সুদর্শনা রহমানের গল্প : যুদ্ধ নয় ভালবাসা

(একটি আফগান কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে )


কাল সারা রাত ধরে অবিশ্রান্ত ভাবে গোলা গুলির আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠেছে বিনি । শূন্য বাড়িতে একটা নিশ্চল মানুষের সাথে কাঁহাতক এমন মুখ বুজে থাকা যায় । যুদ্ধ শুরু হয়েছে আজ মাস আষ্টেক হয়ে গেল । একটার পর একটা পরিবার গ্রাম ছাড়তে ছাড়তে গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে, শুধু তাঁরা দুজন আর বিশাল ঐ পুস্কুনির ওপারে বৃদ্ধা ইন্দু মাসী । ঘরের ঝাঁপ খুব সাবধানে খোলে বিনি যদিও জানে ঘরের মানুষটির কাছে নিঃশব্দ আর কোলাহল দুই সমান ।
দূরের গ্রাম থেকে ধোঁয়া উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে বাতাসে ভেসে আছে আধপোড়া গাছ গাছালীর গন্ধ, চোখ জ্বালা করে জল ভরে আসে বিনির । প্রতিদিনের নিত্য কর্ম শুরু হয় বিনির, আনমনে উঠান ঝাঁট দেয়, কুয়া থেকে পানি তুলে দাওয়া উঠানে ছিটিয়ে দেয়, দুচারটি গাছ পালায় পানি দেয়, খোপ খুলে মুরগী গুলোকে ছেড়ে দেয়, হাঁস গুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় পুকুর ধারে,পাতার চুলা জ্বালিয়ে দুধ জ্বাল দেয় । একটা ছোট কাসার বাটিতে করে খানিকটা দুধ নিয়ে শাড়ীর আচল দিয়ে ধরে ঘরে এসে ঢোকে । ভেজা গামছা দিয়ে পরম মায়ায় মুখ মুছিয়ে দেয় ভাশুরের । বলে, ''মিয়াঁ ভাই সকাল হইছে, দুধটুকুন খাইয়া লন তারপর আপনের ওষুধ দিমু'' । ঝিনুকে করে একটু একটু দুধ মুখে দেয় ভাশুরের, তারপর হোমিওপ্যাথির শিশি থেকে কয়েকটা ফোঁটা ফেলে দেয় ভাশুরের হা মুখে ।


পাশের গ্রামে নসের তালুকদার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বড় ডাঃ যুদ্ধের কারণে বাড়ি এসে আছেন । মানুষের মুখে শুনেছে বিনি তিনি নাকি ধন্বন্তরি, মড়াকে বাঁচাতে পারেন এমন তাঁর নামযশ । ইন্দু মাসীর হাতে পায়ে ধরে তাঁকে ডাকিয়ে এনেছিল বিনি তিনি পর্যন্ত জবাব দিয়েছেন যে, নিদান আলী আর কোনো দিন চলতে ফিরতে পারবে না, এমন কি পারবে না কানে শুনতে আর কথা বলতে ও । যতো দিন বেঁচে আছে এমন জীবন্মৃত হয়েই বেঁচে থাকবে । চোখের সামনে মিলিটারিরা যখন পুরা পরিবারকে একসাথে মেরে ফেলে সে দৃশ্য দেখে সেই যে নিদান আলী জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে যায় তারপর থেকে আর তার জ্ঞান ফেরেনি । মিলিটারিরা তাকে মৃত মনে করে ফেলে যায় । বিনি তখন পিছনের পুকুরে কচুরি পানার তলায় নিজেকে ঢেকে ডুবেছিল । গ্রামের যে ক'জন মানুষ বাকী ছিল সবাই প্রাণ ভয়ে পালিয়েছে । পাড়া পড়শিরা বিনিকেও সাথে নিতে চেয়েছিল, বুঝিয়েছিল যুবতী বউ এমন শূন্য পুরীতে একা থাকা ঠিক নয় । সংসারে এই অথর্ব ভাশুর ছাড়া আর আছেই কে বিনির যার জন্য সে পালিয়ে বাঁচবে, আর যাবেটাই বা সে কোন চুলায় । মরতে হলে এখানেই মরবে, তা মরণ ও তার সহজে হবে কিনা এ নিয়ে বিনির মনেও যথেষ্ট সন্দেহ ! পাঁচ সাত ভাবতে, ভাবতে ঘরের টুকি টাকি কাজ সারে বিনি, খুদ কুঁড়ো যা জোটে সকাল সকালই ফুটিয়ে নেয় । ভাশুরকে পাতলা ট্যাল টেলে ঝোলের মতো রান্না করে ঝিনুকে করে খাইয়ে দেয় । মাসীকে দিয়ে গ্রামের হাট থেকে হোমিওপ্যাথির শিশি কিনিয়ে আনে, গায়ে গতরে যদি একটু তাগদ হয় সেই আশায় । একা থেকে থেকে হাফিয়ে ওঠে বিনি ।


