তারাপদ রায়ের গল্প : কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি

আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে দিয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের, মানে তৎকালীন পঞ্চায়েতের রাস্তাটা ছিল খুব নিচু। সেটা ছিল ইংরেজরা যাকে বলে ফেয়ার ওয়েদার রোড। অর্থাৎ, ভাল আবহাওয়ায় ব্যবহার করা যায়। অন্য সময়ে জল-কাদার জন্যে যাতায়াত কঠিন। তবে, বর্ষাকালে ধলেশ্বরীর জল ওই রাস্তা দিয়ে ঢুকে যেত। রীতিমত স্রোত। নৌকো চলে যেত ওই রাস্তা ধরে। তখন আমাদের গ্রাম হয়ে উঠত ভেনিস শহরের মতো। প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে একটা করে নৌকো। এ বাড়ি-ও বাড়ি যাতায়াত হত নৌকোয়। বাজারে, ইস্কুলে যেতে হলে নৌকো ছাড়া গতি নেই।


আমাদের বাড়ির সদরে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তার পাশ ঘেঁষে একটা প্রাচীন কাঁঠালগাছ ছিল। বর্ষাকালে যখন খাল দিয়ে নৌকো চলাচল শুরু হত, ওই কাঁঠালগাছটার গুঁড়ির সঙ্গে নৌকো এসে বাঁধত। আমাদের বাইরের বাড়ির সামনের অংশটুকুর নামই হয়ে গিয়েছিল কাঁঠালঘাট। কেউ কেউ বলত, মান্ধাইঘাট।

আমাদের টাঙাইল জেলার উত্তরে মধুপুরগড়ে আদিবাসী মান্ধাইদের বাস। মকাই, রাঙাআলু, কাঠ, টিয়াপাখি আর কাঁঠাল নিয়ে আসত মান্ধাইরা আমাদের এলাকায়। এই রকমই একটা কাঁঠালের বিচি থেকে আমাদের কাঁঠালঘাটের গাছটা জন্মেছিল অনেক কাল আগে। সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলের গাছ সমতলে জন্মাতে বা বাড়তে চায় না, কিন্তু এই গাছটা জন্মেছিল এবং মহীরুহের চেহারা নিয়েছিল। খুব উঁচু নয়, কিন্তু বিশাল চওড়া। ঘন কালো পাতায় ছাওয়া গাছটিকে দেখলে মনে হত ওর নীচে দু’দণ্ড বিশ্রাম করি। বিশাল গোল গুঁড়ি, ডালে ডালে নানা জাতের পাখির বাসা। একসঙ্গে কাঁঠাল হত তা অন্তত হাজার খানেক। একেবারে গাছের গোড়া থেকে গুঁড়ি ঘিরে ছোট ছোট খাজা কাঁঠাল।

আমরা তো সারা বছরই শহরের বাড়িতে থাকতাম। গ্রামের বাড়িতে থাকতেন ঠাকুরদার বিধবা খুড়িমা। তিনি মন্দির- বিগ্রহ জমি-জিরেত ইত্যাদি প্রবল প্রতাপে দেখাশুনো করতেন। তাঁর কথা অমান্য করার লোক আমাদের সংসারে বা আশেপাশে কেউ ছিল না।

সে বছর খুব বর্ষা হয়েছিল। আমরা শহর থেকে রথের মেলায় গিয়েছিলাম। আমি দাদা আর মা। ঠাকুরদা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে সহায়িকা ছিলেন আন্নামা নামে আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, বিধবা, আমাদের বাড়িতেই থাকতেন, কাজকর্ম করতেন।

সে বার রথ পড়েছিল সপ্তাহের শেষে। ঠাকুরদা ঠিক করেছিলেন আমাদের সবাইকে নিয়ে রথের মেলার পরে গ্রামের বাড়িতে রাত্রিবাস করে পরের দিন থেকে, সন্ধেবেলা ফিরবেন। আমাদের বাড়ি থেকে রথের জায়গাটা ছিল মাইল পাঁচ-ছয় দূরে। আর, সেখান থেকে আমাদের গ্রাম ছিল আরও ছয় মাইল দূরে।

