পুকুরশোভা গ্রামের মুখে যে পাকুড়গাছ, তা পেরুলে অনতিদূরে সার-সার সুপারি বিরিক্ষ। আর ওই সারবাধা বিরিক্ষের দিকে নয়ন তুলে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রয়েছে ফকরের ঘরখানা।
তা ঘরের মতো ঘরই বেধেছে ফকরে। ঘরামির নিপুণ হাতের পরশে আলো-হাওয়াতে উদর পুরে যেন ভরাট গতর নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে!
এই ঘর ছাওয়ার কাজে ফকরে ওস্তাদ লোক বটে। ঘরামির কাজে যত সে দক্ষ হয়েছে, ততই তার নিজের আসল নামটা একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেছে।
ফকরে ঘরামির নামটা যে কোনোদিন ফখরুদ্দিন আরজ আলি তরফদার ছিল পুকরশোভার কারোইর আজ তা আর স্মরণ নাই। তার বাপের দেওয়া দীর্ঘ নামটা হ্রস্ব হতে হতে এখন ফকর, ফখর এবং ইয়ার দোস্তদের কাছে শুধু ফকরে। নিপুণ ঘরামি হিসাবে ফকরের যত নামকডাক, তা এ তল্লাটে আর কারো ছিল না। কিন্তু আসল ঘটনা ঘটলো রুসমতিকে নিকাহ করে আনার পর। রুসমতির উজালা রূপের কাছে ফকরে তো ফকরে-- ফকরের কাজকর্মও কেমন যেন পানসে হয়ে উঠল! ফকরের অবস্থা এখন এমন-- ফটফটা জোছনার নিচে যেন সে এতটুকুন জুনিপোকা।
রুসমতির রূপের রোশনাই চারপাশে যত ছড়িয়েছে ফকরে ততই গুটিয়ে গেছে। যেন বা খোলসে থাকা শুঁয়াপোকা। আলো-হাওয়ার ভীতিতে যে বাইরে বেরুতে নারাজ। তবে ফকরের এই গুটিয়ে যাওয়া আড়াল-আবডালেই রয়ে গেল। কারণ স্ত্রীলোকের রূপের রোশনাইয়ে মশগুল থাকা লোকজন অন্যের ভালমন্দের দিকে দৃষ্টি দেবে কখন? এই দুনিয়াদারি আজব চিড়িয়াখানা বটে। রূপের ফান্দে আটকে পড়া লোকজন অন্যের গুণপনাতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে এমন ভাবাটাও অবান্তর। ফলে শুয়াপোকা হয়ে ওঠা ফকরে খোরস বন্দী হয়ে বৃক্ষের ডালে লটকে রইল। এতে পুকুর শোভার মানুষজনের তেমন এলো-গেল না।! শুঁয়াপোকা কি জুনিপোকা-- ফকরেকে যেভাবেই আখ্যা দেয়া হোক না কেন-- তাতে তার ঘরামিপনায় সামান্যতম হেরফেরও ঘটে নাই!
