অন্যান্য দিনের চেয়ে অফিসের কাজ আজকে অনেক তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেলেছে জুবায়ের। একটা ফুরফুরে মেজাজ যে তার আচরণ আর শরীরের অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিলো তা অধীনস্তদের নজরেও পড়েছিলে নির্ভুলভাবে। হিসাব নিকাশে খুব নির্ভুল বলে জুবায়েরের সামনে সবাই খুব সতর্ক থাকে। পরিপাটি ও সুদর্শন জুবায়ের তাই অধীনস্তদের কাছে এই কারণে কিছুটা সভয় শ্রদ্ধার আসন তৈরি করে রেখেছে। একেবারে দ্রুত বড় লোক হওয়ার জন্য এই সব গুণের কথা কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে মাঝে মধ্যেই বলে থাকেন। এমনিতেই বাংলাদেশ দ্রুত বড় লোক হওয়ার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য দেশ হলেও জুবায়েরের এই গুণকে তারা কোনভাবেই খাটো করে দেখে না।
সবাইকে আজ সে আগেই ছুটি দিয়েছে। দুটো শিপমেন্ট কনফার্ম করে এখন সে নিশ্চিন্ত। হঠাৎ তার মনে পড়লো তাহমীনার কথা। তাহমীনাকে সে কিছুদিন থেকেই অবহেলা করে আসছিলো। একটা ফোন করলে কেমন হয়? হঠাৎ করেই কেন তাহমীনার কথা মনে এলো যাকে সে অবহেলা করে আসছে? জুবায়ের নিজের কাছেই এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না। কিছুক্ষণ দ্বিধার মধ্যে থেকে তাহমীনাকে সে ফোন করে বললো, কেমন আছ?
জুবায়েরের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কল পেয়ে তাহমীনা খানিকটা অবাক আর আনন্দে অভিভূত হলেও কন্ঠে ছিলো অভিযোগ। কেমন থাকবো? তুমি দিন দিন যত বড়লোক হচ্ছ আমার প্রতি তোমার অবহেলা ততটাই বাড়ছে।
মোটেই ঠিক নয় মীনা। আসলে কি জান, ব্যস্ততা এত বেড়ে গেছে যে পারিবারিক অনেক দায়িত্বই পালন করতে পারছি না। বিশ্বাস কর, আমি এই জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। থাক এসব, কী করছ তুমি? তাহমীনার কন্ঠস্বর তার মেজাজকে খোলতাই করতে লাগলো। সেল ফোনটা কানে চেপে রেখেই টেবিলের ডানপাশের নিচের দরজাটা খুলে শিভাস রিগালের বোতলটা বের করে টেবিলে রাখলো। বরফ বা ঠান্ডা পানি মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যেস থাকলেও এই মুহূর্তে তা পাওয়া মুশকিল। এক জুবায়ের ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণী অফিসে নেই। নিজের পিয়নটাকেও ছেড়ে দিয়েছে। গ্লাসের মধ্যে সামান্য ঢেলে বোতলের মুখটা বন্ধ করে এক চুমুকে খানিকটা খেয়ে নিলো জুবায়ের।
খুব ব্যস্ত না থাকলে চলে এসো। আমার হাতে কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। আসতে পারবে? পারবো। ওপাশ থেকে জবাব এলো। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোবাস না। তাহমীনা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু জুবায়ের থামিয়ে দিলো তার আগেই।
তুমি আস, এলেই সব বুঝিয়ে বলবো। কথা বলতে বলতে গ্লাসের ভেতরে সোনালি অংশটুকু দোলাতে দোলাতে জুবায়ের নিশ্চিত হওয়ার জন্য জানতে চাইলো, কতক্ষণ লাগবে?
ঘন্টাখানেক তো লাগবেই?
এত সময়? বাসাতো বেশি দূরে নয়।
মেয়েদের সম্পর্কে কি তোমার ধারণা নেই?
