বিদায় হবি, তোর বাপের বাড়ি যাইয়া থাকপি।’ সুরবালার কান্নায় লোকজন ছুটে আসলেও ধনঞ্জয়কে থামানো খুবই কষ্টকর ব্যাপার ছিল। কাজ না করায় একদিকে যেমন ক্রেতারা দাও-কাচি নিতে এসে ভীড় করতো, অন্যদিকে পাওনাদাররা আসতো টাকা নিতে। তবু তার রামযাত্রা থামতো না।
এইভাবে চলে আসে ঊনিশ একাত্তর সাল। ধনঞ্জয় দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি রেডিও শুনতো আর লোকজনকে ডাকতো। প্রথমে লোকজন ভয় পেলেও পরবর্তীতে তার দোকান ঘরে খবর শোনা মানুষের মেলা বসতো। পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী যখন আক্রমণ করে এলাকার রাজাকাররা ধনঞ্জয়ের বাড়িটা পুড়িয়ে লুটকরে পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে খুশি করে। তাজেল, মান্নান, জুম্মন এরা ছিল রাজাকার। এরাই সব বাড়িতে আগুন দেয়। ধনঞ্জয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। কমান্ডার কমলেশের ইনফর্মার ছিল সে। তার কথায়ই কমলেশ অনেক রাজারকে ধরে ফেলেছিল। এরমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হলে অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে ধনঞ্জয় আবার দোকানে বসে। এবারে হলো মুক্তিযুদ্ধের গল্পের পালা। এইসব গল্পশুরু করলে তার বউ মাঝে মধ্যে বলতো- ‘দুলালের বাপ, তুমি মুক্তিযুদ্ধে গল্প কওয়া বাদ দাও। নিজের চোক্ষে দেখছো না, এই এলাকার বাড়ি ঘর যারা পোড়াইছে, লুট করছে তারা এখন সরকার দলের নেতা। হ্যারা তোমার কিন্তু মাইর্যা ফ্যালাইবে। একবার খালি ভাবো, তুমি মইর্যা গ্যালে আমাগো কী হবে? ’
তার দু’দিন পরে মুক্তিযোদ্ধা শহীদকে কারা যেন ধরে নিয়ে যায়। লোকজন বলে, রক্ষীবাহিনী আইছিল। বহু কায়দায় শহীদকে উদ্ধার করা হয়। তখন শহীদ বদ্ধ উন্মাদ। তাকে টর্চার সেলে এমন অত্যাচার করা হয়েছে যে, সে স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এলাকাবাসী বলছে- রাজাকাররা এখন সরকার দলে মিশে মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যাচার করাচ্ছে।
ধনঞ্জয় রামযাত্রার পালার আয়োজন করে। কিন্তু পালা হয় না। মাইকিং শোনার পরেই রক্ষীবাহিনীর নির্দেশ এসেছে, প্রাকাশ্যে গান-বাদ্য, গণজমায়েত বন্ধ। সুরবালা দেখে, ধনঞ্জয় কেমন যেন বদলে গেছে। গভীর রাতে একদল কালো পোশাক পড়া মানুষ আসে। তারা টর্চ লাইট মারলেই ধনঞ্জয় দৌড়ে যায়। তারপর তার দোকানে বসে কথা হয়। এরপর তারা চলে যায়। ধনঞ্জয়ের বউ ভয় পায়। সে ধনঞ্জয়কে বলে-‘দুলালের বাপ, মুক্তিযুদ্ধ করছো যে, খালি স্বপ্ন দ্যাকছো, এ্যাহনো দ্যাহ সোমায় আছে তুমি পালায়া যাও। তোমারে ওরা মাইর্যা ফ্যালাবে।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। এতো ঋণ কে শোধ করবে? ধনঞ্জয় হাসে। ‘চুপ বোকা, এরা হইলো গণবাহিনী। গরীব মাইনসের লোক। এই আমার এতো ঋণ দ্যাহস, মহাজনগো সুদ খাওয়া দ্যাহস, জমির আইল দ্যাহস, কিচ্ছু থাকপে না। সব দ্যাশের হয়ে যাবে। তহন আমরা কেমন থাকপো একবার ভাব।’ বিজয়ের হাসি হাসে ধনঞ্জয়। আবার বলে-‘আমাগো খালটা নদী হইয়্যা যাবে। ছোড ছোড মাইয়্যাগো মতো ম্যাঘেরা আইসা নাইয়্যা যাবে। এইডার নাম হবে ধনঞ্জয়ের ঘাট।’
