এমদাদ রহমানের গল্প : কয়েকটি প্রাচীন চাবি

নিরঞ্জনের কথা আপনেদের মনে নাই? ওই যে কিছুদিন আগে ডুগডুগি বাজাইয়া আপনেদেরে শুনাইল? তার কথা মনে নেই গো বাবুমশাই আপনেদের? এটা বড় দুঃখের। মনে লয় আমার কথাও আপনেদের কিছু মনে নাই। রাম রহিম যদু মধুর গল্প শুনাইলাম আর হারামজাদা নিরঞ্জন যে ডুগডুগি বাজাইল! নিরঞ্জনের কথা আপনেরা ভুলি যান কেমন করিয়া? আমি ভুলি নাই। কিন্তু তারে আমি রাখতেও পারি নাই। নিরঞ্জন ভেগেছে। তবে ডুগডুগি এখন যার হাতে দেখতে পাচ্ছেন, তার নাম দয়াল। ওরে অনেক খুঁজে পেতে এনেছি। দয়াল...

দয়াল হারামজাদা কোথায় ভাগল? এই দয়াল...

ওই যে বসি বসি পিচ্ছাব করতেছে। দেখতে পাচ্ছেন, একেবারে সাক্ষাৎ নিরঞ্জনের মতো না? ও আরো পটু। ডুগডুগি বাজাতে বললে এমন বাজান বাজায়, মনে লয় তামাম দুনিয়ার কানে বুঝি এবার তালা লেগে যাবে। দয়াল খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারে। বাঁশি কার না পছন্দ। কিন্তু ব্যাপার একটা আছে বটে। দয়ালের বাঁশি সব সময় বাজে না।

সে আপনেরা শুনবেন। বলি, শ্রবণ করিবেন।


আজ আমার কাছে বলার মতো কথা আছে দু খানি। একখানি কমলালেবু কিনবার আর আরেকখানি বুকের দুধ খাইবার। আচ্ছা, কন তো আমরা তো মায়ে দুধ খেয়েই বড় হয়েছি। কেহ কি এখানে আজ আছেন যে জননীর দুগ্ধ খান নাই? অভাগা। বড়ই অভাগা সেই জনা। জীবনের অন্তেবাসী। গানের কথা মনে আছে, মা জননী নাই রে যাহার... হ্যাঁ, অনেকদিন আগে যখন আপনেদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তখন এই তেঁতুলতলাটা যেমন ছিল, আজও তেমনটাই রয়েছে। বদল যা তা তো তেঁতুলগাছটার। বিস্তর ধুলা জমিয়াছে তাহার অলিগরি পাকস্থলীতে। মানে তাহার পত্রসমুদয় সবুজতা হারিয়েছে। আমার এক বৃদ্ধার কথা মনে আছে। তার পুত্র জমিজিরাতের বিরোধে খুন হয়েছিল। খুন হয়েছিল তার বাড়ির কোণে যে খেজুরগাছটা আছে তার গোড়ায়। বৃদ্ধা আজও অন্ধকার নিয়ে, কোটরাগত চক্ষু নিয়ে, কাঠি হয়ে যাওয়া হাত দিয়ে সেই জায়গার মাটি হাতড়িয়ে মরে— যদি ফের তার পুত্রকে পাওয়া যায়! আপনেরা সবাই মায়ের দুধ খেয়েছেন বাবু ভাইয়েরা? আমি খাইনি। আমার মতো অভাগা এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই।

