রাখাল রাহা'র গল্প : উত্থান-পতন

এটা তো হতেই পারে, একজন নিকৃষ্ট মানুষের নামের সাথে আরেকজন মানুষের নামের মিল থাকা। আরশাদকে নিয়ে রুমমেটরা সবাই হাসিঠাট্টা করে -- আরশাদ, তোমার পতনের আর কত দূর?

ব্যক্তিগতভাবে আমার মাঝে-সাঝে ওর প্রতি মায়াই হয়। আহা, বেচারা! হলে সিট না পেয়ে দীর্ঘদিন এ-হল ও-হল করেছে। মেয়েদের হল দু’টি ছাড়া আর কোনো হল নেই যে সে রাত্রযাপন করেনি। এ-নিয়েও সবাই ঠাট্টা করে -- আরশাদ, চলো আজ তোমাকে রোকেয়া হলে রেখে আসি। তবে ওর সাথে আমার পরিচয় অনেকটা ওর এই সর্বহলনিবাসী স্বভাব-সূত্রেই। আমি ক্যাম্পাসের অভিজাত বিভাগে পড়ি।
এই আভিজাত্য যেমন করে সুন্দরী মেয়েরা উপলব্ধি করতে পারে তাদের প্রতি ছেলেদের অস্বাভাবিক আচরণ থেকে, তেমন করেই অন্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের সাথে আলাপ-পরিচয়ের সূত্রেই আমিও বেশ উপলব্ধি করতে পারি । দলের হল-সহসভাপতির তো-ভাই হওয়ার সূত্রে ভর্তি হওয়ার আগ থেকেই সিটে। চার-বেডের রুমে তিন বেডে ধাড়ি ধাড়ি ভাইয়েরা ডাবলিং করলেও আমি সিঙ্গেল। আমার ধারণা অভিজাত বিভাগে চান্স না পেলে সবাই যা করে আরশাদও তেমন একটি সাবজেক্ট বেছে নিয়েছে। সে-সহ সেম-ইয়ারের দু’জন আর একজন সিনিয়র ভাই রাত বারোটার পর ফ্লোরে বিছানা পাতার অনুমতি পায়। সিনিয়র ভাইটির নিজেরই সিট। কিন্তু দল থেকে আমাদের রুমের জন্য বরাদ্দ দেওয়া মোটাসোটা এক ভদ্রলোকের জন্য বাধ্য হয়ে সে এমন ত্যাগ স্বীকার করে আসছে। ভদ্রলোক সিনিয়র-জুনিয়র কোনোটাই নয়, ক্যাডার। আমাকে অবশ্য খুব খাতির করে। ‘কি ভাতিজা, কোনো সমস্যা-টমস্যা হইতাচে না তো’ বলে সে তার বিস্তৃত চরের মতো উদোম পেট ডলতে ডলতে দুপুর বারোটায় ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যায়। চাচামশাই নাকি সত্যিসত্যিই নোয়াখালীর চরদখল-বাহিনীর সর্দার; খান-কয়েক খুনের কেসের আসামী এখানে এসে নিরাপদে ঠাঁই পেয়েছে। আর আমার সিটে বরাদ্দ-পাওয়া ভাইটি নাকি আদি-লীগ করে। তাদের তো উত্তরপাড়ার কোনো হলে থাকার কোনো সুযোগ নেই। ইষ্ট-ওয়েষ্ট উত্তর-দক্ষিণ এমন ভাগ তো জগৎ জুড়েই আছে। ডেভেলপমেণ্ট ষ্ট্র্যাটেজি নির্ধারণে এ ভাগের তো কোনো বিকল্প নেই। আর আরশাদ বিপ্লবী-লীগকে ধরে হলে উঠেছে।

ওর সাথে আমার পরিচয় হঠাৎই বলতে হবে। অনেকদিন ধরে কমনরুমে যাওয়া হচ্ছিল না। একদিন রাতে রুমে ওঠার পথে ভাবলাম কয়েক সেট টেবিল টেনিস খেলে যাই। কিন্তু ঢুকে দেখি গোটা ফ্লোর জুড়ে বিছানা পাতা। এদিক-ওদিক মশারি খাটানো-গোটানো। ভ্যাপসা গন্ধ। এ কি ডেভেলপমেণ্ট! নিশ্চয় আমার তো-ভাইদের কাজ! আসলে ডেভেলপমেণ্টেরও কিছু ব্যাড ইমপ্যাক্ট তো আছেই। এটা আনঅ্যাভয়ডেবল। চলে আসতে গিয়েও প্রায় দরজার মুখেই যে ছেলেটার বিছানা-পাতা তার সাথে আলাপ করে জানলাম এটা এখন থেকে গণরুম। আগ-বাড়িয়ে সে আরো কিছু তথ্য জানান দিল, প্রায় সবাই-ই এখানে দলের নেতাদের ভাড়া দিয়ে থাকছে। তবে তাকে ভাড়া দিতে হচ্ছে না। কারণ গণরুমের সিট-ভাগাভাগিতে বিপ্লবী-লীগ দু’টি সিট পেয়েছে, যার একটা তাকে দেওয়া হয়েছে বিনা ভাড়ায়। ভাড়া দিয়ে বিপ্লবী-লীগ করার চেয়ে সবাই দল করাকে পছন্দ করতে পারে তাই তাদের এই স্ট্র্যাটেজি। তাছাড়া এখানে আসার ঠিক আগে সে যে-হলটিতে থাকতো সেখানে তার এলাকার এক বড়ভাই বিপ্লবী-লীগ করতো, পরে জেনেছি। সে-সূত্রেই বিপ্লবী-লীগের সাথে তার পরিচয়। বাকি আঠারোটি সিটের একটিও আদি-লীগ বা অন্যরা পায়নি। পাবে কেমন করে! এ হল হলো দলের ঘাঁটি। তাদের সাথে সম্পর্ক বিপ্লবী-লীগের ভালোই বলতে হবে। ক্রমক্ষয়িষ্ণু বিপ্লবের লেজ খ’সে খ’সে দল আর তাদের আদি-শরীরে যুক্ত হয়ে চলেছে। তবে মাঝে-মাঝেই তাদের বিপ্লবী রক্ত চাড়া দিয়ে ওঠে নাড়ীছেঁড়া ব্যথায়। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন টেন্ডার, কন্সট্রাকশন কাজের ভাগ, আশেপাশের বিভিন্ন মার্কেটের চাঁদার বাটোয়ারা ইত্যাদি নিয়ে আদি-লীগ নাকি মাঝে মাঝেই বিপ্লবী-লীগকে উপেক্ষা করতে চায়। তখন মায়ে-ঝিয়ের বন্দুকযুদ্ধে ক্যাম্পাস কেঁপে ওঠে। এসময় দলের কাটা-রাইফেলগুলো বিপ্লবী-লীগ ভাড়া পায় বলে আমার তো-ভাই বলেছে। দল আর আদি-লীগের বন্দুকযুদ্ধেও বিপ্লবী-লীগ তাদের কাটা-রাইফেলগুলো দলকে দিয়ে থাকে এ তথ্যও তার থেকে জেনেছি। দারুণ কৌশল! মাথা মেরে লেজকে লালন। অলওয়েজ ফেভারেবল ব্যাল্যান্স অব পাওয়ার!