পরদিন দোকানে বসে গান করছিল ধনঞ্জয়। এসময় দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় রাজাকার তাজেল। সে এখন সরকারি বাহিনীর ইনফরমার। ধনঞ্জয় তাকে দেখে শ্লেষের হাসি হাসে, আর জিজ্ঞেস করে-‘কি তাজেল সাব, বিচার শুরু হবে।’ উত্তর আসে-‘কার বিচার? তোমার বিচার?’ এরমধ্যে রক্ষীবাহিনী ঢুকে পরে। যাত্রাশিল্পী ধনঞ্জয়ের দীর্ঘ চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে বাইড়ে আনে। জিজ্ঞেস করে,‘কি করস?’ ধনঞ্জয় উত্তর দেয়- ‘গান গাই আর স্বপ্ন দেহি।’ এরই মধ্যে রাইফেলের বাট দিয়ে শুরু হয় পেটানো। ‘শালা মাদার চোদের বাচ্চা, গণবাহিনী চোদাস? এই দেখ গণবাহিনী কারে কয়।’ বেধড়ক পেটাতে থাকে। সুরবালা একসময় সরকারি বাহিনীর কমান্ডারের পা জড়িয়ে ধরে। কমান্ডার লাথি মেরে ফেলে দেয়। তারপর ধনঞ্জয়কে ধরে নিয়ে যায়। এরমধ্যে কারা যেন তাজেল কে মেরে ফেলে। গ্রামবাসী বলে, কালো পোশাক পড়া একদল মানুষ এসে তাকে ধরে নিয়েগেছে। তার দুইদিন পর মধুমতীর পাড়ের পাওয়া যায় ধনঞ্জয়ের লাশ। লাশ নিয়ে আসা হয়। পোড়াতে কেউ আসে না ভয়ে। রাস্তাঘাট জনশূন্য। আসে ধনঞ্জয়ের রামযাত্রার দল। তারা হরি বলো, হরি বলো বলে চিৎকার দিলে দু-একজন লোক আসে। তারপর শ্মশান জ্বালিয়ে দেয়ার আগে রামযাত্রা দলের পদকর্তা ক্ষেত মজুর আব্দুল ওহাব বলে ওঠে, ‘ওরা জীবনটা তো রামযাত্রা করতে করতে গেল। তোরা একবার লক্ষণের শক্তিশেল পালাটা ধর। তারা শক্তিশেল পালাটা ধরে। গাইতে শুরু করে-
‘প্রাণের ভাই লক্ষণ রে
ওরে তুই মরলে আমি
ভাই বলিব কারে রে
আমার ভাই বুকে আয় রে’ চারদিকে কান্নার রোল ভেসে আসতে থাকে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে মানুষ। তখনো পাগলা শহীদের উচ্চকিত স্বর ভেসে আসতে থাকে- ‘আপনারা যে যেখানে আছেন পালায়া যান, দ্যাশে স্বপ্নচোর আইছে, পালাইয়া যা...ন। পালাইয়া যা...ন।’
লেখক পরিচিতি
দীপংকর গৌতম
কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক। জন্ম: কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। লিখেন দেশ-বিদেশের কাগজে। কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গবেষণাসহ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। তার মধ্যে কাব্যগ্রন্থ মেঘ-বিচ্ছেদ(২০০৩) এবং মেঘ বলি কাকে (২০০৪) নব্বইয়ের কবিতায় বিশেষ নিরীক্ষার দাবি রাখে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। ই-মেইল : dipongker@yahoo.com, +88 01715 816169