আপনাদেরে বলতেছিলাম দয়ালের কথা। আমি তাকে পেয়েছিলাম এক ট্রেইন যাত্রায়। দয়ালের বাড়ি ছিল। বাপ-মা নাই। সংসারে নাকি কেউ-ই তার নাই। ভাইজানেরা, এমুন মানুষও কি দয়ালের দুনিয়ায় কেহ থাকে? থাকে বোধ হয়। না-হলে এই দয়ালরে মুই কেমনে খুঁজে পেলাম। নিরঞ্জনরে রাখতে পারি নাই। নিরঞ্জন মরে গেছে। নিরঞ্জন মরে গেছে ভাইজানেরা আমার। নিরঞ্জন মরে যায় কেন? কী সুন্দর ডুগডুগিটা বাজাইতে পারত ছেলেটা। তবে দয়ালও পারে। তার বাজানোতে তামাম দুনিয়া যেন নৃত্য করে। দুনিয়ায় যেন ভইছাল জাগে। লোকজন তার বাজনা শুনে দলা হয়। লিলামি ছেলেটার বাজনায় আপনেদের মতো লোকজন আসেন। আপনেদের সঙ্গে মোর গল্প জমে ওঠে। আমি বুঝতে পারি মানুষের জীবন সূর্য্যের মত। তাতে অনেক আগুন। অনেক তেজ। দুনিয়ার বরফ তাতে গলে। জলোচ্ছ্বাস তাতে দেখা দেয়। খরায় পুড়ে যায় জনপদের পর জনপদ, আর আমরা কয়েকজন লোক থেটার দেখতে চোখ পাতি। এই থেটারের একটা নাম দেন আপনেরা। আমি প্রস্তাব করি। এর নাম তেঁতুলতলার থেটার। আসুন, গল্প করতে করতে আগাই। জানেন, আমার না খুব কমলালেবু খেতে ইচ্ছা করে। কেউ কি দেবেন একটা? দয়াল ডুগডুগি বাজাও...

দয়ালের পেচ্ছাব করা আর শেষ হয় না। ছেলেটা কি শুধু পেচ্ছাবই করছে, নাকি অন্য কিছু? তার কি আজ বাজনা বাজাবার কোনও ইচ্ছা নাই? বাবুমশাইরা, দয়াল বাঁশি বাজাতে ওস্তাদ। ওর কাছে যে বাঁশিটা আছে, তার নাম মা। বাঁশির নাম কি কেউ মা রাখে? দয়াল রেখেছে। কেন রেখেছে আমি জানি না। দয়াল যখনই মাকে বাজায়, মানে বাঁশিটা বাজায়, তার মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে। একমনে বাজি বাজিয়ে দয়াল থুক করে একদলা রক্ত ধুলোয় ফেলে দেয়। দেখেছেন, ছেলেটার শরীরের কী হাল! কতো রক্তই বা তার শরীরে বহমান? মা তার সব রক্ত কেড়ে নিচ্ছে। দয়ালকে তার মায়ের গল্প বলতে বলেছি। সে বলতে চায় না। চাপাচাপি করলে এইটুকু মাত্র বলে যে, বলব। তোমার সঙ্গে যেহেতু আছি গল্প তো বলবই। বলব আর কাকে। বাঁশির নাম মা। মাকে বাজালে দয়ালের মুখ রক্তে ভেসে যায়। ভয়াবহ যন্ত্রণা ভাইরে। এ জ্বালা সহা যায় না। অথচ প্রতিরাতে দয়ালের বাঁশি না শুনলে মনে হয় দম নাই। বুকে বাতাস নাই। লাশ হয়ে পড়ে আছি। কীভাবে এর হাত থেকে আমি মুক্তি পাই জানি না। কেউ যদি জানেন তো আওয়াজ দেন। আমি আপনাদের কাছে গিয়া মুক্তির উপায় জানিয়া লই।



বাবু মশাইরা আসেন আরও কিছু দৃশ্য দেখি— মানিক কমলালেবুর দাম জানতে চায়। হালি পঞ্চাশ টাকা। পাশে আরেক স্তূপ কমলা। একটু ছোট সাইজ। এই কমলা চল্লিশ টেকা হালি। এর পাশে আরেকস্তূপ। এর দাম ষাইট টেকা। মানিকের মাকে মনে পড়ে। হাসপাতালে মাকে শুইয়ে রেখে এসেছে সে। মায়ের যে কী রোগ হল। ভাত খেতে পারে না। গলায় আটকে যায়। পেটের ভিতর ব্যথা। দিনরাত মায়ের পেটে খালি ব্যথা। ব্যথার ভয়াবহ যন্ত্রণা। ছটফট। কিন্তু কমলালেবুর এতো দাম হলে চলে? এতো দাম হবে কেন? কমলালেবু তো মানুষেই খায়। গাছের ফল। সে কী করে এখন মাকে কমলালেবু কিনে দেয়? মানিকের বুক ফেটে যায়। চোখ বাধা মানে না। ভিজতে থাকে। ভিজতেই থাকে। একহালি কমলা যে করেই হোক তাকে কিনতে হবে। মা রাতে হাসপাতালে ঘুমিয়ে স্বপ্নে মরণ দেখেছে। দেখেছে কে যেন তার জন্য শাদা শাড়ি নিয়ে এসেছে। নিজ হাতে গোসল করিয়ে শাদা শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে!

