সুমন সুপান্থ'র গল্প : ধ্বংসকালীন বোবা গল্প

অবিরাম যুদ্ধ শেষে কান্দাহারের কোনও সেনা ছাউনিতে ঝিমানো ক্লান্ত মার্কিন সৈনিকের মতো বিধ্বস্ত মন ও দেহ নিয়ে নেটে আমি মোনাকে বলি গল্পটি লিখতেই হবে আমার। সোহেল বলছে আর দেরি হলে বই হচ্ছে না আর এইবার। আজ রাতেই গল্পটা শেষ করতে চাই। রক্ত ও শিরার ভেতর এই থই থই প্লাবনের তোড়ে, কবিতা কবিতা ভাষার চক্করে পড়ে বেহাল দিশেহারা গল্পটা আমার জন্মাতেই পারলো না বুঝি ! সন্দীপন একবার কমলকুমার মজুমদারকে লিখলেন, ‘প্রিয় কমল দা,...আপনি একটা ভাষা পেয়েছেন। আমি, গৌরবে আমরা, অনেকেই পাই নি। বাকী কেউ ধর্তব্যের মধ্যে নয়। বিজনের রক্তমাংস গল্পে আমার যে ভাষা ছিলো, বিপ্লব ও রাজমোহন গল্পের সে ভাষা আলাদা। এই জন্যেই আমি ঘন ঘন লিখতে পারি না। বিষয়ের অভাবে নয়, ভাষার অভাবে’।


কীর্তিমানের সঙ্গে নিজেকে মাপতে পেরে শ্লাঘা বোধ হয়। আমারও এমন হয়, বলি আমি মোনাকে। আমি বিষয় পাল্টাতে অন্য কিছু লিখি। গদ্যের মধ্যে কবিতার পঙত্তি ভরে দিয়ে বসে থাকি। কবে আর আসে এমন ভাষা, এমন নিবিড় প্রেমে! ভালোবাসা ততোক্ষণ ভালোবাসাই নয় যদি না তার জন্যে হাহাকার উঠে তোমার ভেতরের গভীর খাঁজে। যদি না তুমি কাঁদতে বসে যাও তার জন্য। ওপারে, মোনা, আমার বন্ধু, আমার সখী গলে গলে পড়ে। প্রেমে জল হয়ে যায় গলে। আমি পাল্টা একটা উইন্ডো খুলে ওয়াল স্ট্রীট বিরোধী বিক্ষোভে সারা দুনিয়ার জ্বলে উঠার খবরে পুলক বোধ করি। নেটে ফারুক ওয়াসিফকে খুঁজি। অভিন্যু কিবরিয়া কে খুঁজি। সাকী ভাইকে, জুনায়েদ সাকীকে তালাশ করি। ঢাকায়ও তো এমন একটা বিক্ষোভের আয়োজন হচ্ছে, শুনেছি। মঞ্জুরুল আহসান খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসে সকালেই পড়লাম, নিরানব্বুই বনাম এক/ বড়োলোকদের দে ঠেক! এক ভাগ ধনী লোকের কাছে নতজানু নিরানব্বুই ভাগের এই বিক্ষোভ কি নাড়াতে পারবে কিছু? সেমি-কমিউনিষ্ট উচ্ছ্বাস নিয়েই আরেকটা উইন্ডোতে ইউ টিউবে গিয়ে দেখি লেডি গাগার নতুন ভিডিও এসেছে কি না। অক্সফোর্ড শহরের রাস্তা ঘাটে তীব্র শীত জমে উঠলে তখন আবার শামীম ভাইর কথা মনে পড়ে। সেই যে উনি নাতিশীতোষ্ণ ব-দ্বীপে বাস করেও কেমন করে জানি জেনে গেলেন যে, কারা যেন ডানা কাটা হিমের ভেতর হেঁটে হেঁটে চিরকালীন এক গহ্বরে হারিয়ে গেলো।