বাদলার মরশুম আসার আগে-ভাগে যথারীতি ফকরের ডাক পড়েছে। ডাক পড়েছে পুকুরশোভা ছাড়িয়ে জলশোভা বা তরুশোভার সর্বত্র।
ডাকের সাথে ফকরের নিষ্ঠাও বেড়েছে। ঘরামির কাজে তার একেবারেই ফাঁকিঝুকি নাই! অবশ্য তা থাকলেই বা চলবে কেন? পেটের মধ্যে দিবানিশি যে খিদার উনান জ্বলে তার আগুন নেভানোর জন্য তো রুটি চাই। আর রুটির যোগান দিতে হলে রুজি চাই। রুটি আর রুজি নিয়ে ব্যস্ত থাকা ফকরে কিন্তু ভেতরে ভেতরে একেবারে বাসীচুলার অনুরূপ। যাতে আগুন নাই-উত্তাপ নাই- খালি ছাই আর শীতলতা! এর কারণ ইয়ার দোস্তদের কাছে বাতুন নাই। ফকরের ইয়ার দোস্তরা ঠিকই জেনেছে রুসমতির রূপ যত উজালা, স্বভাব ততটাই কুঁদলে। রূপবতী রুসমতির মেজারের এতটাই তলক যে, একটা চড়াইও বাঁশঝাঁড়ে একদ- জিয়াতে পারে না। পুচ্ছ উঁচিয়ে বসতে না বসতেই রুসমতির বাজখাই কণ্ঠস্বরে উড়ে পালাতে বাধ্য হয়।
রুসমতির এই গোপন স্বভাবের কথাতো সকলের জানার কথা না। ফলে ফকরে যখন ধারালো কাচির ফ্যাসে খড় কেটে কেটে স্তুপ করে তখন তালালমিয়া অথবা ঘটু, খয়েরমিয়া অথবা রহমত হয়তো বলে ওঠে--ফকরেমিয়া একখান বিবি তুমি আনছ নিকাহ কইরা-- কপাল বটে তুমার-- যারে কয় আজ কপাইল্যা।’
এইসব কথা শুনে কাচির ফ্যাস-ঘ্যাচ করে বসে যায় ফকরের আঙুলে। আর দরদর করে রক্ত পড়তে থাকে। খয়েরমিয়া তখন ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে বলে-আরে মিয়া করলা কি? করলা কি? নিজের বিবির খুবসুরতির কথা কুইন্যা আঙ্গুলই কাইট্যা ফেলাইতেছ দেখতেছি!
আর তালালমিয়া দাঁত কেলিয়ে গান ধরে--
সে ঘরের ভিটা তুমি ভিটার খুঁটি আমি
পিরীতেরই ছাউনি বেড়া আছে ঘিরিয়া...
ফকরের মনে হয় এতক্ষণে কাচির ফ্যাসটা তার গলায় বসে গেলে ঢের স্বস্তির হতো। ফকরে ম্যালাক্ষণ পরে তৎপর হয়ে ওঠে-- কারো দুয়ার থেকে বা বাইরবাড়ি থেকে দূর্বাঘাস তুলে এনে দাঁতের নিচে পিষতে থাকে। পিষতে পিষতে বহুকাল আগে শোনা একটা ঠোল্লোক মনে পড়ে, বউয়ের পেডে হাপ ঢুকছে-- কইবারও নাই, সইবারও নাই!
ফকরে কি করে কাউকে আসল কথা বলবে-- বউয়ের চাঁদমুখ দেখে যারা অজ্ঞানভাব হয়ে আছে তাদের কাছে? ওই চাঁদমুখের মুখ ঝামটার তলক অন্যকে বুঝানোর সাধ্য ফকরের নাই।
দূর্বাঘাসের প্রলেপ ভাল করে লাগানোর পরও রক্তপাত বন্ধ হয় না। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। আর নিমিষে মাটির রঙের সঙ্গে মিলে যায়। ফকরে সেদিকে তাকিয়ে ভাবে--দেখছুনি মাটির মইদ্যে কোনো কিছুর দাগ টের পাওন যায়না-- তেমুনই মাইনষের খোমা-- সেইহানে কোনোকিছুর দাগ লাইগ্যা থাহে না। আল্লারে কি যরনতনায় মাইষে পড়ত-- যুদি কেউ কারোর মনডা দেখতে পাইত।
এ রকম ভাবতে ভাবতেই ফকরে ঘরের পর ঘর ছাইতে থাকে। শন দিয়ে অথবা খড় দিয়ে। রোদে পুড়ে পুড়ে তার শরীর আরো কুচকুচে কালো হয়ে ওঠে!
ফকরের কালোকিষ্টি গায়ের রঙ দেখে রুসমতি ঘেন্নায় নাক সিটকিয়ে দূরে সরে যায়। যেতে যেতে কথার হুলে কফরেকে ঘায়েল করে দেয়--ইরে মারে! মিনসের গতরের রূপ যেন ছলকাইয়া পড়ে! এমুন জন্মের কালারে বাপ! কালা কারে কয়-- য্যান চুলার বাসি আংরা।
বলেই ভাতের সানকি ফকরের সামনে ঠেলে দেয়। ফকরের পেটে তখন দোযখের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে। শুধু পেটে নয় মনেও তার আগুনের কু-। ভাতে হাত দেওয়র আগে পুনরায় সে পূর্বের ভাবনায় ঢুকে পড়ে--যুদি মন কেউ দেখতে পাইত! যদি কোনো পরকারে মনের কথা খোমাতে পরকাশ্তি-- তাইলে জগত এক্করে বিরান অইয়া যাইত!
