সে সময়ে আশুতোষরা খুব তারকেশ্বর যেত, বছরে অন্তত
একবার তো বটেই। শিবের বরে নাকি জন্ম তার। মানত রাখতে ছ’মাস বয়সে মাথা নেড়া করে আনা হয়েছিল। সাদাকালোয়
ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ফোটোটা আছে। কাকুমনির তোলা। পেছনে ঝোপঝাড়, গাছপালা। দুধপুকুরের
সামনে ঠাকুমার কোলে সে। পাশে মা। সুচেতা খুব খেপিয়েছিল ছবিটা দেখে, ‘ঈস্ উদ্বাস্তু শরণার্থীদের মতো দেখাচ্ছে গো’। এই ন্যাড়া হওয়াটা মনে না থাকলেও, পরবর্তী অনেকগুলো
ওরকম ঘটনা আবছা মনে আছে। তার স্মৃতি বেশ প্রখর। ওই যাওয়াগুলো আনন্দের ছিল।
বাড়িসুদ্ধু সবাই একসাথে লোক্যাল ট্রেনে করে, স্টেশনে নেমে রিক্সায় ধুলোপথ ধরে
মন্দিরের চুড়ো। বাঁধা একজন পাণ্ডা ছিলেন। ভারিক্কী, ফর্সা, সুদর্শন, মধ্যবয়সী।
দাপট ছিল মন্দিরে। নামটা হয়ত মহাদেব আচার্য বা ভোলানাথ আচার্য। আশুতোষ একটু ভুলে
গেছে। মা বেঁচে থাকলে বলতে পারত। ‘তারকেশ্বরের মাহাত্ম্য’ নামের বইটা হঠাত হাতে
না পড়লে, এসব তো কবেই ঝাঁট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া শুকনো পাতা। সেটাই স্বাভাবিক। সে তখন হাঁদা,
পেটরোগা, হাড়জিরজিরে পুঁয়ে-পাওয়া একটা ছেলে। তারকনাথের ডোর আর মাদুলির বোঝা হাতে
আর গলায়। বছরভর আমাশা, জিয়ার্ডিয়ার পেট কামড়ানি আর থকথকে পায়খানা। ঠাকুমা বাটা
থেকে পানপাতা নিয়ে তেল মাখিয়ে নাভিতে বোলাত। তারপর প্রদীপে ধরলেই পট্পট্ পুড়ত
পাতাটা। ঠাকুমা বলত, ‘সাইরা গেল গা রোগবালাই’। কাকাবাবু রয়ে রয়ে হাসত, ‘কুসংস্কার। ভাল ডাক্তার দেখাও বউদি’।
ঠাকুমা নাকি বলত, ‘বড়পোলার একখান পোলা না অইলে, বংশে বাতি দিব কে?’ শুনে তার দিদিরা কি মুখ বেঁকাত? নিবেদিতা আর নবনীতা? হতেও পারে! আশুতোষকে
এইসব হিংসেপাতি আর ‘গা জ্বলে যায়’-এর আঁচ থেকে সরিয়ে, পুতুপুতু করে রাখা হত।
অবেলায় বইঠাসা ছোট্ট লাইব্রেরি ঘরের অন্ধকারে বসে
থাকার অভ্যেস জ্ঞান-হওয়া ইস্তক। সে নাকি তার দাদুর মতো। দাদুর পোকা-ধরা মুড়মুড়ে
বইয়ে শ্বাস টেনে নাক বন্ধ, সর্দি, হাঁপের টান। অস্মিতা ফোন করলে আজকাল খালি শাসন
করে, ‘বাপী, তোমার বদভ্যেস
ছাড়ো প্লিজ’। ভালই লাগে, মেয়ে তো!
ফোটো তিনটে কে গুঁজে রেখেছিল বইটাতে? বইটাও এখানে থাকার কতভাগ সম্ভাবনা ছিল?