যেহেতু আমরা ইমতিয়ার শামীমকে চিনি, জানি অল্প বিস্তর, এই গল্পে তাঁর কোন ভুমিকা নেই জেনেও গল্পের প্রাক্কালে তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম মনে আসে আমাদের। আমরা আলাদা আলদা দুই মহাদেশে বসেও হয়তো একই রকম ভাবি, আমি আর মোনা, সন্ধ্যাউত্তীর্ণ এই রাতে এইমাত্র যে মেয়েটা, রক্তাত্ত, এসে নামলো ভাঁটপুর বেবিস্ট্যান্ডে, তার বৃত্তান্ত ইমতিয়ার শামীম কি মামুন হুসাইন জানলে আরও ভালো একটা গল্প হতে পারতো। এঁদের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্বের কথা মোনা জানে। তবু বলে, নাহ তুমিই লিখো। এই গল্প তোমার। তুমি লিখলেই ভাল লিখবে। বলেই নিজেকে শোধরায়, আবার জিজ্ঞেস করে, ‘বললাম তো এ তোমার গল্প, কিন্তু তুমি কি সত্যিই এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছো?... আই মিন মেয়েদের শরীরে...!’ আমি থামিয়ে দিই। শোনো, মানিক কাকুর কথায় বলি, লেখক তো অভিজ্ঞতা থেকে লিখে না। অভিজ্ঞান থেকে লিখে। এই যে তিনি পদ্মার মাঝিদের বৃত্তান্ত লিখে গেলেন, কিন্তু নিজে তো জীবনেও তাদের সাথে থাকেন নি। দু’ একবার ওদের সঙ্গে কথা টথা বলেছেন, বিড়ি ফুঁকেছেন, তাও ডাঙায়ই। তো?

তো, তখন মনে হয় বছরের ছলনাময় সেই দিন ক’টি। যখন মনে হবে বসন্তই এটা। আর শীত পালিয়েছে কবে। পাতা ঝরা সম্পন্ন। আবার নতুন পাতারও নেই হদিশ। সন্ধ্যা উত্তীর্ন সেই রাতের চৌকাঠ ধরে তখন অল্প আলোর মরা জোছনা বেবিস্ট্যান্ডের সবচেয়ে বড় বিলবোর্ডে হাস্যোজ্জ্বল মডেল মেয়েটার ভরাট স্বাস্থ্য দু’টোতে পড়েও বিচ্ছুরণ তুলতে পারছিলো না। কোন কোন রাত এমন কুশলী। এমনই প্রবঞ্চনাময়।

ভাঁটপুর বেবিস্ট্যান্ডের যে জায়গাটায়, বড় বিলবোর্ডটার পাশে, কনকপুর-উজানডাঙার সব বেবিট্যাক্সি, সিএনজি এসে থামে, মেয়েটি সেখানে এসেই নামে। শহরফেরত ক্লান্ত, অবসাদে নুয়ে আসা সব মানুষ এখানে নেমেই ভিন্ন ভিন্ন জনপদে গেঁথে থাকা তাদের বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। শহীদুল হক হলে লিখতেন, হয়তো তারা হাঁটে, কিংবা হাঁটে না। হয়তো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকে, ইয়ার দোস্তদের জন্য অপেক্ষা করে। ‘পারাপার’ পেরিয়ে তবেই তিনি খেয়াল করেছিলেন, শহীদুল হক নামে আরও একজন লেখক আছেন। তখন তিনি যে তার পিতামহের নাম যুক্ত করে নিয়ে, ‘ জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় শহীদুল জহির নামে উপস্থিত হন, এই তথ্য এখন পুরোনো বটে। খুব একটা তথ্যও নেই অবশ্য তাঁর ব্যাপারে। একা নিঃসঙ্গ মানুষটা হঠাত বুকে ব্যথা উঠলে নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়েছিলেন সিঁড়ির কোনেই! ভেতরে টিভিটা তখনো চলছিলো। আমৃত্যু টিভি দেখার এই বিলাশ বেঁচে ছিলো তাঁর! ফয়জুল ইসলাম সুমন গল্প করছিলেন, বুঝলে, স্যারের বিছানা বরাবর একটা টিভি এমন ভাবে রাখা ছিলো, যাতে শুয়ে শুয়েও দেখা যায়। ফয়জুল ইসলাম আর শহীদুল জহির এক সঙ্গে কাজ করেছেন অনেকদিন। মৃত্যুর পরেও তিনি শহীদুল জহিরকে স্যার ডাকতে ভুলেন না। যেমনটা গল্প লিখতে গেলে আমরা তরুণের দল তাঁর এই ‘হয়তো’ আর ‘কিংবা’র ফাঁদে পড়ে অহরহই স্যার ডেকে চলি তাঁকে।