সুরবালা দাস। বয়সের চেয়ে বেশি বুড়ো হয়ে গেছে। মাথার সব চুল পেকে গেছে। কতকাল তাতে তেল-জলের ছোঁয়া পড়ে না, তাও জানার আগ্রহ নেই কারো। শরীরের চামড়া ওয়ারগান্ডি শাড়ি সোডার জলে সিদ্ধ করলে যেমন কুঁচকে যায় তেমনি কুঁচকে গেছে। চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে খেলা করে অন্ধকার। ঠিক মতো খেতে পায় না। আচার্য বাড়ির মন্দিরের বারান্দায় শুয়ে থাকে। রাতভর ঘুমায় না। অনেকটা অপ্রকৃতিস্থও। তিন ছেলে, কেউ ঠিক মতো খেতে দেয় না। মাঝে মধ্যে সালিসি বসে- কোন ছেলে কবে তার মাকে খাওয়াবে তা ঠিক করে দেয়। কিন্তু ওই সালিসি পর্যন্তই সব কিছু। তারপরে আর খোঁজ থাকে না কারো। কথায় বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না। সুরবালার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। কোনো ছেলে একবার খেতে দিল, তারপরে আর কেউ খোঁজই রাখলো না। খাওয়া না-খাওয়া নিয়ে সুরবালারও তেমন কোনো টানাপোড়েন নেই। এলাকার অনেকেই বলতো- অনিল আছে, গীতা আছে, ওরা ভারতে লোক পৌছে দিয়ে আসে। পাসপোর্ট-ভিসা কিছুই লাগে না। সুরবালাকে তার মেয়েদের কাছে দিয়ে আসো। মেয়েরা সবাই খুব ভাল আছে। মেয়েরাও চিঠি লেখে মাকে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সুরবালা কখানোই স্বামীর শ্মশান ছেড়ে যাবে না।
এদিকে তার ছেলেদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভাল না। তিন ছেলের মধ্যে ছোটজন ভ্যান চালায়। আর বাকী দু’জন বাবার ব্যবসা ধরে রেখেছে। বাবা ছিলেন লোহার কর্মকার। এজন্য জাত কর্মকাররা তাকে সহ্য করতে পারতো না। কারণ তারা আসলে কর্মকার না। নিচুজাতের, রজক দাস। ‘গৌতম বাড়ি’র ধোপা ছিলেন তারা। এ আবার আরেক ইতিহাস। গৌতমরা যে জমিদারি পেয়েছিল সেই রায়তের নাম ‘গৌতমের আবাদ’। রায়ত পাওয়ার পরে ধোপা নাপিত এসব পেশাজীবীরা জমিদারদের নির্ভর করেই বেঁচে থাকতো। সেই হিসেবে গৌতমদের দীঘির পাড়ে রজক দাসদের জায়গা দেয়া হয়েছিল। ওখানেই তারা থাকে। রজক দাসদের মধ্যে যারা ওখানে গৌতম বাড়ির ‘শাসন’ ধরে রেখেছিল তাদের মধ্যে শ্যাম দাস ও ধনঞ্জয় দাস এই দুইভাই-ই প্রধান। বড় ভাই শ্যাম দাস গুড়ের ব্যবসা করতো। গোপালগঞ্জের সাঁচিয়াদা থেকে গুড় এনে সিকির বাজার, ঘাঘর বাজার, চৌধুরীর হাট, পয়সার হাটে বিক্রি করে চলতে এদের সংসার। সাঁচিয়াদা ছিল এদের গুড়ের মোকাম। কিন্তু এ পর্যন্ত যেতে আসতে যারপরনাই কষ্ট হতো। দুই-তিন দল মিলে এরা নিজেরা নৌকা বেয়ে যেত মোকামে। গোপালগঞ্জ পৌঁছানোর পর গেটের ভেতর দিয়ে নৌকা নিয়ে পৌঁছানো ছিল সবচেয়ে কষ্টের কাজ। এইজন্য ছয়জনে নৌকা বাইলে কষ্ট কম হতো। কিন্তু সমস্যা ঘটতো একখানে। মোকামে যাওয়ার আগের দিন ধনঞ্জয় হাওয়া হয়ে যেত। দিন-রাত বৈঠা টেনে মোকামে যেতে ভালো লাগতো না তার। তার ভালো লাগতো রামযাত্রা করতে। রামযাত্রার দলছিল সিকির বাজারের কাছেই। প্রাইমারি স্কুলে চলতো রিহার্সাল। এখানেই ধনঞ্জয়ের পুন্য ক্ষেত্র। এরচেয়ে প্রিয়কাজ তার কোনোটাই ছিল না। ঘুমের ভেতরেও ধনঞ্জয় চিৎকার করে ডায়লগ বলে ওঠতো-‘ কে তুমি হাসছো? সত্য করে দাও পরিচয়। দেবে না পরিচয়? তুমি যেই হও লঙ্কেশ্বরী রাক্ষসী তুমি। তোমাদের স্বর্ণ লঙ্কা আমি ছাড়খাড় করে দিয়ে চলে যাবো। হাঃ হাঃ হাঃ...
বল? সীতা কোথায় বল? কোথায় অশোক বন? মা সীতা, তুমি কেঁদ না মা। আমাকে যদি বিশ্বাস না হয় এই দেখ আমার হাতে প্রভু রামের পদচিহ্ন। বল মা, কিভাবে উদ্ধারিব তোমায়?’