তুমি ছাড়া আর কারো সম্পর্কে নেই, মীনা।
কপট অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মীনা জানতে চাইলো, তাই নাকি? কেন বিশ্বাস হয় না। জুবায়ের আর কথা না বাড়িয়ে গ্লাসের যে-অংশটুকু ডান হাত দিয়ে দোলাচ্ছিলো তা এক চুমুকে শেষ করে বললো, এলেই তোমার বিশ্বাস হবে। তাহমীনার যে দিন বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো তাগিদ থাকে না সেদিন বিকেলের দিকে গোছল সেরে নেয়, আজও তাই করেছে। আধা ঘন্টা আগেই সে গোছল সেরে নুরুল আলম আতিকের ‘যাদুর শহর’ নাটকের প্রথম পর্ব দেখছিলো। নাটকের মাঝখানেই জুবায়েরের ঝলমলে ফোন কলটি এসে তার মনকে আলোকিত করে তুললো। কিছুদিন থেকেই জুবায়েরের সাথে তার সম্পর্কটির কোন নিশ্চয়তা খুঁজে না-পেয়ে তার মন খুব খারাপ ছিলো। মাঝে মধ্যে জুবায়েরকে ফোন করে পাওয়া যেত না। আজ মেঘ না চাইতেই জলের মতো কলটি পেয়ে সে দারুণ খুশী। কী পড়বো - শাড়ী নাকি সেলোয়ার কামিজ, - ভাবলো সে। না, শাড়ী বেশ সময়-খেকো - পড়তে সময় লাগে, তা ছাড়া হাটার স্বাচ্ছন্দ্যকে খানিকটা ব্যাহত করে বলে মনে হয়। সাদা কালো প্রিন্টের সেলোয়ার কামিজই সে বেছে নিলো।
তাহমীনা আসবে এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পর থেকে জুবায়েরের কাছে সময়টা স্থবির কিংবা ক্রমবর্ধমান মনে হতে থাকলো। অপেক্ষার এই সময়টিতে কিছু করার নেই ভেবে সে এক রকম অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। তার অফিস রুমের সোফাটির দিকে তাকালো একবার। টয়লেটের পরিচ্ছন্নতাও পর্যবেক্ষণ করলো। হাল্কা কিছু খাবার দাবার আনতে পারলে ভালো হতো। পিয়নকে দিয়ে একটা থাই স্যুপ আনিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার তাগিদে সেটি আর খাওয়া হয়নি। কিন্তু স্যুপ ঠান্ডা ভালো লাগে না।
মাকে একটা ফোন করলে কেমন হয়? খোঁজখবরও নেয়া যাবে আর তাতে করে সময়ও কাটবে। কিন্তু মাকে ফোন করা মানেই কুরবানীর বিষয়টি কনফার্ম করা ছাড়া কথা শেষ করা যাবে না। জুবায়েরের কুরবানীতে অনিচ্ছা নেই, কিন্তু কথা হলো মা খুব দামী একটা গুরুর আবদার করে বসলে সেটাকে না বলার শক্তি তার থাকবে না। সামনে ঈদের বাকি মাত্র ১২ দিন। সিদ্ধান্ত নিলে মাকে তা এখনই জানাতে হবে। টেবিলে রাখা ফোন সেটটি বেজে ওঠা মাত্র জুবায়ের তাকিয়ে দেখে তাহমীনার কল। কী ব্যাপার?
নিচের গেটটা লক করা। তুমি কি ভিতরে আছ?