ইয়ার দোস্তদের বলা ‘আজকপালি’ শব্দটা যেন ভাতে সানকির ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে! সত্য সত্যই হয়তো কোনোদিন সে রাজা হবে। নইলে দোস্তরা কেন তাকে ‘আজ কপালি’ বলে?
কিন্তু রাজা যে কিসে হয়? কিভাবে হয়-- সে পথ তো আর জানা নাই! তবুও দোস্তরা তাকে বলে ‘আজকপালি!’ সেও নিজেকে তাই ভেবেই সুখে থাকতে চায়।
ভাতের গ্রাস মুখে তোলার পর তার পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে। ফকরের মনে হয় এক্ষুনি সে বমি করে ফেলবে!
--এমুন বে-মজাদার রান্ধন!
ফকরের ইচ্ছা করে চিৎকার দিয়ে বলতে--তোর আতের রসুই এমুনই বেস্বাদ!
কিন্তু বলা হয় না। তার আগেই রুসমতির রুক্ষ্ম কথা ভাতের সানকিতে আছড়ে পড়ে--
--ভাত সামনে থুইয়া কুন জমিদারির ভাবনা ভাববার নাগছ? খাইয়া-দুইয়া উদ্ধার কর আমারে।
ফকরে চমকে তাকিয়ে দেখে দুয়ারের আমগাছের ডালটা জোরে নড়ে ওঠে। আর একটা বড়সড় দাঁড়কাক কা-কা রবে উড়ে যায়!
০২
ফরিদা বেওয়ার কুঁড়েঘরখানা পড়ো পড়ো হয়ে উঠেছে গেল বর্ষাতেই। জায়গায় জায়গায় খড় খসে গিয়ে বাঁশের কংকাল বেরিয়ে পড়েছে। জোরে হাওয়া বইলে হুসহুসিয়ে তা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। আচানক হাওয়ার স্পর্শে ফরিদা বেওয়া কুঁকড়ে ওঠে। আতংকিত মনে এদিক সেদিক তাকায়-- মনসা দেবী কি ভুল করে তার ঘরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেল! এই ভয়ে-ভাবনায় সারারাত তার অঘুমা কাটে। তবে রাত ফর্সা হয়ে গেলে তেমন ভয়ডর তাকে আর আক্রান্ত করে না! কারণ তরুশোভার দশঘর লোকের সকলেই তাকে চেনে-জানে। মান্যি-গণ্যি না করলেও সামনে পড়লে সালাম-আদাব দেয়। ফরিদার সোয়ামি আবুল কুদ্দুস জীবিত থাকাকালীন তরুণশোভার লোকেরা তাকে তেমন চিনত না। ঘরের বউ-ঝিরা তো পদ্দা-পুর্শিদাভাবেই থাকে। তবে আজুল কদ্দুস মারা যাওয়ার পর ফরিদাকেই সংসারের হাল ধরতে হলো। ফলে কাজ-কর্মেও তাকে বেরুতে হলো। আর তখুনি কিনা ফরিদা বেওয়ার চেহারা-সুরত স্পষ্ট হলো সকলের কাছে। আল্লাহর বান্দাকে নিন্দানো গুনাহর কাজ-- কিন্তু উপায় কি? ফরিদা বেওয়ার চেহারা তো চেহারা নয়-- যেন দোযখের পেত্নিকালো-কিষ্টি গায়ের রঙ। মাড়ি-বার-করা আতার-বিচির মতো দাঁতের সারি। ওই মুখের দিকে তাকালে ভয়ে-ভাবনায়-ঘেন্নায় আপনা আপনিই চোখ বুঁজে আসে। চোখ বুঁজে তরুশোভার লোকেরা নতুন ধন্দে পড়ে--এমুন দোযখের পেত্মির লগে আব্দুল কুদ্দুস কেমনে যে সংসারে বাইচ্যা ছিল।
