আমার মায়ের কি আগে থেকেই গভীর-গোপন কোনো অসুখ ছিল, কিংবা বাবার, অথবা দুজনেরই? হঠাৎ করেই এসব প্রশড়ব সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু উত্তর পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না—যাদেরকে নিয়ে এই প্রশড়ব তারা সব জিজ্ঞাসার ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন অনেক আগেই। বাবা মারা গেছেন সেই কবে, বছর পনের তো হবেই; মা-ও তখন থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন, মৃতই বলা যায়—সচেতন জগতের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই বহুদিন ধরে। বাবার মৃত্যুটা ছিল রহস্যময়-- কেউ বলেন খুন, কেউ বলেন আতড়বহত্যা, কেউ বলেন দুর্ঘটনা। ট্রেনে কাটা পড়েছিলেন তিনি। তাঁর মতো একজন মানুষের পক্ষে অ্যাকসিডেন্টালি ট্রেনের নিচে কাটা পড়া বেশ অস্বাভাবিক ব্যাপার বলেই হয়তো অন্য সম্ভাবনাগুলোর কথা বলা হয়।
এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী আমার মা, তার কাছ থেকেও কিছু জানার উপায় নেই, তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা আরোগ্যাতীত। অনেকের কাছে শুনেছি, মা-ই নাকি বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের নিচে ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু বীভৎস মৃত্যুদৃশ্যটি সহ্য করতে পারেনি বলে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অন্যপক্ষ বলেন, বাবা সুইসাইড করেছিলেন এবং মাকে এই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী বানানোর জন্য ইচ্ছে করেই তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর কোনটি সত্যি কোনটি মিথ্যে তা নির্ণয় করা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হয়নি। বাবার মৃত্যু এবং মায়ের অসুস্থ হয়ে পড়ার পর নাকি আমাকে নিয়ে একটা টানাটানি হয়েছিল। মানে, আমি কোন বাড়ি থাকবো তাই নিয়ে দুই পরিবারের যুদ্ধ। ব্যাপারটি নাকি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল, এবং আমার চাচা-ফুপুরা
জয়ী হয়েছিলেন শুধু এই যুক্তিতে যে, আমার মা একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা, তার কাছে আমার থাকাটা নিরাপদ নয়। আমি বড়ো হয়ে উঠেছি দাদা-দাদু, চাচা-চাচি, ফুপুদের কাছেই। না, তাদের কাছে কোনো অবহেলা-অনাদর পাইনি আমি, বরং একটু বাড়াবাড়ি রকমের আদর-যতড়ব করেছেন তারা। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে আর কোনো কিশোর এমন অসাধারণ ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠে বলে আমার জানা নেই। আমার দাদাবাড়ির প্রায় সবাই অসম্ভব আবেগপ্রবণ, যুক্তির চেয়ে তাদের কাছে আবেগ অনেক বেশি মর্যাদা পায়, তাদের প্রায় সব সিদ্ধান্তও আবেগতাড়িত। তারা আমাকে যেমন ভালোবেসেছেন তেমনি মায়ের প্রতি আমার ঘৃণা জাগানোর যাবতীয় কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন। এ বাড়ির সবারই দৃঢ় বিশ্বাস-- মা-ই বাবাকে মেরে ফেলেছে। মা যে অত্যন্ত নিষ্ঠুর একজন মানুষ এবং এ কাজ করা যে তার জন্য খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার—এটা আমাকে বিশ্বাস করানোর জন্য তারা চেষ্টার অন্ত রাখেনি। ঠিক মেরে ফেলার মতো কী এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, অনেক জিজ্ঞেস করেও এই প্রশেড়বর কোনো সদুত্তর আমি পাইনি। অন্যদিকে, এমন একটি ভয়ংকর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মা-র সঙ্গে বা নানবুড়ির সঙ্গে আমার যোগাযোগ অক্ষুণড়ব ছিল, এবং সেখানে যেতে চাইলে এ বাড়ির কেউ বাধা দিতো না। মাঝে মাঝে মা-র জন্য খুব মন খারাপ হতো, বাবার মৃত্যুর পর মা-র সঙ্গেও এমন অনিচ্ছাকৃত দূরত্ব আমাকে ভীষণ একা করে দিয়েছিল। দুজনকেই আমি খুব মিস করতাম। বড়োরা আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আদালত পর্যন্ত দৌড়েছেন অথচ আমাকে একটিবারের জন্যও কেউ জিজ্ঞেস করেননি যে আমি কার কাছে থাকতে চাই। মনে আছে, জজ সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস
করেছিলেন-- তুমি কোন বাড়ি থাকতে চাও-- দাদুবাড়ি না নানুবাড়ি!আমি স্বাভাবিকভাবেই দাদুবাড়ির কথাই বলেছি-- বাড়ি বলতে আমি তো দাদুবাড়িই বুঝতাম, এখনো তাই বুঝি, কিন্তু আমি তো এ বাড়িতে থাকতে চেয়েছি মাকে নিয়েই, মা এ বাড়িতে আর থাকবে না জানলে আমি নিশ্চয়ই সেটা বলতাম না! তো, মা-র জন্য মন খারাপ হলে দাদুকে বলতাম, দাদু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দাদাকে দিয়ে আমাকে ও বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। দাদা গিয়ে নানার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন, আমার দাদা আর নানা নাকি বন্ধু ছিলেন-- এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটার
পরও কীভাবে তাদের সেই সম্পর্ক অটুট ছিল, সে-ও এক রহস্য। মারকাছে যাওয়াটা আমার জন্য কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। আমাকে দেখলেই মা ভয়ংকর খেপে যেত, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতো, তেড়ে মারতেও আসতো-- ‘আবার তুই এখানে এসেছিস। দূর হ, চলে যা আমার সামনে থেকে। হারামজাদা, তোর জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’ আমি একটু দূর থেকে মা-র এই রুদ্রমূর্তি দেখতাম, কাছে ঘেঁষার সাহস হতো না, যদি মারধোর করে—এই ভয়ে! তবু আমি বারবার মাকে দেখতে চাইতাম, এত ভালো লাগতো মায়ের মুখ! মনে হতো-- এত সুন্দর মুখ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আমাকে দেখলেই মা কেন এমন খেপে উঠতো, আমার অপরাধটা কী তা আমি কোনোদিনই বুঝে উঠতে পারিনি। এরকম অনেক না-বোঝা নিয়ে আমি বড়ো হয়ে উঠেছি। কোনোদিন মা আমাকে কাছে ডেকে আদর করে দুটো কথা বলেছে—এমন কোনো স্মৃতি আমার নেই, যদিও বাবাকে নিয়ে আমার অসংখ্য মধুর স্মৃতি। বাবাকে তো ছোটবেলাতেই হারিয়েছি, আমার বয়স তখন মাত্র বছর দশেক-- এতসব কথা কীভাবে যে মনে আছে! প্রতিদিন বাইরে যাওয়ার সময় আমি এটা-ওটার জন্য বায়না ধরতাম এবং আবশ্যিকভাবে বাবা সেগুলো নিয়েই ঘরে ফিরতো। আমার এত খেলনা জমেছিল যে সেগুলো রাখার জন্য বড়োসড়ো একটা আলমারির প্রয়োজন হতো। এখনো সেই খেলনাগুলো আমি রেখে দিয়েছি। কিন্তু এসবের চেয়ে আমার কাছে মধুর হয়ে আছে ঘুম পাড়ানোর স্মৃতি। ছোটবেলায় আমি সহজে ঘুমাতে চাইতাম না, মা আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে টায়ার্ড হয়ে পড়তো আর একসময় বকাবাজি শুরু করতো, মা-র কাছে ঘুমাতে তাই ইচ্ছে করতো না। বাবা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাজ করতো, তবু আমি বায়না ধরতাম--‘আমি তোমার সাথে ঘুমাবো বাবা।’ কাজ ফেলে, হয়তো আমাকে বকাবাজি থেকে রক্ষা করার জন্যই, বাবা আমাকে ঘুম পাড়াতে আসতো। বাবার ঘুম পাড়ানোর পদ্ধতিটা ছিল অদ্ভুত। আমার সারা গায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলাতে বুলাতে গান গাইতো, ঘুম পাড়ানি গান-- আয়রে আয় ঘুম আয়, আমার বাবার চোখে নেমে আয়; কিংবা ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো ; কিংবা খোকনসোনা বলি শোনো, থাকবে না আর দুঃখ কোনো, মানুষ যদি হতে পারো ;-- এইরকম আরো কত কত গান। বাবার ওই করুণ মধুর গানগুলো শুনতে শুনতে আমি মুহূর্তের মধ্যে ঘুমে তলিয়ে যেতাম। শুধু গান নয়, বাবা আমাকে মাঝে মাঝেই নিয়ে যেত রূপকথার রাজ্যে এবং সেখানে অনিবার্যভাবে আমিই হতাম রাজপুত্র। পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিতো ফুলের দেশে, কথা হতো ফুলপরীর সঙ্গে, বাবার শিখিয়ে দেয়া কথামতো আমি তাদেরকে ঘুমপরীর কথা জিজ্ঞেস করতাম-- কোথায় সে, কেন আমার চোখে নেমে আসছে না! তারা বলতো-- আমরা তো জানি না, তবে চাঁদপরী জানতে পারে। যেতাম চাঁদের দেশে চাঁদপরীর কাছে। চাঁদপরী বলতো-- ঘুমপরী তো এই কিছূক্ষণ আগে মেঘের দেশে বেড়াতে গেছে। ছুটে যেতাম মেঘপরীদের দেশে—মেঘপরীরা বলতো, ঘুমপরী তো আমাদের আড়ালে লুকিয়ে আছে, তুমি তো রাজপুত্র, তুমি না ডাকলে নাকি ও যাবে না। আমি তখন ঘুমপরীকে ডাকতাম-- ঘুমপরী এসো! আমার তো ঘুম আসছে না, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। বলতে-না-বলতে আমার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতো, মনে হতো সত্যি বুঝি ঘুমপরী নেমে এসেছে আমার চোখে, ঘুমপরীর আদর নিতে নিতে এক মধুর অনুভূতি নিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতাম আমি। মা বলতো-- ‘তুমি তো ওর অভ্যাস খারাপ করে ফেলছো। ঘুমানোর জন্য এত বাহানা করতে হয় নাকি!’
‘কেন, তুমি একটু আদর-টাদর করে ঘুম পাড়াতে পারো না! বাচ্চা একটা ছেলে। এই বয়সেই তো ওর এসব গল্প শুনতে ইচ্ছে করবে।’
‘না, আমি অতো আহ্লাদ করতে পারবো না।’
‘আচ্ছা, তোমাকে করতে হবে না। আমিই করবো।’
‘না, তুমিও করবে না। ফালতু আহ্লাদ দিয়ে তুমি ওর মাথাটা নষ্ট করে দিচ্ছ।’
‘আমার তো একটাই মাত্র ছেলে, ওকে আহ্লাদ দেবো না তো কাকে দেবো!’