একট্রাঙ্ক পুরনো বইপত্তর ঠাকুমার দেহত্যাগের পর কাগজওয়ালাকে বিক্রি করে দিয়েছিল
মা। তার বাবা ও মায়ের পরপর মৃত্যুতে সে পরলোকতত্ব-টত্ব নিয়ে মেতেছিল। ড্যাম্পধরা চিঠিপত্তর,
বাতিল কাগজ, শিশুসাথী, আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোরভারতী তার চোখের সামনেই
কাগজওয়ালায় সাইকেলে বাঁধা হয়েছিল। তত্বাবধানে সুচেতা। এলবামগুলো বেছেবুছে, ক্ষয়ে
যাওয়া ছবিগুলো কুচিয়ে ফেলেছিল ময়লার বালতিতে। চোখের সামনেই হারিয়ে গিয়েছিল উড়ে
যাওয়া ধুলো হয়ে। ‘কুমারী ভবানী
ভট্টাচার্য। ঊণিশ বতসর নয় মাস। শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি। সন ১৯৭২’। ফোটোর পেছনে লেখা নীলকালি ভীষণ আবছা। প্রায় পড়া
যায়না। আশুতোষ তখন সেভেনে না সিক্সে? কোণা মুড়ে গেছে ফোটোর। ফোটোর মধ্যে শাড়ি-পরা
মেয়ের লম্বা বেনী বুকের বাঁদিকে লেপ্টে আছে। টলটলে চোখ। পেছনে ব্রিজ-ট্রিজ দেওয়া নদীর
ব্যাকগ্রাউণ্ড। মফঃস্বলের পাতি স্টুডিওতে তোলা ছবি।
‘ও কে মা? আমাদের সঙ্গে কেন থাকবে?’ সে বিস্মিত হয়েছিল।
‘চুপ চুপ। অত কথা বলতে হয়না’।
তাদের পুরো পরিবার ফিরে যাচ্ছে তারকেশ্বর দর্শন
সেরে। সঙ্গে নোতুন মেয়েটি, চিবুক গলা এক করে শাড়ি-চাদরে গা-মাথা মুড়ে ঠাকুমার পাশে
বসেছিল। দিদিরা পিঠোপিঠি, আশুতোষের সঙ্গে ভাব নেই। উলটে তাকে কাছে ঘেঁষতে দিতনা।
তাদের মা আর বাবা নিচু সুরে কী বলাবলি করছিল। সে মাথায় উলের মাফলার বেঁধে জানালার
পাশে রেললাইনের দ্রুত সরে সরে যাওয়া দেখছিল। পদার্থ বিজ্ঞানের বিশেষ কোন্
চ্যাপ্টারের থিওরির সাদৃশ্য খুঁজছিল। না, কাকুমনি সঙ্গে ছিলনা সেবারে। তার অল্পদিন
আগেই চাকরি পেয়েছিল দুর্গাপুরের কাছাকাছি কোথাও।
তার পড়ার ঘরটা মা আর ঠাকুমার মন্ত্রণাকক্ষ। সে বাড়ন্ত
একটা ছেলে। অনেক কিছু না বুঝলেও বোঝার চেষ্টা করে, তা ভাবতে চাইত না। ‘আশুভাই শিবের অংশ, ভোলাবাবা। তাইনের মতো
ন্যালাখ্যাপা। মনে পাপ নাই। ও বুঝেনা বড়বৌমা। বও, দরকারি কথাখান কই। ফোটোখান
ছোটনরে দেখাইছিলাম। মন লয়, পছন্দ হইছে’। ঠাকুমার ভারী উতসাহ। ‘আপনি যা ভাল বোঝেন মা।
ঠাকুরপো পছন্দ না হলেও মুখ খুলবেনা। মেনে নেবে। আপনার বড় ছেলের মতো’। তার মাও দিব্যি তাল দিচ্ছিল। ‘পছন্দ অইবই বউমা, আমি কইতাছি। কত উচ্চ বংশ, ঠাকুরমশয়
হাতে ধইরা কইছে, মারেন কাটেন মাইয়া মুখ খোলব না। আমরাও খবর করমু না। মা-মরা
ভাইগনী, হের বাপ বড় গরীব। শান্ত সুশীল মাইয়া। ঘরের সমস্ত কাম পারে। বাকি তুমি
শিখাইয়া লইবা’। তার মা ম্যাট্রিক
পাশ, বলিয়ে-কইয়ে। ঠাকুমার প্রধান মন্ত্রী। প্রথমে নাতনিদের ঘরে ভবানীর শোওয়ার
ব্যবস্থা করেছিলেন কেন, মাথায় ঢোকেনি আশুতোষের। টানা বারান্দার এককোণায় প্রায়