সকালবেলা মায়ের জন্য একটু জাউ নিয়ে গেলে সে দেখে পাশের বেডের রোগী কমলালেবু খাচ্ছে। কী ঘ্রাণ! জিবে তৎক্ষণাৎ জল কাটে। মুখ ভর্তি হয়ে সেই জল পেটে চালান হয়। সে মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের মুখেও কি জল কাটছে? সে মায়ের সামনে জাউয়ের বাটি খুলে দেয়। মা খেতে পারে না। একটু মুখে দিতেই বমি আসে। কিন্তু কমলালেবুর অদ্ভুত গন্ধ তার বমি আটকে দেয়।

মানিক ভাবে, যে-করেই হোক বিকালে বা রাইতে মায়ের জন্য একহালি কমলা কিনতেই হবে। তার আছকিরের কথা মনে পড়ে। যদি কয়টা টাকা ধার দেয়? অবশ্য অন্য এক উপায়ও আছে। সে আজ আছকিরের লগে ঘুমাবে। কেউ কারো সঙ্গে ঘুমালে টাকা পাওয়া যায় এটা মানুষের যত আবিষ্কার আছে, সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। দয়াল— বাজাও...

ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ...

অথচ, আমার প্রাণ আটকে থাকে বেহালার তারে। মানুষের ভেতর নাকি পৃথিবীর সব বাদ্যযন্ত্র লুকানো আছে। বেহালা খোল করতাল সারেঙ্গি মন্দিরা... রাত্রিবেলা যখন মানুষ একা হয়, যখন তার ঘুম আসে না, যখন হারিয়ে ফেলা ছোটবেলা তার কাছে পুনর্বার ফিরে আসতে শুরু করে, বাদ্যযন্ত্রগুলো কোলাহল করে ওঠে। তারা বাজতে শুরু করে। কী গান গুঞ্জরিত হয় তখন? তখন কেউ কি কথা বলে? সে কথা কি শোনা যায়? কেউ কি মিঠে স্বরে কিছু কথা বলে? বলে না। শুধু একতারা দোতরার তারে সুর কথা কয়। মানুষের চোখের কোণ তখন আনন্দে ভেসে যায়। দুঃখে ভেসে যায়। বুক প্লাবিত হয় গোপন কান্নায়। নিজেকে কতো আপন করে জড়িয়ে থাকা যায় তখন। তাই মাটি, তোমাকে প্রণাম। তুমি বীজ অঙ্কুরিত করো। তাতেই বৃক্ষ। তাতেই শস্যদানা। তাতেই বাঁচা। তাতেই নবজাতক। কান্না। হে বংশীবাদক, বাজাও...

ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ...

এবার ছাতিমের গল্প বলি। রামচন্দ্রপুর গ্রামে এই একটাই ছাতিমগাছ। ফটিকদের ঘর এই ছাতিম গাছটার কাছে। তাতে ঝিম মেরে বসে থাকে এক প্রাচীনকালের শুকুন। ঠায় বসে থাকে। দিবসবেলায় কেউ তাকে একচুল নড়তে দেখে না। মানুষ দূর থেকে শকুনটারে প্রণাম জানায়। ফটিক এখানকারই বাসিন্দা। এই ফটিক ছাতিমতলায় বসে রাইতের বেলা শুধু ডুগডুগি বাজায়। আর কিছুই আমি জানি না। এই ফটিকই কি আমার সেই নিরঞ্জন? আপনেরা কিছু জানেন, বাবু মশাইরা?