গাছ পালার আড়ালে আড়ালে দিয়ে পা টিপে টিপে হাটে বিনি কাল বোরখা দিয়ে শরীর ঢাকা, ইন্দু বুড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায়, জোরে একটা শ্বাস ফেলে । ইন্দু বুড়ি দাওয়ায় বসে হামান দিস্তায় পান ছেঁচছিল টুক টুক করে মুখ তুলে বিনিকে দেখে একগাল হাসে, একটা পিড়ি এগিয়ে দেয় ওর দিকে, "আয় মা বয় । তরে না পই পই কইরা মানা করছি এমন দিন দুফুইরে বাইর হইস না বাড়ির থিকা । কুন দিন কুন জনের কুনজরে পইরা যাবি তহন আর রক্ষা নাই মা, কিডা বাঁচাইবো তরে'' ।


''কি করুম গো মাসী ঘরে দানা পানি নাই, আমি নহয় শাক পাতা সিঞ্জায়া কুনু রহম দুইডা মুহে দেই, মিয়াঁ ভাই অসুইক্কা মানুষ তাঁরে কি দেই কও । ঘটি বাটি যা আছিল বেইচা বেইচা তো এই পোড়া প্যাড ভরাইলাম আদ্দিন, তাও জালা ভরে না । বেচনের মতন জিনিস ও আর বাড়িত নাই খাওনের অভাবে হাঁস মুরগীও ঠিক মতো ডিম দেয় না, যে কয়ডা অয় তুমার হাত দিয়াই তো বেচাই । মুরুব্বী মাইনসেরে না খাওইয়া ক্যামনে রাহী কও, এই নাক ফুলডা শেষ সম্বল । যা পাও তাই দিয়া চাইল ডাইল, নুন আর অসুদ আইনা দেও মিয়াঁ ভাইয়ের । বিনা ত্যালে রাদ্ধন যায় বিনা নুনে তো খাওন মুখে উডে না" ।


ইন্দু বুড়ি হাঁ হাঁ করে ওঠে, ''সোয়ামীর শ্যাষ চিনটা বেচপি অবাগি''



''বিদবা মাইয়া লোকের আবার সোয়ামীর চিন কি গো মাসী, আর কি সোয়ামীর সংসার করছি তাকি তুমার আজানা ? তুমি আর দুক্কুর মইদ্দে মস্কারা কইরো না মাসী '' তিক্ত হাসে বিনি ।



''আইচ্ছা বাড়িত যা মা, আমি বাজার ঘুইরা আইতেছি । আর বাজারে কি কিছু মিলে নাকি, মাইনসে আইজ কাইল ভিক্ষাও দেয় নারে মা । আর দিবো কুন থিকা নিজেগরেই জুটে না, আমারে কি দিবো । কি জুদ্দু লাগলো দ্যাশে, বাড়ি ঘর পুইড়া শ্যাষ, মানুষ মইরা সাফা, তাও থামনের নাম নেয় না । এক কাল গিয়া তিনকালে ঠেকছে, স্বামী সংসার সব গিল্লা খাইছি ভগমান অ আমারে চক্ষে দ্যাহে না । এক সুময় আমার বাড়ি থেইকা মানসে একমুঠ না খাইয়া খালি মুহে বিদায় নেয় নাই আইজ আমি মাইনসের দুইয়ারে মাইগা খাই '' কাপড়ের খুঁটে চোখ মোছে ইন্দু বুড়ি ।