আছসি, একটু দাঁড়াও। তবে কি পিয়ন ভুল করে যাবার সময় বন্ধ করে গেছে? তাড়াতাড়ি চাবি নিয়ে গেটের কাছে এসে তাহমীনাকে দেখে মৃদু হেসে ক্ষমাপ্রার্থীর ভঙ্গিতে বললো, সরি, পিয়নটা যাবার সময় ভুল করে লাগিয়ে গেছে অথবা আমার যাতে কোন ডিসটার্ব না হয় সেই ভেবেও হয়তো বন্ধ করে গেছে। গেটটা খুলে তাহমীনাকে ভিতরে নেয়ার সময় জুবায়ের সামনের দিকে তাকিয়ে নীল চেক সার্ট পড়া একটা ২৫/২৬ বছরের যুবককে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করলো। তবে শিভাস রিগালের কয়েক চুমুকের চাঙা ভাবটা এই অস্বস্তিকে সহজেই আড়াল করে দেয়।
তাহমীনাকে নিয়ে নিজের অফিস কক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে গভীর আবেগে জরিয়ে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খেল। তাহমীনাও সমর্পিতার মতো নিজেকে জুবায়েরের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়। আবার বহুদিন পর তার শরীরের অতল আহবানকে উন্মুক্ত করে দিতে পেরে সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে তার শরীর থেকে কাপড়চোপড় আলগা হতে থাকে। জুবায়েরও যেন প্রতিযোগিতার খেলায় সার্ট প্যান্ট দ্রুত খুলে ফেলে। সমস্ত শরীরকে তারা পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেয় কিছুক্ষণের জন্য। নগ্ন অবস্থায়ই জুবায়ের আরেকটা গ্লাসে শিভাস রিগাল ঢেলে চুমুক দিতে বলে তাহমীনাকে। তাহমীনার আগ্রহ না থাকলেও জুবায়েরের অনুরোধে সামান্য চুমুক দিয়ে তা আবার ফিরিয়ে দেয়। না, আমার গলা পুড়ে যাচ্ছে। তুমি কী করে খাও, বলতো? আমি পারবো না। আমার হয়ে বরং তুমি খাও। তাহমীনাকে কোলে বসিয়ে রেখেই জুবায়ের তাহমীনার অংশটুকু খেয়ে ওকে আবারও চুমু খেল। গভীর আদরের সঙ্গে জুবায়েরের দুই কাঁধে হাত দুটো রেখে তাহমীনা জানতে চায় ... আচ্ছা, আমরা এভাবে আর কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে....
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না জুবায়ের।
তুমি যদি আমাকে বিয়ে না কর তাহলে এই দুঃখেই আমি হয়তো একদিন মারা যাব, দেখো। জুবায়ের তাহমীনার আবেগ আর করুনায় মেশানো দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এই প্রথম নেশার আচ্ছন্নতার মধ্যেও কেঁপে উঠলো।
৫ আগস্ট ২০১২
অন লাইন পত্রিকাসহ সমস্ত দৈনিকে শীর্ষ সংবাদ হাতিরপুলে তরুণীর খন্ড-বিখন্ড লাশ উদ্ধার: হাতিরপুলের নাহার প্লাজায় নীল ট্রাভেলসে অসংখ্য তরুণী তাদের সম্ভম হারিয়েছে। নানা প্রলোভনে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তরুণীদের ওই অফিসে নিয়ে যেত জুবায়ের।
ঘাতক জুবায়ের তাকে ধর্ষণ করার পর গলা টিপে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করে জানালা দিয়ে পাশের ৫ তলা ভবনের ছাদের ওপর ফেলে দেয়। মাংস ও নাড়িভুড়ি কমোডে ফ্লাশ করে দেয়। হাড় থেকে মাংশ আলাদা করার জন্য সারা রাত সে এই কাজ করে। ৫ তলার ছাদ ও রাস্তা থেকে পুলিশ ২৮টি টুকরো উদ্ধার করে।
জুবায়ের স্বপ্ন থেকে এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে চার দেয়ালের অপ্রশস্থ জায়গায়।০
লেখক পরিচিতি
রাজু আলাউদ্দিন
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। ১৯৬৫ সালের ৬ মে শরিয়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম-এ কাজ করছেন। দেশি ও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লেখার পাশাপাশি ইংরেজি ও স্প্যানীশ থেকে প্রচুর অনুবাদ করেছেন।
প্রকাশিত অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থ :গেয়র্গ ট্রাকলের কবিতা (মঙ্গলসন্ধ্যা), টেড হিউজের নির্বাচিত কবিতা (বাংলা একাডেমী), সি. পি. কাভাফির কবিতা (শিল্পতরু প্রকাশনী),
কথোপকথন (বাংলা একাডেমী), সাক্ষাতকার (দিব্যপ্রকাশ), খ্যাতিমানদের মজারকাণ্ড (মাওলা ব্রাদার্স), নির্বাচিত বোর্হেস (ঐতিহ্য প্রকাশনী, ৫ খণ্ড, সম্পাদনা) বোর্হেসের আত্মজীবনী (সংহতি প্রকাশনী, সহ-অনুবাদক), আলাপচারিতা (পাঠকসমাবেশ, গৃহীত সাক্ষাতকার)
অন্য আলোয় অন্য ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বিদেশি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের আলাপচারিতা(সংহতি প্রকাশনী)
প্রকাশিতব্য গ্রন্থ:
দক্ষিণে সূর্যোদয় : লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস(অবসর প্রকাশনী)
অনূদিত কথাসমগ্র : অনূদিত সাক্ষাৎকার সমগ্র (কথা প্রকাশনী)
সবাইকে আজ সে আগেই ছুটি দিয়েছে। দুটো শিপমেন্ট কনফার্ম করে এখন সে নিশ্চিন্ত। হঠাৎ তার মনে পড়লো তাহমীনার কথা। তাহমীনাকে সে কিছুদিন থেকেই অবহেলা করে আসছিলো। একটা ফোন করলে কেমন হয়? হঠাৎ করেই কেন তাহমীনার কথা মনে এলো যাকে সে অবহেলা করে আসছে? জুবায়ের নিজের কাছেই এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না। কিছুক্ষণ দ্বিধার মধ্যে থেকে তাহমীনাকে সে ফোন করে বললো, কেমন আছ?