বাবু মশাইরা, আমার সময় শেষ। ট্রেইন আসছে। ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আমি ও দয়াল এইবার চাকায় চড়ব। যাবো অন্য জনপদ। গল্প সংগ্রহ করতে। আমার বুকে আর কোনও কথা নাই। এবার বাহির হইতে হবে। শেষ বারের মতো গল্পের যেটুক এখনও বলা হয় নাই, সেটুক শুনেন। দয়ালের বাঁশি এখন বাজতেও পারে। দয়াল?

না। দয়াল এখন আর বাজাবে না। তার মা এখন আর বাজবে না। তারচেয়ে পুরোনো ডুগডুগিটাই বাজুক। বাজাও দয়াল... ডুগডুগডুগডুগডুগ... কিছু গল্প বাকি ছিল, আপনেরা শুনতে থাকেন। আমার ট্রেইন এসে গেছে। গেলাম। যেতে যেতে কারখানার চিমনি নির্গত মিশকালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীদের চাঁদের দিকে উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আমি আপনেদের কথাই ভাবতে থাকব। কারখানার চিমনি মিশকালো ধোঁয়া চাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারে। মিশকালো ধোয়া কোথাও যেতে পারে না বলে চাঁদের দিকে যায়। আমি যাই নতুন জনপদে। সেখানে নিতাই নামের মানুষ আছে। সে এখন তার বৌয়ের কাছে যায়। বউ দুইটা কমলালেবু বের করে। গন্ধ তার খিদা উসকে দেয়। সে দ্বন্দ্বে পড়ে। তুই কমলা পাইলে কই?... সেখানে গল্প আছে।



তবে বলে রাখি এই যে লোকাল ট্রেইনটা ইস্টিশনে প্রবেশ করছে, তাতে কতো লোক আছে জানেন? সেখানে কতো ক্রোধ আছে জানেন? ভাইরে, মানুষ যেখানে আছে, সেখানে ক্রোধ আছে, জিঘাংসা আছে, ছুরির চকচকে ফলা আছে, নবজাতক আছে, ভালোবাসার ঘরছাড়া আছে। মানুষ কিসের টানে যে ঘর ছাড়ে! খেয়াল করলেই দেখবেন এক যুবক এক মেয়ের হাত ধরে ট্রেইন থেকে নামছে। তারা আজ ঘর ছেড়েছে। এই দুজন পরস্পরকে ভালোবেসেছে। তারা এই শহরে গোপনে ঘর বাঁধতে এসেছে। কেউ যাতে তাদের খুঁজে না পায়। তারা পলাতক। সঙ্গে পয়সাকড়ি তেমন নাই। যুবক কবিতা লেখে, মেয়েটা ছড়া। ট্রেইনে এই শহরে আসতে আসতে মেয়েটা মনে মনে একটা ছড়া লেখেছে। কুমড়ো ফুল কুমড়ো ফুল, করলি তুই মস্ত ভুল। তারপর সে কল্পনা করেছে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। বাচ্চাটা সুন্দর কথা বলতে শিখেছে। কি সুন্দর বাবা বলে ডাকে। বাচ্চাটাকে সে ছড়াটা শিখিয়ে দিল। কুমড়ো ফুল কুমড়ো ফুল, করলি তুই মস্ত ভুল...

মা, তারপর কী?

মা পরেরটুকু আর লেখেনি। সে আনন্দে, ভেজা চোখে বাচ্চাটার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে তাকে।

বাবুমশাইরা, আসেন, থু থু নিক্ষেপ করি। বাদ্যযন্ত্র বাদে আর যতো যুদ্ধযন্ত্র রয়েছে, তাদের উদ্দেশে থু থু নিক্ষেপ করি। দেখি কার থু থু কতো দূর যেতে পারে। পৃথিবীর স্থানে স্থানে ছড়ানো পরাশক্তিগুলোর গায়ে আমাদের থু থু লাগে কি না পরীক্ষা করে দেখি। ভয় নাই। আমরা জঙ্গলের পুত্র। আমরা মাটির জন্য কাঁদি। মাটির উর্বরাশক্তির জন্য কাঁদি। মাটি কষ্ট পেলে আমরা ঘুমাতে পারি না। আসেন, মাটির জন্য কাঁদি। যুদ্ধবাজরা মাটির কথা ভাবে না। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত অরণ্য কার ওপর স্থিত? মাটির ওপর। তাতে চাষ হয়। তাতেই শস্যদানা। তাতে সবুজ ফসল, বাতাসের আদরে নাচতে থাকে।