রথের মেলা থেকে প্রচুর ফজলি আম, ধামাভর্তি বিন্নি ধানের খই আর চিনির মঠ, কিছু গৃহস্থালির জিনিস, বঁটি, দা, বেতের ধামা— এই সব কিনে আমরা সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় মান্ধাইঘাটে পৌঁছলাম। জলে টইটম্বুর গ্রামে মান্ধাইঘাট ও তার পিছনের মন্দির-উঠোন, বাসাবাড়ি এগুলিই যা একটু কচ্ছপের পিঠের মতো উঁচু হয়ে রয়েছে। ঘাটে নৌকোর গাদাগাদি ভিড়।

আমরা পৌঁছতেই মালিকের নৌকো দেখে সবাই নিজেদের নৌকোগুলো একটু একটু সরিয়ে ঘাট পর্যন্ত আসার জায়গা করে দিল। আমরা ঠিক সময়ে এসেছিলাম। আমরা নামতে নামতে প্রচণ্ড বেগে ঝড় এল। মন্দিরের চাতালে দু-একজন লোক প্রসাদ খাচ্ছিল। তারা দৌড়ে ছুটে গিয়ে মন্দিরের মধ্যে আশ্রয় নিল। আমরাও তাড়াতাড়ি উঠোনটুকু পেরিয়ে আমাদের কোঠাবাড়ির বারান্দায় উঠলাম। খুড়িঠাকুমা লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভেতরের বড় ঘরটায় একটা ছোট হ্যাজাক জ্বলছে।

এ বাড়িতে এক সময় একসঙ্গে পঁচিশ-তিরিশ জন লোক থাকত। বড় বড় তক্তপোশ, এক একটায় চার-পাঁচ জন শুতে পারে। ঘরে ঢোকার পর মা ঠাকুরদাকে বললেন, ‘রথের মেলার জিনিসপত্র সবই তো নৌকোয় রয়ে গেল।’

ঠাকুরদা বললেন, ‘নৌকো দড়ি ছিঁড়ে যদি ভেসে না যায়, তবে এই ঝড়ে কিছু হবে না; তা ছাড়া, নৌকোর মাঝিরা তো আছে।’
সাধারণত, ভরা বর্ষায় কখনও তেমন ঝড় হয় না। কিন্তু আমাদের ওখানে আষাঢ়-শ্রাবণে কখনও কখনও হঠাৎ প্রবল ঝড় হত।

সে দিন সেই ঝড় গভীর রাত পর্যন্ত ছিল। সব চেয়ে আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে ঝড় থামার পরে। তখনও বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি থেমে থেমে পড়ছিল। রাতে মা খুড়িঠাকুমার সঙ্গে পাশের ঘরে শুলো। আমি দাদা আর ঠাকুরদা বড় ঘরটায় শুলাম। তার আগে আমি আর দাদা গাছপাকা মর্তমান কলা আর ফজলি আম দিয়ে দুধভাত খেয়েছি। দুধভাত অবশ্য আমাদের নিয়মিত নৈশ খাদ্য ছিল। অন্যেরা তাজা ইলিশমাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছিল।

তখন ধলেশ্বরীতে প্রচুর ইলিশ। আমার মা খুব ইলিশ ভালবাসতেন। ঠাকুরদা তো সন্ধ্যার পর প্রায় কিছুই খেতেন না। বাতাসা কিংবা হাল্কা দুধ খই দিয়ে খেতেন।

বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মাঝরাতে প্রচণ্ড শব্দে আর একটা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল। মান্ধাইঘাটে মানুষদের আর্ত চিৎকার। কয়েকশো পাখির সমবেত কলরব। গ্রাম্য কুকুরের গর্জন। ঘটনাটা কী, আমরা বুঝবার আগে ঠাকুরদা বললে, ‘ভূমিকম্প’!

