শামসুজ্জামান হীরার গল্প : দিঘির জলে পুরনো চাঁদের শব


দিঘির ঘাট শ্যাওলা জমে গাঢ় সবুজ। গা থেকে খুলে খুলে গেছে ইট। বসবার জয়াগাটা কাত হয়ে আদ্দেক পানির ভেতর মুখ গুঁজে আছে। পারদের মত নিস্তরঙ্গ পানিতে রাতজাগা চাঁদের ছায়া পড়ে শুয়ে আছে---যেন ব্যবচ্ছেদের অপেক্ষায় হিমশীতল শব। রাতের নিরন্ধ্র জমিনে জোনাকিরা দল-বেঁধে পিঙ্গলবর্ণের বিচিত্র নক্সা তুলে চলেছে অনবরত। শহিদ কী-করে এমন নিশুতি রাতে এতখানি পথ পাড়ি দিয়ে এ-বাড়িতে এল, জানে না। জানে না অনেক কিছুই, জানতেও চায় না। জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে, কেন ঘটে কারণ জানা যায় না। সব ঘটনার হয়ত কারণ থাকেও না। শহিদ, জীবনের সবক্ষেত্রে ব্যর্থ এক লোক, জানে না কী-ভাবে ছত্রিশ বছর পর এমন নিশুতি রাতে এখানে এসে পৌঁছুল।


নিভৃতপল্লী কেলিশহরের এ-বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল শহিদের গেরিলাদলটি, একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের কোনও-এক সময়। দিন-তারিখ মনে নেই। মনে নেই; মনে থাকে না ওর অনেক কিছুই। বয়স এখন ওর বাষট্টি। বাষট্টি বছর বয়সেও অনেকে যথেষ্ট শক্ত-সবল থাকে, টনটনে থাকে স্মরণশক্তি, শহিদের নেই। চোখে ঘোলা দেখে। এক কিলোমিটার হাঁটতেই হাঁপিয়ে ওঠে। ডায়াবেটিক রোগী।

সন্ধ্যা গড়ালে এই দিঘির পাড়ে বসে গল্প করত গেরিলা দলটি। ভারত থেকে যুদ্ধপ্রশিক্ষণ নিয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ওরা কেলিশহরের এই বাড়িটিতে এসে উঠেছিল বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে ধস্ত-শরীরকে চাঙা করতে আর সেই-সঙ্গে শক্ত একটা ঘাঁটি কী-করে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে ভাবতে।

বিশাল বাড়িটিতে বাসিন্দা বলতে সাধন, ওর স্ত্রী, ছোট্ট একছেলে আর বিধবা মা। দুটো মাটির ঘর। পাশাপাশি বড়সড়। দোতলা। চাটগাঁর পল্লীতে মাটির দোতলা ঘর, ওপরে টিনের চাল, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়ে। দোতলায় থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল দলের আটাশজন গেরিলার। কাঠের পাটাতনের ওপর দোতলায় মাথা তুলে দাঁড়ানো কঠিন; জানালা তো দূরের কথা, ফাঁক-ফোকরও নেই যা-দিয়ে সামান্য বাতাস খেলা করতে পারে। থাকবে কেন? দোতলা তো বসবাসের জন্য নয়, গুদামের কাজে ব্যবহারের জন্য। সারাদিন আটাশটি ময়দার গোলা অতিকায় তন্দুরে পাউরুটি হবার অপেক্ষায় থাকত। সে কী দুর্ভোগ! ঘরের বাইরে বেরোনো, দিনের বেলায়, যখন বাড়ির পাশ দিয়ে পায়ে-চলা পথ ধরে লোকেরা যায় গঞ্জের বাজারে, বিপজ্জনক তো বটেই। খুব বেশি হলে মাইল তিনেক দূরে পাকবাহিনীর ক্যাম্প। না, এভাবে বেশিদিন থাকা চলে না। নিরাপদ আশ্রয় দরকার, সেই-সঙ্গে দরকার খোলা বাতাসে গা-ছেড়ে চলাফেরা, প্রশিক্ষণ ঝালাই করা এবং শত্রুর মোকাবেলা করার জন্যে ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান আঁটা।

কেলিশহরের অদূরেই ছোট-ছোট পাহাড়ের সারি, লোকে বলে করলডেঙ্গা পাহাড়। পায়ে-হেঁটে দু-ঘন্টার পথ। দু-পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সরু-পথে কিছুদূরে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে বেশ উঁচু এক পাহাড়। বেছে নেয়া হল ওটাকেই। চাঁদির গাছপালা, ঝোপঝাড় সাফ করে ওখানে গড়ে তোলা হল বড়সড় ব্যারাক। ঘর তৈরির বেশির-ভাগ কাঁচামাল পাওয়া গেল পাহাড়েই। খুঁটির জন্য সেগুনগাছ, ছাউনির জন্য বাঁশ আর শণ। গাঁয়ের বিশ্বস্ত ঘরামিরা গায়ে খেটে বিনিপয়সায় তুলে দিল ঘর---শোবার জন্য মাচা।