এরপর একদিন হঠাৎ করেই বাইরে থেকে এসে দেখি সে বিছানাপত্তর নিয়ে আমার রুমে। রুমে নয়, একেবারে আমার বেডে বসে আছে। এ কি ডেভেলপমেন্ট! মনে হলো এই বুঝি গণরুমের বোঁটকা গন্ধওয়ালা বিছানা আর ঘর্মাক্ত একটা শরীর আমার গায়ের সাথে লেপটে গেল। এটা কেমন করে সম্ভব! আমার তো-ভাই কি আমার সাথে বেঈমানী করলো? নাকি দলে তার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেল? কয়েকদিন থেকে বরিশাল গ্রুপের প্রতি টাঙ্গাইল গ্রুপ ক্ষেপে আছে। না না, এভাবে তো আমি থাকতে পারবো না, পড়াশোনা করতে পারবো না! আগামীকালই আমার ইনকোর্স পরীক্ষা। মনে হচ্ছিল পরীক্ষার খাতার উপর ওর নোংরা বিছানাপত্তর নয়, একবারে কাঁটাবন বস্তির ঘিনঘিনে কাঁথাকম্বল বিছানো! এই বস্তিটা নাকি নানা মুভমেন্টে দারুণ সহায়ক -- আমার তো ভাই বলছিল। নেতা-কেডারদের লুকোনো, অস্ত্রপাতি রাখা, হেরোইন-গাঁজার চালান সরবরাহসহ নানাবিধ কাজে অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয় বহুবার চেষ্টা করেও পারেনি। ই্টস্ আ বিগ প্রবলেম অব সিটি ডুয়েলার্স, এণ্ড ইট শুড বি রিমুভড। আরশাদ আমার দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু এখানে তো সহানুভূতি দেখানোর কিছু নেই। আমার তো-ভাইয়ের কথাটা স্মরণ হলো, ‘তোর লগে কেউ যদি ট্যারাবেরা করে হোজা জানলা দিয়া ফালায় দ্যাবা, বোজজো?

আমি সোজা ওর বিছাপত্তর আমার খাটের উপর থেকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলাম। যেন টেবিল-পত্র গুছিয়ে যেভাবে পড়তে বসি সেভাবেই পড়তে বসে গেলাম। প্যারেটো এফেসিয়েন্সিটা এখনই বুঝে ওঠা দরকার। ইনকোর্সে এটাই এ্যাটেইন করবো।

পরদিন দেখলাম, রাত ১২টার পর আরশাদ মেঝেতে বিছানা পাতছে। আর এভাবেই সে আমাদের ৪৩৮ নম্বর চার-বেডের রুমের দশম বাসিন্দা হিসাবে স্থায়ী হয়ে গেল। সারাদিন কই থাকে কি করে! খাটের নীচে পেপার পেড়ে একপাশে গাদা করে বিছানাপত্তর আর বইপুস্তক রাখা। তা আছে! খেয়াল করে দেখলাম জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ, আবুল হাসান, নেরুদা, ম্যাক্সিম গোর্কী, নাজিম হেকমত না হিকমত, নামই শুনিনি -- কি সব বই! খামোখা! চাচামশাই রাতে মাঝে মাঝে বাইরে যাওয়ার আলসেমিতে খাটের নীচেয়ই কফ-থুতু ফেলে। পাশেই ইলেকট্রিক কয়েল জ্বালিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। হলের ডাইনিং-ক্যাণ্টিনের যা অবস্থা! যাদের সামর্থ্য আছে আমরা সবাই কাজের ছেলে রেখে রুমে রান্না করি। এসব ছেলেরা দরকারে অস্ত্রপাতি-পটকা-বোমা টানতেও বেশ কাজে লাগে শুনেছি। আগে চুলাগুলো সব বারান্দায় ছিল। কিছুদিন আগে দারোয়ান মামা এসে বলে গেছে হাউজ-টিউটরদের চোখে যেন চুলা না পড়ে। চুলা সব ভিতরে সরান। প্রভোস্টের নির্দেশ।

সবকিছু মিলে আমার হল-জীবন বেশ মজারই বলতে হবে। কোনো সমস্যা নেই। আমার তো-ভাই সহসভাপতি হলে কি হবে, তার দাপট সভাপতি-সেক্রেটারীর চেয়ে বেশী। বরিষালের দাপুটে মন্ত্রীর সাথে ওর ওঠাবসা। রান্না করার ছেলেটা মাঝে মাঝে ছুটিতে গেলে অগত্যা কেন্টিন-ডাইনিং-এ খেতে গেলে দেখি মামারা আমার বিলও নেয় না। ওদের দোষে আমারও আজকাল বিল দেওয়ার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হল-গেটের বাইরের চা-বিস্কিটের দোকানগুলোও বিল চাইলে দেখি এখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন, নাকি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ? -- বুঝতে পারি না।

হলে মাঝে মাঝেই রাতের মিছিল শুরু হয়। ডাইনিং-কেন্টিনের সব আলো নিভে গেলে বিপ্লবী-লীগ ‘কমরেড কমরেড’, আর দল ‘ওরে দ্যাশে কি কোনো নেত্তিরি আছে রে?’ বলে যখন বারান্দা দিয়ে চক্কর দেয় তখন রুমগুলো কেমন গমগম করতে থাকে। ভিতরে বসে হাইপার ইনফ্লেশন থিওরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বুকটা হঠাৎ ফুলে উঠতে চায়। এই তো, এই তো আমার বিশ্ববিদ্যালয়! বহু আন্দোলনের সূতিকাগার! আদি-লীগের কোনো শ্লোগান এ হলে নাকি বহুকাল কেউ শোনেনি। তারা আছে মাঠের ওপারে, দক্ষিণপাড়ায় তাদের নেত্তিরি নিয়ে। তবে এ হলেও যে নেই একেবারে তা নয়। কারণ টয়লেটের দরজায় দু-নেত্রীর নামে যত উত্তেজক বাক্যগঠন আর ছবি আঁকা সম্ভব তার সবই দেখা যায় প্রাতঃকর্ম করার সময়। একনেত্রীর নামে কোনো উপভোগ্য সৃজনশীল লেখা দেখে শৌচকর্ম সেরে সেদিনই দ্বিতীয়বার ঢুকলে তার পাশে আরেক নেত্রীর নামে পাল্টা এবং আরো শক্তিশালী শব্দবিন্যাস দেখা যায়। সেগুলো পাঠ করে আমার হাতমারার কাজটা বেশ জমে ওঠে। এটা ইদানীং দেখছি বেশী বেড়ে গেছে। সকালে উঠেই দেখি চাচামশাই ধবধবে পাছা বের করে শুয়ে আছে। পাছার আয়তনকে একটু কমিয়ে দেখলে মনে হয় ঠিক নীলার পাছার সাথে মিলে যাবে। নীলার কথা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওর সাথে সবাই কত সহজে মেশে! অথচ আমি মিশতে পারি না। আগেই ওর নিরাভরণ রূপ ছিলা-মুরগীর মতো চোখে ভাসে। চোখে চোখে তাকাতে পারি না। ভালো করে একটা প্রেমও করতে পারলাম না জীবনে! আচ্ছা আরশাদ কি প্রেম করে? ইদানীং দেখছি সবাই শুয়ে পড়ার পর আমার খাটের নীচে ছোট টেবিল-ল্যাম্প জ্বালিয়ে কবিতা পড়ে। আবার মাঝে মাঝে দেখি নোটবইয়ে কিসব যেন লেখে, অনেক রাত করে। আলোটাকে এমনভাবে কাগজে মুড়ে দেয় যেন কারো চোখে না লাগে। কাণ্ডজ্ঞান আছে আবার ঠিক ঠিক! কি লেখে এত রাত করে! আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়। পরদিন তাকে-তাকে ছিলাম। কিন্তু সুযোগ পেলাম না।