একটু পরে ঘাটের মাঝিমাল্লারা কোঠাবাড়ির বারান্দায় উঠে এল। আমরা বেরুতে গিয়ে দেখি সামনের দরজা খোলা যাচ্ছে না। পিছনের দরজা খুলে উঠোন ঘুরে বাইরে আসতে দেখি বিশাল কাঁঠাল গাছটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

তাড়াতাড়ি হাত-দা এনে সামনের ঘরের দরজার মুখে ডালপালাগুলো কেটে সরিয়ে দিয়ে বেরুনোর রাস্তা করা হল। খুড়িঠাকুমা কিন্তু নির্বিকার। মার কাছে শুনেছি, প্রথম শব্দটা হওয়ার পরে তিনি নির্বিকার ভাবে মালা জপা শুরু করেন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। এবং মাকে ইশারায় তাঁর পাশে বসে থাকতে বলেন।

গ্রামসুদ্ধ লোক ওই গভীর রাতে ভিড় করে দেখতে এল এই সাংঘাতিক কাণ্ড। মান্ধাইঘাট থেকে আস্তে আস্তে নৌকোগুলো অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রওয়ানা হল। একটা নৌকোরও কোনও ক্ষতি হয়নি, কারণ গাছটা সামনের দিকে শুকনো ঘাট আর মন্দিরের চাতালের ওপর পড়েছিল। অল্পের জন্য মন্দির আর কোঠাবাড়ি বেঁচে গেছে। গ্রামের সবাই বলাবলি করছিল এই কাঁঠাল গাছটা তারা সবাই জন্ম থেকে দেখছে। কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়। কিন্তু লোকে এ রকম ভাবতে ভালবাসে।

পর দিন লোকজন লাগিয়ে গাছের ডালপালা ছেঁটে পরিষ্কার করা হল। গ্রামের লোকেরা এসে একটা দুটো করে কাঁচা কাঁঠাল নিয়ে গেল। ছাগল খুব কাঁঠালপাতা খেতে ভালবাসে। এই বর্ষার মধ্যে বেলা হতে না হতে কোথা থেকে দু-তিনটে ছাগলও চলে এল কাঁঠালপাতা খাওয়ার জন্যে। শেষরাতে বৃষ্টি থেমে গেছে। ঠাকুরদা আমাকে আর দাদাকে নিয়ে একটা ডিঙিতে করে গ্রামের কিনারে গিয়ে মাঝিদের কাছ থেকে বড় বড় কয়েকটা ইলিশমাছ কিনে আনলেন। সে দিন দুপুরেও ইলিশমাছ।

ইলিশমাছের তেল দিয়ে ইলিশমাছের গাদা ভাজা, হাল্কা সরষে দিয়ে ভাপা ইলিশমাছের পেটি, ইলিশ পাতুরি, ইলিশমাছের ঝোলভাত, শোলাকচু দিয়ে ইলিশমাছের মাথা আর পাকা তেঁতুল দিয়ে ইলিশমাছের ল্যাজার টক। কিশোর রসনার সেই পরিতৃপ্তির স্বাদ আজও জিভে লেগে রয়েছে।

পর দিন ঠাকুরদার কাছারি খোলা। সুতরাং সন্ধ্যাবেলা রওয়ানা হতেই হল। আমরাও সঙ্গে ফিরলাম। তবে, আসার আগে একটা ব্যাপার ঘটল। খুড়িঠাকুমা একটা গোলমাল পাকালেন। এ রকম তিনি প্রায়ই করতেন। তিনি ঠাকুরদাকে বললেন, ‘ফলবান প্রাচীন বৃক্ষ সমূলে বাস্তুভিটায় উৎপাটিত হয়েছে। একটা শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করতেই হবে। না হলে গৃহস্থের অমঙ্গল হবে।’ খুড়িঠাকুমা পণ্ডিত বংশের কন্যা। তাঁকে দু-একবার মৃদু প্রতিবাদ করার পর ঠাকুরদা অবশেষে রাজি হলেন। ঠিক হল, আশ্বিন মাসে পুজোর আগে আগে তিনি বাড়ির সবাইকে নিয়ে আসবেন। শান্তি-স্বস্ত্যয়নের আচার-আয়োজন, পুরোহিত এ সব যেন ঠিক করা থাকে।

আমাদের সেরেস্তার নায়েব মশাইকে ডেকে ঠাকুরদা টাকা-পয়সার কথা বলে দিলেন। আর এটাও ঠিক হল, ভাদ্রের শেষে গ্রামের হাটে ঢোল শহরত করে এই কাঁঠালগাছটা নিলামে বেচা হবে। এটা দেবোত্তর সম্পত্তি। সব আইন মেনে চলতে হবে। ঠাকুরদাই আশ্বিন মাসে শান্তি-স্বস্ত্যয়নের সময় এসে মন্দির চাতালে নিলাম ডাকাবেন।