সারাটা দিন জবুথবু হয়ে বসে থাকত ভবীদিদি। তাদের ওই বলেই ডাকতে শেখানো হয়েছিল। লালপাড়
সাদা শাড়ি পরে দুই দিদি ইস্কুলে যেত। একজন দশক্লাস, একজন এগারক্লাস।
ইস্কুলে যাবার ভাতের থালা বেড়ে দিয়েছে মা। ভবীদিদিকে
বলেছে, জলের গেলাস এনে দিতে। বড়দি ভাত ভেঙেছে। বাঁহাত দিয়ে মায়ের আঁচল ধরে একটু
টানল। তাতে মা খানিক রেগে গেল, কারণ এঁটোজনিত ছোঁয়াছুঁয়ি। তবু বড়দি কিছু বলল
ফিসফিস করে, ছোড়দিও তখন কিছু বলল। মা রান্নাঘরের দিকে তাকাল। ভবীদিদি জলের গেলাস
হাতে করে আসছিল। দিদিরা খেয়ে উঠে, তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। আশুতোষের পেট
মোচড়াচ্ছিল। ভাত খেয়ে উঠে বেশিরভাগ দিন এরকম হয়। পায়খানা থেকে বেরিয়ে দেখল,
ভবীদিদি বারান্দার দেওয়াল ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে, গোঁজ হয়ে। মা দেখতে পায়নি
তাকে, কারণ তার দিকে পেছন ফেরা। ‘ভবী, কি হয়েছিল তোর
কালকে? টুলু বুলু এখন বলল! রাত্তিরে ছটফট করছিলি, হাতপা ছিটাচ্ছিলি! না বললে বুঝব
কি করে?’ আশুতোষ মায়ের আঁচলে
ভিজে হাত মুছে নিল, ‘মা, আমার টিফিন
বাক্সো, জলের বোতল দাও’। পরের দিন থেকে
দিদিদের ঘরে আর শোয়নি ভবী। ঠাকুমার ঘরের ফালি জায়গাটাতে ক্যাম্পখাট পড়ল রাত্তিরে। মস্ত
তক্তপোষে অভ্যেসমতো সে ঠাকুমার পাশে। ঠাকুমা ঘুমোলে জোরে জোরে নাক ডাকে।
তার কাকুমনি মাঝখানে এসেছিল। মাত্র একরাত থেকে ফিরে
গেছে। দরজা বন্ধ করে মা-ঠাকুমার সঙ্গে কী কথাবার্তা হয়েছে, আশুতোষের জানার কথা
ছিলনা। এর মধ্যে কোন্ একটা রাত্তিরে হঠাত ঘুম ভেঙে তার জলতেষ্টা পেয়েছিল। পাশে ঠাকুমা
মুখ হাঁ করে গভীর ঘুমে। মেঝেয় পা ফেলার জায়গা খুঁজতে গিয়ে দেখল, ক্যাম্পখাট খালি। ঘরের
ভেতরের জানালা দিয়ে বারান্দায় মুখ বাড়াল। ওখানে শুয়ে সাঙ্ঘাতিক হাতপা ছেটাচ্ছে
ভবীদিদি। কি বিচ্ছিরি। তার প্রচণ্ড পেট কামড়ে উঠল। ঠাকুমাকে একবার ঠেলা মারল, ঘুম
ভাঙল না। দু’হাতে পেট চেপে সে শুয়ে
রইল বাকি রাত। বাইরের জানালার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঘরে আলো ঢুকতেই, কোনওদিকে না দেখে
দৌড় মারল। তার মা সবে বাসি কাপড় ছেড়ে বেরোচ্ছে বাথরুম থেকে। প্রায় বমি করার মতো ঘটনাটা
উগড়ে দিল। নমিতা বিপুল বিস্ময়ে থ’! সকালে কাকুমনির ঘরে
পড়তে বসেছিল। খোলা দরজা দিয়ে নজর গেল, মা খুব করে হাত বোলাচ্ছে ভবীদিদির পিঠে। ‘কিরে বল্। না বললে অষুধ আনাই কেমন করে’? ‘কিচ্ছু হয় নাই দিদি’, ভবীদিদির চিবুক বুকে গেঁথে আছে। আশুতোষ চুপচাপ
দরজার পেছনে। নমিতা সাধছে, ‘তা’লে অম্বলের ব্যথা? পাতলা পাইখানা হচ্ছে? মাসিকের