উঁচু টিলার মাথা, যেখানে ব্যারাক, তা-থেকে কিছুটা নিচে আরেকটি টিলার মাথায় সমতল স্থান। ও-জায়গাটায় হত প্রশিক্ষণ আর সমাবেশ। গিরিখাত বেয়ে চপলা বালিকার মত নেচে-নেচে প্রবাহিত ঝরনা, স্থানীয়রা যাকে বলে ছড়া, তার অফুরন্ত স্বচ্ছ পানিতে পিপাসা মেটানো থেকে ধোয়ামোছা এমনকি গোসলের কাজ সারা হত অনায়াসে। পাহাড়ে স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে না-তোলা পর্যন্ত সাধন দত্তের বাড়িতেই থাকা। সাধনের মা-র মধ্যে প্রথম প্রথম দ্বিধাদ্বন্দ্ব-সংকোচ, কিছুটা-বা বিরক্তির ভাব দেখা গেলেও খুব বেশিদিন লাগে না তা কেটে যেতে। পাড়াগাঁর পৌঢ়া বিধবা, সংস্কার থাকাটাই স্বাভাবিক। সাধন অগ্রসর চিন্তার মানুষ---কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী। আর সে-কারণেই বেছে নেওয়া ওর বাড়ি।


২.
দিঘির জলে চাঁদের নিস্পন্দ শব। বাড়িটার চারপাশে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছগাছালি। মাটির ঘর দুটো নেই। সেখানে এখন সেমিপাকা টিনের চৌচালা। উঠোনের পুব-কোণে সেই হিজলগাছটি এখনও তেমনি আছে---গায়ে-গতরে বেড়েছে এই যা। ঝরে-পড়া হিজল-ফুলে গাছতলা ছেয়ে গেছে---গোল করে বিছোনো যেন গোলাপি গালিচা। ওখানেই গুটিঁসুটি বসে আছে সাদা শাড়ি-পড়া কে যেন। ঝিঁঝিঁর তীক্ষ্ণ সুর রাত্রির কালো গায়ে সিরসির্ কাঁপন তুলে চলেছে। অতিক্ষুদ্র এই কীটগুলোর গলায় কী শক্তি---শরীরের তুলনায় যে-কোনও প্রাণীর চেয়ে উচ্চরব তুলতে সক্ষম! কিন্তু হাঁটুমুড়ে মাথা নুইয়ে বসে-থাকা মেয়েটি কে?

- ক্যান আছ বাআজি...? গম আছ না? মনে হয় বহুদূর থেকে ফাঁপা ফাঁপা কেমন এক শব্দের স্রোত কানে এসে আছড়ে পড়ে শহিদের।

- কে আপনি? পাশ ফিরে কিছুটা শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করে শহিদ।

- চিনিন ন পার? আঁ’ই... আঁ’ই তোঁআর...।

চিনে ফেলে শহিদ, সাধনের মা, যাকে ও মাসিমা বলে ডাকত। ছত্রিশ বছরে মাসিমা একটুও বদলাননি! সেই চিকন কালো-পেড়ে ধবধবে ধুতি---সেই দোহারা গড়ন, ফরসা মায়া-মায়া মুখ!

- কতদিন ন দেখি তোঁআরে... খুব পরান পোড়ে...।

- আমারও তো খুব প্রাণ কাঁদে আপনার জন্য---সাধনদার মুখে সব শুনেছি; হাহ্ ...।

- তোআঁরা চলি যঅনর পর মিলিটারি আইস্যেল। ওইযে ওডে মেডির দোতালা ঘর দুইয়ান আছিলর---পুড়ি দিয়ে। তারপর--- তারপর আহা...।

ঝিঁঝিঁর ডাক ঠেলে ফোঁপানোর শব্দ এসে কানে লাগে শহিদের। হিজলগাছতলা থেকেই শব্দটা আসছে।

- কে কাঁদে ওখানে, মাসিমা?

- কন আবার, মিনতি... তোআঁরার মিনতিদি: মাসিমার নির্লিপ্ত জবাব।

মিনতি, সাধনের একমাত্র বোন, দক্ষ কারিগরের হাতে-গড়া লক্ষ্মীপ্রতিমা যেন। স্বামী শহরের এক স্কুলের মাস্টার। বিয়ে হয়েছে বছর খানেক হল। শহিদরা যখন ওদের বাড়িতে, শেষের দিকে কদিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল মিনতি। বয়সে বড় না-হলেও শহিদ ওকে দিদি বলেই ডাকত। কী-যে সুরেলা ছিল ওর গলা! আড়াল থেকে ওর গাওয়া-গান শুনলে কে বলবে উৎপলা নয়! মোটা লাল-পেড়ে শাড়ি, হাতে শাঁখার চুড়ি, কপালে লাল-টিপ আর সিঁথিতে চওড়া-করে-টানা সিঁদুর---মিনতি হিজলতলায় তুলসি-বেদীতে যখন সন্ধ্যা-আরতি করত; মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত শহিদ। দেখতে দেখতেই ওর সঙ্গে ভাব জমে ওঠে শহিদের। দিদি-ডাকে লজ্জা পেত, বলত : আমি কি আপনার বড় যে দিদি ডাকতে হবে?