তাই, বলি আবার, হয়তো, মেয়েটা ততোক্ষণে এক পা দু পা হেঁটে চলেছে। নিত্য দিনের সেই গতি নেই আজ পায়ে, কিন্তু ভেতরে গন্তব্যে পৌছুবার ভীষণ তাড়া। হাতের রেখার মতো এই পথ চেনা তার। তা আলোভরা জোছনায় কী নিকষ অন্ধকারে। শহর থেকে ভাঁটপুরে নেমে কাঁচা মাটির পথ ধরে দুই গ্রাম ফেলে গেলে, পরের গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে তাদের ছোট্ট এক ঘরের বাড়ি। এক চিলতে উঠোন। বাড়ি তো নয়, একটা দ্বীপের মতো জায়গা। মুল গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন একটু খাস জমিতে তার প্রায়ান্ধ বৃদ্ধ বাবার বদৌলতে সরকার থেকে পাওয়া করুণার এই আশ্রায়ন ভুমি। তবু এতদিনের চেনা জানায় এই মাটিটুকুই খুব নিজের হয়ে গেলো বড্ড তাড়াতাড়ি। এখানে ফেরার জন্যই ফি সন্ধ্যায় এক অদ্ভুত তাড়া আসে তাই ভেতরে। এখানে এসে দাঁড়ালেই তারও মনে পড়ে যায় বাড়ি একটা ছিলো বটে তাদেরও।

আর এই খানে এসে মামুন হুসাইনের ‘কতিপয় যুদ্ধাপরাধ অন্বেষণার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি অথবা আগাম ফলাফল’ গল্পের সেই মেয়েটি আর তার বাবার কথা হামলে পড়ে আমাদের মগজে। এই বাংলাদেশের আরও এক প্রান্তে তার অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বাবার একটা ঝলমলে সংসার ছিলো। বাবার সংসারই বলতে হয়। মা তো সেই কবে তাদের তিন ভাই বোন আর সমস্ত সংসারটাকে বাবার কাছে রেখে, ক্যান্সার পোষে পোষে মারা গেলেন।


মৃত্যুর গল্পে দীর্ঘ মিছিল।

বাবা আর পারছিলেন না। সেও পারছিলো কি? তার ঝকঝকে তরুন ভাইটাকে নিয়ে গেলো। পান পাতার মতো সবুজ বোনটিকে নিয়ে গেলো অন্যেরা আরেকদিন। সে লুকিয়ে গেলো কেমন করে জানি, বাড়ির পেছনের পুকুরে ডুবে থাকতে পারলো। মধ্য পউষের হিম হিম জলে নেমে সে শুধু ঘামতে থাকলো। সে জানল না, কী হচ্ছে ভেতর বাড়িতে। বোনের আর্তনাদ মুখে গুজে রাখা গামছায় আটকে থেকে এক গোঙানির আওয়াজ তুলতে পারল কেবল। ভাইকে নিয়েছিলো রাষ্ট্রীয় পোশাক। কী বলবো! আমার ভাই কোন দল করতো না। কখনো মিছিলে যায় নি। হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার তো প্রশ্নই আসে না। এতো এতো নিরীহ ভাইটি ছিলো আমার! আপনার ভাই তো আকমল হত্যা মামলার ২৬ নং আসামি ছিলো বলে র‍্যাব দাবি করছে? মেয়েটি চারপাশে তাকায়। আকাশভর্তি এতো অন্ধকার কেন আজ। চোখের জল ভিজে শুকিয়ে, এক আধটু পৌছেছে মুখে। কী নোনতা সাধ এর! বাবা বলছিল না কিছু। তবে বাবা একদিন গল্প বলছিলো। বলতে বলতে বসে পড়েছিলো হঠাত! বসে পড়লে কেন বাবা? অমন মেয়ের গল্প বলতে হলে বসে পড়তেই হয় দুই দণ্ড। স্কুল শিক্ষকের মেয়ে ছিলো সে। যেমন তেমন তার রূপ, গানের গলা ছিলো অসাধারন। মেয়েটা নিজেই লিখতে চাইতো গান, আর সুরও দিতো। পড়াশোনায় ভালো। সংসারী। লক্ষ্মী মেয়ে।