আজ ক্যাম্পাসে দল-এর মিটিং। হলের গেট সকাল থেকেই বন্ধ। ক্যাডার-ছাত্ররা সব বসে গেছে গেটে। সবাইকে নয়টায় একসাথে মিছিল করে ক্যাম্পাসে যেতে হবে। প্রায়ই এমন হয়। কাউকে কাউকে দেখেছি ক্যান্টিনের পিছন দিয়ে সেফটি ট্যাংকের দুর্গন্ধ ডিঙিয়ে প্রাচীর টপকে ক্যাম্পাসে যেতে। আজকে নাকি সেপথও বন্ধ থাকবে চাচামশাই বলেছে।

আমার এ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আমি টয়লেটে যেয়ে আজ বেশ উদ্দীপনাময় কিছু অঙ্কন আর কাব্য পেলাম। একপাশে “... দার বোদায় কত বাল/ মাঝখানে তার বড় খাল/ সে খালে পঁচা শামুকের গন্দ/ চুদতে কি আর মন্দ?”; আর অপরপাশে “... নার বোদায় কত বাল/ মাঝখানে তার বড় খাল/ সে খালে পঁচা শামুকের গন্দ/ চুদতে কি আর মন্দ?” দু’দুটি লোভনীয় ছবি-সহযোগে কাব্যপাঠ করতে করতে শৌচকর্মের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ দরোজার পুরোনো কাঠের খ’সে-পড়া পঁচা কালচে অংশ দিয়ে আধাহাত লম্বা একটা চ্যালা কিলবিল করতে করতে বের হলে তড়িঘড়ি করে পানি ঢেলেই গোসলখানায় ঢুকে যাই। রাবিশ! শ্যাম্পুর মিনিপ্যাকটা দু’হাতের দারুণ উত্তেজনায় আজ শেষ হয়ে যায়। মাথা আর ঘষা হয় না।

বেশ ঝরঝরে লাগছিল! রেডি হয়ে বের হওয়ার সময় মনে হলো আরশাদ আজ ইচ্ছে করেই আমার সাথে বের হচ্ছে। কিন্তু আমি কি করতে পারি। জগতৎ তো এমনই। অর্থনীতিই সবকিছু নির্ধারণ করে, রাজনীতি কিছু না। গেটে আমাকে না আটকালেও ঠিকই আরশাদকে আটকে দিল। আমি বাইরে একটু দাঁড়ালাম। আসলে সে যে বিপ্লবী-লীগও করতো না তা আমি শুধু নয়, হলের বিপ্লবী-লীগের নেতা-কেডাররাও জানতো। বিপ্লবী-লীগের শেলটারে নেই আবার দলও করে না তাহলে তো বুঝতেই হবে সে আদি-লীগের সমর্থক। মাঝে মাঝে ভাবি সে আসলে ৪৩৮ নম্বরে ঢুকলো কেমন করে! মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় -- সে রগকাটা-কোলাবরেটরের লোক না তো? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, তা বোধহয় না। মাঝে মাঝেই জীবনানন্দ আওড়ায়, রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করে। তবে কি হারমোনিয়াম পার্টি? কি জানি কি ও!

সে গেটের ওপার থেকে আমার দিকে তাকালো বলে মনে হলো। কিন্তু আমি তো আর সেদিকে তাকাতে পারি না। এখনই ওয়াহাব উদ্দিন মাহফুজ স্যারের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। দ্বিতীয় সারিতে বসেও তার আওয়াজ পাওয়া যায় না, অনেক বড় মাপের অধ্যাপক। গেট থেকে একজন আমাকে ইশারা করে চলে যেতে বলল। যাওয়ার পথে একটা কথা মনে হয়ে হাসি পেল ¬-- সব হলে থাকার মতো আরশাদের সব দলে মিছিল করার সৌভাগ্যও হয়ে যাচ্ছে!

সেদিন বেশ রাত করে সে রুমে ফিরলো। আমার দিকে তাকালোও না। তাকালে বুঝতো আইএসএলএম কার্ভটা আমার কপালে কিরকম ভাঁজ তৈরী করে রেখেছে। সবাই তখন শুয়ে পড়েছে। শেষে আমিও শুয়ে পড়লাম। কিন্তু খেয়াল করলাম আরশাদ উঠে তার ছোট্ট টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বেলে আজও কি যেন লিখছে। ও কি সত্যিই প্রেমে পড়ল, নাকি পড়াশোনায় মনোযোগ দিল? দিক, কি আর ফিউচার ওদের!

সকালে উঠেই দেখি সে বের হয়ে গেছে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। মনে হলো ডিপার্টমেন্টের তনিমা আপা একাকী কক্ষে নিরাভরণ হয়ে আছে; এখনই তার ব্রেষ্টের বিস্ফোরণ ঘটবে। শরীরে শিহরণ খেলে গেল। হাত-মুখ না ধুয়েই খাটের নীচে রাখা ওর বিছানার মধ্য থেকে খাতাটা বের করলাম -- “গণতন্ত্র! কী বিস্ময়! একটা মানুষ অপরের রাজনৈতিক মতামতের মূল্য দিচ্ছে না, তাকে একটা মত মেনে নিতে জুলুম করছে, অথচ সে-ই আবার অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছে। . . .” ধুর! কোথায় একটু সুড়সুড়ি পাবো! তার কোনো কিছু নেই। ও কি সামরিক-সরকারের দালাল হয়ে গেল নাকি শেষ-মেষ!

এরপর দীর্ঘদিন আর আরশাদকে নিয়ে মাথা ঘামাই না। আরশাদ তার নিজের মাথাই ঘামিয়ে ঘামিয়ে মরে। সেদিন সারা শরীর ঘামে ভিজিয়ে দুপুর গড়িয়ে যখন রুমে এল ওর চোখমুখ একবারে লাল। শরীরে মনে হলো একটুও বল নেই। সটাং শুয়ে পড়লো। কার বিছানায় সেটা যেন ওর মনেও হলো না। খানিক পর চাচামশাই এসে চেতে উঠলো, হেইয়া, হোগার মুদিন দিমুয়ানে রাইফেলের বাট হান্দায়ে। জানো না, বালশের নীচে কি আছে?