দুপুরের রোদ পরে এসেছে, উঠানে ঠুক ঠুক আওয়াজ শুনে বিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে । দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে দেয়, ইন্দুর হাত থেকে ছোট পুটলিটা নিয়ে পাশে সরিয়ে রাখে, বাকী টাকা গুলো নিয়ে আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখে । তাড়াতাড়ি কাঁসার গ্লাসে পানি ভরে ইন্দু বুড়ির হাতে দেয়, তালের পাখাটা দিয়ে বাতাস দেয় । পানিটা হাতে নিয়ে বলে, ''আবার কাঁসার গিলাস ক্যান মা, তরে না কইছি টিনের গিলাসে দিস'' আলগোছে গলায় ঢালে ইন্দু বুড়ি ।
''আবার সেই কতা, আমি না তোমারে কইছি এই জাইত পাইতের কতা কবা না আমার কাছে । প্যাডে ভাত নাই জাইত পাইত ধুইয়া কি জল খামু মাসী ? আর জাইত পাইত হইলো বড় মাইনসের জন্যি, গরিবগুব্বো মাইনসের জাইত অতো সহজে যায় না গো মাসী'' । অহন কও বাজারে কি শুনলা, জুদ্দুর খপর কও ?


''খপর ভ্যালা না মা, বাজারে জিনিসের আক্রা, জোর জুদ্ধু চলতিছে চাইর দিক । হোনলাম রাজাকাররা নাহি যে কুনু সুময় আমাগো গিরামে আইসবে । জানে গিরামে লুক জন নাই তাও নাহি অরা বাড়ি বাড়ি মুক্তি লুকের খুঁজ করতাছে । মাইনসের জুবুতি ম্যাইয়া গুলারে নষ্ট করনের লাগি জীব দিয়া হ্যাগোরে নাল ঝরে, তয় হেরা হুনছি বাজারের ছিনাল গোরে ঘিন পায় । যদি আহে তয় তোর কইল রক্ষা নাই মাগো । জুদিল জিগায় একা ক্যান তুই, দিন ক্যামনে চলে কবি বেবুবেশ্যা তুই, গতর বেইচা চলি ।



''মাসী, তাতো বুজলাম । একা থাইকা থাইকা দম বন্দ হয়া আইতে চায়, রাইত দিন জ্যান আর কাটে না গো মাসী, ভূতের বাড়িডা গিল্লা খাইতে চায়'' ।



"আমার দিদিমা কইতো মেয়া মানুষে কতা হোননের লুক নাই আর মনের মইদ্দে যে হগল কতা তা কওন অ যায় না । মনে দুক্ষু হইলে গাছের কাছে গিয়া কবি ইন্দু, গাছের জান আছে তর কতা ঠিক হুনবে কিন্তু কারো কাচে তা কবে না কুনু সুময় । পাথরের কাচে কবি পাথর গইলে যাবে কিন্তুক অন্য কারো তা ফাঁস করি দেবে না জানিস '' ইন্দু বুড়ি লাঠি ভড় দিয়ে উঠে দাঁড়ায় টুকুর টুকুর করে পাছ বাড়ি দিয়ে নিজের ভিটার দিকে রওনা হয় ।


