হয়তো আগেও সমস্যাটা ছিল সুপ্ত অবস্থায়, কিন্তু জিনাত বেগম এখন তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন।
বিশেষ করে আগের দিন শাকিলার বাসা থেকে ফিরে আসার পর থেকে।
ফলাফল গতরাতের পুরোটাই কাটলো নির্ঘুম অবস্থায়।
পরদিন সকালে উঠলো মাইগ্রেনের ব্যথা।
অনিদ্রা আর মাইগ্রেন - একেবারে কান আর মাথা।
একটা টানলে আরেকটা সুরসুর করে এগিয়ে আসে।
সেই সাথে শুরু হবে আরও কিছু যন্ত্রণাদায়ক উপসর্গ।
যেমন, খাবারের অরুচি, বমি বমি ভাব।
বেলা বারটা বাজে, এরই মধ্যে তিনবার বমি করা হয়ে গেছে।
বাসায় এসেছে নতুন কাজের মানুষ।
মধ্যবয়সী মহিলা।
জিনাতের খাবারের অরুচি আর বমি করা দেখে সেই মহিলা একটা ছোট্ট প্লেটে একটু তেঁতুলের আঁচার এনে সামনে রেখে বললেন, 'নেন খালাম্মা খান।
এই সময় এরকম হয়।'
এতক্ষণ জিনাতের মেজাজটা ঠাণ্ডা ছিল।
এবার সেটাও গেল তেতে।
'আপনি আমাকে খালাম্মা করে ডাকছেন,' বয়সে বড় হলে সাধারণত জিনাত তাকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করে থাকে, অবশ্য বাসায় কাজ করতে আসা মহিলাদের বয়স বুঝবার জো নেই - অনেকের তো চল্লিশের মধ্যেই মেনোপজ হয়ে যায়, 'আমি যদি আপনার খালাম্মার বয়সী হই তবে আমার কি আর সেই সময় আছে?'
আরও কিছুক্ষণ গজগজ করে জিনাত শোবার ঘরে চলে আসলো।
আয়নার সামনে দাঁড়াল।
সুবর্ণা মুস্তফা, শম্পা রেজা তার থেকে বয়সে কত বড়।
তারপরও এরা বুড়ি হয় না।
আর এই চৌচল্লিশ বছর বয়সে জিনাত হয়ে গেছে খালাম্মাদের মতো দেখতে।
একটু মুখ উঁচু করলো।
থুতনীর নিচে আরেকটা থুতনি।
ওজনের চাপে।
এখন দেখে আর বোঝার উপায় নেই যে কোন একসময় তার এই খাঁজ কাটা থুতনীর কতো প্রশংসা ছিল।
কতো ছেলে এর প্রেমে পড়েছিল! একসময়ের সুন্দরী জিনাত এখন অতীত।
বয়সের থেকেও দোষটা আসলে মেদের।
নইলে মাধুরি দিক্ষিতের কেন আর বয়স বাড়ে না? মাইগ্রেনের ব্যথাটা আবার বাড়লো বলে।
জিনাত বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।
এই ঘরের দেয়াল জুরে তাদের স্বামী-স্ত্রীর বাঁধানো অনেক ছবি আছে।
চোখজোড়া স্থির হয়ে রইলো একটা ছবির উপর।
গতবছর তোলা।
স্বামী তার থেকে চার বছরের বড়।
অথচ ছবিতে দেখলে মনে হয় স্বামীর থেকে জিনাতের বয়স অন্তঃত অর্ধ-যুগ বেশি।
এই এক অদ্ভুত রহস্য! জিনাত নিয়মিত পার্লারে যায়।
ফেসিয়াল, ম্যানিকিউর, প্যাডিকিউর করে।
অথচ করিম, জিনাতের স্বামী, এসব কিছু না করেই বয়স ধরে রেখেছে।
এই সপ্তাহ থেকে জিনাত করিমের মাথায় মেহেদি দেওয়া বন্ধ করবে।
আগামি মাস থেকে করিমকে দাড়ি রাখতে বলবে।
তাতে যদি সমস্যাটা একটু কমে।
নইলে জিনাতের দুশ্চিন্তা এতটুকুও কমবে না।
মাইগ্রেনের আক্রমণ থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে না।
সমস্যাটার কথা বলতে গেলে অনেকেই হাসবে।
গুরুত্ব দিতে চাইবে না।
আজকাল মানুষের অনুভূতিগুলো এতো ভোঁতা হয়ে গেছে যে বিপদ সম্পর্কে আগাম সাবধান হওয়ার কথা কেউ ভাবে না।