তাড়িতাড়ি আরশাদ উঠে পড়লে চাচামশাই বিছানার নীচ থেকে কাটা-রাইফেল বের করে বললো, দ্যাকছো মনু, হেইয়া হোগার মইদ্যে হান্দাইয়া দিমুয়ানে।

আরশাদ তাড়াতাড়ি নীচে নেমে খালি মেঝেতেই শুয়ে পড়লো, তবে আমার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো ও হঠাৎ কাভি ভাইয়ের স্টেইনগানের মতো গর্জে উঠবে। ফাইট করে কি! হেইয়া মোগো দ্যাশের পোলা! চাচামশাই ওর দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হলো। রুমের সবচেয়ে সিনিয়র জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের আমানুল ভাই পরিস্থিতিটা পর্যবেক্ষণ করছিল। স্বাভাবিক। সে বেশ সাংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে বললো, দেখো আরশাদ, তুমি যতই রাস্তায় রাস্তায় উত্তাপ নিয়ে আসো আমরা কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি, তোমার পতন হতে এখনো অনেক দেরি আছে। খামোখা উত্তেজিত হয়ে গোলাগুলির মাঝে যেও না।

আরশাদ মেঝেয় শুয়েই আমানুল ভাইয়ের দিকে তাকালো। তার চোখে তখনও আগ্নেয়গিরি। সেদিকে তাকিয়ে আমানুল ভাই একটু বিব্রত হয়ে পাশ ফিরে লেপ গায়ে দিয়ে পেপার পড়তে লাগল। শীত হোক গ্রীষ্ম হোক, রাত হোক আর দিন হোক সে লেপ গায়ে দিয়ে শোয়। চাটগাঁইয়া হলেও কথা বলে খুব সুন্দর করে। কবে নাকি ঘুম থেকে উঠে দেখেছিল তার পাছার কাপড় একটু ছেঁড়া। তার সন্দেহ কোনো এক তো-ভাই সেদিন তার পাছা-মেরেছিল। চট্টগ্রামের মানুষের নাকি এ-স্বভাব বেশি। আমার ধারণা, সেই ভয়েই সে সবসময় শুতে হলে ভালো করে গায়ে লেপ জড়িয়ে নেয়।

খানিক পরেই দেখি আরশাদ উঠে জামা-কাপড় পরে কোথায় বেরিয়ে গেল। ফিরে এলো বেশ রাত্রিতে। এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে চুপ করে মেঝেয় বিছানা পেতে শুয়ে পড়লো। বাপরে, আমাকেও পাত্তা দিচ্ছে না যেন! আমি আনব্যালান্সড গ্রোথ নিয়ে ভাবতে লাগলাম। এটা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটু পরেই আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম আরশাদ আজও তার ছোট্ট ল্যাম্পটা জ্বেলে কাগজ দিয়ে মুড়ে দিচ্ছে। পণ্ডিতি!

কিন্তু সকালবেলা তেমন উত্তেজনা অনুভব না করলেও মনে হলো দেখি না, আজ কি লিখেছে। ও বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে খাতাটা খুঁজে বের করলাম -- “ওরা বুঝতে পারছে না যে এই সামরিক স্বৈরশাসকের পতন ঘনিয়ে এসেছে। সারাদিন পর . . .।” হতাশ হলাম, সব মিলিয়ে। কি জানি, ওর কথা সত্যিও হতে পারে। এসময়ে পতন-টতন ঘনিয়ে এলে তো আবার মারামারি লাগবে। পড়াশুনা করবো কিভাবে এদেশে! টোফেলটায় ভালো একটা স্কোর করতে পারলে বাইরে কোথাও -- দেখি কি হয়। অত ভয়ের কিছু নেই।

কিন্তু সেদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল দেখে রীতিমতো ভয়ই গেলাম। মিছিলের এ রূপ না-দলের, না-লীগের -- এ এক বন্য রূপ! মনে হলো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। আড্ডাগুলো যেন সব মিছিলে মিশে গেছে। এ কি বিস্ময়! জুটিগুলো কি সব প্রেম ভুলে গেল নাকি? লাইব্রেরির কোণা-কাণা, নজরুলের মাজার, টিএসসির লন -- সব যেন সচেতন হয়ে উঠল। কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাকেও দেখলাম বলে মনে হলো। আমি অত খবর রাখিনি, ক’দিন থেকেই নাকি ক্যাম্পাসে সাদা এ্যাম্বুলেন্স দেখা যাচ্ছে, এবং আজও তারা এসে গেছে। এর সাথে অসুখ-বিসুখের কী সম্পর্ক আমি বুঝে ওঠার আগেই মল চত্বরের দিক থেকে বেশ কিছু গুলির আওয়াজ কানে এলো। আমি দৌড়ে কলাভবনের ভিতরে আশ্রয় নিতে গিয়ে মাল-চত্বরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। সমাজতত্ত্ব বিভাগে এত মাল কেন এর অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা খুঁজতে ক্লাস না থাকলে আমরা প্রায়ই এ চত্বরে হাজির হই। আমাদের রুমেল মালগুলোর ঊর্ধ্ব-নিম্ন অঙ্গের সাইজ-শেপের কি-সব নাম যেন বলে বলে ধাবমান এক-একটা জীবন্ত স্যাম্পল দেখায়। আজ সেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে নিজের নিম্ন-ঊর্ধ্ব অঙ্গের উপর দিয়ে কয়েকজনকে পালাতে দিতে হলো। একটু ডিপ্রেশন এলেও পরবর্তী মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে ওখান থেকে উঠে দৌড়ে সোজা তিন তলায় ডিপার্টমেণ্টের সামনে যেয়ে হাঁপ ছাড়ি। বিভাগটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। সব গেল কোথায়? ফাইনাল ইয়ারে ফার্ষ্ট হতে যাচ্ছে জাকির ভাইকে পেলাম। সে বলল, কি এক বিরক্তি বলো এসময়! জানুয়ারীতে ফাইনাল আমাদের। স্যারেরাও শুনছি কেউ কেউ মিছিল করে বেড়াচ্ছে!

আস্তে আস্তে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে জড়ো হলো। হঠাৎ এমন গোলাগুলি শুরু হলো মনে হলো দেয়াল ভেদ করে চলে আসবে। আর আমাদের বিভাগটা হয়েছে কোণাকুণি একেবারে মলচত্বরের কাছে। সবাই বারান্দা থেকে হুড়মুড় করে সেমিনার-রুমে গিয়ে মেঝেয় বসে দোয়া-কালাম পড়তে লাগলাম। কয়েকটি মেয়ে তো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল -- আম্মু এত করে মানা করছিল, আজগা যাসনা! আমার মনে হতে লাগল ঢেউয়ের মতো গর্জন আর বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও মেয়েগুলোকে দেখে আমার হাসিই পাচ্ছিল। আহ্ হারে আদরের দুলালী! হলের পাতলা ডাল আজ একটু খাইয়া যাও। এভাবে কতক্ষণ গাদাগাদি করে কাটলো কে জানে। গোলাগুলি যখন থামল তখন প্রায় বিকেল। এক এক করে সবাই কলাভবন ছেড়ে বের হলো। জানতে পারলাম সাদা এ্যাম্বুলেন্স চলে গেছে -- সরকার-সমর্থিত ক্যাডারেরা ক্যাম্পাস এবং হল থেকে বিতাড়িত হয়েছে। আমি হলের দিকে আগালাম। মল চত্বর তখনও থমথমে। গাছগুলোও গুলি খেয়ে খেয়ে কেমন যেন বিষণ্ন। কিছু ডালপালা ভেঙে পড়েছে। ফাঁকে ফাঁকে বারুদের গন্ধ। এর সাথে পাল্লা দিয়ে মধ্যিখানের মহুয়া গাছটা যেন ক্ষেপে উঠেছে আজ। ওহ, কি গন্ধ! বিভৎস! সবার এত পছন্দ কিন্তু আমার ইঁদুরের পেস্যাবের মতো লাগে!