সেই থেকে ঘরের কাজ কর্ম সেরে বিনি ভাশুরের কাছে বসে । ভাশুরের যত্ন নিতে নিতে, খাওয়াতে খওয়াতে বক বক করে মনের সুখ দুঃখ ব্যক্ত করে । বলে, '' বোজলেন মিয়াঁ ভাই, ইন্দু মাসী কইলো মনের কতা গাছের কাছে, পাথরের কাছর বইসা কলি মন হালকা হয় । আপনে তো পাত্থরের নাহালই, তয় আমার মন কয় আপনে সব শুনতি পান বুজতি পারেন, ক্যাবল বইলতে পারেন না । বিয়াদপি নিয়েন না, ভাশুর মানুস বাপের সমান । আমিও আপনেরে বাপ গিয়ান করছি সকল সুমায় । আপনেও বেটির মতন দ্যাখছেন আমারে । বার বসর বয়সে বিয়া দিয়া বাপ বিলাইের মতন খেদাইয়া দিল আর কুনু দিন একটা উদ্দিস করল না । হে অ আছিল দিন আনে দিন খায় কামলা মানুস, ঘর ভর্তি এন্ডি গেন্দী । আমিও বাইচা গেলাম, তয় আপনের মায়ে মানুষটা বেশী সুবিদার আছিল না । দাসী বান্দির মতন খাটাইয়া নিছে, সুময়ে অসুময়ে গুমুর গুমর কিল অ মারছে, তয় ভাতের কষ্ট দেয় নাই। বেসেতের বান্দা আল্লাহ্‌ তাঁরে বেহেস্তে নিক'' ।


রাতে দূর থেকে গুম গুম গোলা গুলির আওয়াজ শোনা যায় । ঝিনুক দিয়ে ভাশুরকে খাওয়াতে,খাওয়াতে বিনি বলে,'' মিয়াঁ ভাই মাসী কইলো রাজাকারেরা বাজারে কাছে হাই ইশকুলে ঘাটি গাড়ছে, মাইনসের উপর খুব জুলুম করতাছে । বাইছা, বাইছা সোন্দর জুবুতি মেয়া মানুষগোরে মিলিটারির হাতে তুইলা দিতাছে, নিজেরাও ইজ্জত নষ্ট করতাছে । মাইনসের গরু ছাগল গুলাও খইয়া শেষ করলো । বাড়ি বাড়ি গিয়া জুবক পোলাগো ধইরা আইনা জোর কইরা রাজাকারে নাম ভর্তি করে । কতা না হুনলে বাড়ি সুইদ্দা মাইনসেরে খতম কইরা দেয়, ঘরে আগুন লাগায় । কুনু দিকে মাইনসের শান্তি নাই, মুক্তি জুদ্দে গেলে অ শাস্তি, না গেলে অ শাস্তি । আমার আর কি মিয়াঁ ভাই সারা জন্ম তো দুক্ষু কইরাই কাডাইলাম । জুবুতি হওনের আগ পরজন্ত আপনের মায়ের লগে ঘুমাইছি । আপনে ভাশুর মানুষ সরমের কতা তয় আপনেরে কই, আপনের ভাই আছিল ঢ্যামনা, এক্কেরে ঢোঁড়া সাপ । রাইতে হের পাশে শুইয়া আমার জ্যান সর্বাঙ্গ শরীর পুইড়া যাইতো, খালি ছটর ফটর করি । নিজে নিজে নিজেরে ঠাণ্ডা করনের চেষ্টা করি । আপনের বলদ ভাইয়ে কয় অস্থির করো ক্যান ? কই যে গরম করে, হেই ব্যক্কলে ঊইডা জোরে জোরে পাঙ্খা দিয়া বাতাস পারে । ওই জ্বলুনি কি হাওয়ায় মিডে কন, যার নাম হইলো যৌবন জ্বালা, জইলা পুইড়া মরণ । অহন হাতের কাছে একখান কাঁচি রাইখ্যা দিছি, কাওরে মারতে না পারি নিজের গলায় বসাইয়া দিমু একপোঁচ । আপনের ফালায়া মরতে ও পারতাছি না মিয়া ভাই'' ।