মহিলারা একসাথে হলে কার কী আছে সেটা নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে বেশি।
কার কী নেই বা সাধারণ সমস্যাগুলো নিয়ে কেউ কোন টু শব্দটি করে না।
ভাবখানা এমন যেন সবাই এক-একেকটা রূপকথার গল্পের মধ্যে বাস করছে।
অথচ জিনাতকে আজকে যা ভাবাচ্ছে কালকে তো অন্য আরেকজনও তা নিয়ে চিন্তিত হবে।
শাকিলা তো বলেছে কমবেশি সবাই এই সমস্যায় ভোগে।
মিড লাইফ ক্রাইসিস।
এমন না যে করিম ইতিমধ্যে কোন সমস্যা শুরু করে দিয়েছে।
সমস্যার কোন আগাম লক্ষণও টের পাওয়া যাচ্ছে না।
তাতে কি হয়েছে? বলা যায় না ভেতরে ভেতরে কি নট-ঘট চলছে।
হিমবাহের কতটুকু আমরা দেখি? মাত্র একভাগ।
বাকী ৯৯ ভাগই পানির নিচে লুকিয়ে থাকে।
সাবধানের মার নেই।
জিনাতের মতো বুদ্ধিমতি মহিলারা আগে থেকে সতর্ক থাকে।
আর এই অতিরিক্ত সতর্কতার ফল হলো নির্ঘুম রাত, মাইগ্রেনের ব্যথা, বারকয়েক বমি । আর বাসার সাংসারিক কর্মচারি মনে করে বুড়ি বয়সে বেগম সাহেবা বোধহয় আবার গর্ভবতী হয়ে পড়েছে।
আচ্ছা, আগেরদিন শাকিলাদের বাসায় না গেলে কি এই দুশ্চিন্তা এড়ানো যেত? অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না।
প্রলয় সম্পর্কে জেনেছে, এখন সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
শাকিলাকে একটা ধন্যবাদ দিতে হয়।
একটা দিন আগেও জিনাত জানতো না যে দিন কে দিন উচ্চহারে ছেলেধরার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে আতংকের বিষয় হলো এই ছেলেধরা সেই ছেলেধরা নয়।
বাচ্চাদেরকে এরা ধরে না।
ধরে বাচ্চাদের বাপদের।
অফিস পাড়ায় নাকি প্রায়শই অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েদের সেজেগুজে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়।
এদের কেউ কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে সেক্রেটারির চাকরি বাগিয়ে নেয়।
তারপর শুরু হয় এদের ছেলেধরা প্রকল্প।
খুব সাবধানে এরা ঝোপ বুঝে কোপ মারে।
প্রথম লক্ষ্য থাকে অফিসের বড় সাহেব।
সেটি যদি সম্ভব না হয় তাহলে পরবর্তী টার্গেট অফিসের অন্য যে কোন মধ্যবয়স্ক অফিসার।
মধ্যবয়সটা হলো নিভে যাওয়ার আগে দপ করে জ্বলে উঠার মতো।
অবশ্য কেউ কেউ আছে অনির্বাণ, আবার কেউ কেউ পার্মানেন্ট-নির্বাণ।
মোদ্দা কথা হলো নির্বাণের আগে অনির্বাণ হওয়ার শেষ চেষ্টা হিসেবে অনেকেই ছেলেধরার ফাঁদে পা দেয়।
লুকিয়ে লুকিয়ে স্ত্রীর অজান্তে অল্পবয়সী মেয়েদের সাথে প্রেম করা শুরু করে।
তারপর তা বিয়ে পররয্ন্ত গড়ায়।
বেচারা প্রথম স্ত্রীর তখন দুয়োরাণি অবস্থা।
শেষ পররয্ন্ত তারা বনবাসী হয়।
এরকম ঘটনা নাকি এখন আর নাটক-সিনেমার কাহিনী নয়।
অহরহই হচ্ছে।
আঙ্গুল গুনে বলার মতো অবস্থায় নেই।
এমনকি পরিচিত মানুষজনদের মধ্যেই এখন এরকম ঘটনা ঘটার কথা শোনা যাচ্ছে।
জিনাত বললো, 'শাকিলা তোমার তো কোন সমস্যা নেই।
ভাই হজ করে এসেছেন।
দাড়ি রাখতে শুরু করছেন।
এখন তো আর অন্য মেয়ের দিকে তাকাবে না।'
'কে বলছে তোমাকে? হাসান ভাইয়ের কথা শুন নাই?'