জুবায়েরের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কল পেয়ে তাহমীনা খানিকটা অবাক আর আনন্দে অভিভূত হলেও কন্ঠে ছিলো অভিযোগ। কেমন থাকবো? তুমি দিন দিন যত বড়লোক হচ্ছ আমার প্রতি তোমার অবহেলা ততটাই বাড়ছে।
মোটেই ঠিক নয় মীনা। আসলে কি জান, ব্যস্ততা এত বেড়ে গেছে যে পারিবারিক অনেক দায়িত্বই পালন করতে পারছি না। বিশ্বাস কর, আমি এই জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। থাক এসব, কী করছ তুমি? তাহমীনার কন্ঠস্বর তার মেজাজকে খোলতাই করতে লাগলো। সেল ফোনটা কানে চেপে রেখেই টেবিলের ডানপাশের নিচের দরজাটা খুলে শিভাস রিগালের বোতলটা বের করে টেবিলে রাখলো। বরফ বা ঠান্ডা পানি মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যেস থাকলেও এই মুহূর্তে তা পাওয়া মুশকিল। এক জুবায়ের ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণী অফিসে নেই। নিজের পিয়নটাকেও ছেড়ে দিয়েছে। গ্লাসের মধ্যে সামান্য ঢেলে বোতলের মুখটা বন্ধ করে এক চুমুকে খানিকটা খেয়ে নিলো জুবায়ের।
খুব ব্যস্ত না থাকলে চলে এসো। আমার হাতে কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। আসতে পারবে? পারবো। ওপাশ থেকে জবাব এলো। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোবাস না। তাহমীনা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু জুবায়ের থামিয়ে দিলো তার আগেই।
তুমি আস, এলেই সব বুঝিয়ে বলবো। কথা বলতে বলতে গ্লাসের ভেতরে সোনালি অংশটুকু দোলাতে দোলাতে জুবায়ের নিশ্চিত হওয়ার জন্য জানতে চাইলো, কতক্ষণ লাগবে?
ঘন্টাখানেক তো লাগবেই?
এত সময়? বাসাতো বেশি দূরে নয়।
মেয়েদের সম্পর্কে কি তোমার ধারণা নেই?