এইসব তর্ক প্রায়ই হতো। মাঝে মাঝে ঝগড়াও হতো, তা-ও আমাকে কেন্দ্র করেই। ঝগড়া অবশ্য বলা যায় না, বাবা ছিল চুপচাপ ধরনের লোক-- খুব অল্প কথা বলতো, মা একাই চিৎকার-চেঁচামেচি করে যেত। একসময়, আমি তখন কেবল বুঝতে শিখেছি, বাবা একেবারেই চুপ হয়ে গেল। মা-র সঙ্গে দিনের-পর-দিন একটা কথাও বলতো না, মাঝে মাঝে মা কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে শুনেছি--
‘তুমি তোমার রাগ কমাও, না হলে আমি কথা বলবো না।’ শুধু মা নয়, দাদু ছাড়া বাসার অন্য কারো সাথেও কথা বলতো না বাবা-- যদিও আমার সঙ্গে প্রচুর কথা বলতো, গল্প করতো, আমার আহ্লাদ- আব্দার হাসিমুখে মেনে নিতো। তারপর কোত্থেকে যে কী হলো বুঝতে পারলাম না, শুধু এটুকু মনে আছে-- দিন দিন মা-বাবার সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে গেল, মা-র রাগ-মেজাজ বেড়েই চললো এবংসেগুলোর অধিকাংশই এসে পড়তে লাগলো আমার ওপর। আমি আমার অপরাধ বুঝে ওঠার আগেই মা-র কাছে ভয়ংকরভাবে মার খেতে লাগলাম। ছোটবেলার সেইসব নির্মম মারের কথা এখনো পরিষ্কারভাবে মনে আছে আমার। মা আমাকে একবার বটি দিয়ে মারতে এসেছিল-- সেই রুদ্র মূর্তি এখনো চোখে ভাসে আমার, এখনো মনে হলে আতংকে কেঁপে উঠি। আরেকবার মা আমার হাত ভেঙে দিয়েছিল। আমি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলাম, কিন্তু কানড়বার সাহসটুকু
পর্যন্ত পাইনি, কারণ মা হিসহিস করে বলছিল-- ‘একফোঁটা শব্দ করবি না, শব্দ করলে মেরেই ফেলবো।’ আমি তার কথা বিশ্বাসও করেছিলাম। মা এসব অত্যাচার করতো বাবার অনুপস্থিতিতে, আবার বাবার কাছে এসব কথা বলার উপায়ও ছিল না-- মা কঠিনভাবে সাবধান করে দিতো-- ‘বাবাকে বললে খুন করে ফেলবো।’ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বাবা বাসায় ফিরেই বুঝে ফেলতো-- কিছু একটা ঘটেছে। মা যেদিন আমার হাত ভেঙে ফেললো-- এতদিন আগের কথা তবু আমার স্পষ্ট মনে আছে-- বাসায় ঢুকেই বাবা বললো, ‘কী হয়েছে বাবা, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’ আমার খুব কানড়বা পাচ্ছিল, কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছিল না-- ‘বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো-- ‘কী হয়েছে আব্বু, কী হয়েছে তোমার?’
‘ব্যথা পেয়েছি।’ -- কোনোমতে বলতে পারলাম
‘কোথায় ব্যথা পেয়েছ?’
‘হাতে।’
‘হাতে! দেখি দেখি’-- বাবা দেখলো আমার হাত ফুলে উঠেছে, আমি ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। ভ্রু কুঁচকে বাবা জিজ্ঞেস করলো--
‘কীভাবে ব্যথা পেলে বাবা? মনে তো হচ্ছে ভেঙে গেছে!’
মা আগ বাড়িয়ে বললো-- ‘খাট থেকে পড়ে গিয়েছিল...’
‘ওকে বলতে দাও’-- বাবা গম্ভীর স্বরে বললো।
‘বলো বাবা, কীভাবে ব্যথা পেলে?’
‘খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলাম...’ -- আমি মা-র কথাই রিপিট করলাম। বাবা মনে হয় বিশ্বাস করলো না। আমাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ালো, ডাক্তাররা এক্সরে করে জানালেন-- ভেঙে গেছে, প্লাস্টারও করে দিলেন। বাসায় ফিরে বাবা আরো গম্ভীর, মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো-- ‘ওর হাত কীভাবে ভাঙলো?’
‘বললাম তো!’
‘মিথ্যে কথা বলবে না, এত বড়ো ছেলে এই নিচু খাট থেকে পড়ে হাত ভাঙে নাকি? কীভাবে ভেঙেছে বলো!’
মা এবার ভেঙে পড়লো, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো-- ‘আমি ভেঙেছি।’
‘তুমি ভেঙেছ মানে?’
‘হ্যাঁ, আমি ভেঙেছি। আমি নিজে ওর হাত ভেঙে দিয়েছি।’
‘কেন ভেঙেছ, জানতে পারি?’-- বাবা অতিমাত্রায় স্বাভাবিক।
‘আমি ওকে গোসল করে নিতে বলছিলাম কিন্তু আমার কথা না শুনে ও খেলছিল, তাই মাথায় রাগ উঠে গিয়েছিল।’
‘আর তাই তুমি তোমার নিজের ছেলের হাত নিজে ভেঙে ফেললে!’
মা চুপ।
‘তুমি কি মানুষ? কোনো মা নিজের ছেলেকে বিনা কারণে এরকম ভয়ংকর শাস্তি দিতে পারে সেটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। মা তো দূরের কথা, অন্য কোনো মানুষের পক্ষেও এরকম পৈশাচিক কাজ করা সম্ভব নয়। তুমি তা বোঝো?’
‘হ্যাঁ বুঝি, আমি ... আমি... আমি তো অসুস্থ।’
‘না তুমি অসুস্থ নও। তুমি একটা ডেভিল। শয়তানের সাক্ষাৎ বংশধর। তুমি এর শাস্তি পাবে। সারাজীবন ধরে তোমাকে সেই শাস্তি বহন করে যেতে হবে। এতদিন আমি তোমাকে কিছু বলিনি, অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, সাইμিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছি, বছরের-পর-বছর ধরে তোমাকে হেল্প করার চেষ্টা করেছি,
কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তুমি নিজে নিজের এই স্বভাবটাকে পাল্টাতে চাও না। ঠিক আছে, তুমি তোমার রাগ নিয়েই বাঁচো, কিন্তু আমি তোমাকে শাস্তি দেবো, ভয়ংকর শাস্তি, ভয়ংকর শাস্তি...’ –বাবা বারবার ভয়ংকর ভয়ংকর শব্দটি বলছিল, আর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছিল। মা অবিরল কাঁদছিল, কিন্তু ওই কানড়বা বাবাকে এতটুকু স্পর্শ করছিল না। এর কিছুদিন পরই বাবা মারা গেলেন। বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে আমি আরেকটি রহস্যের মুখোমুখি হই। জানতে পারি-- বাবা নাকি বিস্ময়কর রকমের মেধাবী মানুষ ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, কিন্তু তারচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে-- জীবনের শেষ কয়েকটি বছর তিনি কিছু একটা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছিলেন। গবেষণার এই কাজটি তিনি শুরু করেছিলেন বিদেশে বসে এবং একটু গুছিয়ে উঠতেই তিনি ফিরে আসেন এই যুক্তিতে যে, কাজটা তিনি দেশে বসে শেষ করতে চান। কারণ, গবেষণাটা শেষ হলে এই একটি কাজের জন্যই নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি নাকি বলতেন-- শেষ করে এনেছি, প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, এখন শুধু চূড়ান্ত রূপটি দিতে হবে। এসব কথা আমি জানতে পারি বাবার সহকর্মী এবং বন্ধু সাজ্জাদ চাচার কাছ থেকে। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই তিনি প্রায় নিয়ম করে আমাকে দেখতে আসতেন। বাবাকে নিয়ে নানারকম গল্প করতেন, বাবার রহস্যময় কাজ নিয়ে আলোচনা করতেন, বলতেন-- ‘এ
জাতির দুর্ভাগ্য যে কাজটি তিনি শেষ করে যেতে পারলেন না। এত বড়ো প্রতিভাবান মানুষ আরো একশো বছরেও এ দেশে জন্মাবে কীনা সন্দেহ আছে।’ এসব কথায় আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যেত। কী ছিল বাবার গবেষণার বিষয়, প্রায় শেষ করে আনা কাজটিরই বা কী হলো-- এসব নিয়ে আমার কৌতূহলের কোনো উত্তরও পাইনিবহুদিন। কারণ, মৃত্যুর পর তাঁ র অফিসরুম খুলে দেখা গিয়েছিল-- সমস্ত কাগজপত্র পোড়ানো, রুম জুড়ে ছাইয়ের স্তুপ। এই তথ্যটি অবশ্য আমাকে প্রায় নিশ্চিত করে দেয়, বাবার মৃত্যুটা আত্মহত্যা ছিল-- একদম পরিকল্পনা করে, দিনক্ষণ ঠিক করে তিনি তাঁর কাগজপত্রগুলো নিজ হাতে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। সাজ্জাদ চাচারকাছেই শুনেছি-- বাবা কখনো তাঁর গবেষণার বিষয় সম্বন্ধে বা কাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু বলতেন না, সবাই শুধু জানতো-- কাজটি শেষ হলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূল রহস্যটা জানা যাবে। বাবা নাকি
খুব পপুলার শিক্ষক ছিলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে অসম্ভব পছন্দ করতো, তাঁর লেকচার শোনার জন্য অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট থেকেও নাকি ছেলেমেয়েরা ক্লাসে এসে বসতো। তিনি কোথাও দাঁড়ালে তাঁর চারপাশে নাকি ভিড় জমে যেত, এবং তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘণ্টারপর- ঘণ্টা কথা বলে যেতেন-- কিন্তু সে-সব কথা থেকে তাঁর মূল গবেষণা সম্বন্ধে কিছুই জানা যেত না। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়েছে যে, বাবা সম্ভবত এমন বড়োমাপের কোনো কাজ করছিলেন না, কিন্তু মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ায় এবং এরকম একটা বিরাট ইমেজ
তৈরি হওয়ায় তিনি বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন, ফলে গবেষণা সংμান্ত কাগজপত্রগুলো পুড়িয়ে ফেলে তিনি নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি আমার এই ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে, আসলে এতক্ষণ ধরে যা কিছু বলছি তা ওই পরিবর্তিত ধারণার জন্যই। নইলে বাবার মৃত্যু, মায়ের অসুস্থতা সবই তো মেনে নিয়েছি, মানিয়ে নিয়েছি এসবকিছুর সঙ্গে, এখন এমনকি খুব একটা মনও খারাপ হয় না-- তবু এতদিন পরে এসব নিয়ে কথা বলছি কেন? বলছি, কারণ, সাজ্জাদ চাচা সেদিন আমার হাতে একটি ডায়েরি দিয়ে গেছেন, বলেছেন-- ‘এই ডায়েরিটাতোমার বাবার অফিসরুমের টেবিলে ছিল, একটা প্যাকেটের মধ্যে। ওপরে আমার নাম লেখা ছিল, আমাকে লেখা একটা চিঠিও ছিল--
লিখেছিলেন, এই ডায়রিটা যেন আমি তোমার হাতে পৌঁছে দিই, তবে এখনই নয়। তুমি যখন যথেষ্ট বিবেচনাসম্পনড়ব এবং বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে তখন। আমি হয়তো আরো আগেই তোমার হাতে এটা দিতে পারতাম, তবু একটু বেশি সময় নিয়েছি তোমার কল্যাণের কথা ভেবেই। এখন আমার সময় হয়ে এসেছে-- বুড়ো হয়ে গেছি, কবে চলে যাই ঠিক নেই-- তোমাকে এটা বুঝিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চাই
বাবা।’ বলাই বাহুল্য, ঘটনাটা ছিল আমার জন্য এক বিরাট বিস্ময়। সাজ্জাদ চাচা, এমনকি, কোনোদিন বলেনওনি যে, তাঁর কাছে বাবা আমার জন্য কিছু একটা রেখে গেছেন। ডায়রিটা হাতে পেয়ে আমি পাগলের মতো পড়তে থাকি। একদম শুরুতে লেখা--
খোকাবাবু, আমার বাবা, এই লেখাগুলো তোমার জন্য।
তারপরের পৃষ্ঠায়--যখন তুমি এটা পড়বে, আমি হয়তো তখন থাকবো না। কিন্তু তোমার মনে থাকবে অনেক অনেক প্রশড়ব, যেগুলোর উত্তর তুমি কোথাও পাবে না, কেউ তোমাকে সেসব প্রশেড়বর উত্তর দেবে না,
যদিও বিষয়গুলো তোমার জানা উচিত।
তারপরের পৃষ্ঠায়--
তোমার মা যখন কনসিভ করলো এবং আমরা সেটা জানতে পারলাম, তখন থেকেই তোমার মা এবং আমি মিলে তোমার সঙ্গে কমিউনিকেট করার চেষ্টা করেছি। আমি একজন বিজ্ঞানকর্মী। বিজ্ঞান যদিও কোথাও বলেনি যে, গর্ভস্থ শিশুর সঙ্গে কমিউনিকেট করা যায় তবু আমি সেই চেষ্টাটা করেছিলাম একটি বিশেষ কারণে। আমাদের দেশে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, গর্ভবতী মায়েরা যদি সবসময় সুন্দর কোনো দৃশ্য দ্যাখে তাহলে তার বাচ্চা দেখতে সুন্দর হয়। এই সংস্কারের কারণেই আমাদের দেশের গর্ভবতী মেয়েদের অনেককিছু খাওয়া নিষেধ, অনেক দৃশ্য দেখা নিষেধ, অনেক জায়গায় যাওয়াও নিষেধ। ঘরের মধ্যে সুন্দর কিছু রেখে দেয়া হয় যেন প্রতিমুহূর্তে গর্ভবতীদের সেটা চোখে পড়ে। হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের মানুষগুলো এসব বিশ্বাস করে এসেছে-- সেই অনুযায়ী কাজও করেছে। এইসব বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। আমার মনে হলো-- দেখা যাক না, যদি সত্যিই সেটা করা যায়! তোমার মাকে আমি বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম-- সেও সহযোগিতার হাত বাড়ালো। আমরা প্রায় প্রতিদিন তোমার সঙ্গে কথা বলতাম, এমনভাবে বলতাম যেন সত্যিই তোমার অস্তিত্ব আছে, যেন তুমি সত্যিই সেসব শুনতে পাচ্ছো। শুধু কথা নয়, কবিতা পড়ে শোনানো, গান বাজিয়ে শোনানো প্রায় নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তোমার মা খুব সুন্দর গান গাইতো, সে-ও গেয়ে শোনাতো। একসময় মনে হলো—এরকম বিচ্ছিনড়বভাবে শোনালে হবে না, সেক্ষেত্রে ফলাফলটা বোঝা যাবে
না, অতএব আমরা একটা গান সিলেক্ট করে সেটাই প্রতিদিন নিয়ম করে চার-পাঁচবার তোমাকে শোনাতে লাগলাম।
একইসঙ্গে চলতে থাকলো তোমার জন্য এক কাতর প্রার্থনা। কার কাছে? আমি প্রচলিত অর্থে ধার্মিক মানুষ নই, ধর্ম নিয়ে কোনোদিন মাথাই ঘামাইনি, তাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিনি, করেছি সেই মহাশক্তিধর প্রকৃতির কাছে যার অপরূপ শৃঙ্খলা- সৌন্দর্য আর নিয়মের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছিলাম বিজ্ঞানের গবেষণা করতে গিয়ে। শুনলে তোমার কেমন লাগবে জানি না, তবু বলি-- তোমাকে কমিউনিকেট করার এই অদ্ভুত পরীক্ষাটি
সফল হয়েছিল। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, আমরা যে গানটি তোমাকে শোনাতাম, তোমার চারমাস বয়সের সময় সেই গানটি তুমি সনাক্ত করতে পেরেছিলে। কীভাবে জানো? ওই বয়সের শিশুদের আধাঘণ্টা পরপর খাওয়াতে হয়-- আমি তোমাকে প্রায় আটঘণ্টা না খাইয়ে রেখেছিলাম, তুমি ভয়াবহ কানড়বাকাটি করছিলে, কানড়বা থামানোর নানারকম চেষ্টা চলছিল—ঝুনঝুনি বাজানো, গান শোনানো, ইত্যাদি-- কিন্তু খাওয়ানো নিষেধ!