এরপর শাকিলার কাছ থেকে হাসান ভাই আর বিথী ভাবির কথা শুনে তো জিনাত একেবারে তাজ্জব বনে গেল।
এর আগে অবশ্য রাইয়ান ভাই আর জুলি ভাবির কথা শুনেছিল।
তখন মনে হয়েছিল ওদের এমনটা হতেই পারে।
রাইয়ান ভাই আর জুলি ভাবি আল্ট্রা মর্ডান দম্পত্তি।
পার্টিতে অন্য মানুষের সাথে নাচানাচি করে।
মাঝে মধ্যে ড্রিংক্স করে।
কিন্তু হাসান ভাইয়ের মতো পরহেজগার মানুষ এমনটা কি ভাবে করতে পারলো? বীথি ভাবিও মাটির মানুষ।
কারও সাথে-প্যাচে নেই।
সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
আরেকটা শখ অবশ্য বীথির আছে তা হলো রান্না করা।
ওদের বাসায় দাওয়াত করলে কমপক্ষে দশ রকমের মিষ্টি বানাবে সে।
এখন সেই বিথী ভাবি মিষ্টি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে।
হাসান ভাই হঠাৎ করেই একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে।
সেই মেয়ের সাথে আবার উনার পরিচয় হয়েছিল মসজিদেই।
হাইফাই-লোফাই, ধার্মিক-অধার্মিক - কোনভাবেই এই মিডলাইফ ক্রাইসিসকে বাগে আনা সম্ভব নয়।
এই বিপদ যদি এখন জিনাতের ঘাড়ে উঠে পড়ে তাহলে তার কী হবে? সে কোথায় যাবে? ছেলেমেয়েরা দুদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শুরু করবে।
কেলেংকারির কথা না হয় বাদই দিল, একসাথে কতগুলো মানুষের ভবিষৎ অন্ধকার।
'শাকিলা তুমি তো আমাকে খুব চিন্তার মধ্যে ফেলে দিলে।
আমার কিন্তু লক্ষণ খুব একটা সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না।'
'কি রকম?'
'গত সপ্তাহে বোনের বাসায় যেতে চাইলাম।
বর বলে "তুমি যাও, আমি আজকে মাথায় মেহেদি দিব"।'
'হুম।'
'তারপর ইদানিং খুব এক্সেসাইজ করা শুরু করছে।
বলে ভূড়ি নাকি খুব বড় হয়ে গেছে।'
'করিম ভাই তো এমনিতেই খুব ফিট।
তার উপর আবার এক্সারসাইজ শুরু করছে?'
