শ্রাবণী দাশগুপ্ত এর গল্প আবাস


(১)
চুপিচুপি ফ্ল্যাটটা কিনেই ফেলল সুগত, লোন নিয়ে প্রায় মেরু পরিবর্তন কোলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ অনেকদিন ধরেই সতর্কবার্তা দিচ্ছিল পিয়ালি মেয়ে বড় হচ্ছে ঐশীর ক্লাস নাইন ওদের পাড়াটা ক্রমে বিশ্রী হয়ে উঠছে কিছুদিন আগে হামাগুড়ি দেওয়া ছোকরাগুলো আজকাল চুলে রঙ লাগিয়ে হিরো পিয়ালি বলেছিল,
--ফ্ল্যাটই ভাল, একটু ছোটতেও অসুবিধে নেই শুধু একটা ভদ্র পরিচ্ছন্ন পাড়া চাই, ব্যাস


সাতচল্লিশের ভাগ-বাঁটোয়ারার তালেগোলে এই বাড়ি সুগতর উদ্বাস্তু ঠাকুরদা আব্রু বাঁচাতে শস্তায় কিনেছিলেন ধনী মুসলমান ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিশালাকৃতি মেগালিথ্‌স্মৃতিপীঠ সুগত বলে তাদের আর মেজকার ঘর ছাড়া বাকি সব সারসার তালাবন্ধ, অনেকদিন ধরেই স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ির বাইরের দেওয়ালে বারবার গজিয়ে ওঠে অশত্থের চারা সুগতর বিরক্ত লাগে, লোক ডেকে কাটিয়েও ফেলে দুই জ্যাঠা ও ছোটকাকা গত হয়েছেন অনেকদিন, তার মা-ও বাবার জন্যে এবাড়ি সে ছাড়তে পারেনি এতদিন তিনিও সুগতকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দিয়ে গেছেন বছর দেড়েক হল তুতো-ভাইবোনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকেই কোলকাতার বাইরে যোগাযোগের সুতোটাও ফেঁসেফেঁসে গেছে মেজকাকা অবিবাহিত


সুগতর নোতুন ফ্ল্যাট আলোয় মাখামাখি ভদ্র সভ্য সুস্থ পরিবেশ, অন্তত বাহ্যিক সকলে নিজের জীবনটুকু নিয়েই বাঁচে ঐশীর স্কুলবাস বাড়ির সামনের রাস্তা পর্‍যন্ত আসে পিয়ালি আবার গানের স্কুলে যাতায়াত শুরু করেছে, সারাদিনই প্রায় ব্যস্ত বিয়ের খাট আর আলমারি ছাড়া ওবাড়ি থেকে আর কিছু আনেনি সুগত পরে ভাবা যাবে করে ফেলে রেখে এসেছে দেওয়াল জুড়ে বড় বড় ক্যাবিনেট তাতে সমস্ত জিনিস এবং বই সুগত আর ঐশী দুজনেই বই পাগল নিরঞ্জনকে অনেক বুঝিয়েছিল সে,
--কাছাকাছি ওয়ানরুম ফ্ল্যাট নিয়া থাক, এই বাড়ির কথা পরে ভাবা যাবে

নিরঞ্জন কিছুতেই রাজি হলেন না,
--আমি যামু না, তরা যা গিয়া

সুগতও অন্য ভাইবোনেদের মতো নোতুন বাড়ির ঠিকানা, নিজের ফোননম্বর দিয়ে গিয়েছিল মেজকাকা মোবাইল ব্যবহার করেন না
--দরকার পড়লে সঙ্গে সঙ্গে জানাইবা আমার নম্বরে কিন্তু এই পাড়ায় গোপন রাইখ

নিরঞ্জন ইতিবাচক নেতিবাচক কোনও মন্তব্য করেন নি শুধু বেহুলাদি একটু ক্ষুব্ধ হয়েছিল,
--তোমরা চললে গো দাদাবাবু? মেজকাবাবু একা একা থাকবে কেমনে?