স্মিত হেসে শহিদ বলত : কী ডাকব তাহলে? মাসিমার মেয়ে তো দিদিই, কাকিমা নয়...

- ও বুক্ লে বুক্! ঠিক আছে দিদি-ই সই, কাকিমা হতে চাই না। অতো বুড়ি এখনও হই নাই ফাঁল্লার... !

অন্য যোদ্ধাদের সঙ্গেও মিনতির সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওর চোখে যে-ভবিষ্যৎ হাতছানি দেয়, সে-ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবার লোকদের ও যেন একটু বেশি মাত্রায়ই ভালবেসে ফেলে। দাদার কাছেও অনেক শুনেছে ও কমিউনিস্টদের কথা।

গোড়া সনাতন ধর্মচারিণী মাসিমার মধ্যেও অবিশ্বাস্য সব পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। হেঁসেলে, এমনকি খাবারঘরে বিধর্মী কেউ ঢুকলে গোবরের প্রলেপ দিয়ে শুদ্ধ না-করা পর্যন্ত যে মহিলা স্বস্তি পেতেন না, তিনি কিনা হপ্তা না-যেতেই শহিদকে সঙ্গে না-নিয়ে মুখে অন্ন তুলতেন না। কোনও কোনও দিন ঘরে ফিরতে শহিদের দেরি হত, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসত, অভুক্তই থাকতেন তিনি। জোরাজুরি করলে ওই একই কথা তাঁর : ওই পোআডারে অঙ্গে ন লই আঁ’ই খাইন ন পারি।


৩. 

পাহাড়ে-তৈরি ঘাঁটিটি দেখতে দেখতেই ছিমছাম। নিজেরাই পাহাড়ের গা কেটে তাক্ তাক্ সিঁড়ি করে নেয়। চে গেভারা কি বলিভিয়ার গহিন অরণ্যে এমনই ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন? শহিদের ভেতর চে জন্মাতে থাকে। সকালে ব্যারাক থেকে চের মত ক্যাপ পরে, কাঁধে স্টেনগান ঝুলিয়ে পাহাড়ের গা-কাটা সিঁড়ি ধরে যখন নিচে নামে তখন নিজেকে ওর সত্যি চে মনে হয়। রক্তিম সূর্যের মাঝে সোনালি মানচিত্র-খচিত জাতীয় পতাকার পাশে কাস্তে-হাতুড়ি-আঁকা পার্টির লাল ঝাণ্ডা ধীরে ধীরে উত্তোলিত হত, গলাছেড়ে গাইতো ওরা জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা...’ ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক, ‘জাগো জাগো সর্বহারা...’। তারপর কখনও জনযুদ্ধের রাজনৈতিক তাৎপর্যের ওপর আলোচনা; কখনও বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে কথাবার্তা; কখনও-বা অপারেশনের পরিকল্পনা।

- হায়েনা আর শেয়াল দু-জাতকেই নির্মূল করতে হবে। শেয়ালগুলো হায়েনাদের পথ দেখিয়ে লেলিয়ে দেয় মুক্তিকামী জনতার ওপর। ওই হারামজাদা দালালগুলো না থাকলে দিশা পেত বেজম্মা পাক-হায়েনারা? ভরাট কণ্ঠে বলে শহিদ।

- এক্কেবারে রাইট কথা। হেইয়া হাত মক্সো করনের লাইগ্যা পয়লা পেরথমে দালাল-নিধন শুরু করা যাউক: বলে কুদ্দুস, রেল-শ্রমিক-নেতা। বাড়ি বরিশাল, যুদ্ধ শুরুর সময় চাটগাঁয় থাকায় আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার।

- কাজ শুরু করার আগে একটা লিস্ট করা দরকার। ছোটখাট বিভ্রান্ত বিপথগামীরা যেন গুরুদণ্ড না পায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পার্টি থেকে তো এ-ব্যাপারে গাইডলাইন দেওয়াই আছে। যারা নারীধর্ষণ, আগুন লাগানো, হত্যা এসব কাজে নিজেরা জড়িত, পাকসেনাদের সহযোগিতা করছে তাদেরকে হালাক্... : বলে শহিদ।

- আল-বদর, আল-শামস্ আর রাজাকার বাহিনীর লোকদের ব্যাপারে পার্টির কী নির্দেশ? জানতে চায় প্রতাপ।

- ওরা সুসংগঠিত রাজনৈতিক ঘাতক। দেখামাত্র খতম: বলে শহিদ।

- তালিকা-টালিকা বুঝি না। যুদ্ধে অত বাছবিচার চলে না। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা তাদেরকেই খতম করতে হবে। বীজ রাখা চলবে না, হুঁ : উত্তেজিত প্রতাপ কড়া ভাষায় বলে চলে: পিশাচের বীজ থাকলে তা থেকে আবার পিশাচ জন্মাবে।

- বীজ কি শুধুই ব্যক্তি? চেতনার দিকটাকে কিন্তু আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না তেমন। শুধু শত্রুকে শারীরিকভাবে নির্মূল করার লড়াই-ই কি এটা? যে-স্বদেশ পাবার জন্যে যুদ্ধ করছি তার রূপটা কী হবে, কেবল পৃথক একটা ভূখণ্ড ? খণ্ডিত পাকিস্তান? নাকি অন্য কোনও কিছু? কী হল, চুপ কেন, বলুন? প্রতাপকে লক্ষ করে প্রশ্ন শহিদের।