আবুল কুদ্দুস কি মরে নিস্তার পেয়েছে? তরুশোভার লোকেরা অবশ্য এ নিয়ে কথা বাড়ায় না। থাকুক না, বিধবা মানুষটা গ্রামের এক কোণায় পড়ে থাকুক। বিধবা মানুষের দিলে চোট দিয়ে গুনাহর ভাগীদার কেই বা হতে চায়? ফলে ফরিদা বেওয়া তরুশোভার এক কোণায় প্রায় নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করতে থাকে।
গেলবার বর্ষায় টানা পনের দিনের বৃষ্টি-বাদলায় চালের খড়গুলো একেবারে পচে নেতিয়ে গেল। কি করা। বর্ষা বিদায় হয়ে শীত আসার পরই ফরিদা বেওয়া দুশ্চিন্তায় একশেষ।
--ঘরখানা এইবার ছাইতেই অইব। না ছাইলে ঘরে থাকনই দায় অইয়া পড়ব।
ফকরে ঘরামির নিপুণ কাজের কথা সে পূর্বেই বহুবার শুনেছিল। ফলে ফকরে ছাড়া আর কার উপরই বা সে ভরসা করে? ফকরে কে সে দিনের পর দিন খবর পাঠায়-- কিন্তু ফকরের পাত্তা নাই। ফরিদা বেওয়া ফের একে-তাকে ধরে খবর পাঠায়। কিন্তু ফকরে দূরে থাক, তার ছায়ার দেখাও পাওয়া যায় না।
ইয়ার বন্ধুদের কাছেও এই খবর আর গোপন থাকে না। তারা বেশ চাপের ভেতরই ফকরেকে ঠেলে দেয়-ফকরে-- তুই কি হাছাই হাজা অইয়া গেলি নাকি?
ফকরে প্রতি উত্তর করে না। ইয়ার বন্ধুরা ফের ঠেসে ধরে-ফকরে তোর কি আর ট্যাকাকড়ির দরকার নাই? কামের ডাক পাইছস তাও কিনা চুপ মাইর্যা এদিক-ওদিক করতাছস? বেওয়া কি তোরে মাগনা কাম করাইব নাহি? হুনছি বিধবার নাহি ট্যাকার কমতি নাই।
ফকরে তামাকে টান দেয় আর চুপ মেরে থাকে। হুক্কার ধোয়া বলকে বেশি পরিমাণে গলায় ঢুকে পড়লে বেদম কাশে। কাশতে কাশতে দম ছেড়ে বেওয়ার ডাকে সাড়া না দেওয়ার কারণ খোলাসা করে।
--হুনছি বেওয়া নাকি দোযখের পেত্নি। হের গতরের রঙডা চুলার বাসী আংরার লাহান। হের কামে আমি কেমতে যাই? হের কামে গেলে কি আমার আত-পাও চলব? চলব না।
ফকরের কথা শুনে ইয়ার বন্ধুরা হো হো করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে--বেটা তুই সত্যিই আজা। বেজায় খুব সুরত বউ-পাইছস-- বউয়ের রূপের এমনই ভাঁপ-তাপ যে তুই কিনা বদসুরত মাইয়া নুকের কামও করতে চাস না?