ধনঞ্জয়ের মন পরে থাকতো এই যাত্রা গানে। শ্যাম দাস ধনঞ্জয়কে একটু সংসার মুখি করার জন্য তাকে ঘটাকরে বিয়ে দেয়। মা মারা যাওয়ার সময় শ্যাম দাসকে বলে গেছেন, পাগল ভাইড্যারে ফ্যালাইস ন্যা শ্যাম। শ্যাম দাস এতোদিন মায়ের কথা শুনে আসলেও ধনঞ্জয়ের বিয়ের পরে তার ছন্নছাড়া জীবনে জন্য কথা শুনতে হতো তার বউকে। প্রতিনিয়ত এই কথা একসময় ঝগড়ায় রূপ নেয়। শ্যাম দাস ও ধনঞ্জয়ের বউয়ের ঝগড়া প্রাত্যহিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর শ্যাম দাসকে একদিন ছোট ভাইকে আলাদা করে দিতে হয়। আলাদা হওয়ার পর শ্যাম দাস তার দুই ছেলেকে নিয়ে গুড়ের ব্যবসা শুরু করে। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। শ্যাম দাসের পেটের ব্যথা দিনদিন বাড়তে থাকে। তার পেটের ডানপাশ থেকে ব্যথাটা ওঠতো। ওঠলে আর হিতাহিত জ্ঞান থাকতো না। এসময় কৌটায় রাখা ‘খাই-সোডা’ কৌটার দুই মুখটি খেলেই ব্যথা পড়ে যেত।
একবার মোকামে যাওয়ার পথে ব্যথা ওঠলে যত সোডা খায় ব্যাথা আর কমে না। পরে তাকে দুই ছেলে গোপালগঞ্জ শহরের সেরা ডাক্তার বিজিতেন বাবুর কাছে নিতে নিতে পথিমধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। শ্যাম দাস মারা যাওয়ায় ধনঞ্জয় বিপদে পড়ে যায়। কারণ রামযাত্রা গাইতে গলেও তাতে শ্যাম দাস যতই রাগ হতো আলাদা হওয়া সত্তে¡ও খাওয়ার সময় ছোট ভাইকে ছাড়া ভাত তার গলা নামতো না। তাছাড়াও বাজার-ঘাট যা কিছু তিনি আনতেন তার অর্ধেকটা ধনঞ্জয়ের বউ সুরবালা ডেকে দিয়ে দিত। কোথাও রামযাত্রা গাইতে গলেও দাদার কথা ভেবে ধনঞ্জয় কোনো চিন্তা করতো না। কিন্তু এখন?
ধনঞ্জয় কর্মকার পাড়ার সুচিত কর্মকারের সঙ্গে ‘সামনের কাজ’ নেয়। সামনের কাজ মানে দোয়াত(বড় হাতুড়ি) দিয়ে লোহা পেটানো। কয়লার আগুনে পোড়া দগদগে ঘায়ের মতো লোহার রঙ হয়ে গেলে তাকে পেটানো হয়। ধনঞ্জয় এই লোহার রঙের মধ্যে দাদার মৃত্যুর পর নিজের হৃদয়টাকে দেখে নিতো। একমায়ের গর্ভে জন্ম নেয়ার যে কত জ্বালা তা আর কেউ না বুঝলেও লোকশিল্পী ধনঞ্জয় বুঝতো। এভাবে কয়লায় লোহা পোড়াতে আর হাঁপরের শিকল টানতে টানতে ধনঞ্জয় কাজ শিখে ফেলে এবং নিজের বাড়ির ওপর একখানা দোকান দেয়।
তাদের বাড়িটা দেখতে খুব সুন্দর। পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রাম একটি রাস্তা। রাস্তার পরেই একটা ছোট খাল। খালে প্রচুর মাছ, কিলবিল করে। ধনঞ্জয়ের কাজ হলো কিছু সময় কর্মকারের কাজ করা, তারপর পথ দিয়ে যারা যায় তাদের ডেকে হুঁক্কা খাওয়ানো ও রামযাত্রার গল্প করা। লোকজন বেশি হলে নিজে সুগ্রীবের ভূমিকায় কিভাবে অভিনয় করেছেন দেখিয়ে দিতেন। কখনো কখনো লক্ষ্মণ শক্তিশেলে আহত হওয়ার পর রামের বিলাপ গেয়ে শোনাতেন-
‘প্রাণের ভাই লক্ষ্মণ রে
ওরে তুই মরলে আমি
ভাই বলিব কারে রে
আমার ভাই বুকে আয় রে’