এই ট্রেইনে হরমুজ আলিও আছে। সে আমার বন্ধু। তার ঝোলায় কয়েকটা বাঁশি আছে। লোকটা আজব কিসিমের। কারও যদি চক্ষে কোনও সমস্যা থাকে, তো সোজা হরমুজ আলির কাছে চলে যাবেন। তার কাছে লতাপাতা আছে। শামুকের খোল আছে। কাছিমগালা আছে। ব্যাঙের হাড় আছে। পাখির পালক আছে। শকুনির ঠ্যাং আছে। বেড়ালের চক্ষু আছে। দুই চক্ষে দুই ফোঁটা থানকুনি পাতার রস ফেলে সে বাড়ি যেতে বলবে। দুটো টাকা দিতে ভুলে যাবেন না বাবুমশাইরা। হরমুজ আলি মাত্র একবেলা খায়। চব্বিশ ঘণ্টার একেবারে মাঝামাঝি টাইমে সে পেটে খাদ্য পাঠায়। এই শেষ। ঘুমানোর কথা সে কখনোই ভাবে না। এখানে যারা অবসরপ্রাপ্ত আছেন, যারা একসময় বেদম লেফ-রাইট লেফ-রাইট মেরেছেন, দীর্ঘদিন বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিসে কাজ করতে করতে, করতে করতে... তাদের জন্য, এখন অবসরপ্রাপ্তির পর জীবনকে আর জীবন বলে ভাবতে পারেন না যারা, হরমুজ আলি তাদের জন্যই কয়েক রাইত এই শহরে থাকবে। আপনারা কান পাতবেন। শুনবেন, রাত্রি গান গাইছে। মিহি দানাদার সুর কোথাও যেন ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হবে এতোদিন কোথায় ছিল বসন্তের পাখিরা। এতোদিন কেন তারা কোলাহল করেনি। আপনাদের পরম শান্তির ঘুম আসবে। ভোরে জগিং করতে বেরুলে মনে করে ইস্টিশনের প্ল্যাটফরমে যাবেন। তাকে মাত্র দুটো টাকা দিলেই হবে। হরমুজ আলি তাতেই খুশি।

দয়াল...

ডুগডুগডুগডুগডুগডুগডুগ...

আমার বন্ধু ইতালো একটা রূপকথা বলেছিল। বাবু মশাইরা আপনেদের বলেই ফেলি। সেও বাঁশি বাজানো নিয়া। এক চাষির ছেলে বাঁশি বাজাতো। দিনরাত শুধু বাঁশি। শুধু সুর। শুনেন তাহলে... চলেন কল্পনা করি। একটা বাড়িতে সার সার ঘর। সেই ঘরে কোনো শিশু নেই। শুধু বৃদ্ধরা বাস করে সেখানে। আর সেই বৃদ্ধ শকুনটাও। শকুনটার কোনও সারাশব্দ নেই। যেন মৃত। যেন মৃত্যু এসে বধ করে গেছে তাকে। শকুনটা তাকিয়ে আছে বৃদ্ধদের দিকে। বৃদ্ধরা শুধু মৃত্যুকেই কামনা করছে। আমাদের ভাবনায় বারবার কেন মৃত্যু প্রসঙ্গ হয়ে ফিরে আসে বলতে পারেন? কারণ, আমরাই মৃত্যুকে লালন করেছি। আমরাই বধ করেছি প্রাণিসকলকে। আমাদের জঠরে বড় খিদা। সেই কালের কথা স্মরণ করেন বাবু মশাইরা। দয়াল...

ডুগডুগডুগডুগডুগ...