নাকে রুমাল চেপে হলে এলাম। এস দেখি সে এক এলাহি কাণ্ড। সবাই একে-ওকে কোলাকুলি করছে। সাধারণছাত্র-ক্যাডারছাত্র-নেতা সব মিশে গেছে। গেষ্টরুমে একটু উঁকিঝুঁকি দিলাম। চাচামশাইসহ বহিরাগত ক্যাডারদের কাউকে দেখলাম না। আরশাদকে দেখলাম সোফায় বসে আছে। অবাক ব্যাপার! কি জানি, তার কি এমন উত্থান হলো আজ! আমাকে ঠিক দেখলো বলে মনেও হলো না। আনব্যালান্সড গ্রোথটা ঠিক বুঝে ওঠা হয়নি। বুঝতে হবে।

এর সপ্তাহদুয়েক পরেই আমরা একদিন রুমে মেতে উঠলাম আরশাদকে নিয়ে। আমানুল ভাই গায়ে লেপ জড়িয়ে বালিশে হেলান দিয়ে পত্রিকা থেকে চোখ তুলে বলল, তো আরশাদ, তোমার পতন তো হলো, এবার আমাদের মিষ্টি-টিষ্টি খাওয়াও। আরশাদ দেখি বেশ সিরিয়াস। যেটা কখনো করে না, মেঝে থেকে উঠে একেবারে আমারে বেডে বালিশটা নিয়ে আরাম করে বসে বলল, দেখেন, এবার দেশে সত্যি একটা পরিবর্তন আসবে, স্বাধীনতার পর যেটা সম্ভব হয়নি। আরশাদের সিরিয়াসনেস দেখে আমানুল ভাইকেও একটু আশান্বিত হতে দেখলাম -- না এর একটা সম্ভাবনা আছে।

কি জানি, কতটুকু লাভ-ক্ষতি হবে! আমি বরং অপর্চ্যুনিটি কস্ট্-এর দিকে মন দিই। ক’মাস বাদে পরীক্ষা। দেশজুড়ে আবার নির্বাচনের হাঙ্গামা। যারা আসে আসবে, আমার অত কি! কিন্তু নির্বাচনের আগে আমার তো-ভাইদের কেমন চুপসে যেতে দেখলাম। মনে হলো ডাইনিংয়ের শেষ বেলাকার ডালের মতো বিবর্ণ সব মুখ। ওদের ধারণা নির্বাচন-শেষে আদি-লীগের হাতে ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। আমিও একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আরশাদ কেন, কাউকেই একেবারেই ঘাটাই না। কারো বলে বিশ্বাস আছে নাকি! কিন্তু বিস্ময়করভাবে নির্বাচন-শেষে ক্যাম্পাস দলের নিয়ন্ত্রণে আসার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। আর আমার তো-ভাইয়েরা দারুণ দাপটে হলে ফিরে এলো। এর কিছুদিন পরেই ক্যাম্পাসে দল-লীগের যে মিলন হয়েছিল তা ভেঙে পড়ল। উত্তরপাড়া থেকে আদি-লীগকে বিতাড়িত করে দক্ষিণপাড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো, আর দক্ষিণপাড়া থেকে দলের পাত্তা গুটিয়ে উত্তরপাড়ায় চলে-আসাদের নিয়ে হলে বেশ ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন’-এর মিছিল শুরু হলো। ক্যাম্পাসের দেয়ালে-দেয়ালে, বাথরুমের দরোজায়-দরোজায় যেসব বাণী ধোয়া-মোছার কাজ চলছিল তা দ্বিগুণ উদ্যমে ফিরে এলো। এরপর প্রায় রাতে উত্তর-দক্ষিণ গোলাগুলি শুরু হলো। মাঝের মাঠ পেরিয়ে ফাঁকা ফাঁকা গুলি ছুটতে লাগল। এবং এর সাথে প্রায় প্রতিদিন গোলাগুলি শেষে ছাদ থেকে ছাদে চিৎকার করে দু-দলের দু-নেত্রীর নামে দারুণ আদিরসাত্মক বাক্যযুদ্ধ শুরু হলো। গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় দু’পারের রসের ঢেউ হল-মাঠের মাঝামাঝি ধাক্কা খেয়ে খেয়ে উছলে উঠতে লাগল। আমি কিছুক্ষণ এটা পান করার পর ষষ্ঠ কর্মেন্দ্রিয়ের পুলক প্রায় প্রতিদিনই রোধ করতে পারি না। হাতে একটু শ্যাম্পু নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাই। ডিসগাষ্টিং!

কয়েকদিন পরেই দুপুরবেলায় ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ার মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হলো। বিস্ময়করভাবে গোলাগুলিতে আদি-লীগের চেয়ে দলের দ্বিগুণ-সংখ্যক ক্যাডার মারা পড়ল। একজন সাধারণ-ছাত্রও মারা পড়ল। বেচারা! বিপ্লবী-লীগ দলকে অস্ত্র সরবরাহ করলেও শেষ রক্ষা হলো না। ততদিনে আমার মতো ভীরুও ফাইট দেখতে দেখতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সংঘর্ষ-শেষে হলে ফিরে দেখি পাশের কলেজের যে-ছাত্রটি দলের ক্যাডার হিসাবে আমাদের হলে রাজত্ব করতো তার লাশকে ঘিরে সেই মেয়েটি চিৎকার করে কাঁদছে -- ও রে স্ট্যাব কইরা পঙ্গু কইরা রাইখা দিল না কেন! আমি সারাজীবন টাইনা নিয়া বেড়াতাম! ওর মতো ভালো মানুষ কেডায় আছিল! ওরে সবাই কত সম্মান করতো, কত সালাম দিতো! মেয়েটির ফিগার দারুণ। ওকে ভেবে একদিন পুলক নিয়েছিলাম কয়েকবার। সে নাকি সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্রী। আমাদের হলের একটি সিঙ্গেল রুমে ছেলেটাকে নিয়ে একরকম ঘর-ই করত। পরদিনই পত্রিকায় পড়লাম সরকার থেকে বরাদ্দকৃত হেলিকপ্টারে করে তার লাশ গ্রামের বাড়ি বরিশালে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ভালো। মোগো দেশী বাই! মইরাও শান্তি!

এ ঘটনার পর শান্তি স্থাপনের জন্য অনির্দিষ্ট-কাল ক্যাম্পাস বন্ধ হলো। হল ছাড়ার সময়ে আমানুল ভাই তার ব্রিফকেস গোছাতে গোছাতে বলল, কি আরশাদ, তোমার পরিবর্তনের কি হলো! আরশাদ কোনো কথা না বলে তার পাটের হাতব্যাগটার মধ্যে জামাপাপড় আর কিছু বইপুস্তক ভরে বের হয়ে গেল।

মাসখানেক পর যখন ইউনিভার্সিটি খুলল তখন ক্যাম্পাসে দল-লীগের বেশ একটা ইক্যুলাইব্রিয়াম প্রতিষ্ঠা হলো। দল ও আদি-লীগ উভয়ে বিশাল বিশাল মিছিল নিয়ে প্রত্যেকদিন নিরাপদ কক্ষপথে ক্যাম্পাস-প্রদক্ষিণ করতে লাগল। গ্রহজগতের এমন ভারসাম্যের প্রভাব পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে পড়লো। হলের গেট প্রায় প্রত্যেকদিন সকাল আটটার আগেই বন্ধ করে দেওয়া হতে লাগল। এরপর প্রত্যেক রুমে এসে নেতা-ক্যাডারদের আহবান -- ভাইসব আসেন আসেন, এই আসো আসো, আরে নাশতা পরে কইরো, আগে মিছিলে চলো -- অব্যাহত থাকল। কিন্তু সবকিছুর এমন ভারসাম্যেও আমাদের আরশাদ কেমন যেন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল। ইক্যুলাইব্রিয়ামের এমন ইমপ্যাক্ট আছে কিনা দেখতে হবে। কি জানি কি চেয়েছিল ও -- একেবারে ড্যাম কেয়ার হয়ে উঠল। একদিন সকালে আমার তো-ভাইসহ অন্যেরা সবাইকে মিছিলে ডাকতে এলে ও সরাসরি বলে বসল, ভাই, আমি দল করি না।

কী!