আমরা সে দিন সন্ধ্যার মধ্যে শহরের বাড়িতে ফিরে এলাম। আমি আর দাদা ফিরে আসার পর প্রত্যহই দিন গুনতাম শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, নিলাম এ সব দেখতে যাওয়ার জন্যে। সেপ্টেম্বরের শেষে এক সপ্তাহ ধরে সেকেণ্ড টার্মিনাল পরীক্ষা। তার কয়েকদিন পরে মহালয়া। মহালয়ার সময়েই আমরা বাড়িসুদ্ধ সবাই আবার চললাম গ্রামের বাড়িতে। এ বার আর নৌকোয় করে যাওয়া যাবে না। মান্ধাইঘাট গাছচাপা পড়ে আছে। তা ছাড়া, রাস্তা থেকে জল নেমে গেছে।

এ বার বাবা, ঠাকুমা সবাই সঙ্গে। তা ছাড়া, কাজের লোক, রান্নার লোক, চারটে ঘোড়ার গাড়ি করে আমরা চারাবাড়িঘাটে গিয়ে সেখানে থেকে স্টিমারে আমাদের গ্রাম এলাসিনে গেলাম। সেখান থেকে আমরা ছেলেরা পায়ে হেঁটে আর মা ও ঠাকুমা আর আন্নামা একটা পাল্কিতে করে বাড়িতে পৌঁছলাম।

আমাদের বাড়িতে অবশ্য দুর্গাপুজো হত না। মহালয়াও বিশেষ ভাবে কিছু হয় না। তবে বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম সেখানে এলাহি কাণ্ড চলছে। মান্ধাই কাঁঠালগাছের পারলৌকিক ক্রিয়া, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন এই সব নিয়ে।

পর দিন থেকে দেবীপক্ষ শুরু হবে। দেবীপক্ষের প্রথম দিনই মান্ধাই কাঁঠালের আত্মার শান্তির জন্যে যথাযথ শেষ কৃত্যাদি করা হবে। ‘কাঁঠালের আত্মা’ কথাটায় বাবা ও ঠাকুরদা দু’জনেই কেমন ঘাবড়িয়ে গেলেন। কিন্তু খুড়িঠাকুমা সাধারণ লোক ছিলেন না। তাঁর নির্দেশ অমান্য করার সাহস কারও নেই। একটা প্রশ্ন উঠেছিল মান্ধাই কাঁঠালগাছের বয়স নিয়ে। প্রশ্নটা জরুরি, কারণ যত বয়স হয়েছিল তত পোয়া কাঁচা দুধ ওই গাছের গোড়ায় দিতে হবে। গ্রামের কোনও লোক গাছটির সঠিক বয়স বলতে পারেনি। তাদের এক কথা, ‘জন্ম-ইস্তক দেখছি’।

অবশেষে অশীতিপর হাজি সামসুদ্দিন বললেন, ওই মান্ধাইঘাটে আগে একটা বাদামগাছ ছিল। ছোটবেলায় ওই গাছের নীচে অনেক হা-ডু-ডু খেলেছেন। তাঁর কথা মান্য করে ধরে নেওয়া হল গাছটির বয়স সত্তর। তার মানে, সত্তর পোয়া বা সাড়ে সতেরো সের দুধ, এখনকার ষোলো লিটার সেই গাছের ভাঙা গুঁড়িতে ঢালা হল।