তোমার দাদু রেগেমেগে আমাকে মারতে এসেছিল, তোমার মা অবিরল কাঁদছিল, কিন্তু আমি তোমার কাছে কাউকে ভিড়তেই দিইনি। আটঘণ্টা পর, তোমার কানড়বাকাটির মাত্রা যখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে-- আমি তখন ওই গানটি বাজিয়ে দিলাম। এবং এক আশ্চর্য বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করলাম-- তোমার কানড়বা থেমে গেছে। শুধু তাই নয়, কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তুমি গানটি শুনলে, তারপর হাতপা নেড়ে আও আও করে কিছু বলার চেষ্টা
করলে, আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলে। এ ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আটঘণ্টা ধরে অভূক্ত কোনো শিশু, যে একটু আগেও সর্বশক্তি দিয়ে কাঁদছিল, সে একটি গান শুনে এভাবে হাসতে পারে সেটা কোনো বিশ্বাসযোগ্য দৃশ্য নয়। এই ফলাফলের কথা আমি কোথাও প্রকাশ করতে পারিনি, কিন্তু ঘটনাটা আমার মধ্যে এক গভীর পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। আমি যে গবেষণাটাকরছিলাম সেখানেও এক বিরাট পরিবর্তন আসে এই ঘটনাটার
পরই।
এই পৃষ্ঠাটা এই পর্যন্তই। সম্ভবত লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন-- ভেবেছিলেন পরে লিখবেন, কিন্তু পরের পৃষ্ঠায় আর এ প্রসঙ্গ নেই, আছে সম্পূর্ণ ভিনড়ব একটি প্রসঙ্গ। লিখেছেন-- আমার মনে হয়েছিল, তোমার মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে আমার এক ধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। তুমি আমার কাছে কেবলমাত্র আমার সন্তানই নও, প্রকৃতির বিশেষ বার্তাবাহক। অথচ তোমার বয়স যখন বছর দেড়েক তখনই হঠাৎ করে
আবিষ্কার করলাম-- তোমার মা তোমাকে সহ্য করতে পারে না। অযথা মারধোর করে, বকাবাজি তো করেই। আমি আমার গবেষণা নিয়ে এত বেশি মগড়ব ছিলাম যে, এই বিষয়গুলো খেয়ালই করিনি, যখন চোখে পড়লো ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। কয়েকটা উদাহরণ দিলে তুমি বুঝতে পারবে কত তুচ্ছ কারণে তোমার মা তোমাকে কী ভয়ংকর নির্যাতন করতো। তারপর পৃষ্ঠার-পর-পৃষ্ঠা জুড়ে সেইসব নির্যাতনের বিবরণ—এর কিছু আমার নিজেরও মনে আছে, অনেককিছু মনে নেইও। পড়তে পড়তে আমি শিউরে উঠি। কোনো মা যে তার সন্তানকে এই পরিমাণ নির্যাতন করতে পারে সেটা কল্পনাও করা যায় না। এই বর্ণনার পর আবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন। তাঁর গবেষণা প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে আবার, লিখতে গিয়ে আনুষঙ্গিক আরো বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। লিখেছেন-- প্রকৃতির যে বিচিত্র এবং বহুমাত্রিক প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাদের মধ্যে একটা ঐক্যসূত্র খুঁজে পাওয়ার এবং মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিটি কী ছিল সেটি আবিষ্কার করার জন্য আমি কাজটি শুরু করি আমেরিকায় বসে। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়-- অনেক আগে থেকেই নানাভাবে এই বিষয় নিয়ে কাজ হয়েছে।...
এরপর এ বিষয়ে কী কী কাজ হয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত অথচ মনোগ্রাহী বিবরণ দিয়েছেন এবং বিশেষ করে জগদীশ চন্দ্র বসু এবং আইনস্টাইনের ব্যাপারে তাঁর প্রচণ্ড আবেগ ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন--
এই দুজন মানুষ দুটো ভিনড়ব দিক থেকে এই ঐক্যসূত্রের সন্ধান করেছিলেন। কিন্তু জগদীশের কাজ বোঝার মতো তেমন কেউ সেই সময় সারা পৃথিবীতে ছিলেন না, এখনো নেই। ফলে কাউকে কিছু বোঝাতে না পেরে শেষ জীবনে তিনি অসম্ভব নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। সত্যি বলতে কী ওই কাজটির তিনিই শুরু তিনিই শেষ। অন্যদিকে আইনস্টাইন একটু বেশি বয়সে যে কাজটি শুরু করেছিলেন, সেটি শেষ করে যেতে পারেননি। পারলে প্রকৃতির মূল রহস্য বোঝা যেত। তোমার মনে হতে পারে-- এরকম
একটা কাজ করার যোগ্যতা আমার আছে কী না। হ্যাঁ, আছে। আমি জানি কাজটি কীভাবে শেষ করতে হবে। আমেরিকায় কাজটি শুরু করার বছরখানেক পর ওখানকার একটা কনফারেন্সে আমি এ বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম, এই বক্তৃতাগুলো নিয়ে তখন আমেরিকার বিভিনড়ব মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল এবং আমি হঠাৎ করে এসে দাঁড়ির্য়েছিলাম বিজ্ঞান কমিউনিটির কেন্দ্রে। দেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত যখন নিই, তখন ওরা আমাকে যে-কোনোকিছুর বিনিময়ে রেখে দিতে
চেয়েছিল-- আমি থাকিনি। কারণ আমার মনে হচ্ছিল-- এ কাজটি শেষ করার জন্য এই দেশের প্রকৃতি আমাকে সাহায্য
করবে। কাজটা প্রায় শেষের পথে, আমি সম্ভবত এখন জানি-- কেন এবং কীভাবে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল, এইসব
বহুমাত্রিক প্রকাশগুলোর মধ্যে সম্পর্কটাই বা কী।...
এরপর এই বিষয়ে তিনি আরো কিছু কথা লিখেছেন এবং ফিরে
গেছেন অন্য প্রসঙ্গে।
আমার এখন এসব লেখার কথা নয়, কিন্তু কেন জানি না, আমার
মনে হচ্ছে-- কোথায় যেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে
কাজটা শেষ করার ব্যাপারে একটা বাধা আসবে।
এই পৃষ্ঠাটা এখানেই শেষ। বোঝার কোনো উপায় নেই যে, তিনি
কোন ধরনের বাধার আশংকা করছিলেন আর এই আশংকার পেছনে
কারণটিই বা কী ছিল! এরপরের কয়েকটি পৃষ্ঠায় আবার মা-র প্রসঙ্গ--
আমি এখনো জানি না তোমার প্রতি তোমার মায়ের এমন বিরূপ
হয়ে ওঠার কারণ কী! তবে যেটুকু অনুমান করতে পারি সেটুকু
তোমাকে বলছি। তোমার মা ছোটবেলা থেকে দারুণ
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। ওর মা মারা গিয়েছিলেন ওর
ছোটবেলায়, আর ও ছিল ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়ো।
মানুষের জীবনে কৈশোরকালটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ--
মেয়েদের ক্ষেত্রে এই কথাটি আরো বেশি সত্যি, কারণ এই
বয়সেই মানুষের শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে
খুব দ্রুত। এই বয়সটি তোমার মা কাটিয়েছে নিদারুণ
আশংকায়, অজানা এক ভয়ে। নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে
তার, এর অনেককিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না, এই
বয়সটিতে মায়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করে,
কিন্তু তিনি না থাকায় এ সমস্তকিছু তাকে ফেস করতে হচ্ছিল
একা একা। তোমার মা দেখতে খুব রূপসী ছিল-- এটাও ছিল
তার জন্য এক বিরাট বিপদ। আমাদের সমাজটি ভীষণ বদ্ধ,
ছেলেমেয়ের সম্পর্ক এবং যৌনতা নিয়ে এখানে অহেতুক ট্যাবু
থাকার কারণে, বিশেষ করে ছেলেরা, এমনকি বুড়ো বয়সেও,
বিকৃতিতে ভোগে। আপাত ভদ্রলোকেরাও দাঁত-নোখ বের করে
তরুণী-রূপসী মেয়েদের দিকে ছুটে আসে। তোমার মা-র
দিকেও আসতো। এবং এদের অনেকে ছিল ওর বাবার বয়সী,
যাদেরকে কেউ সন্দেহই করতো না। নিজেকে রক্ষা করার জন্য
তোমার মাকে নানারকম কৌশল অবলম্বন করতে হতো,
নানারকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হতো, এবং এগুলো করতে
করতেই তার সমস্ত শক্তি ও সৃজনশীলতা শেষ হয়ে যেত।
তোমার মা-র গানের গলা ছিল অসম্ভব সুন্দর, কিন্তু গানের
শিক্ষকও তার দিকে লোলুপ হাত বাড়ানোর জন্য গান জিনিসটির
প্রতিই তার বিবমিষা জন্ম নেয়। গাওয়া তো দূরের কথা গান সে
শুনতেও পারতো না। তার এইসব জটিলতার সঙ্গে আমার
পরিচয় ঘটে বিয়ের পরে। পরিচিত কোনো কোনো মানুষকে
দেখে সে অস্বাভাবিক ভয়ে কেঁপে উঠতো, কোনো মানুষকে
দেখে ঘৃণায় কুঁচকে উঠতো, ঘৃণার মাত্রা এত তীব্র ছিল যে,
বাসায় এসে গোসল না করা পর্যন্ত স্বস্তি পেতো না! এসবই
অসুস্থতার লক্ষণ-- আমি জানতাম। আমি তাই প্রম থেকেই
তাকে এসব কমপে−ক্স থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর
সব মানুষই যে দাঁত-নোখ বের করে তার দিকে ছুটে আসছে না,
সেটা ওকে বোঝাতে আমার প্রায় বছরদুয়েক সময় লেগেছিল।
যাই হোক, আমার কাছে এসে ও হয়তো নিরাপত্তা পেয়েছিল।
আর দীর্ঘদিন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার পর যখন সে নিরাপত্তা
পেলো তখন যেন সমস্ত ক্লান্তি, সমস্ত কষ্ট, সমস্ত বেদনা, সমস্ত
কানড়বা এসে তাকে দখল করলে। এতসব জটিলতা নিয়েও আমি
সুখী ছিলাম। তোমার মা অসুস্থ হলেও মোটের ওপর
ভালোমানুষ-- তার অসুস্থতার জন্য তো আর সে দায়ী নয়!