ভাই, আমি দল করি না।

চোদানীর পোলা! চল -- বলে আমার তো-ভাই ওকে চুল ধরে টেনে-হিঁচড়ে লুঙ্গি পরা অবস্থায় টেনে নিয়ে গেল।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমার খুব খারাপ লাগতে লাগল। মনে হলো ওকে উদ্ধার করি। এভাবেই তো অন্যায় আচরণের প্রতিরোধ করতে হয়। পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের ছাত্রসমাজ কি সাহসী ভূমিকাই-না পালন করেছিল। মনে হতেই বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। কিছু করতে পারলাম না। সবকিছুই আসলে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। আমি পারব কেমন করে? বিষয়টাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে টেবিলে বসলাম। গেম থিওরিটা বোঝা দরকার দ্রুত। হার্ভার্ড থেকে নতুন জয়েন করা হাসানুজ্জামান স্যার দারুণ দারুণ সব তত্ত্বের আলো ছড়াচ্ছেন। আজ ক্লাসে মনোযোগ দিতে হবে। তা সত্ত্বেও সন্ধ্যায় রুমে ফিরে কেমন যেন গুমোট অন্ধকার লাগতে লাগলো। রাতে হল-অফিস আলো করে প্রভোস্ট স্যার এলেন দীর্ঘদিন পর। ফ্লোরে ফ্লোরে হাউজ টিউটরদের পদচারণা শুরু হলো। আমার ধারণা আরশাদ প্রভোস্ট স্যারকে গিয়ে বলেছে। খানিক পরেই দারোয়ান এসে বলল, মামা, স্যার আসছেন।

আমরা চেয়ারটা এগিয়ে দিলাম। কিন্তু স্যার বেশ দায়িত্ববান সেদিন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পাঠদান শুরু করলেন -- এই আপনারা এখানে কে কে থাকেন? আপনি কবে থেকে আছেন? আপনার সিট হয়েছে? আপনার দ্বৈতাবাসের অনুমতি আছে? বাইরে হিটার কেন? বারান্দায় হিটার জ্বালানো যাবে না।

পাঠদান শেষ করে গটগট করে টিউটর স্যার চলে গেলেন পরবর্তী রুম-ক্লাসে।

পাঠ্যবস্তু উপলব্ধি করে আমার সকালে আরশাদের প্রতি যে একটু পক্ষপাত তৈরি হয়েছিল তা একেবারে উলটে গেল। মনে হতে লাগলো যত নষ্টের মূলে সে। হিটারটা স্যারদের কথামতো ভিতরেই ছিল। পতনের উত্তেজনায় সে ওইটাকে আবার বাইরে নিয়ে গেছে। ভিতরে হিটার জ্বললে উনার নাকি নীচে শুতে অসুবিধা হয়। বলে, রান্নার নোংরা-আবর্জনা ওর বিছানা-বইপত্রে পড়ে। কারেন্ট তো পুড়ছেই, তো হিটার বাইরে রাখলে কি অসুবিধা? ক্ষমতা নেই একফোঁটা, যুক্তির অভাব নেই! এখন যদি হিটারের লাইন কেটে দেয়! বিষয়টা মনে করতেই ডাইনিংরুমের কৃত্রিম কাঠের মধ্যে পানি-ঢুকে-ফোলা ছিঁবড়ে-বেরিয়ে-আসা নোংরা স্যাঁতসেঁতে টেবিলের ওপর ডাল-ভাত রাখার বেঁকা-তেড়া কালচে সিলভারের গামলা আর বিশ্রি নীলচে প্লাস্টিক বাটির মধ্যে সিদ্ধ পানসে মাছের সাথে ভেসে থাকা কাকরোলের চোখা চোখা মাথাগুলো গায়ে বিঁধতে লাগল।

চরম বিরক্তি নিয়ে টেবিলে বসলাম। অনেকদিন ওর সাথে কথাই বলি না। দলের মধ্যেও এর মাঝে বরিশাল আর টাঙ্গাইল ইজমের রেষারেষি চরমে উঠেছে। শুনেছি দু’গ্রুপে দুজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এর নেতৃত্বে রয়েছেন। দলের উপর প্রভাবের মাত্রার সাথে নাকি নেত্রীর উপর প্রভাবের সূচক ওঠানামা করে। দারুণ শেয়ার-বাজারীয় ব্যাপার! দক্ষিণপাড়ার মাদারীপুর আর গোপালগঞ্জ ইজম নিয়ে উত্তরপাড়ায় হাসাহাসি চলে আসছে দীর্ঘদিন। উত্তরপাড়ায় আসলে এত দীর্ঘ ইজমীয় বিরোধ ছিল না। হঠাৎ করে সেখানেও প্রত্যেক হলে এরকম জেলাওয়ারী রেষারেষি শুরু হলো। কিছুদিন পরেই মধ্যরাতে এর বিস্ফোরণ ঘটল। বারান্দা জুড়ে প্রচণ্ড দাঁপাদাপির ফাঁকে কয়েক রাউন্ড গুলি হলো। নীচেয় কাউকে বেদম পেটানোর শব্দ শুনে রুমের সবাই আমরা একরকম কাঁপতে লাগলাম। আর আমাদের পালোয়ান-বাহাদুর আরশাদ, উনি জানালা খুলে নীচে গেটে-বারান্দায় উঁকি দিলেন। সাথে সাথে নীচ থেকে চিৎকার এলো, এই কোন্ শুয়োরের বাচ্চা রে! জানালা বন্ধ কর, নাই গুলি করবো। রুমের সবাই অস্থির হয়ে ওঠায় আরশাদ জানালা বন্ধ করলে আমি গিয়ে ওর জামার কলার ধরে টেনে এনে মেঝেয় পাতা ওর বিছানায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম -- বোকা চোদা, পারো না বাল ফালাতি, আবার ফুটানি! শুয়ে থাক্ বোদায়!

মেজাজ এতটা তিরিক্ষি হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। নাজানি রাতের অন্ধকারে কোন্ গ্রুপের হাতে হলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায়! আবার ক’দিন থেকেই শুনছিলাম যে-কোনো মুহূর্তে হল রেইড হতে পারে। সামনে অনার্স ফাইনাল। এসময়ে ডিস্টার্ব হলে! কি এক অস্বস্তি নিয়ে শুয়ে পড়লাম।

ভোর-রাতে হল-বারান্দায় বুট-জুতোর আওয়াজ শুনে সবার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে থেকে মনে হলো দরজাটা কেউ বন্ধ করে দিল। একটু পরই দরজায় ঠক ঠক করে মোটা গলায় আওয়াজ, খোলেন তো ভাই!