স্ত্রী রাগ হতো। ছেলেরা বড় হচ্ছে। ঘরে চাল বেশি লাগে, আর সে কাজ ফেলে রাম যাত্রা গায়। একদিন বউয়ের ওপর ভীষণ চটে যায়। হাতের একটা লাঠি পেয়ে সে তেড়ে গেল বউয়ের দিকে। পেটাতে পেটাতে বলতে শুরু করলো-‘চুতমারানি মাগী, রামযাত্রা তোর চোদ্দ পুরুষ শোনছে? শিক্ষা-দীক্ষাহীন মূর্খ কোথাকার, আইজই বিদায় হবি, তোর বাপের বাড়ি যাইয়া থাকপি।’ সুরবালার কান্নায় লোকজন ছুটে আসলেও ধনঞ্জয়কে থামানো খুবই কষ্টকর ব্যাপার ছিল। কাজ না করায় একদিকে যেমন ক্রেতারা দাও-কাচি নিতে এসে ভীড় করতো, অন্যদিকে পাওনাদাররা আসতো টাকা নিতে। তবু তার রামযাত্রা থামতো না।
এইভাবে চলে আসে ঊনিশ একাত্তর সাল। ধনঞ্জয় দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি রেডিও শুনতো আর লোকজনকে ডাকতো। প্রথমে লোকজন ভয় পেলেও পরবর্তীতে তার দোকান ঘরে খবর শোনা মানুষের মেলা বসতো। পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী যখন আক্রমণ করে এলাকার রাজাকাররা ধনঞ্জয়ের বাড়িটা পুড়িয়ে লুটকরে পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে খুশি করে। তাজেল, মান্নান, জুম্মন এরা ছিল রাজাকার। এরাই সব বাড়িতে আগুন দেয়। ধনঞ্জয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। কমান্ডার কমলেশের ইনফর্মার ছিল সে। তার কথায়ই কমলেশ অনেক রাজারকে ধরে ফেলেছিল। এরমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হলে অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে ধনঞ্জয় আবার দোকানে বসে। এবারে হলো মুক্তিযুদ্ধের গল্পের পালা। এইসব গল্পশুরু করলে তার বউ মাঝে মধ্যে বলতো- ‘দুলালের বাপ, তুমি মুক্তিযুদ্ধে গল্প কওয়া বাদ দাও। নিজের চোক্ষে দেখছো না, এই এলাকার বাড়ি ঘর যারা পোড়াইছে, লুট করছে তারা এখন সরকার দলের নেতা। হ্যারা তোমার কিন্তু মাইর্যা ফ্যালাইবে। একবার খালি ভাবো, তুমি মইর্যা গ্যালে আমাগো কী হবে? ’
তার দু’দিন পরে মুক্তিযোদ্ধা শহীদকে কারা যেন ধরে নিয়ে যায়। লোকজন বলে, রক্ষীবাহিনী আইছিল। বহু কায়দায় শহীদকে উদ্ধার করা হয়। তখন শহীদ বদ্ধ উন্মাদ। তাকে টর্চার সেলে এমন অত্যাচার করা হয়েছে যে, সে স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এলাকাবাসী বলছে- রাজাকাররা এখন সরকার দলে মিশে মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যাচার করাচ্ছে।
ধনঞ্জয় রামযাত্রার পালার আয়োজন করে। কিন্তু পালা হয় না। মাইকিং শোনার পরেই রক্ষীবাহিনীর নির্দেশ এসেছে, প্রাকাশ্যে গান-বাদ্য, গণজমায়েত বন্ধ। সুরবালা দেখে, ধনঞ্জয় কেমন যেন বদলে গেছে। গভীর রাতে একদল কালো পোশাক পড়া মানুষ আসে। তারা টর্চ লাইট মারলেই ধনঞ্জয় দৌড়ে যায়। তারপর তার দোকানে বসে কথা হয়। এরপর তারা চলে যায়। ধনঞ্জয়ের বউ ভয় পায়। সে ধনঞ্জয়কে বলে-‘দুলালের বাপ, মুক্তিযুদ্ধ করছো যে, খালি স্বপ্ন দ্যাকছো, এ্যাহনো দ্যাহ সোমায় আছে তুমি পালায়া যাও। তোমারে ওরা মাইর্যা ফ্যালাবে।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। এতো ঋণ কে শোধ করবে? ধনঞ্জয় হাসে। ‘চুপ বোকা, এরা হইলো গণবাহিনী। গরীব মাইনসের লোক। এই আমার এতো ঋণ দ্যাহস, মহাজনগো সুদ খাওয়া দ্যাহস, জমির আইল দ্যাহস, কিচ্ছু থাকপে না। সব দ্যাশের হয়ে যাবে। তহন আমরা কেমন থাকপো একবার ভাব।’ বিজয়ের হাসি হাসে ধনঞ্জয়। আবার বলে-‘আমাগো খালটা নদী হইয়্যা যাবে। ছোড ছোড মাইয়্যাগো মতো ম্যাঘেরা আইসা নাইয়্যা যাবে। এইডার নাম হবে ধনঞ্জয়ের ঘাট।’