- আগে স্বাধীনতা, তারপর চেতনা, রাষ্ট্রের চেহারা। বাচ্চার জন্ম তো হোক আগে, চেহারা আর চরিত্র-বিচার করা যাবে পরে: বলে প্রতাপ।

হেসে ফেলে শহিদ : তর্কে আপনাদের সাথে পারা কঠিন। বিকলাঙ্গ বাচ্চা কারো কাম্য কি ? তারপরও আমার মনে হয়, দুটো কাজই সমান গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন স্বদেশের স্বরূপ কী হবে তা যদি স্পষ্ট না থাকে চোখের সামনে, দেখা যাবে আজকে যারা মুক্তিযোদ্ধা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের কেউ-কেউ গাঁটছড়া বাঁধছে পরাজিত শত্রুদের সাথে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে পুঁজি করে পাকিস্তানি কায়দায় গড়ে তুলছে লুটেরা বাঙালি ধনিক-বণিকদের শোষণের উর্বরক্ষেত্র। একসময় বলা হবে, এটা ছিল ভাইয়ে ভাইয়ে হিস্যা নিয়ে নেহাত গণ্ডগোল---ব্যস্ । আমরা তো সে-ভাবে দেখি না, মুক্তিযুদ্ধকে মনে করি শ্রেণিসংগ্রামের একটা বিশেষ রূপ হিসেবে; যে-চেতনাকে বুকে নিয়ে লড়াই করছি, চাই তার সফল বাস্তবায়ন। কথাগুলো তো ট্রেনিঙের সময় বহুবার বলা হয়েছে; এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন ? থাক, কথা অনেক হল, এখন আসল কথায় আসা যাক। দীর্ঘ বক্তৃতার পর দম নেয় শহিদ ।

নিচে কার যেন পায়ের ভারি থপ্ থপ্ শব্দ। ওপরের দিকেই আসছে। সবাই চুপ। এই অবেলায় কে আসছে! ভয়ের যদিও কিছু নেই; পাহাড়ে প্রবেশের মুখগুলোতে সান্ত্রি থাকে, অপরিচিত কারও পক্ষে গোপন এই ঘাঁটিতে ঢোকার সুযোগ নেই। কাছে আসতেই চেনা যায়, জগদীশ। মাথায় বিরাট এক বস্তা। ঘেমে রীতিমত নেয়ে উঠেছে। মাথা থেকে বস্তা নামিয়ে বলে: ইঁচা শুঁটকি...। বস্তাভর্তি ইঁচা শুঁটকি। কেলিশহর গ্রামের বাসিন্দারা চাঁদা তুলে ওদের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান দেয়। কাজটা চলে রাতের বেলায়। অসময়ে জগদীশের আগমন সবার মনেই প্রশ্নের জন্ম দেয়। ওর চোখে-মুখেও আতঙ্ক আর বিষাদের ছাপ।

- কী ব্যাপার জগদা, খারাপ কোনও খবর? শহিদের প্রশ্ন।

- অলিদ্যা পাশর গ্রামর হিন্দু বাড়িঘর ব্যাক পুড়ি দিয়ে। আঁরা’র পক্ষর মুসলমান বাড়িঅ। বাঁইচ্যে যে উদা বড়ুয়ারা, চালাকি গরি ইতারা নিজেরারে চাইনিজ বুড্ডিস কয়---মিলিটারি হিতারারে ন ধরে। সুন্দর মাইয়া ঝিউন পাইয়ে তুলি লই গেইয়ে... : কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে মাঝবয়সী জগদীশ। গামছা দিয়ে মুখ আর শরীরের ঘাম মোছে।

ওয়ালিদ, হাটহাজারী বাড়ি, বিত্তশালী পরিবারের সন্তান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হবার পরপরই সংগঠিত করতে থাকে আলবদর-বাহিনী। জামাতের ছাত্রফ্রন্ট ইসলামী ছাত্র সঙ্ঘের ও চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি। দীর্ঘদেহ, গৌরবর্ণ, গ্রীক ভাস্কর্যের অবিকল প্রতিকৃতি এই যুবকটিকে দেখে কে বলবে ওর ভেতরে বাস করে ভয়াবহ এক পশু!

- ওয়ালিদ এখন কোথায়? ধলঘাট গ্রামেই আছে? জিজ্ঞেস করে উদয়ন নাগ, গেরিলা-ব্যান্ডের ডেপুটি লিডার।

- ন। শহরত্ থাকে । জেলা বদরবাহিনীর বড় নেতা। যেত্তে যিঅৎ মনে যাইতো কয়, যায় : বলে জগদীশ।

- এদিকে এলে থাকে কোথায়? ওঠে কার বাড়ি? জানতে চায় শহিদ।

- মজিদ চৌধুরীর বাড়িত। ইতে বদরবাহিনীর থানা প্রধান।

- রাত কাটায় কখনও?