বাআআআবা ! তুমি আবার বানিয়ে বানিয়ে বলছো গল্প। মেয়েটা আহ্লাদিত হয়ে পড়ে। তার চোখের ভেতর আরও আরও সব গল্পের মাল মসলা জমা পড়ে। হঠাত হঠাত তার মনে পড়ে যায়, ইচ্ছা জাগে, আবার সে গান শুরু করে দিক। ‘আকাশ আকাশ ডাকছো কেবল/ আকাশ তোমার একলা নাকি?/ আকাশ জুড়ে মেঘের বাড়ি/ সেই বাড়িতে আমিও থাকি’ এমন করে সে লিখতে শুরু করেছিলো। তার স্কুল শিক্ষক বাবা সেই ফুর্তিতে একটা পুরো রাত মাদুর পেতে বসে রইলেন উঠোনে। তার দুই মেয়ে আর ছেলে সমেত। পালা করে তারা গাইলো। সমস্বরে গাইলো। আছে দুঃখ আছে মৃত্যু। গান থামলো না। একদল মানুষ হামলে পড়লো। মেয়েটার ভাই বলছিলো, ‘আমি নই। আমি নই। আমি মার্ডার কেসের আসামি হতে যাবো কেন? আমার অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমি চাকুরি করি। আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। এই গ্রামে সবাই আমাদের চেনে। আমার নামে কোথাও কোন মামলা নেই’।

তারা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ছেলেটাকে। বাবা একবার থাকালেন পুত্রের মুখের দিকে। চিরকালের জন্য গায়েব হয়ে যাবার আতংকে তার সারা মুখ নিরক্ত। জন্মের সময় এমন এক মুখ নিয়েই জন্মে ছিলো ছেলেটা। দাই বলছিলো ‘এ ছেলের শরীরে তো রক্ত নাই! এ বাঁচবো কেমনে!’ বাবা দৌড়ে গিয়ে গ্রাম্য ডাক্তার আর মধু নিয়ে এলেন। তার মৃত প্রায় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘একটা রাজকুমার এসেছে, দেখেছো?’ সেই রাজার ছেলেকে আজ অন্য রাজার লোকেরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির বাইরে সরকারি জিপের আলোয় ফিকে হয়ে আছে ঘন গাছ গাছালির ঝোপ আর জমাট অন্ধকার। শুন্য ও শান্ত চোখে বাবা একবার সে দিকে থাকালেন। আলো জ্বেলে জ্বেলে এরা সবাইকে অন্ধকারে পুতে দিচ্ছে কেন! মেয়েরা কাঁদতে চাইছিলো গলা ছেড়ে। নিদেন পক্ষে একবার ভাইটিকে দেখতে চাইলো। এক র‍্যাব সদস্য তখন ঠেলে ঠেলে ভাইটিকে সেই জিপে উঠাচ্ছে। তার টি সার্টের একটি অংশ কেবল চোখে পড়লো দু বোনের। মুখের একটু খানি অংশ, জীবনের শেষ অভিব্যক্তি ধরা পড়লো না তাতে। চিরচেনা মুখটা হারিয়ে গেলো চিরদিনের জন্যে।

তার বোনকে তুলে নিতে এলো আরও কিছুদিন পর। এরা অন্য কেউ। অন্য দলের। তার বাবা তখন ক্ষয়ে যাছেন ক্রমশ। নুয়ে নুয়ে আসছেন। মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙ্গে দিয়ে হুরমুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো ১২/১৪ জনের দল। তাদের আধা পাকা আধা টিনের দেয়ালের ঘর কেঁপে কেঁপে উঠলো। তার শিক্ষক বাবার চোখে চোখ পড়ে গেলো মাংকি মাস্ক পড়া আরও ক’ জোড়া চোখ। বাবা চিনলেন। বাবা বললেন না তবু কিছু। এদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তার চত্রিশ বছরের কর্ম জীবন গেলো। আজ তবু তার মানুষের চোখে তাকাতে ভয় করে। প্রিয় ছাত্রদের চোখে রক্তের মতো লাল উন্মাদনা খেলা করে। শিক্ষক বাবা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, এবার কার পালা। তার ছেলে গেছে। তার কোন মেয়েকে নিয়ে যাবে এরা এইবার? চকিতে তার কলেজ জীবনের বড়ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবি আবুল কালাম আজাদের কথা মনে এলো। ছাত্রেরা কেন এমন করে বারবার শিক্ষকদের বুকের পাঁজর ভাঙ্গতে আসে? আর একই দৃশ্য কেনই বা নির্মিত হয় ঘুরে ঘুরে! বাবা দেখলেন বড় মেয়েটা নেই এখানে। সে পালালো কিভাবে! আর ছোট মেয়েটা পাখির বুকের নিচে হিমকাতর বাচ্চাটার মতো কাঁপতে কাঁপতে বাবার দিকেই আসতে চাইছিলো। একটা কম বয়সী ছেলে আচম্বিতে তার কব্জি ধরে ফেললো। বাবা বললেন , ‘ও কে ছাড়ো তোমরা’। ‘কেন? ভোটের সময় মনে আছিলো না? বারবার আইস্যা বলে যাই নাই, মাস্টার সাব, আপনে অন্তত ওগোর সঙ্গে যাইয়েন না’?