'নাটক দেখতে বসলে লোকে নাটক কে লিখছে, কে পরিচালনা করেছে এসব আগে দেখে।
আর ওকে দেখি নাটক শুরু হবার আগেই বলে নায়িকে কে, কেমন দেখতে, সুন্দরী কিনা, অল্পবয়সী কিনা।'
'চিন্তার বিষয়।
চোখে চোখে রাখ।
আমি তো দেখি অল্পবয়সের থেকে মধ্যবয়সই বেশি বিপদজনক।
এদেরকে এখন ছাড়া গরুর মতো ছেড়ে দিতে নাই।'
জিনাতের মাইগ্রেনের ব্যাথাটা এমনি এমনিই বাড়ে নাই।
টেলিভিশনে নাটক চলছে।
খাইরুল করিম বসে বসে নাটক দেখছেন।
জিনাত স্বামীর পাশে এসে বসল।
যা ভেবেছিল তাই।
নাটকের নায়িকা একজন অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে।
এইসব ন্যাকা ন্যাকা নায়িকাদেরকে জিনাতের কাছে অসহ্য লাগে।
বাংলা ভাষাটা র্পযন্ত যে সুন্দর করে বলতে পারে না সে হয়ে যায় নাটকের নায়িকা।
অল্প বয়স হয়েছে তো কি হয়েছে, এদের মুখমণ্ডল থেকে পার্লারের পলেস্তরা সরিয়ে নিলেই আসল চেহারা বের হয়ে যাবে।
আর নাটকের কাহিনীরও কোন আগামাথা নেই।
এই সব ন্যাকাদের চিচি ঝিঝিতে কান ঝালাপালা।
মনোযোগ দিয়ে করিম তাই গ্রোগাসে গিলছে।
সহজে চোখের পলক পরছে না।
অথচ জিনাত যদি করিমকে কিছু দেখতে পরামর্শ দেয় তা তখন কানে নিবে না।
'গৃহসন্ত্রাস' নামে একটা সুন্দর নাটক হচ্ছিল, এর প্রধান অভিনেত্রী জলি মল্লিক। জিনাত বসে বসে তা দেখছিল।
অথচ পাশ থেকে করিম উঠে চলে গেল।
বলে যে মধ্যবয়সী অভিনেত্রীদের নাটক তার ঠিক পোষায় না।
হায় ভবিতব্য! বয়স বাড়ার সাথে সাথে তো অভিজ্ঞতাও বাড়ে।
জিনাত বুঝে গেছে রাজ্য নিজের কব্জায় রাখতে হলে জানতে হবে রাজনীতি।
যুদ্ধ দিয়ে সব এখন জয় করা যায় না।
রাজনীতির ম্যারপ্যাচ কষতে হলে দরকার প্রতিপক্ষের মনের খবর।
জিনাত স্বামীর পাশে বসল।
খাপছাড়া গল্পহীন নাটক আর তার ন্যাকা নায়িকাকে কিছুক্ষণ সহ্য করল।
করিম একনিষ্ট মনে নাটক দেখছে।
বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট খেলা দেখার মতো।
জিনাতকে কিছুক্ষণ পর বললেন, 'দেখ, মেয়েটা খুব সুন্দর অভিনয় করছে।
অনেকদূর যাবে।'
করিমের রুচির এই দৈন্যতা জিনাতকে খুব কষ্ট দিল।
অবশ্য কোন এক অজানা কারণে অধিকাংশ স্বামী প্রজাতিদের তেমন একটা উন্নত রুচি-টুচি থাকে না।
বরং স্ত্রী প্রজাতি তাদের ভেতর সুরুচি তৈরির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই যেমন এখন টিভিতে যেই মেয়ের চেহারা দেখে করিম পটে গেছে, কিছুদিন আগেই তার সম্পর্কে একটা গুজব বেড়িয়েছিল।
মেয়েটি নাকি এক মধ্যবয়সী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে তার তিন নম্বর বৌ হয়েছে।
জিনাত এই খবরটা স্বামীকে দিল,
'এইসব মেয়েরা কিছুদিন অভিনয় করার পর বুঝে যায় বেশিদূর যেতে পারবে না।
তখন দোজবরে কারুর গলায় ঝুলে পড়ে।'
'ভাল তো।
খারাপ কি?'
'খারাপ কী মানে? আরেকজনের ঘরভাংগা ভাল কথা?'
'এক হাতে কি তালি বাজে? দু'পক্ষই ঠিকঠাক করে রাখতে না জানলে ঘর তো ভাংগবেই।'
জিনাত ভাবল এই তো সুযোগ।
এবার স্বামীর মনের খবর বের করে নেওয়া যাক।
সে করিমের পাশে আরেকটু সরে আসল।
নাটকের এই নায়িকাটার মতো ন্যাকা ন্যাকা আদুরে কণ্ঠস্বরে জানতে চাইল, 'আচ্ছা স্বামীরা কেন আরেকটা বিয়ে করে?'
টেলিভিশনের দিকে পূর্ণ মনোযোগ রেখেই করিম নিস্পৃহভাবে উত্তর দিল, 'বউরা খালি জ্বালায় বলে।'
আর যায় কোথায়! তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো জিনাত।
'কই আমি তোমাকে কবে জ্বালালাম? আরামে থাক তো, তাই বউয়ের মূল্য বোঝ না।
অফিস থেকে এসে তো খালি বাবু সাহেবের মতো টিভির সামনে বসে থাক।
আর আমি তো কাজের বুয়া।
সাহেবের যখন দরকার হবে তখন চা, ঝালমুড়ি, রাতের খাবার সরবরাহ করব।'
'এইটা এতো পারসনালি নিচ্ছ কেন? আমি কি বলেছি যে তুমি জ্বালাও?'