সকালে ভাশুরকে গামছা ভিজিয়ে, ভিজিয়ে গা মুছে দিতে দিতে বিনি বলে,'' বোজলেন মিয়া ভাই, বিয়ার তিন বসর পূইড়া গেল পূলা পাইন অয় না, কতো মানত মানতি তাবীয কবজ । শাশুড়ি আম্মায় অস্থির হয়া গ্যাল, কয় বউয়ে বাণজা, পূলারে আবার বিয়া করামু । শেষে ইন্দু মাসী কইলো, কুন গিরামে জ্যান এক সাধক আছে, হেয় মন্তর পইড়া পেট বাইনধাঁ দিলে আমি পোয়াতি হমু । মাসীই সাথে নিয়ে গ্যালো, সাধকের কি চিহারা মিয়াঁ ভাই, জ্যান নূর ঝইরা পড়ে । মাসীরে বসাইয়া আমারে পাশের ঘরে নিয়া গ্যালো, মিষ্টি এক গিলাস শরবত দিলো খাইতে । এমন খুশবু ওয়ালা শরবত আগে কুনু দিন খাই না, খাইয়া কেমুন জ্যান ঘুম ঘুম পাইতে লাগলো তয় এককরে ঘুমাই নাই, জ্যান নিশা লাগছে । সাধকের সাথে মিলনে যে কি ভাব হইলো, মনে লয় আমি জ্যান সাত আসমানের উপর দিয়া ভইসা ভাইসা জাইতাছি'' বলতে বলতে স্বর্গীয় আভা ফোটে বিনির মুখে ।


একটু দম নিয়ে স্বপ্ন মাখা গলায় আবার বলে, "এক বারের মিলনে আমার প্যাডে পোলা পাইন আইলো না, মাসীর সাথে মাসের দিন হিসাব কইরা আরও কয়বার গেলাম । গতর ভারী হওনের খবর শুইনা কি খুশী আম্মাজান, হাটের থন নূতন কাপড় আনাইয়া দিলেন, আমার খাতির বইরা গ্যালো । আমি তো আর বানঞ্জা আছিলাম না, বানঞ্জা আছিলো আপনের ভাই । আপনে তহন ভাবীজানরে লইয়া গঞ্জে থাকেন, এই সব খপর আপনের আজানা । আম্মাজান আশা করছিল পুলা হইবো, হইলো মাইয়া । তয় আম্মাজান নাতনীরে হ্যাঁক থুঃ না করলেও, নাতীর লাইগা তাগাদা দেওন শুরু করলো । মাসী বুজাইলো ঘন ঘন পুলা পান হওন ঠিক না, শরীর ভাইঙ্গা যাইবো । তয় বসর দুই পরে আম্মাজানের আর সবুর মানে না, মাসীর লগে জোর কইরা আবার সাধকের কাছে পাডাইলো । এইবার হইলো পুলা চান্দের লাহান, দুই খাসী জবো দিয়া নাতীর আকিকা করলো । পুড়া কপাল আমার দেশে জুদ্দুর আগুন লাগলো, এক রাইতের মইদ্দে উজাড় হইয়া গেল আমার ঘর, ব্যাকতে সাফা । মেয়া মানুষের হইলো বিলাইয়ের হাড্ডি বুজলেন মিয়াঁ ভাই সহজে মরণ নাই, সবটিরে গোরে পাঠাইয়া আমি বাড়ি পর দেই, রান্দি বাড়ি খাই, আপনের দেকশুন করি'' চোখের কোল বেয়ে পানির ধারা বয়ে যায় বিনির ।


বেলা বারটার দিকে ইন্দু মাসী এসে বলে, '' সর্বনাশ বিনি বাজারে শুইনা আইলাম রাজাকাররা নাহি যে কুনু সুমায় এইদিক আইবো । নিজের লেইগা আমি ডরাই না আমার জ্যাতো চিন্তা তোরে লইয়া, অর্থব্ব মানুষটারে ফেলাইয়া কুনুদিক যাইতেও তো পারবি না । তয় মনে লয় জুদ্দু শ্যাষ হওনের আর বেশী দেরী নাই, মুক্তিরা অ মিলিটারি গো মাইরা সাফা করতাছে । আমার দিদিমা কইতো, 'যারা ভালবাসন কি জিনিস জানেনা, হেরাই জুদ্দু করতে ভালবাসে' !