আমি তো কোন দল করি না। তাই বলে ভোট দেবো না ?

‘ভোট তো দিছেন, ভালো কচ্ছেন। এখন মাইয়াটারে দেন। আরেকটা কই গেলো? একটু গান টান শুইন্যা যাই’। মেয়েটার শিক্ষক বাবা, জীবনে ধমক দিতে পারেন নি কাউকে। এই প্রথম, অক্ষম এক ক্রোধ নিয়ে প্রায় গর্জে উঠলেন, ‘পেয়েছো কি তোমরা? ওর হাত ছাড়ো’। পুকুরে ডুবে থাকা, শ্বাস বন্ধ করে থাকা বড় মেয়েটা এই প্রথম ভেতরবাড়ি থেকে কারো গলার আওয়াজ শুনতে পেলো। মাফলার দিয়ে মুখোশ বানানো লোকগুলো হেসে উঠলো সমস্বরে। ‘ধমক দেন কেন, মাস্টার সাব? একটু গান শুনে যাই। এই তুমি কি আপুর মতো গান গাইতে পার?’ মেয়েটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। ভয়ে আতংকে খুন হয়ে যাওয়া ভাইয়ের মতোই তার মুখটাও নিরক্ত হয়ে পড়ে। মেয়েটার বাবা কন্যার আসন্ন নিখোঁজ হবার আলামত দেখে চোখ বুজে ফেলেন। সেই থেকে আর স্পষ্ট দেখতে পান নি কোনদিন।

বেঁচে যাওয়া মেয়েটি অনেক বুঝালো বাবাকে। ‘একটাই পথ আছে বাবা’, আরো এক নিঝুম রাতে ভয় পাওয়া এক গলায় বললো মেয়েটা, ‘চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই’ । তার বাবা নিরুত্তর বসে রইলেন। কিংবা একটা যুতসই উত্তর খোঁজতে খোঁজতে তার শ্বাস কষ্ট বেড়ে গেলো। মেয়েটা ইনহেইলার আনতে গেলে, আর একটা বাদুড় দুরের কোন গাছের ডালে ঝুলে বিচিত্র এক শব্দে কেঁদে উঠলো বলে শুনলেন তিনি। শুনলেন, বিচিত্র এই ডাক অবিকল মানুষের স্বরে বলে চলছে, চল্‌ পালাই পালাই...। মেয়েটা ফিরে এলে কোমল এক কণ্ঠে বললেন, ‘কি করবি ভেবছিস কিছু? বলিস যে অন্য কোথাও যাবি, গিয়ে খাবো কি? আমি তো আর চাকুরি করতে পারবো না। এখানে যাই হোক, অন্তত, মাথা তো গুজে আছি! আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করা...অনেক টাকার মামলা, অনেক ঝাক্কি...নতুন জায়গা!’ বলে বলে বাবার গলা ধরে এলো। মেয়েটা পানি আনার ছল করে চোখ মুছতে গেলো। তবু কান্না থামাতে পারছিলো না।

মেয়েটা পারছিলো না কিছুই। তার ভেতর গান আর সুবর্ণ এক গম খেত মরে পাণ্ডুর হয়ে যাচ্ছিলো। তার বুকের ওমের ভেতর থাকা বোনটিকে হারিয়ে সে আর ঘুমুতে পারছিলো না কোনও রাতেই। তার ভাইয়ের অফিসের ব্যাগ, সেভের ব্লেড, বিছানা পত্তর ছুঁতে ছুঁতে এর মাঝে অনেকবারই সে স্বহননের কথা ভাবতে গিয়ে, শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ বাবার কথা ভেবে ফেলেছে। মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গে ততদিনে আমরা অনেকেই সেই কাহিনী পড়ে ফেলেছি, মধ্য বয়েসী মা এসে কড়জোর করছেন, ‘তোমারা দু’ একজন আমার কাছে এসো বাবারা। আমার মেয়েটা ছোটো, সে পারবে না। সে মারা যাবে’। মেয়েটা সেই রাতে তার পলায়নকে আর মানতে পারে না তখন। আমি পালিয়ে না গেলে আমার বোনটা কি বাঁচতো? আমরা দুই বোন ভাগ করে নিতাম। বোনের ভাগে তখন কম পড়তো না! তার রক্ত ক্ষরণ কম হতো নিশ্চয়য়ই! বোনটা বেঁচে যেত হয়তো। কিংবা আমাদের মা থাকলে কি করতেন? এমনি করেই এসে বলতেন, আমার মেয়েটা কে ছেড়ে দাও বাবারা। তোমরা দু একজন আমার কাছে আসো। কয়েকজন আমার বড় মেয়েটার কাছে যাও। ও খুব ছোটো তো... ও পারবে না...’