ব্যথা?’ ‘কিচু না দিদি, ক’লাম ত’। ‘বড় ঠ্যাঁটা মেয়ে তো তুই। মাও পারেন। জানা নাই শোনা
নাই, কোত্থেকে বাড়িতে এনে হাজির করেছেন। কী অসুখ, কিসের কী, কে বলে? তোর বাবাকে
চিঠি লিখতে হবে’। মা ঠিক রাশভারী বড়
গিন্নী, কড়া, রাগী, প্রতাপশালিনী। ভবীদিদি হঠাত মায়ের পায়ের ওপরে লুটোপুটি খেতে
লাগল। বেশ গুছিয়ে বলছে, ‘দিদি গো, বিশ্বাস যাও,
অসুকবিসুক না। আমার উপরে ভর হয়, চণ্ডীমাতার ভর। কালীঘাট এখানের কাছে, আমারে একদিন নিয়ে
যেও। আপনেরা যখন আমারে ওইর’ম দেখবেন, দুর্গামন্তর
জপ করো গো। শনি আর মঙ্গল সন্ধ্যাকালে মা আমার শরীরে আসেন। তোমাদের মঙ্গল-অমঙ্গল
বলে দিবে’।
সেই রবিবার সাতসক্কালে ভবী এক খাবলা শালিমার নারকেল
তেল নিয়ে, মুখে গলায় খোলা চুলে মাখল। সূর্যের দিকে মুখ করে বিড়বিড় করতে লাগল।
তারপর ধড়াস করে পড়ে গেল শানে। দাঁতে দাঁত, হাতপা কাঠ, শক্ত। কাপড়চোপড় গা থেকে সরে
গেছে বিশ্রীভাবে। আশুতোষ ঘর থেকে একছুট্টে রান্নাঘরে গিয়ে ‘মা ওমা, এদিকে এসোনা’ বলে ডাকাডাকি করছিল। হারুর মা বাসন ফেলে এসে, জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর
চেষ্টায় বলছে, ‘ও দিদি ওটো, ওটো। অ বউদি,
মির্গি রোগ মনে হয়’! আগের রাত্তিরে আশুতোষের
কাকাবাবু এসেছিল। বংশের সেরা ছেলে। বিচক্ষণ, খুব বুদ্ধিমান। তার বাপের মতো উদোমাদা
বা কাকুমনির মতো উদাসীন না। সকালের চায়ের কাপ হাতে উঠে এসে, ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। নমিতা বলল, ‘ও ঠাকুরপো, কি দ্যাখো’? কাকাবাবু তখন চেটে চেটে
চোখদুটো সার্থক করে নিচ্ছে। নমিতা বলল, ‘হারুর মা, ওর গা-গতর ঢেকে দাও’। কাকাবাবু চোখ সরিয়ে তাচ্ছিল্যের মতো করে বলল, ‘মেয়েটা কে বউদি? হিস্টিরিয়া আছে মনে হচ্ছে।
এপিলেপ্সি... মানে মৃগী’। কখন তার ঠাকুমা এসে
দাঁড়িয়েছিল। ভারী রেগে বলল, ‘কি কস্ তুই বিজু?
সাক্ষাত মা চণ্ডীর ভর হয় তাইর। শুনছস নি? জয় মা মঙ্গলচণ্ডী। উঠ মা। বড়বউমা, তুল্যা
বওয়াও’। সিক্তবসনা ইতিমধ্যে
উঠে বসেছিল। দুহাত উপরে তুলে বেঁধে নিচ্ছিল খুলে যাওয়া চুল। আঁচল-টাঁচল জড়িয়ে, দৌড়ে
ঘরে ঢুকে পড়ল। কাকাবাবু বলছিল, ‘এইরকম হঠকারী
সিদ্ধান্ত নিওনা মা। ছোটনের জীবন নষ্ট করে দিবা’? ঠাকুমার গোঁ খুব, দাপটও। চেঁচাতে লাগল, ‘কি বোঝস্ তুই এ্যাঁ? এমুন লক্ষ্মীমন্ত মাইয়া। তর বৌর মতো ম্যাম দিয়া আমার আর
কাম নাই’। নমিতা দ্বিধায়
পড়েছিল। কাকাবাবু আড়ালে উস্কানি দিয়ে গেছে, ‘মেয়েটা ভাল না বউদি। ছেনালের মতো চলনবলন’। মা জিভ কেটেছিল, ‘ছি ছি ঠাকুরপো, ওরকম
বলতে আছে’? দিনদুই পরে আশুতোষ
তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা ছেনাল কাকে বলে’?