"মাসী লও এক কাম করি তেনারে আমরা দুজন মিলা ধরা ধরি কইরা গোলা ঘরের মইদ্দে ছাপাইয়া থুই । আমি বেজুত দ্যাখলে পুস্কুনিত ঝাঁপ দিমু, নয় কাঁচি তো এক্কখান রাখছি হাতের নাগালে'' বিনি বলে একটা ধান কাটবার চকচকে কাস্তে তুলে দেখায় । দুজনে মিলে টেনে হিঁচড়ে নিদান আলীকে পাশের ছোট্ট গোলা ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে শুইয়ে দেয় । মাঝের বাঁশের চাটাই দেয়া দরজা বন্ধ করে সেখানে টিনের তোরঙের উপর লেপ তোশক কাঁথা বালিশ স্তূপ করে রাখে, তার নীচে রেখে দেয় কাস্তেটা ।


সেদিন বিকলেই বিনিদের বাড়িতে একজন বয়স্ক আর একজন তরুণ রাজাকার রাইফেল হাতে হাজির হয় । দরজায় আওয়াজ শুনে ভঁয়ে কেঁপে ওঠে বিনি, তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় তুলে লম্বা ঘোমটা টানে দরজার কপাট খুলে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ায় । মানুষ দুজন ঘরে ঢোকে এদিক সেদিক উঁকি ঝুঁকি মারে, তরুণটি চৌকির তলায় ঝুঁকে দ্যাখে ।
''বাড়ির আর মানুষ কই'' বাজ খাকী গলায় জিজ্ঞেস করে বয়স্ক জন
কাঁপা কাঁপা গলায় বিনি বলে, ''আর কেউ নাই আমি একলাই''
"একলা মাইয়া মানুষ তুমি এ হানে কি কর"?
"জী কাম করি"
"এমুন অদিনে কিয়ের কাম কর, মস্করা করনের জায়গা পাও না, ভয় ডর নাই তোমার দিলে"?
"জী বাজারে গতর বেচি"
শুনেই কয়েক হাত পিছিয়ে আসে, চেঁচিয়ে ওঠে বয়স্ক মানুষটি ''কি কইলা বেশরম মাইয়া মানুষ, বাপ দাদার বংশের কুলে কালী দিতে শরম করলো না । ওয়াস্তাক ফিরুল্লাহ আল্লাহ্‌জী লা হাওলা কুয়াতে ইল্লা বিল্লাহ আলিয়ুল আজিম'' ! তওবা পড়ে থুতু ছিটিয়ে দেয় বিনির গায়ে ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । তরুণ যুবকটি এতক্ষণ কৌতূহল নিয়ে বিনিকে দেখছিল সেও আস্তে বাইরে যায় । বিনি ধপাস করে বসে পড়ে, উত্তেজনায় তার বুক ধড়াস ধড়াস করতে থাকে এক গ্লাস পানি খায় সে ঢক ঢক করে ।


সন্ধ্যা হবার আগেই আজ বিনি ভাশুরকে খাইয়ে দেয় বলে, ''সব তো হোনলেন মিয়াঁ ভাই, অবস্থা গতিক বেশী সুবিদার না । আজ তরতরি খাইয়া নেন, আপনারে আবার ভিতরে রাইখ্যা দুয়ার দিমু, সাইঞ্ঝ ঘনানির আগেই বাত্তি বুজামু । রাজাকার গো বিশ্বাস নাই"।