সেই কালের কথা স্মরণ করেন আপনেরা। সকলে। কেমন ছিল সেই কাল? যা যা ঘটিয়েছি আমরা, সবই, সব ফিরা আসবে। আমাদের প্রাণেই ফের সবকিছু উত্তর প্রতি-উত্তর হয়ে বিদ্ধ হবে। ছুঁড়ে দেয়া সেইসব তীর তীব্রবেগে বিদ্ধ হবে আমাদেরই হৃদপিণ্ডে।

এই আখ্যানে যুক্ত হবে কমলালেবুর গন্ধ। আর মানবজন্মরোধী কনডমের কথা। শিশুরা খেলবে। তারাই তো বিদ্ধ হবে বারবার। শুনুন তাহলে, গল্প শুনুন।

তার আগে চলুন একটা বাড়ির কথা কল্পনা করি। তারও আগে কল্পনা করি পাকা সড়কপথের কথা। তারও আগে স্মরণ করি চাকার কথা। যে চাকা গ্রামে গ্রামে নিয়ে এল ইট-সিমেন্ট-বালি। একদিন কী হল...



সে লাঠিটাকে সামলে ল্যাংচায়। নিজেকেও তার সঙ্গে সামলে নেয়। ওপরে বেয়ে ওঠার প্রস্তুতি। এখন তাকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে। মানিক একটু থামে। প্রথম ধাপের রেলিঙ বাম হাতে ধরে একটা ধাপ টপকায়। দমের দরকার তাই বুক ভরে দম নেয়। ইতিউতি কাউকে খোঁজে। যদি কারও হাতে জাউয়ের বাটিটা ধরিয়ে দেয়া যেত। আর-সময় তো লোকের অভাব হয় না। আইজ কেউ নাই। গামছা দিয়ে বাঁধা জাউয়ের বাটিটা যদি উলটে যায়! ডাইন হাতে লাঠি আর জাউয়ের বাটিবান্ধা গামছার গিঁট শক্ত করে ধরে বাঁ’হাতে রেলিঙ চেপে সে তিন ধাপ পেরোয়। এই তিন ধাপেই হাঁপ ধরে যায়। এই তো আর মাত্র কয়েকটা ধাপ। সে পিছু ফিরে চায়। না, আইজ কেউ নাই। দরকারের সময় কেউ কাছে থাকে না। শালার দুনিয়া। চুদন। যদি কেউ আসত, তাহলে অনুনয় করে জাউয়ের বাটিটা ধরিয়ে দেয়া যেত। হাসপাতালের ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগে। এই গন্ধ কেন যেন টক টক লাগে। পেট এই গন্ধে খালি গুলায়। পেটের মাল বাইরে খালাস হয়ে যেতে চায়। তার বুক কষ্টে ভেঙে যায়। আজও মায়ের জন্য কমলা কিনতে পারল না। বালের টাকা নাই তো কেমনে কিনা যায়। গাছের ফলেরও কত দেমাক। ষাইট টেকা, সত্তইর টেকা, পইঞ্চাশ টেকা। শাউয়া। মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় মানিক। হাতের লাঠিটা তো বেশ শক্ত। দেবে নাকি মাথায় বাড়ি গোটাকয়েক? ফল বেচার শখ ভোঁতা করে দেবে নাকি এক ডান্ডায়? শালার কমলার দাম বুলে ষাইট টেকা আ’লি। চুদি। তোর বউরে মুই চুদি রে। হারামজাদার মাথায় ঠাস করে বাড়ি মেরে যুদি কয়েকটা কমলা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যেত? সে আর ধাপ পেরোতে পারে না। এক জটিলতার ঘেরাটোপে জড়িয়ে পড়ে। তার মনের ভিতর এখন ক্ষুব্ধ কিছু সংলাপ তৈরি হয়।

দাম কতো?

বিক্রেতা ডাইন পাশে স্তূপ করে রাখা কমলা দেখিয়ে বলে : একদাম পইঞ্চাশ। পাঁচপাইও কম অইত নায়।

আর ইবায়?

অর্থাৎ, মাঝখানের স্তূপের কমলাগুলোর দাম?

বিক্রেতা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে : খামোখা দামদর করিয়া টাইম নাশ করিস না। যিতা কিনার ভাগ নাই, ইতার দাম করস কেনে?

এই কথাটার অপেক্ষায় ছিল মানিক। সে তেঁতে ওঠে।

এই ব্যাটা চুপ। বেশি মাতস কেনে, তরে কইলাম দাম কত কইতে?