- নয় ফাঁল্লার। মজিদ্যা নিজেও রাতিয়া গরত ন থায়।

- ওয়ালিদ রাতে থাকলে খবর দেবেন, ওয়ালিদ মজিদ দুটোকেই এক সাথে ধরা যাবে : বলে শহিদ।

বেলা ভালই হয়েছে। খাবারের ডাক পড়ে। সবাই নিচে নামতে থাকে। খাবার বলতে মোটা আতপ চালের ভাত, ফেনুয়ার ডাল, ইঁচা শুঁটকির ঠ্যালঠেলে ঝোল। ওতেই অমৃতের স্বাদ!


৪.

যত শিগগির সম্ভব বন্ধ করতে হবে ওয়ালিদের দৌরাত্ম্য। এভাবে চলতে থাকলে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে। ওদের সাপ্লাই লাইনও বন্ধ হবে সেই সঙ্গে। কদিন বাদেই খবর দিয়ে যায় জগদীশ। সন্ধ্যার পরও ওয়ালিদকে দেখা গেছে মজিদের বাড়িতে। রাত কাটানোর সম্ভাবনাই বেশি।

ঝানু এবং ক্ষিপ্র জনাপনেরো গেরিলাকে বেছে নেয় শহিদ। গভীর রাতে পৌঁছে যায় মজিদের বাড়ি। বেড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে ওরা চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে বাড়িটিকে। তিনজন এগিয়ে গিয়ে কড়া নাড়ে দরজার। কড়া নাড়ে বারবার। কোনও সাড়া নেই। ধারে কাছেই কোথাও এক শেয়াল ডেকে ওঠে।

- ঘরের দরজা খোলেন; না খুললে ভেঙ্গে ফেলব: চাপা কিন্তু কঠোর কণ্ঠে বলে উদয়ন।

তাও কোনো সাড়া নেই। রাইফেলের বাট দিয়ে দরজায় ঘা দিতে থাকে এবার উদয়ন।

হঠাৎ খুলে যায় দরজা এবং সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নারী-পুরুষের আর্তচিৎকার আর হাউমাউ কান্না।

শহিদ স্বাভাবিক গলায় বলে: চুপ করুন; আপনাদের কোনও ক্ষতি করতে আসিনি। ওয়ালিদ কোথায়? ওয়ালিদকে চাই...।

- অলিদ্যা নাই বাবা: কাঁদতে কাঁদতে কাতর সুরে বলে এক বৃদ্ধা।

- ওয়ালিদ আছে, আমরা জানি আছে...

- অলিদ্যা নাই, আল্লার কসম: বলে বৃদ্ধাটি : অলিদ্যা রাতিয়া চলি গিয়ে গই...।

- মজিদ মিয়া কই?

- মজিদ্যাও নাই: ক্ষীণকণ্ঠে জানায় বৃদ্ধা ।

শহিদ ওর লোক নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকতেই পায়ের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মজিদ। শহিদের পা জড়িয়ে ধরে মরা-কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে; শ্লেষ্মা-জাড়ানো গলায় বলে : আঁ’রে মাফ গরি দন। আঁ’ই অলিদ্যার কতাত ভুল গইজ্জি---আঁ’রে মাফ গরি দন বাআজি...।

- ওয়ালিদ কই? দাঁতে দাঁত ঘষে জিজ্ঞেস করে শহিদ।

- চলি গিয়ে গই.... কুত্তার বাচ্চা চলি গিয়ে গই---আঁ’রে মাফ গরি দন...।

বাড়ির সবগুলো কামরা, যত জায়গা আছে লুকোনোর মত, সব তন্নতন্ন করে তালাশ করে গেরিলারা। নাহ্, কোথাও নেই ওয়ালিদ।

মজিদের দুহাত পিঠমোড়া করে বেঁধে ঘর থেকে বের করে আনে ওরা। পেছন থেকে ভেসে আসতে থাকে কান্নার কোরাস। বাড়ি থেকে পোয়াটেক মাইল দূরে খালের ওপর কাঠের পুল। পুলের কাছে এক মাদারগাছের সঙ্গে মজিদকে বেঁধে ফেলা হয়। ওয়ালিদ ও অন্যান্য দালাল সম্পর্কে তথ্য আদায়ের চেষ্টা চলে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর পুলের ওপর নিয়ে বেয়োনেট চার্জ। নাভি, পেট, বুকের পাঁজরে কাঠঠোকরার মত বেয়োনেট ঠুকরে চলে। থিরথির্ কাঁপতে কাঁপতে কাঠের পুলের পাটাতনে এলিয়ে পড়ে মজিদ। পা দিয়ে ঠেলে খালে ফেলে দেয়া হয় অসাড় দেহখানা ওর খালের কালো জলে।

ওয়ালিদকে না পাওয়াতে মন খারাপ সবারই। সান্ত্বনা এটুকুই, খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে না, মজিদ তো দালাল হিসেবে পয়লা কাতারেরই।

৫.