ফকরে তখনো চোখ মুঁদে তামাক টেনে চলে। তার মনের কথা দোস্তরা কিছুতেই টের পায় না। তবে তার ভাবসাবে দোস্তরা ঈর্ষান্বিত বোধ করে--ব্যাটা বউয়ের রূপে ধরারে সরা জ্ঞান করতেছে।
ফরিদা বেওয়া ফকরের আশায় সেই যে ছিপ ফেলে বসে আছে তো আছেই। ফকরের দেখা নাই। ফরিদা বেওয়াও হাল ছাড়ার পাত্র না। ফলে বারংবার সে খবর পাঠায়। এবং যথারীতি ফকরে আসেনা।
ফরিদা বেওয়া তখন বেশ ভজঘটের ভেতরে পড়ে যায। উপায়ন্তহীন একদিন সে নিজেই পুকুরশোভার উদ্দেশ্যে রুওয়ানা দেয়। সূর্য তখন তার দুই-চারটা পালক সবেমাত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। হিমের মরশুম বলে আলো সামান্য ঘোলা ও তেজহীন। ফরিদা বেওয়া পুকুরশোভায় পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য তার সমস্ত পালকই ছড়িয়ে দেয়। ছড়িয়ে দিয়ে মস্তপানা ঈগলের মতো আসমানের গতরে ভেসে আছে।
সূর্যের এইরূপ ভাসন্ত অবস্থার মাঝেই ফরিদা বেওয়ার নজরে পড়ে ফকরের ঘরখানা। টলটলা দিঘির জলে যেন কোনো ভাসমান রাজহাঁস। মনে মনে তারিফ না করে পারে না সে। সেইসঙ্গে সামান্য ইর্ষান্বিতও বোধ করে। শালার ফকরে-- এতবার খবর দেওয়া সত্ত্বেও তুই কিনা আমার ঘরখানা ছাইয়া দিলি না।
এদিক-ওদিক উঁকি মেরেও ফরিদা বেওয়া কাউকে দেখতে পায় না। মনে মনে ভাবে--কপালডাই আইজকা মন্দ! ফকরে দেহি ঘরে নাই! হের কি ঘরনীও নাই। কেহই নাই?
হঠাৎ বাজখাই কণ্ঠস্বরে সে চমকে তাকায় রুসমতি তার সম্মুখে দাঁড়ানো। কোমরে কষে কাপড় প্যাঁচানো। মাথার চুল চূঁড়া করে খোঁপা করা। পেত্নিরূপ ফরিদা বেওয়াকে দেখে তবদা মেরে গেলেও কণ্ঠ তার অচল হয় না। বরং আগ্রহ ভরে জানতে চায়--কিডা আফনে? আফনে কিডা?
এই রকম চাঁচাছোলা কথাবার্তায় ফরিদা বেওয়া অপ্রস্তুত হলেও মিইয়ে যাওযা অবস্থায় নয়। ফলে সে কোমলের চাইতেও কোমলতর কণ্ঠে বলে--ফকরে ঘরামি কি বাইত নাই?
--ক্যান? আফনের কিয়ের দরকার হেরে?
--দরকার বইল্যাই না অতদূর আইছি।
ফকরে তো সকলের দরকার ঘর বানানোর কাজে। রুসমতি মনে মনে বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। অর্থকড়ির সন্ধান পেলে কারই বা মন্দ লাগে? রুসমতি সাধ্যমত চেষ্টা চালায় গলায় নরমভাব আনার। কিন্তু খসখসে কণ্ঠ তার চেষ্টাকে বাতিল করে দেয়। তবুও সে ফের চেষ্টা করে বলে--হেয় তো ঘরে নাই। জলশোভার মৌলবিগো ঘর ছাওনের কামে গেছে।
--অ। আমিও হেই কামের লাইগ্যাই আইছি। আমার ঘরডা এক্করে ঝুরঝুরা হইয়া গেছে গা।
--কইথন আইছুন আফনে?
--তরুশোভা থিকা। আমি ফরিদা।
রুসমতির মনে পড়ে যায় এর আগে নামটা সে অনেকবার শুনেছে।
যতবার তার সুন্দর চেহারার কথা কেউ বলেছে, ততবারই ফরিদার কুশ্রী চেহারাও সে ইয়াদ করেছে। রুসমতি ফের জোর করে তার কাঠ কণ্ঠ খাঁদে নামায়। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে--ঘরামি আইলে কমুনে আফনে আইছুন।
--আইচ্ছা, আমি তাইলে যাইগা। এট্ট মনে কইরা কইয়ুন ভাবি।
ফরিদা বেওয়া রুসমতিকে ভাবি ডাকছে কেন? মনে মনে বেজায় ক্ষেপে গিয়ে রুসমতি ভাবে--ভাবি! বেবুদ্দা মাগী, আমি তোর কোন জন্মের ভাবি রে! শ্যাওড়া গাছের পেত্নি ভরদুপুরে আইছে মাথায় বাজ ফেলাইতে।
কিন্তু মনের কথাগুলো গিলে ফেলে সে ফের বলে--ঠিকাছে কইয়ুম নে। কইয়ুম নে। ভাইবেন না। ঘরামি আফনের বাড়িত যাইয়া ঘর ছাইয়া দিয়া আইবনে।
০৩.