হারামজাদা ভাগ। ফকিরনির পুয়ায় বুলে কমলা কিনব। ভাগ।

মানিক প্রস্তুতি নেয়। বাম পায়ে ভর দিয়ে দুহাতে লাঠিটা মাথার উপর তুলে ধরে। লাঠি শূন্যে। লাঠি আকাশে পাক খায়। লাঠি কথা বলে। একটা মর্মান্তিক শব্দ হয়। ফল বিক্রেতা দুহাতে মাথা চেপে বসে পড়লে দুইটা বড় সাইজের কমলা নিয়ে মানিক ল্যাংচাতে থাকে। ততক্ষণে সিঁড়ির ধাপগুলো ভেঙে সে সমতলে পৌঁছেছে। এখন আর মিনিটখানেকও লাগবে না। মায়ের পেটে নিশ্চয় ভুখ লেগেছে। কিন্তু মা তো কিছু খেতে পারে না। সে পিসিকে বলেছিল, জাউত থুরা মেথি দিয়ো। ঘেরান অইব। মেথির ঘেরানে জাউ খাওয়া যায়। পিসি আজ জাউয়ে তাই মেথি দিয়েছে। মেথির ঘেরানে মানিকের মুখ এখন জল কাটছে।

হাসপাতালে এলেই তার বুকে মৃত্যুভয় ঢুকে পড়ে। কতো মানুষ এখানে এসে মারা যায়। হাসপাতালে শুধু লাশ আর লাশ। মানুষ নিজের ঘরে মরতে পারে না? মানিক এই সহজ কথাটা কোনোভাবেই বুঝতে পারে না যে মানুষ কেন মরার জন্য হাসপাতালে আসে।

মানিকের কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট। সে দেখে হাসপাতালের রোগীরা কাঁদছে।

ডাক্তার আসে। ডাক্তারের গলায় নল ঝোলানো। এটা দেখে রোগীর প্রাণে যেন হাওয়া খেলে। ডাক্তার এসেছে মানে তো চিকিৎসা এসেছে, মানে তো জীবন এসেছে। আর মরতে হবে না। খালি বাঁচা। বছরভর বেঁচে থাকা। কোটরাগত চোখ নিয়েও দিনদুনিয়ার আলোছায়া দেখা!

ডাক্তার রোগীর বুকে নল লাগায়। নাড়ি টেপে। কাগজে খসখস করে হিজিবিজি লেখে। ইনজেকশন। স্যালাইন। লাগ ভেলকি লাগ। দয়াল...



ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ-ডুগ...



অনুবাদক পরিচিতি
এমদাদ রহমান 

গল্পকার
অনুবাদক।
জন্ম সিলেট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইংলন্ডে থাকেন। 
প্রকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. মাহমুদ হাসান পারভেজ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪ এ ১২:৫৪ PM

    অনুভুতি: মনে হলো কোন থিয়েটারে বসে দেখলাম। ভাল লাগল।
    এবার প্রাচীন চাবিগুলি নিয়ে ভাবছি। ভাবছি। এবং দেখছি।

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারণ! স্বতন্ত্র উপস্থাপন। ঝরঝরে লেখনিতে কাহিনী এগিয়ে গেছে দৈনন্দিন যাপিত জীবনের পরিচিত দৃশ্য নিয়ে যেগুলো আগে এভাবে দেখা হয়নি। তেঁতুলতলার মঞ্চে একের পর এক চরিত্রাভিনেতার ছন্দবদ্ধ আগমন এবং প্রস্থান ঘটেছে। সার্থক তাদের অভিনয়। ক্ষীণদৃষ্টির দর্শকের জন্য নাট্যকার এবং কুশীলব দায়ী নয়। যতবার ডুগডুগি বেজেছে ততবার জীবনটাকে বাঁদরের নাচই মানে হয়েছে। ইমপ্রেশনিজমের প্রভাব গল্পটিকে আরো চিত্তাকর্ষণীয় করেছে। লেখক এমদাদ রহমানকে ধন্যবাদ, অনবদ্য গল্পটির জন্য।

    উত্তরমুছুন