শনিমঙ্গল সন্ধ্যা লাগলেই ভবী ঠাকুরঘরে বসে কাচা শাড়ি
পরে। ব্লাউজ থাকেনা গায়ে। কপালে তেলসিঁদুর। গলায় জবার মালা। থালায় ফুল-বেলপাতা।
হঠাত দাঁত লেগে যায়, ইঁইঁ করে শব্দ করতে করতে মাথাটা চরকির মতো ঘোরায় সে। চুল
ছড়িয়ে নাকে মুখে। ড্যাবাড্যাবা চোখদুখানা অস্বাভাবিক দেখায়। শরীর থরথর কাঁপে।
ঘরসুদ্ধ লোক তটস্থ হয়ে থাকে। কখন উঠবে, কী বলবে। ওই দুই সন্ধ্যেয় সব কাজ, এমনকি
লেখাপড়াও বন্ধ। ঠাকুমার হুকুম। টুলু এগারক্লাস, বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। জোর গলায় বলে, ‘যত ভণ্ডামি। কোত্থেকে যে ধরে এনেছ!’ অথচ ভেতরে সংশয় থাকে, পাপপুণ্যের নানা ভয়। তাই পড়া তুলে
রেখে এসে, না বসে পারেনা। তেলসিঁদুরে, ধুনোয়, ফুলজলে, থকথক করে ঘরখানা। সকলে
মাটিতে মাথা দিয়ে প্রণাম করে। ঘোরের মধ্যে ভবীদিদি গায়ের নানান জায়গায় হাত বোলায়,
ফুল ছোঁয়ায়। এগারো-বারো বছরের আশুতোষ হলেই বা প্যাঁকাটি আর পেটরোগা, ছেলেসন্তান,
বংশপ্রদীপ! গুপ্ত জায়গায় ভবীদিদির হাত পড়লে গা শিউরে ওঠে। নমিতা কটকট করে নিজের
বরের দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটা নিতান্ত ভালমানুষ, চালাক-চৌখস না। ভবীদিদি
প্রত্যেকের ভবিষ্যত বলে। তাকে বলে, ‘প্যাট ঠিক হয়ে যাবে। গুড় খাও। আটারুটি আর গুড়। জন্মবার, শনিবার, রবিবারে আঁশ
খাইওনা’। এদিকে ডাক্তার তাকে
রুটি খেতে বারণ করেছে। শনি আর সোমবারে বাড়িতে নিরামিষই হয়। তার জন্ম বুধবারে।
রবিবারে একটু পাঁঠার মাংস খায়। পাতলা ঝোল করে দেয় মা। সেটাও বাদ। আশুতোষ মুখ কালো
করে বসে থাকে। রান্নার রাধুপিসী আর হারুর মাকে পইপই করে বারণ করে দেওয়া হয়েছে, যেন
খবরটা পাঁচকান না হয়। পাড়ার যত বাড়ির খবর ওদের নখদর্পনে। মা-ঠাকুমাও ভাগ পেয়ে যায়।
নাক গলায়, মন্তব্য করে। হয়ত তাদের বাড়ির কথা নিয়েও অন্য বাড়িতে কানাঘুষো হয়, রসাল
গল্প। আশুতোষ জানেনা। দিদিরা কানাকানি করে। তাকে দেখলেই চুপ। সে আচমকা প্রশ্ন করে,
‘বড়দিদি, অকুতোভয় মানে
জানিস’? আসলে অন্য কথা বলতে
ইচ্ছে হয়, জানতে মন চায়। কাকে যে জিজ্ঞেস করে!