পরদিন দোকানে বসে গান করছিল ধনঞ্জয়। এসময় দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় রাজাকার তাজেল। সে এখন সরকারি বাহিনীর ইনফরমার। ধনঞ্জয় তাকে দেখে শ্লেষের হাসি হাসে, আর জিজ্ঞেস করে-‘কি তাজেল সাব, বিচার শুরু হবে।’ উত্তর আসে-‘কার বিচার? তোমার বিচার?’ এরমধ্যে রক্ষীবাহিনী ঢুকে পরে। যাত্রাশিল্পী ধনঞ্জয়ের দীর্ঘ চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে বাইড়ে আনে। জিজ্ঞেস করে,‘কি করস?’ ধনঞ্জয় উত্তর দেয়- ‘গান গাই আর স্বপ্ন দেহি।’ এরই মধ্যে রাইফেলের বাট দিয়ে শুরু হয় পেটানো। ‘শালা মাদার চোদের বাচ্চা, গণবাহিনী চোদাস? এই দেখ গণবাহিনী কারে কয়।’ বেধড়ক পেটাতে থাকে। সুরবালা একসময় সরকারি বাহিনীর কমান্ডারের পা জড়িয়ে ধরে। কমান্ডার লাথি মেরে ফেলে দেয়। তারপর ধনঞ্জয়কে ধরে নিয়ে যায়। এরমধ্যে কারা যেন তাজেল কে মেরে ফেলে। গ্রামবাসী বলে, কালো পোশাক পড়া একদল মানুষ এসে তাকে ধরে নিয়েগেছে। তার দুইদিন পর মধুমতীর পাড়ের পাওয়া যায় ধনঞ্জয়ের লাশ। লাশ নিয়ে আসা হয়। পোড়াতে কেউ আসে না ভয়ে। রাস্তাঘাট জনশূন্য। আসে ধনঞ্জয়ের রামযাত্রার দল। তারা হরি বলো, হরি বলো বলে চিৎকার দিলে দু-একজন লোক আসে। তারপর শ্মশান জ্বালিয়ে দেয়ার আগে রামযাত্রা দলের পদকর্তা ক্ষেত মজুর আব্দুল ওহাব বলে ওঠে, ‘ওরা জীবনটা তো রামযাত্রা করতে করতে গেল। তোরা একবার লক্ষণের শক্তিশেল পালাটা ধর। তারা শক্তিশেল পালাটা ধরে। গাইতে শুরু করে-
‘প্রাণের ভাই লক্ষণ রে
ওরে তুই মরলে আমি
ভাই বলিব কারে রে
আমার ভাই বুকে আয় রে’ চারদিকে কান্নার রোল ভেসে আসতে থাকে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে মানুষ। তখনো পাগলা শহীদের উচ্চকিত স্বর ভেসে আসতে থাকে- ‘আপনারা যে যেখানে আছেন পালায়া যান, দ্যাশে স্বপ্নচোর আইছে, পালাইয়া যা...ন। পালাইয়া যা...ন।’
লেখক পরিচিতি
দীপংকর গৌতম
কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক। জন্ম: কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। লিখেন দেশ-বিদেশের কাগজে। কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গবেষণাসহ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। তার মধ্যে কাব্যগ্রন্থ মেঘ-বিচ্ছেদ(২০০৩) এবং মেঘ বলি কাকে (২০০৪) নব্বইয়ের কবিতায় বিশেষ নিরীক্ষার দাবি রাখে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। ই-মেইল : dipongker@yahoo.com, +88 01715 816169
0 মন্তব্যসমূহ