এইসব দিনগুলিতে, এই ক্ষত বিক্ষত রাতগুলোতে তবু একবার তার মাথা খুলে গেলো। অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে জেগে উঠে বাবার কানের কাছে মুখ নামিয়ে সে ফিসফিস করে বললো, ‘ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে বাবা’। ঘোলাটে এক জোড়া চোখ তুলে, উৎকর্ণ মেয়েটির বাবা বললেন, ‘ বুঝতে পারছিস, কি বলছিস? একবার ধরা পড়লে কি হবে!’ ‘এই জন্য তো এখান থেকে চলে যেতে চাইছি বাবা’ মেয়েটা শানিত হয়ে, কণ্ঠে দীপ্তি ছড়িয়ে বলে, ‘ আমার উপর ভরসা রাখো’। দীর্ঘ এক বিরতি নিয়ে অপরাধীর মিনতি-স্বরে বাবা বললেন,‘ মা রে, সবচেয়ে বড় কথা, গান গাইবি না তুই আর?!’

বাবা আর মেয়ের যুগল গলায় এইবার ব্যথা হতে লাগলো।

এই রকম সব গল্প লিখে লিখে মামুন হুসাইন, ইমতিয়ার শামীমরা প্রকল্পের সব দরজা জানালা বন্ধ করে রাখলেন। হাত মশকো করার সু্যোগ নিয়ে আমরা যারা ইতিউতি তাকাচ্ছিলাম, মেয়েটা তাদের কথা ভেবে, প্রায়ান্ধ বাবা আর অল্প সল্প কিছু জিনিষ পত্তর নিয়ে সত্যি সত্যি একদিন ভাঁটপুরের দিকের ওই সরকারি আশ্রায়ন প্রকল্পে এক টুকরো বসতি জুটিয়ে নিল।

তারপর সত্যি সত্যি এক সাহসী খেলায়ও অবতীর্ন হয়ে পড়লো তারা দুই পিতা ও কন্যা। এমন সব কৌশল আয়ত্বে নিতে বেশ কিছুদিন লাগে দু’জনেরই। জীবনে অর্জিত মূল্যবোধের শেকড়ে কুড়াল বসাবার কসরতে জাতি গঠনে কারিগর বাবার অস্বস্থি হয় বেশি। মেয়ের জেদের কাছে তবু হার। এ এমন হার! এ এমন পরাজয়। মা রে; বাবা তুইও শোন, দেখ বেঁচে থাকটা যতটা বাইরে , ভেতরে তারচেয়ে বেশী। ভেতরেই জয়ী থাকতে হয়। জীবিত থাকতে হয়। ভেতরে তোরা মরে যাইসনা কোনদিন। লোকে তবে বলবে, মাস্টরের নিজের পোলাপানরে দ্যাখো! পরের পোলা মানুষ করবো ক্যামনে?’ মাদুর পাতা উঠোন। একটু দূরে শেফালির একটা গাছে ফুল এসেছে...কাছেই রজনীগন্ধার একটা ঝোপ, মিলিত সেই মৌতাতের ভেতর তারা চারটা মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুদ্ধতার ক্রম পাঠ করছিলো___ বাবার চোখে, আলোহীন দুই চোখে এমন দৃশ্যের অবতারনা হলে, মেয়েটার রাগ বাড়ে, ‘ এতোদিন ধরে বলেছি। এই একটা দিন। এই একটা দিন কেবল তুমি চালিয়ে নিয়ে যাও। আর তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি সামলে নেবো। তবু... তবু তুমি_’ মেয়েটার কথা শেষ হয় না। বাবা সত্যি সামলে নিয়ে নিজেকে, উঠে দাঁড়িয়ে বলেন , ‘চল্‌ , আজই যাই’

‘ঠিক ঠাক মতো সব বলতে পারবে তো?’
‘হুম, পারবো।’

যতোটা নিখুঁত হলে ভালো হতো, তা হয় না ঠিক, কিন্তু অভিনয় তারা দু’জনেই উৎরে যায়। বাব বলেন, ‘ দেখুন, আমি রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক। চোখে খুব একটা ভালো দেখি না । এই মেয়েটিই আমার সম্বল। ঘর বাড়ি যা ছিলো, সব নদী নিয়ে নিছে। এই জেলায় আছি তো অনেকদিন। এই দেখেন , চেয়ারম্যানের একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। মেয়েটার একটা চাকুরী হলে, আমরা বাঁচতে পারি আর কি...’