সকলকে আশীবার্দ করা শেষ হলে নমিতা শঙ্খ বাজায়। জলের
মতো সময় বয়ে যায়। না হয় লেখাপড়া, না সময়মতো রাত্তিরের খাওয়া! হয়ত পরদিন ইস্কুলে
পরীক্ষা, কিচ্ছু তৈরি হয়না। হয়ত খিদেয় পেট গোঁগোঁ করছে, মাচণ্ডী আর যেতেই চাননা।
দিদিদের উঁচু ক্লাস, বিরক্ত হয়ে ওঠে। দুজনেই ভাল ছাত্রী। বিদ্রোহ করে, ‘পড়া বন্ধ করে রোজ এইসব যাত্রাপালা ভাল্লাগে না মা’! সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমা কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বলে, ‘কইতে নাই এমন কথা। কী অইছস্ ছেমড়িগুলান। আমাগো কত
ভাইগ্য, মা আসেন। তগো দেবদ্বিজে ভক্তি নাই, শ্বশুরঘরে গিয়া কি করবি’? মাও চোখ পাকায়, ‘টুলু-বুলু বেশি পড়া দেখাস্ না। ভোরে উঠে পড়তে বসতে পারনা’? সে মুহূর্তে হয়ত ভর শেষ হয়। মাচণ্ডী বিদায় নেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার, আশুতোষের কাকাবাবু যে ক’বার এসেছে, এমনকি শনিমঙ্গল অবধারিত থাকলেও পারতপক্ষে ভর হয়না। হয়তো বুধবারে
সকালে হল বা রবিবার মাঝরাত্তিরে। ইস্কুল, কলেজ, ছোটাছুটি - ভবী ধড়াম করে পড়ল।
ঠাকুমা বলে উঠল, ‘কালী কালী কপালিনী
মাগো’। মা একদিন সবার
সামনেই বলে বসল, ‘হ্যাঁরে তোর আজকাল যে
বুধবারে, শুক্কুরবারে, যেকোনো দিনেই হয় দেখি’! ভবীদিদি চুপ করে আঙুলে আঁচল পাকায়। দাঁত দিয়ে নখ কাটে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে
থাকে। চোখে জল। আশুতোষের বুকে কষ্ট জাগে। কী করবে বেচারা?
কাকুমনি বাড়িতে আসতেই চায়না। এলেও সারাটা দিন বাইরে
পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। মা বকে। ঠাকুমা বলে, ‘কিরে ছোটন, ঘরেই থাকস না দেখি’! কাকুমনি স্বভাবে শান্ত। গলার আওয়াজ যেমন নীচু, তেমন গম্ভীর। বলে, ‘থাকনের উপায় রাখছ কিনা! আমার আসতেই ইচ্ছা করেনা।
মেজদা মেজবৌদিই ভাল আছে। কারুর তোয়াক্কা নাই’। কাকুমনির নাকি এরই মধ্যে অফিসে খুব সুনাম হয়েছে। প্রমোশন হবে তাড়াতাড়ি।
ঠাকুমা এতে ভবীদিদির ‘পয়’ দেখে। সুখ্যাতি করে তার বাবা-মায়ের কাছে। ওদের যত
কথাবার্তা, আশুতোষের পড়ার ঘরের সামনে বসে। বাবাকে ঠাকুমা বলছিল, ‘বুঝলি অজু, ছোটনের বিয়াটা সাইরা ফালাইতে অইব। দিন
ঠিক কইরা, আমার অসুখের সংবাদ দিয়া পত্তর দে। আইয়া পড়ুক’। বাবা সরল বলে কি আর বোকা? ভাবে, কাজটা বোধহয় ঠিক
হবেনা। বলল, ‘মা, ছোটনরে না জানাইয়া
কইর না। তারও তো পছন্দ অপছন্দ আছে। যুবক হয়েছে, ভাল চাকরি করছে। মেয়েটা তো
লেখাপড়াও তেমন-’। ঠাকুমা রেগে গজগজ
করছিল, ‘পাপ অইব অজু। মায়ের
অংশ, দেবাংশী। বোঝস নাই? ইশকুলের ফটরফটর বিদ্যায় অর কোন্ কাম? বড়বৌমা, তুমি চিঠি
লিখ্যা দাও। বিজুটা তো ধম্মকম্ম ভুল্যা নাস্তিক অইছে বৌর পাল্লায় পইড়া’।
কাকুমনি এসেছিল। ঘরের দরজা বন্ধ করে, মিটিংএর পর
মিটিং। ঠাকুমা, বাবা, মা কাকুমনি। কাকাবাবুও একদিন। দিদিরা দু’জনে নিজেদের মতো গুজুরগুজুর। ভবীদিদি আড়ালে থাকে।
সামনে আসেনা বেশি। আশুতোষ কোথাও জায়গা পায়না, ঘুরঘুর করে। পড়ার টেবিলে গল্পের বই