যাহোক, জটিলতাগুলো সে কাটিয়ে উঠেছিল। তোমার জন্মের
সময় সে পুরোপুরি সুস্থই ছিল। কিন্তু তোমার জন্মের পর আমার
সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এলে তুমি। একদিকে আমার
গবেষণা অন্যদিকে তুমি, এই দুইয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে
গিয়ে তোমার মায়ের প্রতি আমি আর আগের মতো মনোযোগ
দিতে পারিনি। এমনকি এটাও খেয়াল করিনি যে, ওর অসুস্থতার
পুরনো লক্ষণগুলো আবার ফিরে আসছে। আমি তখন গবেষণার
বিষয়টি নিয়ে এমন এক ঘোরের মধ্যে থাকতাম যে, আমার কাছ
থেকে অন্য সবকিছু বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই ব্যাপারটি তুমি
ঠিক বুঝবে কী না জানি না। আমার সারা জীবনের আরাধ্য
রহস্য যখন ধীরে ধীরে তার আবরণ খুলে নিজেকে মেলে ধরছে
আমার সামনে, তখন আমি কীভাবে অন্যদিকে মনোযোগ দেব?
আমার এই অমনোযোগই তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি
ফিরিয়ে আনে বলে আমার ধারণা। এর মধ্যেই তোমার ওপর
তোমার মায়ের বীভৎস সব অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে। আমি
সারাদিন ইউনিভার্সিটিতে নিজের রুমে পড়ে থাকি, এমনকি
ক্লাসগুলোও নিয়মিত নিতে পারি না, কিন্তু মন পড়ে থাকে
বাসায়-- আতংকে ভুগি-- কখন তোমার কী হয়ে যায়! একটা
কথা তোমাকে বলা উচিত হবে কী না জানি না, তোমার কাছে
খুবই অস্বাভাবিক শোনাবে হয়তো, তবু বলি-- তোমার ওপর যে
নির্যাতনগুলো হতো সেগুলো সাধারণত আমার অনুপস্থিতিতে
ঘটতো, এবং তোমার মা কিংবা বাসার অন্য কেউ আমাকে সেসব
বলতো না, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে আমি তা জেনে
যেতাম। কীভাবে জেনে যেতাম সেটা আমার কাছে এক বিরাট
রহস্য। এই তো সেদিন, তোমার মা যেদিন তোমার হাত ভেঙে
ফেললো-- আমি ইউনিভার্সিটিতে নিজের রুমে বসে কাজ
করছিলাম, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিংবা জেগে ছিলাম,
কিংবা ঘোরে ছিলাম-- হঠাৎ শুনতে পেলাম, ‘আপনি যে এখানে
বসে আছেন, আপনার ছেলের হাত ভেঙে ফেলছে সেটা
দেখছেন না কেন? আপনার ছেলের জীবনের চেয়ে এইসব
আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’ কথাটা কে বললো, বা আদৌ
কেউ বললো কী না সেটা বিবেচনা না করেই আমি বাসার দিকে
ছুটলাম এবং এসে দেখলাম-- সত্যিই তোমার হাত ভেঙে ফেলা
হয়েছে! একে তুমি কী বলবে? যাই হোক এই ঘটনার পর
আমার হঠাৎই মনে হলো, কিংবা আমি স্বপেড়ব দেখলাম কিংবা
আগের মতো কেউ একজন বললো-- আমাকে যে-কোনো
একটি বেছে নিতে হবে, হয় আমার গবেষণার সাফল্য অথবা
তোমার জীবন। গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তোমার মৃত্যু
অনিবার্য এবং সেটা তোমার মায়ের হাতে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে
ফেললাম।
ডায়েরির পাতা শেষ, লেখাও শেষ। আমি এক বিস্ময়কর ঘোর নিয়ে
বসে রইলাম। কোনটি সত্যি, কোনটি মিথ্যে, কোনটি বাস্তব, কোনটি
কল্পনা, কোনটি ঘোর, কোনটি রহস্য-- এসবকিছুকে আলাদা করা
আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলাম
কয়েকদিন। বারবার ডায়রি খুলে রহস্যময় লেখাগুলো পড়লাম, তাতে
করে ঘোর তো কমলোই না, বরং আরো বাড়লো। মনে হলো-- এই
সমস্তকিছুর রহস্যভেদ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ-ও মনে
হলো-- এ সবই পাগলের প্রলাপ-- শুধু আমার মা-ই নয়, বাবা
নিজেও অসুস্থ ছিলেন। মারাতড়বক ধরনের হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন।
প্রকৃতির রহস্যভেদ, সৃষ্টিরহস্যের কূলকিনারা করা-- এসব ভূয়া,
ফালতু কথা। একটি অসুস্থ দম্পতির ঘরে জন্ম নিয়ে আমি কীভাবে
এখনো সুস্থ আছি সেটা ভেবে অবাক লাগলো। বাবার মহাপ্রতিভাবান
ইমেজ হঠাৎ করেই আমার কাছে ফিকে হয়ে এলো, এবং মা-র জন্য
মন খারাপ লাগতে লাগলো। অনেকদিন পর মাকে দেখতে ইচ্ছে
হলো আমার। আশ্চর্য ব্যাপার-- মা-র সম্বন্ধে আমি কারো কাছ থেকে
ইতিবাচক কোনো কথা শুনিনি কোনোদিন-- এমনকি আমার নানার
বাড়ির লোকজনও তাকে অপছন্দই করে, তারাও বাবার প্রশংসায়
মুখর, আমার নিজেরও কোনো মধুর স্মৃতি নেই মাকে ঘিরে, তার কথা
মনে হলে কেবলই ভয়াল সব স্মৃতি তেড়ে আসে-- তবু মা-র প্রতি
আমি সবসময় একটা তীব্র ভালোবাসা বোধ করে এসেছি, কখনো
কোনো বিরূপ মনোভাব আমার মধ্যে জন্ম নেয়নি। এই ডায়েরি পড়ার
পর সেই ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল, সঙ্গে যুক্ত হলো এক গভীর
সহানুভূতি। নানা মারা যাওয়ার পর ও বাসায় মা-র জায়গা হয়নি,
মামারা তাকে দূরে-- শহরতলীর একটা ক্লিনিকে-- রেখেছে। আমি
মাঝে মাঝে সেখানে তাকে দেখতে যাই। মা কোনো কথা বলে না--
আগে যেমন দূর দূর করতো এখন তা-ও করে না, এক অদ্ভুত
নীরবতা আর ঔদাসীন্য তাকে ঘিরে থাকে। কিন্তু এবার আমাকে
দেখেই মা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো, হাসলো মিষ্টি করে, তারপর
মধুর স্বরে বললো-- ‘কোনো কূলকিনারা করতে পারলি?’
আমি অবাক হলাম। এত স্বাভাবিকভাবে মা কোনোদিন আমার
সঙ্গে কথা বলেনি।
‘পারলি না, তাই না?’-- মা আবারও বললো-- ‘পারবি না। এর
কোনো কূলকিনারা কেউ করতে পারবে না।’
‘তুমি কিসের কথা বলছো মা?’
‘এই যে, যা নিয়ে পড়ে আছিস, ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছিস...’
‘তুমি জানো, আমি কী নিয়ে ভাবছি?’
‘হ্যাঁ, জানবো না কেন? তুই তোর বাবার কাজকর্ম নিয়ে ভাবছিস।’
‘তুমি জানলে কীভাবে? সাজ্জাদ চাচা এসেছিলেন, না?’
‘সাজ্জাদ চাচাটা আবার কে?’
‘কেন, তুমি চেনো না?’
না, কোনোদিন নামও শুনিনি। কে সে?’
‘সত্যি তুমি চেনো না?’
‘না, কেন?’
‘তাহলে তুমি জানলে কীভাবে যে আমি বাবার কাজকর্ম নিয়ে
ভাবছি, এতদিন তো একথা জিজ্ঞেস করোনি! ’
‘ও এই কথা! এটা তো... এটা তো...এমনিতেই জেনেছি।’
‘কীভাবে জেনেছ?’
‘তোর বাবা যেভাবে সব জেনে ফেলতো, আমিও সেইভাবেই
জেনেছি।’
‘এর মানে কী মা?’