___ ‘কিন্তু উনি তো...?’

___ ‘ না না কথা বলতে না পারলে কি হবে, আমার মেয়েটা লেখাপড়া জানে। নদী নিয়ে নিলো সব। তাই সার্টিফিকেট, মার্কশিট নাই... তাছাড়া এই পোষ্টে তো আপনাদের কম্পোজারই চাই। আমার মেয়ে ভালো টাইপ করতে পারে’।

বোবা মেয়েটা চোখের ভেতর তখন সমস্ত শক্তি এনে, অসহায়ত্ব জড়ো করে তাকায়। প্রশ্নকর্তা পিতা ও তার বোবা কন্যা দু’ জনকেই দেখেন। ‘ কি বলবো...! আপনি শিক্ষক মানুষ, দেখি কি করতে পারি’ বলে ঢোক গিলে, শ্বাস নিতে নিতে হঠাতই কি এক আবিস্কারের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে যায় তার মলিন মুখমণ্ডল। বললেন, ‘ এক কাজ করেন না কেন, উনার এপ্লিকেশনটা আপনারা প্রতিবন্ধী কোঠায় জমা দেন। চাকুরীটা পেয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশী’।

ফিরতি পথে পিতা ও কন্যা উত্তীর্ণ ছাত্রের মতো হাস্যোজ্বল চোখ মুখ নিয়ে তাকালো পরষ্পরের দিকে। ভেতরে ছলছল নদীর শব্দ তখন শোনা যাচ্ছিল না।

মেয়েটার চাকুরী হয়ে গেলো সত্যি। জেলা শিক্ষা অফিসে সরকারি নথি পত্রের কম্পোজ করতে করতে, বেসরকারী ক্লান্তিতে ডুবে ডুবে, কথা না বলতে থাকার মায়, বোবা হয়ে থাকার এক আশ্চর্য কৌশলই সে রপ্ত করে নিতে পারলো। সকালে অফিসে পৌছুতে না পৌছুতেই ফাইল-পত্রের স্তুপ জমা হয়ে যায় টেবিলে। এই গুলো কম্পোজ করতে করতেই অফিস আওয়ার শেষ। ফলে কখনোই খুব একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় নি তার এই স্বপ্রণোদিত বাকবন্ধকতা নিয়ে। এমন কি বাড়িতেও, অনায়াস এক ভঙ্গিমায়, হাতের স্পর্শে, ইংগিতে বাবার সঙ্গে দিব্যি চালিয়ে নিতে থাকলো সংসার কর্ম।


কাহিনী এখানেই শেষ। অথবা কাহিনীর শেষ বলে কিছু নেই। সব কাহিনীর শেষেই তাই নতুন এক কাহিনী জন্মায়। তাদের হয়তো পড়া নেই, তবু, শহীদুল জহিরের ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’র কৌশল ধরে এই জনপদের যুবকেরা তখন নতুন এক খেলায় মেতে উঠে। কিংবা তারা হয়তো নিজেরাই নতুন এক খেলা আবিস্কার করে নেয়। তারা পালা করে প্রত্যেক সন্ধ্যায় একেকজন মেয়েটার সঙ্গে একই মিশুক/বেবি/ সিএনজি তে চেপে বসতে থাকে। সারা পথ, ঝাকুনিতে, অন্ধকারে ডান হাতটা মেয়েটার ডান বগলের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে, কিংবা বাঁ দিকের জন বাঁ হাতটা বাম হাতের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে অবিরাম পিষ্ট করে যেতে তাকে মেয়েটাকে। এই খেলার নতুন কোন নাম তারা দিতে পারে নি। কিন্ত শহরের যে জায়গা থেকে ভাঁটপুরের মিশুক/বেবি/ সিএনজিগুলো ছাড়ে, অফিস ভাঙার নির্দিষ্ট একটা সময়ে সেই জায়গা যুবকদের ভীড় বাড়তেই থাকে ক্রমান্বয়ে। সবাই তো আর একসঙ্গে উঠতে পারে না। যেদিন যার সৌভাগ্য ধরা দেয়, মেয়েটির পাশের সিটে বসবার সুযোগ আসে, সে সেদিন অন্যদের দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর একটা হাসি দিয়ে দুর্ভাগ্যবানদের পিত্তের জ্বালা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে ভাঁটপুরে সেই বিলবোর্ডের নিচে এসে নামে। নেমে বিড়ি সিগারেট ফুঁকে । কিংবা পরের মিশুক/বেবি/ সিএনজিতে করে আসা ইয়ার দোস্তদের জন্য অপেক্ষা করে। তার এসে ভাঁটপুরে পৌছালে সান্ত্বনা দেয়, ‘কাইলকে তুই চান্স পাই বি। কাইল আমি নাই। আব্বার লগে নবীগঞ্জ যাইতে অয়। কাইলকে পাপলুও যাইতো না। হে হালার জ্বর আইছে...’