বুকের মধ্যে ধপধপ করতে লাগলো। সবাই এ-ওর দিকে তাকালো। আমানুল ভাই ভালো করে লেপটা মুড়ি দিয়ে শুলো। মাস্টার্স পাশ করে সে হলে বসেই ক’বছর সাংবাদিকতার চাকরি করে আসছিল। ক্যাম্পাস-রিপোর্ট তার দায়িত্বে না। আরশাদই এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দিতেই ধুপধাপ করে কয়েকজন পুলিশ ঢুকল। এখানে-ওখানে, খাটের তলায়, লকারে এলোমেলো একটু হাতড়ে তেলাপোকাগুলোকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে তারা বের হয়ে গেল। বলে গেল, কেউ বাইরে বেরোবেন না।

শালার ঠোলার দল! লবডঙ্কা পাবে! সিট না পাওয়া বেশকিছু ছাত্র আর কিছু ছুরি-বটি ধরে নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করতে করতে ওরা চলে গেল। পেছন পেছন প্রভোস্ট স্যার ছুটলেন। একটা দায়িত্ব আছে না, থানায় গিয়ে ওদেরকে তো ছাড়াতে হবে। বহিরাগত-ক্যাডার-নেতারা সব আগেই খবর পেয়ে ভেগেছিল।

বুঝতে পারছিলাম না, সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে। যেভাবে দলের মধ্যে ভাগাভাগি বাড়ছে! বেশ ক’জন সিনিয়র ভাই হল ছেড়েছে। আমানুল ভাই তার লেপ-কম্বল নিয়ে গেছে গা। মাস্টার্সে এসে আরশাদেরও সিট হয়েছে। কিন্তু লাভ নেই। তাকে প্রায় প্রতিদিনই ফ্লোরে ঘুমাতে হয়। কিন্তু আস্তে আস্তে মনে হচ্ছিল তাকে ফ্লোরও ছাড়তে হবে। মাস্টার্স-এর শেষ পর্যায়ে এসে দলের মধ্যে বিভাজন এত বেড়ে গেল যে আমার তো-ভাইদের হল ছাড়তে হলো। নতুন নতুন ক্যাডারের আগমন ঘটল। তারা হলের সিনিয়র-জুনিয়র কিছুই মানে না। যাকে-তাকে থাপড়ায়, যার-তার বেডে বহিরাগত-ক্যাডার, ক্যাডার-ছাত্র তুলে দেয়। রাতদিন দাপাদাপি, হাই ভলিউম মিউজিক, এলোমেলো মেয়ের আনাগোনা। একটু ঝামেলাই মনে হতে লাগল। হল-ক্যাম্পাসের নানা অনুষ্ঠানে ‘হেইয়ো পিয়া’ আর ‘মেলায় গিয়া’ গানের কানফাটানো ড্রামের সাথে কতই তো নেচেছি। কিন্তু রুমের মধ্যে কাহাতক এটা সহ্য করা যায়! তবে প্রশাসন এর মাঝেও বেশ কড়া! বিশ্ববিদ্যালয়-দিবসে ভিসি স্যার বললেন, যে কোনো মূল্যে শিক্ষার পরিবেশ সমুন্নত রাখবেন! কি জানি কি করবেন!

আরশাদকে তো ওরা ধরেই নিয়েছে, এই শালা আদি-লীগের সমর্থক। ভেজাবেড়াল সেজে আছে। ওর উপর মানসিক অত্যাচারের মাত্রা এমন বেড়ে গেল যে আমার সত্যিই মায়া করতে লাগল। ছেলেটা পরীক্ষা শেষ করবে কেমন করে! যাকগে, পরীক্ষায় পাশ করাই তো জীবনের সাফল্যের একমাত্র উপায় না। যা হয় করবে!

কিছুদিন পরই পরীক্ষার সিডিউল পেলাম। হরতাল আর জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষা শেষ হলো। তত ভালো হলো না। তবে কেরিয়ার প্ল্যান থাকলে এসব ব্যাপার না। এমবিএ-টা করে ফেলবো, ব্যাস! আর আরশাদ কি পরীক্ষা দিল আল্লাই জানে। কিন্তু পরীক্ষা শেষ করার পরদিনই দেখলাম সে দরকারি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে হল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম। বলল, হল ছেড়ে দিচ্ছে। বললাম, তোমার তো সিটের মেয়াদ আরো কয়েক মাস আছে। ও কিছুই বলল না। ওর সেই বিখ্যাত চটের ব্যাগটা হাতে করে বেরিয়ে গেল। কেমন যেন লাগল। একটা ছেলে বটে! বললাম, আর জিনিসপত্র?

সে যেতে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, পরে এসে নিয়ে যাবে।

কিন্তু পরে আসার মতো পরিস্থিতি আর থাকল না। প্রতিদিনই মনে হতে লাগল হলের পরিস্থিতি পালটে যাচ্ছে। কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। সামনে জাতীয় নির্বাচন। কি এক কানাঘুষা যেন চলছে। হলে কোনো মিছিল নেই। কিন্তু অধিকাংশ সময় হলগেট এমনভাবে খোলা থাকে যে কোনোরকমে একজন যেতে-আসতে পারে। কি যে হবে! রেজাল্ট এখনো হলো না, বিসিএস সার্কুলারের কোনো খবর নেই! পরক্ষণেই ভাবি, যা হয় হোক। এমবিএ করছি। এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, নতুন নতুন ব্যাংক হচ্ছে। কয়েকটা নতুন ব্যাংকে ভাইভা দিয়েছি। একটাতে আশা করি হয়ে যাবে। আর যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, আমি চাইলে আরো দু-তিন বছর আরামসে হলে থাকতে পারবো।

নির্বাচনের তখনো সপ্তাহখানেক বাকি। একদিন গভীর রাতে সবার ঘুম ভেঙে গেল। আদি-লীগের শ্লোগান হচ্ছে দলের এই ঘাঁটিতে। হল কি দখল হয়ে গেল! কেউ জানালা খুলতে সাহস করছি না। ভাবছি, এই বুঝি ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ শুনবো, কাউকে বেদম পেটানোর শব্দ শুনবো। কিন্তু না, তেমন কিছুই হলো না। বাকী রাত না ঘুমিয়ে প্রায় পার করলাম। বেশ সকালে ভয়ে ভয়ে নীচে নামলাম। দেখলাম, হল থেকে বের হওয়ার জন্য এতকাল যে উত্তর দিকের গেটটার ব্যবহার হয়ে আসছিল সেটি বন্ধ। আর দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত দক্ষিণ দিকের গেটটি খুলে দেওয়া হয়েছে। গেটের দু’পাশে যে নেতা-নেত্রীর ছবি এতকাল শোভা পেত সেটি সরে গিয়ে অন্য নেতা-নেত্রীর ছবি শোভা পাচ্ছে। আর সেসব ছবি পাহারা দিচ্ছে তারাই যারা এতকাল দলের নেতা-নেত্রীর ছবি পাহারা দিয়ে এসেছে। আজব ব্যাপার! রেভলুশনাল ডেভেলপমেন্ট! সারাদিন ধরে গেট থেকে শুরু করে ছাদের পানির ট্যাঙ্কির গা পর্যন্ত আঁকা ছবিগুলোতে বিশ্রীভাবে কালিমা লেপন করে তার পাশে নতুন নেতা-নেত্রীর ছবি আঁকার কাজ চলল। বহুদিনের অব্যবহৃত দক্ষিণের পথটা ঘাস-পাথর-প্লাষ্টিকের জঙ্গল হয়ে ছিল। হাজার ছাত্রের চলাচলে ক্রমশ তা খটখটে হয়ে উঠতে লাগল। পাশের লন টেনিসের কোর্টটায় কবে কে টেনিস খেলেছিল কে জানে! চারপাশ ঘেরা লোহার জালে লতানো-পাতানো গাছে সারাবছর ছেয়ে থাকতো। একদিনেই সব পরিষ্কার। সত্যিই কি আরশাদের পরিবর্তন আমরা দেখতে পাবো? ক্যাডাররা সব কাটা রাইফেল ছেড়ে র‌্যাকেট হাতে নেবে! আহা, বেচারা আরশাদ! এসব পরিবর্তনের কিছুই দেখতে পেল না!