পুকুরশোভার শীত এই কয়দিন যেন ফিকে হয়ে উঠেছে। তার দাঁতে কয়দিন আগের সেই জোর আর নাই।
ফলে কিছুতেই ত্বক কামড়ে ধরে কাউকে আর বেকায়দায় ফেলতে পারছে না।
উত্তুরে হাওয়া এসে ধীরে ধীরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার আস্তরণ। ফরিদা বেওয়া ভাল করে তাকিয়ে দেখে বৃক্ষদের ডারে-ডালে কুশিপাতার ছড়াছড়ি।
দেখে সে যেন সামান্য কেঁপে ওঠে। হয়তো তার মনে পড়ে যায় আর কয়দিন বাদেই কুহু ডাক ভেসে আসবে। আর বোলের আধিক্যে আমপাতারা ক্রমে মলিন হয়ে উঠবে।
ফরিদা বেওয়ার সামনে হঠাৎ ছায়ার মতো যে মানুষ এসে দাঁড়ায়--সে ফকরে ঘরামি। রুসমতির তাগাদার ঠেলায় রহিম-রহমের নাম নিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছিল তরুশোভার উদ্দেশ্যে। অবশ্য না বেরিয়ে উপায়ও ছিল না। কাজ ফেলে ঘরে বসে থাকা রুসমতির দুই চক্ষের বিষ। ফলে ফকরে কে বেরুতেই হয়েছে।
এক্ষণে দোযখের পেত্নিরএকেবারে সম্মুখে ফকরে। কিন্তু কোনোভাবেই সে ওই বদসুরত দেখবে না-- এই পণ নিয়ে সে ‘জয় বিশকরম’ বলে কুঁড়ের মাচায় উঠে পড়ে। ভালো মতো পরখ করে কোথায় কতোটা খড় লাগবে? কোনখানে আড়ায় ঘুন ধরেছে? ফকরে কিছুতেই ফরিদা বেওয়ার দিকে তাকায় না। সে জানে তাকালেই তার কাজে দ পড়বে। বিন্তু বিধিবাম! দোযখের পেত্নিটা কিনা চাঁচতলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কালোকিষ্টি চেহারা আর মাড়ি-বার-করা আতার-বিচির মতো দাঁত বের করে খানিক পরই বলে--ঘরামিভাই-- আগে আইস্যা নাস্তাপানি আর তামুক খ্যায়া নেও।
ফকরের মনে হয় কাচির ফ্যাস ফের তার আঙুলে বসে যাবে। কারণ ফরিদার কণ্ঠ যেন মধুতে মাখামাখি! তখুনি তার কানে রুসমতির কণ্ঠস্বর ঢুকে পড়ে। কই-- রুসমতির কাছ থিক্যা তো সে এমুন আদরমাখা ডাক পায় নাই। এমন ভাবতে ভাবতেই সে মটকা থেকে নেমে পড়ে। নেমে একেবারে ভিমরি খাওয়ার অবস্থায় পড়ে। দাওয়াতে খেজুর পাটি পেতে রাখা। তাতে পরিপাটি করে রাখা এক বাসন মুড়ি, আলুচচ্চড়ি, কাঁচা পেঁয়াজের টুকরা, চারটে তাজা কাঁচামরিচ আর এক ঢিমা পাটালি। পাশে রাখা এক বদনা পানি। এমনকি মরে-যাওয়া মরদের হুকো-কলকে সাফসুতরো করে সেঁজে রেখেছে তামাকু! আহা! কেমুন সৌষ্ঠবের কাজ! ফরিদা বেওয়া ধারে-কাছে কোথাও নাই। খাবার সাজিয়ে পালিয়ে গেছে!