মন বলে সেই অদৃশ্য বস্তুটিই যত গোলমাল পাকায় সুগতর অস্থির লাগছিল রাত্রের বিছানায় খানিকটা হিংস্রভাবে রুটিন আদর ওগড়ানোর অনেকক্ষণ পর দাঁতে দাঁত পিষে পিয়ালিকে বলেছিল,
--মেজকা চিরকালই ভীষণ একগুঁয়ে, অহঙ্কারী, সেলফ সেন্টার্ড


(২)
প্রায় আড়াই মাস পরে ওরা এবাড়িতে এল, সন্তর্পনে ঘুড়ির টানটান সুতোর মতো লাটাই থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সময় সুতোটা জুড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো স্মৃতির মাঞ্জা, প্রত্যহের যাপন অসতর্ক টানাটানিতে হাত কেটে যেতে পারে গলির শেষপ্রান্তে সুগতদের বাড়ি, একেবারে অন্ধকার দেখাচ্ছে মেজকার দুটো ঘরও? অদ্ভুত লাগে তার! সন্ধ্যের পর তো মেজকা কোথাও বের হন না মেজকার পুরনো প্রণয়িনী কাছেই কোথায় থাকেন, শুনেছিল সুগত, বিধবা পিয়ালি বলে,
--দুতিন দিন আগে ফোন করে এনগেজড টোন পাচ্ছিলাম
--কই, বলোনি তো?

সুগতর ভ্রূতে ভাঁজ ওরা নিজেদের অংশের ঘরদুটো খুলে আলো জ্বালে স্মৃতিরা ঘরময় উড়ে বেড়ায় ফড়ফড় করে সুগতর বাবা-মায়ের ঘর, মায়ের দামী ফার্নিচার কাজকরা ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে চকচকে বার্নিশ মা খুব শৌখিন ছিল বিশালাকার হাস্যমুখী ফোটোগ্রাফ পারিবারিক ইতিবৃত্ত শোনাতে উন্মুখ নিরঞ্জনের ঘর তালাবন্ধ, অন্ধকার চাবি কোথায়, কার কাছে? পিয়ালি বলল,
--কি করবে তাহলে?


শুধু শুধু অনেকটা রাত হয়ে গেল সুগত অপেক্ষা করেছিল নিরঞ্জনের জন্যে মোবাইল থেকে ফোন করেছিল নিরঞ্জনের ঘরে নিরবচ্ছিন্ন এনগেজড টোন ফোন খারাপ? বাড়ি বন্ধ করে নিচে নেমে আসে সুগতরা পেছনে সার সার বন্ধ জানালা, ভেতরে হলদেটে ম্লান স্মৃতি দেওয়াল বেয়ে অবাঞ্ছিত অশ্বত্থের চারা আবার বেয়ে উঠছে সুগতর মাথা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, রাগ হতে থাকে প্রচণ্ড অন্ধকার গলি, এতকালের চেনা, তাও ভয় ভয় লাগে তার গা ঘেঁষে এসেছে পিয়ালি ঐশীও এতক্ষণ একলা বাড়িতে পা চালিয়ে চলতে থাকে ওরা, গলির মুখ অবধি পৌঁছনর তাড়া হিরোরা রাস্তা জুড়ে টহল দিচ্ছে ঐশীকে ফোনে ধরে ঠিক আছে মেয়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল মোড়ের মাথায় দরজা খুলে উঠে বসামাত্র কে ডাকল,
--ফাদার!

খোলা দরজা দিয়ে দেখল শাণ্টু, হিরোদের অন্যতম চুলে রঙ, কানে দুল ঐশীকে ভীষণ বিরক্ত করত সুগত সামলে নিয়ে শান্ত চাপা গলায় বলল,
--বলবে কিছু?

শাণ্টুর চোখ আধবোঁজা, ফিসফিস করে বলল,
--ফুলসজ্জাটা হলোনা আর বউটাকে সড়িয়ে নিলেন ফাদার? তবে ভাব্বেন না, আপনার এসালা জামাই অত ফালতু পার্টি না ঠিক সময়ে খুঁজে বের করে নোবো

ট্যাক্সির ভেতরে বসে আপাদমস্তক ভিজে ওঠে পিয়ালির হার্টবিট থেমে গেছে মনে হয় সুগতর শার্টের কোণ ধরে টানে চলো! শব্দ গলাতে জমে থাকে সুগত একটু ইতস্তত করে শাণ্টু কি মেজকাকে চেনে? চিনবে?

ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে পিয়ালি সারা রাত ধরে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে সুগত স্বপ্ন দেখে, তাদের পুরনো বাড়ির গা বেয়ে সরীসৃপের মতো অজস্র অশ্বত্থের চারা বেরচ্ছে আর সে দেওয়াল বেয়ে উঠে ওগুলো কাটার চেষ্টা করে যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে


(৩)
নিরঞ্জনের ঘরের মেঝেয় আঁচল পেতে শুয়েছিল বেহুলা সুগত কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিল কাল একেবারে ঘুম হয়নি আজ অফিসে ইম্পর্ট্যাণ্ট মিটিং ছিল, না গিয়ে পারেনি তাই হাফ-ডে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে বেহুলা আঁচল দিয়ে ঘামের মুখ মুছল খুব শান্ত গলায় বল,
--তোমার জন্নি বসে আছি দাদাবাবু কাল অনেক রাত্তিরে মেজকাবাবু মরে গেল বেলেঘাটা হাঁসপাতালে লাশ আছে নিজেই ভর্তি হল, আম্মোও ওখেনে ছেলামসাত দিন ধরে জ্বরে ভোগতেছিল বাবু কতবার চেইছি তোমাদের ঠিকানা ফোন নম্বর, বাবু কক্ষুণো বলতনি তা বাদে ফোনটা খারাপ হয়ে গেল, সেই গেল হপ্তা থেকে ফোনের আপিসে খবরও দেয়নে বাবু

একটু চুপ করে শ্বাস নেয় বেহুলা সুগতর গলা দিয়ে কিছু ঠেলে বেরতে চাইছিল সেই অশ্বত্থের চারা সে জোর করে মুখ বন্ধ রাখে বেহুলা ছোট একটা পিতলের চাবিগোছা রাখে তার সামনে
--ন্যাও দাদাবাবু, মেজবাবুর সব চাবি আমার কাছে রাকতে দেছিল

দুপুর শেষ হয়ে এল, একটা পানসেটে বিকেল, তাও বেশিক্ষণ থাকে না সুগত বিছানায় বসে, চারিদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বড় হওয়ার পরে এঘরে বিশেষ আসত না তারা, নিরঞ্জন পছন্দ করতেন না ঘরটা যতদূর সম্ভব অগোছাল, অসুস্থ গন্ধ যেখানে সেখানে ঝুলছে লুঙ্গি ফতুয়া ধুতি কিছু বইপত্র মেঝেতে, বিছানাতেও ফোটোগ্রাফির কয়েকটা বই অজস্র সাদাকালো ফোটো অযত্নে বিক্ষিপ্ত টেবিলে, বিছানায় নদী পাহাড় প্রকৃতি মেজকার ফোটোগ্রাফির শখের কথা জানত ওরা একটি অল্পবয়সী মেয়ের প্রোফাইল অনেকগুলো ছবিতে বেশ চোখা মুখ, পাতাকাটা চুলে কপাল ঢাকা কে জানে কার ছবি? তাদের কোনও আত্মীয়া নয় সুগত অন্য কিছু খুঁজছিল টেবিলের ওপরে একটা বাটিতে নকল দাঁতের পাটি, দুতিনটে শস্তার পেন একটা কালো মলাটের বিবর্ণ ডায়েরি



সুগত ভিনভিনে অস্বস্তি তাড়িয়ে ডায়েরিটা খুলে ফেলল ভর্তি শুধু ঠিকানা আর ফোন নম্বর অজস্র - তাদের সমস্ত আত্মীয়ের নামে, যে যেখানে আছে এখন, এই মুহূর্তে, এইটি তার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বলে বোধ হল




লেখক পরিচিতি
শ্রাবণী দাশগুপ্ত

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
এখন রাঁচিতে থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. গল্পটি পড়ে, আমি মন্ত্রমুগ্ধ। সঙ্গে, লিখতে দ্বিধা নেই " --ফুলসজ্জাটা হলোনা আর বউটাকে সড়িয়ে নিলেন ফাদার? তবে ভাব্বেন না, আপনার এসালা জামাই অত ফালতু পার্টি না – ঠিক সময়ে খুঁজে বের করে নোবো। "... আমাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে !

    উত্তরমুছুন
  2. বাংলা বানানে একটু মনযোগ দিলে ভালো হয়। নতুন লেখার হাত কিন্তু ঝরঝরে নয়।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ জানাই। আপনার নামটি জানান নি কিন্তু।

      শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

      মুছুন
    2. কে যে বেনামে লিখলেন, কেনই বা, বুঝলাম না। যাই হোক - যখন কথোপকথন লেখা হয়, বানান যা খুশি হলেও ইতরবিশেষ হয় বলে মনে হয় না। আর, আপনার 'মনযোগ'-টি 'মনোযোগ' হবে। এটিকে শুদ্ধ করে নিন অন্তত। ধন্যবাদ।
      শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

      মুছুন