তুমি ছাড়া আর কারো সম্পর্কে নেই, মীনা।
কপট অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মীনা জানতে চাইলো, তাই নাকি? কেন বিশ্বাস হয় না। জুবায়ের আর কথা না বাড়িয়ে গ্লাসের যে-অংশটুকু ডান হাত দিয়ে দোলাচ্ছিলো তা এক চুমুকে শেষ করে বললো, এলেই তোমার বিশ্বাস হবে। তাহমীনার যে দিন বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো তাগিদ থাকে না সেদিন বিকেলের দিকে গোছল সেরে নেয়, আজও তাই করেছে। আধা ঘন্টা আগেই সে গোছল সেরে নুরুল আলম আতিকের ‘যাদুর শহর’ নাটকের প্রথম পর্ব দেখছিলো। নাটকের মাঝখানেই জুবায়েরের ঝলমলে ফোন কলটি এসে তার মনকে আলোকিত করে তুললো। কিছুদিন থেকেই জুবায়েরের সাথে তার সম্পর্কটির কোন নিশ্চয়তা খুঁজে না-পেয়ে তার মন খুব খারাপ ছিলো। মাঝে মধ্যে জুবায়েরকে ফোন করে পাওয়া যেত না। আজ মেঘ না চাইতেই জলের মতো কলটি পেয়ে সে দারুণ খুশী। কী পড়বো - শাড়ী নাকি সেলোয়ার কামিজ, - ভাবলো সে। না, শাড়ী বেশ সময়-খেকো - পড়তে সময় লাগে, তা ছাড়া হাটার স্বাচ্ছন্দ্যকে খানিকটা ব্যাহত করে বলে মনে হয়। সাদা কালো প্রিন্টের সেলোয়ার কামিজই সে বেছে নিলো।
তাহমীনা আসবে এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পর থেকে জুবায়েরের কাছে সময়টা স্থবির কিংবা ক্রমবর্ধমান মনে হতে থাকলো। অপেক্ষার এই সময়টিতে কিছু করার নেই ভেবে সে এক রকম অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। তার অফিস রুমের সোফাটির দিকে তাকালো একবার। টয়লেটের পরিচ্ছন্নতাও পর্যবেক্ষণ করলো। হাল্কা কিছু খাবার দাবার আনতে পারলে ভালো হতো। পিয়নকে দিয়ে একটা থাই স্যুপ আনিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার তাগিদে সেটি আর খাওয়া হয়নি। কিন্তু স্যুপ ঠান্ডা ভালো লাগে না।
মাকে একটা ফোন করলে কেমন হয়? খোঁজখবরও নেয়া যাবে আর তাতে করে সময়ও কাটবে। কিন্তু মাকে ফোন করা মানেই কুরবানীর বিষয়টি কনফার্ম করা ছাড়া কথা শেষ করা যাবে না। জুবায়েরের কুরবানীতে অনিচ্ছা নেই, কিন্তু কথা হলো মা খুব দামী একটা গুরুর আবদার করে বসলে সেটাকে না বলার শক্তি তার থাকবে না। সামনে ঈদের বাকি মাত্র ১২ দিন। সিদ্ধান্ত নিলে মাকে তা এখনই জানাতে হবে। টেবিলে রাখা ফোন সেটটি বেজে ওঠা মাত্র জুবায়ের তাকিয়ে দেখে তাহমীনার কল। কী ব্যাপার?
নিচের গেটটা লক করা। তুমি কি ভিতরে আছ?
আছসি, একটু দাঁড়াও। তবে কি পিয়ন ভুল করে যাবার সময় বন্ধ করে গেছে? তাড়াতাড়ি চাবি নিয়ে গেটের কাছে এসে তাহমীনাকে দেখে মৃদু হেসে ক্ষমাপ্রার্থীর ভঙ্গিতে বললো, সরি, পিয়নটা যাবার সময় ভুল করে লাগিয়ে গেছে অথবা আমার যাতে কোন ডিসটার্ব না হয় সেই ভেবেও হয়তো বন্ধ করে গেছে। গেটটা খুলে তাহমীনাকে ভিতরে নেয়ার সময় জুবায়ের সামনের দিকে তাকিয়ে নীল চেক সার্ট পড়া একটা ২৫/২৬ বছরের যুবককে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করলো। তবে শিভাস রিগালের কয়েক চুমুকের চাঙা ভাবটা এই অস্বস্তিকে সহজেই আড়াল করে দেয়।
তাহমীনাকে নিয়ে নিজের অফিস কক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে গভীর আবেগে জরিয়ে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খেল। তাহমীনাও সমর্পিতার মতো নিজেকে জুবায়েরের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়। আবার বহুদিন পর তার শরীরের অতল আহবানকে উন্মুক্ত করে দিতে পেরে সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে তার শরীর থেকে কাপড়চোপড় আলগা হতে থাকে। জুবায়েরও যেন প্রতিযোগিতার খেলায় সার্ট প্যান্ট দ্রুত খুলে ফেলে। সমস্ত শরীরকে তারা পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেয় কিছুক্ষণের জন্য। নগ্ন অবস্থায়ই জুবায়ের আরেকটা গ্লাসে শিভাস রিগাল ঢেলে চুমুক দিতে বলে তাহমীনাকে। তাহমীনার আগ্রহ না থাকলেও জুবায়েরের অনুরোধে সামান্য চুমুক দিয়ে তা আবার ফিরিয়ে দেয়। না, আমার গলা পুড়ে যাচ্ছে। তুমি কী করে খাও, বলতো? আমি পারবো না। আমার হয়ে বরং তুমি খাও। তাহমীনাকে কোলে বসিয়ে রেখেই জুবায়ের তাহমীনার অংশটুকু খেয়ে ওকে আবারও চুমু খেল। গভীর আদরের সঙ্গে জুবায়েরের দুই কাঁধে হাত দুটো রেখে তাহমীনা জানতে চায় ... আচ্ছা, আমরা এভাবে আর কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে....