ফকরে ভয়ানক ধান্দায় পড়ে যায়--
এই যে আব্রু, খাবার সাজিয়ে আড়ারে থাকা, এই সেবা-যত্ন, নরম করে ডাকা-- এইসব কি জন্মে দেখেছে সে?
ধান্দার ভেতর গোত্তা খেতে খেতেই সে মুড়ি আর পাটালি খেতে শুরু করে। তামাকু টেনে ফুরফুরে মেজাজে চাল ছাইতে লেগে যায়। ঘরের কারিকুরিতে মজে গেলে গান তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়--
কুদরত কামিনী সাঁই কুদরত কামিনী
মায়ের হহংকারে আল্লাগনি সাঁই গুণমনি
একদিন পিতা হয়েছিল মা বরকতের কুল
মায়ের দুই কানে দুই মতি ছিল মাথায় ছিল ফুল।
মায়ের অঙ্গে ছিল চন্দ্র সূর্য গালাতে নবী তিনি।
সুরের ফাঁকে ফাঁকে নানা কথা তার কানে যেন নতুন সুর হয়ে বাজে--
--মিয়াসাব পানির তেষ্টা পাইছে নি?
--ও মিয়া তামাকুর নেশা কি খুব নিহি?
--আমার মরা মিনসে তো ঘড়ি ঘড়ি তামাকু খাইত।
--এক্করে টাটকা পানি টিপকল টিপ্যা আনছি খ্যায়া লও।
গান গাইতে সুর ভেসে যাচ্ছিল হাওয়ার টানে। আর গানের কথা যাচ্ছিল প্যাঁচগোচ খেয়ে। ঘটনা কি? তেমন কিছু না।
ফরিদা বেওয়ার পাকসাকের সুঘ্রাণ তার উদরে খিদার জানান দিচ্ছিল। রুসমতির রসুই? মাবুদ আল্লা! এমুন বেমজাদার রান্না। ফকরে এক রকম চক্ষু মুদেই মুখে তোলে। রসুই তো রসুই-- রুসমতির স্বভাবের নোংরামি আর নাপাকির তুলনা কি ত্রিভুবনে আছে? তাছাড়া তার মেজারের কড়া তলকে চড়াই-কাক-চিল সবই উড়ে পালায়। ফকরে তো কোন ছার?
ফরিদা বেওয়া ফকরের হাতে ধোয়া লুঙ্গি আর গামছা ধরিয়ে দিয়ে বলে--যাও মিয়া নদীত ডুব পাইরা আইস্যা চাইট্টে ভাত খাও অভাগিনীর দুয়ারে।
ফকরে যেন আপনা-আপনিই দোযখের পেত্নির দিকে চোখ তুলে তাকায়।
আহা! কি শীতল আর মায়ালি তার চক্ষু জোড়া! চুলার বাসী আংরার মতো গায়ের বরণ-- সবুজ কচুপাতার মতো নয়ন জুড়ানো। তাতে বুদ্ধির ঝিলিক-- সেই কচুপাতার উপর বুঝি সকালের রোদ পাখনা ছড়িয়ে দিয়েছে। নাকটাও বোঁচা কিন্তু তাতেও তাকে খাঁদা মনে হয় না। মাথা ভরতি কালো চুল-- বিনুনি হয়ে পাছার নিচে পড়েছে। ফরিদার কালো কুচকুচে হাতে বাঁশের নলিতে সরিষার তেল-- ফকরে যাতে গোসল করে গতরে মাখতে পারে।
ফকরে কি এমুন তোয়াজ এ জীবনে আর কোথাও পেয়েছে? ভেবে তার চক্ষু জলে ভরে ওঠে। চোখের জল মুছতে মুছতে সে নদীর দিকে হাঁটা মারে।
নদীতে ডুব পেরে এসে ফকরের চক্ষু চড়কগাছ-- এতকিছু কখন রান্না করল দোযখের পেত্নি।
ঢেঁপা শাক, মরলা মাছের চচ্চরি ধনে পাতায় মাখামাখি, মুর্গার লাল ঝোলের গোস, চালের রুটি, গরম গরম ভাত আর পুদিনার চাটনি। খেতে খেতে ফকরের দুই চোখে ঘুম এসে ঢুকে। আহা! এমুন খাওয়ার পরে ঘুম না দিলে কেমনে কি? খাওয়ার পর নারকোরের চারখানা সন্দেশ তার হতে পড়ে। সেই সঙ্গে সাজা পান আর তামাকু।