‘জানি না রে বাবা, আমি জানি না। কিছু বুঝিও না। কীভাবে যে
সব জেনে ফেলি নিজেও বুঝি না। তোর বাবা জানতো, বুঝতো।
একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। কিন্তু অসম্ভব একটা কাজে হাত
দিয়েছিল সে...প্রকৃতির রহস্যভেদ...সৃষ্টির রহস্যভেদ...হয় না,
এভাবে হয় না...প্রকৃতি হলো নারীর মতো...পরতে পরতে তার
রহস্য, এক পরত খুললে আরেক পরত, তারপর আরেক পরত,
তারপর আরেকটা...’ -- মা এলোমেলোভাবে অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত, উদ্ভট
সব কথা বলে যেতে থাকে। আমি কোনো কথা না বলে বাইরে
বেরিয়ে আসি। অনেককিছুই জিজ্ঞেস করার ছিল, কিন্তু মনে হলো--
কোনো লাভ নেই, এসবের কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না।
রাত গভীর হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানে নক্ষত্রের
মেলা। রাত জাগা পাখি, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বসন্তের মৃদুমন্দ
হাওয়ায় গাছের পাতাদের ফিসফিসানি, এইসব রাস্তাঘাট, পাশ দিয়ে
টুংটাং বেল বাজিয়ে চলে যাওয়া খালি রিকশা, বন্ধ দোকানপাট,
বাড়িঘর, দালানকোঠা-- এদের সবাই যেন আমাকে কিছু বলতে
চাইছে। কী বলতে চাইছে? আমি কেন বাবার মতো এদের ভাষা বুঝি
না? একা একা দীর্ঘপথ হেঁটে যাই, আমার একা লাগে... একা
লাগে... একা লাগে। তবু আমি হাঁটতে থাকি। রাত বাড়ছে, মানুষের
ঘুমোবার আয়োজন চলছে, সবকিছু μমশ নীরব-নির্জন হয়ে পড়ছে,
আমি তবু হাঁটতেই থাকি, শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামের মেঠোপথ
ধরে অনির্দিষ্টভাবে হেঁটে যাই... হেঁটে যাই। হঠাৎ মনে হয়, আমি তো
একা নই, মনে হয়-- আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার সামনে উন্মোচিত
হবে এক অশ্র“ত ভাষার জগৎ, মনে হয়-- এই বিপুল সৃষ্টিজগৎ, এই
দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সমস্তকিছু-- আমি এদেরই একজন, আলাদা
কোনো অস্তিত্বই নেই আমার, আমি যেন এদেরই এক নগণ্য সদস্য
মাত্র।
মার্চ, ২০০৬
এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী আমার মা, তার কাছ থেকেও কিছু জানার উপায় নেই, তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা আরোগ্যাতীত। অনেকের কাছে শুনেছি, মা-ই নাকি বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের নিচে ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু বীভৎস মৃত্যুদৃশ্যটি সহ্য করতে পারেনি বলে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অন্যপক্ষ বলেন, বাবা সুইসাইড করেছিলেন এবং মাকে এই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী বানানোর জন্য ইচ্ছে করেই তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর কোনটি সত্যি কোনটি মিথ্যে তা নির্ণয় করা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হয়নি। বাবার মৃত্যু এবং মায়ের অসুস্থ হয়ে পড়ার পর নাকি আমাকে নিয়ে একটা টানাটানি হয়েছিল। মানে, আমি কোন বাড়ি থাকবো তাই নিয়ে দুই পরিবারের যুদ্ধ। ব্যাপারটি নাকি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল, এবং আমার চাচা-ফুপুরা
জয়ী হয়েছিলেন শুধু এই যুক্তিতে যে, আমার মা একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা, তার কাছে আমার থাকাটা নিরাপদ নয়। আমি বড়ো হয়ে উঠেছি দাদা-দাদু, চাচা-চাচি, ফুপুদের কাছেই। না, তাদের কাছে কোনো অবহেলা-অনাদর পাইনি আমি, বরং একটু বাড়াবাড়ি রকমের আদর-যতড়ব করেছেন তারা। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে আর কোনো কিশোর এমন অসাধারণ ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠে বলে আমার জানা নেই। আমার দাদাবাড়ির প্রায় সবাই অসম্ভব আবেগপ্রবণ, যুক্তির চেয়ে তাদের কাছে আবেগ অনেক বেশি মর্যাদা পায়, তাদের প্রায় সব সিদ্ধান্তও আবেগতাড়িত। তারা আমাকে যেমন ভালোবেসেছেন তেমনি মায়ের প্রতি আমার ঘৃণা জাগানোর যাবতীয় কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন। এ বাড়ির সবারই দৃঢ় বিশ্বাস-- মা-ই বাবাকে মেরে ফেলেছে। মা যে অত্যন্ত নিষ্ঠুর একজন মানুষ এবং এ কাজ করা যে তার জন্য খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার—এটা আমাকে বিশ্বাস করানোর জন্য তারা চেষ্টার অন্ত রাখেনি। ঠিক মেরে ফেলার মতো কী এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, অনেক জিজ্ঞেস করেও এই প্রশেড়বর কোনো সদুত্তর আমি পাইনি। অন্যদিকে, এমন একটি ভয়ংকর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মা-র সঙ্গে বা নানবুড়ির সঙ্গে আমার যোগাযোগ অক্ষুণড়ব ছিল, এবং সেখানে যেতে চাইলে এ বাড়ির কেউ বাধা দিতো না। মাঝে মাঝে মা-র জন্য খুব মন খারাপ হতো, বাবার মৃত্যুর পর মা-র সঙ্গেও এমন অনিচ্ছাকৃত দূরত্ব আমাকে ভীষণ একা করে দিয়েছিল। দুজনকেই আমি খুব মিস করতাম। বড়োরা আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আদালত পর্যন্ত দৌড়েছেন অথচ আমাকে একটিবারের জন্যও কেউ জিজ্ঞেস করেননি যে আমি কার কাছে থাকতে চাই। মনে আছে, জজ সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস
করেছিলেন-- তুমি কোন বাড়ি থাকতে চাও-- দাদুবাড়ি না নানুবাড়ি!আমি স্বাভাবিকভাবেই দাদুবাড়ির কথাই বলেছি-- বাড়ি বলতে আমি তো দাদুবাড়িই বুঝতাম, এখনো তাই বুঝি, কিন্তু আমি তো এ বাড়িতে থাকতে চেয়েছি মাকে নিয়েই, মা এ বাড়িতে আর থাকবে না জানলে আমি নিশ্চয়ই সেটা বলতাম না! তো, মা-র জন্য মন খারাপ হলে দাদুকে বলতাম, দাদু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দাদাকে দিয়ে আমাকে ও বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। দাদা গিয়ে নানার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন, আমার দাদা আর নানা নাকি বন্ধু ছিলেন-- এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটার
পরও কীভাবে তাদের সেই সম্পর্ক অটুট ছিল, সে-ও এক রহস্য। মারকাছে যাওয়াটা আমার জন্য কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। আমাকে দেখলেই মা ভয়ংকর খেপে যেত, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতো, তেড়ে মারতেও আসতো-- ‘আবার তুই এখানে এসেছিস। দূর হ, চলে যা আমার সামনে থেকে। হারামজাদা, তোর জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’ আমি একটু দূর থেকে মা-র এই রুদ্রমূর্তি দেখতাম, কাছে ঘেঁষার সাহস হতো না, যদি মারধোর করে—এই ভয়ে! তবু আমি বারবার মাকে দেখতে চাইতাম, এত ভালো লাগতো মায়ের মুখ! মনে হতো-- এত সুন্দর মুখ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আমাকে দেখলেই মা কেন এমন খেপে উঠতো, আমার অপরাধটা কী তা আমি কোনোদিনই বুঝে উঠতে পারিনি। এরকম অনেক না-বোঝা নিয়ে আমি বড়ো হয়ে উঠেছি। কোনোদিন মা আমাকে কাছে ডেকে আদর করে দুটো কথা বলেছে—এমন কোনো স্মৃতি আমার নেই, যদিও বাবাকে নিয়ে আমার অসংখ্য মধুর স্মৃতি। বাবাকে তো ছোটবেলাতেই হারিয়েছি, আমার বয়স তখন মাত্র বছর দশেক-- এতসব কথা কীভাবে যে মনে আছে! প্রতিদিন বাইরে যাওয়ার সময় আমি এটা-ওটার জন্য বায়না ধরতাম এবং আবশ্যিকভাবে বাবা সেগুলো নিয়েই ঘরে ফিরতো। আমার এত খেলনা জমেছিল যে সেগুলো রাখার জন্য বড়োসড়ো একটা আলমারির প্রয়োজন হতো। এখনো সেই খেলনাগুলো আমি রেখে দিয়েছি। কিন্তু এসবের চেয়ে আমার কাছে মধুর হয়ে আছে ঘুম পাড়ানোর স্মৃতি। ছোটবেলায় আমি সহজে ঘুমাতে চাইতাম না, মা আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে টায়ার্ড হয়ে পড়তো আর একসময় বকাবাজি শুরু করতো, মা-র কাছে ঘুমাতে তাই ইচ্ছে করতো না। বাবা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাজ করতো, তবু আমি বায়না ধরতাম--‘আমি তোমার সাথে ঘুমাবো বাবা।’ কাজ ফেলে, হয়তো আমাকে বকাবাজি থেকে রক্ষা করার জন্যই, বাবা আমাকে ঘুম পাড়াতে আসতো। বাবার ঘুম পাড়ানোর পদ্ধতিটা ছিল অদ্ভুত। আমার সারা গায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলাতে বুলাতে গান গাইতো, ঘুম পাড়ানি গান-- আয়রে আয় ঘুম আয়, আমার বাবার চোখে নেমে আয়; কিংবা ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো ; কিংবা খোকনসোনা বলি শোনো, থাকবে না আর দুঃখ কোনো, মানুষ যদি হতে পারো ;-- এইরকম আরো কত কত গান। বাবার ওই করুণ মধুর গানগুলো শুনতে শুনতে আমি মুহূর্তের মধ্যে ঘুমে তলিয়ে যেতাম। শুধু গান নয়, বাবা আমাকে মাঝে মাঝেই নিয়ে যেত রূপকথার রাজ্যে এবং সেখানে অনিবার্যভাবে আমিই হতাম রাজপুত্র। পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিতো ফুলের দেশে, কথা হতো ফুলপরীর সঙ্গে, বাবার শিখিয়ে দেয়া কথামতো আমি তাদেরকে ঘুমপরীর কথা জিজ্ঞেস করতাম-- কোথায় সে, কেন আমার চোখে নেমে আসছে না! তারা বলতো-- আমরা তো জানি না, তবে চাঁদপরী জানতে পারে। যেতাম চাঁদের দেশে চাঁদপরীর কাছে। চাঁদপরী বলতো-- ঘুমপরী তো এই কিছূক্ষণ আগে মেঘের দেশে বেড়াতে গেছে। ছুটে যেতাম মেঘপরীদের দেশে—মেঘপরীরা বলতো, ঘুমপরী তো আমাদের আড়ালে লুকিয়ে আছে, তুমি তো রাজপুত্র, তুমি না ডাকলে নাকি ও যাবে না। আমি তখন ঘুমপরীকে ডাকতাম-- ঘুমপরী এসো! আমার তো ঘুম আসছে না, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। বলতে-না-বলতে আমার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতো, মনে হতো সত্যি বুঝি ঘুমপরী নেমে এসেছে আমার চোখে, ঘুমপরীর আদর নিতে নিতে এক মধুর অনুভূতি নিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতাম আমি। মা বলতো-- ‘তুমি তো ওর অভ্যাস খারাপ করে ফেলছো। ঘুমানোর জন্য এত বাহানা করতে হয় নাকি!’
‘কেন, তুমি একটু আদর-টাদর করে ঘুম পাড়াতে পারো না! বাচ্চা একটা ছেলে। এই বয়সেই তো ওর এসব গল্প শুনতে ইচ্ছে করবে।’
‘না, আমি অতো আহ্লাদ করতে পারবো না।’
‘আচ্ছা, তোমাকে করতে হবে না। আমিই করবো।’
‘না, তুমিও করবে না। ফালতু আহ্লাদ দিয়ে তুমি ওর মাথাটা নষ্ট করে দিচ্ছ।’
‘আমার তো একটাই মাত্র ছেলে, ওকে আহ্লাদ দেবো না তো কাকে দেবো!’
এইসব তর্ক প্রায়ই হতো। মাঝে মাঝে ঝগড়াও হতো, তা-ও আমাকে কেন্দ্র করেই। ঝগড়া অবশ্য বলা যায় না, বাবা ছিল চুপচাপ ধরনের লোক-- খুব অল্প কথা বলতো, মা একাই চিৎকার-চেঁচামেচি করে যেত। একসময়, আমি তখন কেবল বুঝতে শিখেছি, বাবা একেবারেই চুপ হয়ে গেল। মা-র সঙ্গে দিনের-পর-দিন একটা কথাও বলতো না, মাঝে মাঝে মা কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে শুনেছি--
‘তুমি তোমার রাগ কমাও, না হলে আমি কথা বলবো না।’ শুধু মা নয়, দাদু ছাড়া বাসার অন্য কারো সাথেও কথা বলতো না বাবা-- যদিও আমার সঙ্গে প্রচুর কথা বলতো, গল্প করতো, আমার আহ্লাদ- আব্দার হাসিমুখে মেনে নিতো। তারপর কোত্থেকে যে কী হলো বুঝতে পারলাম না, শুধু এটুকু মনে আছে-- দিন দিন মা-বাবার সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে গেল, মা-র রাগ-মেজাজ বেড়েই চললো এবংসেগুলোর অধিকাংশই এসে পড়তে লাগলো আমার ওপর। আমি আমার অপরাধ বুঝে ওঠার আগেই মা-র কাছে ভয়ংকরভাবে মার খেতে লাগলাম। ছোটবেলার সেইসব নির্মম মারের কথা এখনো পরিষ্কারভাবে মনে আছে আমার। মা আমাকে একবার বটি দিয়ে মারতে এসেছিল-- সেই রুদ্র মূর্তি এখনো চোখে ভাসে আমার, এখনো মনে হলে আতংকে কেঁপে উঠি। আরেকবার মা আমার হাত ভেঙে দিয়েছিল। আমি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলাম, কিন্তু কানড়বার সাহসটুকু
পর্যন্ত পাইনি, কারণ মা হিসহিস করে বলছিল-- ‘একফোঁটা শব্দ করবি না, শব্দ করলে মেরেই ফেলবো।’ আমি তার কথা বিশ্বাসও করেছিলাম। মা এসব অত্যাচার করতো বাবার অনুপস্থিতিতে, আবার বাবার কাছে এসব কথা বলার উপায়ও ছিল না-- মা কঠিনভাবে সাবধান করে দিতো-- ‘বাবাকে বললে খুন করে ফেলবো।’ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বাবা বাসায় ফিরেই বুঝে ফেলতো-- কিছু একটা ঘটেছে। মা যেদিন আমার হাত ভেঙে ফেললো-- এতদিন আগের কথা তবু আমার স্পষ্ট মনে আছে-- বাসায় ঢুকেই বাবা বললো, ‘কী হয়েছে বাবা, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’ আমার খুব কানড়বা পাচ্ছিল, কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছিল না-- ‘বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো-- ‘কী হয়েছে আব্বু, কী হয়েছে তোমার?’