দিঘির জলে পুরনো চাঁদের শব। ঝোপঝাড় থেকে এখনও ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁর তীক্ষ্ণ রব। দিঘির পাড়ে বাঁশঝাড়ে বাতাসের শিস।

ছত্রিশ বছর আগে সন্ধ্যার পর এই ঘাটে এসে বসত শহিদ ওর সঙ্গীদের নিয়ে। সাধনও সঙ্গ দিত। আবছা অন্ধকার ঠেলে মিনতি ঝালমুড়ি, নাড়ু আরও কত-কী সাজিয়ে নিয়ে আসত ওদের জন্য।

কদিন কাটাবার পর মিনতি স্বামীর কাছে ফিরে যাবার সময় সে-কী কান্না! বিস্মিত শহিদ---কদিনের পরিচয়, এরই মধ্যে এত আবেগ! কান্না-ভেজা গলায় মিনতির সংক্ষিপ্ত সংলাপ: আবার কি দেখা হবে, দাদা?

সান্ত্বনা দিয়েছে শহিদ : দেশ স্বাধীন হলে কত দেখা হবে। দাদাবাবুকেও দেখব। ওনাকে তো দেখাই হয়নি...।

- আমার খুব ভয় হয়, দাদা : ছলছলে ডাগর চোখ মেলে বলেছে মিনতি।

- কিসের ভয়?

- পাকসেনারা নাকি দুনিয়ার সেরা বাহিনী, আপনারা তো ওদের তুলনায়...

- নস্যি, তাই বলতে চাচ্ছেন তো? হেসে ফেলে শহিদ : ওরা দুর্ধর্ষ কথাটা মিথ্যা নয়, কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে ওদের চাইতেও দুর্ধর্ষ বাহিনীকে কাবু করার নজির রয়েছে অনেক। আমাদের কাজ শুধু কাবু করা...।

মিনতির সঙ্গে সেই শেষ দেখা।


নভেম্বরের শেষ দিকে সাধনই খবরটা দেয়। ও তখন পাগলের মত। পাকসেনাদের সঙ্গে নিয়ে ওয়ালিদ ওদের বাড়িতে চড়াও হয়। ওর বৃদ্ধা মা আর ছোট্ট ছেলেটিকে পাখির মতো গুলি করে মারে---মিনতি তখন বাড়িতেই ছিল; ওকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে মিনতির কোনও খোঁজ নেই। গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে সাধন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের চোখ আর্দ্র। দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে ওঠে শহিদ: ওয়ালিদ, হারামির বাচ্চা---তোকে খতম না করা পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হবে না আমার...।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ---যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে---বোঝা যাচ্ছিল। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যাচ্ছিল কালো ধোয়ার কুণ্ডলী ---বহুদূরে; চট্টগ্রাম শহরে শত্রুঘাঁটির ওপর মিত্রবাহিনীর বিরামহীন বোমাবর্ষণ।

হতাশা গ্রাস করে শহিদকে। না, যুদ্ধ এত তাড়াতাড়ি শেষ হতে পারে না। এত স্বপ্ন এত প্রস্তুতি সবকিছুর ওপর যবনিকা নেমে আসবে এত দ্রুত, তা কী করে হয়! করলডেঙ্গা ঘাঁটি গড়ে তুলতে না তুলতেই গুটিয়ে ফেলতে হবে! দীর্ঘ জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে? মানতে পারে না শহিদ। গেরিলা দলের সঙ্গে চলে ক্রমাগত বৈঠক-আলোচনা। পার্টি থেকে কড়া নির্দেশ, ঘাঁটি ত্যাগ করে শহরে চলে এসো। শহিদের ভেতরে লুকোনো চে’র নিষেধ, ঘাঁটি ছেড়ো না কমরেড। বিপ্লব অসমাপ্ত রেখে কাপুরুষের মত রিট্রিট করো না। গেরিলাদের মধ্যে দেখা দেয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, দোদুল্যমানতা; গোপনে সটকে পড়তে থাকে ওরা। একসময় উপলদ্ধি করে শহিদ, হাতেগনা কজন নিয়ে ঘাঁটি আগলে রাখা সম্ভব নয়। হুঁশিয়ারিও আসে, অবিলম্বে ঘাঁটি ছেড়ে না এলে পার্টির নির্দেশ অগ্রাহ্য করার জন্য কঠোর পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।

বিধ্বস্ত শহিদ শেষ অব্দি ওর সঙ্গে-থাকা বারজন গেরিলা নিয়ে ঘাঁটি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষবারের মত ওরা এসে দাঁড়ায় সেগুন বৃক্ষে ঘেরা স্থানটিতে, যেখানে প্রতিদিন প্রত্যুষে সমবেত হত, সমস্বরে গাইতো জাতীয় সংগীত ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল---ধীরে ধীরে উঠত জাতীয় ও পার্টি-পতাকা। আজও পতাকা দুটো তোলে ওরা; শেষ বারের মত সালাম জানায়; আবেগ জড়ানো কণ্ঠে গায় গান।

শহিদ ফিরে যায় চট্টগ্রাম শহরে, দেশ শত্রুমুক্ত হবার দিন দশেক পর। পথঘাটে জনতার বিজয় উল্লাস---মুহুর্মুহু শ্লোগানে প্রকম্পিত পাহাড়ি নগরী---জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু…।