খুলে বসে থাকে। দিনরাত কাকুমনির ফর্সামুখ লাল হয়ে থাকে। তার সঙ্গেও কথা বলেনা। আদর
করে চুল ঘেঁটে দেয়না। ক্রিকেট বা দুর্গাপুর বাঁধ জল ছাড়ার সময় কেমন দেখতে লাগে, তা
নিয়ে গল্প করেনা। তাদের বাড়িতে চাপাচাপা বিশাল বড়বড় ঘর। লম্বালম্বা খড়খড়ির জানালা।
বিশাল আবছায়া উঠোন জুড়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ঈশ্বর-ধর্ম, ভণ্ডামি-নাস্তিকতা মেলানো
পিণ্ড বাতাসে পাক খেতে থাকে। বেরনোর পথ পায়না। ইদানিং একেবারেই নিয়ম মানছেন না মাচণ্ডী।
তাঁর আসা যাওয়া ভীষণ বেড়েছে। যেকোনো সময়ে পড়ে গিয়ে হাত-পা খিঁচতে থাকে ভবীদিদি। কত
সময়ে, যেখানে আশুতোষ পড়তে বসেছে, সেখানেই। চেহারাটা ক্রমশঃ দরকচা মারা, শীর্ণ।
কালিমাখা চোখ গর্তে। কেমন ভীতুভীতু শুকনো মুখ। কী একটা গোপন, লুকিয়ে রাখছে যেন। দেখলে
মনে হয় কঠিন কোনও রোগে ভুগছে। একদিন তাকে বলেছিল, ‘আশু শোন, ইসে..., তোমার কাকায় কি আমারে তারাইয়া দিব’?
সেটা মঙ্গলবারের ভর। কাকুমনি কোনও কারণে বাড়িতে ছিল।
জোরজবরদস্তি করে টেনে এনে ঠাকুরঘরে বসিয়ে দিয়েছিল তার মা। কাকুমনি ভীষণ রেগে যাচ্ছিল।
ভবীদিদি আপাদমস্তক ফুলবেলপাতা ছোঁয়াচ্ছিল কাকুমনিকে। আবার আছাড় খাচ্ছিল মাটিতে।
শনের মতো চুল ঝাপটাচ্ছিল। শেষ হলে, নিয়মমতো মা শাঁখ বাজাল। ঠাকুমা বলল, ‘ছোটন, মায়ের কৌটার সিন্দুর লইয়া অরে পরাইয়া দে। পরে,
দিন দেইখ্যা পুরুত ডাইক্যা, বিয়ার আয়োজন করমু’অনে’। তারপর কি ঘটেছিল,
কিছুতেই আর ঠিক মনে পড়ছে না আশুতোষের। সেই মুহূর্তে ভয় করেছিল ভীষণ। অজানা অচেনা
কাঁটা শিরদাঁড়া ফুঁড়ে ওঠানামা করছিল। সম্ভবত কাকুমনি সেদিন ওইরকম একটা অদ্ভুত
নাটকের মূল চরিত্র হয়নি। সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল।
এরকম অগোছাল অশান্তির দিন তখন। এক নিঝুম দুপুরে, ঘরে
মাদুর বিছিয়ে তার মা আর ঠাকুমা। সে বিছানায় মটকা মেরেছে। জ্বর এসেছে, ইস্কুল
যায়নি। গোটা বাড়ি থমথম করছে। তার চোখ বোজা। মন উড়ে উড়ে ঠোক্কর খাচ্ছে চার দেওয়ালের
কোণাঘুঁজিতে। মা মন খারাপের সুরে বলছিল, ‘ছোটন তো চলেই গেল মা। আপনার কথা মানল কই’? ঠাকুমা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেছিল, ‘কি আর কই বড়বউমা! এমন মাইয়া পাইছিল, দেবীর অংশ। মাগো মা, ক্ষমা কইরা দিও’! মা’র গলাটা কেমন ধোঁয়ার মতো শোনাচ্ছিল। যেন মেটেমেটে কান্নার গন্ধ। বলছিল, ‘আমি যে আর সহ্য করতে পারছিনা মা। আমার সংসারে
পাটকাঠির আগুন লাগল বলে। কোন্ সময়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে, তখন বুঝবেন। আমি আর
বাঁচতে পারবনা। বাঁচাতেও পারবনা’। ঠাকুমা চমকে
উঠেছিলেন, ‘কও কি বড়বউমা? কি কও’?’ মা আঁচল দিয়ে চোখ
রগড়াচ্ছিল, ‘আমার লজ্জা করে মা... ভবী
আপনার বড় ছেলের দিকে...! শত হোক, রক্তে-মাংসে মেয়ে তো সে। দেহ আছে, চাওয়াচাহিদা, পুরুষমানুষ,