পর দিন শান্তি-স্বস্ত্যয়ন মিটতে বেলা তিনটে হয়ে গেল। বোঁটাসুদ্ধ বেগুনভাজা, বড় বোয়ালমাছের লালঝোল, খেসারির ডাল আর লাল চাল দিয়ে খিচুড়ি, শেষপাতে পোড়াবাড়ি থেকে নিয়ে আসা ছোট মৌচাকের মতো একটা করে চমচম দিয়ে মন্দিরের চাতালে কাঙালি ভোজন হল। সেই কাঙালি ভোজনের এক প্রান্তে লুকিয়ে-চুরিয়ে আমি আর দাদাও সব কিছু খেয়েছিলাম। এখনও বলি, সে ছিল অমৃত। দেশে-বিদেশে চিনে, মোগলাই, জাপানি, ইংলিশ, ফরাসি কত রকম হোটেল রেস্তোরাঁয় কত রকম অখাদ্য, কুখাদ্য, সুখাদ্য খেলাম। জীবন্ত কেঁচো থেকে উটপাখির ডিমের ওমলেট, কিন্তু মান্ধাই কাঁঠালের শ্রাদ্ধের সেই ভোজ, তার স্বাদ এ জীবনে ভোলা যাবে না।

বিকেল পাঁচটা নাগাদ নিলাম ডাকা শুরু হল। কাঁঠালগাছের কাঠ, বিশেষ করে প্রাচীন গাছের, অতি মূল্যবান। খাট, পালঙ্ক, দরজা, জানালা, নৌকো, সাঁকো— সব কিছুতেই এর ব্যবহার। অত্যন্ত শক্ত কাঠ। টেকসইও বটে।

হাটে ঘোষণা করা হয়েছিল বলে নিলামের সময় বেশ ভিড় হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এরা সবাই কিনতে আসেনি। তারা নিলামের মজা দেখতে এসেছিল।

নিলাম পরিচালনা করেছিলেন ঠাকুরদা নিজে। বাবার সহায়ক হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমাদের ওখানকার গোমস্তাবাবু এ ধরনের কাজে অভিজ্ঞ বলে ঠাকুরদা তাঁরই সাহায্য নিয়েছিলেন।

আমরা, বাড়ির সবাই মন্দিরের বারান্দায় বসে নিলামের মজা দেখছিলাম। অত বড় কাঁঠালগাছটির সর্বনিম্ন ডাক ধরা হয়েছিল দশ টাকা। সেখান থেকে ডাক শুরু; শেষ পর্যন্ত সাতাশ না আটাশ টাকায় নদীর ও পারের এক ধনী কাঠমিস্ত্রি গাছটি কিনে নেয়। তাদের ছিল তক্তপোশ বানিয়ে নৌকোয় করে নদীর ধারে ধারে গিয়ে গ্রামের ঘাটের কাছে কয়েকটা তক্তপোশ নামিয়ে বিক্রি করা। তারা লোকজন সঙ্গে করে এসেছিল। দাম মিটিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কুড়ুল দিয়ে গাছের গোড়া থেকে কেটে এবং ওপরের দিকের ডালপালাগুলো ছেঁটে রেখে দিল। ঠাকুরদাকে বলল, ‘আমাদের লোক পাহারায় থাকবে। দু-এক দিন পরে মান্ধাইঘাটে একটা করাতকল বসিয়ে কাঠ চেরাই করে তার পর নৌকোয় করে কারখানায় নিয়ে যাব।’

‘কোনও আপত্তির কারণ নেই’, ঠাকুরদা বললেন, ‘মান্ধাইঘাট তো খালিই পড়ে আছে। শুধু যাওয়ার সময় ঘাটটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে।’ আমরা তো শহরের বাড়িতে চলে এলাম। যথাসময়ে কাঠমিস্ত্রিরা কাঠ চেরাই করে নিয়ে গিয়েছিল। বড়দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখছি, ওই যেখানে মান্ধাই কাঁঠালগাছটি ছিল সেই জায়গাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। তবে গাছের গুঁড়ি যেখানে কেটেছিল সেখানে ছোট ছোট কচি কাঁঠালপাতা গজিয়েছে।

এই সময় খুড়িঠাকুমার মাথায় একটা খেয়াল চাপে। গাছের গুঁড়িতে শিকড়ের ওপরে বেশ আঙুল দুই-তিনেক কাঠ রয়েছে যেটা কাঠমিস্ত্রিরা নিয়ে যায়নি। খুড়িঠাকুমার মাথায় খেয়াল চাপল এই কাঠের চাকাটা বার করে চৌকো করে কেটে একটা বিশাল পিঁড়ি বানাবেন। যে-পিঁড়িতে বড় খোকন আর ছোট খোকন অর্থাৎ আমি আর দাদা, পাশাপাশি বসে খেতে পারি।