জনতার ভিড় ঠেলে শহিদ হেঁটে চলে---হেঁটে চলে উদ্দেশ্যহীনভাবেই। হঠাৎ ওর দৃষ্টি আটকে যায় ভাঙাচোরা সাইনবোর্ডের ওপর। বদরবাহিনীর জেলা-কার্যালয়। বিরাট ভবনটির দোতলায় উঠে ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে একটি কক্ষের ভেতর। শহিদের চোখ ছানাবড়া, এ কী দেখছে ও! ঘরের মধ্যে স্তূপাকারে পড়ে আছে শাড়ি, সেলোয়ার, ব্রা, পেটিকোট আর মেয়েদের জুতো-স্যান্ডেল। বোটকা গন্ধ নাকে জ্বালা ধরায়। তেলাপোকা আর ইঁদুরের নির্ভয় ছোটাছুটি। ওর আগমনে একটা চামচিকে কবার ঘুরপাক খেয়ে কোনওমতে জানালা গলিয়ে উড়ে গেল। ইঁদুরের লাদি ঘরময় ছড়ানো-ছিটোনো। গা ঘিনঘিন্ করে ওঠে শহিদের। ইসলামের ধ্বজাধারী জামাতের বদরবাহিনীর মনোরঞ্জনের কী অপূর্ব ব্যবস্থা! মালে গনিমতের সঙ্গে কোনও-কিছু করাতেই পাপ নেই কোনও---শিউরে ওঠে শহিদ! মিনতিদি কি এখানে ছিলেন? মিনতিদির খুব পছন্দের লাল-পেড়ে শাড়ি খুঁজে চলে শহিদ নিশিতে পাওয়া লোকের মতন। পায় না। মাথায় ওর খুন চেপে যায়। ওয়ালিদকে চাই-ই। কোথায় পালাবে হারামজাদা? ধরা ওকে পড়তেই হবে।

প্রতিদিনই দালাল ধরা পড়তে থাকে। বিজয়োল্লাসে মত্ত জনতা ছুঁচোগুলোকে পটাপট ধরতে থাকে পরম উৎসাহে। কিন্তু ওয়ালিদের হদিস নেই। তাজ্জব ব্যাপার, ওয়ালিদ---হাজার লোকের ভিড়েও যাকে সহজেই চেনা যায়---ধরা পড়ছে না! হাওয়া হয়ে গেল! নাকি এরই মধ্যে ধরা খেয়ে মারা পড়েছে অন্য কোথাও? শহিদ জানে না, কি জানি!


৬.

শ্যাওলা-ধরা ঘাটের ওপর আচ্ছন্নের মত বসে আছে শহিদ, দৃষ্টি ওর নিস্তরঙ্গ জলেতে নিবদ্ধ। বাতাসের বেগ বেড়েছে; ঝাড়ের বাঁশগুলো ধনুকের মত বেঁকে মাটি ছুঁয়ে আবার দাঁড়াচ্ছে মাথা তুলে। কত বছর---কত বছর পেরিয়ে গেল দেখতে দেখতেই। মনে হয় এই তো সেদিন, ছাব্বিশ বছরের যোয়ান শহিদ, পিঠে পনেরো সের গোলাবারুদ, দু-কাঁধে অস্ত্র বয়ে পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথ ধরে দেশে ঢুকছে। সাব্রুম বর্ডার থেকে দীর্ঘপথে শুধু অরণ্য-পর্বত। লোকালয়ের দেখা মেলে নানুপুর পৌঁছে। নানুপুর থেকে কেলিশহর, তা-ও অনেক পথ। লোকালয়ের ভেতর দিয়ে দিনের বেলায় চলাচলে জীবনের ঝুঁকি, স্থানে-স্থানে আর্মিক্যাম্প ---দালালের আস্তানা। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু---সুর্য উঠবার আগেই কোনও নির্ধারিত বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া। বহুবছর পর সেদিনগুলোর কথা মনে পড়লে কেমন জানি হয়ে পড়ে শহিদ। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল জীবন! বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ শহিদ জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ায়---পায় না। স্বপ্ন দেখত একসময়---এখন দেখে না। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সমাজতন্ত্র-শ্রেণিসংগ্রাম---একসময়কার অতিপ্রিয় শব্দগুলো হৃদয়ের তন্ত্রীতে আর তেমন তরঙ্গ তোলে না। চে শুয়ে আছে স্বচ্ছ কফিনে ফ্যাকাসে কী-যেন একটা!