সন্ধ্যায় হলে ফিরে দেখলাম, চোখে পড়ার মতোই পরিবর্তন, উত্তরের চা-রুটি-বিস্কুটের দোকানগুলো সব দক্ষিণে এনে টেনিস কোর্টে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক’দিন থেকেই ভীষণ ভয়ে ভয়ে চলি। আমি যে দলের হল-সহসভাপতির তো-ভাই আমার ব্যাপারে নব্য আদি-লীগের এই সৈনিকদের মনোভাব কী হতে পারে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার তো-ভাইও ডিগবাজি দিল, না কি করল বুঝতে পারছিলাম না। তবে ক’দিন যেতেই লক্ষ্য করলাম, আমার ব্যাপারে সবার মনোভাব বেশ স্বাভাবিক। কেউ কেউ সিনিয়র হিসাবে একটু সালামও দেয়। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটল। এবং আমার তো-ভাই আরো ক্ষমতাবান হয়ে আদি-লীগের আরো বড় নেতা হয়ে ফিরে এল। কিন্তু উত্তরপাড়ার দু-একটা হলে তখনো দলের নিয়ন্ত্রণ থাকায় আমাদের হল-গেটের নিরাপত্তায় সশস্ত্র প্রহরা অব্যাহত থাকল। একদিন গেটে দেখা হওয়ায় আমার তো-ভাই বললো, সাবধানে চোখকান খোলা রাখবা। কোনো জেনারেলের নটি মাগীর বাচ্চা যেন হলে না ঢুকবার পারে!

ইতিমধ্যে আমার ব্যাংকের চাকরি কনফার্ম হওয়ায় হলে থেকে আরামে চাকরি করতে লাগলাম। এমবিএ-টাও চলছিল। জীবনে দারুণ একটা ডেভেলপমেন্ট ঘটলো রাজনৈতিক এই পরিবর্তনে। কিন্তু বয়স হয়ে যাচ্ছিল। আর হাত-মারতে ভালো লাগছিল না। একটা কলেজ পড়–য়া মেয়ে খুঁজছিলাম বিয়ের জন্য। আমার সহকর্মী রুমাকে খারাপ লাগে না। বুকে-পাছায় ভালোই বলতে হবে। কিন্তু অত বয়স্ক মেয়ে বউ হিসাবে ঠিক আমার ভালো লাগে না। কেমন যেন হিজড়া হিজড়া লাগে। জুটে যাবে হয়তো, খোদার লিখন যেখানে আছে। ক’দিন থেকে কেন জানি আরশাদের কথা মনে হয়। ও এখন কোথায় আছে? একদিন অফিস সেরে হলে ফেরার পথে হঠাৎই আরশাদের সাথে দেখা। টেলিপ্যাথী? আমার কেমন জানি মনে হলো। আমিই ছুটে গেলাম। জড়িয়ে ধরে বললাম, কি খবর তোমার? ও কোনো খবর না দিয়ে বললো, একটু হলে যাবে, রুমে যে-কিছু জিনিসপত্র আছে সেগুলো নেবে। যাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম, আরে গণেশ তো উল্টে গেছে। তুমি জানো না! এখন তো হল আদি-লীগের দখলে। উত্তরপাড়ার সব হল-ই প্রায় যায়-যায়। দলের কিছু নেতা হল ছেড়ে পালিয়েছে, বাকীরা সবাই আদি-লীগে যোগ দিয়েছে। আমার তো-ভাইও। ওরা তোমাকে এখন অনেক খাতির করবে, চলো।

আরশাদ খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে আমার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। আমি এটা-সেটা অনেককিছুই জিজ্ঞেস করলাম, ও কোনো-কোনোটার উত্তর দিলো, কিন্তু আমার ব্যাপারে কিছুই জানতে চাইলো না। হলের প্রশস্ত খেলার মাঠের মাঝ দিয়ে আড়াআড়ি হেঁটে আমরা হল-গেটে পৌঁছলাম। কি যেন একটা বুঝে ও পিছিয়ে পড়তে লাগল। আমি ডাকলাম, আরশাদ আসো। কিন্তু গেটের নব্য আদি-লীগ নেতারা আমাকে ইশারা করে হলে ঢুকতে বললো, আর আরশাদকে ডেকে দাঁড় করিয়ে জেরা করা শুরু করলো। সে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করলে আমার তো-ভাই চেয়ার ছেড়ে তেড়ে গিয়ে বলল, কুত্তার বাচ্চা! ভাগছোস্? দেহামু?

আরশাদ কোনো কথা না বলে ভেগে গেল। আর জীবনে এই প্রথম নিজেকে সত্যিসত্যিই অসহায় লাগলো। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলাম, সে সন্ধ্যা-শুরুর আলোয় হল-মাঠের ঘাসগুলোকে পায়ে পায়ে দু’ভাগ করে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়েই থাকলাম। কেন এমন হলো জানি না, ও হেঁটে যাচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল মাঠটা যেন ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে দক্ষিণপাড়া বিলীন করে দিগন্তে মিশে গেল। আমি শিকল-বাঁধা গেটের মধ্য দিয়ে কোনোরকমে বাঁকা হয়ে হলে ঢুকে ভাঙা ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। কিন্তু ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করতে পারলাম না। ক্যাপিটালিজম এখন স্যোসাল রেসপনসিবিলিটির দিকে টার্ণ করছে না?


লেখক পরিচিতি
রাখাল রাহা
জন্ম ১৯৬৯ সালের ১০ অক্টোবর। 

প্রধান সম্পাদক, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও নির্ঘণ্ট প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ‘সম্পাদনা’।
শিক্ষা : বিএসএস ও এমএসএস, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; এমএড, প্রাথমিক শিক্ষা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত গ্রন্থ : অমাবতী (উপন্যাস, ২০০৭); চাষাঢ়ে গল্প (গল্পগ্রন্থ, ২০১২)
sompadona@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ! অসামান্যও। যাপিত জীবনের একটি বিশেষ সময়ে, একজন মানুষের সত্ত্বায় বাস করা বিবিধ আচরণগুলোর এক চমৎকার বিন্যাস। পড়তে পড়তে এই আমি আর গল্পের আমি একাকার হয়ে যায়।

    উত্তরমুছুন