খুড়িঠাকুমার হাতে বেশ কিছু নিজের টাকা সব সময় থাকত। সেটা তাঁর বাপের বাড়ির টাকা। সেখানে একটা আমবন তাঁর বাবা বিধবা মেয়ের নামে লিখে দিয়েছিলেন। প্রত্যেক বছর পুজোর সময় সেই আম বিক্রির টাকা তাঁর কাছে পৌঁছত। সে টাকা সবটাই তিনি জমাতেন, আর আমাদের বাড়ির টাকা খুব টিপে টিপে খরচ করে সব সময় তাঁর হাতে কিছু থাকত। শেষ পর্যন্ত অবশ্য খামখেয়ালি করে প্রায় সব সময়ই এই সমস্ত টাকা উড়িয়ে দিতেন।

মান্ধাই কাঁঠালের কাঠ দিয়ে পিঁড়ি বানানোর বুদ্ধি খুড়িঠাকুমার মাথায় খেলে যাওয়ার পরে তিনি ছুতোর মিস্ত্রি আনালেন। তারা চৌকো ছিমছাম করে পিঁড়িটিকে দাঁড় করাল। সে এক বিশাল ব্যাপার। তিন ফুট বাই আড়াই ফুট। দেখলে মনে হয় ঘরের ছাদ।

এর পর খুড়িঠাকুমা নিজে গিয়ে কাগমারিতে সূত্রধরপাড়ায় পিঁড়িটা নিয়ে গিয়ে একটা বিখ্যাত কাঠের কারিগরকে তাঁর মনোমত নির্দেশ দিলেন,— চার ধারে বর্ডার হবে, মধ্যখানে বিরাট একটা পদ্মফুল, তার দু’পাশে দুটো পাতা।

এক সপ্তাহের মধ্যে দু’বার তদারকি করে গেছেন খুড়িঠাকুমা। তৈরি হওয়ার পরে তিনি আবার নির্দেশ দিয়ে দুটি পাতার দু’পাশে বড় খোকন আর ছোট খোকন লিখিয়ে নিয়েছিলেন। কাঠ কেটে কেটে লেখা। কাঠ কেটে কেটে ফুল, পাতা, বর্ডার। অসামান্য কারু কাজ। লোকগুলোর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছিল। একপুরুষ আগে সন্তোষের রাজবাড়ি তৈরি হওয়ার সময় তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই থেকে আমাদের পাশের গ্রাম কাগমারিতে থেকে গেছে ওরা।

এর পর মহোৎসব, যাকে বলে মোচ্ছব হল মকর সংক্রান্তির দিনে। আমাকে আর দাদাকে পিঁড়ির ওপর পাশাপাশি বসিয়ে খুড়িঠাকুমা ভাইফোঁটার মতো করে কপালে চন্দনের ফোঁটা দিলেন। প্রদীপ জ্বালিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে আমাদের অভিষেক হল।

পিঁড়িটা আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের টাঙাইলের বাড়িতে চলে এল। আমি আর দাদা দু’জনে অবশ্য একসঙ্গে কখনওই বসিনি, তবে গয়না-বড়ি, আমসত্ত্ব বানাবার কাজে ওই কাঠের ফুলপাতা খুব কাজে লাগত। ছাদে রোদ্দুরে শুকিয়ে নিলেই সুন্দর ফুটে উঠত ফুলকাটা ডালের বড়ি, পাতাকাটা আমসত্ত্ব।

বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় আমাদের টাঙাইলের বাড়ি লুঠ হল। তখন আমরা অবশ্য কলকাতায়। বাবা-মা, দাদাও যুদ্ধের সময় কলকাতায় চলে এসেছিলেন। বড় বড় আলমারি, খাট সব লুঠেরারা নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পিঁড়িটা ছাদে ছিল বলেই হয়তো তাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল।

যুদ্ধের পর বাড়িতে ফিরে গিয়ে বাবা-মা সামান্য যা কিছু পেয়েছিলেন তার মধ্যে পিঁড়িটাই মূল্যবান। দাদা পিঁড়িটা ফেরত পেয়ে এত খুশি হয়েছিল যে, শোয়ার ঘরে ওর মাথার কাছে পিঁড়িটা রাখত।