'মনের কথা তো বের গেছে।
সারাদিন আমি খেটে মরি সেসব কিছু না।
বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে তো একটা রেডিমেট সংসারে প্রবেশ কর।
একটা গোছানো সংসার কি এমনি এমনিই তৈরি হয়?'
'দেখ একটা ফুলটাইম জব করে মাত্র একটু রিলাক্স করতে বসলাম।
তুমি সংসারটা গুছিয়ে রেখেছ ভাল কথা।
কিন্তু তোমার মতো তো আর আমি দিনের বেলা "ঘর ঘর কা কাহানি" দেখার সুযোগ পাই না।
এখন যদি তুমি এরকম অকারণে চিল্লাচিল্লি কর তো কেমন লাগে?'
'কি, আমি অকারণে চিল্লাচিল্লি করি? আর তুমি সাধু? অকৃতজ্ঞ কোথাকার? চলে যাব তোমার এই সংসার ছেড়ে।
তখন কতো আরামে থাক দেখা যাবে?'
অবস্থা বেগতিক দেখে করিম একটু ব্রেক কষে ধরল, 'আহা তুমি রাগছো কেন? আমি তো দুষ্টামি করলাম।
আমি তো জানি তুমি ছাড়া আমি অচল'
জিনাতের রাগ হচ্ছে বালিময় মরুভূমি।
সূর্য উথলেই তেতে উঠে।
সূর্য নাই তো কনকনে ঠাণ্ডা।
করিম তার সরল বৌএর মনটা খুব ভালই বোঝে।
করিমের এই এক কথাটেই জিনাতের রাগ ঝিমিয়ে পড়লো।
সে বলল, 'দুষ্টামি না ছাই।
মনের কথা গোপন থাকে না।'
অবশ্য রাতের বেলা জিনাতের নিজের উপরই বেশ রাগ হলো।
সুন্দর সুযোগটা হেলায় হারাল সে।
স্বামীর মনের কথা আর বের করা গেল না।
পরেরবার খুব সতর্ক থাকতে হবে।
কিছুতেই রেগে যাওয়া যাবে না।
কথায় বলে না রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
স্বামীকে সাথে করে জিনাত গিয়েছে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে।
দু'জনে বসেছে পাশাপাশি।
দেশের এক বিত্তশালী লোকের মেয়ের বিয়ে।
অনুষ্ঠান হচ্ছে র্যাডিশন হোটেলে।
এখানে সব অভিজাত মহিলাদের আধিক্য।
বৈদ্যুতিক আলোর থেকেও তাদের শাড়ি-গয়না বেশি দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
জিনাত তার টেবিলে বসা অন্যদেরকে তেমন চিনতে পারছে না।
সবাই তার অপরিচিত।
তাই পাশে বসা স্বামীর সাথেই গল্প করতে লাগল।
উদ্দেশ্য ছাই দিয়ে মাছ ধরা।
ওদের সামনে দিয়ে একটি মেয়ে হেটে চলে গেল।
অল্পবয়সী।
বেশ সুন্দরী।
স্বামীর কানের পাশে মুখ এগিয়ে জিনাত জিজ্ঞেস করল, 'আচ্ছা এখনও তো তোমাদের মেয়ে দেখলে একটু প্রেম প্রেম বোধ জাগে? তাই না?'
'এখনই বলছো কি? এটাই তো প্রেমের আসল বয়স।
অল্পবয়সে প্রেমের আর কি বুঝতাম? সুন্দরী মেয়ে দেখলে প্রেম জাগবে না কেন? এমনটা না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক।'
'প্রেম জাগলে কি ইচ্ছা করে?'
'আমাকে জিজ্ঞেস করে তো লাভ নেই।
আমি অসাধারণ মানুষ।
যারা সাধারণ মানুষ তাদের জিজ্ঞেস করো।'
'তুমি অসাধারণ?'