‘ব্যথা পেয়েছি।’ -- কোনোমতে বলতে পারলাম
‘কোথায় ব্যথা পেয়েছ?’
‘হাতে।’
‘হাতে! দেখি দেখি’-- বাবা দেখলো আমার হাত ফুলে উঠেছে, আমি ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। ভ্রু কুঁচকে বাবা জিজ্ঞেস করলো--
‘কীভাবে ব্যথা পেলে বাবা? মনে তো হচ্ছে ভেঙে গেছে!’
মা আগ বাড়িয়ে বললো-- ‘খাট থেকে পড়ে গিয়েছিল...’
‘ওকে বলতে দাও’-- বাবা গম্ভীর স্বরে বললো।
‘বলো বাবা, কীভাবে ব্যথা পেলে?’
‘খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলাম...’ -- আমি মা-র কথাই রিপিট করলাম। বাবা মনে হয় বিশ্বাস করলো না। আমাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ালো, ডাক্তাররা এক্সরে করে জানালেন-- ভেঙে গেছে, প্লাস্টারও করে দিলেন। বাসায় ফিরে বাবা আরো গম্ভীর, মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো-- ‘ওর হাত কীভাবে ভাঙলো?’
‘বললাম তো!’
‘মিথ্যে কথা বলবে না, এত বড়ো ছেলে এই নিচু খাট থেকে পড়ে হাত ভাঙে নাকি? কীভাবে ভেঙেছে বলো!’
মা এবার ভেঙে পড়লো, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো-- ‘আমি ভেঙেছি।’
‘তুমি ভেঙেছ মানে?’
‘হ্যাঁ, আমি ভেঙেছি। আমি নিজে ওর হাত ভেঙে দিয়েছি।’
‘কেন ভেঙেছ, জানতে পারি?’-- বাবা অতিমাত্রায় স্বাভাবিক।
‘আমি ওকে গোসল করে নিতে বলছিলাম কিন্তু আমার কথা না শুনে ও খেলছিল, তাই মাথায় রাগ উঠে গিয়েছিল।’
‘আর তাই তুমি তোমার নিজের ছেলের হাত নিজে ভেঙে ফেললে!’
মা চুপ।
‘তুমি কি মানুষ? কোনো মা নিজের ছেলেকে বিনা কারণে এরকম ভয়ংকর শাস্তি দিতে পারে সেটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। মা তো দূরের কথা, অন্য কোনো মানুষের পক্ষেও এরকম পৈশাচিক কাজ করা সম্ভব নয়। তুমি তা বোঝো?’
‘হ্যাঁ বুঝি, আমি ... আমি... আমি তো অসুস্থ।’
‘না তুমি অসুস্থ নও। তুমি একটা ডেভিল। শয়তানের সাক্ষাৎ বংশধর। তুমি এর শাস্তি পাবে। সারাজীবন ধরে তোমাকে সেই শাস্তি বহন করে যেতে হবে। এতদিন আমি তোমাকে কিছু বলিনি, অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, সাইμিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছি, বছরের-পর-বছর ধরে তোমাকে হেল্প করার চেষ্টা করেছি,
কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তুমি নিজে নিজের এই স্বভাবটাকে পাল্টাতে চাও না। ঠিক আছে, তুমি তোমার রাগ নিয়েই বাঁচো, কিন্তু আমি তোমাকে শাস্তি দেবো, ভয়ংকর শাস্তি, ভয়ংকর শাস্তি...’ –বাবা বারবার ভয়ংকর ভয়ংকর শব্দটি বলছিল, আর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছিল। মা অবিরল কাঁদছিল, কিন্তু ওই কানড়বা বাবাকে এতটুকু স্পর্শ করছিল না। এর কিছুদিন পরই বাবা মারা গেলেন। বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে আমি আরেকটি রহস্যের মুখোমুখি হই। জানতে পারি-- বাবা নাকি বিস্ময়কর রকমের মেধাবী মানুষ ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, কিন্তু তারচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে-- জীবনের শেষ কয়েকটি বছর তিনি কিছু একটা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছিলেন। গবেষণার এই কাজটি তিনি শুরু করেছিলেন বিদেশে বসে এবং একটু গুছিয়ে উঠতেই তিনি ফিরে আসেন এই যুক্তিতে যে, কাজটা তিনি দেশে বসে শেষ করতে চান। কারণ, গবেষণাটা শেষ হলে এই একটি কাজের জন্যই নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি নাকি বলতেন-- শেষ করে এনেছি, প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, এখন শুধু চূড়ান্ত রূপটি দিতে হবে। এসব কথা আমি জানতে পারি বাবার সহকর্মী এবং বন্ধু সাজ্জাদ চাচার কাছ থেকে। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই তিনি প্রায় নিয়ম করে আমাকে দেখতে আসতেন। বাবাকে নিয়ে নানারকম গল্প করতেন, বাবার রহস্যময় কাজ নিয়ে আলোচনা করতেন, বলতেন-- ‘এ
জাতির দুর্ভাগ্য যে কাজটি তিনি শেষ করে যেতে পারলেন না। এত বড়ো প্রতিভাবান মানুষ আরো একশো বছরেও এ দেশে জন্মাবে কীনা সন্দেহ আছে।’ এসব কথায় আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যেত। কী ছিল বাবার গবেষণার বিষয়, প্রায় শেষ করে আনা কাজটিরই বা কী হলো-- এসব নিয়ে আমার কৌতূহলের কোনো উত্তরও পাইনিবহুদিন। কারণ, মৃত্যুর পর তাঁ র অফিসরুম খুলে দেখা গিয়েছিল-- সমস্ত কাগজপত্র পোড়ানো, রুম জুড়ে ছাইয়ের স্তুপ। এই তথ্যটি অবশ্য আমাকে প্রায় নিশ্চিত করে দেয়, বাবার মৃত্যুটা আত্মহত্যা ছিল-- একদম পরিকল্পনা করে, দিনক্ষণ ঠিক করে তিনি তাঁর কাগজপত্রগুলো নিজ হাতে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। সাজ্জাদ চাচারকাছেই শুনেছি-- বাবা কখনো তাঁর গবেষণার বিষয় সম্বন্ধে বা কাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু বলতেন না, সবাই শুধু জানতো-- কাজটি শেষ হলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূল রহস্যটা জানা যাবে। বাবা নাকি
খুব পপুলার শিক্ষক ছিলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে অসম্ভব পছন্দ করতো, তাঁর লেকচার শোনার জন্য অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট থেকেও নাকি ছেলেমেয়েরা ক্লাসে এসে বসতো। তিনি কোথাও দাঁড়ালে তাঁর চারপাশে নাকি ভিড় জমে যেত, এবং তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘণ্টারপর- ঘণ্টা কথা বলে যেতেন-- কিন্তু সে-সব কথা থেকে তাঁর মূল গবেষণা সম্বন্ধে কিছুই জানা যেত না। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়েছে যে, বাবা সম্ভবত এমন বড়োমাপের কোনো কাজ করছিলেন না, কিন্তু মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ায় এবং এরকম একটা বিরাট ইমেজ
তৈরি হওয়ায় তিনি বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন, ফলে গবেষণা সংμান্ত কাগজপত্রগুলো পুড়িয়ে ফেলে তিনি নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি আমার এই ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে, আসলে এতক্ষণ ধরে যা কিছু বলছি তা ওই পরিবর্তিত ধারণার জন্যই। নইলে বাবার মৃত্যু, মায়ের অসুস্থতা সবই তো মেনে নিয়েছি, মানিয়ে নিয়েছি এসবকিছুর সঙ্গে, এখন এমনকি খুব একটা মনও খারাপ হয় না-- তবু এতদিন পরে এসব নিয়ে কথা বলছি কেন? বলছি, কারণ, সাজ্জাদ চাচা সেদিন আমার হাতে একটি ডায়েরি দিয়ে গেছেন, বলেছেন-- ‘এই ডায়েরিটাতোমার বাবার অফিসরুমের টেবিলে ছিল, একটা প্যাকেটের মধ্যে। ওপরে আমার নাম লেখা ছিল, আমাকে লেখা একটা চিঠিও ছিল--
লিখেছিলেন, এই ডায়রিটা যেন আমি তোমার হাতে পৌঁছে দিই, তবে এখনই নয়। তুমি যখন যথেষ্ট বিবেচনাসম্পনড়ব এবং বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে তখন। আমি হয়তো আরো আগেই তোমার হাতে এটা দিতে পারতাম, তবু একটু বেশি সময় নিয়েছি তোমার কল্যাণের কথা ভেবেই। এখন আমার সময় হয়ে এসেছে-- বুড়ো হয়ে গেছি, কবে চলে যাই ঠিক নেই-- তোমাকে এটা বুঝিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চাই
বাবা।’ বলাই বাহুল্য, ঘটনাটা ছিল আমার জন্য এক বিরাট বিস্ময়। সাজ্জাদ চাচা, এমনকি, কোনোদিন বলেনওনি যে, তাঁর কাছে বাবা আমার জন্য কিছু একটা রেখে গেছেন। ডায়রিটা হাতে পেয়ে আমি পাগলের মতো পড়তে থাকি। একদম শুরুতে লেখা--
খোকাবাবু, আমার বাবা, এই লেখাগুলো তোমার জন্য।
তারপরের পৃষ্ঠায়--যখন তুমি এটা পড়বে, আমি হয়তো তখন থাকবো না। কিন্তু তোমার মনে থাকবে অনেক অনেক প্রশড়ব, যেগুলোর উত্তর তুমি কোথাও পাবে না, কেউ তোমাকে সেসব প্রশেড়বর উত্তর দেবে না,
যদিও বিষয়গুলো তোমার জানা উচিত।
তারপরের পৃষ্ঠায়--
তোমার মা যখন কনসিভ করলো এবং আমরা সেটা জানতে পারলাম, তখন থেকেই তোমার মা এবং আমি মিলে তোমার সঙ্গে কমিউনিকেট করার চেষ্টা করেছি। আমি একজন বিজ্ঞানকর্মী। বিজ্ঞান যদিও কোথাও বলেনি যে, গর্ভস্থ শিশুর সঙ্গে কমিউনিকেট করা যায় তবু আমি সেই চেষ্টাটা করেছিলাম একটি বিশেষ কারণে। আমাদের দেশে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, গর্ভবতী মায়েরা যদি সবসময় সুন্দর কোনো দৃশ্য দ্যাখে তাহলে তার বাচ্চা দেখতে সুন্দর হয়। এই সংস্কারের কারণেই আমাদের দেশের গর্ভবতী মেয়েদের অনেককিছু খাওয়া নিষেধ, অনেক দৃশ্য দেখা নিষেধ, অনেক জায়গায় যাওয়াও নিষেধ। ঘরের মধ্যে সুন্দর কিছু রেখে দেয়া হয় যেন প্রতিমুহূর্তে গর্ভবতীদের সেটা চোখে পড়ে। হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের মানুষগুলো এসব বিশ্বাস করে এসেছে-- সেই অনুযায়ী কাজও করেছে। এইসব বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। আমার মনে হলো-- দেখা যাক না, যদি সত্যিই সেটা করা যায়! তোমার মাকে আমি বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম-- সেও সহযোগিতার হাত বাড়ালো। আমরা প্রায় প্রতিদিন তোমার সঙ্গে কথা বলতাম, এমনভাবে বলতাম যেন সত্যিই তোমার অস্তিত্ব আছে, যেন তুমি সত্যিই সেসব শুনতে পাচ্ছো। শুধু কথা নয়, কবিতা পড়ে শোনানো, গান বাজিয়ে শোনানো প্রায় নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তোমার মা খুব সুন্দর গান গাইতো, সে-ও গেয়ে শোনাতো। একসময় মনে হলো—এরকম বিচ্ছিনড়বভাবে শোনালে হবে না, সেক্ষেত্রে ফলাফলটা বোঝা যাবে
না, অতএব আমরা একটা গান সিলেক্ট করে সেটাই প্রতিদিন নিয়ম করে চার-পাঁচবার তোমাকে শোনাতে লাগলাম।
একইসঙ্গে চলতে থাকলো তোমার জন্য এক কাতর প্রার্থনা। কার কাছে? আমি প্রচলিত অর্থে ধার্মিক মানুষ নই, ধর্ম নিয়ে কোনোদিন মাথাই ঘামাইনি, তাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিনি, করেছি সেই মহাশক্তিধর প্রকৃতির কাছে যার অপরূপ শৃঙ্খলা- সৌন্দর্য আর নিয়মের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছিলাম বিজ্ঞানের গবেষণা করতে গিয়ে। শুনলে তোমার কেমন লাগবে জানি না, তবু বলি-- তোমাকে কমিউনিকেট করার এই অদ্ভুত পরীক্ষাটি
সফল হয়েছিল। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, আমরা যে গানটি তোমাকে শোনাতাম, তোমার চারমাস বয়সের সময় সেই গানটি তুমি সনাক্ত করতে পেরেছিলে। কীভাবে জানো? ওই বয়সের শিশুদের আধাঘণ্টা পরপর খাওয়াতে হয়-- আমি তোমাকে প্রায় আটঘণ্টা না খাইয়ে রেখেছিলাম, তুমি ভয়াবহ কানড়বাকাটি করছিলে, কানড়বা থামানোর নানারকম চেষ্টা চলছিল—ঝুনঝুনি বাজানো, গান শোনানো, ইত্যাদি-- কিন্তু খাওয়ানো নিষেধ!