সন্ধ্যার মুখে ঘরের দরজায় টুক টুক আওয়াজ শুনে হ্যারিকেন হাতে নিয়ে দরজা খোলে বিনি আলো উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, "কেডা মাসী আইলানি ? এমুন আন্ধাইরে কেন গো মাসী"? দুপা পিছিয়ে যায় বিনি, বিকেলের সেই তরুণ রাজাকারটি লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে আছে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করে, "কতো" ?
"কিয়ের কতো" অবাক হয়ে জানতে চায় বিনি
" না মাইনে কতো ট্যাহা নেও তুমি"?
"না না আমি বেবুবেশ্যা না, গেরস্ত ঘরের বউ" আর্তনাদ করে ওঠে বিনি
ছেলেটা বিনিকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে চেপে ধরে টেনে হিঁচড়ে কাপড় চোপড় খুলে ফেলে । উঠে যাবার সময় একগোছা নোট রেখে যায় খোলা দরজা দিয়ে হাওয়া এসে নোট গুলোকে ঘর ময় উড়িয়ে দেয়, হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে বিনি । দৌড়ে কুয়া তলায় যায় ঘড়া ঘড়া পানি তুলে ঢালতে থাকে, রগড়ে রগড়ে গায়ের চামড়া তুলে ফেলতে চায় যেন, কুয়ার পানি আর চোখের পানিতে মাখা মাখি হয়ে যায় ।


বিনি দুই ঘরের মাঝের ঝাঁপ সরিয়ে অন্য দিকে মুখ দিয়ে বসে বলে, " মিয়াঁ ভাই, আপনে তো হুনছেন আমার হেনস্তা । কাইল রাইতে আমি নিজের গলা কাইডা ফালাইতে চাইছিলাম । খালি আপনের কথা মনে কইরা পারলাম না, মাইয়ারা হইলো মায়ের জাইত তার উপর আপনে আঁতুড় মানুষ । আপনেরে ফালাইয়া মইরা আমার শান্তি হপে না, আপনেরে এক গিলাস পানি দেওনের মানুষ ও তো নাই । আপনে মড়ার সময় মুখে পানি দেবে কেডা ? মিত্তুর পরে আম্মাজান জিগাবে, ভাবীজান জিগাবে তহন জবাব দিমু কি ? আমার তো এমনি ইহকাল নাই, পরকালডা ও খোয়াইতে চাই না'' । তয় শ্যাষ রাইতে একখান আজীব স্বপ্ন দ্যাখলাম । আমার জাইন চান্দের লাহান পোলা হইছে কিন্তুক সেই পুলাদার মুখ বুইরা মাইনসের লাহান কুঁচকান চামড়া, জ্যান আমার দাদাজান ফিরা আইছে'' হাঁটুতে মুখ গুঁজে গুংরে কেঁদে ওঠে সে ।



পরদিন সন্ধ্যা হতেই ছেলেটা আবার আসে হাতে একটা পোটলা বিনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, '' দেহ তোমার লেইগা কতো কি আনছি তুমি এইগুলা পিন্দা সাইজা আসো", পোটলাটা বিনির হাতে ধরিয়ে দেয় । বিনি ঘরের এক কোনে গিয়ে লাল ডুরে শাড়ী পড়ে, চোখে মোটা করে কাজল দেয়,ঠোঁটে আলতা মাখে লুকিয়ে হাত বাড়িয়ে কাঁচিটা তুলে নেয় কাপড়ের আড়ালে করে সামনে এসে দাঁড়ায়, ছেলেটা সার্ট খুলে বিছানায় বসে ছিল । আস্তে আস্তে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়ায় ওর গলা জড়িয়ে ধরে লাস্য ভঙ্গীতে তার মুখে দিকে চায় বিনি । ছেলেটা কিছু বুঝবার আগেই তার গলায় গভীর একটা পোঁচ বসিয়ে দেয় ।



পরদিন ভোরে মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ভেসে আসার শব্দ শোনা যায়, কিছুক্ষণ পরেই শোনা যায় উত্তেজিত মানুষের চীৎকার চেচামেচি "জয়বংলা, বাংলাদেশ জিন্দা বাদ'' । দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে বিনি ছুটে উঠানে নেমে আসে দুহাত আকাশে উঁচিয়ে লাল সবুজ রঙের গামছা নাড়তে থাকে, মুখে হাসি চোখ থেকে ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে বারিধারা !



লেখক পরিচিতি
সুদর্শনা রহমান 
অস্ট্রেলিয়া

গল্পকার। অনুবাদক। চলচ্চিত্রকার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