'হ্যাঁ, তা তো বটেই।'
'তাহলে সাধারণ মানুষ কারা? একটা উদাহরণ দাও।'
'এই যেমন আমাদের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এরশাদ।'
'এরশাদ সাধারণ মানুষ আর তুমি অসাধারণ মানুষ?'
'হ্যাঁ।'
'কিভাবে?'
'অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ে দেখলে যা ইচ্ছা করে উনি তা করে ফেলছেন।
আর আমার সেই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা আমি করি না, তাই।'
ও, তো মনে মনে এতোদূর।
শাকিলা তাহলে ঠিকই ধরেছে।
স্বামিদের বিশ্বাস করতে নেই।
জিনাত এখন কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না।
ছাই দিয়ে মাছ ধরা তো হলো, এখন তা কতল করতে হবে।
তার আগে আরও কিছু পরীক্ষা চলুক।
এবার এক্জন মহিলা সামনে দিয়ে চলে গেলেন।
ইনিও বেশ সুন্দরী।
জিনাত স্বামীকে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলেন, 'দেখো ঐ মহিলাকে।
কী সুন্দরী! এই মুহূর্তে ঐ মহিলাকে দেখে কেমন লাগলো?'
'সুন্দর কোথায় মোটা।'
জিনাত বেগম মুখ ফুলিয়ে ফেললেন।
'তারমানে মোটা বলে আমাকেও তুমি কুসিৎ ভাব?'
'আরে না।
পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র সুন্দরী যাকে মোটা হলেও দেখতে ভালো লাগে।'
জিনাত পাশে ফিরনীর বাটিটা সরিয়ে রেখেছিল।
এবার সেটা সামনে এনে খেতে লাগলেন।
বর পাশ থেকে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, 'দেখো, আবার বেশি মিষ্টি খেও না।
বহুমূত্র রোগে ধরে বসবে।'
'মূত্র-ফূত্র কি সব বাজে কথা বলো? তোমাকে আর কালচারড বানাতে পারলাম না।'
'তুমি তো ইংলিস মিডিয়ামে পড়ো নাই।
বাংলায় এতো কাঁচা কেন?'
'কী বলতে চাও তুমি? মূত্র মানে কি তা আমি জানি না?'
'তা হয়তো জান।
কিন্তু বহুমূত্রের মানে জান না।'
'এর মানে কী?'
'ডায়াবেটিকস?'
জিনাত স্বামীর দিকে কড়মড় করে তাকালেন
কয়েক মাস পর সত্যি সত্যিই জিনাত বেগমের বহুমূত্র রোগ ধরা পড়লো।
আর সাথে সাথেই জিনাতের চিন্তাভাবনার ভারকেন্দ্র সরে গেল।
শুধু শুধুই এতোদিন বরের পেছনে গোয়ান্দাগিরিতে সময় নষ্ট করেছে।
এখন যদি নিজে মরেই যায় তাহলে বর এমনিতেই তো আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে, তখন পেত্নী হয়ে তো আর বরের ঘাড়ে চড়ে বসা যাবে না।
সমস্যা যেখানে জীবনমরণের সেখানে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েরা আর কোন আতংক তৈরি করতে পারে না।
এতোদিন মাইগ্রেনের যন্ত্রণা ছিল।
তা সজজেই মেনে নেওয়া যেত।
কারণ মাইগ্রেন নামটার মধ্যে একটা অভিজাত ব্যাপার আছে।
শুধু নামটা নয়, অসুখটাও বেশ রাজকীয়।
জ্ঞাণী-গুণী ব্যাক্তিদের মাইগ্রেন হয়।
কিন্তু বহুমূত্র শুনতে কেমন লাগে? লোকে মনে করবে মহিলা বেশ পেটুক।
একসময় এমন মিষ্টি খেয়েছে যে এখন ডায়াবেটিকস বাধিয়ে ফেলেছে।
ইতিমধ্যে বান্ধবীরা ফোন করে তাদের সমব্যাথার কথা জানাতে শুরু করে দিয়েছে।
তারা সমব্যাথী না কচু! মনে মনে সবাই খুশী।
জিনাতের ফর্সা গায়ের রং নিয়ে ওরা কী জ্বলাতংকে ভূগতো না? মনিরা তো বলেই বসলো, ডায়াবেটিকস হয় যাদের তিনটা 'এফ' থাকেঃ ফিমেল, ফ্যাট এবং ফেয়ার।
এই কালো মেয়েটা সুযোগ পেয়ে কী রকম খোঁচা দিয়ে দিল।
কিন্তু সব ছাড়িয়ে জিনাতকে ধরে বসলো আতংক।