বছর চারেক পরে বাবার কাছ থেকে খুব জরুরি খবর পেয়ে আমি, আমার ছেলে তাতাইকে নিয়ে টাঙাইলের বাড়িতে গেলাম। দাদার শেষ অবস্থা। মৃত্যুশয্যায়। পাগলের ছন্নছাড়া জীবন, চল্লিশ বছর বয়সেই আশি বছরের চেহারা হয়েছে। আমাদের দেখে খুশি হল। তাতাইকে বলল, ‘আয়, নিজের বাড়িঘর, জমি-জমা ভাল করে চিনে নে।’

এগুলো অবশ্য অবান্তর কথা। এর পরে দাদা একটা পুরনো মোক্ষম রসিকতা করল তাতাইয়ের সঙ্গে। বলল, ‘আমার তো কিছু নেই তোকে দেওয়ার জন্যে, কিন্তু তোকে একটা জিনিস দেব, সাতপুরুষ বসে খেতে পারবে।’

রসিকতাটা অনেকেই জানে। বহু কালের পুরনো। এ কালে অবশ্য চলে না। এ কালে তো সকলেই চেয়ার-টেবিলে ভাত খায়। সেই যে কালে মানুষ কাঠের পিঁড়িতে বসে ভাত খেত, এ রসিকতা সেই সময়কার।

এক বৃদ্ধ তাঁর প্রত্যেক আত্মীয়কে বলেছিলেন, ‘তোকে এমন একটা জিনিস দেব, সাতপুরুষ বসে খাবি।’ জিনিসটা আর কিছুই নয়, পিঁড়ি। মেঝেতে বসে খাওয়ার পিঁড়ি. ঠিকমত রাখলে সাতপুরুষ বসে খেতে পারবে।

তাতাইকে গল্পটা বুঝিয়ে বলায় তাতাই খুব হাসল। দু’দিন পরে দাদা মারা গেল। শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে যাওয়ার পর আমরা কলকাতায় ফিরলাম। আসার সময় তাতাই পিঁড়িটা সঙ্গে নিয়ে নিল। আমরা ঢাকা হয়ে এক ক্ষমতাবান বন্ধুর গাড়িতে সড়কপথে সীমান্ত পর্যন্ত এসেছিলাম। শুল্ক দফতর বা পুলিশ আটকায়নি, শুধু বনগাঁয় রিক্সাওলা পিঁড়িটার জন্য পাঁচ টাকা বেশি নিয়েছিল।

কলকাতার বাড়িতেও পিঁড়িটার তেমন ব্যবহার হয়নি। তাতাইয়ের ঘরেই বইয়ের আলমারির পাশে পিঁড়িটা কাত করে রাখা আছে।

বহু দিন হয়ে গেল। তাতাই বিদেশ গেছে, সেও প্রায় দুই দশক হয়ে গেল। বৎসরান্তে এক-আধ বার আসে। পারলে আমরাও যাই। বছর দুয়েক আগে সে একটি ইতালিদেশীয়া কন্যার পাণিগ্রহণ করেছে। দুটি যমজ কন্যা হয়েছে। আমরা তাদের গিয়ে দেখে এসেছি।

ফিরে আসার পর আমার দুই সুন্দরী পৌত্রী আমার শয়নে-স্বপনে সব সময় অবস্থান করছে। অথচ, তাদের বিহনে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এর মধ্যে একটা নিমন্ত্রণ পেলাম আমেরিকা থেকে। অল্প দিন আগেই সে দেশ থেকে ফিরেছি, তবু নাতনিদের টানেই বোধহয় আবার গেলাম।

আমেরিকায় দুটো বত্রিশ কেজি ওজনের লাগেজ নেওয়া যায়। আমার একার আর কত লাগেজ লাগবে। একটা সুটকেসে আমার জামাকাপড়, কিছু খাবার-দাবার, চিঁড়ের মুড়ির মোয়া, কড়াপাকের সন্দেশ, নাতনিদের জন্যে পোশাক এই সব নিলাম। আর দ্বিতীয় লাগেজটার জায়গায় নিলাম মান্ধাই পিঁড়িটা।