তোমার দাদু রেগেমেগে আমাকে মারতে এসেছিল, তোমার মা অবিরল কাঁদছিল, কিন্তু আমি তোমার কাছে কাউকে ভিড়তেই দিইনি। আটঘণ্টা পর, তোমার কানড়বাকাটির মাত্রা যখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে-- আমি তখন ওই গানটি বাজিয়ে দিলাম। এবং এক আশ্চর্য বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করলাম-- তোমার কানড়বা থেমে গেছে। শুধু তাই নয়, কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তুমি গানটি শুনলে, তারপর হাতপা নেড়ে আও আও করে কিছু বলার চেষ্টা
করলে, আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলে। এ ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আটঘণ্টা ধরে অভূক্ত কোনো শিশু, যে একটু আগেও সর্বশক্তি দিয়ে কাঁদছিল, সে একটি গান শুনে এভাবে হাসতে পারে সেটা কোনো বিশ্বাসযোগ্য দৃশ্য নয়। এই ফলাফলের কথা আমি কোথাও প্রকাশ করতে পারিনি, কিন্তু ঘটনাটা আমার মধ্যে এক গভীর পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। আমি যে গবেষণাটাকরছিলাম সেখানেও এক বিরাট পরিবর্তন আসে এই ঘটনাটার
পরই।
এই পৃষ্ঠাটা এই পর্যন্তই। সম্ভবত লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন-- ভেবেছিলেন পরে লিখবেন, কিন্তু পরের পৃষ্ঠায় আর এ প্রসঙ্গ নেই, আছে সম্পূর্ণ ভিনড়ব একটি প্রসঙ্গ। লিখেছেন-- আমার মনে হয়েছিল, তোমার মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে আমার এক ধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। তুমি আমার কাছে কেবলমাত্র আমার সন্তানই নও, প্রকৃতির বিশেষ বার্তাবাহক। অথচ তোমার বয়স যখন বছর দেড়েক তখনই হঠাৎ করে
আবিষ্কার করলাম-- তোমার মা তোমাকে সহ্য করতে পারে না। অযথা মারধোর করে, বকাবাজি তো করেই। আমি আমার গবেষণা নিয়ে এত বেশি মগড়ব ছিলাম যে, এই বিষয়গুলো খেয়ালই করিনি, যখন চোখে পড়লো ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। কয়েকটা উদাহরণ দিলে তুমি বুঝতে পারবে কত তুচ্ছ কারণে তোমার মা তোমাকে কী ভয়ংকর নির্যাতন করতো। তারপর পৃষ্ঠার-পর-পৃষ্ঠা জুড়ে সেইসব নির্যাতনের বিবরণ—এর কিছু আমার নিজেরও মনে আছে, অনেককিছু মনে নেইও। পড়তে পড়তে আমি শিউরে উঠি। কোনো মা যে তার সন্তানকে এই পরিমাণ নির্যাতন করতে পারে সেটা কল্পনাও করা যায় না। এই বর্ণনার পর আবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন। তাঁর গবেষণা প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে আবার, লিখতে গিয়ে আনুষঙ্গিক আরো বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। লিখেছেন-- প্রকৃতির যে বিচিত্র এবং বহুমাত্রিক প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাদের মধ্যে একটা ঐক্যসূত্র খুঁজে পাওয়ার এবং মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিটি কী ছিল সেটি আবিষ্কার করার জন্য আমি কাজটি শুরু করি আমেরিকায় বসে। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়-- অনেক আগে থেকেই নানাভাবে এই বিষয় নিয়ে কাজ হয়েছে।...
এরপর এ বিষয়ে কী কী কাজ হয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত অথচ মনোগ্রাহী বিবরণ দিয়েছেন এবং বিশেষ করে জগদীশ চন্দ্র বসু এবং আইনস্টাইনের ব্যাপারে তাঁর প্রচণ্ড আবেগ ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন--
এই দুজন মানুষ দুটো ভিনড়ব দিক থেকে এই ঐক্যসূত্রের সন্ধান করেছিলেন। কিন্তু জগদীশের কাজ বোঝার মতো তেমন কেউ সেই সময় সারা পৃথিবীতে ছিলেন না, এখনো নেই। ফলে কাউকে কিছু বোঝাতে না পেরে শেষ জীবনে তিনি অসম্ভব নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। সত্যি বলতে কী ওই কাজটির তিনিই শুরু তিনিই শেষ। অন্যদিকে আইনস্টাইন একটু বেশি বয়সে যে কাজটি শুরু করেছিলেন, সেটি শেষ করে যেতে পারেননি। পারলে প্রকৃতির মূল রহস্য বোঝা যেত। তোমার মনে হতে পারে-- এরকম
একটা কাজ করার যোগ্যতা আমার আছে কী না। হ্যাঁ, আছে। আমি জানি কাজটি কীভাবে শেষ করতে হবে। আমেরিকায় কাজটি শুরু করার বছরখানেক পর ওখানকার একটা কনফারেন্সে আমি এ বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম, এই বক্তৃতাগুলো নিয়ে তখন আমেরিকার বিভিনড়ব মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল এবং আমি হঠাৎ করে এসে দাঁড়ির্য়েছিলাম বিজ্ঞান কমিউনিটির কেন্দ্রে। দেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত যখন নিই, তখন ওরা আমাকে যে-কোনোকিছুর বিনিময়ে রেখে দিতে
চেয়েছিল-- আমি থাকিনি। কারণ আমার মনে হচ্ছিল-- এ কাজটি শেষ করার জন্য এই দেশের প্রকৃতি আমাকে সাহায্য
করবে। কাজটা প্রায় শেষের পথে, আমি সম্ভবত এখন জানি-- কেন এবং কীভাবে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল, এইসব
বহুমাত্রিক প্রকাশগুলোর মধ্যে সম্পর্কটাই বা কী।...
এরপর এই বিষয়ে তিনি আরো কিছু কথা লিখেছেন এবং ফিরে
গেছেন অন্য প্রসঙ্গে।
আমার এখন এসব লেখার কথা নয়, কিন্তু কেন জানি না, আমার
মনে হচ্ছে-- কোথায় যেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে
কাজটা শেষ করার ব্যাপারে একটা বাধা আসবে।
এই পৃষ্ঠাটা এখানেই শেষ। বোঝার কোনো উপায় নেই যে, তিনি
কোন ধরনের বাধার আশংকা করছিলেন আর এই আশংকার পেছনে
কারণটিই বা কী ছিল! এরপরের কয়েকটি পৃষ্ঠায় আবার মা-র প্রসঙ্গ--
আমি এখনো জানি না তোমার প্রতি তোমার মায়ের এমন বিরূপ
হয়ে ওঠার কারণ কী! তবে যেটুকু অনুমান করতে পারি সেটুকু
তোমাকে বলছি। তোমার মা ছোটবেলা থেকে দারুণ
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। ওর মা মারা গিয়েছিলেন ওর
ছোটবেলায়, আর ও ছিল ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়ো।
মানুষের জীবনে কৈশোরকালটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ--
মেয়েদের ক্ষেত্রে এই কথাটি আরো বেশি সত্যি, কারণ এই
বয়সেই মানুষের শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে
খুব দ্রুত। এই বয়সটি তোমার মা কাটিয়েছে নিদারুণ
আশংকায়, অজানা এক ভয়ে। নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে
তার, এর অনেককিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না, এই
বয়সটিতে মায়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করে,
কিন্তু তিনি না থাকায় এ সমস্তকিছু তাকে ফেস করতে হচ্ছিল
একা একা। তোমার মা দেখতে খুব রূপসী ছিল-- এটাও ছিল
তার জন্য এক বিরাট বিপদ। আমাদের সমাজটি ভীষণ বদ্ধ,
ছেলেমেয়ের সম্পর্ক এবং যৌনতা নিয়ে এখানে অহেতুক ট্যাবু
থাকার কারণে, বিশেষ করে ছেলেরা, এমনকি বুড়ো বয়সেও,
বিকৃতিতে ভোগে। আপাত ভদ্রলোকেরাও দাঁত-নোখ বের করে
তরুণী-রূপসী মেয়েদের দিকে ছুটে আসে। তোমার মা-র
দিকেও আসতো। এবং এদের অনেকে ছিল ওর বাবার বয়সী,
যাদেরকে কেউ সন্দেহই করতো না। নিজেকে রক্ষা করার জন্য
তোমার মাকে নানারকম কৌশল অবলম্বন করতে হতো,
নানারকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হতো, এবং এগুলো করতে
করতেই তার সমস্ত শক্তি ও সৃজনশীলতা শেষ হয়ে যেত।
তোমার মা-র গানের গলা ছিল অসম্ভব সুন্দর, কিন্তু গানের
শিক্ষকও তার দিকে লোলুপ হাত বাড়ানোর জন্য গান জিনিসটির
প্রতিই তার বিবমিষা জন্ম নেয়। গাওয়া তো দূরের কথা গান সে
শুনতেও পারতো না। তার এইসব জটিলতার সঙ্গে আমার
পরিচয় ঘটে বিয়ের পরে। পরিচিত কোনো কোনো মানুষকে
দেখে সে অস্বাভাবিক ভয়ে কেঁপে উঠতো, কোনো মানুষকে
দেখে ঘৃণায় কুঁচকে উঠতো, ঘৃণার মাত্রা এত তীব্র ছিল যে,
বাসায় এসে গোসল না করা পর্যন্ত স্বস্তি পেতো না! এসবই
অসুস্থতার লক্ষণ-- আমি জানতাম। আমি তাই প্রম থেকেই
তাকে এসব কমপে−ক্স থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর
সব মানুষই যে দাঁত-নোখ বের করে তার দিকে ছুটে আসছে না,
সেটা ওকে বোঝাতে আমার প্রায় বছরদুয়েক সময় লেগেছিল।
যাই হোক, আমার কাছে এসে ও হয়তো নিরাপত্তা পেয়েছিল।
আর দীর্ঘদিন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার পর যখন সে নিরাপত্তা
পেলো তখন যেন সমস্ত ক্লান্তি, সমস্ত কষ্ট, সমস্ত বেদনা, সমস্ত
কানড়বা এসে তাকে দখল করলে। এতসব জটিলতা নিয়েও আমি
সুখী ছিলাম। তোমার মা অসুস্থ হলেও মোটের ওপর
ভালোমানুষ-- তার অসুস্থতার জন্য তো আর সে দায়ী নয়!