মরে যাবার ভয়।
সে এই পৃথিবী থেকে এতো সহজে চলে যেতে চায় না।
তার ছেলেমেয়েদের এখনও মায়ের দরকার আছে।
জিনাতের এখন জীবন-মরণের সমস্যা।
কে কী বললো, কে কী করলো - এসবকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো অবস্থায় আর সে নেই।
এখন জিনাতের একটাই পণ।
আর তা হলো সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
শুরু হলো জিনাতের সংগ্রাম।
প্রথমেই একজন ডায়াটিশিয়ানের সাথে কথা বলে একটা খাবারের চার্ট তৈরি করে নিল।
মেপে খাওয়া আর হাটা।
এখন আর আগের মতো দুপুরে ভাত-ঘুমের সময়টাতে সে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসে না।
সেই সাথে ঘর মোছার কাজটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে।
জীবনটা একেবারে আস্টেপৃস্টে নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলা।
বান্ধবীদের আবার এতোটা পছন্দ হচ্ছিল।
তারা সময়-অসময় একটু-আধটু খোঁচা দিতে ভুলে না।
জিনাত পুরনো বান্ধবীদের পাশ কাটিয়ে নতুন মানুষজনের সাথে সখ্য গড়ে তুলল।
এরা সবাই তার ওয়াকিং ক্লাবের সদস্য।
দুই সপ্তাহ পর পর সবাই একটা দিনের জন্য মিলিত হয়।
কে কতোটা হাটলো, কী ব্যায়াম করলো তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করে।
এতে জিনাতের হাঁটার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়।
ছয় মাস পরেই হাতে-নাতে ফল পেল।
জিনাতের ত্রিশ পাউন্ড ওজন কমে গেল।
সেই সাথে ডায়াবেটিকসও উধাও।
ওজন কমার সাথে সাথে এখন আর আগের মতো রাতে ঘুমের সমস্যা হয় না।
এই ছয় মাসে একবারের জন্যও জিনাতের মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠেনি।
তবে সবচেয়ে যে পরিবর্তনটা চোখে পরে তা হলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেনা যায় না।
মনে হয় আগের থেকে দশ বছর কমে গেছে।
পুরনো ব্লাউজ সব এখন ঢোলঢোলা।
নতুন করে আবার এক ডজন ব্লাউজের অর্ডার দিতে হলো।
মেয়েকে সাথে নিয়ে দোকানে গেলে তাদের দুজনকে লোকে বোন বলে ভুল করে।
শুধু ওজন কমলেই মানুষ সুন্দর হয়ে যায় না।
তাতে থাকতে হয় আত্মবিশ্বাসের শক্তি।
এই ব্যাপারটা জিনাত খুব ভাল্ভাবেই অনুভব করে।
তার জীবনে একসময়ের ভাললাগা বিষয়গুলো আবার নতুন করে ফিরে এসেছে।
এই যেমন বাগান করা, বই পড়া, কবিতা লেখা।
জিনাত এখন একটা বুক ক্লাবের সদস্য।
এই ক্লাবের উদ্যোগে এখন প্রায়ই স্বরচিত কবিতা পাঠের আয়োজন হয়।
অবশ্য প্রতিটি ক্রিয়ারই একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।
জিনাতের জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে সাইড ইফেক্ট হিসেবে যোগ হয়েছে করিমের টিপ্পনী।
'আগে দেখতাম বড়লোকের বৌরা এসব করে।
এখন তো দেখি তুমিই তাদের মতো আচরণ করছো।'
'কি করবো বলো? স্বামী বড়লোক হলে এমনটা না হয়ে উপায় আছে?'জিনাতের রসবোধ বেড়ে গেছে।
স্বামীর সাথে পাল্লা দিয়ে টিপ্পনী কাটেন।
করিম অবাক হয়।
সেই সাথে অভিযোগ করতে শুরু করে জিনাত এখন তাকে আর সময় দেয় না।
এই এক নতুন উপসর্গ।
জিনাত চায় করিম তার অল্পবয়সী নায়িকাদের নাটক দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকুক।