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না জুবায়ের।
তুমি যদি আমাকে বিয়ে না কর তাহলে এই দুঃখেই আমি হয়তো একদিন মারা যাব, দেখো। জুবায়ের তাহমীনার আবেগ আর করুনায় মেশানো দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এই প্রথম নেশার আচ্ছন্নতার মধ্যেও কেঁপে উঠলো।
৫ আগস্ট ২০১২
অন লাইন পত্রিকাসহ সমস্ত দৈনিকে শীর্ষ সংবাদ হাতিরপুলে তরুণীর খন্ড-বিখন্ড লাশ উদ্ধার: হাতিরপুলের নাহার প্লাজায় নীল ট্রাভেলসে অসংখ্য তরুণী তাদের সম্ভম হারিয়েছে। নানা প্রলোভনে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তরুণীদের ওই অফিসে নিয়ে যেত জুবায়ের।
ঘাতক জুবায়ের তাকে ধর্ষণ করার পর গলা টিপে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করে জানালা দিয়ে পাশের ৫ তলা ভবনের ছাদের ওপর ফেলে দেয়। মাংস ও নাড়িভুড়ি কমোডে ফ্লাশ করে দেয়। হাড় থেকে মাংশ আলাদা করার জন্য সারা রাত সে এই কাজ করে। ৫ তলার ছাদ ও রাস্তা থেকে পুলিশ ২৮টি টুকরো উদ্ধার করে।
জুবায়ের স্বপ্ন থেকে এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে চার দেয়ালের অপ্রশস্থ জায়গায়।০
লেখক পরিচিতি
রাজু আলাউদ্দিন
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। ১৯৬৫ সালের ৬ মে শরিয়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম-এ কাজ করছেন। দেশি ও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লেখার পাশাপাশি ইংরেজি ও স্প্যানীশ থেকে প্রচুর অনুবাদ করেছেন।
প্রকাশিত অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থ :গেয়র্গ ট্রাকলের কবিতা (মঙ্গলসন্ধ্যা), টেড হিউজের নির্বাচিত কবিতা (বাংলা একাডেমী), সি. পি. কাভাফির কবিতা (শিল্পতরু প্রকাশনী),
কথোপকথন (বাংলা একাডেমী), সাক্ষাতকার (দিব্যপ্রকাশ), খ্যাতিমানদের মজারকাণ্ড (মাওলা ব্রাদার্স), নির্বাচিত বোর্হেস (ঐতিহ্য প্রকাশনী, ৫ খণ্ড, সম্পাদনা) বোর্হেসের আত্মজীবনী (সংহতি প্রকাশনী, সহ-অনুবাদক), আলাপচারিতা (পাঠকসমাবেশ, গৃহীত সাক্ষাতকার)
অন্য আলোয় অন্য ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বিদেশি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের আলাপচারিতা(সংহতি প্রকাশনী)
প্রকাশিতব্য গ্রন্থ:
দক্ষিণে সূর্যোদয় : লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস(অবসর প্রকাশনী)
অনূদিত কথাসমগ্র : অনূদিত সাক্ষাৎকার সমগ্র (কথা প্রকাশনী)
0 মন্তব্যসমূহ