যাহোক, জটিলতাগুলো সে কাটিয়ে উঠেছিল। তোমার জন্মের
সময় সে পুরোপুরি সুস্থই ছিল। কিন্তু তোমার জন্মের পর আমার
সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এলে তুমি। একদিকে আমার
গবেষণা অন্যদিকে তুমি, এই দুইয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে
গিয়ে তোমার মায়ের প্রতি আমি আর আগের মতো মনোযোগ
দিতে পারিনি। এমনকি এটাও খেয়াল করিনি যে, ওর অসুস্থতার
পুরনো লক্ষণগুলো আবার ফিরে আসছে। আমি তখন গবেষণার
বিষয়টি নিয়ে এমন এক ঘোরের মধ্যে থাকতাম যে, আমার কাছ
থেকে অন্য সবকিছু বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই ব্যাপারটি তুমি
ঠিক বুঝবে কী না জানি না। আমার সারা জীবনের আরাধ্য
রহস্য যখন ধীরে ধীরে তার আবরণ খুলে নিজেকে মেলে ধরছে
আমার সামনে, তখন আমি কীভাবে অন্যদিকে মনোযোগ দেব?
আমার এই অমনোযোগই তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি
ফিরিয়ে আনে বলে আমার ধারণা। এর মধ্যেই তোমার ওপর
তোমার মায়ের বীভৎস সব অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে। আমি
সারাদিন ইউনিভার্সিটিতে নিজের রুমে পড়ে থাকি, এমনকি
ক্লাসগুলোও নিয়মিত নিতে পারি না, কিন্তু মন পড়ে থাকে
বাসায়-- আতংকে ভুগি-- কখন তোমার কী হয়ে যায়! একটা
কথা তোমাকে বলা উচিত হবে কী না জানি না, তোমার কাছে
খুবই অস্বাভাবিক শোনাবে হয়তো, তবু বলি-- তোমার ওপর যে
নির্যাতনগুলো হতো সেগুলো সাধারণত আমার অনুপস্থিতিতে
ঘটতো, এবং তোমার মা কিংবা বাসার অন্য কেউ আমাকে সেসব
বলতো না, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে আমি তা জেনে
যেতাম। কীভাবে জেনে যেতাম সেটা আমার কাছে এক বিরাট
রহস্য। এই তো সেদিন, তোমার মা যেদিন তোমার হাত ভেঙে
ফেললো-- আমি ইউনিভার্সিটিতে নিজের রুমে বসে কাজ
করছিলাম, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিংবা জেগে ছিলাম,
কিংবা ঘোরে ছিলাম-- হঠাৎ শুনতে পেলাম, ‘আপনি যে এখানে
বসে আছেন, আপনার ছেলের হাত ভেঙে ফেলছে সেটা
দেখছেন না কেন? আপনার ছেলের জীবনের চেয়ে এইসব
আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’ কথাটা কে বললো, বা আদৌ
কেউ বললো কী না সেটা বিবেচনা না করেই আমি বাসার দিকে
ছুটলাম এবং এসে দেখলাম-- সত্যিই তোমার হাত ভেঙে ফেলা
হয়েছে! একে তুমি কী বলবে? যাই হোক এই ঘটনার পর
আমার হঠাৎই মনে হলো, কিংবা আমি স্বপেড়ব দেখলাম কিংবা
আগের মতো কেউ একজন বললো-- আমাকে যে-কোনো
একটি বেছে নিতে হবে, হয় আমার গবেষণার সাফল্য অথবা
তোমার জীবন। গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তোমার মৃত্যু
অনিবার্য এবং সেটা তোমার মায়ের হাতে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে
ফেললাম।
ডায়েরির পাতা শেষ, লেখাও শেষ। আমি এক বিস্ময়কর ঘোর নিয়ে
বসে রইলাম। কোনটি সত্যি, কোনটি মিথ্যে, কোনটি বাস্তব, কোনটি
কল্পনা, কোনটি ঘোর, কোনটি রহস্য-- এসবকিছুকে আলাদা করা
আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলাম
কয়েকদিন। বারবার ডায়রি খুলে রহস্যময় লেখাগুলো পড়লাম, তাতে
করে ঘোর তো কমলোই না, বরং আরো বাড়লো। মনে হলো-- এই
সমস্তকিছুর রহস্যভেদ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ-ও মনে
হলো-- এ সবই পাগলের প্রলাপ-- শুধু আমার মা-ই নয়, বাবা
নিজেও অসুস্থ ছিলেন। মারাতড়বক ধরনের হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন।
প্রকৃতির রহস্যভেদ, সৃষ্টিরহস্যের কূলকিনারা করা-- এসব ভূয়া,
ফালতু কথা। একটি অসুস্থ দম্পতির ঘরে জন্ম নিয়ে আমি কীভাবে
এখনো সুস্থ আছি সেটা ভেবে অবাক লাগলো। বাবার মহাপ্রতিভাবান
ইমেজ হঠাৎ করেই আমার কাছে ফিকে হয়ে এলো, এবং মা-র জন্য
মন খারাপ লাগতে লাগলো। অনেকদিন পর মাকে দেখতে ইচ্ছে
হলো আমার। আশ্চর্য ব্যাপার-- মা-র সম্বন্ধে আমি কারো কাছ থেকে
ইতিবাচক কোনো কথা শুনিনি কোনোদিন-- এমনকি আমার নানার
বাড়ির লোকজনও তাকে অপছন্দই করে, তারাও বাবার প্রশংসায়
মুখর, আমার নিজেরও কোনো মধুর স্মৃতি নেই মাকে ঘিরে, তার কথা
মনে হলে কেবলই ভয়াল সব স্মৃতি তেড়ে আসে-- তবু মা-র প্রতি
আমি সবসময় একটা তীব্র ভালোবাসা বোধ করে এসেছি, কখনো
কোনো বিরূপ মনোভাব আমার মধ্যে জন্ম নেয়নি। এই ডায়েরি পড়ার
পর সেই ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল, সঙ্গে যুক্ত হলো এক গভীর
সহানুভূতি। নানা মারা যাওয়ার পর ও বাসায় মা-র জায়গা হয়নি,
মামারা তাকে দূরে-- শহরতলীর একটা ক্লিনিকে-- রেখেছে। আমি
মাঝে মাঝে সেখানে তাকে দেখতে যাই। মা কোনো কথা বলে না--
আগে যেমন দূর দূর করতো এখন তা-ও করে না, এক অদ্ভুত
নীরবতা আর ঔদাসীন্য তাকে ঘিরে থাকে। কিন্তু এবার আমাকে
দেখেই মা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো, হাসলো মিষ্টি করে, তারপর
মধুর স্বরে বললো-- ‘কোনো কূলকিনারা করতে পারলি?’
আমি অবাক হলাম। এত স্বাভাবিকভাবে মা কোনোদিন আমার
সঙ্গে কথা বলেনি।
‘পারলি না, তাই না?’-- মা আবারও বললো-- ‘পারবি না। এর
কোনো কূলকিনারা কেউ করতে পারবে না।’
‘তুমি কিসের কথা বলছো মা?’
‘এই যে, যা নিয়ে পড়ে আছিস, ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছিস...’
‘তুমি জানো, আমি কী নিয়ে ভাবছি?’
‘হ্যাঁ, জানবো না কেন? তুই তোর বাবার কাজকর্ম নিয়ে ভাবছিস।’
‘তুমি জানলে কীভাবে? সাজ্জাদ চাচা এসেছিলেন, না?’
‘সাজ্জাদ চাচাটা আবার কে?’
‘কেন, তুমি চেনো না?’
না, কোনোদিন নামও শুনিনি। কে সে?’
‘সত্যি তুমি চেনো না?’
‘না, কেন?’
‘তাহলে তুমি জানলে কীভাবে যে আমি বাবার কাজকর্ম নিয়ে
ভাবছি, এতদিন তো একথা জিজ্ঞেস করোনি! ’
‘ও এই কথা! এটা তো... এটা তো...এমনিতেই জেনেছি।’
‘কীভাবে জেনেছ?’
‘তোর বাবা যেভাবে সব জেনে ফেলতো, আমিও সেইভাবেই
জেনেছি।’
‘এর মানে কী মা?’
‘জানি না রে বাবা, আমি জানি না। কিছু বুঝিও না। কীভাবে যে
সব জেনে ফেলি নিজেও বুঝি না। তোর বাবা জানতো, বুঝতো।
একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। কিন্তু অসম্ভব একটা কাজে হাত
দিয়েছিল সে...প্রকৃতির রহস্যভেদ...সৃষ্টির রহস্যভেদ...হয় না,
এভাবে হয় না...প্রকৃতি হলো নারীর মতো...পরতে পরতে তার
রহস্য, এক পরত খুললে আরেক পরত, তারপর আরেক পরত,
তারপর আরেকটা...’ -- মা এলোমেলোভাবে অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত, উদ্ভট
সব কথা বলে যেতে থাকে। আমি কোনো কথা না বলে বাইরে
বেরিয়ে আসি। অনেককিছুই জিজ্ঞেস করার ছিল, কিন্তু মনে হলো--
কোনো লাভ নেই, এসবের কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না।
রাত গভীর হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানে নক্ষত্রের
মেলা। রাত জাগা পাখি, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বসন্তের মৃদুমন্দ
হাওয়ায় গাছের পাতাদের ফিসফিসানি, এইসব রাস্তাঘাট, পাশ দিয়ে
টুংটাং বেল বাজিয়ে চলে যাওয়া খালি রিকশা, বন্ধ দোকানপাট,
বাড়িঘর, দালানকোঠা-- এদের সবাই যেন আমাকে কিছু বলতে
চাইছে। কী বলতে চাইছে? আমি কেন বাবার মতো এদের ভাষা বুঝি
না? একা একা দীর্ঘপথ হেঁটে যাই, আমার একা লাগে... একা
লাগে... একা লাগে। তবু আমি হাঁটতে থাকি। রাত বাড়ছে, মানুষের
ঘুমোবার আয়োজন চলছে, সবকিছু μমশ নীরব-নির্জন হয়ে পড়ছে,
আমি তবু হাঁটতেই থাকি, শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামের মেঠোপথ
ধরে অনির্দিষ্টভাবে হেঁটে যাই... হেঁটে যাই। হঠাৎ মনে হয়, আমি তো
একা নই, মনে হয়-- আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার সামনে উন্মোচিত
হবে এক অশ্র“ত ভাষার জগৎ, মনে হয়-- এই বিপুল সৃষ্টিজগৎ, এই
দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সমস্তকিছু-- আমি এদেরই একজন, আলাদা
কোনো অস্তিত্বই নেই আমার, আমি যেন এদেরই এক নগণ্য সদস্য
মাত্র।
মার্চ, ২০০৬
লেখক পরিচিতি
আহমাদ মোস্তফা কামাল
গল্পকার। প্রবন্ধকার।
0 মন্তব্যসমূহ