দাওয়ায় পাতা খেজুর পাটিতে ফকরে যে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও বুঝতে পারে না। যখন ঘুম ভাঙে তার তখন বিকেলের রোদ্দুর ম্লান হয়ে উঠেছে।
ফরিদার ঘরের কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা ঢলে যায।
এইবার পুকুরশোভায় ফিরে যাবে ফকরে। ফরিদার হাতের সাজা তামাকুতে ফকরে শেষ গুঁড়গুঁড়ি তোলে। তামাকুর আগে আগে নারকোলের মিষ্টি চিঁড়া আর এক গ্লাস চা! ফকরে যেন ঘোরের ভেতর খাবি খায়। দোযখের পেত্নিরদেখি গুনপনার শ্যাষ নাই। এইসব দেখে দেখে ফকরের হঠাৎ মায়ের আবছা মুখটা মনে পড়ে। খুব ছোটকালে তার মা মরেছে। মায়ের ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্নেহ-মায়া ফরিদা বেওয়া যেন তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে!
৫০০ টাকা কোচে গুঁজে সে যখন পুকুরশোভার পথে নামে রাত্তির তখন গাঢ় হয়ে উঠেছে। ঝিঁঝিরা বিশ্রি শব্দে ডেকে চলেছে। ফকরে উতলা মন নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে।
তরুশোভার যে ঘরটা আজ সে ছেয়ে দিল তা যদি তার নিজের ঘর হতো! আহা! কতই না ভাগ্যবান হতো সে। যেন সত্যিকারের আজা।
এই দোযখের পেত্নিরসঙ্গে বাদবাকী জীবনটা কেটে গেলে ফকরে খুব সুখী হতো। ওই গাঢ় মমতায়, আদরে,যত্নে, মজাদার অন্নে আর প্রেমে-- ফকরের জীবন কানায় কানায় পূর্ণ হতে পারতো।
কিন্তু উপায় নাই, সে উপায় তার আর নাই! পুকুরশোভার সুন্দরী-ডাইনীর সংসারে সে বাধা। ফলে তাকে ফিরতে হচ্ছে-- ফিরতে হয়-- ফিরতে হবে-- এই মনকষ্টে নাকি দুঃখে নাকি ভাবনায়-- কিংবা হতে পারে ফরিদা বেওয়ার সবুজ কচুপাতার মতো শরীরটা ফেলে যাওয়ার বেদনায়-- ফকরে বড় বেশি কাতর হয়। বড় বেশি আক্রান্ত হয়। ফলে তার চোখ দিয়ে অশ্রু জল হয়ে গড়িয়ে নামে। নামে, নামতেই থাকে...!
লেখক পরিচিতি
পাপড়ি রহমান
গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন। বিভিন্ন গবেষণা কর্মের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। গল্পগ্রন্থ: লখিন্দরের অদৃষ্টযাত্রা, হলুদ মেয়ের সীমান্ত, অষ্টরম্ভা, ধূলিচিত্রিত দৃশ্যাবলি। উপন্যাস: পোড়ানদীর স্বপ্নপুরাণ, বয়ন, মহুয়াপাখির পালক। সম্পাদনা: ধূলিচিত্র। জীবনীগ্রন্থ: ভাষাশহীদ আবুল বরকত।
1 মন্তব্যসমূহ
ekgheye bornona. . .plot valo chilo. . .aro jotno niye likhle valo hoto
উত্তরমুছুন