স্বপ্নভঙ্গের চেয়ে বেশি শোক আর কিছুতে কি আছে? সবকিছু কেমন পাল্টে গেল, পাল্টেই যাচ্ছে অনবরত। অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতা---সমাজ গোল্লায় যাক্! বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার-অর্থনীতি---লুটেরাদের শেখানো সংগীতে কন্ঠ মিলিয়ে উদ্বাহু নৃত্যরত দেশের অনুগত শাসকের দল।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নির্বাসন সেই কবে! ক্ষমতার লোভে চেতনাকে বলি দিতে কাঁপে না কারও বুক! ধর্ম আর অন্তঃসারশূন্য কিছু ফাঁকাবুলির আফিম খাইয়ে যুদ্ধে-জেতা বীর জাতিটাকে কেমন পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে চলেছে কিছু বদমাশ! ঘৃণায় মুখ কুঁচকে একদলা থুথু ফেলে শহিদ। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে---মাসিমা দাঁড়িয়ে আছেন সামনেই, কেমন এক অভিব্যক্তি ওঁর সারা মুখে।

- শুনেছিলাম ওয়ালিদ পাকসেনাদের নিয়ে এসে দিদিকে তুলে নিয়ে যায়। সাধনদা-ই বলেছিলেন---দিদিকে পাওয়া গেছিলো পরে? শুধোয় শহিদ।

সেই একই রকম ফাঁপা ফাঁপা শব্দ : হ, দশদিন বাদে মিনতি ফিরি আইস্যেল। নিশি রাইতত্ মিনতিরে ওই গাছত্ ঝুলি থাকিত দেখা গেইয়ে।

- সাধনদা কোথায়?

শহিদের প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না।

- অলিদ্যার দেখা পাইঅ না? দেশ স্বাধীনর পরঅ ন পঅ তারে?

শহিদ নিরুত্তর। কী বলবে মাসিমাকে, কী বলবে সে!

এইতো সেদিন ঢাকা বাণিজ্যমেলায় গিয়েছিল। বিশাল এলাকা জুড়ে মেলা---সারি সারি জমকালো স্টল, ঝলমলে আলোর বন্যা। উদ্দেশ্যবিহীন আনমনা একাকী সে হাঁটছিল মেলাচত্বরে। ধুলোমাখা ছেড়া স্যান্ডেল আর মলিন পোশাকে ওই পরিবেশে বড়ই বেমানান শহিদ হাঁটছিল সময় কাটানোর জন্য---ঘরে ফিরে সমস্যার মুখোমুখি হওয়া থেকে যতক্ষণ দূরে থাকা যায়...। হঠাৎই দামি পোশাক-পরা দীর্ঘদেহী এক সুপুরুষ হাত বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে, বলে: কেমন আছেন? চিনতে পারছেন না বুঝি আমাকে...?

লোকটির বাড়িয়ে-দেওয়া হাত স্পর্শ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত থমকে যায় শহিদ। ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ঘোলা চোখেও চিনতে অসুবিধা হয় না, প্রসারিত হাতে সম্মুখে দাঁড়ানো লোকটি আর কেউ নয়---ওয়ালিদ! ঘোলা চোখে আগুন জ্বালাতে চায়---পারে না; শিরা-জেগে-ওঠা হাতে আতিপাতি খোঁজে যেন কি---পায় না; কেবল মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটো শক্ত হয় বারবার; দুর্বল দাঁতের ঘষায় চোয়ালের হাড় ফুলে ওঠে---অধোমুখে হনহন্ হেঁটে মেলা থেকে বেরিয়ে আসে শহিদ।


- কী হইয়ে, অলিদরে ন পঅ আইজো? মাসিমার কণ্ঠ।

হিজল গাছটির দিকে তাকায় শহিদ, এতক্ষণ ফোঁপাতে-থাকা মিনতিদি তো নেই বসে গাছতলায়, কী আশ্চর্য, গেল কোথায়? গাছের ডালে ওটা কী ঝুলে আছে?

শরীরের রক্ত ওর হিম হয়ে আসে।

ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ফোটে মাসিমার---ঠোঁট নড়ে; কথাগুলো মনে হয় দূর-থেকে ভেসে-আসা কাঁপা কাঁপা প্রতিধ্বনি: ডরাইঅ না? মিনতি কান্দে... কান্দে, তারপর গাছত্ ঝুলি থায়। আঁ’ই ইয়ানদি আরা রাইত গুরাগুরি গরি, বেয়াইন্যা অইবার আগ দিআরে আঁ’র চিতাত্ ফিরি যাই---মিনতিঅঁ যায়। ব্যাকগুনরে চিতাত্ নয় কব্বরত্ য’ন পড়িব। তুঁ’ইঅ বউত বুড়া অইঅ---যুদ্ধর বছরত্ কী তত্তাজা আছিলা, ---এয়া আঁ’র বয়সি। তোঁ’আর বয়সত্ আঁ’ই চিতাত্ উট্টিলাম---আঁ’র বয়স আর বাড়িত্ ন পারইল...।


পারদের মত নিস্তরঙ্গ পানি; পুরনো চাঁদ গা-বিছিয়ে শুয়ে আছে, ডিসেকটিং টেবিলে যেমনটি শুয়ে থাকে নিস্পন্দ শব---ব্যবচ্ছেদের অপেক্ষায়!


ঝপাং শব্দ ওঠে দিঘির জলে, উঠেই মিলিয়ে যায়।




লেখক পরিচিতি
শামসুজ্জামান হীরা

মুক্তিযোদ্ধা।
গল্পকার। প্রবন্ধকার।
প্রকাশিত দুটি গল্পগ্রন্থ-- ‘দিঘির জলে পুরনো চাঁদের শব’ ও ‘কানাগলিতে কানামাছি’।
সম্পাদিত বই অরুণ সোম কর্তৃক অনূদিত নিকোলাই গোগলের ‘ওভারকোট’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