আর মেয়েটা, প্রতি সন্ধায়ই, নেমে দ্রুত হেঁটে বাবার কাছে পৌছে যাবার ইচ্ছায় পা বাড়ালেই তার অবাধ্য চোখ বিলবোর্ডবাসিনী মডেল মেয়েটার সুডৌল বুকে গিয়ে আটকায়। তখন হয়তো তার নিজের বক্ষ জোড়ার দিকে সে আলগোছে একবার তাকায়। কিংবা বাড়ি পৌছে শয্যা নিলে মথিত বুকে খুব ব্যথা করলে, সকল লজ্জা ভুলে নিজের বুকে কম দামী একটা বাম মালিশ করে চলে। আজতক এমনই চলছিলো। এই পিষ্ট হওয়া, এই মথিত হওয়াটাকে সে তার চাকুরীর কি মায়, দিনযাপনের অংশ হিসেবেই মেনে নিয়েছিলো।

আজকেই বাঁধল বিপত্তি। পাশের ছেলেটা, তারচেয়েও কম বয়সী ছেলেটা, যখন নতুন কিছু করার উত্তেজনায় তার বাম স্তনে নতুন ব্লেড দিয়ে একটা পোঁচ বসিয়ে দিল। সিএনজিটা তখন মাত্রই শহর ছেড়ে অন্ধকার পথে ঢুকেছে। সে টের পেলো রক্তে তার সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে। গোঙানীর মতো করে সে কেবল অদ্ভুত এক শব্দ তুললো মুখে। ছেলেটা ব্লেড ধরা হাত সরিয়ে নিলো তৎক্ষণাৎ। বিজয়ীর হাসিতে তার মুখ তখনো ঝলমলে, ক্রর। মেয়েটা আগুন চোখে, ঘৃণাজর্জর দৃষ্টিতে দ্বিতীয়বার তাকালো। ছেলেটা একটু সরে বসলো। আর ড্রাইভার কে বলে পরের মোড়ে নেমে গেলো আচমকা । মেয়েটা তার বাম বাহু দিয়ে ক্ষত স্থানটা চেপে রাখলো যতোটা পারা যায়। তার ডানা বেয়ে, হাতের গাঁ বেয়ে, মধ্যমা দিয়ে রক্তের একটা চিকন ধারা তবু নিচেই নামতে থাকলো।

একটা হুলস্থুল হয়তো বাঁধানো যেতো। ছেলেটা নেমে যাবার আগেই, বাবাকে যেমন হাতের স্পর্শে বুঝিয়ে দেয় অনেক কিছু; ড্রাইভার বাঁ অন্যান্য সহযাত্রীদেরও তেমন কিছু সংকেত পৌছানো যেতো হয়তো। কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস তখন আর সেই তুঙ্গে নেই। চকিতে তার মস্তিস্ক জেগে উঠলো, সময় মতোই জাগলো, যদি নিখুত না হয় অভিনয়!? বাবা তো নিজের জন, বাইরের মানুষ কি আর তেমন করে ভুলচুক মাফ করে দেবে? এক লহমায় জানাজানি হয়ে যাবে তার সকল ছলের কথা। কি সব্বোনাশ! সে এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে দিয়ে স্বীয় অভিনয়ের দিকে মনোযোগ ধরে রাখতে চাইলো কেবল। এক মুহুর্তের ভুলেই অনেক কিছু ঘটে যাতে পারে। এক বার মুখ ফসকে কান্নার সঙ্গে একটা শব্দ বেরুলেই তার এতোদিনের প্রশিক্ষন বৃথা হয়ে যেতে পারে।

বড় কথা, তার চাকুরী চলে যেতে পারে!


লেখক পরিচিতি
সুমন সুপান্থ
কবি। গল্পকার



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