আর অন্যদিকে করিম চায় জিনাতের সময়।
অবস্থা বেগতিক দেখে জিনাত একটি সমঝোতার পথ খুঁজে বের করে।
ঠিক করেছে রাতের খাবারের পরে এখন থেকে তারা দুজন মিলে হাটতে বেরুবে।
একদিন দু'জনে হাটতে বেড়িয়েছে।
তাদের দেখে এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসলেন।
করিমের দিকে না তাকিয়েই জিনাতের পথ আটকে ধরলেন।
আর জিনাতও ভদ্রলোকের সাথে হেসে হেসে গল্প করতে শুরু করে দিল।
করিমের কথা তার মনেও থাকলো না।
বেচারা করিম আর কি করে।
কিছুদূর গিয়ে স্ত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল।
অনেকক্ষণ পর জিনাতের কথা শেষ হলো।
এগিয়ে এসে করিমের সাথে যোগ দিল।
'এতোক্ষণে তোমার কথা শেষ হলো?' করিমের কন্ঠস্বরে রীতিমতো উত্তাপ।
'কি করবো? আমি তো পাশ কাটিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
ভদ্রলোক না ছাড়লে কি করবো?'
'দেখতে তো মনে হয় লাফাংগা টাইপের লোক।
কোন চাকরি-বাকরি করে না।'
'ঠিকই বলছো।
কোন চাকরি-বাকরি করে না।
মানে করার দরকার হয়না।
নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা আছে।
সেসবও লোকজন দিয়ে চালায়।
নিজে শুধু প্রকাশনার ব্যবসাটা দেখে।
আমাদের বুক ক্লাবের একজন বড় ডোনার।'
'বৌ কোথায়?'
'বৌ মারা গেছেন।
ভদ্রলোন এখন বৌ খুঁজছেন?'
'এতোক্ষন তোমার সাথে কী কথা বলল?'
করিমের জ্বলাতংক দেখে জিনাত বেশ মজা পেল।
একটা সময় জিনাতও কী এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায়নি? বল এখন ওর কোর্টে।
খেলাটা জমাবার জন্য খুব জোরসে বলটা ফেরাতে হবে।
'ভদ্রলোক বললেন, "আপনি দেখতে খুব সুন্দর।
আপনাকে আমার খুব ভাললাগে।"'
করিম খুব গম্ভীর হয়ে গেল।
পথে আর একটা কথাও বলল না।
জিনাত অতো দুশ্চিন্তা করলো না।
রাতের বেলা বরের মান ভাংগিয়ে দিতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
সেই সাথে পরদিন সকালবেলা শাকিলাকে ফোন করতে হবে।
জানাতে হবে তার আবিষ্কৃত নতুন তড়িকা।
ছেলে-ধরা থেকে রক্ষা পাবার জন্য নিজেকে আর কাক-তাড়ুয়া বানিয়ে রাখার দরকার নেই।
লেখক পরিচিতি
ওয়াহিদা নূর আফজা
লেখক পরিচিতি
ওয়াহিদা নূর আফজা
জন্ম সালঃ ৩০শে জানুয়ারি
জন্মস্থানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ
বর্তমান আবাসস্থলঃ ফ্রীমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া.
পেশাঃ তড়িৎ প্রকৌশলী
প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ : কিন্নরকণ্ঠী নদী, বিতংস, ঘরট্ট
প্রাপ্ত পুরস্কার: কথাসাহিত্যে কালি ও কলম পুরষ্কার'২০১৩
http://www.cadetcollegeblog.com/author/noorafzaইমেইল-ঠিকানা দেবেনঃ wahidaafza@gmail.com
জন্মস্থানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ
বর্তমান আবাসস্থলঃ ফ্রীমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া.
পেশাঃ তড়িৎ প্রকৌশলী
প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ : কিন্নরকণ্ঠী নদী, বিতংস, ঘরট্ট
প্রাপ্ত পুরস্কার: কথাসাহিত্যে কালি ও কলম পুরষ্কার'২০১৩
http://www.cadetcollegeblog.com/author/noorafzaইমেইল-ঠিকানা দেবেনঃ wahidaafza@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