সুখসংসারের, ছেলেপুলের সাধ আছে। এতবড় আশাটা স্বপনটা ভেঙে গেল যে ওর’! ঠাকুমা আঁতকে উঠেছিল। হেরে যাওয়া গলায় বলছিল, ‘অ বড়বউমা, কও কি করছে অজুরে? কি কইছে? অজু যে তাইর
বাপসমান’। তার মা অনেকক্ষণ ধরে
ফিসফিস করে ঠাকুমাকে কি বলেছিল, আশুতোষ শুনতে পায়নি। তার শুধু মনে হচ্ছিল, ভবীদিদিকে
একমাত্র তার মা-ই বুঝেছিল, আর কেউ না। তার বয়সটা কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাচ্ছিল।
কাকুমনিকে ঠাকুমা বাধ্য করতে পারেনি। সেই ঘটনার পর ক’বছর যেন আসেনি বাড়িতে! যখন এসেছিল, আশুতোষের ক্লাস
টেন। সঙ্গে নোতুন কাকিমা। সুন্দর দেখতে, দুর্গাপুরের ইস্কুল টিচার। ঠাকুমা অসুস্থ
তখন, শয্যাশায়িনী।
ফোটোটা আশুতোষের সামনের টেবিলে পড়ে আছে। তার চোখের
পাওয়ার আজকাল খুব বেশি। তাই ফোটোটা আরও ঝাপসা। সে বসে বসে ভাবছিল, শেষ পর্যন্ত
কবে বিদায় হয়েছিল ভবীদিদি? একা? না হলে, কার সঙ্গে? কেউ কি ওকে নিতে এসেছিল? কোথায়
গেল? কিচ্ছু মনে নেই। আর বেশিদিন তাদের বাড়িতে ছিলনা, সেটা মনে পড়ছে। যাওয়ার সময়ে
কি কেঁদেছিল? কাঁদলেও, কার জন্যে? অবান্তর প্রশ্নমালা মাথায় চরকিপাক। ঠিকঠাক উত্তর
দেওয়ার কেউ নেই আজ।
লেখক পরিচিতি
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
এখন রাঁচিতে থাকেন।
লেখক পরিচিতি
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
এখন রাঁচিতে থাকেন।
bhalo laglo pore :)
উত্তর দিনমুছুন-alokparna
ধন্যবাদ অলোকপর্ণা।
উত্তর দিনমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।
Ke ba ki dayi ? Manusher biswas na durbolota ? aapato sahaj jibon kintu kothao to se vishon golmele. Bojha geleo dhora jay na naki dhorbar poreo obodhyo i theke jay.
উত্তর দিনমুছুনদায়ী এই চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ধর্মের নামে... দুর্বলতায় ভর করে স্টিরিওটাইপ গেঁথে দেওয়া। কখনো আত্মরক্ষার তাগিদেও...
মুছুনপড়ার ও প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্যে ধন্যবাদ।
শ্রাবণী দাশগুপ্ত।
গুল্পটি ফোটোগ্রাফিক, বা 'ফোটোগ্রাফ' গাল্পিক। প্রতি ছবিরই আলাদা গল্প, কোনটা ঘষা, কেউ উজ্জ্বল। একপ্টা আবছা ছবিকে স্পষ্ট করে তুললেন শ্রাবণী, প্রশংসনীয় দক্ষতায়।
উত্তর দিনমুছুনগল্পটি*...একটা*
উত্তর দিনমুছুনআমার তরফ থেকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা...। নামটি লিখতে ভুলেছেন।
উত্তর দিনমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।
এইরকম গল্প আগে পড়ি নাই বললে মিথ্যাচারণা করা হবে।তবে এত পোক্ত ভাষায় নয়।ভাষার টান প্রবল।কখন যে শুরু আর কখন শেষ বুঝতেই পারিনি।আপনার আরো গল্প পড়বার আগ্রহ রইল। তমাল রায়
উত্তর দিনমুছুনপ্রতিক্রিয়া জেনে লাগল ভাল। অনেক ধন্যবাদ...
মুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।
Didi, eta agei porechi, valo legeche, somporker jotilota sohoj sundor vabe prokaryotic korte perecho setai asol krititwo. ......
উত্তর দিনমুছুন