ভেবেছিলাম বিমানবন্দরে আপত্তি করবে, কিন্তু শুল্ক বা অভিবাসন, এমনকী বিমান কোম্পানি কোনও আপত্তি করল না, জিনিসটা আমার সঙ্গেই প্লেনে তুলে দিল। কিন্তু সানফ্রান্সিসকো গিয়ে পিঁড়িটা খুঁজে পেলাম না। আমার ব্যাগ এল, আরও সকলের জিনিসপত্র এল, কিন্তু আমার সেই মান্ধাই পিঁড়ি, সেটা কোথাও নেই।

বিরাট বিমানবন্দর। কোথায় কাকে কী বলি, শেষে এক মেমসাহেবকে ধরে কথাটা বললাম। তাকে বোঝাতে রীতিমত কষ্ট হল জিনিসটা ঠিক কী। সাহেব-মেমরা কোনও দিন পিঁড়িতে বসেনি। তারা সাদামাটা মেঝেতে বসেছে, চেয়ারে বসেছে, টুলে বসেছে, বক্সে বসেছে, সোফায় বসেছে কিন্তু পিঁড়ির ব্যাপারটা সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই।

কিছু বুঝতে না পেরে মেমসাহেব আরও দু-চার জনকে সংগ্রহ করল। সবাই মিলে মাল আসবার কনভেয়র বেল্ট এমন ভাবে অত বড় জিনিসটাকে খুঁজতে লাগল যেন আলপিন খুঁজছে। কিন্তু অত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু হল না। আমার মান্ধাই পিঁড়ি সানফ্রান্সিসকো অবধি পৌঁছয়নি, কিংবা পৌঁছলেও বিমানের পেটে থেকে গেছে।

অবশেষে সবাই মিলে আমাকে সান্ত্বনা দিল, হয়তো সিঙ্গাপুরে বিমান বদলের সময় এ দিক-ও দিক হয়ে গেছে, দু-একদিনের মধ্যে এসে যাবে। আমি ছেলের বাড়ির ঠিকানা রেখে গেলাম। এবং প্রতি দিন দু’বেলা ফোনে খবর নিতে লাগলাম। কিন্তু কাঁঠাল কাঠের পিঁড়িটা উদ্ধার হল না। মহাশূন্যে কোথায় কোন বিমানে পৃথিবীর কোন দূর দেশে এক গ্রাম্য কারিগর-অলঙ্কৃত মান্ধাই কাঁঠাল কাঠের সেই পিঁড়িটা এখন কোথায় মনে মনে ভাবি। ছেলে আর ছেলের বউকে আমার মনের দুঃখ বোঝাতে পারি না। নাতনিদের বোঝার বয়স হয়নি। ওই পিঁড়িটা যে তাদের বসার জন্য এনেছিলাম সেটা তাদের বোঝাতে পারি না। শুধু তাতাই এক দিন আনমনে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা এটা কি সেই পিঁড়িটা?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। ইতিমধ্যে পুত্রবধূ এয়ারলাইন্সকে ধমকে পিঁড়িটার জন্য পঁচাত্তর ডলার ক্ষতিপূরণ আদায় করে এনে আমাকে দিয়েছে। টাকাটা দুই নাতনির জন্য বউমার হাতে দিয়ে বললাম, ‘ওদের দুটো বসবার আসন কিনে দিও।’

সামান্য পঁচাত্তর ডলারে আমেরিকায় কী করে দুটো আসন হবে? কোনও পিঁড়ি জাতীয় জিনিস পাওয়া যাবে কি না। বউমা বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে কিছু না বলে টাকাটা রেখে দিল।

আমি কিন্তু কাঠের পিঁড়িটাকে ভুলতে পারছি না। কলকাতায় ফিরে এসেছি। কখনও স্বপ্ন দেখি আমাদের সেই খুড়িঠাকুমার মান্ধাই কাঠের পিঁড়ি প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। কখনও দেখি আশ্বিন মাসের সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে সে পিঁড়ি দিগন্ত পাড়ি দিচ্ছে। কখনও মনে হয় পিঁড়িটা একটা বিরাট সিংহদরজা, সেই দরজার ও পাশে এলা আর লীলা, আমার দুই নাতনি খেলা করছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